০৭. জোজোর জ্ঞান ফিরল

জোজোর জ্ঞান ফিরল আরও তিন ঘণ্টা বাদে। ততক্ষণে সন্তুর ঝিমুনি এসে গেছে। খঙ্গাপুরে সে জোজোকে ফেলে নামতে পারেনি, তার পরেও জোজোর জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় সে অনেকক্ষণ বসেছিল। খাকি পোশাক পরা লোকটাও চা খাবার একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সন্তু আর একা কতক্ষণ জেগে থাকবে?

জোজো চোখ মেলেও শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর একসময় ধড়মড় করে উঠে বসল। সন্তু ও খাকি পোশাক-পরা লোকটির দিকে সে তাকাল অবাকভাবে। তাকে কখন ট্রেনে তোলা হয়েছে, তা সে বিন্দুবিসর্গও জানে না। রাত্রির ট্রেন ছুটছে দারুণ জোরে। জানলা খোলা, বাইরে শুধু অন্ধকার। কুপের দরজাটাও ভোলা।

এদিক-ওদিক চোখে বোলাতেই জোজোর চোখ পড়ল স্যান্ডউইচের বাক্সটা। ঘুম ভাঙতেই খিদেতে তার পেট জ্বলছে দাউ দাউ করে। কোনও দ্বিধা না করে সে বাক্সটা তুলে নিল। তাতে তখনও গোটা তিনেক স্যান্ডউইচ অবশিষ্ট আছে। জোজো প্রথমে একটা তুলে নিয়ে গন্ধ শুকল। তারপর খেতে শুরু করে দিল। তিনটেই শেষ করে ফেলল সে। দেওয়ালের একটা হুকে একটা ওয়াটার বটল ঝুলছে। সেটা নামিয়ে সে জল খেল অনেকখানি।

এবারে সে সন্তুর মুখের কাছে মুখ ঝুঁকিয়ে এনে দেখল। সত্যিই সন্তু কিনা। তার ভুরু কুঁচকেই আছে। এখনও সে কিছু বুঝতে পারছে না। খাকি পোশাক পরা লোকটাকেও সে লক্ষ করল ভাল করে। একে সে জীবনে কখনও তো দেখেনি। লোকটি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।

জোজো এবারে কুপের দরজার কাছে গিয়ে বাইরেটায় উঁকি দিল। সরু করিডরটা জনশূন্য। এখন কত রাত কে জানে!

ল্যাট্রিনটা বাঁ দিকে!

জোজো চমকে পেছনে ফিরে তাকাল। খাকি পোশাক-পরা লোকটার নাক ডাকছিল একটু আগে, কিন্তু আসলে সে ঘুমোয়নি? লোকটা কিন্তু চোখ বুজেই আছে এখনও।

লোকটি আবার বলল, বাথরুমে যাবে তো, যাও ঘুরে এসো!

জোজোর সত্যিই বাথরুমে যাওয়া দরকার। সে কোনও কথা না বলে বাঁ দিকে চলে গেল। বাথরুমের কাছেই একটা আলাদা সীটে একজন কন্ডাক্টর গার্ড বসে বসে ঢুলছে। এখন বেশ গভীর রাত, মনে হচ্ছে। এই কামরায় আর কেউ জেগে নেই মনে হয়। কোথায় যাচ্ছে এই ট্রেন?

বাথরুম সেরে জোজো ফিরে এল কিন্তু কুপের মধ্যে ঢুকল না। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে ডাকল, সন্তু!এই সন্তু!

খাকি পোশাক-পরা লোকটি চোখ বোজা অবস্থাতেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, শ্‌ শ্‌ শ্‌ শ্‌! এত জোরে কথা বলে না! ভেতরে এসে কথা বলো!

জোজো এবারে তীব্র গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?

লোকটি বলল, ভেতরে এসে শুয়ে পড়ো না ভাই। এত রাত্রে কেন গোলমাল করছ? আমি কেউ না। আমি একজন অতি সাধারণ লোক। তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি।

এত কথাবার্তায় সন্তু জেগে উঠল। তাকে চোখ মেলতে দেখেই জোজো বলল, এই সন্তু, উঠে আয়! শিগগির উঠে আয়। আমি পুলিশ ডেকেছি। এক্ষুনি পুলিশ এসে এই স্পাইকে অ্যারেস্ট করবে!

খাকি পোশাক-পরা লোকটা এবারে উঠে বসে বিরক্ত ভঙ্গি করে বলল, হাড়জ্বালালে দেখছি! চলন্ত ট্রেনে পুলিশ আসবে কী করে? এলে তো আসবে পরের স্টেশনে? পরের স্টেশন আসতে এখনও দুঘণ্টা দেরি আছে। ততক্ষণ ভেতরে এসে বসো!

তারপর সে সন্তুর দিকে ফিরে বলল, তোমার বন্ধুকে বলো না, আমি কি তোমাদের মারছি না ধরছি? তোমরা পালাতে চাও পালাবে, থাকতে চাও। থাকবে। তা ছাড়া আমি স্পাই হতে যাব কোন্ দুঃখে? ওসব ঝামেলায় আমি নেই!

জোজো সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, তুই কি লোকটাকে চিনিস?

সন্তু দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, না!

জোজো বলল, আমি চিনি। রামপ্রতাপ সিং-এর অ্যাসিস্ট্যান্ট। রামপ্রতাপ সিং হল আমার বাবার এক নম্বরের শত্রু। বিলাসগড়ের রাজার ছেলেকে রামপ্রতাপ সিং গুম করতে গিয়েছিল, আমার বাবা তার সব ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছিল। এখন সেই রাগে রামপ্রতাপ সিং আমাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ধরে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল! আমি কিন্তু অজ্ঞান হইনি। এতক্ষণ চোখ বুজে সব শুনেছি।

খাকি পোশাক-পরা লোকটি চোখ বড় বড় করে বলল, ওরে বাবা, এ যে এক লম্বা চওড়া গল্প। রামপ্রতাপ সিং-এর নাম আমি বাপের জন্মে শুনিনি! বিলাস গড়টাই বা কোথায়?

সন্তু বলল, জোজো, ভেতরে এসে বোস। আমি তো ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছি না।

জোজো এবারে ভেতরে এসে বলল, আমি গার্ডসাহেবকে সব বলে এসেছি। উনি টরে টক্কা করে পরের স্টেশনে খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন। ট্রেন থামলেই পুলিশ এসে এই স্পাইটাকে অ্যারেস্ট করবে?

লোকটি উঠে কুপের দরজাটা টেনে বন্ধ করে ছিটকিনি লাগাল। তারপর তাতে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে বসল, এই, স্পাই পাই করবে না বলে দিচ্ছি! পুলিশ আসে তো ভালই, আমার আইডেন্টিটি কার্ড দেখাব। তুমি তো খুব চালু দেখছি। এর মধ্যে গার্ডকে খবর দিয়ে এলে?

সন্তু জোজোর একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। ঘুম থেকে উঠেই জোজোর উদ্দাম কল্পনা শক্তি চালু হয়ে গেছে!

জোজো লোকটিকে বলল, আপনি দরজা বন্ধ করলেন কেন?

পুলিশ এলে খুলে দেব। রাত্তিরে দরজা বন্ধ করে রাখাই নিয়ম। যদি চোর ছাচোড় ঢুকে পড়ে। এখন লক্ষ্মী ছেলের মতন শুয়ে পড়ো। রাত্তিরটায় আর ঝাট কোরো না।

জোজো বলল, মোটেই আমরা এখন ঘুমোব না!

তা হলে তো দেখছি, আমাকেও ঘুমোতে দেবে না। তুমি যা বিচ্ছু ছেলে দেখছি, আমি ঘুমোলে যদি আমার বুকের ওপর চেপে বসো! তোমার বন্ধুটি কত ভাল, এতক্ষণ কিছু করেনি!

সন্তু বলল, জোজো, ওনার কাছে রিভলভার ছুরি দুটোই আছে!

লোকটি বলল, আচ্ছা সে কথা বলে ওকে ভয় দেখাচ্ছ কেন? আমি তোমাদের বয়েসী ছেলেদের ওপর ছুরি বন্দুক চালাব না মোটেই। সঙ্গে রাখতে হয় বলে রাখা। শোনো ভাই, একটা কথা বলি, পুলিশ যদি আসে, আমি নিশ্চয়ই দরজা খুলে দেব। আর যদি না আসে, তাহলে আর রাত্তিরে দরজা খুলো না। সকাল হলে দেখা যাবে। আমি এখন শুয়ে পড়ছি কেমন? যদি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ি, আমার গায়ে-টায়ে যেন হাত দিতে যেও না। আমার ঘুম খুব পাতলা!

লোকটি সত্যিই আবার শুয়ে পড়ে চোখ বুজল। জোজো এসে বসল সন্তুর পাশে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই আগে বল তো, তোকে এরা কী করে নিয়ে এল। এখানে?

জোজো বলল, আমি চেতলা পার্ক দিয়ে শর্টকাট করছিলুম, বুঝলি। লোডশেডিং, মানুষ জন দেখা যায় না। এমন সময় চারজন লোক হঠাৎ আমায় ঘিরে ধরল। আমি ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছি, জানিস তো? টপাটপ এক একজনকে ঘায়েল করতে লাগলুম। তিনজন চিৎপটাং হয়ে গেল, শুধু অন্ধকারের মধ্যে একজন হঠাৎ আমার পিঠে বুঝি ইঞ্জেকশান-এর সিরিঞ্জ ফুটিয়ে দিল! তাতে আমি টেমপোরারি, কিছুক্ষণের জন্য..

সন্তু বুঝল, জোজোর কাছ থেকে আসল ঘটনাটা সহজে জানা যাবে না। জোজো অনেকখানি রং না চড়িয়ে কিছুই বলতে পারে না। সন্তুর ঘুম পাচ্ছে। জোজো বহুক্ষণ ঘুমিয়ে বা অজ্ঞান হয়ে ছিল। কিন্তু সন্তু তো বেশিক্ষণ ঘুমোয়নি। জোজোর কথা শুনতে শুনতে তার ঝিমুনি এসে গেল।

পরের স্টেশনে পুলিশ এল না, তার পরের স্টেশনেও। সন্তু যখন আবার ভাল করে জেগে উঠল, তখন ভোর হয়ে গেছে। জোজোও তার কাঁধে হেলান দিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। খাকি পোশাক পরা লোকটি এর মধ্যেই উঠে পড়ে চুল আঁচড়াচ্ছে।

সন্তুর চোখে চোখ পড়তেই সে বলল, তৈরি হয়ে নাও, এবারে নামতে হবে!

একটা ছোট্ট স্টেশনে ট্রেনটা এসে থামল। সন্তু ভেবে দেখল এখানে নেমে পড়া ছাড়া উপায় নেই। লোকটা তাদের কোথায় নিয়ে যায় দেখাই যাক না। এ পর্যন্ত এই লোকটা তাদের সঙ্গে কোনও খারাপ ব্যবহার করেনি। এখন চ্যাঁচামেচি করে লোক জড়ো করা যেতে পারে বটে। কিন্তু লোকজনদের সে কী বলবে? এই লোকটা তাদের দুজনকে জোর করে ধরে এনেছে? সে আর জোজো দুজনেই কলেজে পড়া ছাত্র, তারা ছেলেধর পাল্লায় পড়েছে। এ কথা শুনলে কেউ বিশ্বাস করবে? এরকম কথা সন্তু মুখ ফুটে বলবেই বা কী করে? তা ছাড়া এই লোকটা তো সত্যিই সন্তুকে জোর করে আনেনি। সন্তু খড়গপুরে নেমে যেতে চাইলে লোকটা তো একবারও আপত্তি করেনি। তা হলে দেখাই যাক না, কী উদ্দেশ্যে তাদের এখানে নিয়ে আসা হয়েছে!

সে জোজোকে ঠ্যালা মেরে বলল, এই ওঠ!

জোজো চোখ মেলেই জিজ্ঞেস করল, পুলিশ এসেছে?

খাকি পোশাক পরা লোকটি বলল, চলো, আগে নামি স্টেশনে। তারপর সেখানে পুলিশের খোঁজ করা যাবে এখন। এখানে কিন্তু ট্রেন বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না।

ওরা নেমে পড়ল প্ল্যাটফর্মে। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দিল।

ছোট স্টেশন, আর দুতিনজন মাত্র যাত্রী নেমেছে এখানে। লোকজন বিশেষ নেই। স্টেশনের বাইরে সুন্দর ফুলের বাগান।

একজন ফর্সা, লম্বা মতন লোক, পাজামা আর সিল্কের পাঞ্জাবি পরা, এগিয়ে এল ওদের দিকে। সঙ্গে একটা বেশ বড় অ্যালসেশিয়ান কুকুর।

হাসি-হাসি মুখে লোকটি তিনজনের দিকেই বলল, কী আসতে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? রাত্রে ঘুম হয়েছে?

লোকটির ভাব ভঙ্গি এমন যেন সন্তুদের সঙ্গে তার অনেক দিনের চেনা। যেন কোনও আত্মীয় ওদের স্টেশনে রিসিভ করতে এসেছে। অথচ সন্তু এই লোকটিকে কোনওদিন দেখেনি। সে জোজোর দিকে তাকাল। জোজোও লোকটিকে চেনে বলে মনে হয় না। যদিও জোজো ভুরু কুঁচকে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আছে।

খাকি পোশাক পরা লোকটি বলল, রাত্তিরে মশাই একদম ভাল ঘুম হয়নি।

আমি এখন হোটেলে গিয়ে ঘুমোব। তারপর বিকেলের ট্রেনে ফিরব।

পকেট থেকে একটা লম্বাটে নীল খাতা বার করে পাতা উল্টে বলল, নিন, এখানে সই করুন; দুজনকেই ঠিকঠাক বুঝে পেয়েছেন তো?

সিল্কের জামা পরা লোকটি খাতাটায় সই করে দিল।

আমার ডিউটি ওভার? সব ঠিক আছে?

হ্যাঁ। আপনি যেতে পারেন!

খাকি পোশাক পরা লোকটি সন্তুদের দিকে তাকিয়ে বলল, চলি ভাই! ভাল থেকো! ভাল বেড়ানো হোক তোমাদের!

সে লাইন পেরিয়ে চলে গেল অন্যদিকে।

সিঙ্কের জামা পরা লোকটি সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার নাম সন্তু, আর এর নাম জোজো, তাই না! আমার নাম লর্ড আর আমার এই কুকুরের নাম টম্! চলো, তবে যাওয়া যাক।

জোজো বলল, নমস্কার মিঃ লর্ড। আচ্ছা, এখানকার থানাটা কোথায় একটু বলতে পারেন?

সিল্কের জামা পরা লর্ড বলল, থানা? তা একটু দূরে আছে। থানায় কিছু দরকার আছে বুঝি? সে যাওয়া যাবে বিকেলের দিকে। তোমাদের কাকাবাবু আর পিসেমশাই অপেক্ষা করে আছেন, চলো, দেরি করলে ওনারা চিন্তা করবেন।