[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

১১. চোখ মেলার পর

চোখ মেলার পর মনে হল, মহানিদ্রা নয়তো। এই তো আবার দিব্যি জেগে উঠেছি। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভোরের আকাশ, পাহাড়ের বাড়িগুলির বাতি নিভে গেছে বলে বাড়িগুলিও দেখা যায় না, শুধুই মেঘ-প্রতিম পাহাড়।

মনট বেশ খুশি-খুশিই লাগল।

বিছানায় যাওয়া হয়নি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম চেয়ারে বসেই। রাত্তিরে তা হলে আর কেউ আসেনি!

শরীরটা একটু দুর্বল লাগছে, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতেই মাথাটা টনটন করে উঠল। তা হোক, এ নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক নয়। স্পন্ডেলাইটিস না স্পন্ডিলোসিস কী যেন বলে, তা হতে পারে, ঘাড়ে বেশ ব্যথা। ব্লাড প্রেশার খুব বাড়লেও নাকি এরকম ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। আমার তো এসব ঝামেলা ছিল না আগে! ফিরে গিয়েই ভূমেন গুহ-র কাছে পরামর্শ নিতে হবে। জানাতে হবে ধ্রুব বন্দ্যোপাধ্যায়কে। আগে তো পৌঁছই।

দেওয়াল ধরে-ধরে গেলাম বাথরুমে।

কাল রাতে আমি মরে যাইনি বটে, কিন্তু মৃত্যুভয় পেয়েছিলাম ঠিকই।

সেই ভয়ের কাছে কি নতজানু হয়েছি?

ইলিয়ানার নাম করে একটা লোক ওরকম অদ্ভুত টেলিফোন করল কেন? অন্য ইলিয়ানা।

কাল রাত্রে কিছুই খাইনি, মদ্যপানও যৎসামান্য, বেশ খিদে টের পাচ্ছি। খিদেই তো ভালো স্বাস্থ্যের লক্ষণ, গুরুতর অসুখ হলে খিদে চলে যায়।

পোশাক-টোশাক পরে চুল আঁচড়ে বেরিয়ে পড়লাম ঘর থেকে। মাথাটা একটু একটু ঘুরছে এখন। মনে-মনে বারবার বলতে লাগলাম, অজ্ঞান হলে চলবে না, অজ্ঞান হলে চলবে না। যত অখাদ্যই থাক, তবু কিছু খেতে হবে পেট ভরে, তা হলেই দুর্বলতা চলে যাবে।

বড় ডাইনিং হলটিতে ব্রেকফাস্ট খেতে এখনও অনেকে আসেনি। আমিও অন্যদিন দেরি করে আসি। বৃদ্ধ কবি হোজে ‘ডি’কস্টা একা বসে আছেন একটা টেবিলে। সামনে বই খোলা। অন্য কয়েকটা টেবিলেও তো বসে আছেন একজন-একজন করে, কিন্তু ওই টেবিলটা যেন বড় বেশি ফাঁকা।

আমি সে টেবিলে বসলাম। ফ্রাঁসোয়াজ-এর আর কোনও খবর নেই। সে ঠিকই করেছে, তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, সাংবাদিক হতে চায়, শুধু-শুধু এক ঈর্ষাকাতর বৃদ্ধের এঁকে দেওয়া ঘেড়াটোপের মধ্যে বন্দিনী থেকে সে কেন নষ্ট করবে তার জীবন? এসব দেশে বিবাহিত সম্পর্কের বাইরে নারী-পুরুষের একসঙ্গে থাকা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে। তবু বারবার মনে হচ্ছে, বেচারি সরল মেয়েটি যেন কোনও কঠিন আঘাত না পায়।

আজকে কর্নফ্লেক্স ও দুধ পাওয়া গেল। এ যেন চাঁদ পাওয়া। হোটেলের সামনের দোকান থেকে কয়েক প্যাকেটে বিস্কুট কিনে এনে রেখেছি। এই কদিন শুধু তাতেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করছিলাম সকালে।

অন্য এক টেবিলের একজন আমার নাম ধরে ডাকল। অনেকের সঙ্গে পরিবৃত হয়ে সেখানে। বসে আছে গ্যাব্রিয়েল। গত কয়েকদিন সে আমাকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ফেরাচ্ছিল।

কাছে যেতেই গ্যাব্রিয়েল বলল, তোমার টিকিটের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তোমাকে আজই সন্ধেবেলা চলে যেতে হবে, এ ছাড়া আর কোনও ফ্লাইটে বুকিং পাওয়া যায়নি। কাল সকালে তুমি বোগোটা থেকে ফ্লাইট নিয়ে পৌঁছে যাবে নিউ ইয়র্ক। তুমি সাড়ে ন’টার পর অফিস থেকে টিকিটটা নিয়ে যেও।

আজ সন্ধেবেলা ম্যাডেলিন ছেড়ে চলে যাব, আর কাল সকালে বোগোটো থেকে নিউ ইয়র্কের ফ্লাইট। তাহলে আমি রাত্তিরটা থাকব কোথায়?

গ্যাব্রিয়েল দু-কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, সে ব্যবস্থা তোমাকেই করতে হবে। উৎসবের শেষ অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সবাই এখন খুব ব্যস্ত থাকব।

যথাসময়ে টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রচুর ধন্যবাদ জানালাম গ্যাব্রিয়েলকে। সে ধন্যবাদে কিন্তু আন্তরিকতা ছিল না। মনে-মনে বলছিলাম, হাতখরচের টাকাটা দিলে না! সে টাকাটার কথা এখনও মনে পড়ল না।

মুখ ফুটে টাকা চাইতে পারি না বটে, কিন্তু গরিব বংশের ছেলে, টাকার কথা ভুলতেও পারি না।

টিকিট বদলের সুসংবাদের সঙ্গে জুড়ে রইল আর একটা উদ্বেগ।

ভেবেছিলাম, ম্যাডেলিন থেকে বোগোটা পৌঁছে দু-এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে ধরতে পারব পরের ফ্লাইট। এরা সে ব্যবস্থা করতে পারেনি। এক রাত কাটাতে হবে বোগোটায়। সেখানে কারুকে চিনি না। রাত্তিরবেলা খুঁজতে হবে কোনও হোটেল, সে শহরে যখন তখন অশান্তির কথা সবাই জানে।

আগের সকালেই কান্তি হোর একটা দুঃসংবাদ দিয়েছেন। অনেক দিন ধরে ঠিক হয়ে আছে। তিনি এসে পড়বেন বোগোটায় কিংবা ম্যাডেলিনে, তাঁর সঙ্গে দেখা হবেই। কান্তি হোর দুঃখিতভাবে জানিয়েছেন, তিনি বোগোটায় হোটেল পর্যন্ত বুক করে রেখেছিলেন, কিন্তু হঠাৎ ঠিক হয়েছে, কলম্বিয়ার যে কোম্পানির সঙ্গে তাঁর কাজের সম্পর্ক, সেখানকার লোকেরাই সদলবলে যাচ্ছে কানাড়ায়, আলোচনার জন্য। অর্থাৎ, এখন ইচ্ছে থাকলেও শুধু বেড়াবার জন্যও তিনি এখানে আসতে পারছেন না।

কাজের ব্যাপার, সুতরাং বলার কিছু নেই।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ইস, কেন কান্তিবাবুর কাছ থেকে তাঁর হোটেলের নামটা জেনে রাখিনি? তাঁর বুকিংটা আমি কাজে লাগাতে পারতাম। তিনি মন্ট্রিয়েল চলে যাবেন, এখন আর তাঁকে ফোনে পাওয়া যাবে না।

পুপলুকে ফোন করা যেতে পারে।

আগে দেখেছি, ওরা কম্পিউটারের ইন্টানেটের মাধ্যমে হোটেল বুক করে খুব সহজেই। বোগোটার মতন যে-কোনও শহরে কত হোটেল আছে সবই জানা যায় ইন্টারনেটে। কোনটায় কত রেট, কোনটায় ঘর খালি আছে। তারপর ক্রেডিট কার্ড দিয়েই সংরক্ষণ করা যায় পছন্দমতো ঘর। চিঠি লিখতে হল না, অগ্রিম টাকা পাঠাতে হল না, কম্পিউটার নামের আশ্চর্য প্রদীপের আলাদিন ঠিক করে দিতে পারে সবকিছু।

পুপলুকে ফোন করার কথা ভাবতেই মনে পড়ে গেল, এই রে, পুপলু আর চান্দ্রেয়ী যে বলেছিল, এ সপ্তাহান্তে ওরা কোথায় যেন তাঁবুতে থাকতে পারে। এখন তো ওদের পাওয়া যাবে না।

পুপলুর বাবা এর আগে একা একা অনেক দেশে গেছে, নিজেই হোটেল ঠিক করে নিয়েছে। এবার যে মাথা টলটল করছে বলে তার বাবা বেশ ভয় পেয়ে গেছে, তা সে জানবে কী করে!

যদি হদরোগ বা ব্লাড প্রেশার বৃদ্ধি হয়েই থাকে, তাহলে একেবারেই দুশ্চিন্তা করা উচিত নয়। টেনশানে এসব রোগ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

মন, শান্ত হও, ফিরে এসো একটা স্থির বিন্দুতে।

সব বড় শহরেই অশান্তি, গণ্ডগোল, মারামারি হয়। তবুও তো হাজার-হাজার মানুষ নিত্য যাতায়াত করে, বাস-ট্রেন চলে, বিমানবন্দর সচল থাকে। আমি এ পর্যন্ত কখনও কোথাও ভয়ঙ্কর কোনও হিংস্রতার ব্যাপার দেখিনি। তা আগের দিন বা পরের দিন ঘটেছে। বোগোটাতেও কিছু হবে না।

এ হোটেলের কাউন্টারে টেলিফোন ও কয়েকদিন বিছানা-চায়ের বিল মেটাতে এসে জিগ্যেস করলাম, আপনাদের এই হোটেলের কি কোনও শাখা আছে বোগোটায়? এরকম তো থাকে।

ম্যানেজার ব্যক্তিটি বললেন, না, আমাদের সেরকম কোনও শাখা নেই।

তাহলে বোগোটার কয়েকটি মাঝারি হোটেলের নাম বলে দিতে পারেন?

তিনি কয়েকটি হোটেলের নাম লিখে দিলেন। এবং জানালেন বোগোটায় বিমানবন্দর থেকে শহরের মূল কেন্দ্রের দূরত্ব অন্তত সাত-আট মাইল, ট্যাক্সি ভাড়া নেবে অন্তত দশ ডলার।

ঘরে এসে সুটকেস গুছিয়ে নিলাম।

মনের মধ্যে একটা কথা এখনও খচখচ করছে, বোগোটায় গিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া আর হোটেলের খরচ আমাকে দিতে হবে। এরা হাতখরচের টাকাটা শেষ পর্যন্ত দিল না, অন্য সবাই পেয়েছে।

মধ্যবিত্ত মানসিকতা আর কাকে বলে!

রাগ কমাবার জন্য ঠিক করলাম, দুপুরে এখানে আর খেতে যাব না। নিউ ইয়র্কে পৌঁছে কিংবা বোগোটা থেকে গৌতম দত্তকে খবর দিলে সে কতরকম খাওয়াবে!

এবং মনটাকে অন্যদিকে ফেরাবার জন্য খুঁজতে লাগলাম গান।

গানের একটা মজা এই, তা সমসাময়িকতা গ্রাহ্য করে না।

এরকম সময়ে যে-গান মনে পড়ল, তার সঙ্গে সমসাময়িক বাস্তবতার কোনও সম্পর্ক নেই।

প্রথমেই মনে পড়ল, পূর্ণ দাসের একটা গান, মাঝিগিরি জানি ভালো, ও-ও ভয় পেও না, ব্রজাঙ্গনা…।

গুনগুন করে গাইতে গাইতে তাল দিতে লাগলাম টেবিলে। এটা দাদরা, তাই না?

পরের গান, প্রেম জানে না রসিক কাঁলাচাঁদ…।

এটাও তো দাদরা তাল। ধাধিন না, তা ধিন না।

আমার যেমন বেণী, তেমনি রবে চুল ভিজাব না। এটাও দাদরা নয়?

তা হলে কি যত বাউল গান ও পল্লীগীতি সবই দাদরা?

হে ক্ষণিকের অতিথি, এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া…। এ-ও তো ধা ধিন না, তা ধিন না!

গগনে গগনে ডাকে দেয়া, ছায়া ঘনাইছে বনে বনে। এটাও দাদরা হতে বাধ্য।

তাহলে শুধু বাউল গান নয়, রবীন্দ্রসংগীত সমেত অধিকাংশ বাংলা গানই দাদরা তালে।

এটা কি আমার এই মুহূর্তের আবিষ্কার? আগে আর কেউ ভাবেনি?

ছেলেবেলায় এরকম মনে হত। মাঝে মাঝেই দারুণ পুলকিত বোধ করতাম, নিজেকে একজন আবিষ্কারক ভেবে। সীমাবদ্ধ জ্ঞান নিয়ে যে আবিষ্কারক হওয়া যায় না, এ বোধ তখন জাগেনি।

কাহারবা নয় দাদরা বাজাও, উলটোপালটা মারছো চাঁটি। শশীকান্ত, তুমিই দেখছি। আসরটাকে করবে মাটি…।

এই আধুনিক গানটাতেই ঠিক ধরেছিল, বাংলা গানের ঝোঁক দাদরার দিকে।

ধ্যাৎ! আমাকে দাদরায় পেয়ে বসল নাকি? কতকাল আগে তবলা শিখেছিলাম, এখন কিছুই মনে নেই। চর্চা না থাকলে কি সহজে তাল বোঝা যায়? কাল রাত্তির থেকেই আমার এই দাদরা বাতিক হয়েছে। হয়তো সব কটাই ভুল ভাবছি।

তালের নাম না জানলেও তাল ঠিক রাখা যায়। যারা কবিতা আবৃত্তি করে, তারা কি সব ছন্দের নাম জানে?

ভালো কইরা বাজাও গো দোতারা, সুন্দরী কমলা নাচে। এর কী তাল জানি না।

গান করতে-করতেই স্নান সেরে নিলাম। বাথরুমটা এবারেও জাহাজের মতন দুলে উঠল বটে। এমন কিছুনা। কাল রাত্তিরে সত্যিই বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছিল।

শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে।

বিস্কুটের প্যাকেটগুলো শেষ করতে হবে। তাহলে আর দুপুরে ডাইনিং রুমে যাওয়ার দরকার নেই। কারুর কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে না।

বোগোটায় কি বিপদ হবে? নাঃ, এখন বিপদ-টিপদ বাদ থাক, ফিরে গিয়েই স্বা তাঁকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি। সবক’টা মহাদেশ না ছুঁয়ে একেবারে চলে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

আপাতত বোগোটার কথাও চিন্তা করে লাভ নেই। হে ক্ষণিকের অতিথি–

হে নিরুপমা, হে নিরুপমা…

বিদায় ম্যাডেলিন!

গানের গুনগুনোনি অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়।

এক সময় হঠাৎ খেয়াল হয়ে গেল, সাড়ে চারটে বেজে গেছে। আমাকে তো এখনি বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ধরতে হবে।

সুটকেস-ফুটকেস নিয়ে তড়িঘড়ি নেমে গেলাম নীচে। লিফট চালিকা মহিলাটিকে বারবার বললাম, গ্রাসিয়াস, গ্রাসিয়াস। সঞ্জীবচন্দ্রের ভাষায় এঁর ওষ্ঠ ভারী প্রসন্নতাব্যঞ্জক। একদিন ইনি ভারতবর্ষ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইছিলেন। ভাষার অসুবিধের জন্য কিছু বোঝাতে পারিনি। এঁর সঙ্গে আর দেখা হবে না।

নীচের কাউন্টারের কাছে উৎসব কর্তৃপক্ষের একজন প্রতিনিধি দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ি দেখছে। সে বলল, তোমার হাতে বেশি সময় নেই। এয়ারপোর্ট যেতে এক ঘণ্টার বেশি লাগবে। যে-কোনও ট্যাক্সি নেওয়া তোমার পক্ষে নিরাপদ নয়, তাই আমরা তোমার জন্য বিশেষ ট্যাক্সি ঠিক করে রেখেছি।

আমার জন্য যে এটুকু চিন্তা করেছে, সে জন্য সত্যিই কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। শুধু তাই নয়, বিমানবন্দরে পৌঁছে ট্যাক্সি চালক আমার কাছ থেকে ভাড়া নিতে চাইল না, সে সারা দিনের জন্য উৎসব-কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিপদ্ধ। এ কথাটা না জানিয়ে সে অনায়াসেই ভাড়া নিয়ে নিতে পারত আমার কাছ থেকে। এমনকী কিছু বকশিশ দিতে গেলেও সে বলল, না, না, দরকার নেই।

আসবার পথেও পুরো পাহাড় ডিঙিয়ে আসতে হয়েছে। তা হলে সত্যিই বিমানবন্দর থেকে শহরে যাওয়া-আসার এই একটিই রাস্তা। ড্রাইভারটি ভাঙা ইংরিজিতে বারবার বলছিল, তুমি চিন্তা কোরো না, তোমাকে ঠিক সময়ে পৌঁছে দেব।

এরকম ভদ্র ট্যাক্সি ড্রাইভার কখনও দেখিনি।

বোগোটার ড্রাইভারটিও একইরকম ভদ্র। একে আরও বেশি নম্বর দেওয়া উচিত, কারণ, এ তো কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত নয়, আর দশজনের একজন।

মালপত্র নিয়ে বাইরে এসে প্রথম এই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে পেয়ে, কয়েকটি হোটেলের নাম লেখা কাজটি দেখিয়ে বললাম, এর মধ্যে কোনও একটি ভদ্রগোছের হোটেলে নিয়ে যেতে পারো?

সে একটি হোটেলের নামের পাশে আঙুল রাখল।

এর ভাড়া কত?

সত্তর ডলার।

ঠিকই আছে। এই টাকাটাও গচ্চা বলে ধরে না নেওয়া যেতে পারে।

লন্ডন থেকে নিউ ইয়র্কে আসার ফ্লাইটে আমার মানিব্যাগ হারিয়ে গিয়েছিল, সেটা উদ্ধার করে দিয়েছে কলম্বিয়ারই এক রমণী ইলিয়ানা। সুতরাং তার কিছু টাকা এখানে খরচ করলে সেটাই হবে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো। এ দেশকে পরিশোধ।

ড্রাইভারকে জিগ্যেস করলাম, কত ট্যাক্সি ভাড়া পড়বে?

সে বলল, নয় থেকে দশ ডলার।

অর্থাৎ এ-ও আমাকে ঠকাবার মতলবে নেই। এরকমই তো ভাড়া হওয়ার কথা।

এখন রাত সাড়ে ন’টা।

শনিবার বলেই হয়তো, রাস্তা বেশ ফাঁকা। চওড়া রাস্তা, আপাতত বেশ সুদৃশ্য শহর। দূরে ছোট পাহাড়ের রেখা। পথে লোক বিশেষ নেই, কিন্তু গাড়ি আছে।

আমার মনটা যে শুধু হালকা হয়ে আছে তাই-ই নয়, মাথা ঘোরাটাও কম। মাঝে-মাঝে শুধু যেন চিড়িক-চিড়িক করছে। মাথাটা পেছনে ঘোরাতে গেলে ঘুরে যাচ্ছে সমস্ত প্রকৃতি।

তা-ও মনে হচ্ছে, এ যাত্রা বেঁচেই গেলাম। একবার নিউ ইয়র্ক পৌঁছতে পারলে আর কোনও চিন্তা নেই।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর ট্যাক্সিটা যখন বড় রাস্তা ছেড়ে উলটোদিকের একটা ছোট রাস্তায় বেঁকতে যাবে, সেই সময় শুরু হয়ে গেল আকস্মিক গণ্ডগোল। উলটোদিক থেকে ছুটে আসছে প্রবল বেগে একটা গাড়ি, তার পেছনে-পেছনে একটা পুলিশের গাড়ির শেয়াল ডাকের মতন আওয়াজ।

এই সময় রাস্তা পার হওয়া বিপজ্জনক। সব গাড়িকে থেমে থাকতে হয়।

প্রথমে আমাদের সামনে দিয়ে ছুটে গেল একটা ভ্যান। তার পেছন দিকে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে তিন-চারজন নারী-পুরুষ, তাদের হাতে অটোমেটিক রাইফেলের মতন বিদঘুঁটে অস্ত্র। ওদের মধ্যে একজন…ওদের মধ্যে…অস্ত্র হাতে একজন রমণী কি ইলিয়ানা? সেরকমই দাঁড়াবার ভঙ্গি, সেই রূপ। সত্যি, না আমার চোখের ভুল?

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে পেরিয়ে গেলে গাড়িটা, তারপরই পেছনের পুলিশের গাড়ি থেকে শুরু হল গুলি চালনা।

ড্রাইভারটি আমাকে বলল, শুয়ে পড়ো, শুয়ে পড়ো।

পুলিশ ও অন্য পক্ষের গোলাগুলি চলতে লাগল খানিকটা দূরে। তা বুঝতে পেরেই ড্রাইভারটি খুব জোরে ট্যাক্সি চালিয়ে পৌঁছে গেল নির্দিষ্ট হোটেলের দরজায়।

হোটেলটির সদর বন্ধ করে দেওয়া ছিল, আমাদের ডাকাডাকি শুনে খুলে দিল।

হোটেলের সমস্ত কর্মচারী লবিতে দাঁড়িয়ে আছে উদ্বেগ ঠোঁটে নিয়ে, কেউ কোনও কথা বলছে না। আমার বুকের মধ্যে যেন চেঁকি পাড় দিচ্ছে, এত কাছ থেকে গুলিগোলার ব্যাপার আর কখনও দেখিনি।

ম্যাডেলিনেও দেখেছি, এখানকার সরকার ও জঙ্গিদের সম্পর্ক নিয়ে কথা উঠলেই উদ্যোক্তারা বা স্থানীয় কবিরা সবাই চুপ করে যায়। কে যে কোন জঙ্গি দলের সমর্থক তা প্রকাশ্যে জানাতে চায় না। সরকারবিরোধী কথা বললেও হয়তো বিপদ আছে।

খানিক বাদে সব শব্দ থেমে গেলে আমার ঘরের বন্দোবস্ত হল। এ হোটেলে এখন বোধহয় আর খুব কমই লোক আছে। বিশেষ সাড়া-শব্দ নেই। একজন পোর্টার আমার মালপত্র পৌঁছে দিয়ে গেল তিনতলার একটি প্রশস্ত ঘরে। ঘর না বলে সেটাকে সুইট বলা উচিত, তা হোক, আমার সাধ্যমতন ভাড়া আগেই নিয়ে নিয়েছে।

পোর্টার যুবকটিকে বললাম, আমার কিছু খাদ্য চাই। দুপুরে কিছু খাইনি, খিদে পেয়েছে।

সে আমাকে হাত তুলে বরাভয় দেখাল। অর্থাৎ সে ইংরিজি জানে না। ডেকে আনছে আর একজনকে।

এই হোটেলে একজনই ইংরিজি জানে, সে মেয়েটি চলে এল অবিলম্বে।

আমি তাকে আমার খাদ্য-পানীয়ের প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, আমাকে কাল সকালেই চলে যেতে হবে, সাড়ে সাতটার মধ্যে চা কিংবা কফি এনে আমাকে জাগিয়ে দিতে পারবে তো!

মেয়েটি বলল, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। ঠিক সাড়ে সাতটায় চা পাবে।

সে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে জিগ্যেস করলাম, কিছু যদি মনে না করো, তা হলে বলো তো, একটু আগে লড়াই হল পুলিশের সঙ্গে কাদের?

মেয়েটি বলল, একটা ব্যাঙ্ক লুটের কথা শুনেছি। তারপর একটি বিপ্লবী দলের সঙ্গে এইমাত্র সংঘর্ষ হয়েছে পুলিশের। মেশিন গান ফিট করা পুলিশের এই সব গাড়িগুলো উপহার হিসেবে এসেছে ওয়াশিংটন ডি সি থেকে। সাংঘাতিক সব গাড়ি। বিপ্লবীদের মধ্যে একজন মহিলা আর একটি কিশোর মারা গেছে শুনলাম।

মেয়েটি চলে যাওয়ার পর আমি পাথরের মূর্তির মতন বসে রইলাম একটুক্ষণ।

একজন মহিলা মারা গেছেন, তিনি কি ইলিয়ানা? যাঃ, হতেই পারে না। আমি ভুল দেখেছি। ওই বয়েসের কোনও নারী কি বিপ্লবে যোগ দেয়? দিলেও হয়তো তাত্বিক হতে পারে। অন্য বিপ্লবীদের আশ্রয় দিতে পারে, কিন্তু অস্ত্র নিজের হাতে নেবে কি!

নিশ্চয়ই আমি ভুল দেখেছি। চলন্ত গাড়িতে, কয়েক মুহূর্ত, ভুল তো হতেই পারে। ইলিয়ানা নয়, অন্য কেউ।

অবশ্য, এখানকার বিপ্লব কিংবা নাশকতা কিংবা সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আমার জ্ঞান কতটুকু? মধ্যবয়স্কা মহিলা কিংবা সেই বয়েসের পুরুষরা অস্ত্র ধরে কি না, সে সম্পর্কেও আমার ধারণা নেই।

তবু, ইলিয়ানা আমার সামনেই এসে প্রাণ দেবে, অথচ তার সঙ্গে একটাও কথা বলার সুযোগ হবে না, এটা যেন বড় বেশি বাড়াবাড়ি।

এতসব যুক্তির তৌল করার পরেও মনটা ভারী হয়ে আসে।

চোখ বুজে আমি ধ্যান করতে বসি। কোনও আরাধ্য দেবতা নেই, ধর্ম নেই। ঈশ্বর নেই। তবু ধ্যান, তীব্র একাগ্রতা।

নিঃশব্দে বলতে থাকি, ইলিয়ানা, তুমি আজ এখানে ছিলে না, তুমি মরতে পারো না, আমার তীব্র ইচ্ছেশক্তি দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবই। তুমি বেঁচে থাকো, তুমি সহসা চলে গেলে পৃথিবী অসুন্দর হয়ে যাবে। তোমাকে বাঁচতেই হবে। আমার আয়ুর কিছুটা দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে, তুমি আমার যা উপকার করেছিলে, তার তুলনায় এই প্রতিদান তো সামান্য। তুমি বেঁচে থাকো, ইলিয়ানা, আমি একজন রূপের পূজারি, কোনওদিন হয়তো তোমাকে আর দেখব না। তবু তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই!

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সে বেঁচে আছে।