[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

কফি বানিয়ে দিচ্ছিলেন দালি নিজে

কফি বানিয়ে দিচ্ছিলেন দালি নিজে

শরৎকালের এক সকালে অ্যালেন গিনসবার্গ ও গ্রেগরি করসসা, এই দুই কবির সঙ্গে আমি হাঁটছিলুম, নিউ ইয়র্কের রাস্তায়। আমাদের গন্তব্য লি রয় জোনস নামে একজন কৃষ্ণকায় কবি ও নাট্যকারের বাসস্থান; এই লি রয় জোনস পরবর্তীকালে কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের এক উগ্রপন্থী নেতা হয়েছিলেন, সঙ্গে রিভলভার রাখতেন, কিন্তু সে সময়ে তাঁর মস্তিষ্ক সবে উষ্ণ হতে শুরু করেছে, আগের রাত্রে এক পানশালায় গ্রেগরি করসোর সঙ্গে তাঁর জোর কথা কাটাকাটি হয়েছে। কবি-লেখকদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি সব দেশেই হয়ে থাকে। অ্যালেন গিনসবার্গের মাথা ঠান্ডা, তাকে সবাই মানে, তাই সে চলেছে, দুজনের মিটমাট করে দিতে। আমি তখন দিন পনেরো ধরে অ্যালেনদের অ্যাপার্টমেন্টে অতিথি, পালা করে রান্না করি, ঘর ঝাঁট দিই, বাজারে যাই এবং কখনও সবাই মিলে একসঙ্গে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ গান গাই। সেই সকালে আমার কিছু করণীয়। ছিল না, তাই আমাকেও সঙ্গে নিয়েছিল অ্যালেন।

লোয়ার ইস্ট সাইডের তিন নম্বর রাস্তা, এটা গরিবদের পাড়া। বাপ-মা খেদানো শ্বেতাঙ্গ ছেলে-মেয়ে, কৃষ্ণাঙ্গ বেকার কিংবা মজুর, মারকুটে, পোরতোরিক্যান, বেশ কিছু নানা জাতের নেশাখোরদের সঙ্গে কিছু কিছু শিল্পী-কবিরাও তখন এ পাড়ায় থাকত। বাড়িগুলো উঁচুর দিকে লম্বা লম্বা বস্তির মতন, লিফট নেই, লঝঝড়ে সিঁড়ি, দেওয়ালে নানারকম অসভ্য কথা লেখা। পরে আরেকবার গিয়ে দেখেছি, সেইসব অনেক বাড়িই ভেঙে ফেলা হয়েছে। ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’ নামে একটি বিখ্যাত ফিলমে সেই পাড়াটির তৎকালীন ছবি বিধৃত হয়ে আছে।

সেই সকালটি ছিল মনোরম, রৌদ্রকরোজ্জ্বল, পথে অনেক ঝলমলে মানুষ। এসব রোদকে সাহেবরা বলে গ্লোরিয়াস সানশাইন। হঠাৎ থেমে গিয়ে অ্যালেন রাস্তার বিপরীত দিকের একজন মানুষের দিকে আঙুল দেখিয়ে জিগ্যেস করল, ওই লোকটিকে চেনো?

সেই লোকটির দিকে অনেকেই ফিরে ফিরে দেখছে। বেশ মোটা-সোটা দীর্ঘকায়, গায়ে একটা সোনালি রঙের জ্যাকেট, সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তার গোঁফটি, মোম দিয়ে পাকানো, দু-দিকে একেবারে খাড়া। সব মিলিয়ে অনেকটা যেন হরতনের গোলামের মতন। আমি দু’দিকে মাথা নাড়তেই অ্যালেন বলল, সালভাদর দালি। চলো, আলাপ করবে?

গ্রেগরি করসোর তাতে আপত্তি। সে বলল, না, না, ছাড়ো ওর সঙ্গে দেখা হলেই ও অনেকক্ষণ বকবক করবে!

কিন্তু ইতিমধ্যেই দালি আমাদের দলটিকে দেখতে পেয়েছেন। অ্যালেনের দিকে হাত তুলে দাঁড়াবার ইঙ্গিত করে তিনি সমস্ত ট্র্যাফিক অগ্রাহ্য করে লম্বা লম্বা পা ফেলে পেরিয়ে এলেন রাস্তা। চেহারা ও পোশাকেও দালি এমনই বিশেষ দ্রষ্টব্য যে তাঁর জন্য সব গাড়ি থেমে যায়।

আমি সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চিত এবং নির্বাক। আমার তখন হিরো ওয়ারশিপের বয়েস, আমি দালির এমনই ভক্ত যে মনে হল চোখের সামনে এক দেবতাকে দেখছি। দালির একটি ছবির অনুপ্রেরণায় আমি ‘জ্বলন্ত জিরাফ’ নামে একটি কবিতা লিখেছি মাত্র কয়েক মাস আগে। সেই মহান শিল্পী আমার চোখের সামনে? আমরা দেশে থাকতে ইমপ্রেশনিস্ট, পোস্ট ইমপ্রেশনিস্ট, কিউবিস্ট, সুররিয়ালিস্ট শিল্পীদের নিয়ে মাতামাতি করি, কিন্তু মুল ছবিগুলি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয় না। দুধের বদলে পিটুলিগোলার মতন ছবির বইতে ছোট-ছোট প্রিন্টই আমাদের সম্বল। আমরা ছবিগুলির কাহিনি অনেক জানি কিন্তু ছবিগুলির প্রকৃত শিল্প-উপভোগের সুযোগ পাই না। সেইজন্যই নিউ ইয়র্কে এসে আমি ক্ষুধার্তের মতন মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম, গুগেনহাইম মিউজিয়াম ও অন্যান্য আর্ট গ্যালারিগুলো ঘুরে এইসব মাস্টারের ছবি যতগুলো পেয়েছি দেখে নিয়েছি। পিকাসোর চেয়েও দালির ছবি আমার বেশি প্রিয়, তার কারণটা ব্যাখ্যা করতে পারব না, তবে দালির ছবি আমার কল্পনাকে বেশি উদীপ্ত করে।

রাস্তার এদিকে এসে দালি প্রায় ধমক দিয়ে অ্যালেনকে বললেন, তুমি আসবে বলেছিলে, তুমি আমার শর্ট ফিল্ম দেখতে এলে না। অ্যালেন আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। আমি ভারতীয় শুনে দালি ভুরু তুলে, অদ্ভুত একখানা মুখ করে বেশ কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন নিঃশব্দে, তারপর অ্যালেনকে বললেন, চলো, চলো, তোমরা সবাই আমার ওখানে চলো!

গ্রেগরি ক্ষীণ আপত্তি জানালেও দালি তা শুনলেন না, তিনি গ্রেগরির হাত দৃঢ় মুষ্টিতে ধরে জোর করে টেনে নিয়ে চললেন।

দালিকে ওই গরিবপাড়ায় দেখতে পাওয়া একটা আশ্চর্য ঘটনা। সেই ষাটের দশকেই দালি বিশাল ধনী ব্যাক্তি। মাতিস, ব্রাক ও কানদিনস্কির পর পিকাসো এবং দালিই পৃথিবীর সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পী এবং দুজনেই টাকা পয়সার ব্যাপারে ছিলেন শাহেন শা, ঝানু ব্যাবসাদার যাকে বলে। পিকাসো তো কেউ তাঁর ছবি কিনতে এলে তাঁর সঙ্গিনী ফ্রাসোয়াজ জিলো-র আঁকা ছবিও গছিয়ে দিতেন, আর দালি ফুলদানি কিংবা পেয়ালা-পিরিচে নতুন ডিজাইন করার নামে দুটি চারটি আঁকিবুকি কেটে আদায় করতেন প্রচুর টাকা। তবু দালি সেই সময়টায় শখ করে গ্রিনিচ ভিলেজে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে সদলবলে থাকতেন। আমাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার দিনটায় তিনি রোদ্দুরে প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, যদিও তখন সকাল সাড়ে দশটা।

দালির, সঙ্গে আমার আলাদা করে কিছু কথা হয়নি, ভারত সম্পর্কে তিনি বিশেষ কোনও আগ্রহও দেখাননি। এক সময়ে ফরাসি দেশে জমায়েত শিল্পীরা খানিকটা ঝুঁকেছিলেন জাপানি শিল্পকলার দিকে, কিন্তু ভারতীয় শিল্প রীতি পশ্চিমে কখনও তেমনভাবে আদৃত হয়নি। আমি মুগ্ধভাবে দালিকে শুধু দেখছিলাম ও তাঁর কথা শুনছিলাম। দালি খুব উৎসাহের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন শর্ট ফিল্ম নিয়ে। অন্য কয়েকজনের সহযোগিতায় তিনি একটি শর্ট ফিলম বানানো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন সেসময়।

এ কথা সবাই জানে যে, এক সময় বিখ্যাত পরিচালক লুই বুনুয়েলের সঙ্গে দালি যুক্ত ছিলেন শিল্প নির্দেশক হিসেবে। দুজনের মিলিত প্রয়াসে তৈরি হয়েছিল লস অলভিদাদস-এর মতন এক অসাধারণ চলচ্চিত্র, আমার মতে যা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দশটি ফিল্মের অন্যতম। পরে বুনুয়েলের সঙ্গে দালির ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ, না টাকাপয়সা নিয়ে বিবাদ, এই দুই প্রতিভার বিচ্ছেদে চলচ্চিত্রশিল্পে নিশ্চিত অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেছে। কথাবার্তার ফাঁকে আমি একবার দালিকে জিগ্যেস করলাম বুনুয়েলের সঙ্গে আপনি আর ছবি করলেন না কেন? উত্তরটা এড়িয়ে গিয়ে দালি আবার অদ্ভুত মুখ করে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, সে এক লম্বা গল্প!

যে শর্ট ফিল্মের কথা দালি বলছিলেন, সেগুলি দশ-বারো মিনিটের ছবি, নিজেদের প্রমোদের জন্যই খেলাচ্ছলে করা। তার একটি দেখার সুযোগ আমার ঘটেছিল পরে, সেটি কৌতুকও আদিরসের এক বিচিত্র সংমিশ্রণ।

গ্রেগরি করসোর ছটফটানির জন্য সেদিন আমাদের বেশিক্ষণ বসা হয়নি, পর পর তিন কাপ কফি খেয়ে বিদায় নিয়েছিলাম। কফি বানিয়ে দিচ্ছিলেন দালি নিজে, তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে সেদিন। কোনও নারীকে দেখিনি। সেইসময় দালি নিউ ইয়র্কে একটি মজার ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, সেটি বলে শেষ করি। ফিফথ অ্যাভিনিউয়ের মাঝামাঝি অঞ্চলটি নিউ ইয়র্কের সবচেয়ে বড়লোকি পাড়া, সেখানে বড় একটা দোকানে লক্ষ-কোটি টাকার সওদা হয়। সেই রাস্তায় একটি নতুন দোকান খোলা হবে তার অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা করে দেবেন সালভাদর দালি, খবরের কাগজে এর বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল। দোকানটির উদ্বোধন দিন আসন্ন, দালি অনেক টাকা পয়সা নিয়ে বসে আছেন, কিন্তু কিছুই করছেন না, মালিকের তো মাথায় হাত! দালিকে কিন্তু জিগ্যেস করতে তিনি বলেন–হবে, হবে, ব্যস্ত হওয়ার কী আছে। অবশেষে এসে পড়ল উদ্বোধনের দিনটি, তখনও কিছু হয়নি। সকালবেলা দালি সেই দোকানের বিশাল কাঁচের শো উইন্ডোর পাশে পাতলেন একটি বাথ টাব, তার মধ্যে নিজে নগ্ন হয়ে শুয়ে পড়লেন। তাই দেখার জন্য এমন ভিড় জমে গেল যে তা সামলাতে পুলিশের হিমসিম অবস্থা। প্রায় সারা শহরের লোক ছুটে এল সেদিকে। দালির জন্য সেই দোকানের প্রচার হয়ে গেল কোটি কোটি টাকার।

সেই দৃশ্যটি অবশ্য আমি দেখতে যাইনি। আজও আমার মনে আছে দালিকে রাস্তার মাঝখানে প্রথম দেখার স্মৃতি। আমি ভারতীয় শুনে তিনি অদ্ভুত মুখ করে প্রায় ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে বেশকয়েক পলক তাকিয়েছিলেন, কেন তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *