[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১০. কী করছ এখন

–কী করছ এখন?

–কিছুনা।

–যে অবস্থায় আছো, সোজা আমার ঘরে চলে এসো।

–কেন, কেন?

–এসোই না। মজা দেখতে পাবে, এসো—

রজার আমারই বাড়ির তিনতলায় থাকে। হঠাৎ টেলিফোন। কৌতূহলী হয়ে ছুটে গেলাম। বাইরে থেকেই শুনতে পেলাম, ঘর গমগম করছে। বহু লোক। দরজা ঠুকঠুক করেছি, রজার হাস্যমুখে উঁকি দিয়ে বলল, এসো, পার্টি হচ্ছে। টেড আর জুলির জন্য পার্টি।

টেড আর জুলি? শুনে আমার মূর্তি হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অতি কষ্টে ঘরে ঢুকে দেখি সারাঘর জুড়ে নাচ চলছে, টেড আর জুলিও উপস্থিত। টেড আর জুলি ছিল সমস্ত অলস মুহূর্তের মুখরোচক উপাদান। কোথাও টেড বসে থাকলে, জুলি দূর থেকে আসতে-আসতে ওকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে চলে যাবে। আর কোথাও জুলিকে দেখলেই টেড চলে যাওয়ার আগে যা বিড়বিড় করবে, সেটা নিশ্চিত কোনও গালাগালি। কোনও বন্ধুর বাড়িতে টেড আসবার আগে টেলিফোন করে জেনে নেবে, সেখানে জুলি আছে কি না। আর একবার সিনেমা হলের মধ্যে কোণে টেডকে দেখে জুলি পুরো বই না দেখেই উঠে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুজনের মুখ দুজনের কাছে আগুন লাগা, ওদের নাম পরস্পরের কানের বিষ। টেড আর জুলি স্বামী-স্ত্রী।

ওরকম স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া তো কতই দেখেছি। কিন্তু বাইরে বাইরে সুখ দেখানোই তো পশ্চিমি সভ্যতা। পরস্পর বাহুবন্ধনে প্রকাশ্যে হাঁটা, মোটর গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ‘এসো ডার্লিং’ বলা, এবং লোক দেখিয়ে অকারণে টেলিফোন করে স্বামী বা স্ত্রীর স্বাস্থ্য বা মুড সম্পর্কে উদ্বিগ্নতা দেখানো–এইসব তো স্বামী-স্ত্রীর সাজানো ধরন, কেউ জানবে না ওদের মনের মধ্যে আছে সুধা না গরল। কিন্তু টেড আর জুলি নিয়ম-না-মানা প্রকাশ্যে সাপ আর নেউল। ওরা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছে–তার আগে দুজনে আলাদা থাকবে চুপচাপ, পরস্পর দেখা হলে ভদ্রতার হাসি হাসবে–এই তো নিয়ম। কিন্তু ওদের দুজনের কী কী দোষ–আমরা ওদের মুখ থেকেই জেনে গেছি। টেডের বিষম নাক ডাকে ঘুমের মধ্যে, জুলির হাতে নাকি রোজ আট দশটা গেলাস-কাপ ভাঙে, টেড রাত দুপুরে উঠে কফি খেতে চায় এমন পাজি, আর জুলি তার পোষা বেড়ালটাকে সঙ্গে নিয়ে শোবেই, টেড একবেলাও রান্না করতে চায় না আর জুলিটা এমন বিশ্রী যে, উদয়াস্ত টেলিভিশনের সামনে না বসলে চলবে না। এই সমস্ত মহৎ দোষ যখন ওদের আছে, তখন দীর্ঘকাল স্বামী-স্ত্রী হিসেবে থাকা নিশ্চয়ই অসম্ভব।

আড়াই বছর আগে টেড আর জুলি কেউ কারুকে চিনত না। দুজনে দুদিক থেকে গাড়ি চালিয়ে আসছিল ৭৮নং হাইওয়ে দিয়ে। মুখোমুখি ধাক্কা। পুলিশ ইনসিওরেন্সের লোক, মোটর সারাবার কোম্পানি ইত্যাদি ঝামেলা চুকলে দেখা গেল, টেড-এর গাড়িটার কিছুই হয়নি, কিন্তু ওর ডান কবজিটা মচকে গেছে, আর জুলির গাড়িটা একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে, কিন্তু শরীরে আচড়টি পড়েনি। তখন টেড জুলিকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাইল নিজের গাড়িতে–ওর হাত ভাঙা বলে গাড়িটা অবশ্য জুলিই চালাল। সেই প্রথম দেখা। আড়াই দিনের মধ্যে গভীর প্রেম। এক মাসের মধ্যে বিয়ে। শুনেছিলুম, টেড আর জুলির মতো দুরন্ত, উচ্ছল, খুশি দম্পতি বহুদিন কেউ এ শহরে দেখেনি। এক বছর পরেই ঝগড়া, এমন প্রকাশ্যে ঝগড়াও বহুদিন দেখা যায়নি এখানে। আমি আসার পর ঝগড়ার পালাই দেখছি। শুনেছি, ওদের বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা উঠেছে। কেন এই খামখেয়ালি মিলন, যার ফলে এমন কটু বিচ্ছেদ?

