[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৯. টানা দশ দিনের উৎসবে

টানা দশ দিনের উৎসবে আমার অংশগ্রহণ মোট আট ঘণ্টার জন্য। হোটেল বুকিং বারো দিনের।

তা হলে বাকি সময়টা আমি কী করব?

ঘুরে-ঘুরে দেশটা দেখার উদ্দেশ্য নিয়েই তো এসেছিলাম। কিন্তু নানারকম বিধিনিষেধ ও সতর্কবাণী শুনে প্রথম থেকেই বুঝেছিলাম সেটা সম্ভব হবে না।

একা-একা ঘুরে বেড়ানো বিপজ্জনক, অচেনা লোকেদের সঙ্গে আমার দল বেঁধে ঘুরতে ভালো লাগে না। কোথাও একা গেলে আমি অনেক কিছু দেখতে পাই, দল বেঁধে গেলে বিস্তর অবান্তর কথা শুনতে হয়। একজন মাত্র কেউ সঙ্গে থাকলে সুবিধে হতে পারে। কিন্তু সেরকম উপযুক্ত সঙ্গী বা সঙ্গিনী আমি সংগ্রহ করতে পারিনি।

আমার কবিতার স্প্যানিশ অনুবাদ পড়ে দেওয়ার জন্য একজনকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার নাম কার্লোস। সে-ই আমায় সব জায়গায় নিয়ে যাবে, ফিরিয়ে আনবে, এক হিসেবে সে আমার গাইডও বটে। তার ওপরেই আমার দেখাশুনোর ভার। কার্লোস নামটি স্প্যানিশদের মধ্যে অনেকেরই হয়, এখানেই তিন-চারজন কার্লোস আছে। কয়েক দশেক আগে কার্লোস নামে একজন আন্তর্জাতিক দুর্ধর্ষ ভাড়াটে খুনি ছিল, সে বহুরূপী, এবং বহু নাম ব্যবহার করত, ইউরোপ-মধ্যপ্রাচ্যে অনেক রাষ্ট্রপতি বা বিখ্যাত ব্যক্তির গুপ্ত হত্যার জন্য দায়ী করা হত এই কার্লোসকে। ফরাসি দেশের রাষ্ট্রনায়ক দ্য গলকে হত্যা করার নিখুঁত পরিকল্পনাও করেছিল সে, কিন্তু সেবারে সে সার্থক হয়নি। ‘দ্য ডে অফ দ্য জ্যাকল’ এই কার্লোসকে নিয়েই লেখা।

আমার গাইড এই কার্লোস নিরীহ প্রকৃতির মানুষ।

উচ্চতায় বা স্বাস্থ্যে সে একজন দস্যু সর্দার হিসেবে বেমানান হত না, কিন্তু তার চেহারায় খানিকটা বেখাপ্পা ভাব আছে। শরীরের দৈর্ঘ্যটা যেন সে ঠিক সামলাত পারে না। ল্যাক প্যাক করে। অথচ সে খুব রোগাও নয়। তার পোশাকগুলো ঢলঢলে। ফরসা রং, ককেশিয়ানদের মতন নাক, প্রশস্ত কপাল, তবু তার মুখে কোনও ব্যক্তিত্বের ছাপ নেই। বছর পঁয়তাল্লিশেক বয়েস হবে।

কার্লোসের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হতে পারত, কিন্তু হল না। তার অনেকগুলি বাধার মধ্যে একটি হল ভাষা।

আমার গাইড হিসেবে তার ইংরিজি জানবার কথা। কিন্তু কোনও বাক্যই সে শেষ করতে পারে না। দুটি-তিনটি শব্দ বলেই সে থেমে গিয়ে অবিকল তোতলাদের মতন বাকি শব্দ খুঁজতে থাকে।

যেমন আমি তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, আমরা যে এই নুটিবারা নামের হোটেলটায় আছি, এই নুটিবারা মানে কী? সে বলল, ইয়েস, নুটিবারা, মিনিংইট ইজ…।

ব্যাস, তারপর আর কিছু নেই। কিছু বোঝা গেল? এইভাবে কতক্ষণ কথাবার্তা চালানো যায়?

আমার একটা তত্ব বা ধারণা আছে, যারা পারিবারিক জীবনে অসুখী কিংবা যাদের বাবা মায়ের জীবনে প্রেম ছিল না, অর্থাৎ প্রেমহীনতার সন্তান, তারাই অর্ধসমাপ্ত বাক্য বলে।

কার্লোসকে জিগ্যেস করলাম, তুমি বিয়ে করেছ? তোমার ছেলেমেয়ে আছে?

ভাঙা-ভাঙা বাক্যে ও যা জানাল, তাতে বুঝলাম, ও বিবাহিত, সন্তান নেই। স্ত্রীও এখন নেই, বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।

তোমার এখন কোনও বান্ধবী নেই?

হ্যাঁ, আছে। দেখা হয়। রোজ না, মাঝে-মাঝে।

তুমি কি কবিতা লেখো?

না, মানে, অনুবাদ করি, মানে, নিজেও কয়েকটা লেখার চেষ্টা করেছি। বন্ধুরা ভালো বলে না….

তোমার জীবিকা কী? তুমি কোনও চাকরি করো?

সে জানাল যে আগে সে একটা সরকারি কাজ করত, সেটা ছেড়ে দিয়েছে।

তা হলে এখন কী করো?

এখন, কিছু না, মানে এই, এই যে, তোমার সঙ্গে রয়েছি।

অর্থাৎ, সে যে আমার গাইডের কাজ করছে, সে জন্য কিছু অর্থ পাবে। কতই বা পাবে। তাও তো মাত্র দশ দিনের জন্য। তার মানে সে বেকার। সরকারি চাকরি সে নিজেই ছেড়ে দিয়েছে, না ছাঁটাই হয়েছে, তা জিগ্যেস করা যায় না।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী এ দেশে শতকরা কুড়িজন বেকার। সরকারি পরিসংখ্যান কোনও দেশেই যথার্থ হয় না, সুতরাং আরও বেশি হতে পারে।

একদিন কার্লোসকে নিয়ে নগর দর্শনে বেরিয়েছিলাম।

কিন্তু দেখব কী? দু-পা যেতে না যেতেই সে একটা পাব-এর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, এখানকার বিয়ার খুব ভালো। তুমি কলম্বিয়ান বিয়ার চেখে দেখেছ!

সেখানে গিয়ে এক বোতল করে বিয়ার পান করতে হল। কলম্বিয়ার বিয়ার এমন কিছু আহামরি নয়।

আবার মিনিট দশেক পরে সে জিগ্যেস করল, তুমি ক্লান্ত হয়ে পড়োনি? এই পাবেই একটা রেস্তোরাঁ আছে, এটা খুব বিখ্যাত, ওখানে একটু বসে যেতে পারি।

দশ মিনিট হেঁটে ক্লান্ত হব কেন, গরম তো নেই। এখানকার আবহাওয়া সারা বছরই নীতিশীতোষ্ণ, তাই এরা বলে চিরবসন্তের দেশ। আর একটাও মজার কথা পড়েছি একটা বইতে।

ম্যাডেলিন শহরটি সমুদ্র সমতল থেকে পাঁচ হাজার ফিট উঁচুতে। কলম্বিয়ানরা বলে, স্বর্গের চেয়ে মাত্র কয়েক ইঞ্চি নীচে।

মৃদু-মৃদু ঠান্ডা হাওয়ার মধ্যে হাঁটতে ভালোই লাগছিল কিন্তু কার্লোসের আগ্রহ-আতিশয্যে আবার একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই হল। সিগারেটের ধোঁয়া ও বহু নারী পুরুষের গুঞ্জন ছাড়া আর কোনও বিশেষত্ব নেই। যে মেয়েরা পরিবেশন করছে, তাদের সুগোল বক্ষঃস্থল প্রায় সবটাই পরিদৃশ্যমান।

এ দৃশ্যও এখানে মোটেই দুর্লভ নয়। কলম্বিয়ার রমণীদের সৌন্দর্য বিশ্ববিখ্যাত। ইউরোপ আমেরিকার অধিকাংশ বিজ্ঞাপনের মডেল হয় নাকি এখানকার মেয়েরা। রাস্তাঘাটে যেসব তরুণীদের দেখা যায়, তাদের পোশাক অত্যন্ত আঁট, স্কিনটাইট যাকে বলে। শরীরের গড়ন বেঢপ হলে পোশাকে খুব কুৎসিত দেখাত, পোশাকের জন্যই বোধহয় এরা খুব শরীরের চর্চা করে। সেইজন্যই এখানকার তরুণীদের ঊরু, নিতম্ব ও বক্ষদ্বয় একেবারে বিসদৃশ নয়। এবং তা প্রদর্শন করতেও এদের লজ্জা নেই।

শুধু মেয়েরা কেন, মাঝে-মাঝে খুব রূপবান পুরুষও দেখা যায়।

শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের রূপ বর্ণনায় সব সময় গ্রিক দেবতাদের সঙ্গে তুলনা করা হয়। মিশ্র রক্তের জন্য কলম্বিয়ার অনেক পুরুষও প্রকৃত সুপুরুষ।

এক বোতল বিয়ার শেষ করার পর কার্লোস জিগ্যেস করল, তুমি হুইস্কি পছন্দ করো না? সিভাস রিগ্যাল, ব্ল্যাক লেবেল, কুইন অফ কুইনস, সবই এখন পাওয়া যায়।

অর্থাৎ তার হুইস্কি পানের ইচ্ছে হয়েছে। এই সব নামগুলোর ইংরেজি উচ্চারণও ঠিকঠাক জানে।

দিলাম হুইস্কির অর্ডার।

নানারকম চতুরালি করে ও যে আমার পয়সায় মদ্যপান করতে চায়, তাও ঠিক নয়। কেননা, আমি যখন বিল মেটাচ্ছি, তখন ও খুবই কুণ্ঠিতভাবে বলল, আমারই খাওয়ানো উচিত ছিল তোমাকে, কিন্তু আমি আজ বেশি পয়সা আনিনি, অন্য একদিন অবশ্যই–

ওর এই কুণ্ঠাটা আন্তরিক।

তৃষ্ণার্তকে যেমন জল প্রত্যাখ্যান করা যায় না, তেমনই এক বিদেশি, বেকার, স্ত্রী-পরিত্যক্ত, বান্ধবীহীন, ব্যর্থ কবি যদি বিয়ার হুইস্কি পান করতে চায়, তা হলে মানবতার খাতিরেই তাকে নিরাশ করা উচিত নয়।

তার জন্য পয়সা খরচ করতে আমি রাজি হলাম। কিন্তু অতক্ষণ ধরে কী গল্প করব তার সঙ্গে?

একে তো তার ভাঙা-ভাঙা ভাষা, তা ছাড়া তার কৌতূহল প্রবৃত্তিটাই কম।

সে আমার কবিতার অনুবাদ পাঠ করছে, কিন্তু আমি আর কী লিখি, কিংবা মূল বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও তার কোনও আগ্রহ নেই। আমি কোথায় থাকি কিংবা আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ও কিছু জানতে চায় না।

আমি স্প্যানিশ ভাষা জানি না, কিন্তু অনুবাদে স্প্যানিশ সাহিত্য আমরা সবাই বেশ কিছু পড়েছি। এক সময় ইংরেজির মাধ্যমে অনুবাদও করেছিলাম কিছু স্প্যানিশ কবিতা। পাবলো নেরুদা, গার্সিয়া লোরকা, আনতোজিও মাচাদো, হুয়াও রাসেল হিমনেথ এঁদের রচনার উল্লেখ করলেও তেমন কিছু তাপ-উত্তাপ নেই কার্লোসের।

হিমেনেথের একটি কবিতা আমার খুব প্রিয়।

‘ওখানে কেউ না। জল
কেউ না?
 জল কি কেউ নয়?
ওখানে কেউ না। ফুল।
ওখানে কেউ না?
তবু ফুল কি কেউ না?
ওখানে কেউ না। হাওয়া
কেউ না? হাওয়া কি কেউ না?
কেউ না? মায়া
ওখানে কেউ না?
আর মায়া কি কেউ না?’

কার্লোসকে জিগ্যেস করলাম, তোমার এটা কেমন লাগে? এর মূল স্প্যানিশ তোমার মুখস্থ আছে?

কার্লোস জানাল যে কবিতাটা ভালোই, কিন্তু মূল তার মুখস্থ নেই।

শুনেছিলাম, মূল স্পেন ভূখণ্ড থেকে এতদূরে হলেও কলম্বিয়ায় খাঁটি ক্যাসটিলিয়ান স্প্যানিশ ভাষা প্রায় অবিকৃত রাখার চেষ্টা হয়েছে। কানাডার একাংশ যেমন ফরাসিভাষী হলেও সে ভাষা অনেকখানি বদলে গেছে মূল ফরাসিদেশের ভাষা থেকে, এরা সেটা হতে দেয়নি। কিন্তু স্পেনের বড় বড় কবি-লেখকদের নিয়ে এরা আদিখ্যেতাও করে না।

আমাদের দেশে কিংবা বাংলাদেশের কবিতা উৎসবে যেমন মৃত কবিদের নামে মঞ্চ হয় কিংবা বড় বড় পোস্টারে উদ্ধৃত থাকে তাঁদের রচনা, এখানে সেসবের কোনও নিদর্শন চোখে পড়েনি। যাকে বলে ‘হিরো ওয়ারশিপ’ সেটা নেই এদের সাহিত্য-জগতে।

এমনকী গার্সিয়া মার্কেজ সম্পর্কে দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে যা উত্তর পেয়েছি, তাতে অবাক হতে হয়। কলম্বিয়ার সন্তান বিশ্ববিখ্যাত মার্কেজকে নিয়ে এদের গর্ব করারই তো কথা। কিন্তু এরা বলল, ‘হ্যাঁ, কারুর কারুর মতে, মার্কেজ বেশ বড় লেখক, আবার কারুর কারুর মতে, অনেকটাই চমক সৃষ্টির চেষ্টা। এমন কিছু না।

বাংলার একটা প্রবাদ আছে, এ গাঁয়ের মেধো, ভিন গাঁয়ে মধুসূদন। মার্কেজেরও দেখছি সেই অবস্থা।

স্প্যানিশ ভাষায় সমসাময়িক অপর এক মহান লেখক বহেজ এক সময় মার্কেজের নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’ সম্পর্কে তির্যকভাবে বলেছেন, ও বইটা ভালো, কিন্তু আর একটু ছোট করা উচিত ছিল আর নাম দেওয়া উচিত ছিল, ‘ফিফটি ইয়ার্স অফ সলিচুড’। পঞ্চাশ বছরেই তো মার্কেজ নোবেল প্রাইজ পেয়ে গেছেন, তারপর আর নির্জনতা কোথায়?

ওই একদিনই কার্লোসের সঙ্গে বেরিয়েছিলাম, আর। এরপর থেকে ওকে আমি একটু এড়িয়েই চলতাম।

আর একদিন বেপরোয়া হয়ে বেরিয়ে পড়লাম একাই, কর্তৃপক্ষের নিষেধ অমান্য করে। খানিকটা হেঁটে যাওয়ার পর ভয়-ভয় করছে লাগল। আগের দিনই নিউজিল্যান্ড থেকে আগত কবিটিকে কোথায় যেন মারধোর করা হয়েছে, কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার ক্যামেরা ও টাকাপয়সা, এরকম শুনেছি। মারধোরের চেয়ে বেশি আশঙ্কা অপহরণের। এখনই নাকি তিনশোর বেশি বিদেশিকে আটকে রাখা হয়েছে দুর্গম পাহাড় অঞ্চলে।

অল্প বয়েস হলেও না হয় কিছুদিন জঙ্গিদের আস্তানায় কাটিয়ে আসার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যেতে পারত, এখন সেটা বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। তা ছাড়া মাঝে মাঝেই ওরা নাকি একজন দুজনকে খুন করে বাইরে ছুঁড়ে দেয়। যে দেশের রাজনীতি সম্পর্কে আমার স্পষ্ট ধারণাই নেই, সেখানে খামোখা প্রাণটা দিতে যাব কেন?

একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম। কিন্তু যাব কোথায়? কার্লোসকে জিগ্যেস করেছিলাম, এ শহরে দ্রষ্টব্য স্থান কী-কী আছে। সে অনেক ভেবেচিন্তে বলেছিল, সেরকম তো কিছু নেই, তবে কিছু দূরে একটা সুন্দর সাজানো গ্রাম আছে, সেখানে আছে অনেক রকমের রেস্তোরাঁ। এত দূর দেশে এসে শুধু রেস্তোরাঁ দেখতে যাব?

আর ট্যাক্সিতে নগর পরিক্রমা অত্যন্ত নির্বোধের মতন ব্যাপার। তার চেয়ে হোটেলের সামনের বড় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে অনেক কিছু দেখা যায়।

শহরটি নেহাত ছোট নয়।

জনসংখ্যা কুড়ি লক্ষের বেশি। দরিদ্র দেশ বলে বিদিত হলেও শহরের রাস্তাঘাটে তা প্রকট নয়। ভিখিরি নেই। আমাদের দেশের মতন প্রচুর ফেরিওয়ালা আছে, তারা চেঁচিয়ে জিনিস বিক্রি করে। ট্যাক্সিওয়ালা লঝঝরে নয়, অন্য যানবাহনও উন্নত, উঁচু দিয়ে চলা স্কাই ট্রেন আছে।

রাস্তাগুলি ঝকঝকে ও প্রশস্ত। সম্প্রতি নাকি এ শহরের সব রাস্তা নতুনভাবে গড়া ও মেরামতের পর মেয়রমশাই ঘোষণা করেছেন, কেউ যদি কোনও রাস্তায় একটাও খানা-খন্দ খুঁজে বার করতে পারে, তাকে পুরস্কৃত করা হবে!

এই দৃষ্টান্ত অনুসারে কলকাতার মেয়র মহোদয় উলটো একটা ঘোষণা করতে পারেন। কেউ যদি এই শহরে এমন একটাও রাস্তা খুঁজে বার করতে পারে, যেখানে খানা-খন্দ নেই, তা হলে পুরস্কার পাবে সে।

দরিদ্র হলেও এখানকার অধিকাংশ মানুষই বেশ ফুর্তিবাজ। এরা নাচ-গান ভালোবাসে। শুক্রবার বিকেলের পর থেকেই অনেক তরুণ-তরুণী রাস্তার মোড়ে মোড়েই নাচতে শুরু করে। ট্যাংগোনাচের উৎপত্তি নাকি এখানেই।

এরা কবিতা এত ভালোবাসে, নাচ-গান ভালোবাসে, অথচ এখানেই এত হিংস্রতা, এত হানাহানি! রাস্তায় দাঁড়িয়ে জীবনযাত্রার স্রোত দেখলে সেই বিপজ্জনক দিকটির কথা টেরই পাওয়া যায় না। সবই যেন স্বাভাবিক।

কান্তি হোর ঠিকই বলেছিলেন, এখানকার সমস্ত মানুষজনেরই ব্যবহার খুব চমৎকার। ট্যাক্সি চালক, হোটেলের বেয়ারা, বিমানবন্দরের পোর্টার, সকলেরই আচার-আচরণের মধ্যে একটা স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ আছে। কেউ বেশি পয়সা চায় না, কেউ ঠকাবার চেষ্টা করেনি।

শুধু কিছু কিছু বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মধ্যে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। কারুকে কোনও কাজের কথা বললে সে অন্য একজনকে দেখিয়ে দিয়ে সরে পড়ে। উৎসবের উদ্যোক্তাদের মধ্যে দু-একজনকে আমার কোনও প্রয়োজনের কথা বলে দেখেছি, তারা জোর দিয়ে জানিয়েছে, তুমি কোনও চিন্তা কোরো না, আমি নিজে কাগজটা বিকেলে তোমার কাছে পৌঁছে দিয়ে যাব। তারপর কোথায় কী, বিকেল গড়িয়ে রাত্রি, পরের দিনও তার পাত্তা নেই। এই ব্যাপারে আমাদের দেশের সঙ্গে খুব মিল।

দুটি ব্যাপারে আমার মনের মধ্যে অস্বস্তি বা চাঞ্চল্য রয়েই গেল।

আমার ফেরার টিকিটের নির্ঘণ্ট আগে থেকেই পাকা হয়ে আছে। আবার এখান থেকেই বোগোটা, মায়ামি, নিউ ইয়র্ক, লন্ডন হয়ে সরাসরি কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। শুধু লস অ্যাঞ্জেলিসে আর যেতে হবে না।

কিন্তু মায়ামি থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছব রাত আটটা পনেরোয়, এরপর লন্ডনের ফ্লাইট ন’টা পনেরোয়। মাঝখানে মাত্র এক ঘণ্টা সময়। এর মধ্যে এক টার্মিনাল থেকে আমাকে যেতে হবে অন্য টার্মিনালে, রাস্তা চিনতে দেরি হলেই ফসকে যাবে পরের ফ্লাইটটা। তা ছাড়া নিউ ইয়র্কে যদি পৌঁছতে দেরি করে?

নিউ ইয়র্কেই আসার পথে আমার এই নির্ঘণ্ট বদলের কথা বলেছিলাম বিমান কোম্পানিকে। তারা বলল, সেদিন তার আগে অন্য ফ্লাইট নেই। বদল করা যাবে না। তা ছাড়া চিন্তার কী আছে? এক ঘণ্টা যথেষ্ট সময়। টার্মিনাল বদল করতে বড়জোর পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগবে!

যদি নিউ ইয়র্কের ফ্লাইটই দেরি করে পৌঁছয়?

আমেরিকান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট কখনও লেট করে না।

এরকম কথা শুনলেই আমার গা জ্বলে যায়।

পৃথিবীর বহু জাতের বিমানে ঘোরাঘুরি করে দেখেছি, যত বিখ্যাতই হোক, সব এয়ারলাইন্সই কখনও না কখনও দেরি করে ছাড়ে কিংবা দেরি করে পৌঁছয়।

একবার প্যারিসের শার্ল দ্যগল বিমানবন্দরে লন্ডনে যাওয়ার জন্য সকাল ছ’টা থেকে বসে থাকতে হয়েছিল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। যদিও লন্ডন মাত্র এক ঘণ্টার পথ। তাও যদি কর্তৃপক্ষ বলে দিত যে সেদিন নির্দিষ্ট ফ্লাইট ছাড়তে অত দেরি হবে, তা হলে অসীমের বাড়িতে ফিরে গিয়ে খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে-টুমিয়ে বিকেলে আসতে পারতাম। তার বদলে এই ছাড়বে, এক্ষুনি ছাড়বে ঘোষণা করে করে আমাদের তিনবার বিমানে উঠিয়েও নামিয়ে আনা হয়েছিল। অব্যবস্থার চূড়ান্ত। সেদিন এয়ার ফ্রান্সের কর্মীরা ঝটিতি ধর্মঘট করে বসেছিল, তাদের সঙ্গে মালিকপক্ষের আলোচনা চলছিল সারাদিন ধরে।

এয়ার ফ্রান্সই যদি এগারো ঘণ্টা লেট করতে পারে, তাহলে যত দোষ নন্দ ঘোষ আমাদের ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর?

এবারেও তো মায়ামি থেকে বোগোটা আসবার সময় দেড় ঘণ্টা লেট করেছে আমেরিকান এয়ারলাইন্স!

ম্যাডেলিনে পৌঁছবার পরদিন থেকেই আমি টিকিট বদল করার চেষ্টা করে আসছি। হোটেলের দোতলায় বেশ কয়েকখানা ঘর জুড়ে কবিতা উৎসব কমিটির দফতর। গাব্রিয়েল ফ্রাঙ্কো নামে একজনের ওপর বিমানের টিকিট সংক্রান্ত সমস্যার ভার। তাকে আমার ওই এক ঘণ্টার সংকটের ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম, আমাকে নির্দিষ্ট তারিখের আগের দিন ফিরতেই হবে।

সে একগাল হেসে বলল, না, না, আগের দিন যাবে কেন? উৎসবের শেষ দিনটায় দারুণ জমকালো আসর হয়, সেই জন্যই তোমার টিকিট তার পরের দিন করা হয়েছে। যাতে তুমি শেষ উৎসবটা দেখে যেতে পারো।

তাকে জানালাম যে উৎসবের শেষ অনুষ্ঠান দেখতে পারলে খুব ভালো লাগত, কিন্তু আমার উপায় নেই। নিউ ইয়র্ক থেকে ফ্লাইট মিস করার ঝুঁকি আমি কিছুতেই নিতে পারি না।

সে কোনওক্রমেই বুঝতে চায় না, শেষ পর্যন্ত বলল, ঠিক আছে, দেখি, এখন তারিখ বদল করা সম্ভব কিনা, ট্রাভেল এজেন্সির কাছে পাঠাব, তোমার টিকিটগুলো রেখে যাও!

পরদিন দুপুরেই খোঁজ নিতে গেলে গাব্রিয়েল বলল, না, কাল পাঠানো হয়নি, আজ বিকেলে ট্রাভেল এজেন্সির লোক এখানেই আসবে, তাকে দিয়ে দেব।

আবার পরদিন গেলাম, গাব্রিয়েল যেন আমাকে চিনতেই না পেরে বলল, কী ব্যাপার?

আবার আদ্যোপান্ত বলতে হল।

সে বলল, ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোমার টিকিটটা, টিকিটটা…

অন্য টেবিলের দুজনের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টিকিটটা তো ট্রাভেল এজেন্সির কাছে পাঠানো হয়েছে, তাই না।

একজন বলল, হ্যাঁ।

আর একজন একটা ড্রয়ার খুলে আমার টিকিটটা উঁচু করে দেখাল।

গাব্রিয়েল বলল, ‘ওঃ হো, ভুল হয়ে গেছে। কাল অবশ্যই পাঠাব।

অন্যজন বলল, কাল শনিবার।

এবং পরের দিন রবিবার। আগামী দুদিন ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ।

সোমবার যদিও বা টিকিটটা পাঠানো গেল, তার পরেও ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে কোনও উত্তর নেই।

আমি বারবার খোঁজ নিতে গেলে গাব্রিয়েল বেশ বিরক্ত হয়।

এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল। এরা আমার সমস্যাটা বুঝতেই পারছে না।

যদি নিউ ইয়র্কে দেরি করে পৌঁছই, তার একটা চেইন রি-অ্যাকশন হবে। তা হলে নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনের ফ্লাইট ধরা যাবে না। লন্ডনে দেরি করে পৌঁছলে সেখান থেকে কলকাতার ফ্লাইট চলে যাবে। সেটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। কারণ, লন্ডন-কলকাতা সরাসরি বিমান যায় সপ্তাহে মাত্র দুদিন, সেখান থেকে রিজার্ভেশান পাওয়া খুব শক্ত। আগের বছরই এই কারণে আমাকে লন্ডনে আটদিন আটকে থাকতে হয়েছিল।

এবারেও নিউ ইয়র্কে বা লন্ডনে আমার পক্ষে অনির্দিষ্টকাল ধরে অপেক্ষা করার কোনও উপায় নেই।

এখান থেকে ফিরেই কয়েকদিন পর অস্ট্রেলিয়া সফরের সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে আছে। সে টিকিটও তৈরি। এখানে স্বা তাঁকে নিয়ে আসতে পারিনি। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বাঙালিরা স্বা তাঁকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভ্রমণপিয়াসী স্বাতী উন্মুখ হয়ে আছে, অস্ট্রেলিয়ার বাঙালিরাও খুব নিরাশ হবেন আমরা যথা সময়ে পৌঁছতে না পারলে। সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরার কিছু বাঙালি নির্দিষ্ট কয়েকদিনে অনুষ্ঠানের জন্য ‘হল’ ঠিক করে রেখেছেন। সে তারিখগুলি বাতিল হয়ে গেলে কাছাকাছি সময়ের মধ্যে আবার ‘হল’ পাওয়া শক্ত, অনেক টাকার ক্ষতিও হয়ে যাবে।

সুতরাং নিউ ইয়র্ক-লন্ডন আর লন্ডন-কলকাতার কনফার্মড ফ্লাইটগুলি আমাকে অবিকল রাখতেই হবে, শুধু এখান থেকে নিউ ইয়র্ক পৌঁছতে হবে একদিন আগে, সেটা এমন কিছু শক্ত হওয়ার কথা নয়।

কিন্তু দিনের পর দিন ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখার জন্য আমার উদ্বেগ রয়েই গেল।

দ্বিতীয় উদ্বেগের কারণটা ঠিক বলার মতন নয়, আবার গোপন করবই বা কেন?

একদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে হায়াৎ আর জিয়াউল হাতখরচ বিষয়ে কী যেন বলাবলি করছিল। আমি কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করেছিলাম, হাতখরচ ব্যাপারটা কী?

ওদের একজন বলল, আপনি এখান থেকে হাতখরচ পাননি? আপনার আমন্ত্রণের চিঠিতে সেরকম কিছু লেখা ছিল না? সবাইকেই তো দেবে।

ঘরে এসে সেই চিঠিটা, খুঁজে বার করলাম। সত্যিই তো, তাতে লেখা আছে আমার হোটেল খরচ, খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াত ব্যবস্থা ছাড়াও কিছু হাতখরচ দেওয়ার কথা। আগে সেটা আমি খেয়াল করিনি।

পাঁচদিন কেটে গেল, সে টাকা এখনও দিল না কেন? আমাকে গিয়ে চাইতে হবে নাকি? ওদেরই তো প্রথম দিনই আমাকে দেওয়া উচিত ছিল।

তিন লক্ষ দশ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। শুনে যত চমকপ্রদ মনে হয়, তানয় অবশ্য।

টাকা তো নয়, এখানকার মুদ্রা পেসো। তার মূল্যমান অতি সামান্য। এক ডলারে দু-হাজার দুশো, অর্থাৎ আমাদের ভারতীয় এক টাকা চারশো পেসো-রও বেশি। এর মধ্যে আমকে কিছু ডলার ভাঙাতেও হয়েছে, তাই মূল্যমান জানি। অনেকটা ইতালির লিরার মতন, সিগারেট কিনতেও পাঁচ হাজার, দশ হাজার লাগে।

তিন লক্ষ দশ হাজার পেসো প্রায় দেড়শো ডলার, আমাদের প্রায় সাত হাজার টাকার মতন। এই টাকার অঙ্কটা এমন কিছু বেশি নয়, আবার উপেক্ষা করবার মতনও নয়।

টাকাটা যখন প্রত্যেক আমন্ত্রিত কবিকে দেবেই বলা হয়েছে, তখন পৌঁছনোর পরেই তো পাওয়ার কথা। চাইতে হবে কেন?

এত দূর থেকে ডেকে এনে হোটেলে রেখে খাতির-যত্ন করছে, তার পরেও আবার টাকা চাইতে যাব? এটা আমার কাছে সম্মানজনক মনে হয় না।

গ্যাব্রিয়েলের ঘরে টিকিটের খবর নিতে বারবার যাই, সেখানে অনেকেই আমাকে চিনে ফেলেছে। সেখানে কারুর মনে পড়ে না যে আমাকে টাকাটা দেওয়া হয়নি? সেখানে দাঁড়িয়ে উৎকর্ণ হয়ে থাকি, এই বুঝি কেউ বলবে, ওঃ হো, আপনি হাতখরচ নেননি কেন? এই যে–

কেউ সে কথা বলে না।

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মনে-মনে বলি, নাঃ, চাইব না, কিছুতেই চাইব না! ভারী তো সাত হাজার টাকা!

মন কিন্তু নিজের কাছেও সত্যি কথা বলে না।

মনের একটা অংশ খিকখিক করে হাসে। হাসতে-হাসতে বলে, তুমি এমন কিছু বাবু হওনি যে সাত হাজার টাকা এমনি-এমনি ছেড়ে দেবে। তোমার ন্যায্য প্রাপ্য টাকা। সাত হাজার টাকা এমন কিছু ফ্যালনাও নয়। ওই টাকা লিখে রোজগার করতে হলে তোমাকে কতটা পরিশ্রম করতে হয় বলো তো? একবার না হয় চোখ-কান বুজে, মান খুইয়ে চেয়েই ফ্যালো। এখানে তোমার মানহানির কথা আর কেউ তো জানতে পারছে না। দেশের সাত হাজার টাকার চেয়েও বিদেশে দেড়শো ডলারের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

তবু আমি মুখ ফুটে চাই না বটে, কিন্তু সর্বক্ষণ যে টাকাটার কথা ভাবছি, সেটাই তো একটা পরাজয়।

একদিন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে হঠাৎ মনে হল, টিকিট বদলানোর ব্যাপারটা ক্রমশই খুব বিরক্তিকর হয়ে উঠছে। আর কতবার বলব! আমার যতখানি চেষ্টা করার তো করেইছি, এর পর যা হওয়ার তা হবে। আজ বিকেল থেকেই এ সমস্যাটা একেবারে মুছে ফেলতে হবে মন থেকে।

আর হাতখরচের টাকাটা আমি চাইব না, চাইব না, চাইব না, এটাই শেষ কথা। অতিথির পক্ষে অর্থ ভিক্ষা অতি অশোভন।

এবার থেকে যেমন একবেলা কিছুই খাব না, তেমনি দুপুরের পর থেকে আর এক পাও বাইরে বেরুব না। নিজের সঙ্গে ছাড়া আর একটাও কথা বলব না কারুর সঙ্গে।

চাবি দিয়ে ঘরটা খুলতে-খুলতে মনে হল, আমি যেন সদ্য সন্ন্যাস ব্রত নিয়েছি আর হোটেলের এই ঘরখানা যেন হিমালয় পাহাড়ের কোনও দুর্গম গুহা।