[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

মনে রাখার মতো মধুযামিনী

মনে রাখার মতো মধুযামিনী

পিটার নামে আমার পরিচিত একজন একদিন বেলা এগারোটায় এসে বলল, জ্যাক আজ বিয়ে করছে, চলো, চলো, তোমাকে নিয়ে যাব। চটপট তৈরি হয়ে নাও।

আমি অবাক। জ্যাকের সঙ্গে আলাপ মাত্র দুদিন আগে। তার বিয়েতে আমি যাব কেন? তা ছাড়া জ্যাক নিজে নেমন্তন্ন করেনি। পিটার আমার কোনও আপত্তিই শুনল না, হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল।

বিয়ে তো হয় সন্ধেবেলা: এই দুপুর রোদ্দুরে কোথায় যাব? বিয়ের উৎসবে যোগদান করার জন্য বিশেষ সাজপোশাক দরকার, আমার সেসব কিছু নেই। আমার কুণ্ঠাকেও পাত্তা দিল না পিটার। পোশাকের কথা একটু উল্লেখ করতেই ধমক দিল। পিটার নিজে অবশ্য পরে আছে জিনস ও গেঞ্জি।

পিটার নিয়ে এসেছে একটা জিপ গাড়ি। তার মধ্যে আরও তিন চারটি ছেলে মেয়ে বসে আছে, কারুকেই চিনি না, তবু তারা আমাকে দেখেই হাসি মুখে সম্ভাষণ করল। জিপটা ছুটল শহর পেরিয়ে।

আরিজোনার এই টুসন শহর থেকে খানিকটা দূরেই মরুভূমি। এই মরুভূমির মধ্যেও কোথাও কোথাও দু-একটা বাড়ি আছে, সেরকম কোনও বাড়িতেই বিবাহবাসর নাকি?

মরুভূমি বলতে যে ধু-ধু করা বালুকাময় প্রান্তরের ছবি মনে পড়ে, এ মরুভূমি ঠিক সেরকম নয়। এখানে মাইলের পর মাইল ঊষর প্রান্তর। পাথুরে মাটির মাঝেমাঝে বালি। ছোট ছোট পাহাড়। কিছু কিছু ঘাস জন্মায়, আর আছে ক্যাকটাস। সেরকম ক্যাকটাস আমি আগে কখনও দেখিনি। বিরাট লম্বা লম্বা ক্যাকটাস, কোনও কোনওটা দেড়তলা, দুতলা বাড়ির সমান। আরও একটা ব্যাপার এই, এখানে গরমও বেশি নয়। বরং বেশ মোলায়েম আবহাওয়া।

মরুভূমির মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর একটা বাড়ি চোখে পড়ল। এখানে মিউজিয়াম আছে, আগে দেখেছি, এ বাড়িটা অন্য মনে হয়, হোটেল। সেখানে আরও কুড়ি-পঁচিশটি ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তাদের মধ্যে দেখতে পেলাম জ্যাককে। সে-ও জিনস ও গেঞ্জি পরা, ব্যস্তভাবে কথা বলছে অন্যদের সঙ্গে।

আমি প্রথমে ভাবলাম, এই হোটেলেই বোধ হয় বিবাহ অনুষ্ঠান হবে সন্ধের পর। কিন্তু একটু বাদেই সবাই উঠে পড়ল কয়েকখানা গাড়িতে, আমরা যেতে লাগলাম মুরুভূমির আরও ভেতরের দিকে।

একটা ছোট্ট পাহাড়ের কোলে আবার নেমে পড়লাম সবাই। এখানে সারিবদ্ধ ক্যাকটাসগুলোকে দূর থেকে মনে হচ্ছিল সৈনিকেরমতন। কাছে এসে দেখলাম, জায়গাটা ভারী মনোরম। ছায়া ছায়া ময়। সবুজ গালিচার মতন ঘাসে পাথর ঢাকা। এই মরুভূমিতে জল পাওয়া যায় না, সেটাই জানতাম, কিন্তু এখানে কোথা থেকে যেন একটা জলের ধারা বইছে।

একটা গাড়ি থেকে নামল দুধ-সাদা পোশাক পরা একটি যুবতী, একেবারে খ্রিস্টান বিয়ের কনের মতন সাজ। মেয়েটিকে দেখে চমকে উঠলাম। এ মেয়েটিকেও তো চিনি, এর নাম জেনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের একটি পাব-এর পরিচারিকা। খুব হাসিখুশি মেয়ে, আমাদের বিয়ার সার্ভ করে, আমরা খুব ইয়ার্কি মশকরা করি ওর সঙ্গে। জেনি অবশ্য পড়াশুনোয় খুব ভালো, তুলনামূলক ভাষাতত্ব নিয়ে পি এইচ ডি করছে।

এখন অনেক ছেলেমেয়ে বিয়ে নিয়ে মাথাই ঘামায় না। দু’জনের মধ্যে যদি ভাব-ভালোবাসা হয়, তখন তারা একসঙ্গে থাকতে আরম্ভ করে, তাতে কোনও অসুবিধে নেই, কেউ ভুরু তোলে না। বিয়ে না করা অবস্থায় সন্তান হলেও তারা বৈধ হতে পারে। এখানে যে-সব যুবক-যুবতী উপস্থিত, তারা অনেকেই বিয়ে করেনি!

কিন্তু জেনির হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে করার। এবং পুরো কনের মতন সেজেগুঁজে বিয়ে করবে। জ্যাক তাতে রাজি, কিন্তু সে কিছুতেই গির্জায় যাবে না, রেজিস্ট্রি অফিসেও যেতে চায় না। জ্যাক মরুভুমি ভালোবাসে, এখানে সে প্রায়ই সোনা খুঁজতে আসে। এখানেই হবে জ্যাক ও জেনির বিবাহবাসর।

সবাই মিলে গোল হয়ে বসা হল ঘাসের ওপর। মাঝখানে দাঁড় করানো হল ওদের দু’জনকে। জ্যাকের বয়েস সাতাশ, অত্যন্ত সুঠাম তার স্বাস্থ্য, এখন তার মুখখানা একটু লাজুক-লাজুক দেখচ্ছে। সেই তুলনায় জেনি খুব সপ্রতিভ। সে একটা আংটি আনতে ভুলে গেছে। সবাই হেসে উঠল হো-হো করে। আংটির বদলে জ্যাক একটি চুম্বন দিল জেনিকে।

এরপর জেনি সকলের দিকে চেয়ে বলল, আমাদের বিয়েতে শুভেচ্ছা জানিয়ে তোমরা প্রত্যেকে কি একটা করে কবিতা শোনাবে?

আগে থেকেই এটা ঠিক ছিল। সবাই কবিতার বই এনেছে। পছন্দমতন প্রিয় কবিদের। কেউ কেউ নিজেও লিখেছে। জ্যাক আর জেনি রেড ওয়াইন দিতে লাগল সকলের হাতে হাতে, আর একটার পর একটা কবিতা পড়া হতে লাগল। সবই ছোট-ছোট কবিতা। এইসব অত্যাধুনিক ছেলে মেয়েদেরও রোমান্টিক কবিতার প্রতি বেশ ঝোঁক আছে দেখা গেল।

বিয়ের মন্ত্রের বদলে এই কবিতা পাঠ আমার মোটেই অস্বাভাবিক লাগল না। আমাদের হিন্দু বিয়েতে যেসব মন্ত্র পড়ানো হয়, সেগুলোও তো আসলে কবিতাই। সেগুলো সংস্কৃততেই হতে হবে, আর ব্রাহ্মণ পুরোহিতরাই শুধু পড়াবে, এরকম একটা অদ্ভুত নিয়ম এখনও চলে আসছে। এখনকার বর-কনেরা সেইসব সংস্কৃত কবিতার অর্থ বোঝে না এক বিন্দু, খুব সম্ভবত অনেক পুরুতও বোঝে না, শুধু মুখস্ত বলে যায়।

আমি বই-টই কিছু আনিনি। অন্যদের পেড়াপিড়িতে অগত্যা একটা বাংলা কবিতাই বলে দিলাম।

এর পর কিছুক্ষণ নাচ ও খাওয়াদাওয়া। একটি ছেলে ভালো স্প্যানিশ গান গায়। সে গান শোনাতে লাগলো একটার পর একটা। আকাশে ঘনিয়ে এলো ছায়া, পড়ে এল বেলা। খুব জমকালোভাবে পশ্চিম দিগন্তে সূযাস্ত হল। তখন জ্যাক আর জেনি বৃত্ত থেকে বেরিয়ে হাসি মুখে বলল, এবার আমরা চলি? অন্ধকার হয়ে এসেছে, এখন শুরু হবে আমাদের হানিমুন। কোনও গাড়ির দিকে না গিয়ে ওরা ছুটতে ছুটতে চলে গেল পাহাড়াটার আড়ালে।

ওরা কোথায় যাচ্ছে? পিটার বলল, ওরা আজ ফিরবে না। জ্যাকটা এত মরুভুমি ভালোবাসে, আজ বিয়ের রাতটা এখানেই কাটাবে ঠিক করেছে। খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকবে। আজ পৃথিবীটাই ওদের বিছানা।

ফেরার পথে খানিকবাদে দেখলাম, মস্ত একটা চাঁদ উঠেছে। রূপপালি আলোয় ভরে গেল সেই প্রান্তর। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম, সম্পূর্ণ নির্জন মরুভূমিতে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে। জ্যাক ও জেনি, যেন ওরা এই পৃথিবীর আদি মানব-মানবী। এই চাঁদের নীচে, ভূমিশয্যায় হবে ওদের মিলন। এমন মধুযামিনী বুঝি আর হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *