[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

অনেক দিন পর

অনেক দিন পর

ঘুম ভাঙল বিউগলের শব্দে। চমকে ধড়মড় করে উঠে এলাম বিছানা থেকে। ঘড়িতে সকাল ছ’টা। জানলার কাছে প্রচুর আলো, পাহাড়-চূড়ায় তাড়াতাড়ি ভোর হয়। বিউগলের শব্দ শুনে প্রথমেই আমার মনে হল, তাহলে কি একটা মিছিল বেরিয়েছে? কাল বিকেল থেকেই বিরাট ধরনের কোনও জয়োল্লাস কিংবা গোলমালের প্রতীক্ষা কিংবা আশঙ্কা করছিলাম যেন। কিন্তু সে সব কিছুই না। পাশেই একটা ইস্কুল, সেখানকার ছেলেরা এই সাত-সকালে বিউগল বাজানো শিখছে, অন্যদিকে পাকদন্ডি বেয়ে উঠে আসছে ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা। রাস্তায় শুরু হয়ে গিয়েছে লোক-চলাচল। সামনের জলাপাহাড়ে চলছে ঐরাবতের মতন মেঘেদের বক্রীড়া, আকাশে ঠান্ডা আলো, একটা শান্ত, স্নিগ্ধ সকাল। কিছুই অস্বাভাবিক নয়, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে আছে মানুষ, এই প্রভাতের প্রসন্নতার সঙ্গে শিক্ষার্থী শিশুদের বিউগলের ফুঁ-ও একটুও বেমানান লাগে না। আজকাল সুসংবাদ বড় দুর্লভ। বরং বিপরীতটাই বেশি। প্রতিদিন বাড়ি ফেরার পথে মনে হয় বাড়ির সবাই ঠিকঠাক আছে তো? কিছু গন্ডগোল ঘটেনি? প্রবাসে গেলেও গলায় কাঁটা ফোঁটার মতো উৎকণ্ঠা থেকে যায় দেশের জন্য। আমি সম্প্রতি পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে গিয়েছিলাম, অনেকদিন খবরের কাগজ পড়িনি, ফিরে আসার পরই কয়েকজনের মুখে শুনলাম, দার্জিলিং-সমস্যা মিটে গিয়েছে! প্রথমে বিশ্বাস করতেই চাইনি। কোনও সমস্যাই কি মেটে? ছোট্ট কিংবা নিরীহ ধরনের কোনও সমস্যার বীজ রাষ্ট্রনায়কদের অবহেলায় দু-চার বছরে মহীরুহ হয়ে ওঠে, চতুর্দিকে তার ডালপালা ছড়াতেই থাকে, এই রকমই তো এখন চলছে ভারতবর্ষ জুড়ে। গত দু’বছরে আমাদের অনেকেরই মনে গভীর নৈরাশ্য দানা বাঁধছিল, মনে হচ্ছিল, আবার বুঝি বঙ্গভঙ্গ আসন্ন, দার্জিলিং কালিম্পংয়ের মতন সুন্দর শৈলশহর অনধিগম্য হয়ে যাবে। হঠাৎ এরই মধ্যে পাহাড়ি গোখাদের নেতা সুবাস ঘিসিং গোঁ ছেড়েছেন, তিনি পার্বত্য পরিষদ মেনে নিতে সম্মত হয়েছেন। তাহলে তো বোমা-বন্দুক, বিধ্বংসী আগুন আর কুকরির ঝলসানি থেমে যাওয়ার কথা। যারা দাবি আদায়ের জন্য প্রাণ দিচ্ছিল কিংবা অন্যের প্রাণ নিচ্ছিল, তারা কি খুশি হয়েছে? সেইসব দেখার কৌতূহলেই দার্জিলিং ছুটে আসা।

শিলিগুড়ি ছাড়িয়ে পাহাড়ে উঠতে-উঠতে প্রথমে খটকা লেগেছিল। রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়া নেই বললেই চলে, দু-চারটি মাত্র সরকারি কিংবা সিপাহিদের গাড়ি বিপরীত দিক থেকে আসছে, পথচারীও বিশেষ চোখে পড়ে না। অথচ আগে যতবার এসেছি, এই রাস্তায় প্রচুর যানবাহন ও মানুষজন দেখেছি। ফাঁকা রাস্তা গাড়ি চালাবার পক্ষে সুবিধেজনক, কিন্তু মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি থেকেই যায়। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ঝলমল করছে গাছপালা, দু পাশে ফুটে আছে অজস্র বুনোফুল, কিন্তু সে সৌন্দর্যের দিকেও বেশিক্ষণ আকৃষ্ট হতে পারি না। মানুষ মানুষকেই ভয় পায়, আবার মানুষ মানুষকেই চায়।

কার্শিয়াংয়ের কাছাকাছি এসে দৃশ্য বদলে গেল। বেশ কিছু গাড়ি যাওয়া-আসা করছে, বাস ভরতি মানুষ জিপ কিংবা ট্রেকারে ভরতি যুবকদের দল, দোকান-পাট সব খোলা। মনে হল যেন, সমতলের সঙ্গে যোগাযোগ এখনও ততটা স্বাভাবিক না-হলেও পাহাড়ি এলাকার মধ্যে জীবনযাপনের ব্যস্ততা ঠিকই চলছে। ছোট রেল প্রায় এক বছরের বেশি বন্ধ, তাই ট্যাক্সি-ট্রাকে গাদাগাদি করে অনেককে যেতে হচ্ছে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে।

চা খাওয়ার জন্য থামা হল কার্শিয়াঙ টুরিস্ট লজে। চমৎকার কাঠের বাড়িটি, টেবিলের পাশেই অনেকখানি চোখ জুড়োনা নিসর্গ। বছর তিনেক আগে পর্যটন দফতরের কর্তাদের সঙ্গে আমরা কয়েকজন এসেছিলাম এখানে। উপরতলায় রেস্তোরাঁ। নীচের তলায় রাত্রিবাসের জন্য কক্ষ। এই নবনির্মিত লজটি নিয়ে পর্যটন দফতরের বেশ গর্ব ছিল। শোনা গেল, আন্দোলনের তীব্রতার সময় এই বাড়িটিকে পুড়িয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু একেবারে রাজপথের উপরেই বলে সেটা সম্ভব হয়নি। এখনও বালির বস্তার আড়ালে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে এক রাইফেলধারী সৈনিক। দিনকাল এমনই পড়েছে যে, কোথাও চা খেতে গেলেও রাইফেল-বন্দুক দেখতে হয়! তাতে চায়ের স্বাদ একটু কমে যায় না?

রেস্তোরাঁটি পরিচ্ছন্ন কিন্তু ফাঁকা। আর একটিমাত্র টেবিলে যে ব্যক্তিটি বসে আছেন, তিনি স্থানীয় এস ডি ও, আমার সঙ্গে তাঁর পূর্ব-পরিচয় নেই, কিন্তু আমার সহযাত্রী তাপস মুখার্জিকে দেখে তিনি উঠে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। তরুণ বয়স্ক অবাঙালি এই রাজপুরুষটির চেহারায় এখনও কলেজীয় যুবকের আদল। রাজনৈতিক পরিস্থিতির চেয়েও তিনি কাছাকাছি এক জায়গার বিরাট ধসের ব্যাপারেই বেশি উদ্বিগ্ন। তবু সাম্প্রতিক ঘটনাবলির কথা এসেই যায়। তাপসবাবুর সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার মধ্যে আমি জিগ্যেস করলাম, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, জঙ্গি জি এন এল এফ নেতা ঘিসিং যুদ্ধং দেহি মনোভাব ছেড়ে হঠাৎ পার্বত্য পরিষদ গঠনের প্রস্তাবে রাজি হলেন কেন? রাজপুরুষটি হেসে বললেন, দ্যাট ইজ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন!

আমার যাত্রা শুরু। কার্শিয়াংয়ের আগে ও পরে বেশ কিছু জায়গায় রাস্তা বেশ খারাপ, কয়েকদিন আগেও ধসের জন্য এই রাস্তা বন্ধ ছিল, এখনও মেরামতির কাজ চলছে, দু-এক জায়গায় গাড়ি চলে বেশ সন্ত্রস্তভাবে। এক জায়গায় রাস্তার মাঝখানে বেশ বড় একটা গর্ত, তাপসবাবুর দিকে তাকাতেই তিনি মৃদু গলায় বললেন, মাইন পোঁতা ছিল। কয়েক জায়গায় এ রকম মাইন বিস্ফোরণ হয়েছে।

তাপস মুখার্জি একজন শান্ত ধরনের সাহসী মানুষ। তাঁর জন্ম দার্জিলিংয়ে। তিন পুরুষ ধরে এই শহরে বাস, নেপালি বলতে পারেন মাতৃভাষার মতন, তবু এই আন্দোলনের মধ্যে তাঁকে একবার প্রায় মৃত্যুমুখে পড়তে হয়েছিল, এক শীতের রাত্রে একদল উগ্রপন্থী গোখা তাঁকে বাড়ি থেকে বার করে চোখে বেঁধে নিয়ে যায়, তারপর শেষ পর্যন্ত তিনি কীভাবে রক্ষা পেলেন, সে এক রোমহর্ষক কাহিনী, কিন্তু তাপসবাবু সে ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চান না, এখনও পাহাড়ের যত্রতত্র তাঁর অবাধ গতি। দার্জিলিংয়ের কাছাকাছি এসে আবার মনে পড়ল, এই শহরে আমি শেষবার এসেছিলাম উনশশো পঁচাশি সালে, দার্জিলিং শহর স্থাপনের দেড়শো বছর পূর্তি উৎসবে যোগ দিতে। সে বার লেখক ও সঙ্গীত শিল্পীদের একটি বড় দল এসেছিল, উৎসবে গোখা লেখক ও শিল্পীরাও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সে বারে আমরা ঘিসিংকে দেখিনি, সেরকম কোনও আন্দোলনেরও চিহ্ন ছিল না, তবে কী রকম যেন একটা আলগা-আলগা ভাব ছিল, গোখা লেখক শিল্পীদের সঙ্গে আমাদের আড্ডা হল না, বন্ধুত্ব হল না। আমাদের দিক থেকেই কোনও ত্রুটি হয়েছিল? আমরা দার্জিলিংয়ে অতিথি, সেখানকার অধিবাসীরাই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, এটাই রীতিসম্মত নয় কি? পরে শুনেছিলাম, সেই উৎসবে সমতলের লোকদের যোগ দেওয়াটাই নাকি গোখারা অনেকে পছন্দ করেননি! এটি একটা অদ্ভুত কথা!

সেই সময়েই সমরেশ বসু অসুস্থ হয়ে পড়লেন হঠাৎ। অসম্ভব মনের জোরে তিনি আবার সুস্থ হয়ে উঠে নিজের পায়ে হেঁটেই দু-দিন বাদে বেরিয়ে এলেন হাসপাতাল থেকে। মাত্র এই তো সেদিনের কথা। এখন আর তিনি নেই, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। সে বারে দার্জিলিংয়ে প্রচণ্ড ভিড় দেখেছিলাম। ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির কাছে দার্জিলিং-কালিম্পং বরাবরই অবশ্য দ্রষ্টব্য, গ্রীষ্মকালে ও পুজোর ছুটিতে শুরু হত দার্জিলিং-অভিযান। ইদানীং শীতে-বর্ষাতেও আনাগোনা শুরু হয়েছিল। আমি একবার জানুয়ারি মাসেও এসে যথেষ্ট পর্যটক দেখেছি, শুধু সাহেব-মেমরাই নয়, বাঙালিরাও ঠান্ডা বাতাস ভালোবাসতে শিখেছে। বর্ষাকালেও পাহাড়-বনরাজি বড় নয়নাভিরাম। এক একবার দার্জিলিংয়ে এসে এত চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে যে মনে হত, তা হলে আর দার্জিলিংয়ে এলাম কেন, গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলেই হত! ম্যালের শৌখিন পোশাক পরা জনতাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি।

এ বার সেই ম্যাল পুরোপুরি ফাঁকা। বসবার বেঞ্চিগুলো সব ক’টাই উধাও। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের অফিসের সামনে অনেকবার বোমাবাজি হওয়ার খবর শুনেছি, এখন সেখানে। দু’জন জলপাই-রঙের পোশাক পরা প্রহরী নিথরভাবে দন্ডায়মান। খানিকটা দূরে একটা গাছতলায় প্রায় গাছেরই সঙ্গে মিশে আছে চার-পাঁজজন বিস এস এফ-এর জওয়ান। দুজন মাত্র ঘোড়াওয়ালার মধ্যে একজন নিজেই নিজের ঘোড়া চালিয়ে এল এক পাক। খদ্দের না পেলেও ঘোড়াদেরও তো ব্যায়াম দরকার। দোকানগুলি খোলা, কিন্তু অন্য বারের মতন কেউ ডাকাডাকি করছে না আমাদের, কেউ চোখে চোখ ফেলছে না, কথা বলছে না একটাও। কী ব্যাপার, এরা কি এখনও আমাদের শত্রুপক্ষ মনে করছে নাকি? ম্যাল থেকে ঘড়ি-গম্বুজ পর্যন্ত হেঁটে এলাম একবার। রাস্তার পাশে সোয়েটার, শাল, টুপি খেলনাপাতি সাজিয়ে পসারী-পসারিণীরা বসে আছে ঠিকই, কিন্তু কেউ আমাদের সম্ভাব্য ক্রেতা হিসেবে গ্রাহ্যই করল না।

স্থানীয় অধিবাসীরা কেউ-কেউ যাতায়াত করছে ম্যালের ওপর দিয়ে, নিঃশব্দে। যেন কথা বলা নিষিদ্ধ। চারদিকে একটা থমথমে ভাব। স্বতন্ত্র গোর্খাল্যান্ডের বদলে দার্জিলিং গোখা পার্বত্য পরিষদ পেয়ে এরা অখুশি? তার কোনও প্রকাশ্য চিহ্ন এখনও দেখিনি। মধুর অভাবে গুড় পেয়েও সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছে? দাঙ্গা-হাঙ্গামা, খুনোখুনি কতদিন লোকে সহ্য করতে পারে! কিন্তু সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে রাজি নয় মনে হচ্ছে।

কফি-তেষ্টা মেটাতে স্টেপ অ্যাসাইডের দিকের একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। বাইরের চত্বরে কয়েকজন বৃদ্ধ ও অন্যান্য নারী পুরুষ নিজেদের মধ্যে কী যেন কথা বলছিলেন, হঠাৎ থেমে গেলেন আমাদের দেখে। চেয়ে রইলেন আমাদের মুখের দিকে। কোনও প্রশ্ন নয়, কোনও মন্তব্যও নয়। এতে খানিকটা অস্বস্তি লাগে, আমরা কি এখানে অবাঞ্ছিত? দোকান খুলে রেখেছে, যে-কেউ তো সেখানে আসতে পারে। কিন্তু খদ্দের দোকানে ঢুকলে সামান্য অভ্যর্থনাও করবে না? একজনের চোখে চোখ রেখে সরাসরি প্রশ্ন করলুম, কফি মিলেগা? তিনি নিস্পৃহভাবে বললেন, হাঁ, মিলেগা!

দোকানের ভিতরে আর কেউ নেই। আমরা জানলার ধারে টেবিলে বসার পর কাউন্টার থেকে একটি কিশোর উঠে এল। ভাবলেশহীন মুখ। যেন সে কিছুতেই হাসবে না প্রতিজ্ঞা করেছে। তাকে কফি এবং কোল্ড ড্রিংকসের অর্ডার বুঝিয়ে দেওয়ার পর সে যেন হঠাৎই অসাবধানে বলে ফেলল, ঠিক আছে। ঠিক হ্যায় বলেনি, ঠিক আছে! তার মুখে এই সামান্য বাংলা শুনেই যেন গলে গেলাম একেবারে! সে অবশ্য বিল মেটাবার সময় টিপসের পয়সাটা গ্রাহ্যও করল না, টেবিলের ওপরেই পড়ে রইল প্লেটে।

সারাদিন দার্জিলিং শহরে ঘোরাঘুরি করার পর মনে হল, এখানকার অবস্থা স্বাভাবিকই তো হয়ে গিয়েছে। সর্বত্র যাওয়া-আসার কোনও অসুবিধা তো নেই। একটা যে থমথমে ভাব দেখেছি, সেটা অনেকটাই হয়তো আমার কল্পনা। পার্বত্য পরিষদ নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে কেউ কোনও উচ্ছ্বাস দেখাচ্ছে না বটে, তা তো হতেই পারে, এর ফলাফল কী হবে, তা বুঝে নেওয়ার সময় নিচ্ছে।

সন্ধেবেলাতেই খবর পাওয়া গেল, চকবাজারে দুটি দোকান লুট হয়েছে।

২.

