[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১০. কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বরিশাল শহর

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বরিশাল শহর আমাদের আগমনবার্তা রটে গেল, যদিও কারুকেই আগে থেকে খবর দেওয়া হয়নি। আত্মগোপন করে থাকা মুশকিল। মিলন অত্যন্ত জনপ্রিয় সেখানে, তা ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশনে তার ধারাবাহিক অনুষ্ঠান হয়, সে নিজেও অনেক

অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় সশরীরে, সুতরাং পাঠকদের কাছে তার মুখ বিশেষ পরিচিত। এবং আশ্চর্য ব্যাপার, আমাকেও কেউ কেউ দেখে চিনতে পেরে যায়।

।পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। নিয়মমাফিক আমরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের এস পি, পোলিং অফিসার কয়েকজনের কাছে খোঁজখবর নিতে গেছি। এই সব আমলারাও বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ নন। কেউ কেউ অবশ্য বলেন, আমি নিজে অবশ্য আপনার লেখা কিছু পড়িনি, কিন্তু আমার বউ আপনার ভক্ত, বাড়িতে আপনার বই আছে। আবার কেউ কেউ আমাদের অবাক করে দিয়ে আমার কবিতার দু-চার লাইন মুখস্থ বলে দেয়, কিংবা মিলনের কোনও উপন্যাসের কাহিনি।

সাংবাদিকদের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে পরদিন যেতে হল স্থানীয় প্রেস ক্লাবে। অনেকেই বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাতে চান। তাতে কিছুতেই রাজি হই না। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এক বাড়িতে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলে আরও অনেক বাড়িতে যেতে হবে, তাদের বত্রিশ ব্যঞ্জন খেতে খেতে প্রাণান্তকর অবস্থা হবে। বাংলাদেশের মানুষদের মতন এত অতিথিপরায়ণ মানুষ আর কোথাও দেখিনি।

বরিশাল শহরে হিন্দুদের সংখ্যা এখনও নগণ্য নয়। অশ্বিণী দত্ত এককালে ছিলেন বরিশালের মুকুটহীন রাজা, এখানকার টাউন হলটি এখনও তাঁর নামে। বরিশালের আর একজন স্বনামধন্য পুরুষ ফজলুল হক। ভারতীয় কংগ্রেস যদি এক সময় তাঁর সঙ্গে অসহযোগিতা না করত, তা হলে বোধহয় এ উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যরকম হত।

এককালের সুখ্যাত ব্রজমোহন কলেজ বা বি এম কলেজ এখনও সগৌরবে চলছে। সম্প্রতি এই কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার প্রস্তাব উঠেছে।

সন্ধেবেলা হোটেলের ঘরে বসে আড্ডা দিতে দিতে মিলন বলল, সুনীলদা, এই শহরে জীবনানন্দ দাশ কোন বাড়িতে থাকতেন, তা খুঁজে বার করলে হয় না?

মিলন কবিতা লেখে না, শুধু গদ্যকার, কিন্তু অন্যান্য অনেক গদ্যকারের সঙ্গে তার তফাত এই যে সে খুব কবিতা ভালোবাসে। অনেক সময় তার সঙ্গে আমার গল্প-উপন্যাসের বদলে কবিতা নিয়েই কথা হয়।

বরিশালে এলে জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়বেই, তাঁর বাড়িটি দেখার ইচ্ছে আমারও মনে উঁকি দিয়েছিল।

আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি–শালিক নিয়েছে নিঙড়ায়ে
নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতর
সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে কাঁচের মতন সাদা ঘাসের গায়ে
ভেরেণ্ডা ফুলের নীল ভোমরারা ঝুলিতেছে সাদা স্তন ঝরে
করবীর; কোন এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেছে ফুল,
তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে ঘাসে; নরম ব্যাকুল।

জিগ্যেস করলাম, সে বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে কি এতদিন পর? ওদের কেউ তো এখানে নেই শুনেছি।

মিলন বলল, লোকাল কারুর সাহায্য নিতে হবে। শহরটা আমিও ভালো চিনি না।

পরদিন একজন সাংবাদিককে পাকড়াও করা হল। সুবিধের মধ্যে এই যে, আমাদের সঙ্গে একটি গাড়ি থাকে, পেট্রলের চিন্তা নেই, এবং ড্রাইভার ভদ্রলোকটি গোমড়ামুখো নন।

বরিশাল শহরের মধ্য দিয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে, তার নাম বগুড়া রোড। সেই রাস্তার এক বাঁকের মুখে খুঁজে পাওয়া গেল সেই বাড়ি। আশেপাশে বড় বড় হর্ষ উঠে গেছে, কিন্তু এ বাড়িটি ছিমছাম একতলা। গেট পেরিয়ে ছোট্ট একটি উঠোন, অনেকটা বাগানের মতন, এদিকে ওদিকে কয়েকটি ঘর, পাকা দেওয়াল, ওপরে টালির ছাউনি। বাড়িটিতে এখনও বেশ একটা শান্তশ্রী আছে। বর্তমানে এক মুসলমান পরিবার এখানে থাকেন, তাঁরা যত্ন করে আমাদের দেখালেন।

প্রায় পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে, এ বাড়ি একইরকম থেকে যাওয়া সম্ভব নয়। কিছুটা অদলবদল ও সংস্কার হয়েছে নিশ্চিত, কিন্তু একেবারে খোল-নলচে বদলে যায়নি। একদিকের একটি ঘর দেখিয়ে একজন জানালেন যে সেটি প্রায় আগের মতনই আছে। কল্পনা করা যায়, জীবনানন্দ দাশ ওই ঘরে বসে লিখতেন।

কতদিন তুমি আমি এসে এইখানে বসিয়াছি ঘরের ভিতর
খড়ের চালের নিচে, অন্ধকারে; সন্ধ্যায় ধূসর সজল
মৃদু হাত খেলিতেছে হিজল জামের ডালে…

সে বাড়িতে আমরা বেশিক্ষণ থাকিনি। একটা বাড়ি অত দেখবার কী আছে! এক ঝলক দেখলে বেশি মনে থাকে।

গেটের পাশে সে বাড়ির নাম লেখা আছে, ‘ধানসিড়ি’। জীবনানন্দের আমলের নয়, বর্তমান মালিকেরা এই নাম দিয়েছেন। তাঁরা ওই কবির অনুরাগী।

তখন মনে হল, তা হলে ধানসিড়ি নদীটাও খুঁজে দেখলে হয়। ওই নামে সত্যি কোনও নদী আছে?

বরিশালের চেনা কয়েকজন তরুর লেখক ও সাংবাদিক জানাল যে, ওই নামে একটি নদী অবশ্যই আছে, তারা সবাই শুনেছে।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তারা কেউ জানে না নদীটা ঠিক কোথায়, কেউ দেখেনি। দেখার আগ্রহও হয়নি?

ধানসিরি নামে একটি নদী আছ অসমে। ওখানে সুবনসিরি, ধানসিরি এইরকম নদীর নাম হয়, কিন্তু বানান আলাদা। জীবনানন্দ লিখেছেন ধানসিড়ি, চন্দ্রবিন্দু দেননি।

পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে
ধানসিড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব বয়ে
যেইখানে এলোচুলে রাজপ্রাসাদের সেই শ্যামা আজো আসে…

জীবনানন্দ নিশ্চিত আসামের নদীটির কথা লেখেননি, তাঁর নদীটি একান্তই বাংলার গ্রাম্য নদী। এক নামে একাধিক নদী থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ইছামতী ও যমুনা নামে বহু জায়গায় আলাদা-আলাদানদী আছে। বৈতরণী নামে নদীও একাধিক।

বরিশাল শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ‘কীর্তনখোলা’ নদী। বেশ নামটি। কিন্তু জীবনানন্দ তাঁর কোনও কবিতায় ‘কীর্তনখোলা’ নামটি ব্যবহার করেননি, অথচ দূরবর্তী ধলেশ্বরীর কথা এসেছে বারবার।

‘কীর্তনখোলা’ নদীটির রূপ উপভোগ করা যায় না। এককালে বরিশাল শহরটি নাকি সুন্দর ছিল, নদীর ধার দিয়ে বেড়াবার রাস্তা ছিল, এখন তা বোঝার উপায় নেই। নদীর ধারে কল কারখানা ও বড় বড় গুদামঘর নদীকে একেবারে ঢেকে দিয়েছে, নদী দেখাই যায় না প্রায়। জনসংখ্যার চাপে শহরটি শ্রীহীন।

নির্বাচনের দিনটিতে আমাদের কাজ বিভিন্ন পোলিং বুথ ঘুরে ঘুরে দেখা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা। কোথাও কোনও কারচুপি ও জোর জবরদস্তি চললে, বা সেরকম কোনও অভিযোগ শুনলে লিখে নিতে হবে। মোটামুটি নির্বিঘ্নেই ভোট চলল, অনেক পোলিং বুথের সামনে লম্বা লাইন, সুতরাং আমাদের করণীয় তেমন কিছু নেই। আমি ও মিলন ঘোরাঘুরির ফাঁকে-ফাঁকে খুঁজতে লাগলাম ধানসিড়ি নদীটি।

আগেকার বরিশাল এখন অনেক ভাগ হয়ে গেছে, মহাকুমাগুলি এখন ছোট ছোট জেলা। যেমন ঝালকাঠি (উচ্চারণ ঝালোকাটি), পটুয়াখালি এগুলোও এখন জেলা। সব মিলিয়ে এখানে বলা হয় বৃহত্তর বরিশাল। এই বৃহত্তর বরিশালই আমাদের পরিদর্শন এলাকা। আমরা গাড়ি নিয়ে ঘুরছি অনবরত। শহরের ছেলেরা কেউ ধানসিড়ি নদীর সন্ধান দিতে পারেনি, আমরা যে-কোনও নদীতে খেয়া পার হওয়ার সময় স্থানীয় লোকদের কাছে ধানসিড়ির খোঁজখবর নিই। কেউই সঠিক কিছু বলতে পারে না।

ঝালকাঠির দিকে যাওয়ার জন্য প্রায়ই আমাদের একটি নদী পার হতে হয়। এদিকের অনেক নদীর নামই বেশ সুন্দর, যেমন, একটি নদীর নাম সন্ধ্যা! কিন্তু এই নদীটির নাম মোটেই সুন্দর নয়, বরং অদ্ভুত, মানে বোঝা যায় না। ডাবখান! কেউ কেউ বলল, এটা নদী নয়, কাটা খাল, যদি তাও বা, তা হলেই বা একটা খালের নাম ডাবখান হবে কেন? সমুদ্রের কাছাকাছি এই নদীমাতৃক দেশে ডাব পাওয়া যায় সর্বত্র, এখানকার ডাবের আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, বরং এখানকার সোনালি মর্তমান কলার স্বাদ অপূর্ব! কলা নয়, যেন ক্ষীর।

যাই হোক, এই ডাবখান পারাপারের সময় একজন মাঝি জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ধানসিড়ি নদী আছে, ওই তো ওদিকে। ওদিক পানে অনেকগুলো নদী মিশেছে।

ডাবখান নদীর ধার দিয়ে বাঁধানো সড়ক নেই, মাঝিটি যেদিকটায় হাত তুলে দেখাল, সেদিকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে না। গাড়ি ছেড়ে দিয়ে নৌকো ভাড়া নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু খেয়ার লঞ্চ ছাড়া শুধু যাত্রী পারাপারের জন্য খেয়ার নৌকোও আছে, সে নৌকো ভাড়া নেওয়া যাবে না। অন্য কোনও নৌকো নেই, বহু নৌকোই নির্বাচনের ডিউটি দিচ্ছে। কোনওক্রমেই কি ওই অনেক নদীর সঙ্গম স্থানটিতে যাওয়া যাবে না? খেয়ার ঘাটে অন্যান্য লোকদের জিগ্যেস করলে সকলেই মাথা নেড়ে বলে, মুশকিল, এখান থেকে যাওয়া খুব মুশকিল। কেউ কেউ বিস্ময়ে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা অকিঞ্চিৎকর নদী দেখার জন্য আমাদের এই ব্যাকুলতার কারণ বুঝতে পারে না। কী আছে সেখানে?

তা হলে, ধানসিড়ি নদীটি জীবনানন্দের স্বকপোলকল্পিত নয়, একটা ওই নামের বাস্তব নদী কাছেপিঠে আছে ঠিকই, সচরাচর যাতায়াতের পথে পড়ে না। ডাবখানের তীরে আমরা বেশি সময় কাটালে আমাদের সঙ্গী আনোয়ার বিনীতভাবে আমাদের কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখনও অনেক পোলিং বুথ দেখা বাকি রয়ে গেছে। আমরা ফিরে যাই।

কিন্তু যদি মারামারি না হয়, বুথ দখল বা বোমা ছোঁড়ার ঘটনা না ঘটে, তা হলে আর দেখার কী আছে? ঘোরাঘুরির ফাঁকে ফাঁকে আমরা অন্য দ্রষ্টব্য স্থান দেখে নিই। যেমন ফজলুল হকের বসতবাড়িটি দেখা হয়ে গেল। বেশ বড়, অনেকখানি ছড়ানো বাড়ি, এখনও বেশ সমৃদ্ধ অবস্থা বোঝা যায়, সে বাড়ির একটি অংশ ফজলুল হকের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নিয়ে একটি সংগ্রহশালা করে রাখা হয়েছে। আমি ফজলুল হককে স্বচক্ষে দেখিনি। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের মতন চেহারাটিও যে বিশাল ছিল, তা তাঁর ব্যবহৃত চটি জুতো ও জল খাওয়ার গেলাসের আকৃতি দেখলেই বোঝা যায়।

ফজলুল হকের এক ছেলেও একজন রাজনৈতিক নেতা, এবারের নির্বাচনে প্রার্থী। জীবনানন্দ দাশের ছেলে ও মেয়ে দুজনেরই মৃত্যু হয়েছে, তাঁর বংশে আর কেউ নেই। ট্রামের ধাক্কায় জীবনানন্দ যখন নিহত হন, তখন কবি হিসেবে কজনই বা চিনত তাঁকে। তাঁর বাড়িটি সংরক্ষণের কথা কেউ চিন্তা করেনি, এমনকী কলকাতাতেও কত হেঁজিপেঁজি লোকের নামে রাস্তা আছে, জীবনানন্দ দাশের নামে কোনও রাস্তার নাম রাখা হয়নি। অন্তত ট্রাম কোম্পানি তো তাঁর স্মৃতিরক্ষার কোনও ব্যবস্থা করতে পারত।

যেন চুম্বকের টানে আমরা ডাবখানের তীরে ফিরে যাই বারবার। ঝালকাঠির দিকে কী যেন গণ্ডগোল হচ্ছে, এই উড়োকথা শুনে আমরা নদী পেরিয়ে সেদিকে গেলাম তৃতীয়বার।

ধানসিড়ি নামে নদী আছে, এটা জেনেই আমি সন্তুষ্ট, কিন্তু মিলন নিরুদ্যম হতে রাজি নয়। তার বয়েস কম, জেদি স্বভাব, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, সে ধানসিড়ি আবিষ্কার করবেই। এক জায়গায় একটা ছোট দোকানে সিগারেট কেনার জন্য থেমেছি, মিলন সেখানেও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে। হঠাৎ একজন লোক বলল, ধানসিড়ি যাবেন? এই পাশের সরু রাস্তাটা দিয়ে চলে যান না! মাইল দেড়েক যেতে হবে।

সে রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাবে? হ্যাঁ, যাওয়া যাবে অনেকখানি। এরকম একটা রাস্তা রয়েছে, তা আগে কেউ আমাদের বলেনি কেন? এ লোকটি কি সত্যি কথা বলছে? বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল নিয়ে আমরা এগোলাম সেই প্রথম কাঁচা রাস্তা ধরে। শেষ পর্যন্ত রাস্তাটা এসে থামল এক নদীর কিনারে। একটা খাঁটিয়ার ওপর কয়েকজন লোক বসেছিল, তাদের জিজ্ঞাসা করা হল, এটা কী নদী? তারা বলল, ধানসিড়ি।

এমন কিছু আহামরি রূপ নয় সে নদীর, তবু কেন নাম শোনামাত্র রোমাঞ্চ হল?

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে–এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয়–হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে;
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হব–কিশোরীর–ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে…

এককালে এই ধানসিড়ির তীরেও খেয়াঘাট ছিল, এখন ডাবখানের বুকে ফেরি লঞ্চ চলে। ওদিকে পাকা রাস্তা হয়ে গেছে, তাই এপাশে বিশেষ কেউ আসে না। এক সময় এ নদীও যেন চওড়া ছিল, এখন মজে গেছে, একদিকে চড়া পড়ে যাওয়ায় সেদিকে উঁচু বাঁধ দেওয়া। তবু এখনও এই নদী নাব্য, কিছু নৌকো চলাচল করে।

নদীর ঘাটে দাঁড়ালেই কি নদীকে চেনা যায়? নদীর সঙ্গে একটা শারীরিক সম্পর্ক হওয়া দরকার। সাহেবরা সেইরকম মনে করে। একবার জামশেদপুরের দিক থেকে সুবর্ণরেখা দেখতে গিয়েছিলাম। তখন সন্ধ্যা ঝুঁকে এসেছে নদীর ওপর, পশ্চিম আকাশের সূর্য থেকে সত্যিই অনেকগুলি সুবর্ণরেখা নেমে এসেছে জলে, আমরা প্রথাগতভাবে মুগ্ধ চোখে তাকিয়েছি, আমাদের সঙ্গী ছিলেন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ, তিনি প্যান্ট-শার্ট খুলে ফেলে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় নেমে গেলেন জলে। আর একবার একজন বেলজিয়ান কবি ভ্যারনার ল্যামবারসিকে নিয়ে কাকদ্বীপের দিকে বেড়াতে গিয়ে হারউড পয়েন্ট থেকে নৌকো ভাড়া করে গঙ্গায় ভ্রমণ করছিলাম, মাঝগঙ্গায় ভ্যারনার হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়লেন জলে। আমিও একবার, সেটা খুব সংগোপনে, মানসের জঙ্গলে মধ্যরাত্রিতে মানস নদী দেখে এমনই উতলা হয়েছিলাম, শরীর কাঁপছিল যৌন আবেগে, আর কেউ কোথথাও নেই, রুপোলি জ্যোৎস্নায় নদীটিকে মনে হয়েছিল নারী, সম্পূর্ণ পোশাক খুলে সাঁতার কাটার ছলে সঙ্গম করেছিলাম সেই নদীর সঙ্গে।

এখানে তা সম্ভব নয়। একটা নৌকো এসে থামতেই সেটি ভাড়া করা হল। মাঝির নাম ফারুক, তার খালি গা, লোহা-পেটা শরীর, সঙ্গে একটা দশ-বারো বছরের বাচ্চা ছেলে। ছেলেটি ওর নিজের নয়, অনাথ। আমরা কোথায় যাব? কোথাও যাব না, শুধু এই নদীতে কিছুক্ষণ ঘুরব শুনে ফারুক চোখ ছোট করে তাকিয়ে রইল।

এ নদীর প্রস্থ, বড়জোর বাগবাজারের খালের দেড়গুণ, কোনও দিকেই ধানখেত নেই। একদিকে গ্রাম, কিছু কিছু বাড়ি ও গাছপালা, ‘কাঁঠাল-ছায়া’ আছে কি না বোঝা গেল না। অন্যদিকে বাঁধের ওপর বাবলা গাছের ঝাড় লাগানো হয়েছে। ওই বাবলা গাছগুলি ফারুক মাঝির ঘোর অপছন্দ, তার ধারণা, ওর জন্য হাওয়া গরম হয়, বারবার বলতে লাগল, হাওয়া গরম, দেখেন না ঘাম হচ্ছে, এ বাতাস ভালো নয়। অনাথ ছেলেটির জন্য ফারুকের খুব মায়া, নিজের গামছাটা এগিয়ে দিয়ে তাকে ঘাম মুছে নিতে বলে।

আমরা নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য ফারুককে জিগ্যেস করি, তুমি ভোট দিতে যাবে না?

সে বলল, আলবাত যাব। ভোট নষ্ট করব কেন? ভিড় কমুক, বিকেলে যাব। সকালে গিয়ে লাইন দিলে রোজগার করব কখন?

আবার জিগ্যেস করা হল, কাকে ভোট দেবে, ফারুক মিঞা?

সে চোখ ঘুরিয়ে বলল, তা আপনাদের বলব কেন? আমার প্যাটের কথা কেউ জানতে পারবে না?

তার নৌকোর ছইতে এক নেত্রীর ছবি সাঁটা আছে। সেদিকে ইঙ্গিত করতে সে হি হি করে হেসে বলল, ছবি থাকলে চক্ষে ধূলো দেওয়া যায়। প্যাটের কথা তবু প্যাটেই থাকেই।

বলাই বাহুল্য, ফারুকের মুখের ভাষা একেবারে অন্য রকম। সে-ভাষা আমি বুঝলেও অবিকল লিপিবদ্ধ করা আমার সাধ্যাতীত। এই নিরক্ষর মাঝিটি তার গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে খুবই সচেতন।

কথা বন্ধ করে আমি সতৃষ্ণ নয়নে নদীর দু-দিকে চেয়ে থাকি। এককালে হয়তো এর ধারে ধারে ধানখেত ছিল। জীবনানন্দ কি কোনওদিন সত্যিই এই নদীর বুকে নৌকোয় ঘুরেছেন? কিংবা শহরের অন্য লোকেদের মুখে শুধু নামটাই শুনেছেন।

নদীগুলো খুব বদলে যায়। ধানসিড়ি এখন একটি অতি অকিঞ্চিৎকর ছোট নদী। আমি কপোতাক্ষ নদীতেও নৌকো চেপেছি, তার জল এখন কোনও মৃত পাখির চোখের মতন বিবর্ণ।

ক্রমশ ধানসিড়ি চওড়া হয়, সামনের দিকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ জলরাশি। ফারুক জানাল যে ওইখানে সাতখানা নদী এসে মিশেছে, ওখানে গেলে ঘূর্ণিতে পড়তে হবে। সুতরাং আমরা আবার নৌকো ঘোরাতে বললাম।

এই নদীর নামটি জীবনানন্দের এমনই ভালো লেগে গিয়েছিল যে তিনি বেশ কয়েকটি কবিতায় এই ধানসিড়ির উল্লেখ করেছেন।

এ সব কবিতা আমি যখন লিখেছি বসে নিজ মনে একা;
চালতার পাতা থেকে টুপটুপ জ্যোৎস্নায় ঝরেছে শিশির;
কুয়াশায় স্থির হয়ে ছিল ম্লান ধানসিড়ি নদীটির তীর…

ফারুক মাঝির কথাবার্তা এমনই চিত্তাকর্ষক যে এরপর আমরা নদীটিকে ভুলে গিয়ে তার দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিই। সে কবিতা কাকে বলে জানেই না, তবু সে বলে যে যখন বাতাস থাকে না, তখনই বাবলা গাছগুলোর ভেতর থেকে গরম হাওয়া বেরিয়ে আসে, এই নদীর জল

বড় গম্ভীর, ভোটের ঝগড়াঝাঁটি শেষ না হলে বৃষ্টিধারা নামবে না, ভোটের রেজাল্ট শোনার জন্য মেঘ চুপ করে বসে আছে…

এই ফারুককে নিয়ে কবিতা লেখা কত শক্ত!