[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৩. এ নদীর নাম বিদ্যা

এ নদীর নাম বিদ্যা। সরস্বতী নামের এক পৌরাণিক নদীর অস্তিত্ব নিয়ে কত মাথা ফাটাফাটি তর্ক-বিতর্ক চলেছে, বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নামে সেই পুণ্যবাহিনী নদীর এখনও খোঁজ মেলেনি। এই সাদাসিধে বিদ্যা নামের নদীটির সঙ্গে লেখাপড়ার কোনও সম্পর্ক নেই, এর দু তীরের বহু মানুষ নিরক্ষর, স্কুল-কলেজের সংখ্যা ভয়াবহ রকমের কম।

তবু এ নদীর নাম বিদ্যা কেন? শহর, গঞ্জ, গ্রামের নামের উৎপত্তি সম্পর্কে তবু কিছু লেখালেখি হয়েছে, নদীগুলির নামকরণের কোনও ইতিহাস আমার চোখে পড়েনি। এমনকী পশ্চিম বাংলার সমস্ত নদীগুলির পরিচয় সমন্বিত কোনও বইও নেই, বাংলাদেশে কিন্তু আছে, সে বইয়ের নাম ‘বাংলা দেশের নদনদী’, এক ইঞ্জিনিয়ার ভদ্রলোক অনেক খেটেখুটে লিখেছেন।

কলকাতার অনেক মানুষই সুন্দরবন চেনে না। বাঙালিরা অনেকেই পালামৌ, হাজারিবাগ যায় জঙ্গল দেখতে, এমনকী কানহা কিংবা মানস কিংবা গির অরণ্যেও যায়। অথচ বাড়ির কাছে সুন্দরবন অনেকে সারাজীবনেও চোখে দেখেনি। অনেকে এখনও সুন্দরবনের নাম শুনলেই ভয় পায়, যেন সেখানে সব সময় গজরে-গজরে ঘুরছে বাঘ আর ফোঁসফোঁস করছে সাপ। অবশ্য কিছুকাল আগেও সুন্দরবনে ট্যুরিস্ট লজ কিংবা ভালো কোনও থাকার জায়গা ছিল না। এখন হয়েছে, লঞ্চে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার নিয়মিত ব্যবস্থাও আছে।

আমি যখন প্রথম যাই, বহু বছর আগে, তখন সুন্দরবন ছিল অনেকটাই গা ছমছমে দুর্গম, যদিও কলকাতা থেকে দূরত্ব তেমন কিছুই না।

ইস্কুলে পড়ার সময় থেকেই আমার ঘুরে বেড়ানোর নেশা। দু-তিন বন্ধুকে সঙ্গী করে চলে যেতাম এদিক-ওদিক। সুন্দরবনের দিকে আমাদের প্রথম অভিযান ক্যানিং পর্যন্ত, তখন কত বয়স হবে, পনেরো-ষোলো! সুন্দরবনে যাওয়ার কথা ভাবিনি, তখনও সংঘবদ্ধভাবে, বন্দুক টন্দুক না নিয়ে বেড়াবার প্রশ্নই ছিল না সেখানে। আমাদের ক্যানিং বেছে নেওয়ার কারণটি বেশ মজার। কেউ একজন বলেছিল, ক্যানিং এমনই একটি বিচিত্র শহর, যেখানে দিনেরবেলা সবাই ঘুমোয় আর সারারাত জেগে থাকে। আমাদের সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত হৃদয়ে তখনও লেগেছিল রূপকথার রেশ। এরকম শহরের কথা তো রূপকথাতেই থাকে। ট্রেনের টিকিট কেটে মাত্র তিন ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছনো যায়? এমন রহস্যময় জায়গায় যেতেই হবে।

ক্যানিং এখন বেশ উন্নত, আধুনিক হয়েছে, তখন ছিল নিতান্তই টিমটিমে মফসসল। তখনও অবশ্য ক্যানিংকে বলা হত সুন্দরবনের সদর দরজা।

আমরা চারবন্ধু পৌঁছলাম সন্ধের পর। তখনও ইলেকট্রিক ট্রেন চালু হয়নি। কয়লার ইঞ্জিনে, ঢিকিস-টিকিস করে যেতে সময় লেগেছিল তিন ঘণ্টারও বেশি।

