[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০১. গ্রামের রাস্তায় একটি বাঙালির ছেলে

গ্রামের রাস্তায় একটি বাঙালির ছেলে ঘুরছে। হয়তো তার খুব একা-একা লাগছে। কারুর সঙ্গে বসে দু-দণ্ড প্রাণের কথা বললে প্রাণটা খোলামেলা লাগত। বিখ্যাত রোমের ভগ্নাবশেষের পাশ দিয়ে হাঁটছে দুজন ভারতীয়। বাঙালির ছেলেটি ওদের দেখে উৎসাহিত হল। কিন্তু তখুনি ছুটে গিয়ে কথা বলতে পারল না। আগে দেখা যাক, ওরা কোথাকার লোক। বাঙালি ছেলেটি তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে ওদের কাছাকাছি গিয়ে পিছন-পিছন হাঁটতে লাগল। মুখের ভাব এমন, যেন সে দুজনকে দেখতেই পায়নি। আসলে ছেলেটি কান খাড়া করে শুনছে, ওরা কী ভাষায় কথা বলছে। যদি বাংলায় হয়, তা হলেই একমাত্র সান্ত্বনা। তৎক্ষণাৎ তবে ডেকে বলা যায়, কী দাদা আপনারা কবে এলেন? এখন কোথায় চললেন? চলুন না একসঙ্গে যাওয়া যাক।

কিন্তু, ছেলেটি অনেক দূর অনসুরণ করার পর তবে বুঝতে পারল–ওরা কী যেন এক দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছে। হিন্দিও নয়, মারাঠি বা গুজরাতি, ছেলেটি যার এক বর্ণও জানে না। নিরাশ হয়ে গেল ছেলেটি। তা হলে আর ডেকে লাভ কী, একটাও তো প্রাণের কথা বলা যাবে না। সেই কথা বলতে হবে মুখে ফেনা-ওঠা ইংরেজিতে। ছেলেটি এমনভাবে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল–যাতে ওদের সঙ্গে চোখাচোখি না হয়। ওরা দুজনেও বোধ হয় ছেলেটিকে দেখেছিল, দেখে চিনেছিল বোধ হয় বাঙালি বলে, বাঙালিদের নাকি দেখলেই চেনা যায়, এরাও ডেকে কথা বলেনি। একই দেশের তিনজন মানুষ, দূর বিদেশে এসে কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলল না।

গ্লাসগোতে থাকে শীলা ভট্টাচার্যে। প্রত্যেকদিন সকালে চিঠির বাক্সের কাছে দৌড়ে যায়, যদি চিঠি বা ‘দেশ’ আসে তবু যা হোক খানিকক্ষণ বাংলা ভাষার জগতে থাকা যাবে নইলে যে শুধু নিজের সঙ্গেই কথা বলতে হয়। ইংরেজি আর ইংরেজি আর ইংরেজি, আর পারা যায় না। ল্যান্ডলেডি খুব ভালো, পাড়া প্রতিবেশী খুব ভালো, কলেজে চমৎকার পরিবেশ। কোথাও কোনও অসুবিধে নেই, একমাত্র শুধু প্রাণ খুলে কথা বলতে না পারার কষ্ট। একদিন ল্যান্ডলেডির মেয়ে লিনডা এসে বলল, শীলা, আজ সন্ধেবেলা আমার সঙ্গে একটা পার্টিতে যাবে।

–না ভাই, আজ আমার সন্ধেবেলা অনেক কাজ।

–আহা, চলো না, প্রত্যেক দিনই তো ঘরে বসে-বসে পড়াশোনা করছ। তা বলে শুক্কুরবারটা নষ্ট করবে?

–না ভাই, আজ বাদ দাও। গত সপ্তাহে আমার সর্দি হয়ে তিনদিন নষ্ট হল। আজ একটু মেকআপ করে নিতে হবে।

আসলে শীলার যে ইচ্ছা নেই, তা তো নয়। কিন্তু একে সারা সপ্তাহ একটাও চিঠি আসেনি বলে মন খারাপ, তার ওপর পার্টিতে গেলে শুধু যে ইংরেজি কথাবার্তা তা তো নয়। বিলিতি কায়দায় হাসতে হবে, হাঁটতেও হবে বিলিতি চালে! থাক বাবা, দরকার নেই! লিনডা তবু জোর করে বলল, চলো-চলো, আজ বনির ওখানে একটি নতুন ইন্ডিয়ান ছাত্রও আসবে। ইউ ওনট ফিল লোনলি।

নতুন ভারতীয় ছেলে? যদি বাঙালি হয়। শীলা ভট্টাচার্য তখনি রাজি হয়ে গেল। শীতকালে যদি বৃষ্টি হয়, তখুনি রাজ্যের মন খারাপ হয়। তখন ভালো লাগে না বিদেশে একা থাকতে। যে কোনও কথা, আজবাজে কথা, কিন্তু বাংলায় বলার জন্য একজন সঙ্গী পেতে ইচ্ছে করে।

কলেজের ছেলেমেয়েদের পার্টি, খুব হইহল্লা চলছে। তিনটে ঘর জুড়ে হুল্লোড়। নাচ শুরু হয়ে গিয়েছে, সেই সঙ্গে পানীয়। প্রথম ঘরে কোনও ভারতীয় নেই। দ্বিতীয় ঘরের কোণের দিকে একজন ভারতীয় পানীয় নিয়ে চুপ করে বসে আসে। ছেলেটিও যে শীলাকে দেখে উৎসাহে দপ করে উঠল। কাছে এগিয়ে এসে আলাপ হল। শীলা তুমি একে চেনো? লেট মি ইনট্রোডুশ মিস ভট…ভটাচারিয়া, মিঃ আয়েংগ্যার। আয়েংগ্যার? ভট্টাচার্যি? সঙ্গে-সঙ্গে দুজনের উৎসাহ নিভে গেল। ভারতীয় হয়েও ওরা রইল বিদেশি। শুকনো নমস্কার সেরে দুজনে দুদিকে চলে গেল। যদি ইংরেজিতেই কথা বলতে হতে হয়, তবে খাঁটি ইংরেজিতে বলা ভালো।

সানফ্রানসিসকোর ভারতীয় দূতাবাসে এসেছে একটি ভারতীয় ছেলে। ওর পাসপোর্টে মেক্সিকো যাওয়ার এনডোর্সমেন্ট করিয়ে নিতে। ধরা যাক ছেলেটির নাম অমুক মুখোপাধ্যায়। অফিস প্রায় খালি, ভারপ্রাপ্ত ভারতীয় কর্মচারীটি আমেরিকান মেয়ে টাইপিস্টদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। আমাদের অমুক মুখোপাধ্যায় সানফ্রানসিসকোতে নতুন এসেছে কারুকে চেনে না। ভেবেছিল নিজের দূতাবাসে এসে চেনা পরিবেশ পাবে, নিজের কাজ ছাড়াও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করতে পারবে। কর্মচারীটি মুখে কেজো গম্ভীর ভঙ্গি ফুটিয়ে জিগ্যেস করল, ইয়েস, হোয়াট ক্যান আই ডু ফর য়ু?

ছেলেটি বিনীতভাবে নিজের দরকারের কথা নিবেদন করল।

–দেখি পাসপোর্ট? বলার স্বর এমন যেন ছেলেটি ওঁর ভৃত্য কিংবা চাকরির জন্য ইনটারভিউ দিতে এসেছে।

পাসপোর্ট হাতে নিয়ে উলটে-পালটে দেখতে-দেখতে লোকটি বললেন ইংরেজিতেই, পাশের মেয়েটিকে শুনিয়ে, কীনাম? মু-খো-পা-ড্যি-য়া-য়? জি! প্রিটি লং নেম!

আমাদের চেনা ছেলেটি এবার রেগে গেল। বক্র হেসে বলল, আর তোমার নামটা কী শুনি? নিজলিঙ্গাপ্পা না ভেঙ্গটেশ্বরম? বাঁদর কোথাকার!

আমেরিকান মেয়েটি অবাক! বিদেশে দেখা দুজন ভারতীয়ের এই প্রথম সম্ভাষণ! বিদেশেও ভারতীয় মাত্রই ভারতীয়ের স্বদেশবাসী নয়। দুজন ভারতীয়ও পরস্পর নিজেদের কাছে বিদেশি। ভারতীয় হলেই চলবে না। তোমার আর আমার কি এক প্রদেশ? ভাষা কি এক? নইলে যাও, কোনও বন্ধুত্ব নেই। পাশাপাশি হয়তো থাকে এক বাঙালি আর এক মারাঠি। দুজনেই বেশ ভদ্র ও মার্জিত। তবু পুরো বন্ধুত্ব হয় না, প্রাণ খুলে কথা হয় না। দুজনের সমস্যা হয়তো দুধরনের। বাঙালি ছেলেটি ভাবছে ইস, কতদিন টাটকা মাছ খাইনি! এ এন্ড পি-তে টাটকা মাছ এসেছে কি না একবার খোঁজ করতে গেলে হয় না? মারাঠি ছেলেটির মাছের নামেই বমি আসে! তার দুঃখ, কতদিন তেঁতুলের আচার খায়নি! নিউ ইয়র্ক থেকে কয়েকখানা পাঁপড় এবার লিখে আনতেই হবে।

প্যারিসে কোনও বাঙালি শিল্পীর বাড়িতে হয়তো চার-পাঁচজন বাঙালি বসে রবিবার সকালবেলা আড্ডা দিচ্ছে। ওরা প্ল্যান করছে আগামী রবিবার ওরা ভার্সাইয়ে গিয়ে সারাদিন থাকবে। এমন সময় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার যোগীন্দার সিং এসে হাজির হতেই ওরা চুপ করে গেল। এখন আর ও আলোচনা থাক, অন্য কথা হোক। কে কতটা ফরাসি শিখেছে তাই নিয়ে হাসিঠাট্টা চলুক বরং। কারণ, এখন ওর সামনে রবিবারের পিকনিকের প্ল্যান করলে, ওকেও যেতে বলতে হয়। আর, যোগীন্দার গেলে কি প্রাণ খুলে বাংলা বলা যাবে! ওর সঙ্গে কথা বলতে হবেই ইংরেজিতে, ও যে একটা বর্ণ বাংলা বোঝে না। তা ছাড়া শুনতে হবে ওর হিন্দি!

আবার এক প্রদেশের বলেই যে সব সময় বন্ধু হবে তার কোনও মানে নেই। বার্লিনে রঞ্জনা বোসের সঙ্গে দেখা হল শান্তা রায়চৌধুরীর। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন শান্তা! রঞ্জনাকে বললেন, আপনি কোন পাড়ায় থাকেন বলুন! আমিও সেখানে উঠে যাব। উঃ, বাংলা কথা না বলে হাঁপ ধরে যাচ্ছে! খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে রঞ্জনা বললেন ইংরেজিতে, আমি বাঙালি হলেও বেশিরভাগ থেকেছি বাংলাদেশের বাইরে, পড়েছি সাহেবি স্কুলে, বাবা-মা আমাকে বাংলা শেখায়নি। কী লজ্জা যে হয় সেজন্য! রঞ্জনা বসুর সঙ্গে শান্তা রায়চৌধুরীর বন্ধুত্ব হল না। শান্তা বাড়িতে চিঠি লিখলেন–এখানে একটি বাঙালি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হল। কী দেমাকি মেয়ে বাবা! দেখলে গা জ্বলে যায়!

ল্যান্ডলেডি সদাশিব রাওকে বললেন, তোমাকে ঘর দিচ্ছি বটে, কিন্তু সাবধানে থাকতে হবে বলে দিচ্ছি! আমি জানি, তোমরা ইন্ডিয়ানরা বড্ড নোংরা হও!

–কী করে জানলে?

–আগে যে আমার বাড়িতে একজন ইন্ডিয়ান ছিল। নোংরার হদ্দ!

–কী নাম তার?

–পডমা…পল…ওঃ এই লেখা আছে, পদ্মনাভ বড়ুয়া।

–ওঃ, অসমীয়া কিংবা বাঙালি! তা ওর জন্য তুমি আগে থেকেই আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন?

–কেন? ও কি ইন্ডিয়ান নয়? তোমার দেশের লোক নয়?

থতোমতো খেয়ে চুপ করে গেলেন সদাশিব। না, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আসাম কিংবা বাংলা ভারতবর্ষেই, ওই লোকটি পদ্মনাভ বড়ুয়া তারই স্বজাতি। কিন্তু সদাশিব রাও কোনওদিন আসাম যাননি, জানেন না সেখানকার ভাষা, জানেন না আসামের লোকের খাদ্য কী, আচার ব্যবহার কী। আসাম কিংবা কাশ্মীর কিংবা উড়িষ্যার কোনও ছেলেকে দেখলে তাকে বিদেশির মতোই প্রায় ব্যবহার করতে হবে। আর কলকাতার ছেলেগুলো তো অতি পাজি হয়! ইংরেজিতে বাক্যালাপ, মামুলি সম্ভাষণ। কিন্তু ল্যান্ডলেডির কাছে অস্বীকার করবেন কী করে যে, হ্যাঁ, লোকটি আমারই স্বজাতি ভারতীয়, বিদেশে ওর সুনাম ও দুর্নামের আমিও সমান অংশীদার।