সপ্তাহ খানেকের জন্য শিকাগো গিয়েছিলাম, মাত্র সেদিনই ফিরেছি, তারপরেই রজারের ডাক। সেদিনের পার্টি রজারই ডেকেছে, উপলক্ষ টেড আর জুলির সেদিনই বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। দুজনেরই সমান বন্ধু হিসেবে রজার আজ উৎসব করতে চায়।

এই প্রথম আমি এক আসরে টেড আর জুলি দুজনকেই দেখতে পেলাম। কিন্তু এ কোন টেড আর জুলি? দুজনের মুখে সামান্য গ্লানির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। হো-হো করে হাসছে, হাত ধরাধরি করে। টেডের মুখ থেকে জ্বলন্ত সিগারেট কেড়ে নিয়ে টানতে আরম্ভ করেছে জুলি। নাচের বাজনা থেমে যেতেই টেড চেঁচিয়ে বলল, এই জুলি, রেকর্ডটা বদলে এবার একটা রে চার্লসের দাও। রে চার্লসের কোনটা বলো তো? যেটা আমার সবচেয়ে প্রিয় বাধা দিয়ে হাসতে জুলি বলল, জানি, জানি।

–না, দেখি মনে আছে কি না। বলো তো কোনটা?

–বলব না।

হাসতে-হাসতে জুলি রেডিওগ্রামের কাছে গিয়ে রে চার্লসের একটা রেকর্ড দিতেই টেডের মুখে ঈপ্সিত হাসি আর ঘরময় অট্টহাস্য। টেড বলল, জুলি, এটাও আমি তোমার সঙ্গে নাচব! জুলি ঘাড় বেঁকিয়ে সহাস্য মুখে বলল, ইস, মোটেই না। লজ্জা করে না। টেড ছুটে এসে জুলির হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে লাগল, আর কৃত্রিম বাধা দেওয়ার চেষ্টায় জুলির মুখে হাসি মেশানো রাগ।

আমি ঘরের এক কোণে চেয়ার নিয়ে বসেছিলুম। নাচতে জানি না কিন্তু দেখতে ভালো লাগে। কী সরব উল্লাসময় আজ এই ঘরের হাওয়া। বর্তমান আইন অনুযায়ী টেড আর জুলি স্বামী-স্ত্রী ছিল, একটি দিনের জন্যও একসঙ্গে হলে ওদের দুজনের হাসি দেখিনি। আজ ওরা আর স্বামী-স্ত্রী নয় বলেই ওদের ব্যবহার সত্যিকারের সুখী দম্পতির মতো। কোথাও কোনও গ্লানি নেই। টেড কিরকম অম্লান বদনে জুলির হাত ব্যাগ খুলে সিগারেট প্যাকেট বার করে দিচ্ছে! নিজের বউয়ের হাত-ব্যাগ খুলতেও স্বামীদের এদেশে অনুমতি নিতে হয়, আর আজ ওদের এতই ঘনিষ্ঠতা সে এসব নিয়মও গ্রাহ্য করছে না।

অনেকক্ষণ লক্ষ করার পর বুঝতে পারলুম, টেডের পাশে আর একটা মেয়ে সব সময় ঘনিষ্ঠ থাকার চেষ্টা করছে, তার নাম সেরা। জুলির মতো এক রকমই সুন্দরী। আর জুলির পাশেও আর একটা ছেলে বেশি ঘনিষ্ঠ, ওর নাম পিটার। পিটারকে আমি চিনি, বেশ সরল বেপরোয়া ধরনের ছেলে, গ্রিকদের মতো মুখ। টেড আর জুলির মধ্যে যে ঝগড়া–তার জন্য কোনও তৃতীয় নারী বা পুরুষ দায়ী ছিল না–আমরা বেশ ভালোভাবেই জানতুম। বিচ্ছেদ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ওদের দুজনের আলাদা বন্ধু জুটে গেছে। টেড একবার পিটারের কাঁধ চাপড়ে বলল ব্রেভ বয়! গো আহেড! মাইরি বলছি, জুলির মতো এরকম ভালো মেয়ে আর নেই। জুলিও এক ফাঁকে সেরাকে বলল, এই মুখপুড়ি, তুই টেডকে বিয়ে করবি নাকি?

সেরা বলল, ধ্যেৎ!

আহা লজ্জা কীসের। শোন তোকে কয়েকটা ব্যাপার শিখিয়ে দি ওর সম্বন্ধে!–জুলি সেরার কানে কানে কী যেন বলতে লাগল।

আমি ভাবতে লাগলুম, টেডের সঙ্গে সেরার কিংবা জুলির সঙ্গে পিটারের আলাপ কতদিনের? আবার আড়াই দিন নাকি? আমি সেরাকে ডেকে একবার বললুম, জুলি, তোমার দেশলাইটা একটু দাও তো! সে হি-হি করে হেসে বলল, কী ভুল তোমার! এখনও নাম মনে রাখতে পারো না? আমি জুলি নই, আমি সেরা।

আমি বললুম, ও হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই তো!

খানিকটা বাদে একে একে সকলের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় পিটারকে বললুম, চলি টেড। আবার দেখা হবে!

পিটার বলল, এই, তুমি বুঝি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ? আমার নাম টেড নয়, তুমি ভালো করেই জানো আমি পিটার।

আমি হেসে বললুম ওই একই হল। নামে কি এসে যায়?