বলাই বাহুল্য, আমাদের সেই অভিযানের পরিণতি হয়েছিল খুবই হাস্যকর ও করুণ। খামোকা ক্যানিংয়ের লোক সারারাত জাগতে যাবে কেন? সেই লোকটি আমাদের ডাহা ধাপ্পা দিয়েছিল।

আসলে ক্যানিংয়ে একটি বেশ বড় মাছের বাজার আছে। সেই বাজারটাতেই সারারাত হ্যারিকেন আর হ্যাজাক বাতি জ্বলে। সন্ধের পর থেকে সেখানে মাছ ধরা নৌকোগুলো জড়ো হয় বিভিন্ন নদী ও সমুদ্র থেকে। মাছের আড়তদাররা সেই মাছ কিনে ভোর-ভোর চালান দেয় কলকাতায়। অর্থাৎ বাজারটিতেই শুধু জেলে, মাছওয়ালা, পাইকার ও ফড়েদের ভিড়। চতুর্দিকে আঁশটে গন্ধ। মিনিট পনেরোর বেশি সেখানে ঘোরা যায় না। ফেরার আর ট্রেন নেই, সারারাত আমাদের শুয়ে থাকতে হয়েছিল প্ল্যাটফর্মে, তেলেভাজা-মুড়ি খেয়ে। উপরন্তু খাদ্য ছিল মশার কামড়।

একটি দর্শনীয় ব্যাপার ছিল বটে। গঞ্জ এলাকায় অনেক খরিদ্দার, বিক্রেতা আর পাইকারদের ভিড় হয়, তাদের সঙ্গে থাকে কাঁচা টাকা, তাই প্রত্যেক গঞ্জেই থাকে বেশ্যাপল্লি। এর আগে আমরা ওরকম পল্লি দেখিনি। একটা বড় পুকুরের ধারে, একটা পিচ্ছিল কাঁচা রাস্তার ধারে সারি সারি ঘর, প্রত্যেক দরজার সামনে হাতে লম্ভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মুখে খড়ি মাখা স্ত্রীলোকেরা, খানিকটা দূর থেকে সেই দৃশ্য যেন কেমন অলৌকিক মনে হয়েছিল। ছবিটা মনে গেঁথে আছে।

সেইটুকুই যা রহস্য রোমাঞ্চ!

তার কয়েক বছর পরই সরাসরি সুন্দরবনে।

এবার অন্য একজন বন্ধুর সঙ্গে, যাদের একটা পারিবারিক খামারবাড়ি ছিল সুন্দরবন লাট এলাকায়। সেইজন্য ওই অঞ্চলটি তার চেনা।

এবারেও প্রথমে ট্রেনে ক্যানিং, তারপর লঞ্চে চেপে গোসাবা। এই গোসাবাই সুন্দরবনের প্রাণকেন্দ্র, যদিও মোটেও শহর বলা যায় না। একটি সুদৃশ্য কাঠের বাড়ি শুধু দেখবার মতো। ওখানে নাকি একবার রবীন্দ্রনাথ এসে থেকেছিলেন কিছুদিন। কিন্তু তাঁর লেখায় সুন্দরবনের বিশেষ উল্লেখ নেই।

গোসাবার পাশেই বিদ্যা নদী। সেই নদীতে আর একটি ছোট লঞ্চে চেপে বন্ধুটির গ্রামে, সে গ্রামটির নাম মনে পড়ছে না। সেখানে খাতির-যত্ন পাওয়া গিয়েছিল ভালোই, টাটকা মাছ-মুরগি, কিন্তু সব মিলিয়ে হতাশই হয়েছিলাম। কোথায় সুন্দরবন? বাঘের ডাক শোনা তো দূরের কথা, কাছাকাছি কোনও জঙ্গলই নেই। এমনই একটা সাধারণ গ্রাম, চাষ-বাসের খেত, নদী-নালা। হিংস্র প্রাণী দেখেছিলাম একটি মাত্র, সে দেখাঁটি সত্যি রোমহর্ষক। অতীব হাস্যকরও বটে।

আমার জন্ম যদিও পূর্ববঙ্গের গ্রামে, কিন্তু একেবারে শিশু বয়েস থেকেই গ্রাম-বিচ্যুত এবং পুরোপুরি শহুরে হয়ে গেছি।

বন্ধুটির গ্রামে গিয়ে বহুঁকাল পরে পুকুরের জল খেতে হবে শুনে প্রথমে শিউরে উঠেছিলাম। এখন আমাদের সকলেরই স্বাস্থ্যজ্ঞান টনটনে। কলেরা-ভীতি, টাইফয়েড-ভীতি কার না আছে? গ্রামের পুকুরে বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা সবই চলে, মানুষের সঙ্গে সঙ্গে গরু-মোষও চান করে, ভ্যানগাড়িও দেওয়া হয়। তবে শুনলাম, একটি বিশেষ পুকুরে স্নান, গরু-মোষ নামানো নিষিদ্ধ, তাকে বলে মিষ্টি পুকুর, তার জলই পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গ্রামের সব লোক সেই জল খায়, আমার বন্ধুটিও, সুতরাং আমি আর আপত্তি না জানিয়ে ভাবলাম, দেখাই যাক না!

কিন্তু একটা ব্যবস্থা কিছুতেই আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হল না! মাঠে গিয়ে বড় বাথরুম (এটাই এখনকার ভব্য বাংলা)। গোটা গ্রামেই একটাও বাথরুম নেই। সবাই মগ হাতে নিয়ে মাঠেঘাটে যায়। মেয়েরা পর্যন্ত!

পশ্চিম বাংলার আরও অনেক গ্রামে আমি এরকম বাথরুমহীনতা দেখেছি। ওই ব্যাপারটি যেন একেবারেই অবান্তর। কোনও একটি গ্রামে সন্ধের সময় ঘণ্টাখানেক পুরুষ মানুষদের নদীর ধারে যাওয়া নিষেধ ছিল, সেই সময়টায় স্ত্রীলোকেরা ওই কাজ সারতে লাইন বেঁধে বসে পড়ত। কোনও মহিলার কি দিনেরবেলা বেগ আসতে পারে না, তারা কী করে?

আসলে প্রাইভেসি ব্যাপারটা সভ্যতার উচ্চস্তরের অঙ্গ। আমরা গ্রামে-গঞ্জে এখনও সেই উচ্চস্তরে উঠিনি। এমনকী প্রাইভেসি শব্দটির সঠিক বাংলা প্রতিশব্দও নেই।

তুলনামূলকভাবে পূর্ব বাংলায় এ ব্যাপারে সচেতনতা ছিল। সেখানকার গ্রামে স্নানের জন্য কোনও আব্রু থাকত না বটে, তা সেরে নেওয়া হত নদী বা পুকুরঘাটে, কিন্তু অতি দরিদ্রের বাড়িতেও বড় বাথরুমের জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান থাকত।

প্রকাশ্যে মাঠে-ঘাটে মগ নিয়ে যাওয়ায় আমার ঘোরতর আপত্তি দেখে বন্ধুটি আমার জন্য চটপট একটি বাথরুম তৈরি করে দিল। অর্থাৎ বাড়ির পিছন দিকে একটা গর্ত খুঁড়ে পেতে দেওয়া হল কয়েকটা ইট, আর তালগাছের কয়েকটি পাতা কেটে গর্তটার চারপাশে পুঁতে দিতেই হয়ে গেল আব্রু। সেখানে গিয়ে সবেমাত্র বসেছি, অমনি তালপাতায় খড়মড় শব্দ হল এবং আমার চক্ষু চড়কগাছ। চিড়িক-চিড়িক করে জিভ বার করতে-করতে সেখান দিয়ে ঢুকছে একটা মস্ত মোটা সাপ! এর থেকে ভীতিজনক ও অস্বস্তিকর অবস্থায় আর কোনও মানুষ পড়েছে কি? আমার তখন পালাবারও উপায় নেই। শুনেছিলাম, একেবারে নড়াচড়া না করলে সাপ নিজে থেকে দংশন করে না, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে কাঠের মূর্তি হয়ে রইলাম। সাপটা একটা মালগাড়ির মতো লম্বা, আসছে তো আসছেই, এবং মালগাড়ির থেকেও ধীর গতি এবং আঁকাবাঁকা, সর্পিল গতি যাকে বলে।

বলাই বাহুল্য, শেষ পর্যন্ত আমি সর্পদংশিত হইনি। সেটা নির্বিষ দাঁড়াস এবং বাস্তু সাপ শুনেও মোটেই সান্ত্বনা পাইনি, আর একদিনও থাকতে চাইনি সেখানে।

কিন্তু সেবারেই সুন্দরবন দেখা হয় সবিস্তারে। গোসাবায় ফিরে এসে আরও দুটি গ্রামে গেলাম। রাঙাবেলিয়া ও সাতজেলিয়া। রাঙাবেলিয়া গ্রামটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এককালের বিপ্লবী ও পরবর্তীকালে গান্ধিবাদী সমাজসেবী পান্নালাল দাশগুপ্তের সংস্থা টেগোর সোসাইটি এখানকার স্থানীয় মানুষদের জন্য অনেক কাজ করেছেন। রাঙাবেলিয়ায় কিছু স্যানিটারি বড় বাথরুম পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে। মাছ ধরা যাদের জীবিকা এবং সুন্দরবনের গহনে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যারা মধু সংগ্রহ করতে যায়, দারিদ্র্য ছিল তাদের চিরসঙ্গী, এখন অবস্থার উন্নতি হয়েছে অনেকটা। এর কাছাকাছি একটা গ্রামের নামই হয়ে গিয়েছিল বিধবা গ্রাম, সেখানে বিধবার সংখ্যা খুব বেশি, কারণ তাদের স্বামীরা জঙ্গলে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে অকালে বাঘের মুখে প্রাণ দিয়েছে। এখন আর সচরাচর সেরকম ঘটে না।

রাঙাবেলিয়ায় তখন একজন আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তাঁর নাম তুষার কাঞ্জিলাল। সেই সময়ে ইনি ছিলেন ওখানকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, এ ছাড়াও তিনি গ্রামের সঙ্গে বিশাল কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। তার বিস্তৃত পরিচয় এখানে দেওয়া যাবে না। তুষারবাবুর আমন্ত্রণে আমি পরে বেশ কয়েকবার রাঙাবেলিয়ায় গিয়ে থেকেছি এবং ঘুরে দেখেছি।

তুষার কাঞ্জিলাল একজন চমৎকার লেখক। গ্রামের মানুষদের সুখ-দুঃখের কথা, একেকটি মুখ সামান্য কয়েকটি আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলার মতো ভাষার দক্ষতা ইদানীং আমি অন্য কোনও লেখকের মধ্যে দেখিনি। অনেক বঞ্চনা ও দীর্ঘসূত্রতার কথা তিনি লেখেন, কিন্তু তার মধ্যে তিক্ততা বা ক্রোধ প্রকাশ পায় না, থাকে শ্লেষ ও কৌতুক! এমন লেখার ক্ষমতা যদি আমার থাকত!

এই রাঙাবেলিয়াতেই বহুঁকাল ধরে রয়েছে কবি বিনোদ বেরা। সে একজন চাষি, নিজের হাতে সামান্য জমি চাষ করে কোনওক্রমে সংসার চালায়। ‘দেশ’ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যাতেও ছাপা হয় তাঁর কবিতা। বিনোদ বেরা একজন আধুনিক কবি হিসেবে গণ্য, অথচ জমি চাষ করাই তাঁর জীবিকা, এমন দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত আর নেই।

রাঙাবেলিয়া থেকে সাতজেলিয়া গ্রামে যেতে হয়েছিল পায়ে হেঁটে, মাঝখানে খেয়া নৌকোয় নদী পেরিয়ে।

সাতজেলিয়া গ্রামটি বেশ বড়, সেটাই বলতে গেলে শেষ জনবসতি, তারপর বাঘের এলাকা। সাতজেলিয়াতে যার বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছিলাম, সেও একজন আলাদা ধরনের মানুষ। সে দক্ষিণ কলকাতার একটি সম্পন্ন পরিবারের সন্তান, লেখাপড়া অনেকখানি শিখে ভালো চাকরি করছিল। অর্থাৎ সহজভাবে নিরুদ্বেগ, সফল জীবনযাপনে তার কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ চাকরি-বাকরি ছেড়ে সে সাতজেলিয়ায় চলে এসে চাষবাস শুরু করে। এখানে তাদের কিছু পৈতৃক জমি ছিল এবং বাথরুম সমেত একটি ছোট পাকা বাড়ি, সে আধুনিক প্রথায় চাষ শুরু করে, যাতে গ্রামের অনেক মানুষের উপকার হয়, নিজেরও জীবিকার সংস্থান হয়।

সুন্দরবনের চাষ মানে অনিশ্চয়তার সঙ্গে সর্বক্ষণ লড়াই। প্রকৃতি এখানে বিমুখ, প্রবল ঝড়বৃষ্টি তো আছেই, নোনা জল জমিতে ঢুকে পড়লে দু-এক বছর সে জমি নিষ্ফলা হয়ে যায়। আমার সেই বন্ধুটি দাঁতে দাঁত কামড়ে সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। তার স্ত্রী এই সন্ধের পর অন্ধকারে ডুবে থাকা (বিদ্যুৎ নেই) গ্রামে এসে থাকতে রাজি হয়নি, তা ছাড়া ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে লেখাপড়া করাবার জন্য কলকাতাতেই রয়ে গিয়েছিল। কলকাতায় বন্ধুটিকে আগে শৌখিন প্যান্টশার্ট পরতে দেখেছি, গ্রামে সে লুঙ্গি এবং গেঞ্জি পরে নদীর ঘাটে বসে স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিত অনায়াসে। সিগারেটের বদলে বিড়ি ধরেছিল।

এবার নদীর কথা।

ক্যানিং থেকে আমরা লঞ্চে যে নদীবক্ষে যাই, সে নদীর নাম মাতলা। সেটি বেশ বড় নদী। মাতলার তুলনায় বিদ্যা নদীর দৈর্ঘ্য বেশিনয়। কিন্তু তেজ আছে।

এই বিদ্যা নদীতে নৌকোয় করে ঘুরেছি অনেকবার। ভোরবেলা যাত্রা করে সারাদিনের জন্য বেরিয়ে পড়া। সন্ধের আগেই ফিরে আসা উচিত, তাও দুয়েকবার হয়নি।

সঙ্গে চাল, ডাল ও অন্যান্য খাদ্য পানীয়, নৌকোতেই রান্না-বান্না। এই নদী ধরে একদিকে গেলে সমুদ্রের মুখে পড়া যায়, অন্যদিক দিয়ে চলে যাওয়া যায় বৃহৎ ও দুর্দান্ত রায়মঙ্গল নদীতে, তার পাশেই বাংলাদেশের সীমান্ত। বাংলাদেশের যমুনা নামে একটি নদী এসে মিশেছে রায়মঙ্গলে। জলের ওপর সীমারেখা টানা যায় না, তাই এখানকার নৌকোগুলোতে কোনওটায় ওড়ে ভারতের পতাকা, কোনওটায় বাংলাদেশের।

বিদ্যা নদী দিয়ে যেতে-যেতে একসময় কোনও জনবসতি চোখে পড়ে না, শুধু জঙ্গল। সুন্দরবনে বড় গাছ বা মহিরূহ প্রায় নেই-ই বলতে গেলে, সব গাছই বেঁটে-বেঁটে, সুঁদরি বা সুন্দরী নামের গাছের জন্যই এ জঙ্গলের এমন নামকরণ, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে কোনও মিল নেই, এ জঙ্গল সুদৃশ্য নয়। মানুষখেকো বাঘের নিবাস বলেই এ জঙ্গলের দিকে তাকালে দিনেরবেলাও গা ছমছম করে। এবং সেটাই এ জঙ্গলের আকর্ষণ।

এখানকার বাঘের দিন বা রাত্রি নেই। এ বাঘ নিয়ে একেবারেই ছেলেখেলা চলে না। কৌতুকের ছলে কোনও শহুরে পর্যটক এখানে এসে নৌকো থেকে একবার জঙ্গলের ধারে নেমেছে, অমনি সঙ্গে-সঙ্গে বাঘ এসে তাকে ঘাড় কামড়ে ধরে নিয়ে গেছে, এরকম ঘটনা গল্প হলেও সত্যি। নদীর ধারে-ধারে দুরকম গাছ দেখা যায়, ম্যানগ্রোভ আর হেঁতাল। চাঁদ সদাগরের হেঁতালের লাঠির সঙ্গে এই হেঁতালের কোনও মিল নেই, ঝোঁপ ধরনের, পাতাগুলিতে সবুজের মধ্যে কিছুটা হলদের আভাস, বাঘের পক্ষে এর মধ্যে গা-ঢাকা দিয়ে থাকা আদর্শ, কামুক্লাজ যাকে বলে। শোনা যায়, নদী বা খাঁড়ির মধ্যে নৌকো চলার সময় বাঘ আড়াল থেকে একেকটা নৌকো অনুসরণ করে আসে মাইলের পর মাইল। মানুষের সামান্য দুর্বলতার জন্য অপেক্ষা করে।

দিনেরবেলা চলন্ত নৌকোর ওপরে যে বাঘ লাফিয়ে পড়ে না, তার কারণ, বাঘের স্বভাবই এই, সে মুখোমুখি মানুষের সঙ্গে সংগ্রামে লিপ্ত হতে চায় না। সুন্দরবনের সব বাঘই মানুষকে আক্রমণ করে অতর্কিতে পিছন দিক থেকে। ঘাড়টা প্রথমে কামড়ে ধরে মট করে ভেঙে দেয়। এই জন্য অনেক কাঠুরে ও মধুসংগ্রহকারী জঙ্গলে ঢোকার সময় মাথার পিছনে একটা মানুষের মুখ আঁকা মুখোশ বেঁধে নেয়, যাতে বাঘ মনে করে মানুষটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এতে আক্রমণের সংখ্যা অনেক কমে গেছে।

রাত্তিরে মাঝনদীতে নৌকো বেঁধে রাখাও খুবই বিপজ্জনক। মিশমিশে অন্ধকারে বাঘ প্রায় নিঃশব্দে নদী সাঁতরে এসে নৌকা থেকে মানুষ তুলে নিয়ে গেছে, এরকম দৃষ্টান্ত আছে। এমনও হয়েছে, নৌকো থেকে একজন লোককে বাঘে নিয়ে গেল, অন্যরা তা টেরও পেল না।

আমরাও একবার প্রায় সেরকম বিপদের মুখে পড়েছিলাম। বিদ্যা নদী ধরে যেতে-যেতে একসময় মনে হয়, পৃথিবীতে জঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ আর অজস্র খাঁড়ি। আমি দেশে বা বিদেশের জঙ্গলে একাধিকবার বাঘ দেখলেও সুন্দরবনে কখনও স্বচক্ষে বাঘ দেখিনি। এখানকার লোকে বলে, যে বাঘের দেখা পায়, সে আর সেই বাঘের রূপ বর্ণনা করার জন্য বেঁচে থাকে না। তবে সুধন্যখালিতে বাঘের টাটকা পায়ের ছাপ কিংবা সজনেখালিতে সদ্য বাঘের কামড়ে অর্ধমৃত একজন মানুষকে দেখেছি। আর দেখেছি কুমির। খুব ছোটবেলায় স্টিমারে যেতে যেতে পদ্মার চরে কুমিরদের রোদ পোহাতে দেখেছিলাম। অনেককাল পরে সেরকম দেখেছি সুন্দরবনে।

প্রথমবার বিদ্যা নদীতে ভ্রমণে কোনও ঘটনা ঘটেনি। শুধু দৃশ্য অবলোকন ও নিজেদের মধ্যে আমোদ-প্রমোদ হয়েছিল। তাই দ্বিতীয়বার ভয় ভেঙে গিয়েছিল অনেকখানি।

এবারে গোসাবা থেকে যাচ্ছিলাম মাধবকোটির দিকে। তাড়াহুড়ো নেই, মাঝি দুজন নৌকো চালাচ্ছিল ধীরে-ধীরে। জোয়ার-ভাটার হিসেব করে একবার থামতেও হয়েছিল লোকালয় দেখে। নৌকোতেই রান্না হয়েছিল খিচুড়ি, জেলেদের নৌকো থেকে কেনা হয়েছিল চিংড়ি ও তোপসে মাছ। এমন টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা, খিচুড়ি একটু-একটু করে নিতে-নিতে ঠিক কতটা খাচ্ছি বোঝা যায় না, সুতরাং গুরুভোজন হয়ে গিয়েছিল।

শীতকাল, রোদ্দুর যেমন আরামের, তার সঙ্গে হাওয়া দিলে ঘুমও এসে যায়। খানিকটা দিবানিদ্রার পর জেগে উঠে দেখি, আকাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি সন্ধে হওয়ার কথা নয়, শীতের আকাশ হঠাৎ ছেয়ে গেছে মেঘে।

তার ওপরে, মাঝিদের মুখে একটা কথা শুনে পিলে চমকে গেল।

মাঝিরা পথ হারিয়ে ফেলেছে।

এখানে নদীর গায়ে-গায়ে অন্য নদী, প্রচুর উপনদী, শাখানদী, মাঝিরা কী করে নিশানা ঠিক রাখে কে জানে। হয়তো আকাশের সূর্য দেখে। এখন সূর্য অদৃশ্য। পূর্ব-পশ্চিমও বোঝার উপায় নেই।

ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কা তো আছেই, আমরা ফিরব কোন দিক দিয়ে? মাঝি দুজন রীতিমতো ঘাবড়ে গেছে।

রাত্তিরবেলা সব নদীই রহস্যময়ী হয়ে যায়। দুদিকের কিছুই দেখা যায় না বলে মনে হয় বিদ্যা নদী যেন অনেক চওড়া হয়ে গেছে। আলো দেখলে গ্রামের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, আলো না থাকলেই জঙ্গল। কোথাও এক বিন্দু আলো নেই বলে কোনও পাড়ের দিকে যেতে মাঝিরা ভরসা পাচ্ছে না।

প্রথম সমস্যা দেখা দিল পানীয় জলের। আমরা হিসেব করে জল এনেছিলাম, খিচুড়ি খাওয়ার পর তেষ্টা বেড়ে যায়, সব জল ফুরিয়ে গেছে। আমরা নদীর বুকে ভাসছি, তবু যেন মরুভূমি। বিদ্যা নদীর জল এক আঁজলা মুখে দিয়ে দেখেছি, অসহ্য রকমের নোনতা, বমি এসে যায়।

বাঘের ভয়ে অন্ধকার তীরে তরী ভেড়ানো যাবে না। মাঝনদীতেও কিন্তু রাত্তিরবেলা স্বস্তি নেই। এইসব সীমান্ত অঞ্চলে ডাকাতের উৎপাত লেগেই আছে। ডাকাতরা কোনও সীমারেখা মানে না। এখানকার ডাকাতরা পালিয়ে যায় বাংলাদেশে, ওখানকার ডাকাতরা লুকোয় এসে পশ্চিম বাংলায়। এখানকার ডাকাতরা এমনই ছ্যাঁচড়া যে জামা-প্যান্ট কেড়ে নেওয়ার জন্যও মানুষ খুন করে। এসব ঘটনা কোনওদিন কাগজে ছাপা হয় না। সেইজন্যই অন্য কোনও নৌকো দেখলে সাহায্য চাইতেও ভয় হয়। অন্য কোনও নৌকো অবশ্য একটাও দেখা যায়নি। আকাশে মেঘ জমলে সুন্দরবনের নদীতে বেরুতে ডাকাতরাও ভয় পায়। বেশ কিছুক্ষণ ধরে নৌকোটা চলছে তো চলছেই। আমরা সবাই চুপচাপ, যেন নিরুদ্দেশের যাত্রী। কোথাও থামার উপায় নেই, অথচ কোনদিকে যাচ্ছি তাও জানি না।

এই রকম সময়ে বিপদ যেন ভারসাম্যে দোলে। ঝড় উঠলে নৌকো উলটে কুমিরকামটে ভরা নদীতে পড়ব। নৌকো পাড়ে লাগলে সেখানে কটা হিংস্র বাঘ অপেক্ষা করে আছে কে জানে। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘের একেবারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঝড় না উঠলে ডাকাতরা বেরিয়ে পড়তে পারে, তা হলে তো সোনায় সোহাগা!

আবার একটুর জন্য বেঁচে যাওয়াও যায়।

সবেমাত্র বাতাসের বেগ প্রবল হচ্ছে, এমন সময় দূরে একটা আলোর বিন্দু দেখে আমরা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম। আলোর বিন্দুটি সঞ্চরণশীল নয়, অর্থাৎ ওখানে বসতি আছে। জোরে জোরে নৌকো চালানো হল সেদিকে।

আলোর বিন্দু একটিই মাত্র, কাছাকাছি গিয়েও অন্য আলো দেখা গেল না, তার মানে ওখানে গ্রাম নেই। আরও কাছে যেতে কেউ একজন, সেই আলোর দিক থেকে একটা হুঙ্কার ভেসে এল, কে আসে? তোমরা কারা, পরিচয় দাও!

সেটা একটা ফরেস্ট চেকপোস্ট। জায়গাটার নাম দত্তের বাগান। রাতে নৌকো চালানোর মতো ছেলেমানুষি হঠকারিতার জন্য সেখানকার বন্দুকধারী রক্ষীরা আমাদের প্রচুর ধমক দিল।

তবে, রাতটার মতো আমাদের আশ্রয় ও আতিথ্যও দিয়েছিল, তাদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।