[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

মনোহরণ অরণ্যে বারবার

মনোহরণ অরণ্যে বারবার

আমার জন্ম জলের দেশে। খুব ছোটবেলায় আমি বড় কোনও জঙ্গল দেখিনি। কৈশোরে কলকাতা শহরে এসে এত মানুষের জঙ্গল দেখে হকচকিয়ে গেছি।

আমি প্রথম মনোহরণ অরণ্য দেখি সাঁওতাল পরগনায়। স্কুলের গণ্ডি পেরুতে না পেরুতেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রায়ই ছুটে গেছি সিংভূম, মানভূমের নানান ছোট-ছোট জায়গায়। ধলা ভূম গড়, গালুডি প্রভৃতি অঞ্চল থেকে খানিকটা গেলেই চোখে পড়ত শাল-মহুয়া-সেগুনের ঘন বন, তেমন বিখ্যাত কিছু না, কিন্তু একবার ঢুকলে আর বেরুতে ইচ্ছে করে না। কুসুম নামে যে কোনও বড়সড় গাছ থাকতে পারে, তা আমার ধারণাতেই ছিল না। কোনও বইতেও আগে পড়িনি, সে গাছ প্রথম দেখি সাঁওতাল পরগনায়।

চাইবাসাকে কেন্দ্র করে অনেকবার গেছি শোডি, টেবো, বরাইবুরু, একবার কারও নামে একটি নদী দেখতে পেয়ে মনে হয়েছিল জঙ্গলের মধ্যে সেই নদীটিকে আমরাই প্রথম আবিষ্কার করলুম। ছোট-ছোট টিলার গায়ে মাখা জঙ্গল, লাল রঙের পাকদণ্ডি, অপ্রত্যাশিত সুখবরের মতন হঠাৎ হঠাৎ একটা ঝরনা, এই জায়গাগুলিকে মনে হত বড় আপন, বড় মাদকতাময়। নির্জন ফরেস্ট বাংলোগুলিতে অনাহুত ও রবাহুত হয়ে উঠে পড়েছি প্রায় জোরজার করে, কখনও হোমরাচোমরাদের আগমনে শ্যাচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছি চৌকিদারের ঘরে। এমনকী এক গ্রীষ্মে সরাসরি জঙ্গলের মধ্যে গাছতলায় রাত কাটাবার সৌভাগ্যও ঘটে গেছে, সে জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব ছিল না অবশ্য, ভাল্লুক ও হাতির পাল সম্পর্কে অনেক গুজব শোনা গেছে। কিন্তু তারা সশরীরে এসে জ্বালাতন করেনি। মনেই পড়েনি সাপের কথা। সেই একটা বয়েস, যখন মৃত্যুকে মনে হয় খেলার সঙ্গী।

পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত তরাই অঞ্চল উত্তর বাংলায়, আর কলকাতার খুব কাছেই ভুবনবিদিত সুন্দরবন। কিন্তু আমি বিহার-উড়িষ্যার প্রচুর জঙ্গল চষে বেড়ালেও পশ্চিম বাংলার এই দুই অরণ্য আমার দেখা হয়নি অনেকদিন। স্বাধীনতা অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গের পর উত্তরবঙ্গ বেশ দুরধিগম্য হয়ে গিয়েছিল। সেই সময় বার দু-এক দার্জিলিং যাওয়ার অভিজ্ঞতা মনে আছে। বড় ট্রেনে মনিহারি ঘাট, তারপর ফেরিতে গঙ্গা পার, তারপর ওপারে নেমেই বালির ওপর দিয়ে মালপত্র সমেত দৌড়োতে হত মিটার গেজের ট্রেনে জায়গা দখল করার জন্য। শিলিগুড়িতে নেমে আবার দেশলাই-এর বাক্সের মতন ছোট ট্রেন। তখন এত বেশি ট্যাক্সি-মিনিবাসের চল ছিল না ওদিকে। শিলিগুড়ি থেকে জলপাইগুড়ির দিকে মোড় নেওয়ার সুযোগ হয়নি একবারও, কারণ চেনাশুনো

থাকায় কোথায় রাত্রিবাস করব, কীভাবে জঙ্গলে ঘুরব, তার কোনও হদিশ জানা ছিল না। আর সুন্দরবন এত কাছে হলেও কলকাতার খুব কম লোকেই নিছক বেড়াবার জন্য সুন্দরবন যাওয়ার চিন্তা করত তখন। সুন্দরবন নামটা শুনলেই নরখাদক বাঘ, কুমির ও সাপের ছবি ভেসে উঠত এবং গোটা সুন্দরবনে তখন কোথাও বাইরের লোকের কোনও থাকবার জায়গা ছিল না। ক্যানিং শহরটি সারারাত জেগে থাকে। এই কথা শুনে আমরা একবার দলবেঁধে ক্যানিং-এ গিয়ে সারা রাত্রি মাছের বাজারে ঘুরেছি। সকালবেলা স্টিমার ঘাটে দাঁড়িয়ে প্রবল মাতলা নদীর দিকে তাকিয়ে সুন্দরবনের দিকে পাঠিয়ে দিয়েছি দীর্ঘশ্বাস।