ঘুম পর্যন্ত এসে আমরা ওপরের রাস্তা ধরলাম টাইগার হিলের দিকে। ছেলেবেলায় ঘুম নামটি শুনলেই একটা অদ্ভুত আবেশ বোধ হতা। ছোট ট্রেনে আসতে-আসতে আমরা স্টেশনের নামগুলি মুখস্থ রাখতাম এইভাবে ছড়া বানিয়ে। কার্শিয়াং-টুং, সোনাদা-ঘুম! সেই ট্রেনের লাইনে এখন মরচে পড়ে গেছে, ঘুম স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে গুচ্ছের সি আর পি। এক ঝাঁক পায়রার মতন হঠাৎ বৃষ্টি এসেই আবার উড়ে চলে গেল।

টাইগার হিলের রাস্তা বিষম খাড়াই, গাড়ি উঠছে গোঁ-গোঁ শব্দ করে। জোড়বাংলোর পর জনবসতি আর নেই বললেই চলে। দু-একটি বাড়ির সামনে কর্মরত নারী পুরুষরা মুখ ফিরিয়ে সবিস্ময়ে তাকাচ্ছে। রাস্তার পাশে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ছে কাঠকুড়ানি কামিনরা, যেন অনেকদিন তারা কোনও গাড়ি দেখেনি। আমাদের দার্জিলিং শহরের বাইরে কিছুটা ঘোরাঘুরির প্রস্তাবে তাপস মুখার্জি প্রথমে একটু খুঁতখুঁত করছিলেন, চিন্তিত ছিলেন আমাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে, শেষ পর্যন্ত নিজেই মত বদল করে জোগাড় করে আনলেন গাড়ি। এখানে বৃষ্টিতে সদ্য স্নান করা দু পাশের সবুজ বনানীর মধ্যে এমন একটা স্নিগ্ধতা রয়েছে, এমন একটা শান্তির ভাব যে, কোনও বিপদের কথা মনেই আসে না।

একদিন আগেই সন্ধেবেলা দুটি দোকান লুঠ এবং কয়েকজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীকে গুম করার কথা শোনা গেলেও পরদিন সকালবেলা আবার দোকান-বাজার ঠিকই খুলেছে, সব কিছুই আপাত স্বাভাবিক। কপালে সবুজ ফেট্টি বাঁধা জিন এন এল এফ-এর যুবা কর্মীদের যেমন অনেক জায়গায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায়, সেইরকমই তারা নাকি নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দাম কেউ বেশি বাড়ালে সেইসব দোকানদারদের শাসায়, ধরে নিয়ে গিয়ে চড়-চাপাটি দেয়, কিছু কিছু লুটপাটও হয়। সেইসময় রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নেই এমন কিছু কিছু চরিত্র অরাজকাতর সুযোগ নিয়ে পেশি ও কুকরি প্রদর্শন করতে পারে, লোকজন ভয়ে দৌড়োদৌড়ি করে। তবু, এইসব ছোটখাটো বিপদের পটভূমিকাতেও জীবনের স্রোত থেমে থাকে না।

অবশ্য এরকম দু-একটি ঘটনার কথা আমি শুনেছি মাত্র, চোখে দেখিনি। টাইগার হিলে আমি কখনও বিখ্যাত সূর্যোদয় দেখতে যাইনি। তবে একটা রাত্রি কাটিয়েছিলাম ওখানকার চমৎকার টুরিস্ট বাংলোতে। বছর তিনেক আগের কথা। সেবার সঙ্গে ছিলেন কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, এবং পর্যটন কর্পোরেশনের ডিরেকটর আদিনাথ ভট্টাচার্য। জানুয়ারি মাস, আকাশ ঝকঝকে নীল, পাহাড়গুলি যেন নিজেদের দৈর্ঘ্যের চেয়ে দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল। এখানকার টুরিস্ট লজে ম্যানেজারের নাম তামাং, তিনি একজন প্রাক্তন সৈনিক, রাত্তিরবেলা খাওয়া-দাওয়ার পর ঘরের মধ্যে ফায়ার প্লেসে হাত সেঁকতে-সেঁকতে তিনি আমাদের অনেক ভূতের গল্প শোনালেন। ওরকম শীতের রাতে ভূতের গল্পই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। ভোর হবার আগেই প্রকৃতিপ্রেমিক সমরেন্দ্র ছুটলেন খানিকদূরের প্যাভিলিয়নে চড়ে আকাশের লাল বলটি লাফিয়ে ওঠার দৃশ্য দেখার জন্য, ফিরে এসে ধ্যানমগ্ন হয়ে তিনি একটি গম্ভীর-সুন্দর কবিতাও লিখে ফেললেন, আমি অবশ্য তখনও বিছানা ছেড়ে উঠিনি। সেবারে ওই টুরিস্ট লজে বেশ কিছু নেপালি ছেলেমেয়ে দেখেছিলাম। ওরা সূর্যোদয়ের দেশের মানুষ, তাই বুঝি অন্য দেশে এসেও ওরা সূর্য দেখার সুযোগ ছাড়ে না।

আমাদের গাড়ি যখন টুরিস্ট বাংলোর দিকে বাঁক নিচ্ছে, তখন দেখি টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ। সে সম্ভবত আমাদের গাড়িটাকে পুলিশের গাড়ি ভেবেছিল। টুরিস্ট বাংলোটি দেখেই আমি একবার চোখ বুজলাম। ঘটনাটি আগেই শোনা ছিল, তবু স্বচক্ষে দেখার অভিঘাত অনেক তীব্র হতে বাধ্য। সেই টুরিস্ট লজটি এখন ভূতপূর্ব টুরিস্ট লজ। কিছুদিন আগে সেটিকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার কঙ্কাল। এখানে দমকল আসার প্রশ্নই ওঠে না বোধ হয়, তাই আগুন তার ইচ্ছে মতন বাড়িটাকে খেয়েছে, শুধু পাথরের দেয়ালগুলি হজম করতে পারেনি। ঠিক যেন বিশ্বাস হয় না, এখানে যে বাড়িটিতে আমি থেকে গেছি, কত গল্প, কত হাস্য-পরিহাস হয়েছে, এখনও তার পরিপার্শ্ব একই রকম হয়েছে। শুধু বাড়িটি নেই। সামনের বারান্দাটা ছিল পুরো কাঁচে ঢাকা, তার ওপর নানারকম প্রজাপতি ও পতঙ্গ এসে বসত, এখন চতুর্দিকে ছড়ানো কাঁচের টুকরো। পাথরের খাঁচাটার একটা অংশে আঙুল দেখিয়ে আমি বলি, ওই যে, ওই ঘরটায় আমরা শুয়েছিলাম। সেটাকে ঘর বলে চেনার কোনও উপায় নেই। রাশি রাশি কাপ-প্লেট অর্ধেক ভাঙা হয়ে পড়ে আছে। যারা আগুন দিয়েছে, তারা লুট করতে আসেনি, ধ্বংস করতেই এসেছিল।

স্বাতী দুঃখিতভাবে প্রশ্ন করল, এমন সুন্দর বাড়িটি ওরা পোড়াল কেন? গোর্খাল্যান্ড হলেও তো বাড়িটা ওদেরই কাজে লাগত। আবার ওদেরই তো এখানে নতুন বাড়ি তৈরি করতে হবে।

আমি ও তাপস চুপ করে রইলাম। এইসব প্রশ্নের উত্তর হয় না। কলকাতায় একসময় যখন তখন ট্রাম-বাস পোড়ানো হত কেন, পঞ্জাবের উগ্রপন্থীরা কেন নিরীহ বাসযাত্রী বা পূজা প্যান্ডেলের লোকজনদের হত্যা করছে? আমাদের দেশে প্রতিবাদের ভাষাই হল হিংসা এবং ধ্বংস।

কাছেই ফুটে আছে অজস্র ঘাসফুল। দু-তিনটি অতি শিশু ছাগল ছানা তিড়িংবিড়িং লাফাচ্ছে। অদূরের ঝাউবনে শোনা যাচ্ছে বাতাসের শব্দ, কী অপূর্ব উজ্জ্বল আজকের সকালটি। দগ্ধ বাংলোটির দিকে পেছন ফিরে আমরা চিরকালীন সুন্দরকে দেখি।

দার্জিলিং শহরের মধ্যেই সার্কিট হাউস এবং একটি পি ডরু ডি-র বাংলো ঝলসানো অবস্থায় রয়েছে। ঘুরতে ফিরতে সার্কিট হাউসটিকে কয়েকবার দেখেছি। আর দার্জিলিং জেলায় মধ্যে দূরে-দূরে অনেকগুলি বাংলো, যেখানে পুলিশ সহজে পৌঁছতে পারে না। সেগুলি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেরকম আর একটি বাংলোও দেখতে গেলাম।

দার্জিলিং শহর ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে, মিরিকের পথে একটি জায়গায় নাম লেপচা জগত (আসল নাম নাকি লাপচে জগত), সেখানকার বাংলোটি ব্রিটিশ আমলের। দুর্গম পাহাড়ে একটি চিত্তহারী স্থান খুঁজে বার করার কৃতিত্ব ছিল সাহেবদের। একেবারে জঙ্গলের মধ্যে এই বাংলোটি এমনই এক জায়গায়, যার সামনে উপত্যকা, বিপরীত দিকে দেখা যায় পুরো দার্জিলিং শহর, আরও দূরে কালিম্পং ও সিকিম। এখানেও আমি আগে এসেছি একাধিকবার। এই বাংলোটি সম্পর্কে একটা কাহিনি আছে। একবার এক ইংরেজ এই বাংলোতে কয়েকটি দিন। কাটিয়ে যান, সর্বক্ষণই বৃষ্টি পড়ছিল, এমন একটানা বৃষ্টি তিনি আগে কখনও দেখেননি। বাংলোর ভিজিটার্স বুকে তিনি সেই বৃষ্টির বর্ণনা লিখে গিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর বহু বছর পর তাঁর ছেলে এসেছিলেন এখানে। পুরোনো খাতা উলটেপালটে তিনি তাঁর বাবার লেখাটা দেখতে পান। সেই লেখার নীচে পুত্র তাঁর মন্তব্য লিখলেন, ফাদার ইট ইজ স্টিল রেইনিং হিয়ার।

ফায়ার প্লেসের চিমনি দুটি ছাড়া এই বাংলোর আর কিছুই প্রায় অবশিষ্ট নেই। ধ্বংসকারীরা চৌকিদারদের ঘরগুলো পর্যন্ত পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। শুধু এক কোণে রান্নাঘরটি কোনওক্রমে অবশিষ্ট আছে। সামনের চত্বরে একজন প্রৌঢ় টাঙ্গির মতন একটি অস্ত্রে ধার দিচ্ছিল। তার পাশে কয়েকটি বাচ্চা কাচ্চা আর একটি লোমশ কুকুর। আমাদের দেখে সে টাঙ্গিটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। সে আসলে একজন নিরীহ লোক, এই প্রাক্তন বাংলোটির চৌকিদার। বাংলোটি আর না থাকলেও তার চাকরিটি তো আছে, তাকে এখানে ডিউটি দিতেই হবে। কিন্তু বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে তার এখানে থাকার খুবই কষ্ট, কোনক্রমে রান্নাঘরটিতে মাথা গুঁজে আছে। সে কথা বলার লোক পায় না, আমাদের কাছেই তার অভিযোগ জানিয়ে কিছু প্রতিকার চাইল। হায়, আমরা শুধুদর্শকমাত্র!

গাড়িটাকে দূরে রেখে আমরা বনপথ দিয়ে অনেকটা হেঁটে এসেছিলাম, ফেরার পথে একবার মনে হল, হঠাৎ যদি অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে গোটা চার পাঁচেক মানুষ আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে কী হবে? জায়গাটা অসম্ভব নির্জন বলেই এরকম গা ছমছমে কল্পনা মাথায় আসে। কিন্তু সেরকম কোনও ঘটনা ঘটল না। তবু আমি বলব, রাজনৈতিকভাবে হামলা বন্ধ হলেও এখনই চট করে কারুর ওই লেপচা জগত বনবাংলোর দিকে যাওয়াটা ঠিক হবে না, গুন্ডা-বদমাসের উপদ্রব তো হতেই পারে।

এ কথা ঠিক, অনেকের মুখেই শুনেছি, আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনও নেতাদের নির্দেশ ছিল সাধারণ মানুষ, বাঙালি অবাঙালিই কারুকেই মারধোর, খুন জখম করা চলবে না। লড়াই হয়েছে জি এন এল এফের সঙ্গে পুলিশ ও সি আর পির। এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দল সি পি এমের সঙ্গে। পাহাড় অঞ্চলে কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন বলা যেতে পারে। সি পি এম কর্মীদের অদম্য সাহস ও আদর্শের জোরের প্রশংসা শুনেছি সর্বত্র। প্রায় সব গোখাই যখন সুবাস ঘিসিং-এর দলের সমর্থক, তখনও যেসব গোখা সি পি এম দল ছাড়েনি, তারা সামাজিকভাবে ধিকৃত হয়েছে, বাঙালির পা-চাটা কুকুর বলে অনেকে তাদের গায়ে থুতু দিয়েছে। কেউ-কেউ খুনও হয়েছে, তবু তারা অনমনীয় থাকতে পেরেছে।

দার্জিলিঙে গত বছর দু’এক ধরে কোনও টুরিস্ট আসে না। বন্ধের জন্য, ধসের জন্য পর্যটকেরা নানা রকম অসুবিধেয় পড়েছে বটে, কিন্তু তাদের ওপর কোনও আক্রমণ হয়নি কখনও। সুবাস ঘিসিং-এর জনপ্রিয়তার একটা প্রধান সূত্রই হল বাঙালি বিরোধিতা। বাঙালিদের নামে ছড়ানো হয়েছে প্রচুর ঘৃণা, কিন্তু তাঁর দলে যে শৃঙ্খলা আছে তা মানতেই হবে। দার্জিলিঙের স্থানীয় বাঙালি কিংবা কর্মক্ষেত্রে আসা বাঙালি ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর কোনও শারীরিক অত্যাচার করা হয়নি, কোনও বাঙালিকেই দার্জিলিং ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়নি।

শুধু, কিছুদিন আগে স্থানীয় এক বাঙালি যুবককে কয়েকটি নেপালি ছেলে এসে কুপিয়ে মারে, তার বৃদ্ধ বাবা বাধা দিতে এলে তাকেও খুন করা হয়। এই নৃশংস কান্ডটি ঠিক কী কারণে ঘটেছিল, তার সঠিক ব্যাখ্যা আমি অনেকের কাছে জিগ্যেস করেও পাইনি।

৩.

ম্যালে কয়েকজন ছাত্রর সঙ্গে দেখা। দার্জিলিং সরকারি কলেজের বাঙালি ছাত্র, বছর তিনেক ধরে এখানে আছে, আন্দোলনের পুরো চেহারাটাই তারা দেখেছে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম তারা কাছাকাছি জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি থেকে এসেছে, কিন্তু সেরকম উল্লেখ করতেই তারা জানাল না,, আপনাদের সাউথ বেঙ্গল থেকেও অনেকে আসে, কলকাতা, সোদপুর, চুঁচড়ো…। আমি যে সাউথ বেঙ্গলের লোক বা কলকাতা নগরীটি সাউথ বেঙ্গলে, তা এতদিন খেয়াল করিনি। আমরা কথায়-কথায় উত্তরাঞ্চলকে বলি নর্থ বেঙ্গল, সুতরাং সাউথ বেঙ্গলও তো থাকবেই। আমরা যেমন বলি বম্বে মেল, তেমনি বম্বের লোকেরাও একটা ট্রেনকে বলে ক্যালকাটা মেল, এটা প্রথমবার শুনে খুব অবাক লেগেছিল। ছাত্ররা সাহিত্য বিষয়ে উচ্ছ্বাস দেখাতে চাইলেও আমি তাদের প্রথমেই প্রশ্ন করি, এই গন্ডগোলের মধ্যে তোমাদের কোনও অসুবিধে হয়নি তো? তারা সকলেই একবাক্যে জানাল যে তাদের কোনও বিপদে বা ঝামেলায় পড়তে হয়নি। তবে লম্বা-লম্বা বন্ধের সময় কলেজ বন্ধ থেকেছে পড়াশুনোর কিছু ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে কখনও কোনও আশঙ্কা ঘটেনি। অবশ্য সন্ধে ছ’টার পরে তারা পারতপক্ষে কেউ রাস্তায় বেরোয় না। একজন হাসতে-হাসতে বলল, আমরা নিজেরাই নিজেদের ওপর এমন কড়া ডিসিপ্লিন চাপিয়েছি যে আমাদের বাবা-মায়েরাও এতটা আশা করতে পারবেন না, সন্ধের পর আর কিছুই করার থাকে না বলে আমরা শুধুই পড়াশুনো করি।

ক্লাস ধরবার তাড়া ছিল বলে ওরা চলে গেল। ওদের কাছ থেকে খবর পেয়ে আরও একদল ছাত্র বিকেলবেলা দেখা করতে এল হোটেলে। তাদের দাবি, তাদের মেসে একবার যেতে হবে। আমারও আজ্ঞায় অনুৎসাহ নেই। হস্টেলে থাকার বদলি বাঙালি ছাত্ররা ছোট ছোট দল করে বিভিন্ন জায়গায় মেস বানিয়ে আছে। ঘর ভাড়া-এখন সুলভ। অধিকাংশ হোটেল বন্ধ হয়ে আছে, সেই সব হোটেলের মালিকরা সাগ্রহেই ছাত্রদের মাসিক হিসেবে ঘর ভাড়া দিতে রাজি, ছাত্ররা নিজেরাই রান্নার ব্যবস্থা করে নেয়।

পরের দিন সেই মেসবাড়ির আড্ডায় গিয়ে দেখি কয়েকটি ছাত্রীও এসেছে। তারা অবশ্য হস্টেলেই থাকে। ছাত্রীরা নিজের উদ্যোগে আলাদা মেস করে থাকার মানসিকতা সারা দেশেই কোথাও এখনও আসেনি বোধহয়। এই ছেলেমেয়েদের পরিচ্ছন্ন, খোলামেলা ব্যবহারে কিছুক্ষণ বেশ সুন্দর সময় কাটল, যদিও আড্ডা-গল্প-কবিতা পাঠের মাঝে-মাঝে সমসাময়িক সংকটের কথা এসেই পড়ে। একটি ছেলে বেশ জোরাল গলায় গোখা আন্দোলনের সমর্থনে একটি কবিতা শোনাল। এই আন্দোলনকে সে বিপ্লব আখ্যা দিয়েছে। তার টগবগে যৌবনদীপ্ত চেতনা কাছাকাছি আর কোনও বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে সম্ভবত এটাকেই আঁকড়ে ধরতে চায়।

কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কেউ-কেউ পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবি সমর্থন করেছেন, দু এক জায়গায় দেওয়ালে বাংলা-ইংরেজিতে উগ্র ঘোষণাও দেখেছি। সুবাস ঘিসিং কি সে কথা জানেন না? না হলে তিনি কলকাতায় আসতে ভয় পান কেন? ভয় কিংবা লজ্জা কিংবা অবজ্ঞা, যাই হোক, শ্রীযুক্ত ঘিসিং কলকাতাকে এড়িয়ে চলেন, ঘুরিয়ে নাক দেখাবার মতন তিনি দিল্লি যাবার জন্য আর পাঁচ জায়গা ছুঁয়ে যান কিন্তু কলকাতায় পা দেন না। কলকাতা শহরে তিনি জীবনে কখনও এসেছেন কি না সে সম্পর্কেও কেউ নিশ্চিত নয়। গত সপ্তাহে মনে হয়েছিল, সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, ঘিসিং কলকাতায় এসে হিল কাউন্সিলের চুক্তিতে সই করে দেবেন। তিনি দিল্লি থেকে চলে এলেন কিন্তু কোথায় গেলেন তা জানা যায়নি প্রথম দিন। তারপর শোনা গেল তিনি কলকাতায় না পৌঁছে পাটনায় বসে আছেন। পাটনাতেই যখন এলেন, তখন দার্জিলিং ফিরলেন না কেন? এই নিয়ে কত জল্পনা-কল্পনা। সাধারণ মানুষ যেন আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না, কবে সই হবে?কবে সই হবে?

সমতলের একটা ভুল ধারণা দার্জিলিংয়ে এসে ভাঙল। কলকাতায় অনেকেই বলাবলি করে যে দু-বছর ধরে দার্জিলিঙে কোনও টুরিস্ট যাচ্ছে না। এরপর আর কত দিন আন্দোলন চালাবে? না খেয়ে মরবে যে! অথচ দার্জিলিঙে দেখছি, একটা-দুটো টুরিস্ট পেলেও তাদের সম্পর্কে স্থানীয় লোকদের কোনও আগ্রহ নেই। পর্যটক না আসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হোটেল-ওয়ালা আর দোকানদারেরা, তারা কেউ স্থানীয় নেপালি নয়। ধনী ব্যবসায়ীদের নানাদিকে ডালপালা ছড়ানো থাকে, দু-তিন বছরে তারা কুপোকাত হয় না। ঘোড়াওয়ালা ও কুলিশ্রেণির লোকরা এক জায়গায় কাজ না পেলে অন্য জায়গায় চলে যাবে সর্বত্রই দিনমজুরদের যা নিয়তি। তা ছাড়া রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয় মধ্যবিত্ত শ্রেণি, তারা কোনও ক্রমেই পর্যটকদের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং টুরিস্টরা এসে হঠাৎ নবাবি ভাব দেখিয়ে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয় বলে তাদের ওপর শহরের স্থায়ী বাসিন্দাদের খানিকটা বিরক্তির ভাব থাকারই কথা। কলকাতার বাঙালিবাবুরা পাহাড়ে গিয়ে সমস্ত গোর্খা-নেপালিদেরই দারোয়ান শ্রেণি মনে করে বহুঁকাল ধরে অবজ্ঞাসূচক ব্যবহার করেছে, সে কথাও তো ভুললে চলবে না।

এখন ওখানকার কোনও কলেজের এক তরুণ গোৰ্খা লেকচারার যদি উগ্রভাবে পৃথক গোর্খাল্যান্ড দাবি করেন, তা হলে তিনি টুরিজমের ব্যাপারে তোয়াক্কা করবেন না, কারণ এতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কোনও ক্ষতি বৃদ্ধি নেই। বরং গোর্খাল্যান্ড স্থাপিত হলে যখন চাকরি বাকরিতে গোখাদেরই প্রাধান্য দেওয়া হবে, কলেজের উঁচু পদ থেকে বাঙালিরা সরে যাবে, তখন তিনিই হয়ে যেতে পারেন হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট কিংবা প্রিন্সিপাল! এর সঙ্গে জাতীয়তাবাদের মাদক তো আছেই!

দুপুরবেলা খেতে বসে পাশের টেবিলে এক বাঙালি দম্পতিকে দেখতে পাই, তাদের সঙ্গে একটি বারো-তেরো বছরের কিশোর। কিশোরটির প্যান্ট-শার্টের সঙ্গে টাই, পরিপাটি চুল আঁচড়ানো, তার বাবা-মা তাকে বেশি-বেশি খাবার দিচ্ছেন। একটি বাৎসল্যের ছবি, বোর্ডিং স্কুলে পড়া সন্তানকে দেখতে এসেছেন জনক-জননী। স্কুলগুলি আবার খুলেছে বলে তাঁরা খুশি। অন্য একটি টেবিলে এক যুবতী তার শিশুকে জোর করে খাওয়াচ্ছে ফুট স্যালাড, দুরন্ত শিশু বারবার টেবিল ছেড়ে পালিয়ে যেতে চায়। যুবতীটির স্বামী সমতলের একজন ব্যাংক অফিসার, বিশেষ করে তাঁকে আসতে হয়েছে দার্জিলিং, স্বামীকে তাঁর পত্নী একলা ছাড়তে চাননি। দার্জিলিংয়ে বহিরাগত বলতে প্রধানত এই ধরনের মানুষই। বিদেশি পর্যটকও চোখে পড়ে না বিশেষ। আমি তো ঘুরে ফিরে একটা শ্বেতাঙ্গ দম্পতিকেই দেখতে পাচ্ছি। এরই মধ্যে এক ফাঁকে একবার দেখতে গিয়েছিলাম ঘুম-এর তিব্বতি মন্দিরটি। সেখানকার ভিজিটারস বুকটা দেখলাম কৌতূহলবশত, গত চার দিনে পাঁচ জন মাত্র দর্শনার্থীর নাম, তার মধ্যে একটা বিদেশির এবং বাকিদের মধ্যে কেউ বাঙালি নয়। এই বিখ্যাত মনাস্টারির এমন দশা। আমি অল্প বয়েসে বয়েজ স্কাউট হিসেবে এসেছিলাম এখানে, তারপর অনেকবার দার্জিলিং ঘুরে গেলেও ঘুমে আসা হয়নি। ছেলেবেলায় এই মনাস্টারিটিকে যেন আরও বিরাট, আরও অনেক রহস্যময় মনে হয়েছিল। কেন যে ছেলেবেলার সেই চোখটা হারিয়ে যায়।

এক সন্ধেবেলা একটি নেমন্তন্নের আসরে ডাক পেয়ে গেলাম দৈবাৎ। বেশ কিছু সরকারি অফিসার সাংবাদিক ও ব্যবসায়ী সেখানে উপস্থিত এবং তাঁদের অনেকের স্ত্রী। রীতিমতন একটা পার্টি, কিন্তু সেখানে একজনও নেপালি-গোখা নেই। দেখে খটকা লাগে। নেপালি-গোখাদের সঙ্গে অন্যদের সামাজিক মেলামেশা কি একেবারেই বন্ধ? বিচ্ছেদ কি একেবারে সম্পূর্ণ হয়ে গেছে? ফাটল আর কোনও দিন জোড়া লাগবে না? চরম গন্ডগোলের মধ্যেও বড় বড় ব্যবসায়ীরা এখানে নির্বিঘ্নে রয়ে গেছেন, তাঁদের কারুর কারুর অভিমত এই যে গোখা হিল কাউন্সিল হচ্ছে এই আন্দোলনের জয়ের প্রথম ধাপ। এরপর ওরা আলাদা রাজ্য না নিয়ে ছাড়বে না। এবং সেই সম্ভাবনায় এদের যে কিছু অসুবিধে ঘটবে, তাও মনে হল না।

এই আসরেই দেখা হয়ে গেল ডি আই জি রমেশ হান্ডার সঙ্গে। এর নাম ও বীরত্বের কাহিনিগুলি শুনলে মনে মনে ছবি তৈরি হয় এক জবরদস্ত পুলিশ সাহেবের, দশাশই চেহারা, বেড়ালের ল্যাজের মতন গোঁফ, চোখে কটমটে দৃষ্টি, গলায় বজ্রের আওয়াজ। আদতে ইনি একজন নম্র, লাজুক ধরনের মানুষ চাপা গলায় কথা বলেন। গোঁপ-টোপ কিছু নেই, মুখ-চোখে কোনও টেনশানের ছাপও নেই। বলাই বাহুল্য, ইনি একজন অসমসাহসী পুরুষ। সংকটের সময় ইনি নিজেই বহু অভিযান পরিচালনা করেন, একবার সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েও একটু নিরুদ্যম হননি, তাঁর চলাফেরাও নিয়ন্ত্রিত হয়নি। হান্ডার সঙ্গে আমার কিঞ্চিৎ পূর্ব পরিচয় ছিল, আমরা পাশাপাশি বসে গল্প করলাম বেশ খানিকক্ষণ, দার্জিলিং নিয়ে কোনও প্রশ্ন তুললাম না, সর্বক্ষণ সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে ওঁর নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না। আমারও তেমন মাথাব্যথা নেই। আমরা অন্যান্য গল্প, চেনা লোকদের ঘটনা নিয়ে হাস্য-পরিহাস করলাম প্রাণ খুলে।

এক সময় পার্টি ছেড়ে আমি চলে এলাম বাইরে। কাঁচের জানলার ওপাশে রাতের দার্জিলিং ঈষৎ ঝাঁপসাভাবে দেখা যায়। নিঃশব্দে সরু সরু বৃষ্টিপাত হচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে মিটিমিটি আলো। কোথাও কোনও শব্দ। এই শহরে আরও অনেকবার আসব নিশ্চয়ই। গোখারা নিজস্ব হিল কাউন্সিল গঠন করে এই অঞ্চলের উন্নতি করুক, স্থানীয় লোকদের প্রাধান্য স্থাপিত হোক, সে তো খুব ভালো কথা, কিন্তু বাঙালি মানস থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা কিছুতেই মুছে ফেলা যাবে না। এবার মেঘ-বৃষ্টির জন্য কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে দেখা হল না, পরের বার দেখা হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *