[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

পাহাড় যেখানে ডাকে

পাহাড় যেখানে ডাকে

কাঠমান্ডু থেকে চিনের সীমান্তের দিকে যে রাস্তাটা চলে গেছে, আমরা এগিয়ে চলেছি সেই রাস্তা ধরে। এই পথে ট্রলি বাস চলে। এই রাস্তাটা তৈরি করেছে চিনেরা, আর ট্রলি বাস জাপানিদের গড়া। আমাদের দেশে ট্রলি বাস নেই, কিন্তু এদেশে এসেও এবার ট্রলি বাসে চাপার সুযোগ হল না, জায়গা পেয়ে গেলুম ইয়েতি ট্রাভলস-এর আরামদায়ক কোচে।

এই পথেই পড়ে ভক্তপুর, নেপালের প্রাচীন এক নগরী। কিন্তু আপাতত আমরা ভক্তপুরে থামছি না, আমাদের গন্তব্য আরও দূরে।

কাঠমাণ্ডু উপত্যকা পা হওয়ার পরই শুরু হল পাহাড়ি পথ। এখানে একটা উঁচু জায়গায় পেছনে ফিরে দূরের কাঠমাণ্ডুকে দেখায় যেন এক মডেল নগরী। বড় অপূর্ব সেই দৃশ্য।

ছোট-ছোট পাহাড়ের গা দিয়ে ঘুরে-ঘুরে বাস যায়। ক্রমে পাহাড়গুলি বড় হয়ে উঠেছে। হাত বাড়ালেও ছোঁয়া যায় যে এইসব পাহাড়, এরাও সবাই হিমালয়ের এক একটি ঢেউ। হিমালয় নাম শুনলেই আমার রোমাঞ্চ হয়। এই যে পাহাড়ের শ্রেণি, একটার আড়ালে দেখা যায় আর একটির মাথা, এই রকম কিছু পাহাড়ের দূরত্বেই রয়েছেন নগাধিরাজ এভারেস্ট!

পিচ-বাঁধানো আধুনিক যে পথ দিয়ে এখন আমরা চলেছি, এক কালে এরই কাছাকাছি পার্বত্যপথ দিয়ে এখানকার মানুষ বাণিজ্য-পশরা নিয়ে যেত তিব্বত সীমান্তে। তিব্বতীয়রাও নেমে আসত সেই পথ দিয়ে। এখন সেই অবাধ বাণিজ্যের দিন আর নেই। এখন সব দেশের সীমান্তই সৈন্যরা পাহারা দেয়।

পাহাড়ের গায়ে গায়ে সাধারণ নেপালি চাষিদের বাড়ি। পাহাড়ের ঢালু গায়ে থাক-থাক কাটা চাষের খেত। দূর থেকে মনে হয়, ওই সব খেত যেন মানুষের তৈরি নয়। প্রাকৃতিক, ঠিক ছবির মতন। আসলে বহু বছরের বহু পরিশ্রমে মানুষই ওইভাবে পাহাড় কেটে ফসল ফলাচ্ছে।

চাষিদের বাড়িগুলোও আমাদের দেশের চাষিদের মতন নয় অধিকাংশ বাড়িই লালচে রঙের ইটের এবং দোতলা। খুব বড় নয়, কিন্তু পরিষ্কার, ছিমছাম। আমাদের দেশের গ্রামের দিকে যে খোলার ঘর বা ঝুপড়ি দেখা যায়, সেরকম একটাও চোখে পড়ল না। তাহলে ভারতীয় চাষিদের চেয়ে নেপালি চাষিদের অবস্থা কি ভালো? বোধহয় তাই।

দু-পাশের সবুজের মধ্য দিয়ে চলেছে কোচটা, এক সময় দেখতে পেলুম একটা টিলার ওপরে এক ঝাঁক ঘরবাড়ি। যত্ন করে তৈরি করা বাগান। আমাদের কোচ একটু বাদে থামল সেখানেই। রাস্তা থেকে বেশ কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে এলেই ধূলিখেল মাউন্টেন রিসর্ট। এর চত্বরের ওপরে দাঁড়ালে প্রথমটা বুক ধক করে ওঠে। যেন আমি পাহাড় দেখছি না, চারদিকের পাহাড়ই আমাদের দেখছে।

এখানে রয়েছে একটা বেশ বড়ে ডাইনিং রুম এবং কয়েকটি কটেজ। প্রত্যেকটি কটেজই স্বয়ংসম্পূর্ণ, দুটি করে শয্যা। এই শৈলাবাসটি দেখলে ইটালি কিংবা মেক্সিকোর কোনও হোটেল বলে মনে হয়। নাইট অফ দা ইগুয়ানা ফিলমে অ্যাভা গার্ডনার যে হোটেলটির মালিকানি ছিলেন, সেই হোটেলটির কথাও মনে পড়ে যেতে পারে। সব কিছুই সাহেবি কায়দায় সাজানো ও অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। এখানে অবশ্য কাছাকাছি সমুদ্র নেই, রয়েছে জঙ্গলময় উপত্যকা।

এই রকম একটা জায়গা খুঁজে বার করাই বড় কথা। সেই কৃতিত্ব এই মাউন্টেন রিসর্টের পরিচালক শ্রীযুক্ত বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ’র প্রাপ্য। তিনি ইয়েতি ট্রাভেলসের একজন অফিসার, সাহেব মেমদের নিয়ে নেপালের সব জায়গায় ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। তা ছাড়া এক সময় তাঁর শিকারের শখ ছিল, তাই নিরালা জঙ্গল অঞ্চলগুলি চেনেন। ঘুরতে-ঘুরতে একদিন এই টিলার ওপর দাঁড়িয়েই, উঁচু পাহাড়ঘেরা গোল দিগন্তের দিকে চেয়ে-চেয়ে তিনি সেই জায়গাটিকে ভালোবেসে ফেললেন। তিনি এখানে কিনে ফেললেন অনেকটা জমি, অর্থাৎ পুরো একটি পাহাড়ের চূড়া। তারপর প্রতিষ্ঠিত হল ধূলিখেল মাউন্টেন রিসর্ট। এসব মাত্র কয়েক বছর আগেকার কথা।

শীতকালে, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে এখান থেকেই দেখতে পাওয়া যায় বিশ্ববিখ্যাত কয়েকটি শৃঙ্গ। মা কালু, ধওলাগিরি, গৌরীশঙ্কর ইত্যাদি। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে এভারেস্টেরও দর্শন মিলতে পারে, তার জন্য আর একটা উঁচু টিলায় ওঠার দরকার। এমনকি ঘরে শুয়ে শুয়েও এই সব বরফ ঢাকা পাহাড় দেখা যায়, ঘরগুলো সেইভাবে তৈরি।

এখন বর্ষাকাল, দূরের পাহাড় সব জমাট মেঘে ঢাকা, কাছের পাহাড়গুলোতে চলেছে মেঘ ও রোদের খেলা। এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, এই ঝিকমিকে রোদ।

আমরা বেশ একটা বড় দল মিলে এসেছি। কথা ছিল, দুপুরে এখানে লাঞ্চ খেয়ে তারপর কিছুক্ষণ প্রকৃতির শোভা উপভোগ করে বিকেলে ফিরে যাওয়া। কিন্তু দু-এক ঘণ্টার মধ্যে আমি প্রকৃতির শোভা ঠিক হজম করতে পারি না, বিশেষত এত বড় বড় পাহাড়-মাখা প্রকৃতি। ফেরার আগে আমি হঠাৎ ঠিক করলুম, আমি আজ রাতটা এখানে থেকে যাব।

আমাদের দলটির ব্যবস্থাপনার ভার নিয়েছিলেন হানি হলিডে সংস্থার শ্রীস্বপন পোদ্দার। তাঁকে কানে-কানে কথাটি জানাতেই তিনি বললেন, নো প্রবলেম! ধূলিখেল মাউন্টেন রিসর্টের পরিচালক বিষ্ণু শ্ৰেষ্ঠ-ও প্রস্তাবটিতে রাজি হয়ে গেলেন সঙ্গে-সঙ্গে। বিকেল হওয়ার আগেই কোচটি ফিরে গেল কাঠমাণ্ডু। টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে আমি ওঁদের বিদায় জানালুম। তারপরই জায়গাটা অসম্ভব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

এই রকম নিস্তব্ধতার মধ্যেই টের পাওয়া যায় যে মানুষের কণ্ঠস্বর, একটা দুটো পাখির ডাক কিংবা বাতাসে গাছের পাতার শব্দ কত মধুর। প্রত্যেকটি আলাদা করে চেনা যায় এবং সূক্ষ্মতম ঝংকারও কানে আসে। পাহাড়ের গায়ে মেঘের ছায়া পড়ে অনবরত রূপ বদল হচ্ছে। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার কাছ দিয়েই নেমে গেছে গভীর উপত্যকা। তা এতই গভীর যে অনেক নীচে আমি দেখতে পাচ্ছি উড়ন্ত বকের ঝাঁক ও ভাসমান মেঘ। ওই উপত্যকার কোনও মানুষ হয়তো ভাবছে যে ওই বকের পাঁতি উড়ছে। আকাশের গা দিয়ে, আর আমি দেখছি ওরা মাটির কত কাছে!

এই জায়গাটিতে বড়-বড় ছাতা রাখা আছে, যাতে বৃষ্টি পড়লে আশ্রয় নেওয়া যায়। এক একটা গোল গাছও ছাতার মতন। এখানে চেয়ার টেনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়।

এক ফাঁকে আমি আমার ঘরটি দেখে এলুম। ডাইনিং হল থেকে টিলার ওপরের দিকে উঠে যেতে হয় খানিকটা। সেখানে লাল ইটের কটেজ। জানলায় অতি সূক্ষ্ম তারের জাল ও কাচ। পাশাপাশি দুটি খাটের বিছানা এত ধবধবে সাদা যে দুগ্ধফেননিভ বলতে ইচ্ছে করে। বাথরুম ঝকঝকে। চমৎকার ব্যবস্থা। বিছানায় শুয়ে পড়ে দেখলুম, বালিশে মাথা রেখেও পাহাড় দেখা যায়!

আবার বেরিয়ে এসে বসলুম উপত্যকার সীমান্তে। অনেক নীচে দেখা যাচ্ছে একটি দোতলা বাড়ি। তিনটি বাচ্চা মেয়ে খেলছে উঠোনে। এত উঁচু থেকে ওদের দেখাচ্ছে পুতুলের মতন।

একটু বাদে দুজন নেপালি যুবক এসে বসল আমার কাছাকাছি, তাদের হাতে বন্দুক, বিনা আলাপেই কথা বলতে শুরু করলুম ওদের সঙ্গে। যুবক দুটি বেশ উচ্চশিক্ষিত মনে হল। দুজনেই ব্যবসায় জড়িত, শিকারের শখ আছে। কাঠমাণ্ডু থেকে মাঝে-মাঝে চলে আসে এই দিকে শিকারের খোঁজে।

আমি জিগ্যেস করলুম, এ দিকে কী শিকার পাওয়া যায়?

হরিণ আছে নানা জাতের, লেপার্ড আছে যথেষ্ট, তা ছাড়া বুনো শুয়োর ও খরগোশ।

একজন লোক আঙুল দিয়ে নীচের উপত্যকার একটা জঙ্গলের দিক দেখিয়ে বলল, ওই তো ওইখানে কয়েকদিন আগেই একটা লেপার্ড মেরেছি।

শিকারের গল্প শুনতে সব সময়েই ভালো লাগে। পাহাড়ের গায়ে-গায়ে ভেড়ার লোমের মতন জঙ্গল। সেদিকে এবারে নতুনভাবে তাকালুম।

আমি রাত্তিরে এখানেই থাকব শুনে যুবক দুটি বেশ অবাক। বারবার জিগ্যেস করতে লাগল, এখানে রাত্রে থেকে কী করবেন? রাত্তিরে তো কিছুই করার নেই।

আমি বললুম, এত সুন্দর কটেজ বানিয়ে রেখেছে, তা কি রাত্তিরে থাকার জন্য নয়?

ওরা বলল, হ্যাঁ থাকে, সাহেবরা থাকতে আসে। তারা নির্জনতা আর পাহাড়ের নিঃশব্দ মহিমা উপভোগ করে।

আমি হেসে বললুম, সে কী! সাদা চামড়া না হলে কি নির্জনতা আর পাহাড়ের মহিমা উপভোগ করতে কোনও বাধা আছে?

ওরা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না, না, তা অবশ্য নয়। কিছু কিছু ভারতীয়ও আসে দেখেছি। তবে তারা তো আসে নারী-পুরুষ জোড়ায়-জোড়ায়। আপনি একেবারে একা।

আমি আপশোশের সুরে বললুম, যার কেমন ভাগ্য। যুবক দুটি চলে গেল একটু পরে। ওদের সঙ্গে গাড়ি আছে, রাত্তিরের মধ্যেই ফিরে যাবে। শহরে। আস্তে আস্তে বিকেলের আলো নরম হয়ে আসছে।

বিষ্ণু শ্রেষ্ঠ-ও এখানে থাকেন না রাত্রে। তিনি প্রত্যেকদিন আসেন না, তাঁর অন্য কাজ থাকে। শনিবার রবিবার এখানে থাকেন। সারা সপ্তাহ এখানে হোটেল চালায় তাঁর মেয়ে। মেয়েটির বয়েস একুশ-বাইশের বেশি নয়, একেবারে মেম-সাহেবের মতন ফুটফুটে চেহারা।

এখানে ইলেকট্রিসিটি নেই। আমার কাছে সেটাই আর একটি উপরি আকর্ষণ মনে হল। চতুর্দিকের পাহাড়ের সারি হাজার-হাজার বছর ধরে একই রকম রয়েছে, এর মধ্যে হঠাৎ এক জায়গায় কৃত্রিম আলো যেন খুবই বেমানান হত। সাড়ে সাতটার পর সব কিছু ডুবে গেল নিঝুম অন্ধকারে, পাহাড় ও আকাশ মিশে গেল একাকার হয়ে। শুধু মাঝে-মাঝে দেখা যায় গাড়ির হেড লাইট, চিনা সড়ক দিয়ে ট্রাক চলেছে। পাহাড়ের বাঁকে-বাঁকে তাদের শব্দ একবার বাড়ছে, একবার মিলিয়ে যাচ্ছে।

অনেক রাত পর্যন্ত আমার ঘুম তো দূরের কথা ঘুমের ইচ্ছেও মাথায় এল না। আলো নেই, কথা বলার একটি মানুষ নেই, এইরকম সময়ে যেন নিজেকে খুব কাছাকাছি পাওয়া যায়। দিনের পর দিন তো কাটে হইচই-এর মধ্যে, কত রকম ব্যস্ততা, কত ভুল বোঝাবুঝি, এত সব কিছুর মধ্যে নিজের সঙ্গেই শুধু কথাবার্তা হয় না। তা ছাড়া আমরা প্রতিনিয়ত সময় কাটাই ছোট-বড় মাঝারির সাহচর্যে। সত্যিকারের বৃহতের সংস্পর্শ লাভ আর কটা দিন ভাগ্যে ঘটে! এখন এই অন্ধকারের মধ্যে, যদিও চোখে দেখতে পাচ্ছি না, তবু টের পাচ্ছি হিমালয়ের মহান গাম্ভীর্য। এখানকার বাতাসে যেন রয়েছে দৈব স্পর্শ। নিজের নিশ্বাসই যেন বেশ পবিত্র লাগে। একা-একা বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর মনে হয়, হৃদয়ের ভেতরটা যেন ধোয়া-মোছা হয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে।

তারপর এক সময় মনে হল, সমবেত পাহাড় থেকে একটি ধ্বনি ভেসে আসছে। যেন ডাক উঠেছে। ভুলে যেও না, ভুলে যেও না, গাছপালা, পশুপাখির মতন মানুষও এই প্রকৃতিরও সন্তান!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *