[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

জেনিভায় দোল

জেনিভায় দোল

১৫ আগস্ট খ্রিস্টানদেরও একটি পবিত্র উৎসবের দিন। এইদিন ক্যাথলিক-প্রধান দেশগুলিতে ছুটি থাকে ও খুব উৎসব হয়।

এক ১৫ আগস্টে আমি সুইটসারল্যানডের জেনিভায়, ওইদিন দেশে নানান উৎসব ও হইহই হচ্ছে ভেবে একটু মনমরা লাগছিল। আমার বন্ধু বিমান বললেন, চলো হে, সন্ধেবেলা আজ লেকের ধারে মেলা আছে। দেখবে রঙের বাহার। সেজেগুঁজে বেরোলুম সন্ধেবেলা। বিখ্যাত জল হাওয়ার দেশ। আমি অবশ্য কাশ্মীরের সঙ্গে কোনও তফাৎ পাইনি, তবু যা পেয়েছি সেই মুহূর্তে তো তার তুলনা নেই। ফুরফুর করে অল্প শীতের হাওয়া দিচ্ছে, চলেছি হ্রদের দিকে। ছোট শহর জেনিভার সন্ধেবেলার একমাত্র আকর্ষণ হ্রদের তীরে, সেখানে ভিড় ভেঙে পড়ে। হ্রদের পাড়ে মানুষ, হ্রদের ওপর নৌকোয় মানুষ।

সেদিন গিয়ে দেখি, হ্রদের পাড়ে অনেকখানি জায়গা ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘেরা জায়গায় ঢুকতে হলে পাঁচ ফ্রাংকের (পাঁচ টাকা) টিকিট কিনতে হবে। সেখানে সন্ধেবেলা কনসার্ট হবে, একটু রাতে পোড়ানো হবে বাজি। টিকিটের কথা শুনেই বিমান আর আমি চোখাচোখি করলুম। চোখে চোখেই কথা হয়ে গেল, টিকিট কাটতে হবে, পাগল হয়েছ? কনসার্ট আর বাজি দুটোই দূর থেকে শোনা আর দেখার জিনিস। ওর জন্য টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকার কী দরকার!

কিন্তু দলে-দলে মেয়ে পুরুষ ঢুকছে সেখানে। মানুষের মাথায় বহুদূর দেখা যায় না। এত লোক ঢুকছে কেন, বিশেষ কোনও আকর্ষণ আছে ওখানে। বিমানের সঙ্গে আবার চোখে-চোখে কথা হল, কী বিনা টিকিটে ঢোক যায় না? দেশে থাকতে কত জলসায়, পাড়ার থিয়েটারে গেট ভেঙে ঢুকেছি। আর এই সামান্য পুঁচকে দেশে? তক্ষনি ঠিক করে নিয়েছি বিনা টিকিটে ঢুকতে হবে।

অবিবাহিত বাঙালি যুবক, এর মতো মারাত্মক চিজ নাকি দুনিয়ায় দুটি নেই, অনেকের মুখেই শুনেছি। বিমান আর আমি তখুনি মতলব এঁটে ফেললুম। এদিকটাই প্রধান ঢোকার পথ, নিশ্চয়ই উলটোদিক থেকে ঢোকা সহজ হবে। শহরের নানান গলি-খুঁজি ঘুরে কয়েকবার পথ হারিয়ে, উৎসব প্রাঙ্গণের অপর পাড়ে লেকের ধারে যখন এসে পৌঁছেছি, তখন কনসার্ট প্রায় শেষ। টুক করে আমরা ভেতরে ঢুকে পড়েছি।

তখন শুরু হল বাজি পোড়ানো। এ-রকম বাজি পোড়ানো উৎসব আমি আগে আর কখনও দেখিনি। এত রং-বেরঙের অদ্ভুত রকমের বাজির সমাবেশ দেখলে চমৎকৃত হতে হয়। তখন বুঝতে পারলুম, কেন পাঁচ টাকার টিকিট। এই বাজির তৈরির খরচের তুলনায় পাঁচ টাকার টিকিট তো কিছুই নয়। এরকম বাজি তৈরি করতে যখন পারে, তখন সুইটসারল্যানড চাঁদে রকেট পাঠায় না কেন? একজন বিখ্যাত লেখক বলেছিলেন, সুইটসারল্যানড তিনশো বছর ধরে শ্রেষ্ঠ ঘাড়ি তৈরি করছে, অথচ পৃথিবীতে সময়ের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি পিছিয়ে আছে সুইসরাই। কিন্তু না, এ-রকম বাজির বাহার দেখে, শূন্যে মিলিয়ে যাওয়া অসংখ্য ফুলঝুরি দেখে মনে হয়, এ জাতের পক্ষে চাঁদে রকেট পাঠানোও ছেলেখেলা।