বিভূতিভূষণের আরণ্যক উপন্যাস পড়ে আমি পুর্ণিয়ায় গিয়েছিলাম সেই অরণ্য দেখতে। কিন্তু কোথায় সেই লবটুলিয়া? পুর্ণিয়ার ধারেকাছে গভীর জঙ্গল নেই। বিভূতিভূষণের অরণ্যটি বোধহয় অনেকখানিই কাল্পনিক, সেই জন্যই ওই উপন্যাসের গাছপালার চেয়েও মনুষ্যচরিত্রগুলিই আমাদের মনে বেশি দাগ কেটে যায়। ভিকি বাম-এর লেখা গ্রিন ম্যানসন-এর অরণ্যের অনুভূতি আমি প্রথম পাই আসামে গিয়ে। টুকরো-টুকরো হয়ে যাওয়ার আগে গোটা আসাম রাজ্যটাই যেন ছিল অরণ্যময়। কাজিরাঙা-র মতন নামজাদা জঙ্গলের চেয়েও আমার বেশি ভালো লাগত পাহাড়ি রাস্তার দু-ধারে নামহীন বিস্তীর্ণ অরণ্য। শিলচর শহর থেকে লামডিং যাওয়ার ছোট ট্রেনে বসে দু’দিকে অরণ্য দেখতে দেখতে প্রথম শরীরে অনুভব করেছিলাম অকৃত্রিম আদিমতার শিহরণ। জাটিংগা নামের একটি দুর্দান্ত স্রোতস্বিনী নদীর কাছেই হারাং গাঁজাও নামে একটি ছোট্ট স্টেশন। তার মাঝামাঝি অকারণে দাঁড়িয়ে গেছে ট্রেন। দু’দিকে সবুজ অরণ্যের ঢেউ, তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, কোনওদিন যেন ওখানে মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি। ইচ্ছে করছিল, ট্রেন থেকে নেমে দৌড়ে চলে যাই।

সংরক্ষিত অরণ্যগুলির মধ্যে মানস-এর তুলনা নেই। বরপেটা রোড ধরে এসে জঙ্গল এলাকায় ঢোকার পরেই দুপাশে অজস্র কাঞ্চন ফুলের গাছ। যেন একটি কাঞ্চন সরণি। সাদা কাঞ্চন আমার প্রিয় ফুল। আমি প্রথম যে-বার মানসে যাই সে-বারে আসামে কিছু একটা গোলযোগ ছিল। সেই জন্য আমি ছাড়া আর কোনও যাত্রী ছিল না। ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের মধ্যে আমি পৌঁছেছিলাম জঙ্গলের অভ্যন্তরের বাংলোয়। সে অভিজ্ঞতার কথা আমি অন্যত্র লিখেছি। এই মানসেই আমি প্রথম চিড়িয়াখানার বাইরে বাঘের ডাক শুনতে পাই, খুব কাছ থেকে। যদিও চোখে দেখা যায়নি। এখানেই প্রাতঃভ্রমণকারী একা একটি বিশাল হাতিকে দেখে কিপলিং-এর উপন্যাসের হাতি-চরিত্রটির কথা মনে পড়েছিল। মানসের আর একটি বৈশিষ্ট্য হল এই যে দীর্ঘ দিনের ব্যবধানে সেখানে আবার গেলেও একটুও হতাশ হতে হয় না, বড়-বড় বৃক্ষের আন্দোলিত শিখর, ময়ূর ও ধনেশ পাখির ডাক মনে হয় অবিকল একই রকম আছে। বহু দূর বিস্তৃত ঘাস বনে হরিণের পালের অন্দোলন দেখে দেখে তৃষ্ণা মেটে না। কালের হস্তাবলেপ মানসের রূপ বিশেষ ঝরাতে পারেনি।

সে কথা কিন্তু হাজারিবাগ ন্যাশনাল পার্ক কিংবা বেতলা সম্পর্কে খাটে না। কয়েক বছর অন্তর-অন্তর ওইসব জায়গায় গেলে পুরোনো চেনাশুননা অনেক গাছ দেখতে পাওয়া যায় না। তাছাড়া ইদানীং কেমন যেন বাণিজ্যিক-বাণিজ্যিক ভাব। ছুটির দিনে বাস ভরতি লোকজন আসে, তারা মাইকে তারস্বরে হিন্দি গান বাজায়, পিকনিক করে, কয়েকটা পোষা হরিণ দেখার পর তারা রেডিমেড বাঘ কিংবা হাতি না পেয়ে অতিশয় বিরক্ত হয়।

উত্তরবঙ্গ সুগম হয় ফরাক্কায় সেতু তৈরি হওয়ার পর। তার কিছু আগে আমি উত্তরবঙ্গে প্রথম যাই চা-বাগানের সূত্রে। লঙ্কাপাড়া টি এস্টেটটি একেবারে ভুটান সীমান্তে, খাড়া প্রাচীরের মতন পাহাড়ের গা থেকে নেমে এসেছে এক ঝটিকার মতন নদী, স্থানীয় নাম পাগলিনী। চা-বাগান সংলগ্ন প্রচুর জমিতে জলা-জঙ্গল হয়ে আছে। মধেশিয়া বস্তির পাশ দিয়ে মাঝরাতে চলে যায় হাতির পাল। ভুটান পাহাড় থেকে শুধু পাগলা ঝোরা বা হাতির পালই আসে না, নেমে আসে। কাজের খোঁজে গরিব নেপালিরা। তারা চা-বাগানের কিনারায় কিংবা সরকারি খাস জমিতে ঝোঁপড়ি বানিয়ে কোনওরকমে মাথা গুঁজে থাকে। জঙ্গলের কাঠ-পাতার ওপর জীবিকা নির্বাহ করে। জ্যোৎস্না রাত্রে বারান্দায় বসে দূরের সেই নেপালি বস্তিগুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে সেই চা-বাগানের ম্যানেজার বলেছিলেন, দেখবেন, এদিকে নেপালিদের সংখ্যা যেমন দিন দিন বাড়ছে, শিগগিরই একদিন ওরা নেপালিস্থান দাবি করবে।

চা-বাগানে বছরের পর বছর চাকরি করতে কেমন লাগে তা আমি জানি না, তবে দিন সাতেকের জন্য বেড়াতে যাওয়ার জন্য এমন আদর্শ স্থান আর হয় না। চা-গাছের উচ্চতা একবুক, মাঝে-মাঝে থাকে লম্বা-লম্বা শেড ট্রি। এই কাননে দু-বেলা ভ্রমণ করলে চোখ ও মস্তিষ্কের বড় আরাম হয়। আমি তিন-চারটি চা-বাগানে কয়েকবার গেছি, এখনও সুযোগ পেলেই যেতে ইচ্ছে করে।

প্রথম প্রথম গিয়ে পুরো উত্তর বাংলাটাই অরণ্যময় মনে হত। জলদাপাড়া, গোরুমারা ইত্যাদি নাম করা জঙ্গল তো আছেই, তা ছাড়াও আরও কত জঙ্গল। এ যেন বাংলার এক নতুন রূপ। কলকাতা-কেন্দ্রিক সমতলের বাঙালিরা এই রূপটা খুব কম জানে। বাংলা সাহিত্যেও এইসব জঙ্গল নিয়ে তো প্রায় কিছুই লেখা হয়নি। বিভূতিভূষণও বাংলার অরণ্য নিয়ে কিছু লেখেননি। জিম করবেট উত্তরবঙ্গ কিংবা সুন্দরবনে আসেননি, বিহার পর্যন্ত এসে ফিরে গেছেন। তাই তাঁর অনবদ্য শিকার-কাহিনীগুলিতে বাংলার কোনও স্থান নেই।

আমি একবার বাসে চেপে মাদারিহাট যাচ্ছি, হঠাৎ বাসটা থেমে গেল। কেন? না, সামনেই তিনটি বুনো হাতি রাস্তা পার হচ্ছে। ওখানে এমন প্রায়ই হয়। আর একবার গিয়েছিলাম জয়ন্তী নামে একটি ছোট্ট জায়গায়, আলিপুরদুয়ার থেকে ছোট ট্রেন। মাঝখানে একটি স্টেশনের নাম রাজা-ভাত-খাওয়া। একজন সহযাত্রী বললেন, মাঝেমাঝে হাতির উপদ্রবে এখানকার স্টেশনমাস্টার ও অন্যান্যরা সন্ধের পরই পালিয়ে যায়। ট্রেন লাইনটি শেষ হয়ে গেছে জয়ন্তীতে এসে। আমরা সাধারণত জানি যে ট্রেন লাইন একটা বড় স্টেশনে শুরু হয়ে দূরের আর একটা কোনও বড় স্টেশনে শেষ হয়। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে ট্রেন লাইন যে ফুরিয়ে যায়, তা আগে ধারণা ছিল না। স্টেশনটির অদূরে একটি পায়ে হেঁটে পার হওয়ার মতন ঝরনা, তার ওদিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে কিছু দূর এগোতেই দুম-দুম করে শব্দ পাওয়া গেল। গুলির নয়, বোমার। আমার সঙ্গী আমার হাত চেপে ধরে বললেন, আর এগোনো ঠিক হবে না, হাতির পাল বেরিয়েছে।

জানলুম যে বক্সাইট না ডালোমাইট কী যেন আনতে ওই জঙ্গলের মধ্যে লরি ঢোকে। সামনে বুনো হাতির পাল এসে গেলে পটকা ফাটিয়ে তাদের ভয় দেখানো হয়। সেখানে তখন প্রচুর হাতি। প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাই প্রকৃতীশ বড়ুয়া ওরফে লালজি, যিনি হাতি বিক্রির ব্যাবসা করেন, তিনি বাচ্চা হাতি ধরার জন্য কাছেই ক্যাম্প করে আছেন। আমি ভাবলুম, বাঙালির জীবনে যদি হাতির এতখানি ভূমিকা থাকে, তাহলে হাতি নিয়ে কেউ কিছু লেখেননি কেন? প্রভাতকুমার মুখোঁপাধ্যায়ের একটি পোষা হাতির গল্প ছাড়া আর তো উল্লেখযোগ্য কিছু মনে পড়ে না।

জয়ন্তীর কথা আর একটি কারণে মনে আছে। ওখানেই আমি প্রথম তক্ষক দেখি। ছেলেবেলা থেকে তক্ষকের ডাক শুনে আসছি। কিন্তু এই প্রাণীটি বড়ই গোপন সঞ্চারী, সহজে দেখা যায় না।

এখন উত্তর বাংলায় গেলে মনটা হু-হুঁ করে। কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা ভাব। সেই নিবিড় লতাগুল্মময় বনরাজি কোন চুলোর গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে? কুচবিহার থেকে একবার চিলাপাতার জঙ্গলে গিয়ে যে প্রগাঢ় বাজয় নিস্তব্ধতা অনুভব করেছিলাম বহুক্ষণ ধরে। কয়েক বছর পরে সেখানে ফিরে গিয়ে তা কিছুই পেলাম না। শোনা গেল শুধু কাঠ কাটার একটা বিশ্রী শব্দ।

বাঁকুড়া-মেদিনীপুরেও এখানে সেখানে ছড়ানো অনেক জঙ্গল দেখেছি। এখন কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে জঙ্গল বাঁচাবার চেষ্টা হচ্ছে। কিছুদিন আগে একবার মুকুটমণিপুর থেকে যাচ্ছিলাম ঝিলিমিলির দিকে। পথের দুপাশে দেখি সার বেঁধে অগণন নারী-পুরুষ আসছে। তাদের প্রত্যেকের মাথায় কাঠের বোঝা। তারা জঙ্গল খালি করে আসছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। প্রথমে খুব রাগ হয়েছিল, মনে-মনে আমিও জার্মানির গ্রিন ক্লাবের সদস্য। কোথাও কারুকে গাছ কাটাতে দেখলেই ক্ষুব্ধ হই। কিন্তু পরে মনে হল, এরা গাছ কাটছে বাধ্য হয়ে। জঙ্গলের কাঠ এনে বিক্রি করাই এই জীর্ণ-শীর্ণ মানুষগুলির বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, এদের ওপর রাগ করা যায় না। অদূরদর্শী সরকার তো এদের জীবিকা কিংবা জ্বালানির কোনও বিকল্প ব্যবস্থা করেনি।

