০৬. কাকাবাবু একবার চোখ মেলেই

কাকাবাবু একবার চোখ মেলেই আবার চোখ বুজিয়ে ফেললেন। এখনও চোখের পাতাদুটো খুব ভারী। ঘুম কাটেনি। শরীরটা দুলছে। শরীরটা দুলছে।

মাথা ঘুরছে? কিংবা তিনি কি শূন্যে ভাসছেন? তাঁর ইচ্ছে করল চোখ খুলে ভাল করে দেখতে। কিন্তু কিছুতেই আর তাকাতে পারছেন না।

মিনিট পনেরো আবার অজ্ঞানের মতন ঘুমিয়ে কাকাবাবু দুচোখ মেললেন। আলোতেও চোখ ধাঁধিয়ে গেল। সেইজন্য কিছুই দেখতে পেলেন না। শরীরটা এখনও দুলছে। গলা শুকিয়ে কাঠ, জলতেষ্টা পেয়েছে খুব। অতিকষ্টে তিনি পাশ ফিরলেন।

কে যেন জিজ্ঞেস করল, জল খাবেন?

কাকাবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। আগে তিনি মনে করবার চেষ্টা করলেন, তিনি কোথায় রয়েছেন? কখন ঘুমিয়ে পড়লেন, ঘুমোবার আগে। কোথায় ছিলেন, তাঁর এসব কিছুই মনে পড়ল না।

মিঃ রায়চৌধুরী, জল খাবেন?

প্রচণ্ড মনের জোর এনে কাকাবাবু এক ঝটকায় উঠে বসলেন। তার মাথা ঘুরতে লাগল, মনে হল গায়ে একটুও জোর নেই। তারই মধ্যে তিনি বুঝতে পারলেন যে, তিনি রয়েছেন একটি রেলের কামরায়। বেশ বড় কামরা কিন্তু তাতে আর একজন মাত্র লোক রয়েছে। লোকটির গায়ে একটা পাতলা সাদা

কোট, হাসপাতালের ডাক্তাররা যেরকম পরেন।

ঘুমের ঘোরে কাকাবাবু একটুও বিস্ময় প্রকাশ করলেন না। লোকটির দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন বেশ কয়েক মুহূর্ত।

লোকটি একটি ফ্লাস্ক থেকে এক গেলাস জল ঢেলে নিয়ে কাছে এসে বলল, জলটা খেয়ে নিন, ভাল লাগবে।

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে গেলাসটা নিয়ে সবটা জল খেয়ে নিলেন ঢকঢক করে। তারপর গেলাসটি ফেরত দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ!

সাদা কোট পরা লোকটা বলল, শরীর খারাপ লাগছে না তো? খিদে পেয়েছে?

কাকাবাবু মনে মনে ভাবলেন, এটা ট্রেনের কামরা, না হাসপাতাল? কোনও উত্তর না দিয়ে তিনি চারদিক ভাল করে চেয়ে দেখলেন। সবকটা জানলা বন্ধ। তবে এটা সাধারণ রেলের কামরা নয়। স্পেশাল ব্যাপার। খুব সম্ভবত সেলুন কার। এক পাশটা লেবরেটরির মতন। কিছু যন্ত্রপাতি ও টেস্ট-টিউব ইত্যাদি রয়েছে। ট্রেনটা খুব জোর ছুটছে। সেই জন্যই তার শরীরটা দুলছে।

সাদা কোট পরা লোকটি বলল, আপনি একটানা ঠিক সতেরো ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন।

যেন এটা মোটেই আশ্চর্য হওয়ার মতন কোনও কথা নয়, এইভাবে কাকাবাবু বললেন,ও!

কামরার এক কোণে তাঁর ক্রাচ দুটো রয়েছে। কিন্তু এক্ষুনি উঠে দাঁড়াবার মতন তাঁর শরীরের জোর নেই। মাথাটা ঠিক মতন পরিষ্কার হয়নি। সেইজন্যই কাকাবাবু ঠিক করলেন, এখন তিনি এই লোকটিকে কোনও কথাই জিজ্ঞেস করবেন না।

লোকটি আবার বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করল, কিছু খাবেন, স্যার? চা কিংবা কফি?

কাকাবাবু বললেন, এক কাপ কফি খেতে পারি। ট্রেন থামুক।

ট্রেন থামার দরকার নেই। আমি কফি তৈরি করে দিচ্ছি। দুধ-চিনি থাকবে তো?

না, শুধু কালো কফি।

লোকটি স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে জল গরম করল। তারপর এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এল, সঙ্গে দুটি বিস্কুট।

কাকাবাবু বিনা বাক্য ব্যয়ে সেই কফি ও বিস্কুট শেষ করলেন। এবং অনেকটা চাঙ্গা বোধ করলেন।

লোকটি বলল, কিছু মনে করবেন না, স্যার। আপনার পা একটু দেখব?

কাকাবাবু ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন। লোকটি সত্যিই ডাক্তার, কাকাবাবুর নাড়ি টিপে ধরে দেখল। তারপর ব্লাড প্রেশার মাপল। খুশির সঙ্গে বলল, বাঃ, সব ঠিকঠাক আছে।

সবকটা জানলা বন্ধ, ভেতরে চড়া আলো জ্বলছে, এখন দিন কি রাত তা বোঝা যাচ্ছে না। তবু কাকাবাবু কোনও কৌতূহল প্রকাশ করলেন না।

একটু পরে পাশের একটা দরজা খুলে ঢুকলেন অংশুমান চৌধুরী। তাঁর মাথায় টুপি, হাতে একটা রুপো বাঁধানো ছড়ি। কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে তিনি কিছু বলতে যেতেই কাকাবাবু আগেই বললেন, কী খবর? ভাল?

অংশুমান চৌধুরী বেশ চমকে গেলেন। তিনি ভেবেছিলেন, কাকাবাবু নিশ্চয়ই রাগারাগি করবেন।

তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনি এখন ভাল বোধ করছেন তো?

কাকাবাবু বললেন, চমৎকার। এই ছেলেটি কফি আর বিস্কুট খাওয়াল। শুনলাম, একটানা সতেরো ঘণ্টা ঘুমিয়েছি, সেটাও বেশ ভাল ব্যাপার, অনেকদিন ভাল ঘুম হচ্ছিল না।

অংশুমান চৌধুরী কাকাবাবুর উলটো দিকের একটা বেঞ্চে বসে পড়ে বললেন, বাঃ, তা হলে কাজের কথা শুরু করা যাক।

কাকাবাবু দুহাত তুলে আড়মোড়া ভেঙে বললেন, থাক, এখন কাজের। কথাটথা থাক। আবহাওয়ার কথা বলুন! গরমটা বেশ কমে গেছে, কী বলুন!

অংশুমান চৌধুরী অট্টহাসি হেসে বললেন, আপনি মশাই বিচিত্র মানুষ। আপনার ওপর রাগ আছে আমার, অথচ আপনার কথা শুনে না হেসেও পারি না।

কাকাবাবু বললেন, আপনার ওপর একটুও রাগ নেই, কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার হাসি পায় না। আপনি বরং কিছু মজার কথা বলুন তো!

অংশুমান গম্ভীর হয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, একটা মজার কথা হচ্ছে এই যে, শেষ পর্যন্ত আমি আর আপনি একই সঙ্গে সম্বলপুর যাচ্ছি। আমাদের প্রতিযোগিতার খেলা এর মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, সম্বলপুর ভাল জায়গা। বেড়াবার পক্ষে ভাল জায়গা।

শুধু সম্বলপুর নয়, তারপর জঙ্গলেও যেতে হবে।

তাও মন্দ নয়, অনেকদিন জঙ্গলে যাওয়া হয়নি। আমি অনেকদিন ট্রেনে চাপিনি। বেশ ভালই লাগছে।

মিঃ রায়চৌধুরী, আমার মাথায় চুল নেই। আর কোনওদিন চুল গজাবে। কিন্তু আপনার মাথা ভর্তি চুল। আমি আপনার চুল দিয়ে বাজি ফেলেছি। এবারের খেলায় আপনি যদি হেরে যান তা হলে আপনার মাথা কামিয়ে ফেলতে হবে। তারপর আমি একটা আড়ক তৈরি করেছি। সেই .আড়ক মাখিয়ে দিলে আপনার মাথাতেও আর কখনও চুল গজাবে না।

বাজি ফেলেছেন? কার সঙ্গে বাজি ফেলেছেন? আমার মাথার চুল কামিয়ে ফেলতে হবে, অথচ আমি তার কিছুই জানলাম না?

বাজিটা আমি নিজের মনে মনেই ফেলেছি। আর আমি যদি হেরে যাই। তা হলে আমি নিজেও এর পর থেকে ক্রাচ নিয়ে হাঁটব। কোনওদিন আর দুপায়ে হাঁটব না।

কাকাবাবু এবারে মুচকি হেসে বললেন, এইটা আপনি একটা মজার কথা বলেছেন। হার-জিতের কথা আসছে কী করে? আমি আপনার সঙ্গে কোনও প্রতিযোগিতায় নামছিই না!

নামছেন না কী মশাই, প্রতিযোগিতা তো এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। আমরা কী আর এমনি এমনি সম্বলপুর যাচ্ছি?

কাকাবাবু বললেন, তা হলে আমি সম্বলপুরে যাচ্ছি না!

এর মধ্যে ট্রেনটার গতি কমে এসেছে। কোনও একটা স্টেশন আসছে। কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে ক্রাচ দুটো নিলেন। তারপর ডাক্তারটির দিকে ফিরে অনুরোধের সুরে বললেন, দরজাটা একটু খুলে দিন তো ভাই!

ডাক্তারটি তাকাল অংশুমান চৌধুরীর দিকে। অংশুমান চৌধুরীও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি কি নামতে চাইছেন নাকি? না, না এখানে আপনার নামা হবে না।

কাকাবাবু দরজার দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে বললেন, আপনি আমাকে ঘুমের ওষুধ ইঞ্জেকশান দিয়ে জোর করে এতটা পথ নিয়ে এসেছেন। এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ জন্য আমি আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারতুম। কিন্তু তা দিচ্ছি না। এবারেও আপনাকে ক্ষমা করছি। দয়া করে, আপনি আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।

অংশুমান রেগে উঠে বললেন, ক্ষমা? আপনি আমাকে ক্ষমা করবার কে? এবারে আপনার মাথা ন্যাড়া না করে আমি ছাড়ছি না।

অংশুমান এক পা এগোতেই কাকাবাবু ক্রাচ তুলে প্রচণ্ড জোরে মারলেন তাঁর হাতের লাঠিটায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারটির বুকে সেই ক্ৰাচটি ঠেকিয়ে বললেন, আমাকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না।

ডাক্তারটি অসহায়ভাবে বলল, না না। আমি আপনাকে বাধা দেব কেন? সেটা তো আমার কাজ নয়।

ট্রেন থেমে গেছে। কাকাবাবু দরজার হাতল ঘুরিয়ে বললেন, গুড বাই।

অংশুমান চৌধুরী বললেন, এখানে আপনি জোর করে নামতে চান নামুন। পরে আপনাকে আসতেই হবে সম্বলপুরে। আপনার ভাইপো সন্তু এতক্ষণে সম্বলপুরে পৌঁছে গেছে!