[সোর্স না জানা অজানা গল্প]

০৮. ম্যাডেলিনে কবিতা উৎসব

ম্যাডেলিনে কবিতা উৎসব চলবে একটানা দশদিন।

এত দীর্ঘদিন ধরে, এতগুলি আন্তর্জাতিক কবিদের আমন্ত্রণ করে এনে কবিতা নিয়ে উৎসব, পৃথিবীর আর কোনও দেশে হয় কি না আমার জানা নেই। তাও কলম্বিয়া নামের ছোট দেশে, ম্যাডেলিন নামে একটি অকিঞ্চিৎকর শহরে। যে শহরটিকে হিংস্রতা ও মাদক চোরাচালানের কেন্দ্র হিসেবেই লোকে চেনে।

একটি দশতলা হোটেলের প্রায় পুরোটাই কবিতা উৎসবের দখলে, তাও শুধু খাওয়া-থাকার জন, কবিতা পাঠ এখানে হয় না, তা শহর ও শহর ছাড়িয়ে নানা জায়গায়। এই বিপুল খরচের জোগান কোথা থেকে আসছে, সে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে।

সরকারি সাহায্য আছে বলে মনে হয় না।

সরকারের উপস্থিতি কোথাও নেই, সে মর্মে কোনও ফেস্টুন বা পোস্টারও চোখে পড়েনি।

অন্যান্য জায়গায় বিভিন্ন স্পনসরের নাম থাকে, এখানে কোনও মঞ্চেই ‘কবিতা উৎসব’ ছাড়া আর কিছু লেখা থাকে না। উদ্যোক্তরা প্রমেটিও নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা।

তাহলে কি মাদক চোরাচালানকারী বিপুল বিত্তের মালিকরাই পৃষ্ঠপোষক? তারা নাম জাহির করতে চায় না? এ বিষয়ে জিগ্যেস করা যায় না, কিছু জানাও যায় না। কিন্তু মনে প্রশ্ন থাকেই, যারা বে-আইনি মাদকের ব্যাবসা করে, যারা এমনই দুর্দান্ত ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির যে যখন তখন জজ-ম্যাজিস্ট্রেটদেরও খুন করতে দ্বিধা করে না, তারা কবিতার জন্য এত টাকা খরচ করতে যাবে কেন? খুনিরা ভালোবাসে কবিতা?

আমাদের দেশে মদ, সিগারেট কোম্পানি, ঠান্ডা পানীয় প্রস্তুতকারীরা বড় বড় খেলা কিংবা হুলুস্থুল নাচ-গান-বাজনার উৎসবের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করলেও কবিতা নিয়ে তো কখনও মাথা ঘামায় না।

এই দশ দিনের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় কবিদের ভাগ ভাগ করে কবিতা পাঠের ব্যবস্থা হয়েছে। আমার বরাদ্দ চারদিন। এক-একটি অনুষ্ঠানে পাঁচ বা ছ’জন বিভিন্ন দেশের কবি, সমসংখ্যক অনুবাদক-অনুবাদিকা, দু-ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানেই দেখেছি, হলঘর সম্পূর্ণ ভরতি, অনেককে দাঁড়িয়ে বা সিঁড়িতে বসেও শুনতে হয়, কোনওরকম গণ্ডগোলহীন মনোযোগ, বিপুল করতালি। অনুষ্ঠানের শেষে দলে দলে ছেলেমেয়ে এমনকী বয়স্ক-বয়স্করাও আসে বিদেশি কবিদের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য। উদ্যোক্তারা প্রকাশ করেছেন চারশো সত্তর পৃষ্ঠার একটি সুমুদ্রিত গ্রন্থ, যাতে রয়েছে আমন্ত্রিত কবিদের এক গুচ্ছ করে কবিতার স্প্যানিশ অনুবাদ। আমার কবিতাগুলির অনুবাদ করেছেন দিল্লির জহহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শ্যামাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়। এ ছাড়াও রাউল হেইসে নামে স্থানীয় এক কবি আমার আরও কয়েকটি কবিতার অনুবাদ করে রেখেছেন, তিনি কোথা থেকে সেগুলো পেয়েছেন কে জানে।

ওই অনুবাদ কাব্য-সংগ্রহটি অনেক শ্রোতারই হাতে হাতে, তারা কিনেছে, অনুষ্ঠানের শেষে এক এক কবির নামের নির্দিষ্ট পৃষ্ঠায় নিয়ে নিচ্ছে স্বাক্ষর।

কবিতা পাঠের সময় আমি নিজের সঙ্গে একটা মজা করেছি।

অনুবাদক পাঠ করছেন আমার কবিতার স্প্যানিশ ভাষ্য, শ্রোতারা সেগুলিই উপভোগ করছে, ভালো লাগছে কিংবা মন্দ লাগছে, কিন্তু আমার বাংলা পাঠ কেউ বুঝছে না একটি শব্দও। আমার বাংলা কবিতা আমি নিজেই পড়ছি, নিজেই শুনছি। তা যদি হয়, তা হলে প্রত্যেকবার অনুবাদের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে আমার মূল কবিতা পড়ার দরকার কী? অন্য কবিতা পড়লেও তো কেউ ধরতে পারবে না। তাহলে শুধু নিজের কবিতা কেন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের কবিতা মুখস্থ বলে গেলেও দিব্যি চলে যাবে।

একবার অনুবাদক আমার নীরা বিষয়ক একটি কবিতা পাঠ করার পর আমি মূল হিসেবে পড়ে গেলাম, ‘যদিও সন্ধ্যা নামিছে মন্দ মন্থরে। সব সঙ্গীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া…!’ অনুষ্ঠান শেষে একজন মাত্র লোক এসে আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনার কবিতার স্প্যানিশ অনুবাদে প্রি যাফেলাইট শব্দটি ছিল, বাংলায় তো সে শব্দটি শুনলাম না?

আমি প্রায় স্তম্ভিত! এমন মনোযোগী শ্রোতাও থাকে?

সবচেয়ে মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানটি হয়েছিল একটি মেডিক্যাল কলেজে।

ডাক্তারির ছাত্র-ছাত্রী ও তাদের অধ্যাপকদের কবিতা সম্পর্কে এত আগ্রহ? হল তো পরিপূর্ণ ছিলই, তা ছাড়া যাকে বলে ভাইব্রেশান, তাতে বোঝা যাচ্ছিল কবি ও শ্রোতাদের মধ্যে একটা নিবিড় যোগাযোগ ঘটে যাচ্ছে। অটোগ্রাফ সংগ্রহের জন্যও তাদের উৎসাহ প্রচুর। শুধু তাই নয়, পরদিন ওখানকার একটি ছাত্রী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের লেখা ধন্যবাদ পত্র, একটি কলম ও গালে একটি চুম্বন উপহার দিতে এসেছিল।

প্রত্যেকটি অনুষ্ঠানেই আমি মঞ্চে বসে শ্রোতাদের মুখগুলির মধ্যে ইলিয়ানাকে খুঁজি। অকারণ, অর্থহীন, অযৌক্তিক এই খোঁজা, তবু এটা যেন আমার বাতিক হয়ে গেছে। নিজের মানিব্যাগ থেকে টাকা বার করে কিছু কিনতে গেলেই প্রত্যেকবার মনে পড়ে ইলিয়ানার কথা। কেন তাঁকে আমি ধন্যবাদ জানাইনি? তিনি কি আমাকে সেই সুযোগ আর একবার দেবেন না?

একদিন হোটেল থেকে রাস্তায় বেরিয়েই দেখি, উলটো দিকে এক মহিলা ট্যাক্সি ডেকে উঠে পড়লেন। আমার বুকটা ধক করে উঠেছিল। ইলিয়ানা না? ঠিক যেন সেইরকম চেহারা! আসলে তেমন মিল নেই, আমার কল্পনারই প্রতিফলন।

মাঝে মাঝেই ভাবি, ওই মধ্যবয়েসি মহিলাটি কি নিছক গৃহবধূ? কিংবা অধ্যাপিকা? চিত্রাভিনেত্রী? পলিটিশিয়ান? একা একা ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন, নেহাত সাধারণ হতে পারেন না। যৌবনকালে ওঁর জন্য কজন পুরুষ ডুয়েল লড়েছে? এখনও ওঁর যা শরীরের বাঁধুনি, তাতে যৌবন পড়ন্ত মনে হয় না।

ইংল্যান্ড, আমেরিকা তো বাদই দিলাম, চিন, জাপান, কেনিয়া, নরওয়ে, ডেনমার্কেরও যে কোনও শহরে অন্তত একগুচ্ছ বাঙালি দেখা যায়। ম্যাডেলিন শহরে একজনও বাঙালি নেই তো বটেই, ভারতীয়ও আছে কি না সন্দেহ। একজনকেও দেখিনি। বিভিন্ন দেশের রেস্তোরাঁ আছে, চিনে রেস্তোরাঁ তো থাকবেই, এখন জাপানিরাও সর্বত্র, কিন্তু ভারতীয় বা পাকিস্তানি বা বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ একটাও নেই। আশ্চর্য, সর্দারজিরাও ওখানে পৌঁছতে পারেনি।

আমাদের সঙ্গে যে কয়েকজন বিভিন্ন আরব দেশের কবি আছেন, তাঁরা নুটিবারা হোটেলের বিস্বাদ খাদ্য খেতে-খেতে তিতিবিরক্তি হয়ে একদিন আমাকে বলেছিলেন, এখানে ভারতীয় হোটেল নেই কেন? তা হলে অন্তত রুটি-মাংস খেয়ে বাঁচতাম। ভারতীয় খাবার আমাদের খুব পছন্দ।

একটি কাব্যপাঠের আসরে শ্রোতাদের মধ্যে দুজন শাড়িপরা মহিলাকে দেখে মনে হয়েছিল, এই তো, বাঙালি না হলেও ভারতীয় নারী তো হবেই! তাদের গায়ের রংও মেম সাহেবদের মতন নয়।

অনুষ্ঠান শেষে মহিলা দুটি নিজে থেকেই এগিয়ে এলেন আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য।

ও হরি, এরা তো ভারতীয় নয়, এখানকারই মিশ্র জাতি। স্প্যানিশ ও স্থানীয় অধিবাসীদের

মিশ্রণের ফলে এখানকার অনেক নারী পুরুষদেরই গায়ের রং আমাদের মতন তামাটে।

মহিলা দুটি শাড়ি পরেছে, কারণ এরা ইস্কনের সদস্য, বৈষ্ণব। এখানেও ইস্কন পৌঁছে গেছে। রামকৃষ্ণ মিশনের চেয়েও ইস্কন অনেক সুদূরপ্রসারী। এই ইস্কনের দৌলতে মহাপ্রভু, শ্রীচৈতন্য, কৃষ্ণ, মায়া, কর্ম এইরকম কয়েকটি শব্দ এখানকার বুদ্ধিজীবীরা জানে।

ইস্কন পরিচালিত এখানে একটি নিরামিষ ভোজনালয় আছে, আমি যেহেতু এদের মহাগুরু প্রভুপাদের দেশের লোক, বাংলা শব্দ উচ্চারণ করেছি, সেই সুবাদে এরা ইস্কন ভোজনালয়ে আমাকে নেমন্তন্ন করলেন। আমি সঙ্গে-সঙ্গে রাজি, কিন্তু উদ্যোক্তাদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত যে ব্যক্তিটি আমাদের সঙ্গে ছিল, সে মৃদু ও দৃঢ় স্বরে জানাল এই মহিলাদের আমরা চিনি না। সুতরাং এদের কাছে তোমাকে আমরা ছেড়ে দিতে চাই না। এরা সন্দেহভাজন হোক বা না হোক, এরা তোমার নিরাপত্তা দিতে পারবে কি না তা বুঝবে কী করে? তোমার না যাওয়াই ভালো। সুতরাং ওদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করা গেল না। ইস্কনের নিরামিষ রান্না খুব সুস্বাদু হয়। তা থেকে বঞ্চিত হলাম।

মুখের ওপর তো প্রত্যাখ্যান করা যায় না, তাই আমাকে বলতেই হল, এখন কয়েকটা দিন ব্যস্ত আছি, পরে খোঁজ করবেন!

আমন্ত্রিত কবিদের মধ্যে শাড়ি পরা মেয়ে একটিই আছে। সে এসেছে শ্রীলঙ্কা থেকে। শ্যামলা রঙের ছোটখাটো চেহারার তরুণীটিকে হুবহু বাঙালি বলে মনে হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, তুমি কলকাতার রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সবাই তোমাকে বাঙালি মেয়ে বলে ভুল করবে। মেয়েটির নাম রামিয়া জিরাসিংঘে। সে হেসে বলেছিল, আমাদের সঙ্গে বাংলার মানুষদের কিছু কিছু মিল আছে।

কিন্তু আমি শ্রীলঙ্কায় গিয়ে দেখেছি, সেখানকার মানুষরা ‘আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লঙ্কা করিল জয়’ এ তথ্য মানতে চায় না। (বিজয় সিংহ বাঙালিও নয়, খুব সম্ভবত গুজরাতি)। রামায়ণের কাহিনিও সেখানে অনেকে জানে না কিংবা জানলেও আলোচনা করতে চায় না। ওখানকার স্কুল-কলেজে পড়ানো হয় না রামায়ণ। কারণ রামায়ণ অনুযায়ী তো শ্রীলঙ্কার অধিবাসীদের পূর্বপুরুষ সবাই ছিল রাক্ষস!

পাকিস্তানে এখন শাড়িপরা নিষিদ্ধ। পাকিস্তান থেকেও একজন মহিলা এসেছেন, তিনি সালোয়ার-কামিজ পরা, মধ্যবয়েসি, খুবই সপ্রতিভ এবং তুখোড়। আমি তাঁকে প্রথম দিন দেখতে পাইনি, তিনিই এক সকালে ডাইনিং রুমে আমায় খুঁজে বার করলেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, তিনি আমার নাম জানেন এবং নবনীতা দেবসেনের সঙ্গে ভালো পরিচয় আছে। কিশোয়ার নাইদ নামে এই কবি পেশায় সরকারি অফিসার, এক সময় পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন, তাই কিছু কিছু বাংলা জানেন। কিশোয়ার নাইদ সেই ধরনের মহিলা যার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পরই মনে হয় অনেকদিনের চেনা।

একটি অধিবেশনে কিশোয়ার আর আমি পাশাপাশি বসেছিলাম, কবিতা পাঠও পরপর, কিশোয়ার ফিসফিস করে নানারকম মজার-মজার গল্প বলছিল। কিশোয়ারের উর্দু কবিতার আংশিক রস গ্রহণে আমার অসুবিধে হল না, উর্দু গজল তো আমরা হরদমই শুনি। আমার বাংলা কবিতাও কিশোয়ার খানিকটা বুঝেছে বলে দাবি করল।

একজন সুইডিশ মহিলা ঘুরে-ঘুরে বিভিন্ন দেশের কবিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তাঁর পত্রিকার জন্য। আমাকে তিনি এতবার ডাকলেন, বসা হল হোটেল সংলগ্ন এক রেস্তোরাঁয়, সেখান থেকে রাস্তার দৃশ্য দেখা যায়, সন্ধে হয়ে এসেছে। মহিলাটির সঙ্গে কথা বলতে-বলতে আমি চমকৃত। বাংলা সাহিত্য বিষয়ে তাঁর দারুণ জ্ঞান, তিনি জানেন জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কতখানি প্রভেদ, নজরুল ইসলামের আবির্ভাবের গুরুত্ব, এমনকী উত্তরবঙ্গে যে নকশালবাড়ি নামে একটি গ্রাম আছে, যেখান থেকে সামরিক বিপ্লবের উদ্ভব, তাও তাঁর জানা।

কিছুক্ষণ পরে কিশোয়ার সেখানে এসে উপস্থিত হল। সাক্ষাৎকার বন্ধ হয়ে শুরু হল আড্ডা। আমরা বিয়ার নিয়েছিলাম, কিশোয়ার কী খাবে জিগ্যেস করতেই সেও বিয়ার চাইল। পাকিস্তানে মদ্যপানের ব্যাপারে নাকি কঠোর নিষেধ আছে, কিশোয়ারের ব্যবহার দেখে মনে হল, সে সুরাপানে বেশ অভ্যস্ত।

ঘণ্টা দু-এক পরে আড্ডা ভাঙার সময় আমি রমণী দুটিকে বললাম, তোমরা ব্যাগে হাত দেবে না। বিয়ার-টিয়ারের বিল সই করব আমি। ওরা আপত্তি করার চেষ্টা করতেই আমি বাধা দিয়ে বললাম, শোনো, আমি মেল শোভেনিস্ট, মেয়েদের টাকাপয়সা নিয়ে নাড়াচাড়া করা দেখতে আমার ভালো লাগে না!

সুইডিশ মহিলাটি মেনে নিলেও কিশোয়ার হইহই করে উঠল, সে তার ভাগের অংশ দেবেই দেবে। আমি বললাম, কিছুতেই না। তুমি আমাদের টেবিলে এসে বসলে কেন?

কিশোয়ার আমার হাত চেপে ধরল, আমি তা ছাড়াবার জন্য টানাটানি করছি, সুইডিশ মহিলাটি বললেন, এবার কি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবে নাকি?

আমি বললাম, আজকাল কোনও যুদ্ধেই কেউ জেতে নাকি? কেউ জেতেও না। কেউ হারেও। আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। মাঝখান থেকে শুধু বহু প্রাণ ও বহু অস্ত্র নষ্ট হয়। তবে আপাতত এখানে এই যুদ্ধটায় আমি জিতব!

কিশোয়ার জিগ্যেস করল, কত টাকা পর্যন্ত হলে তুমি মেয়েদের খরচ দিয়ে দাও?

মোক্ষম প্রশ্ন! অতি বুদ্ধিমতী মহিলা তো।

হাসতে-হাসতে বললাম, তোমরা দু-তিন হাজার টাকা খেয়ে ফেললে আমি মোটেই দিতাম। একশো-দেড়শো হলে ভাগাভাগি করাটা ভালো দেখায় না।

কবিদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় নারীদের সংখ্যা দশ শতাংশ, অর্থাৎ খুবই পুরুষ প্রাধান্য। অথচ, আমাদের দেশে তো বটেই, অন্যান্য দেশেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের পড়ুয়াদের মধ্যে ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীরেদ সংখ্যা বহুগুণ বেশি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা এম এ ক্লাসে মেয়েদের উজ্জ্বল উপস্থিতির মধ্যে ছেলেদের প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না।

বেশ কয়েকজন কবি লাজুক এবং একচোরা, আর কিছু কবি হইচই প্রবণ। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের কালো রঙের কবিরা সব সবল ও দীর্ঘকায়, জোরে জোরে কথা বলে। এঁদের বেশ কয়েকজনের মাথায় আমাদের দেশের পাহাড়ি সাধু-সন্ন্যাসীদের মতন দীর্ঘ জটা। এটাই নাকি এখনকার ফ্যাশান ওই সব অঞ্চলে। পিঠ পর্যন্ত ঝুলন্ত, শক্ত জটা নিয়ে এঁরা ঘুমোন কী করে? এটা যেন আমারই সমস্যা!

কয়েক দিনের মধ্যেই সবচেয়ে অমিশুক হিসেবে আমার পরিচিতি রটে গেল। কেউ-কেউ এসে অভিযোগও করেছে, তুমি অন্যদের সঙ্গে মেশো না কেন?কথা বলতে চাও না?

আর সবচেয়ে মিশুক আর ঠিক জনপ্রিয় না হলেও সবচেয়ে বির্তকিত হলেন আমেরিকার কবি আমিরি বরাকা। ইনি কৃষ্ণাঙ্গ হলেও লম্বা-চওড়া নন, ছোটখাটো, প্রায় বৃদ্ধ, মুখে দাড়ি, ভাবভঙ্গিতে অ্যালেন গিনসবার্গের অনুকরণ।

ইনি ডেকে ডেকে সবার সঙ্গে আলাপ করেন। এবং বিলি করেন নিজের সম্পাদিত পত্রিকা। সে পত্রিকায় আগুন ঝরছে। সব লেখাতেই আমেরিকার শাসক সম্প্রদায় এবং প্রেসিডেন্টকে তীব্র আক্রমণ। এঁর মতে আমেরিকা দেশটায় চলছে অগণতান্ত্রিক গণতন্ত্র আর প্রেসিডেন্ট বুশ বর্ণবিদ্বেষী ও জাল-জোচ্চুরি করে জিতেছেন!

আমেরিকার রাষ্ট্রপতির বাবা-মা তুলে গালাগাল করলেও পার পাওয়া যায়, কোনও শাস্তি হয় না। প্রেডিডেন্ট কেনেডি খুন হওয়ার পর তাঁর উত্তরাধিকারী জনসনকে খুনি সাজিয়ে নাটক লেখা হয়েছিল।

আমিরি বরাকার কবিতা পাঠের সময়ও গালাগালিগুলি খুব প্রকট আর উচ্চকণ্ঠ।

কোনও-কোনও কবির মুখের ভাবে একটা প্রচ্ছন্ন অভিমান লেগে থাকে সব সময়। যেন তিনি বলতে চান, আমি যে নিজের দেশের কত খ্যাতিমান কবি, তোমরা বুঝতেই পারছ না।

শুনেছিলাম এই সম্মেলনে মার্কেজ আসবেন, আসেননি। তিনি অসুস্থ, ক্যানসার রোগে আক্রান্ত।

সকালবেলা ব্রেকফাস্টের সময় কয়েকদিনের মধ্যে একটা ঘটমান নাটক লক্ষ করলাম।

একজন কৃষ্ণকায় বৃদ্ধ কবির সঙ্গে সবসময় থাকে তাঁর প্রায় হাঁটুর বয়েসি এক তরুণী। এঁরা কোন দেশের জানি না। কাছাকাছি টেবিলে দেখতে পাই, কবিটির সঙ্গে থাকে একগাদা কাগজ ও বইপত্র, তিনি অন্য কারুর সঙ্গে কথা বলেন না। শুধু মেয়েটির সঙ্গে ফিসফিস করেন। এবং ঘনঘন হিসি করতে যান।

তিনি উঠে গেলেই অন্য টেবিলের কোনও না কোনও অত্যুৎসাহী কবি উঠে আসে মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমাবার জন্য। মেয়েটির বয়স বড় জোর বাইশ-তেইশ, পুরোপুরি কালো নয় গায়ের রং, মুলাটো ধরনের মুখখানায় অপূর্ব লাবণ্য মাখা আর লজ্জা-লজ্জা ভাব। আজকাল লাজুকতা পশ্চিমি দেশে আর দেখাই যায় না।

যুবকেরা মেয়েটিকে অন্য টেবিলে ডাকলে সে প্রবলভাবে মাথা নেড়ে আপত্তি জানায়। আর বৃদ্ধ কবিটি ফিরে এসে অন্য যুবকদের সঙ্গে কথা বলতে দেখলে অমনি মেয়েটিকে বকাবকি শুরু করেন।

কবিটি কি তাঁর মেয়েকে সঙ্গে এনেছেন, তাকে সর্বক্ষণ পাহারা দিয়ে রাখতে চান? এসব দেশে এটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। পরে জানা গেল, ওঁরা স্বামী-স্ত্রী! বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যার প্রতি বেশি-বেশি দুর্বলতা ও সবসময় হারানোর ভয় সব দেশে একই রকম।

একদিন আমি একটা টেবিলে একা বসে আছি, অন্য টেবিলে জায়গা না পেয়ে ওই দুজন খাবারের প্লেট নিয়ে বাধ্য হয়ে বসলেন আমার পাশে।

আলাপ করতে না চাইলেও, ভদ্রতা সূচক সুপ্রভাত বলতেই হয়। সেইটুকু বলেই আমি হাতের বইতে মনোনিবেশ করি। এখানকার কোনও খাবারই আমার রোচে না, এমনকী পাউরুটিও এমন খড়মড়ে যে মনে হয় গাল কেটে যাবে, একদিন মাত্র ডিমের ঝুরঝুরি বা ক্রামবলড এগ দেখা গিয়েছিল। আমি শুধু দেখেছি, নিজে পাইনি। লাইনে দাঁড়িয়ে সেই ভাণ্ডটা পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতেই নিঃশেষ। খরা-পীড়িত মানুষের মতন আগের লোকেরা যে যতটা পারে তুলে নিয়েছে। তাই আমি শুধু কাপের পর কাপ কফি খাই।

আমি নিজে থেকে কোনও কথা বলছি না কিংবা মেয়েটির প্রতি চোরা দৃষ্টিপাত করছি না দেখে বোধহয় বৃদ্ধ কবিটি নিশ্চিন্ত হলেন। হঠাৎ জিগ্যেস করলেন, তুমি কি ভারতীয়?

আমি মাথা নেড়ে বোঝালাম যে তাঁর অনুমান সঠিক।

তিনি আবার বললেন, আমি ভারত সম্পর্কে আগ্রহী। কিছু কিছু ভারতীয় দর্শন পড়েছি।

এবারে মাথা নাড়লাম দুবার।

সকালবেলা অনর্থক বাক্যব্যয় করা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো নয় বলে আমি দুবার মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলাম, ওঁর ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে আগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু সে বিষয়ে এখন আলোচনার আগ্রহ আমার নেই।

তিনি আবার বললেন, উপনিষদে চমৎকার কবিত্ব আছে।

আবার দুবার শিরশ্চালন। মেয়েটি খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছে এদিকে।

এই কবি অন্য কারুর সঙ্গে কথা বলতে চান না, আমি শুধু ভারতীয় বলেই যেন দয়া করছেন। আমি কেন এই দয়া নিতে যাব?

এরপরেও তিনি বললেন, আমার নাম হোজে ডি’কস্টা, আমি হেইটি থেকে এসেছি।

এবারে আমাকে মুখ খুলে নিজের নাম জানিয়ে বলতেই হল, আপনার সঙ্গে আলাপ করে সুখী হলাম।

তারপরই উঠে গেলাম কফি আনতে।

ফিরে এসে দেখি কবিটি নেই, বসে আছে মেয়েটি। কবি তা হলে গেছেন হিসিখানায়।

মেয়েটির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সে ইংরিজিতে বলল, তুমি ভারতীয়? আমার খুব ভারতে যেতে ইচ্ছে করে।

একজন ঈর্ষাকাতর বৃদ্ধকে উপেক্ষা করলেও একটি তরুরীকে অবহেলা করব কেন?

হেসে বললাম, এসো একবার ভারতে বেড়াতে।

সে বলল, ভারত যে অনেক দূর।

হ্যাঁ, অনেক দূর। তুমি কি কবিতা লেখো?

মেয়েটি প্রবলভাবে মাথা নেড়ে বলল, না, না, আমি কবিতা লিখতে পারি না। কবিতা লেখা সহজ নাকি? আমি একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াই। আমার খুব ইচ্ছে সাংবাদিক হওয়ার।

সেটা খুব শক্ত নয়, চেষ্টা করলেই পারো।

অসুবিধে আছে। সাংবাদিকতা করতে হলে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে হয়। সেটা উনি পছন্দ করেন না।

তোমার নাম কি?

আমার নাম ফ্রাঁসোয়াজ।

ফরাসি নাম?

হ্যাঁ। তুমি ফরাসি ভাষা জানো?

জানি না-ই বলা যায়। তবে ফরাসিতে ছেলেদের নাম হয় ফ্রাঁসোয়া, আর মেয়েদের ফ্রাঁসোয়াজ, এটা অন্তত বুঝি। তোমাদের ভাষা বুঝি ফরাসি?

আমাদের ইংরিজি, ফরাসি আর হেইশিয়ান, তিনটে ভাষাই শিখতে হয়। আমার স্বামী আরও অনেক ভাষা জানেন।

মেয়েটির গলার আওয়াজটি বেশ মিষ্টি। লাজুকভাবেই আস্তে-আস্তে কথা বলে।

একটি অ-ফরসা মেয়ের ফরাসি নাম কেমন যেন অসঙ্গত মনে হয়। শ্যামলী কিংবা কৃষ্ণা নামেই ওকে বেশি মানাত।

আমাদের দেশেও কোনও কোনও মেয়ের নাম শেলি কিংবা বিউটি হয়, সে নাম শুনলেই অন্যদিকে তাকাতে ইচ্ছে করে।

মেয়েটি তিনটি ভাষা জানে, স্কুলে পড়ায়। তার মানে নিজস্ব জীবিকা আছে। কিন্তু তার সাংবাদিকতা করার সাধ মেটাতে দেবে না তার হিংসুক স্বামী।

ওর রূপ আর গুণ দুই-ই আছে, তবু ও বাপের বয়েসি একজন বৃদ্ধকে বিয়ে করতে গেল কেন?নামকরা কবি, সেই খ্যাতির মোহ?

কিন্তু এ কথা তো জিগ্যেস করা যায় না।

ভারতের নাম শুনেই বৃদ্ধ কবিটির উপনিষদের কথা মনে পড়েছিল। দর্শন ও কবিত্ব। কিন্তু বর্তমান ভারত তো উপনিষদের দেশ নয়, বর্ণ-বৈষম্য, জাত-পাতের অবিচার, ধর্ম-ভেদের লড়াই, কত রকম নীচতা, ক্ষুদ্রতা প্রতিদিন চোখে পড়ে। গৌতম বুদ্ধ ও মহাত্মা গান্ধির দেশ হওয়া সত্বেও হিংস্রতা ও হানাহানি চলছে সারাদেশ জুড়ে। প্রাচ্যদেশে ভারতই প্রথম পারমানবিক অস্ত্র বানাবার অপরাধে অপরাধী।

বাংলা ও ভূগোল বইতে যার নাম হাইতি, এখানে সকলে বলে হেইটি, সে দেশটা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? হেইটি নাম শুনলেই মনে পড়ে অরাজকতা ও স্বৈরাচার, অশান্তি ও খুনোখুনি। একসময় সেখানকার এক কুখ্যাত স্বৈরাচারী শাসক পরিচিত ছিল পাপা ডক নামে, তার এক গুপ্ত বাহিনীর নাম ছিল টনটন। হিটলারের গেস্টাপোদের মতন, তাদের হাতিয়ার ছিল পাতলা লিকলিকে ছুরি, সামান্য সন্দেহে তারা হাজার লোককে পেটের মধ্যে ওই ছুরি চালিয়ে হত্যা করেছে। গ্রাহাম গ্রিন এই সময়টা নিয়ে ‘দ্য কমেডিয়ানস’ নামে একটা বাস্তব উপন্যাস লিখেছিলেন। সেটা হলিউডের নাম করা ফিল্মও হয়েছিল। এলিজাবেথ টেলর ও রিচার্ড বার্টন ছিল প্রধান ভূমিকায়। এখনও হেইটিতে মানুষের গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা নেই।

এক একটা দেশ সম্পর্কে এরকমই এক ধরনের একপেশে পরিচিতি ছড়িয়ে আছে বহির্বিশ্বে। আজ সকালের আগে আমিও তো জানতাম না হেইটিতে রয়েছে এই বৃদ্ধ হোজে ডি’কস্টার মতন বহু ভাষাবিদ কবি, যিনি উপনিষদের পর্যন্ত খবর রাখেন। আর এই ফ্রাঁসোয়াজ-এর মতন সুন্দরী, মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে, নিশ্চয়ই আরও আছে এর মতন।

কোনও একটা দেশের নামে সে দেশের মানুষের পরিচয় হতে পারে না। এই জন্যই আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়, দেশজিনিসটাই একটা গাঁজখুরি ব্যাপার।

চোখ ও মুখের সৌন্দর্য ছাপিয়েও ফ্রাঁসোয়াজ-এর নম্র ও লাজুক ভঙ্গিটিই আমার বেশি ভালো লাগছিল।

কিছুক্ষণ নীরবভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থেকে আমি হঠাৎ বলে ফেললাম, ফ্রাঁসোয়াজ, তোমার মুখটা দেখলেই মনে হয়, তোমার মধ্যে একটা সুন্দর সারল্য আছে।

এই উক্তিটিতে পুরুষ সুলভ স্তুতির চেয়ে স্নেহের ভাবটাই বেশি।

ফ্রাঁসোয়াজ আরও লজ্জা পেয়ে মাথাটাকে নীচু করে প্রায় টেবিলের সঙ্গে চুঁইয়ে ফেলল।

আর কোনও কথা হল না। ফিরে এলেন তার স্বামী। আরও দুজন এসে যোগ দিল আমাদের টেবিলে।

এর পর আর কোনও সকালেই আমাদের এক টেবিলে বসা হয়নি। সবাই তো আর এক সময়ে আসে না। সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে ন’টা, এর মধ্যে যার যখন খুশি।

দূর থেকে দেখেছি কয়েকবার। চোখাচোখি হলে ফ্রাঁসোয়াজ এক ঝিলিক হাসি উপহার দিয়েছে।

জীবনে আর কখনও দেখা হবে না, ঠিকানা বদলাবদলিও করিনি, তবু যেন ওর সঙ্গে একটা চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব হয়ে গেল। হেইটি নামের দেহটার ভাবমূর্তি বদলে দিল এই এক দম্পতি।

কয়েকদিন পর দেখি, বৃদ্ধ কবিটি একা বসে আছেন ব্রেকফাস্ট টেবিলে। এর আগে সব সময় ওদের দেখেছি একসঙ্গে। মেয়েটির অসুখ করল নাকি?

ওঁর কাছে খোঁজ খবর করতে গেলে উনি হয়তে উলটো ভাববেন। মনের মধ্যে রয়ে গেল অদম্য কৌতূহল।

পরের দিনও তাই। অন্য এক টেবিলে একা-একা বসে কাপের পর কাপ খেয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ কবি। সামনে যথারীতি একগাদা বই, তিনি পড়ছেন না, শূন্য উদাস দৃষ্টি। ফ্রাঁসোয়াজ-এর অনুপস্থিতিতে সকালবেলায় এ ঘরের ছবিটি অসম্পূর্ণ মনে হয়।

ফ্রাঁসোয়াজ অসুস্থ কিনা, তা জানার একটা বুদ্ধি মাথায় এসে গেল।

কবিরা কে কোন ঘরে থাকে, তার একটা তালিকা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি চট করে উঠে গিয়ে হোটেলের লবি থেকে ফোন করলাম হোজে ডি’কস্টার ঘরে। কেউ ধরল না। ফোন বেজেই গেল।

তাহলে তো ফ্রাঁসোয়াজ ঘরেও নেই। বেশি অসুস্থ, হাসপাতালে গেছে? তরুণী, স্বাস্থ্যবতী, তার হঠাৎ এমনকী গুরুতর অসুখ হতে পারে?

পরদিনও ফ্রাঁসোয়াজকে দেখা গেল না, অসুস্থ হয়ে পড়লেন তার স্বামী।

বৃদ্ধ কবি একা একাই বসেছিলেন ব্রেকফাস্ট টেবিলে, হঠাৎ তিনি এলিয়ে পড়ে গেলেন মাটিতে, চেয়ারও পড়ে গিয়ে জোর শব্দ হল।

আরও কয়েকজনের সঙ্গে আমি দৌড়ে গেলাম তাঁর কাছে। ধরাধরি করে তোলা হল। তিনি অজ্ঞান হয়ে যাননি। বারবার বলতে লাগলেন এমনি মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।

তিনি অন্য কোনও রকম সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে চুমুক দিতে লাগলেন কফিতে। তাঁর কথার মধ্যে রয়েছে গাম্ভীর্য ও ব্যক্তিত্ব।

আমার টেবিলে আরও চার-পাঁচজন বসেছিল, আমি ফিরে আসার পর তাদের নীচু গলায় আলোচনা শুনে, যদিও ফরাসি ভাষায়, খানিকটা খানিকটা বোঝা গেল যে ফ্রাঁসোয়াজ নামের মেয়েটি দুদিন ধরে উধাও হয়ে গেছে। না, আতঙ্কবাদীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়নি, তার জামাকাপড়ের হ্যান্ডব্যাগটিও নেই, সে চলে গেছে একজন কলম্বিয়ান কবি ও সাংবাদিকের সঙ্গে, তাকেও আর দেখা যাচ্ছে না।

প্রথমেই একটু অভিমান হল আমার। ফ্রাঁসোয়াজ চলে গেল, আমাকে একবারও বলেও গেল না?

তারপরই হাসি পেয়ে গেল। আমাকে সে বলবে কেন, আমি তার কে? আমার সঙ্গে চলে যাওয়ায় তার স্বামী থানা-পুলিশ বা হইচই করেনি। কারুর কাছে মুখই খোলেনি। সাজ্জাতিক আঘাত পেয়েছেন নিশ্চয়ই, তা তিনি সহ্য করছেন একা-একা। ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন, তরুণী বউকে সব সময় চোখে-চোখে রাখতেন, সেগুলোও তো প্রবল ভালোবাসারই লক্ষণ। বুড়ো হয়ে গেছেন, তা আর তিনি কী করবেন। ফ্রাঁসোয়াজ তো জেনেশুনেই তাঁকে বিয়ে করেছিল। হয়তো জানতেনই, ও মেয়ে চলে যাবে একদিন।

এরকম আঘাত পেয়েও যে তিনি আত্মসম্মান হারাননি, এ জন্য বৃদ্ধ কবিটির ওপর আমার শ্রদ্ধা হল।

যে তরুণ কবি-সাংবাদিকটি ফ্রাঁসোয়াজকে ইলোপ করে নিয়ে গেছে, সে নাকি এই ডাইনিং হলে সকাল-দুপুরে নিত্য হাজিরা দিত। খুবই সুপুরুষ ও আলাপি। কিন্তু আমি তার চেহারাটা মনে করতে পারলাম না।

মনে-মনে সেই যুবকটির উদ্দেশে বললাম, দেখিস হারামজাদা, ওই সরল, সুন্দর মেয়েটিকে কষ্ট দিস না।