একবার কারুকে কিছু না জিগ্যেস করে আন্দামান যাওয়ার জন্য একখানা জাহাজের টিকিট কেটে ফেলেছিলুম। সেখান থেকে কোনও নেমন্তন্ন পাইনি। সেখানকার কারুকেই চিনি না। শুভার্থীরা জিগ্যেস করেছিল, হঠাৎ একা একা আন্দামান যাবে কেন? এর উত্তরে এভারেস্ট প্রসঙ্গে যে বিখ্যাত উক্তি আছে, ‘বিকজ ইট ইজ দেয়ার’, সেটি বলতে ইচ্ছে করে। যদিও এভারেস্টের সঙ্গে আন্দামানের কোনও তুলনাই চলে না। তবু বাঙালির ছেলে আন্দামান দেখব

কেন? জাহাজে আন্দামানের ভাড়াও এমন কিছু বেশি নয়, দিল্লি-বম্বে যেতে পারলে আন্দামান না যাওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? যারা কাশ্মীর কিংবা গোয়া বেড়াতে যায়, তারা আন্দামানের কথা চিন্তাও করে না। তাহারা কী হারাইতেছে তাহা তাহারা জানে না।

অবিভক্ত বাংলায় কত বিরাট সমুদ্র-উপকূল ছিল। তবু বাঙালি জাতি সমুদ্রবিমুখ, একমাত্র সিলেটের খালাসিরাই যা সমুদ্র চিনেছে। পশ্চিমে বাংলাতেই সমুদ্র তটরেখা কম নেই। তবু বাঙালিরা সমুদ্র দর্শনে ছুটে যায় পুরীতে। এখন দীঘা আর বকখালি টিমটিম করছে। তাও যারা সেখানে যায় তারা অনেকেই জলে নামে না। সমুদ্রভ্রমণ তো দুরের কথা আর আন্দামান তো কালাপানির দূরত্বে।

বঙ্গোপসাগরের জল কিন্তু কালো নয় মোটেই, গাঢ় নীল। এমনই নীল যে মনে হয় রয়াল বু কালির মতন, কলম ডোবালেই লেখা যাবে। জাহাজে যেতে চারদিন লাগার কথা, আমার বেলায় লাগল পাঁচদিন। একদিনের প্রবল ঝড়ে জাহাজ এক জায়গায় ঠায় থেমে রইল। আমারও বেশ বিনা পয়সার মধ্য সমুদ্রে সাইক্লোন দেখার অভিজ্ঞতা হয়ে গেল। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ‘কর্তা কাপ্তেন কইছে ছাইক্লোন হতি পারে,’ এই লাইনটা মনে পড়ছিল বারবা। কিন্তু ভয় হয়নি। জাহাজডুবির ঘটনা পৃথিবীতে এখন অতি বিরল। সেই ঝড় থামার পর ঝাঁকের পর ঝাঁক উড়ুক্কু মাছ দেখেছিলাম।

আন্দামানের সৌন্দর্য শ্বাসরুদ্ধকর যাকে বলে। গ্রিসের দ্বীপপুঞ্জ। কিংবা ইটালির ক্যম্পরির তুলনায় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ কোনও অংশে নূন নয়। আমি সবচেয়ে অবাক হয়েছি এখানকার অরণ্য দেখে। আন্দামানের জঙ্গল সম্পর্কে আমার আগে কোনও আন্দাজ ছিল না। আসামের জঙ্গল দেখে আমার যে অনুভূতি হয়েছিল, তা বদলে যায় আন্দামানে এসে। মনুষ্যবর্জিত এক একটি দ্বীপের ঘন, দুর্ভেদ্য বন দেখে মনে হয়, এই বনই সত্যিকারের আদিম ও অস্পৃষ্ট! এইসব বন দেখে আরও রোমাঞ্চ লাগে, কারণ অধিকাংশ গাছই চিনি না। জলের কাছাকাছি ম্যানগ্রোভ এর ঝাড় চিনতে পারি। কিন্তু একটু গভীরে যে-সব বিশাল বিশাল মহিরুহ, সেগুলি আমার অদৃষ্টপূর্ব। পাহাড়ি-পাইন ছাড়া এত লম্বা গাছও আমি আগে দেখিনি।

নিকোবর বাদ দিয়ে শুধু আন্দামানেই দ্বীপের সংখ্যা দুশোর বেশি। সুপেয় জলের অভাবে অধিকাংশ দ্বীপেই মানুষের বসতি নেই। কিন্তু আকাশের জলে বৃক্ষসংসার জমজমাট।

একটি-দুটি দ্বীপে নেমেছি একপ্রকার গা ছমছমানি নিয়ে। পরিষ্কার বালিতে নানা রকম নুড়ি, ঝিনুক ছড়ানো, যা সবই সংগ্রহযোগ্য মনে হয়। পাশের জঙ্গল দিনের বেলাতেই অন্ধকার, বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দেই ভয় লাগে। যদিও এইসব জঙ্গলে বাঘ-ভাল্লুক নেই, বিষাক্ত সাপও নেই, কিন্তু জারোয়া নামে নিবাবরণ, অরণ্যচারী আদিবাসীদের সম্পর্কে অনেক রোমহর্ষক কাহিনি শোনা আছে। যারা সভ্য মানুষদের ঘোরতর অপছন্দ করে। আমি নিজেকে তেমন সভ্য মনে করি না। কিন্তু জারোয়ারা তা বুঝবে কী করে। আমার জামা-কাপড় দেখেই যদি তারা বিষাক্ত তীর মেরে দেয়?

নৌকোয় বা লঞ্চে বসেই এইসব দ্বীপ-জঙ্গলের শোভা দেখা নিরাপদ। অন্তত এই রকমই অবস্থা ছিল, আমি যখন যাই সেই সময়ে।

একদিন পোর্ট ব্লেয়ার থেকে লঞ্চ নিয়ে রঙ্গত নামে একটা দ্বীপে গিয়েছিলাম। সকালবেলা যাত্রা করে পৌঁছেছিলাম প্রায় সন্ধের সময়, সারাদিন ঠায় দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে লঞ্চের ওপরে খোলা ডেকে। আন্দামানে যখন তখন বৃষ্টি আবার তার পরের মুহূর্তেই খটখটে রোদ। সুতরাং আমি পর্যায়ক্রমে বৃষ্টিতে ভিজেছি ও রোদে পুড়েছি।

এই রকম কষ্টকর জার্নির মধ্যেও চোখ জুড়িয়েছে দু’ধারের দৃশ্য। সমুদ্র সেখানে মরুভূমির মতন ধু-ধু নয়, একটু দূরে-দূরেই ছোট-বড় দ্বীপ। কোনও দ্বীপই নগ্ন নয়, গাছপালায় ঠাসা। মনে হয় যেন প্রকৃতির কুমারী উদ্যান। একসঙ্গে এত নীল ও সবুজ রং আর কখনও দেখিনি।

রঙ্গত দ্বীপটি বেশ বড়, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বাস চলাচল করে। অন্য প্রান্তের জাহাজঘাটার নামটি বড় সুন্দর, মায়া বন্দর। প্রগাঢ় বনানীর মধ্য দিয়ে একটিই মাত্র পথ। আমি কেন যেন মাঝপথে নেমে পড়েছিলাম। মাঝে-মাঝে জঙ্গল সাফ করে উদ্বাস্তুদের বসতি, ধান জমি। ইস্কুল। আমি যেখানে নেমেছি, সেখানেও দু-চারখানা ঘরবাড়ি রয়েছে, পোষা কুকুরের ডাক শোনা যায়। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেলাভূমিতে পৌঁছে এক বিচিত্র দৃশ্য দেখলাম। চার পা বাঁধা অবস্থায় একটা বিশাল হরিণ পড়ে আছে সেখানে। তখনও জীবন্ত। হরিণটির নীচের পায়ের দিকটা ডুবে গেছে জলে। শরীরের অর্ধেকটা বালির ওপর। জোয়ারের জল একটু-একটু করে বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্র ওপরে উঠে এসে হরিণটাকে গ্রাস করবে। আমাকে দেখতে পেয়ে হরিণটির দু-চোখের তারা কেঁপে উঠল।

আন্দামানের কোনো কোনও বনে হরিণের সংখ্যা অজস্র। মূল ভূখণ্ড থেকেই কিছু হরিণ নিয়ে এক সময় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। বাঘ নেই বলে হরিণদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি হয়েছে। পোর্টব্লেয়ারে তখন হরিণের চামড়ার দাম তিন-চার টাকা, মাংসের কিলোর দামও ওইরকম। অন্যান্য দ্বীপে পয়সা দিয়ে কেউ হরিণের মাংস কেনে না। যেখানে উদ্বাস্তুরা চাষবাস করছে, সেখানে হরিণের পাল এসে ফসল নষ্ট করে। হরিণ একটা উপদ্রব। কোনও এক সময় কেউ একটা হরিণ মারলে সরকার থেকে একটাকা করে বকশিশ দেওয়া হত।

তবু হাত-পা বেঁধে একটি জীবন্ত হরিণকে জলে ফেলে দেওয়া হবে। এ দৃশ্য আমার কাছে অসহ্য বোধ হয়। আমি ছুটে গিয়ে একটি বাড়িতে ডাকাডাকি করে এক ভদ্রলোককে ঘটনাটি জানালুম। ভদ্রলোক আমার চাঞ্চল্য দেখেও গা করলেন না। বললেন, ওই হরিণগুলো মহা হারামজাদা!

আমি আবার ফিরে এলুম বেলাভূমিতে। হরিণটির চোখের ভাষার মিনতি অগ্রাহ্য করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি চেষ্টা করলুম ওর সামনের পায়ের বাঁধন খুলে দিতে। কিন্তু কাজটা মোটেই সোজা নয়। আমার কাছে–ছুরি-টুরি কিছুই ছিল না। হরিণটির মাথায় বড় বড় ডালপালার মতন ছড়ানো, ধারালো শিং, আমি কাছে যেতেই হরিণটি আরও ভয় পেয়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। সে আমাকে উদ্ধারকারী হিসেবে চিনতে পারছে না। আর একজন আততায়ী ভাবছে। আমার চেষ্টা ব্যর্থ হল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সমুদ্রের ঢেউ তাকে গ্রাস করে নিয়ে গেল। আমার জীবনে সেটি একটি অবিস্মরণীয় মৃত্যুদৃশ্য।

ওই রঙ্গত দ্বীপের জঙ্গলেই একদিন আচমকা গোটা তিনেক হাতি দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলুম। সে হাতিগুলো অবশ্য ঠিক বুনো হাতিও নয়, পোষাও নয়। মাঝামাঝি। এক সময় কোনও একজন কাঠ-ব্যবসায়ী বড়-বড় কাঠের গুঁড়ি বহন করবার জন্য মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকগুলি হাতি নিয়ে গিয়েছিলেন। পরে তাঁর ব্যাবসা ফেল করলে তিনি আর হাতিগুলো ফিরিয়ে আনার ঝামেলা নিতে চাননি। সেগুলোকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছেন। দু-এক পুরুষের মধ্যেই যে তারা আবার পুরোপুরি বুনো হাতি হয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী!

আন্দামান ভ্রমণের দু-তিন বছর পর আমি প্রথম সুন্দরবনে বেড়াতে যাই। কলকাতার সবচেয়ে কাছে যে জঙ্গল সেখানে যেতে আমার এত দেরি হল। পরিচিত একজনের সূত্রে একজন যুবকের সঙ্গে আলাপ হল। যে চাকরিবাকরি ছেড়ে সুন্দরবনে চাষবাসের কাজ আত্মনিয়োগ করেছে। অবশ্য আগে থেকেই সাতজেলিয়া গ্রামে তাদের পারিবারিক জমি ও একটি বাড়ি ছিল।

হ্যামিলটন সাহেবের কাছারি বাড়ি ছিল এই সাতজেলিয়ায়। সেখানে সেই আমলেই দু-একটি পাকা বাড়ি তৈরি হয়েছিল। সাতজেলিয়ার আস্তানা গেড়ে সেখান থেকে নৌকো ভাড়া করে শুরু হয় সুন্দরবন পরিভ্রমণ।

সুন্দরবন এমনই একটি জঙ্গল, যেখানে পায়ে হেঁটে ঘোরার কোনও উপায়ই নেই। কাঠুরে ও মধু সন্ধানীরা বাধ্য হয়েই পায়ে হেঁটে জঙ্গলে ঢোকে বটে, তাদের দল থেকে একজন দুজন প্রায়ই ফেরে না। বাইরের লোকরা এভাবে জঙ্গলে ঢোকার অনুমতিই পাবে না। লঞ্চে চেপে নদীর দুধারের জঙ্গল দেখা আর সিনেমার জঙ্গল দেখা প্রায় একই রকম। সুন্দরবনের জল-জঙ্গলের সঙ্গে যতটা সম্ভব নিবিড় পরিচয় নৌকোতেই হয়, তাতে রোমাঞ্চ আছে। সেই প্রথমবারেই নৌকো নিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে গভীর রাতে আমরা রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম। রাস্তা মানে, নদীপথ। জঙ্গলের মধ্যে-মধ্যে অসংখ্য নদী আর খাঁড়ি। কিছুতেই আর ফিরে আসার পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে শুনেছিলাম, বাঘের মুখে না পড়লেও ডাকাতের পাল্লায় যে পড়িনি তা আমাদের সাত পুরুষের ভাগ্য। ওখানকার ডাকাতরা নৌকোটা তো নেয়ই, তা ছাড়া জামাকাপড় পর্যন্ত খুলে নিয়ে উলঙ্গ নৌকো-যাত্রীদের জঙ্গলের কিনারে নামিয়ে নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়।

সাতজেলিয়ার একটু আগে রাঙাবেলিয়া মোটামুটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম, সেখানে পরিচয় হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এবং ওই অঞ্চলে টেগোর প্রজেক্টের কর্ণধার তুষার কাঞ্জিলালের সঙ্গে। ফলে সুন্দরবনে আমার আস্তানার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর আমি নানা দিক দিয়ে সুন্দরবন গেছি, কিছুতেই সুন্দরবনের আকর্ষণ পুরোনো হয় না।

আমি কোনওবারই সুন্দরবনে বাঘ দেখিনি, দেখতেও চাই না। জংলী জানোয়ার দেখার একটা উদগ্র বাসনা নিয়ে আমি কখনও জঙ্গলে যাইনি, এমনি যে-কোনও জঙ্গলে গেলেই শরীরে একরকম মাদকতা বোধ হয়। তা সে যত ছোট জঙ্গলই হোক। তা ছাড়া একবার আমি একটি জঙ্গলে গিয়ে এত জন্তু-জানোয়ার দেখেছি যে পেট ভরে গেছে। সারা জীবনে আর না দেখলেও চলবে। হয়তো শুনলে এখানে অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে যে আমি একসঙ্গে অন্তত পাঁচ সাত শো হরিণের ঝাঁক দেখেছি। খোলা আকাশের নীচে দশ ফুট দুরত্ব থেকে দেখেছি দশ বারোটি সিংহ, দুটি লেপার্ড দু’দিক থেকে তাড়া করে হরিণ ধরছে এই দৃশ্য দেখেছি অনেকক্ষণ ধরে। হাতির পাল গণ্ডার ও জিরাফ বহু। এমনকী রাত্তিরে আমার তাঁবুর পাশে ফোঁস ফোঁস শব্দ

শুনে জেব্রার পাল ভেবে উঁকি মেরে দেখি দুটি প্রকাণ্ড জলহস্তী। এসব সিনেমার দৃশ্য নয়। কল্পনাও নয়, এই সবই আমি দেখেছি কেনিয়ার মাসাইমারা অরণ্যে। এক সময় আমার মনে হয়েছিল, উঃ যথেষ্ট হয়েছে, আর জন্তু-জানোয়ার দেখতে চাই না! তবে সেখানে অরণ্য বিশেষ ছিল না। এখানে আমি বিদেশের অরণ্যের প্রসঙ্গ আনছিও না।

সুন্দরবনে বাঘের চেয়েও অনেক বিপজ্জনক হচ্ছে সাপ। শীতকালের দুমাস ছাড়া সুন্দরবনে সাপের ভয় সব সময়। যতবারই সাপ দেখি, বুক কেঁপে ওঠে, বোধহয় সামনাসামনি কোনও নরখাদকে দেখলেও এত ভয় পাব না। একবার সুন্দরবনে একটি খামার বাড়িতে বসে সন্ধেবেলা গল্পগুজব করছি, হঠাৎ একটু দূরে ধানখেতে কীসের যেন একটা গোলমাল হল। আমরা দৌড়ে গেলুম। একটি জোয়ান ছেলে আগাছা নিড়ড়াচ্ছিল। হঠাৎ তাকে সাপে কামড়েছে। ছেলেটি অত্যন্ত তেজি। তার ধারণা সাপটা ঠিক বিষ ঢালতে পারেনি, সে বাপ-মা তুলে গালগাল দিতে দিতে হাতের কাস্তেটা দিয়ে সাপটাকে কেটে টুকরো-টুকরো করে ফেলল, তারপর হাসতে হাসতে বাড়ি চলে গেল।

পরদিন দুপুরে আমরা নৌকো নিয়ে জঙ্গল দেখতে বেরিয়েছি, রায়মঙ্গল নদী দিয়ে যেতে যেতে দেখলুম ভেসে আসছে একটি কলার মান্দাস। তাতে মশারি টানানো, ফুলের মালা দিয়ে সাজানো, সামনে নাম-ঠিকানা লেখা কাগজ আঁটা, মশারির মধ্যে সেই ছেলেটির শরীর, গতকাল সন্ধেবেলা যাকে জলজ্যান্ত দেখেছিলুম।

তখনই মনে মনে শপথ করেছিলুম, আর কোনওবার গ্রীষ্মকালে সুন্দরবনে যাব না। সে শপথ রক্ষা করা যায়নি, আরও কয়েকবার গেছি। সুন্দর রহস্যময় ওই অরণ্যের যেন একটা নিজস্ব ডাক আছে।

‘দা সিক্রেট লাইফ অফ প্ল্যান্টস’ বইটি পড়ার পর আমি ভুল করেও কক্ষনো গাছের একটা পাতা ছিড়ি না। গাছ যে মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়, তা সত্যি সত্যি অনুভব করি এখন। গাছ মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে যত খুশি মাথা উঁচু করে, গভীর বনে কোনও অতিকায় শিমুল গাছ দেখলে মনে হয়, এই গাছের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এখন জঙ্গলে গেলে যে-কোনও সুযোগেই কোনো গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসি, মুনি-ঋষিদের মতন তপস্যা করি না বটে তবু কিছুক্ষণ চুপ থাকলেই মাথার মধ্যে শান্তি পাই।

বহু অরণ্যে ঘুরেছি, এখনও না দেখা রয়ে গেছে কত বনভূমি। জঙ্গলে গিয়ে কখনও সেরকম বিপদে পড়িনি, বরং অনেক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি। এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় যে গাছেরাই নিঃশব্দ বার্তা পাঠিয়ে বাঁচিয়েছে।

একটা মজার ঘটনা দিয়ে শেষ করি। কয়েক বছর আগে আমাদের এক বন্ধু ও বৃক্ষলতাগুল্মতাত্বিক শম্ভুলাল বসাক-এর সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের বস্তার জেলার জঙ্গলে ঘুরছিলাম আমি, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সমীর সেনগুপ্ত। নারায়ণপুর শহর থেকে একদিন একটা ভাড়া করা জিপে আমরা রওনা হলুম অবুঝমারের দিকে। কেন যে আমরা অবুঝমারের দিকে যাচ্ছি, তার কোনও কারণ নেই। অনেক জঙ্গল এর মধ্যেই ঘোরা হয়েছে। তবু আর একটি জঙ্গল যাওয়া।

রাস্তাটি এত খারাপ যে কহতব্য নয়। কোথাও কোথাও রাস্তাই নেই। মস্ত বড় বড় খাদ। কোথাও হাঁটু-গভীর নদী, তবু আমরা চলেছি অবুঝমারের দিকে। দুপাশে নিচ্ছিদ্র জঙ্গল, তাতে রয়েছে অনেক বাঁশঝাড়, আমলকি গাছ, তেজপাতা ও লবঙ্গ গাছ। আরও বহু নাম না জানা গাছ। এমন কিছু কিছু ফুল, যা শম্ভুলালও চেনে না। কিছুক্ষণ পরে জিপটি গোলমাল করতে লাগল। তাতে জিপটিকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না, রাস্তার অবস্থার জন্য তার একটুআধটু বিদ্রোহ জানানো স্বাভাবিক। ড্রাইভারের ওপর জিপটিকে দুরস্ত করার ভার দিয়ে আমরা পায়ে হেঁটে ঘুরতে লাগলুম জঙ্গলের মধ্যে, প্রচুর আমলকি পাড়া হল, হাসির আওয়াজে বন কাঁপানো হল। তখনও আমরা ভাবতেই পারিনি যে জিপগাড়ির ড্রাইভারটি এক অতি আনাড়ি মেকানিক। সে সমস্ত যন্ত্রপাতি খুলে ফেলে কিছুই আর ঠিকমতন লাগাতে পারছে না। জিপটি আগে যদি বা একটু আধটু চলছিল, এখন একেবারে অনড়, ইঞ্জিনও কোনও শব্দ করে না।

জঙ্গলের মধ্যে বিকেল হতে না হতেই এক রকমের গাঢ় ছায়া নেমে আসে। অপ্সরাদের তখন ঝরনার জলে স্নান করার জন্য নেমে আসার সময়। তখন আমাদের খেয়াল হল ফিরব কী করে? যেখানে আমরা গাড়িভ্রষ্ট হয়েছি, সেখান থেকে অবুঝমার কুড়ি-বাইশ মাইল, নারায়ণপুরও সেই রকম দুরত্ব, মাঝখানে আর কোনও জনবসতি নেই। প্রথমে আমরা হেঁটেই ফিরে যাব বলে বেশ মনের জোর নিয়ে হাঁটতে শুরু করলুম। এই পথে আমরা আর কোনও গাড়ি দেখিনি। তবে পায়ে হাঁটা মানুষ কিছু দেখেছি। এরা সকালবেলা অবুঝমার থেকে রওনা দিয়েছে। সন্ধেবেলা নারায়ণপুরে পৌঁছবে, পরদিন হাটে যাবে। কিন্তু ওদের মতন কি আমরা হাঁটতে পারি? পাহাড়ি

চড়াই-উতরাই রাস্তা। ঘণ্টাখানেক বীরদর্পে হাঁটার পর দেখা গেল আমরা আড়াই-তিন মাইলের বেশি যেতে পারিনি। এই গতিতে চললে আমাদের অন্তত সাত-আট ঘণ্টা লাগবে পৌঁছতে। তা-ও যদি একটানা সাত আট ঘন্টা হাঁটার সামর্থ্য থাকে! বোঝা গেল, সেটা অসম্ভব। রাত্তিরটা জঙ্গলেই কাটাতে হবে।

ঝুপ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসছে। তখন খেয়াল হল, এই জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ার টানোয়ার নেই তো? শক্তি একজন পথচারীকে জিগ্যেস করল। ভাই, এই জঙ্গলে বাঘ-টাঘ নেই তো? লোকটি খুব অবাক হয়ে উত্তর দিল, জঙ্গলে বাঘ থাকবে না তো কি শহরে থাকবে?

আমরা কাছাকাছি গোল হয়ে বসলুম। মাঝখানে জ্বাললুম আগুন। সঙ্গে অস্ত্র কিছু নেই, খাবারদাবারও নেই। কেন যেন আমরা ভেবে রেখেছিলুম, অবুঝমারে পৌঁছে আমরা সবকিছু পেয়ে যাব। এখন আমাদের সারারাত পেটে কিল মেরে জেগে থাকতে হবে। অন্ধকারের মধ্যে জোনাকি দেখলেও মনে হচ্ছে বাঘের চোখ। আবার জোনাকি বলে উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। সত্যিই তো সে জঙ্গলে বাঘ আছে এবং ওদিককার ভাল্লুকগুলোও বড় হিংস্র। ব্যাপারটা বড্ড গল্প গল্প অথচ সত্যি আমাদের জীবনে ঘটছে, এখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

হাটের যাত্রীদের একজনের হাতে আমরা আমাদের বিপদের কথা জানিয়ে নারায়ণপুরের এস ডি ও কে একটি চিঠি দিয়ে দিয়েছি। সেই লোকটি চিঠিটা দেবে কি না। কিংবা কখন দেবে, কিংবা এস ডি ও অন্য জায়গায় ট্যুরে গেছেন কি না। কিংবা আমাদের চিঠি পেলেও তিনি গুরত্ব দেবেন কি না, এরকম অনেকগুলো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সুতরাং এক্ষেত্রে বিপদের ব্যাপারটা একেবারে তুচ্ছ করে সারারাত হাসি ঠাট্টা করে কাটাই ঠিক কাজ। কিন্তু তেমনভাবে হাসা যাচ্ছে না। বিপদের ঝুঁকিটা বড়ই বেশি। আকাশে জ্যোৎস্না নেই, জঙ্গল একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। একটা পাতা খসে পড়ার আওয়াজও ভয়ঙ্কর মনে হয়।

খানিকবাদে পেলাম একটা যান্ত্রিক আওয়াজ, এবং গাড়ির আলো। সারাদিন সে রাস্তায় আমরা আমাদের জিপ ছাড়া দ্বিতীয় গাড়ি দেখিনি, এই গাড়িটার আলোও আসছে রাস্তা দিয়ে নয়। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। আমরা হই হই করে উঠে দাঁড়ালুম। সেটা একটা বাঁশ বোঝাই ট্রাক, জঙ্গলের মধ্যে একটা পাহাড়ের চূড়ায় প্রচুর বাঁশঝাড় আছে। এই ট্রাকটি সেই বাঁশ আনতে যায় দিনে একবার। আমাদের দ্বিতীয়বার অনুরোধ করতে হল না, ট্রাক ড্রাইভারটি আমাদের তুলে

নিল। যে-রাস্তায় জিপ চালানোই শক্ত, সে রাস্তায় অতবড় একটা ভারী ট্রাক চালানো যে কত বিপজ্জনক তা বলে বোঝাতে হবে না। আমরা ড্রাইভার সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি

এখানে প্রত্যেক দিন ট্রাক নিয়ে আসেন, ফিরে যান কী করে? ড্রাইভার দার্শনিকের গলায় উত্তর। দিল, মানুষ পয়সা রোজগারের জন্য কত কী-ই তো করে! মাঝরাস্তায় আমরা আর একটা জিপের দেখা পেলুম, সেটি এস ডি ও পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ আমাদের উদ্ধারের জন্য প্রচুর বন্দোবস্ত। তবু নারায়ণপুরে ফিরে আসবার পর আমাদের মনে হল, সারারাত জঙ্গলে কাটালেই বোধহয় বেশ হত! এখনও আমরা দেখা হলেই আলোচনা করি। বাস্তারের ওই জঙ্গলে আবার ফিরে যেতে হবে, আগুন জ্বেলে একটা রাত কাটাতে হবে ওখানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *