[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১১. যে বাড়িতে বসে আমি চা খাচ্ছি

যে বাড়িতে বসে আমি চা খাচ্ছি, গত বছর সে বাড়ির অর্ধেক বন্যায় ডুবে ছিল। বাড়ির মালিক মোসলেম আলি, সচ্ছল, মধ্যবিত্ত, শিক্ষকতাও করেন। বাড়ির একটি অংশ পাকা, ঢালাই করা ছাদ, অন্য অংশে টিনের চাল। এ বাড়ির একটি কিশোর আমাকে শোনাচ্ছিল গতবারের অভিজ্ঞতার কথা। উনিশ-কুড়ি দিন বাড়ির সবাই মিলে ছাদের ওপর বাস করেছিল। আমি জিগ্যেস করলাম, সারা দিন-রাত ছাদে? বৃষ্টির সময় কী করতে?

ছেলেটি বলল, পাশের টিনের চালের তলায় মাচা বাঁধা হয়েছিল, সেখানে ঢুকে যেতাম। আর খাবার জল পেতে কোথায়? মাঝে-মাঝে একজন কেউ নেমে গিয়ে দূরের কোনও জেগে-থাকা টিউবওয়েল থেকে নিয়ে আসত। ছেলেটি পানি বলে না, আমার সামনে জলই বলতে লাগল বারবার। তার গলায় দুঃখের সুর নেই, এই বয়েসে কিছুদিনের জন্য সবাই মিলে ছাদের ওপরে থাকা, সেখানেই রান্না-খাওয়া অভিনব অভিজ্ঞতার মতন। সে বলল, আমাদের চেয়েও, যাদের মাটির বাড়ি তাদের কষ্ট হয়েছে বেশি।

যাদের মাটির বাড়ি বন্যায় গলে যায়, তারা অনেকে গাছের ওপর উঠে বসে থাকে। মানুষ কী করে দিনের পর দিন গাছের ওপর বাস করে, ঘুমোবার সময় পড়ে যায় কি না, এ ব্যাপারে আমার মনে একটু খটকা ছিল! সাত লক্ষ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা গাছেই বাস করত, সেই স্মৃতি কি জিন-বাহিত হয়ে এখনও আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে? না, তা নয়। মাটির বাড়ির লোকেরা জল ধেয়ে আসার আগেই গাছের ওপর মাচা বেঁধে নেয়। মাঝে-মাঝে টুপটাপ করে দু-একটি শিশু জলে পড়েও যায়।

গ্রামের নাম পঞ্চানন্দপুর, মালদা শহর থেকে চব্বিশ-পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। এ গ্রামের কাছেই গঙ্গা। আটানব্বই সালে এই অঞ্চলের বহু গ্রাম বানের জলে ডুবে গিয়েছিল। কয়েকটি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এ বছর বর্ষা শুরু হবে আর সাত দিনের মধ্যেই। সকলের চোখে-মুখে আবার বন্যার আশঙ্কা।

বন্যা আমি কম দেখিনি। ছেলেবেলায় পূর্ববঙ্গে তো প্রতি বছর বন্যা হত। আমাদের বসতবাড়ি অবশ্য কখনও ডুবে যায়নি। তবে বন্ধুদের বাড়িতে খেলা করতে যেতে হলে সাঁতরে যেতে হত। ভিজে পোশাক গায়ে নিয়ে তো আর খেলা যায় না, তাই একটা ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে ইজের আর গেঞ্জি খুলে নিয়ে এক হাত উঁচু করে আর এক হাতে সাঁতরে যেতাম, ওপারের ডাঙায় উঠে আবার পরে নিতাম সেগুলো।

উনিশশো আটাত্তর সালের ভয়াবহ বন্যায় যখন কলকাতা ছিল জলবন্দি, হাওড়া-হুগলি মুর্শিদাবাদের গ্রাম ছিল জলের তলায়, বম্বে রোডের মতো হাইওয়ে দিয়েও নৌকো চলেছিল, সেবারে নৌকোয় চেপে গিয়েছিলাম হাওড়ার গ্রাম দেখতে, মুর্শিদাবাদে গিয়েছিলাম আর্মির হেলিকপ্টারে। তবে বন্যায় কোনও বাড়িতে বসে আমি আগে চা খাইনি।

শুধু চা নয়, সঙ্গে মুখরোচক নাস্তা ও মালদার বিখ্যাত আম খেয়ে আমরা একটি দল বেরিয়ে পড়লাম গঙ্গার উদ্দেশে। নৌকোয় চেপে ভাঙন ও ধ্বংসচিহ্ন দেখতে যাওয়া হবে।

এই দলে আমি যোগ দিলাম কী করে? আমাকে খবরের কাগজ থেকে রিপোর্ট করতে পাঠানো হয়নি, এ ধরনের রিপোর্টিংয়ের বয়স আমি পেরিয়ে গেছি, পরবর্তী অগণন তরুণেরা এসেছে সুন্দর-ত্রুদ্ধ মুখে, এসব এখন তাদেরই কাজ। আমার এখানে আগমন অনেকটাই আকস্মিক।

কয়েকদিন আগে বিড়লা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিকাল মিউজিয়ামের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক শ্রী সমর বাগচী টেলিফোনে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি অরুন্ধতী রায়ের লেখাটা পড়েছেন?

সমরবাবুর সঙ্গে আগে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না, টেলিফোনে সেই প্রথম আলাপ। মাত্র দুদিন আগে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকে অরুন্ধতী রায়ের নর্মদা-আন্দোলন, সেই প্রসঙ্গে ভারতের সমস্ত নদী-বাঁধ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প সংক্রান্ত অমানবিক কর্মকাণ্ড, ব্যর্থতা, সরকারি ও আন্তর্জাতিক জুয়াচুরি নিয়ে লেখাঁটি পড়ে আমি অভিভূত হয়ে আছি। প্রচুর পরিশ্রম, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও গবেষণার সমন্বয়ে লেখা এই রচনাটি মর্মস্পশী কিন্তু আবেগের বাহুল্য নেই, তথ্যবহুল অথচ সুখপাঠ্য। এই আধা-বাঙালি তরুণীটি একটি মাত্র উপন্যাস লিখেছেন, ‘গড অব স্মল থিংস’, সেটি পড়ে আমার ভালোই লেগেছিল, যদিও আহামরি কিছু নয়, কিন্তু পরিবেশ সংক্রান্ত এই সুদীর্ঘ প্রতিবেদনটি যেন অনেক বেশি সার্থক।

সমরবাবুর সঙ্গে এ বিষয়ে একটু আলোচনার পরেই তিনি বললেন, আমাদের পশ্চিম বাংলাতেও তো ফারাক্কা ব্যারেজ নিয়ে অনেক সমস্যা দেখা দিয়েছে, মালদহে এবারেও গত বছরের মতন বন্যা হতে পারে, মালদহে ও মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরে গঙ্গার ভাঙনে এই নদীর সম্পূর্ণ গতি পরিবর্তনেরও সম্ভাবনা, এইসব নিয়ে কি বাঙালি লেখকরা কিছু লিখতে পারেন না?

আমি খানিকটা চুপসে গেলাম। এক-একজনের লেখার ধরন এক এক রকম। বিষয়বস্তু নির্দিষ্ট করে, কোথাও গিয়ে, দেখেশুনে, লোকজনের সঙ্গে কথা বলে কিছু লেখার অভ্যেস আমার নেই, অচেনা লোকদের সঙ্গে আমি সহজ ভাবে মিশতে পারি না, কথা বলতেও পারি না। আমার ঝোঁক ইতিহাসের দিকে। সমরবাবুর প্রশ্নের উত্তরে আমি লজ্জা পেয়ে মিনমিন করে বললাম, ওই সব ব্যাপারে আমার তো কোনও অভিজ্ঞতা নেই, বিশেষ কিছু জানি না..। সমরবাবু বললেন, চার তারিখে আমরা একটা দল মালদা যাচ্ছি সবকিছু দেখতে, যাবেন আমাদের সঙ্গে? এমনিতে আমার হাতে এখন অনেক কাজ, অনেক কমিটমেন্ট, তা ছাড়া শারদীয়া সংখ্যায় লেখার প্রস্তুতিও তো নিতে হবে, তবু সেসব চিন্তা না করে হঠাৎ বলে ফেললাম, ঠিক আছে, যাব! কোন দল, কাদের দলের সঙ্গে, তা কিছুই জিগ্যেস করিনি।

মোসলেম আলির বাড়ির কাছেই গঙ্গা, কাছেই মানে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটা পথ। ৫ জুনের অসহ্য গরম একটা দিন, স্লেট রঙের আকাশ, ঠা-ঠা রোদ, একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। আমার কোনওদিনই ছাতা ব্যবহারের অভ্যেস নেই, এখানে একজন জোর করে আমায় একটা ছাতা দিয়েছেন, টের পেলাম সেটার অশেষ উপকারিতা। মালদার গরমের সঙ্গে কলকাতার গরমের তুলনাই চলে না। ছাতার বাইরে যেটুকু অঙ্গে রোদ পড়ে, সেটুকু যেন পুড়িয়ে দেয়।

দলটি নারী-পুরুষ মিশ্রিত পনেরো-ষোলো জনের। সমরবাবু ছাড়া কয়েকটি চেনা মুখও পেয়েছি। ‘হন্যমান’-এর লেখিকা ও কবি জয়া মিত্র পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে খুব উৎসাহী, হিল্লি-দিল্লি-রাজস্থান ঘুরে বেড়ান, তিনি আছেন এই দলে। সোনালি চা-বাগান-আন্দোলনখ্যাত চিন্ময় ঘোষকেও অনেকদিন চিনি, মাথার চুল ধপধপে সাদা, রোগা চেহারা, হাঁপানি অসুখ আছে, তবু অদম্য উৎসাহে তিনি সারাবাংলা ঘুরে বেড়ান, কোথায় যেন পড়লাম, তাঁকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘বাউল কমিউনিস্ট’, এই অঞ্চলে তিনি অনেকবার এসেছেন, প্রধানত তাঁর উৎসাহে এখানে গড়ে উঠেছে ‘গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটি’। আরও কয়েকজন অল্প চেনা, নতুন করে পরিচয় হল ড . কল্যাণ রুদ্রের সঙ্গে, উনি ভূগোলের অধ্যাপক, নদী-বিশেষজ্ঞ, গঙ্গা নিয়ে বিশেষ গবেষণা করেছেন। জ্ঞানী অথচ বিনীত মানুষ।

নৌকোটি বেশ বড়, যদিও নৌকো বললে ভুল হবে, এখন সবাই বলে ভটভটি। মোটর লাগানোর ফলে আধুনিকতার স্পর্শ পেয়েছে, দাঁড় বা লগি ঠেলতে হয় না, কিন্তু নৌকোর চেহারা ও মাঝিমাল্লাদের মলিন পোশাকের কোনও পরিবর্তন হয়নি, হয়তো তাদের আর্থিক অবস্থারও। একটি নিতান্তই বালক জল সেঁচছে, যার ইস্কুলে যাওয়ার কথা। একটু বাতাস থাকলে এই নৌকো-যাত্ৰা আরামদায়ক হতে পারত, কিন্তু প্রকৃতি একেবারে নিবাত-নিষ্কম্প, রোদের ঝাঁঝ জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিচ্ছে একবারে।

গঙ্গার রূপ এখানে দেখতে একটুও ভালো লাগে না, বেঢপ, বেখাপ্পা! সমুদ্র অনেক দূরে, তবু নদী এমন ফুলে ফেঁপে চওড়া হবে কেন? মাঝখানে সুদীর্ঘ চড়া। এরকম রূপ হারাবার একটিই কারণ, ফরাক্কায় গঙ্গার গতি রুদ্ধ করা হয়েছে, লক্ষ্মী মেয়ের মতন গঙ্গা মেনে নেবে কেন, তাই তো সে দুধারে আয়তন বিস্তার করছে, বর্ষার সময় বিপুল জলরাশি নিয়ে ধাক্কা মারছে পাড়ে, আরও বিস্তৃত হওয়ার জন্য গ্রাস করছে গ্রামের পর গ্রাম।

এমনিতে অনাদিকাল থেকেই নদীতে বান হয়। কূল ছাপিয়ে বানের জল এসে দুপারের অনেক জমি ডোবায়, আবার নেমে যায় বানের জল, প্রচুর পলি পড়ে জমি হয় উর্বর। বন্যার সময় সাময়িক বিপদ ও বহু মানুষের গৃহচ্যুতি হলেও ফসলের উন্নতি হয় অনেক। কিন্তু নদীগুলিকে বাঁধবার ফলে এই স্বাভাবিক অবস্থা বদলে গেছে। নদীকে মাঝে-মাঝে জীবন্ত মনে হবেই। ফারাক্কার বিশাল বাঁধের বিরুদ্ধে চরম আঘাত দেওয়ার জন্য গঙ্গা যেন এখন ফুঁসছে, ফরাক্কাকে সে ভাঙতে পারবে না, কিন্তু ফরাক্কাকে এড়িয়ে সম্পূর্ণ অন্য পথে তো যেতে পারে!

গঙ্গার বুকে ফারাক্কার মতন একটা বাঁধের পরিকল্পনা হয়েছিল সেই ইংরেজ আমল থেকেই। গত শতাব্দীতেই সাহেবদের প্রধান চিন্তা ছিল কী করে কলকাতার বন্দরটাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। কারণ ভারত-শোষণের যাবতীয় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড হত প্রধানত কলকাতা বন্দর দিয়ে। বিহারের রাজমহলের পাহাড়ি অঞ্চল ছেড়ে গঙ্গা বাংলার সমতল ভূমিতে এসে কিছুদূর প্রবাহিত হওয়ার পর মুর্শিদাবাদ জেলার কাছে দুটি ধারায় ভাগ হয়েছে, সেখান থেকে একটির নাম পদ্মা, অন্যটির নাম ভাগীরথী। এই ভাগীরথীকে ইংরেজরা বলত হুগলি নদী, কিন্তু আপামর জনসাধারণ গঙ্গাই বলে। বরাবরই গঙ্গার প্রধান ধারা ওই পদ্মা, তুলনায় ভাগীরথী দুর্বল। মাঝে মাঝেই ভাগীরথী প্রায় শুকিয়ে গিয়ে কলকাতা বন্দর অকেজো হওয়ার উপক্রম হয়েছে, ইংরেজরা খোঁড়াখুঁড়ি করে কোনওরকমে ভাগীরথীকে চালু রেখেছে। ১৯৩০ সালে ২৬ ফুট ড্রাফটের জাহাজ কালকাতা বন্দরে আসা-যাওয়া করতে পারত বছরে প্রায় তিনশো দিন, স্বাধীনতার দেড় দশক পরেই সেরকম জাহাজের চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই বাধ্য হয়েই বর্ষায় গঙ্গার অতিরিক্ত জল ধরে রেখে, গ্রীষ্মে সেই জল ছেড়ে নদীকে সচল রাখার জন্য গৃহীত হয় ফরাক্কা বাঁধ পরিকল্পনা। দুজন আন্তর্জাতিক নদী-বিশেষজ্ঞ জে জে ড্রনকার্স এবং ডব্লু হেনসেন-এর পরামর্শ নিয়ে কাজ শুরু হয় ১৯৬২ সালে, শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। আন্তর্জাতিক নদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিশ্চিত খুব প্রয়োজনীয়, কিন্তু এই নদী ঘিরে কত মানুষের আবেগ উন্মদনা, জীবিকা ও জীবদর্শন, লোককথা ও গান আছে, তা কি তাঁদের পক্ষে বোঝা সম্ভব? তাঁরা কি ভাবতে পেরেছিলেন, এই ফারাক্কাকে উপলক্ষ করে পাকিস্তান, পরে বাংলাদেশের সঙ্গে জলবন্টন নিয়ে আমাদের মন কষাকষি শুরু হয়ে যাবে? এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর কথাও নয় তাঁদের।

ফরাক্কার ফিডার ক্যানাল, জল ছাড়া না-ছাড়া, জলের পরিমাণ ভাগাভাগির চুক্তি, চুক্তি নিয়ে আন্দোলন, এইসব নিয়েই নানান খবর তৈরি হয়ে আসছে। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের উপরিভাগের যে-অংশ, সেখানকার মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের দিশি বিশেষজ্ঞ বা সরকার কোনও চিন্তা করেননি, কিংবা চিন্তা করলেও প্রকাশ করেননি। প্রকাশ না করারও যথেষ্ট কারণ আছে।

ছেলেবেলায় সিরাজউদ্দোল্লা নামে একটি নাটকের রেকর্ড খুব বিখ্যাত ছিল। টিভি তো দূরে থাক, অডি ক্যাসেটও তখন অকল্পনীয়, একমাত্র ভরসা রেডিয়ো, সেখানে প্রায়ই শোনানো হত নাটকটি, নির্মলেন্দু লাহিড়ির কাঁপা কাঁপা গলায় ট্র্যাজিক নায়ক সিরাজের সংলাপ বুক কাঁপিয়ে দিত। সেই নাটকে নিয়তির গানের মতন এক মাঝির মুখের গান ছিল এই রকম :নদীর এ কূল ভাঙে, ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা–সকালমেলা আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা, এই তো নদীর খেলা…। নদী এবং মানুষের জীবন সম্পর্কে অতি সরল সত্য কথা। একসময় মাদারিপুর শহরের পাশে বর্ষায় প্রমত্ত নদ আড়িয়াল খাঁর পাড় ভাঙা দেখে আমার ওই গানটি মনে পড়ত; এখনও নৌকোয় যেতে যেতে গঙ্গার পাড় ভাঙার দৃশ্য দেখতে দেখতে মনের মধ্যে গানটি গুনগুনিয়ে ওঠে।

পুরোনো ম্যাপে দেখা যায়, রাজমহল থেকে ফরাক্কা পর্যন্ত গঙ্গার প্রবাহ প্রায় সরলরেখার মতন। কিন্তু নদী কক্ষনও চিরকাল সরল থাকে না, নদী তো আর খাল নয়, এখন স্যাটেলাইটের ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যায়, গঙ্গা এই অংশে বেঁকে গেছে কাস্তের মতন, এবং সেই বাঁকটি মালদা জেলার দিকে। অর্থাৎ প্রত্যেক বর্ষায় ক্রুদ্ধ জলের তোড় ধাক্কা মেরে খেয়ে নিচ্ছে মালদার গ্রামের পর গ্রাম, অপর পারে বিহার, সেখানে জেগে উঠেছে চর, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের দিক সংকুচিত হয়ে বিহারের জমি বাড়ছে। আবার ফরাক্কা পেরিয়ে গঙ্গা ধাক্কা মারছে ডানদিকে, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদের ভূমিক্ষয় হচ্ছে নতুন চর উঠছে বাংলাদেশে। নদী কখন ডানদিকে, কখন বাঁ-দিকে ধাক্কা মারবে, সেটা তার খেয়াল বলা যেতে পারে। মনে হয় যেন, ফারাক্কার প্রতি আক্রোশে গঙ্গা পশ্চিমবাংলার ওপরেই প্রতিশোধ নিতে চাইছে।

ভূমিক্ষয়ের চেয়েও আরও অনেক বিপদের খাঁড়া মালদা জেলা ও শহরের ওপর দোদুল্যমান।

এখানে গঙ্গার ধারার খুব কাছাকাছি আছে আরও কয়েকটি ছোট নদী। পাগলা, ভাগীরথী (অন্য এক অকিঞ্চিৎকর ভাগীরথী), কালিন্দী, ফুলহার এবং মালদা শহরের পাশে মহানন্দা। পাগলা নদীর সঙ্গে এখন গঙ্গার দূরত্ব আধ কিলোমিটারেরও কম। প্রচুর পলি জমে জমে গঙ্গার খাত এখন অনেক উঁচু হয়ে গেছে। বর্ষার সময় গঙ্গায় জল হয় তিরিশ-বত্রিশ লক্ষ কিউসেক, কোনও কোনও বছর হঠাৎ এর চেয়ে আরও বেশিও হতে পারে, সেই বিপুল জলরাশি ফরাক্কায় গিয়ে ধাক্কা মারে, সেখানকার ১০৮টি সুইস গেটের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই এখন আর খোলা যায় না, চর উঠে, পলি জমে অবরুদ্ধ হয়ে গেছে) আবার ফিরে আসে, মানিকচক ও কালিয়াচকের মধ্যবর্তী গ্রামগুলি গ্রাস করতে থাকে। যদি একবার গঙ্গা এসে পাগলা নদীকে ছুঁয়ে দেয়, তখন আরও নদীগুলি মিলিয়ে সে দিকেই হয়ে যাবে গঙ্গার মূল প্রবাহ, সেই নতুন গঙ্গা ফরাক্কাকে পাশ কাটিয়ে, কাঁচকলা দেখিয়ে সোজা গিয়ে মিশবে বাংলাদেশের পদ্মায়। এই পঞ্চানন্দপুরের মতন অসংখ্য গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, মালদা শহরও পরিণত হবে জলাভূমিতে। এটা শুধু সম্ভাবনা নয়, রীতিমতন বাস্তব আশঙ্কা।

বাংলাদেশে তখন পানি ভাগাভাগি নিয়ে অভিযোগের অবকাশই থাকবে না, ফরাক্কা বাঁধের বাধা না থাকায় পুরোটাই চলে যাবে পদ্মায়। কিংবা উলটো ব্যাপারও হতে পারে, অচিন্তনীয়ভাবে এত বেশি পানি পেয়ে পদ্মা শুরু করতে পারে তাণ্ডবলীলা, যেমন হয়েছে অতীতে, পদ্মা যে কত প্রাসাদ, অট্টালিকা সমেত জনপদ খেয়ে ফেলেছে, তার কি ইয়ত্তা আছে? সেই জন্যই তো পদ্মার আর এক নাম ছিল কীর্তিনাশা। তখন হয়তো বাংলাদেশ আবার দাবি করবে, এত বেশি পানি চাই না, ফিরিয়ে নাও, ফিরিয়ে নাও। সেখানকার মৌলবাদীরা বলবে, গঙ্গাকে বাঁধনমুক্ত করা ভারতের এক ষড়যন্ত্র।

গঙ্গার গতি পরিবর্তন রোধ ও মালদাকে বাঁচানোর জন্য কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছেন? ১৯৭৮ সালে গড়া হয়েছিল প্রীতম সিংহ কমিটি, তার রিপোর্ট পেশ করা হয় দুবছর বাদে। বন্যায় বহু চাষের জমি নষ্ট হয়, কিন্তু তা রোধ করার জন্য নদীর পাড় বাঁধানোর যে বিপুল খরচ, সেই তুলনায় কৃষি-ক্ষতি অনেক কম। তবে ধুলিয়ান, ঔরঙ্গাবাদ, গিরিয়া, কুতুবপুর, শেখ আলিপুর, সাঁকো পাড়া ইত্যাদি জনবহুল অঞ্চলে পাথর দিয়ে পাড় বাঁধাবার প্রস্তাব করা হয়েছিল। অনেক জায়গায় এরকম বাঁধ দিতে বহু কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখন আরও একটি অন্য উপায় অবলম্বিত হচ্ছে। তার নাম স্পার (SPUR), বাঁধ থাকে নদীর সমান্তরাল, স্পার নদীর গর্ভে নেমে আসে, যাতে স্রোতের ধাক্কা প্রতিহত হতে পারে। এসবই যেন কোনও দৈত্যের হাতে বাচ্চা ছেলের খেলনা দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা। ১৯৯০ সালে আখেরিগঞ্জে ছ’কোটি টাকা খরচ করে যে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, মাত্র পঁয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে নদী তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।

বাঁধের প্রসঙ্গ উঠলেই এখানকার সাধারণ মানুষ হাসাহাসি করে। দশ কোটি টাকা বাজেট শুনলেই বলে বড়জোর অর্ধেক। অর্থাৎ অর্ধেক টাকা চুরি হবেই। চুরি শব্দটা ব্যবহার করা বোধহয় ঠিক হল না, প্রমাণ করতে হয়। এসব কখনও প্রমাণ হয় না। তবে কি তছরূপ? তারও প্রমাণ লাগে। অনায়াসে বলা যায় বে-হাত। অর্ধেক টাকা যে অনেকগুলি অদৃশ্য হাতে হাতে চলে যাবে, তা সবাই দিন ও রাতের মতন স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নিয়েছে। বাকি অর্ধেক টাকাও আক্ষরিক অর্থেই জলে যায়। কোনও বাঁধ বা স্পারই দু-তিন বছরের বেশি টেকে না।

নৌকোয় যেতে যেতে আমরা এরকম অনেক ভাঙাবাঁধ ও গ্রামের ধ্বংসচিহ্ন দেখতে লাগলাম। কলকাতা থেকে আগত দলটির সঙ্গে স্থানীয় লোকজনও রয়েছে অনেক। কেউ গান গাইছে, না, হাস্য পরিহাস করছে না, সকালর মুখেই শুধু বন্যা ও ভাঙনের কথা। এঁরা ভুক্তভোগী, কেউ-কেউ দু-তিনবার বাড়ি-জমি হারিয়েছেন এবারের আসন্ন বর্ষায় আরও কতখানি বিপদ আসবে সেই চিন্তায় আকুল। সাপে যাকে কামড়ায়নি, সে যেমন সাপের বিষে যাতনা কতখানি তা বুঝবে না, তেমনই যাঁরা জন্মভিটে, বাড়ি-ঘর, নিজের হাতে লাগানো গাছ, নিজের প্রতিপালিত গরু-মোষ, হাঁস-মুরগি, হারায়নি, তাদের পক্ষে কী এদের মর্মবেদনা বোঝা সম্ভব? যেমন পূর্ববঙ্গ থেকে যারা উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে, তাদের আর্থিক ও বৈষয়িক ক্ষতির চেয়েও মনঃকষ্ট যে বেশি, তা কি পশ্চিমবাংলার মানুষ ঠিকঠাক বুঝেছে কখনও?

এত ক্ষয়ক্ষতি সত্বেও এরা কিন্তু এখনও নদীকে ভালোবাসে। নদীকে কে না ভালোবাসে? কিন্তু যেমন বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে, সন্ন্যাসীরা পাহাড়ে, তেমনই নদীকেও নদীর খাতেই সবচেয়ে ভালো মানায়। নদী বিনা আমন্ত্রণে হুড়মুড় করে বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হলেই সর্বনাশ। ‘নদী, তুমি নদীতেই থাকো, বাড়িতে এসো না’, এই পঙক্তিটি আমার মনে এসেছিল আড়িয়াল খাঁ নদীর বাড়ি-ঘর ভাঙার রুদ্ররূপ দেখার স্মৃতিতে।

এক জায়গায় একটি নতুন স্পার তৈরি হচ্ছে দেখে সবাই মিলে নৌকো থেকে নেমে পড়া হল। বড়-বড় গয়নার নৌকো থেকে নামানো হচ্ছে রাশি রাশি বোল্ডার। লৌহসদৃশ এই গ্রানাইট খণ্ডগুলি আনা হচ্ছে বিহার থেকে। নদীগর্ভে পলিথিনের শিট বিছিয়ে পাথর মুড়ে, বিদেশি টেকনোলজিতে নতুন ধরনের মজবুত স্পার গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এখানে। কাজ শুরু হয়েছে সবেমাত্র। একজন তরুণ ইঞ্জিনিয়ার কাজ তদারক করছেন, অনেকে মিলে প্রশ্ন করতে লাগল তাঁকে, আমার কাজ পাশে দাঁড়িয়ে শোনা। একজন জিগ্যেস করল, বরষা তো এসে গেল প্রায়, কাজ এত দেরিতে হচ্ছে কেন? তিনি উত্তর দিলেন, সরকার থেকে ওয়ার্ক অর্ডার এসেছে মাত্র সাত দিন আগে। (কেন ওয়ার্ক অর্ডার এত দেরিতে এসেছে, এর উত্তর তাঁর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা তো সবাই জানি, রাস্তা সারাবার কাজ শুরু হয় বর্ষার ঠিক আগে, যাতে অর্ধেক ধুয়েমুছে যায়, পরের বছর আবার কাজ শুরু করতে হয়।) স্পারটি ঠিক এখানেই কেন গড়া হচ্ছে, স্রোত এখানে ধাক্কা খেয়ে কি অন্য জায়গায় পাড় ভাঙবে না? এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, অদূরে ভাঙন শুরু হয়ে গেছে। তরুণ ইঞ্জিনিয়ারাটি বললেন, স্থান নির্বাচনের দায়িত্ব তো তাঁর নয়। সেসব ওপর মহলের ব্যাপার। তাঁকে যেখানে কাজ করতে বলা হয়েছে, তিনি সেখানেই করবেন। ঠিকই কথা। জনসাধারণের সামনে এদেরই পড়তে হয়, অথচ যারা নীতি নির্ধারণ করেন, তাঁরা থাকেন অদৃশ্য।

দেখলেই বোঝা যায়, বর্ষার আর বড়জোর সাত দিন দেরি, তার মধ্যে এই কাজ শেষ হওয়া সম্ভব নয়। সবেমাত্র বোল্ডারগুলি মজুরদের মাথায়-মাথায় নামছে। বারো কোটি সত্তর লক্ষ টাকার প্রকল্প। এর অর্ধেক টাকা কি ঘুষ খাওয়ানো হচ্ছে নদীকে? টাকাপয়সা কি নদীর কাছে সুখাদ্য? আমার খটকা লাগল। বালি ব্রিজ পার হওয়র সময় অনেককে গঙ্গায় পয়সা ছুঁড়ে দিতে দেখেছি। কেন দেয় লোকে? হিন্দুদের মধ্যে ঠাকুর-দেবতাদের টাকাপয়সা, সোনাদানা ঘুষ দেওয়ার প্রথা তো আছেই।

আবার নৌকোয়, এবং খানিক দূর যাওয়ার পর আবার একটি গ্রামের কাছে নামার উদ্যোগ নেওয়া হল। সবাই নামলেন, আমি ছাড়া। এই ৫ জুন যেন আমার অভিজ্ঞতায় উষ্ণতম দিন। এক একজনের শরীর এক-একরকম তাপ সহ্য করতে পারে। শীতে আমার কষ্ট হয় না, শূন্যের নীচে পঁচিশ ডিগ্রি ঠান্ডাতেও আমি সাবলীলভাবে ঘোরাফেরা করেছি। কিন্তু বেশি গরমে আমার মাথা ঝিমঝিম করে, অন্যদের তুলনায় আমার ঘাম হয় বেশি। পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে সপসপে, তাতে শরীর অবসন্ন লাগে, তা ছাড়া হাঁটুতে একটা ব্যথা আছে বলে এবড়ো-খেবড়ো জমিতে হাঁটতেও অসুবিধে হয়। হঠাৎ অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে পড়লে অন্যরা বিব্রত হবেন বলে আমি আর নামলাম না। তাতে একটা সুবিধে হল, এখানকার কিছু লোকের সঙ্গে নিরিবিলিতে কথা বলা গেল।

নানা বয়সের কিছু লোক স্নান করছে এখানে। তারা নৌকোর কাছে এসে জিগ্যেস করতে লাগল, আমরা কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি, সরকারি লোক কি না ইত্যাদি। এদের মুখপাত্রটি নিজের নাম ঠিক কী বললেন, বোঝা গেল না, তবে বাংলা ফিল্মে এই ধরনের মানুষের নাম সৃষ্টিধর মণ্ডল বা গোবিন্দ সামন্ত হয়। সৃষ্টিধরই ধরে নেওয়া গেল, চেহারাটি বেশ আকর্ষণীয়, লম্বা-চওড়া, কপাট-বক্ষ, মহিষ-বর্ণ, কণ্ঠস্বর সুগম্ভীর। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি ঈষৎ গর্বের সঙ্গে জানালেন যে তিনি ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়েছেন এবং অ্যালোপ্যাথি ডাক্তারি করেন। পরে একটি মুসলমান যুবকও বলেছিল, তার দাদারা বিএসসি, এমএসসি পাশ করেও চাকরি পায় না দেখে সে মাধ্যমিকের পর লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। এখন কোয়াক ডাক্তারি করে, ভালোই পসার, সেই জন্য একটি অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে। কোয়াক শব্দটি তার নিজেরই ব্যবহার করা।) সৃষ্টিধরের বাপ-ঠাকুরদার আমলের বাড়ি আছে এই গ্রামে, সঙ্গে বাগান ও জমি, কয়েকবার বন্যা এসে ধাক্কা দিয়েও ভাঙতে পারেনি, তাঁর ধারণা, এবারে বন্যা হলে সবকিছু তলিয়ে যাবে।

তিনি অভিযোগের সুরে বললেন, নতুন স্পার তৈরি হচ্ছে পঞ্চানন্দপুর গ্রামটাকে বাঁচাতে, কারণ ওরা আন্দোলন-টান্দোলন করছে, তা হলে এ দিকের গ্রামগুলোর কী হবে? পঞ্চানন্দপুর মুসলমান-প্রধান গ্রাম, তাদের খুশি করার জন্য এরকম সরকারি সিদ্ধান্ত, এই তাঁর বক্তব্য। এবং আমাদের যদি কিছু করার ক্ষমতা না থাকে, তা হলে আমরা শুধু-শুধু রোদে পুড়ে শখ করে এসব দেখতে এসেছি কেন? ঠোঁটে হাসি এঁকে নিরুত্তাপ থাকা ছাড়া আর আমার উপায় কী?

বিকেলবেলা সভা শুরু হল গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে। পাগলা নদীর পাশ দিয়ে দিয়ে রাস্তা। আপাতত নিস্তেজ, ছোট নদী, কচুরিপানা ও দামে ভরা। এর নাম কেন পাগলা? অজ্ঞাতে নিশ্চয়ই কিছু পাগলামি করেছে, এবং ভবিষ্যতে আরও অনেক খ্যাপামি করার অপেক্ষায় আছে? গঙ্গা নদী নিয়ে যেমন হিন্দুদের বহু পৌরাণিক কাহিনি ও লোককথা আছে, তেমনই মুসলমানদেরও আছে নিশ্চয়ই, তারাও তো বহু শতাব্দী ধরে বাস করছে এই নদীর দু ধারে। আমাদের সঙ্গী একটি যুবক বলল, সে তার দাদির কাছে একটা গল্প শুনেছে। গঙ্গা আর এখানকার অন্য সব নদীগুলো মিলে সাত বোন, আর তাদের একমাত্র ভাই এই পাগলা। গঙ্গা তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য খুব ব্যাকুল। একদিন না একদিন আসবেই। এটা কি গল্প, নাকি প্রৌঢ়ার ভবিষ্যদ্বাণী?

সভা হবে একটা স্কুলবাড়িতে। সুকিয়া মহাজনী নামে এক মহিলার অনেক সম্পত্তি ছিল। তিনি সবকিছু দান করেন স্কুল তৈরি করার জন্য। তাঁর নামেই পঞ্চানন্দ সুকিয়া হাইস্কুল। বেশ মজবুত দোতলা পাকা বাড়ি, সামনে বিস্তৃত মাঠ, এখানে-ওখানে আমবাগান, এখন সব গাছ আমে ভরতি। সুন্দর পরিবেশ। শুনলাম, দুবার স্কুলটির স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে, এবারে বোধহয় এ বাড়িটিও ছাড়তে হবে, কারণ সেই গঙ্গা।

পঞ্চানন্দপুরে পঁচাত্তর ভাগ মুসলমান, পঁচিশ ভাগ হিন্দু। আপাতত মনে হয় চমৎকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রয়েছে, বাস্তবে ঠিক ততটা নয়, কয়েকজন হিন্দু গুজগুজ করে আমাকে কিছু কিছু ক্ষোভের কথা জানিয়েছে। হিন্দুরা এখানে সংখ্যালঘু, সব জায়গাতেই সংখ্যালঘু মনস্তত্ব একই রকম। এই প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি হিন্দু, সম্পাদক মুসলমান, বক্তা ও শ্রোতারা অনেক দূর দূর গ্রাম, এমনকী মালদা শহর থেকেও এসেছেন, হিন্দু-মুসলমান মিশ্রিত। এখানে সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে কাজ করার সংকল্প নিয়েছেন, দেখে ভালো লাগে।

বক্তারা কেউ অবান্তর কথা বলছেন না। নদীকেন্দ্রিক জীবন, বহু অভিজ্ঞতায় পোড়-খাওয়া একজন মানুষ যখন নিজেদের কথা বলে, তার ভাষার অভাব হয় না, তার বক্তব্য হয় নিখাদ। আর কোনও সভায় এত আগ্রহী শ্রোতা দেখেছি বলেও মনে হয় না। বিষয় শুধু নদী আর বাঁধ।

সমর বাগচী মশাইকে যত দেখেছি, ততই অবাক হচ্ছি। ছেষট্টি বছর বয়েস, শরীরে দু একবার অপারেশন হয়ে গেছে, কিন্তু সারাদিন ঘোরাঘুরিতে একটুও ক্লান্তি নেই। আমি গরমে কাতর, তিনি নির্বিকার। চাকরি থেকে অবসর নিলেও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিজ্ঞান-চেতনা জাগাবার কাজ করে যাচ্ছেন, পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারে ঘুরছেন গ্রামে গ্রামে। মনীষা নামে একটি তরুণীও কলকাতা থেকে এসেছে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে। তাঁকে দেখিয়ে জয়া মিত্র বললেন, সারা ভারতেই এখন পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে অনেক মহিলাই অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন। শ্ৰীমতী মেধা পটেকর তাঁদের প্রেরণাদাত্রী?

দ্বিতীয়ার্ধে ড . কল্যাণ রুদ্র অনেকগুলি মানচিত্র সহযোগে খুব সুবোধ্য ভাষায় গঙ্গা নদীর চরিত্র, গতি-প্রকৃতি, ফারাক্কা বাঁধের ভালো-মন্দ দিক এবং মালদা জেলাকে বাঁচাবার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করলেন। আমি কিছুক্ষণ বসে শুনলাম মনোযোগী ছাত্রের মতন, তারপর একসময় মনে হল, যথেষ্টরও বেশি হয়ে গেছে। একদিনে কি এত নদী সহ্য হয়? এখন ঘামে ভেজা জামাটা বদলানোই বেশি দরকার।

রাত ন’টা বেজে গেছে, অন্যরা কিন্তু তখনও আলোচনা চালিয়ে যেতে চান।

রাত্রে ওই স্কুলবাড়িতেই অন্যদের সঙ্গে আমার শোয়ার কথা, কিন্তু স্থানীয় উদ্যোক্তারা বেশি খাতির দেখিয়ে, আমার আপত্তি সত্বেও প্রায় জোর করেই নিয়ে গেলেন কাছাকাছি এক গৃহস্থের বাড়িতে। সেখানে ইনভার্টারে একটি টেবিল-পাখা চলতে পারে সারারাত।

নতুন জায়গায় শুয়ে অনেকক্ষণ আমার ঘুম আসে না। বারবার মনে হতে লাগল, আমি এখানে কেন এসেছি? একদিন-দুদিন ঘুরে দেখায় কী আর এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে? আসল দ্রষ্টব্য তো নদী নয়, মানুষ। সে জন্য একটানা অনেকদিন এখানে থেকে যাওয়া উচিত, তা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। অরুন্ধতী রায় যা পেরেছেন, সেরকম আমি পারব কী করে? অরুন্ধতী একটি মাত্র উপন্যাস লিখেছেন, আর লিখবেন না বলেছেন, এখন তিনি পুরোপুরি সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট, নর্মদা বিষয়ক নিবন্ধটি রচনার জন্য তিনি নিশ্চিত ছ’মাস বা এক বছর সময় নিয়েছেন। তাঁর ভাষা ইংরেজি, তিনি সারা দেশের, এমনকী বিদেশেরও অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন। আমি গল্প উপন্যাস রচনাতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, ভালো হোক বা না হোক, সেটা আমার ‘কর্ম’। কবিতা রচনা আমার প্রাণের শখ, সেসব ছেড়েছুঁড়ে এখন কি আর আমার পক্ষে সমাজকর্মী হওয়া সম্ভব? দুর্গত মানুষের পাশে গিয়ে এক-এক সময় দাঁড়াতে ইচ্ছে করে, অথচ পারি না, এক দারুণ বৈপরীত্য। এক দিকে আমি ব্যক্তিগত জীবনে ভ্রমণপিপাসু, আবার অন্যদিকে ঘরকুনো লেখক। আমি নিজে জানি, আমি অপরিশোধ্যভাবে জন্ম-রোমান্টিক। সেই জন্যই মানুষকে একটু দূর থেকে দেখি, জনসাধারণের মধ্যে মিশে গিয়ে সহজভাবে কথা বলতে পারি না। এটা আমার অযোগ্যতা হতে পারে, কিন্তু আমি এই ধাতুতে গড়া। দূর থেকে যেটুকু দেখি, তা লিখলে কি কারও কোনও কাজে লাগতে পারে?

আর একটা কথা মনে আসতেই শিহরণ হয়। ফরাক্কা বাঁধের আংশিক ব্যর্থতা সত্বেও সরকার সেটাকে টিকিয়ে রাখতে নিশ্চিত বদ্ধপরিকর। কারণ, তার সঙ্গে এখনও কলকাতা বন্দরের ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক ইত্যাদি বড়-বড় ব্যাপার জড়িত। তার জন্য মানিকচক, পঞ্চানন্দপুর, কালিয়াচক ইত্যাদি অঞ্চলগুলি যদি ভেসেও যায়, সেই ক্ষতি সারা দেশের তুলনায় কতখানি? সেই জন্য কি সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ এই অঞ্চলটাকে কনডেমড বলে ধরেই নিয়েছেন? বাড়ি-জমি সমেত এই কয়েক লক্ষ মানুষকে বাঁচাবার সত্যিই কি কোনও উপায় আছে?

নদীর গতি-প্রকৃতি অনেকটা পেন্ডুলামের মতন, একবার এ পার ভাঙে, ও পার গড়ে, আবার অন্যদিকে ফেরে। নদীর খাত যে-অঞ্চলসীমার মধ্যে বারবার পরিবর্তিত হয়, তাকে বলে মিয়েন্ডার বেল্ট, আজই কল্যাণবাবুর কাছ থেকে তা জেনেছি। মালদা-মুর্শিদাবাদে এই মিয়েন্ডার বেল্ট দশ কিলোমিটার ব্যাপী। দু-পারের এই ভূমি থেকে সমস্ত বসতি একেবারে সরিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু যাদের বাড়ি-ঘর ভাঙা হবে, তাদের পুনর্বাসন হবে কেথায়, কীভাবে? এই ব্যাপক উদ্যোগ কি সরকারের পক্ষে সম্ভব? সরকার ক্ষতিপূরণ দেবে? ক্ষতিপূরণ বা রিলিফের টাকা কীভাবে, কত দিনে এবং শেষপর্যন্ত কতটুকু প্রকৃত প্রাপকের হাতে পৌঁছয়, তা কি আমরা জানি না?

মনে পড়ে, নদীর ঘাটে সেই সৃষ্টিধর নামের লোকটির শেষ উক্তি। প্রায় ধমকের সুরে তিনি আমায় বলেছিলেন, নদী তার ইচ্ছেমতন কাজ করবে। মানুষ তাকে বাধা দিতে পারবে? নদী যদি আমার বাড়িখানা খেয়ে ফেলতে চায়, খাক না। তখন আমি বিবাগী হয়ে যে-দিকে ইচ্ছে চলে যাব। তাতে আপনাদের কী আসে যায়? আপনারা দেখতে এসেছেন কেন?

ওই মানুষটির মনস্তত্ব কি আমি কোনওদিন বুঝতে পারব?