এরপরই কিন্তু আরম্ভ হল আসল উৎসব। সেই উৎসবের বর্ণনা দেওয়ার জন্যই এই লেখা। ১৫ আগস্ট আমাদের স্বাধীনতা দিবস, সেদিন আমি সুইটসারল্যানডে বসে দোল খেললুম। এর চেয়ে সুন্দর দোল খেলা আর হয় না।

বাজি উৎসবের পরেই সমস্ত লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। আরম্ভ হল দোল খেলা। এ-দোলে জল রং নেই। আবির-ফাগও নেই জামাকামড় নষ্ট হওয়ার। টুকরো-টুকরো কুচি-কুচি নানারঙের কাগজ। সেই কাগজের কুচো বড় বড় প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে। সমস্ত ছেলেমেয়ের হাতে সেই প্যাকেট, এ ওর মুখে, মাথায়, পিঠে, বুকে মুঠো-মুঠো কাগজের কুচি ছুঁড়ে মারছে। অবিকল আমাদের ফাগ খেলা, শুধু ফাগের বদলে কুচি কাগজ। চেনা-অচেনা, মেয়েপুরুষ, ছেলে-বুড়ো কোনও ভেদ নেই, হো-হো হাসির মধ্যে ছুঁড়ে মারছে এ ওকে। কেউ হয়তে কানের ফুটো থেকে কাগজ কুচি বার করছে, আর একটা মেয়ে হাসতে-হাসতে এসে অন্য কানের ফুটোয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কেউ হয়তো প্রতিবাদ করার জন্য মুখ খুলছে–অমনি খোলা মুখের মধ্যে ঢুকে গেল এক মুঠো কাগজ। অসম্ভব ভিড় ঠেলে এগুনো যায় না। পথে এক ফুট প্রায় কাগজের কুচি জমে গেছে। মাঝে-মাঝে ঠিক রথের মেলার মতন আলুর চপ, ফুলুরির দোকান (অর্থাৎ স্টেক আর হট ডগ)। হঠাৎ দেখলুম, আমি বিমানকে হারিয়ে ফেলেছিভিড়ের মধ্যে।

একা-একা রং কানার মতো ঘুরছি। মাথায় মাঝে-মাঝে ঠকাস-ঠকাস করে মার খাচ্ছি। রঙিন কাগজ ছোঁড়ার সঙ্গে-সঙ্গে আর একটা জিনিস আছে। জগন্নাথ মন্দিরের পাণ্ডারা যেসব বেতের ছপটি মারে, সেইরকম ওখানে অনেকের হাতে একটা করে ফাঁপা, হালকা, কাঠের হাতুড়ি। ঠকাস-ঠকাস করে মাথায় মারছে, লাগে না। মেয়েরা মারছে ছেলেদের, ছেলেরা মেয়েদের। একজনের বান্ধবীকে মারছে অন্যপুরুষ, এক পুরুষ মারছে অপরের বান্ধবীকে। সঙ্গে-সঙ্গে উচ্ছল, অজস্র হাসি। একজন পিছন থেকে মাথায় মারলে, সেই দিকে তাকাতেই সামনে থেকে আরেকজন, আবার সামনে ঘুরে দাঁড়াতেই পাশ থেকে। হো-হো হাসিতে হ্রদের জলে যেন অনেক বেশি তরঙ্গ উঠছে।

আমি একা-একা ঘুরছি। আর মাথায় ঠাকাস-ঠকাস করে মার খেয়ে যাচ্ছি। খুব বেশি মুখ খুলে হাসার উপায় নেই, তাহলেই মুখের মধ্যে ঢুকে পড়ছে এক মুঠো কাগজ। দাঁড়িয়ে মুখ থেকে কাগজ বার করতে আবার কোটের পাশ দিয়ে পিঠের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে কাগজ। খলখল করে হাসতে-হাসতে সুইস-সুন্দরীরা আমাকে দেখেই বলাবলি করছে, ইস এ-লোকটার চুলগুলো কী কালো রে। দে দে আরও রং দে। অবশ্য অন্য কথাও বলতে পারে (আমার ক্ষীণ ফরাসি বিদ্যেয় ওই রকমই বুঝেছিলাম)।

আমার চুল অবশ্য তখন আর কালো কোথায়। লাল-নীল রঙে ভরতি। একবার করে চিরুনির মতো আঙুল বোলাচ্ছি আর ফরফর করে রাশি রাশি রঙিন কাগজ উড়ছে। আমিও তখন কাগজ ছুঁড়ে মারছি, ওইসব রূপালি মেয়েদের সোনালি চুলে।

কত রাত পর্যন্ত ওইভাবে ঘুরেছিলাম মনে নেই। এক সময় বেশ শীত করতে লাগল। ঘড়ির দেশ, আশেপাশে কোনও ঘড়ি পাই না, কে জানে কটা বাজে। একটা লোককে থামিয়ে জিগ্যেস করলুম, আপনার ঘড়িতে কটা বাজে?

এই যে, এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি?

তাকিয়ে দেখি বিমান, রঙিন কাগজ মেখে এমন চেহারা হয়েছে যে চিনতেই পারিনি আগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *