০১. দুপুরবেলা হঠাৎ কলেজ ছুটি হয়ে গেল

দুপুরবেলা হঠাৎ কলেজ ছুটি হয়ে গেল। একজন প্রোফেসর পদ্মশ্রী খেতাব পেয়েছেন, সেইজন্য। বাইরে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, কিছু ছেলেমেয়ে সেই বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল। সন্তু কলেজের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছে বৃষ্টিতে ভিজবে কি ভিজবে না, এই সময় তার বন্ধু জোজো তার পিঠে হাত দিয়ে বলল, চল সন্তু, কোথাও ট্রেনে করে ঘুরে আসি।

জোজো সন্তুদেরই পাড়ায় থাকে, প্রায়ই ওরা একসঙ্গে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরে। জোজো একেবারে গুল ঝাড়বার রাজা। ওর কথা শুনলে মনে হবে, পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় লোক ওর বাবা-মাকে চেনে। ফিডেল কাস্ত্রো ওদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে গেছেন, ইন্দিরা গান্ধী এক সময় ওদের মুর্শিদাবাদের বাড়িতে কিছুদিন লুকিয়ে ছিলেন, বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় জোজোর বাবাই তো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে টেলিফোন করে বলেছিলেন, খবদার, বঙ্গোপসাগরে সেভেনথ ফ্লিট পাঠাবেন না, তা হলে আপনার প্রেসিডেন্টগিরি ঘুচে যাবে! জোজোর বাবা শিবচন্দ্র সেনশর্মাকে সবাই এত মানে, কারণ তিনি একজন নামকরা জ্যোতিষী। এমনকী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারও নাকি আগের ইলেকশানের সময় ওর বাবার কাছ থেকে মন্ত্রপুত আংটি নিয়েছিলেন।

সন্তু জোজোর এই সব গল্প বিনা-প্রতিবাদে শুনে যায়। তার ভালই লাগে। জোজো সব সময় প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, সন্তুর কাকাবাবুর চেয়ে তার বাবা অনেক বেশি বিখ্যাত। সন্তুর কোনও অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী কাগজে বেরুলেই জোজো এসে বলবে, আরে তুই তো মোটে নেপালে গিয়েছিলি! বাবা আমাকে গত মাসে কোথায় নিয়ে গিয়েছিল জানিস? সাইবেরিয়ায়! কেন জানিস? না, সেটা বলা চলবে না, ভীষণ সিক্রেট, স্টেট সিক্রেট যাকে বলে, ফাঁস হয়ে গেলেই আমার ফাঁসি হবে।

জোজোর ট্রেনে করে ঘুরে আসার প্রস্তাব শুনে সন্তু বলল, কোথায় যাব? দিল্লি? বম্বে?

জোজো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ধুৎ, ওসব জায়গায় তো কতবার গেছি; নিউইয়র্ক, মস্কো, হেলসিংকি দেখার পর কি আর দিল্লি বম্বে ভাল লাগে? এই সব বৃষ্টির দিনে যেতে হয় কোনও নতুন জায়গায়; মনে কর, কোনও গ্রামের মধ্যে ছোট্ট একটা স্টেশান, চারদিকে সবুজ গাছপালা, একটা ছোট্ট নদী বয়ে যাচ্ছে। একটাই দোকান আছে সেই গ্রামে, সেই দোকানে বসে তেলেভাজা, মুড়ি আর চা খাওয়া কী রকম দারুণ না?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, শুনতে বেশ ভাল লাগল। কিন্তু ট্রেনে যে চাপব, পয়সা পাব কোথায়? পকেট তো ঢন্‌ঢন্‌!

জোজো এমনভাবে হাসল যেন সন্তুটা একেবারে ছেলেমানুষ, কিছুই বোঝে না! সে ঠোঁট উল্টে বলল, বেড়াতে আবার পয়সা লাগে নাকি? তুই আমার সঙ্গে আছিস না? শিয়ালদা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আমার আপন মামা, আর হাওড়ার স্টেশন-মাস্টার আমার পিসেমশাই। তুই ইন্ডিয়ার কোথায় যেতে চাস বল না! এক্ষুনি বিনা পয়সায় নিয়ে যেতে পারি।

সন্তু মিনমিন করে বলল, স্টেশন-মাস্টার আত্মীয় হলেই বুঝি ট্রেনে বিনা পয়সায় চাপা যায়; অন্য স্টেশনে ধরবে না?

জোজো বলল, তুই টেস্ট করে দেখতে চাস; চল, শিয়ালদায় চল, আমি তোকে হাতে-হাতে প্রমাণ করে দিচ্ছি। টিকিট চাইবে কী রে? আমাদের জন্য আলাদা কম্পার্টমেন্ট, স্যালুন কাকে বলে জানিস, তাই জুড়ে দেবে। আমরা যেখানে বলব সেখানে থামবে!

সন্তু বলল, ঠিক আছে, পরে কোনওদিন তোর সঙ্গে ওইভাবে বেড়াতে যাব, এখন বাড়ি চলি।

জোজো অবাক হয়ে ভুরু তুলে বলল, এর মধ্যে বাড়ি যাবি? আজ তো আমাদের সাড়ে চারটে পর্যন্ত ক্লাস হওয়ার কথা ছিল। এখন মোটে একটা দশ বাজে। এতখানি সময়, আমরা অনায়াসেই কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসতে পারি।

সন্তু বলল, এই কয়েক ঘন্টায় ট্রেনে চেপে কোথা থেকে ঘুরে আসব?

জোজো বলল, কেন, ডায়মন্ডহারবার, বনগাঁ, চন্দননগর, উলুবেড়িয়া, যে-কোনও জায়গায় যাওয়া যেতে পারে, ফিরতে বড়জোর সন্ধে হবে।

সন্তু ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছে, জোজোর পাল্লায় পড়া মোটেই বুদ্ধির কাজ হবে না। ডায়মন্ডহারবার বা ওই সব জায়গায় যেতে-আসতেই তিন চার ঘন্টা লেগে যাবে। বাড়িতে কোনও খবর না দিয়ে শুধু-শুধু এরকম ঘুরতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

জোজো হঠাৎ যেন কিছু একটা আবিষ্কার করার মতন আনন্দে চেঁচিয়ে উঠে বলল, সোনারপুর! মনে পড়েছে! দ্যা ইট! চল্ সোনারপুর ঘুরে আসি। তোকে সিংহ দেখাব!

সন্তু আর না হেসে পারল না। সোনারপুর জায়গাটার নাম সে শুনেছে, সে জায়গাটা আফ্রিকায় নয়, চব্বিশ পরগনায়। সেখানে সিংহ?

সন্তুর অবিশ্বাসী দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে জোজো বলল, তুই তো ইজিপ্টে গিয়ে উটের পিঠে চেপেছিস, তাই না, হাতির পিঠে চেপেছিস কখনও? বল, সত্যি করে বল?

সন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হল যে, সে কখনও হাতির পিঠে চাপেনি।

জোজো বলল, সোনারপুরে তোকে আমি হাতির পিঠে চাপাব। আমি তোর পাশেপাশে উটে চেপে যাব। সুন্দরবন পর্যন্ত ঘুরে আসব।

সোনারপুরে সিংহ শুধু নয়, উট, হাতি! উঃ সত্যি, জোজোকে নিয়ে আর পারা যায় না! গুলেরও তো একটা সীমা থাকা উচিত! সন্তু কাকাবাবুর সঙ্গে সুন্দরবন ঘুরে এসেছে, ওই সোনারপুরের পাশ দিয়েই যেতে হয়েছিল। সোনারপুর তো দূরের কথা, গোটা সুন্দরবনেই একটাও হাতি নেই। উট আর সিংহ থাকার কথা তো কল্পনাও করা যায় না!

এইসময় ওদের আর-এক বন্ধু অরিন্দম পেছন থেকে এসে বলল, এই, গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কী গ্যাঁজাল্লি করছিস; বাড়ি যাবি না? এর পর রাস্তায় জল জমে ট্রামবাস বন্ধ হয়ে যাবে!

সন্তু বলল, অরিন্দম, তুই সোনারপুর জায়গাটার নাম শুনেছিস?

অরিন্দম বলল, কেন শুনব না? এই তো শিয়ালদা লাইনে, বোধহয় চার পাঁচটা স্টেশন! আমি ওই স্টেশন দিয়ে পাস করেছি অনেকবার?

সোনারপুরে জঙ্গল আছে?

জঙ্গল? মানুষ থিকথিক করছে! ওই স্টেশন থেকে যতরাজ্যের তরকারিওয়ালারা ওঠে। তবে দু চারটে বাগানবাড়ি আছে শুনেছি।

জোজো বলছে, ওই সোনারপুরে নাকি বাঘ-সিংহ, হাতি-উট-গণ্ডার ঘুরে বোড়ায়!

অরিন্দম হা-হা করে হেসে উঠে বলল, ও জোজো, দিস ইস টু মাচ্! তুই সন্তুকে ভালমানুষ পেয়ে আর কত গুল ঝাড়বি? অ্যাঁ?

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, আমি বাঘ কিংবা গণ্ডারের কথা বলিনি। সন্তু বাড়াচ্ছে। কিন্তু যদি সিংহ দেখাতে পারি?

অরিন্দম বলল, আফ্রিকার কোনও রাজা বুঝি তোর বাবাকে সিংহ প্রেজেন্ট করেছে? তুই মাঝে-মাঝে সিংহ নিয়ে মর্নিং ওয়াক করতে যাস?

সন্তু বলল, শুধু সিংহ নয়, জোজো বলছে, সোনারপুরে গেলে ও আমাদের হাতি কিংবা উটের পিঠে চাপাতে পারে।

অরিন্দম বলল, জোজো, তুই শুধু-শুধু কেন এই পচা কলেজে পড়ে আছিস? তুই ওয়ার্ল্ড গুল কমপিটিশানে নাম দে। নিঘাত ফাস্ট হয়ে যাবি। তারপর গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে তোর নাম উঠে যাবে।

জোজো গম্ভীরভাবে ডান হাতের পাঞ্জাটা বাড়িয়ে বলল, কত বেট?

অরিন্দম বলল, কিসের বেট! তুই ওয়ার্ল্ড গুল কমপিটিশানে ফার্স্ট হবি কি? নিশ্চয়ই হবি।

জোজো বলল, সে কথা বলছি না। আমি যদি এখন থেকে ঠিক দুঘন্টার মধ্যে তোদের হাতির পিঠে চাপাতে পারি, তা হলে কতটাকা বাজি হারবি?

অরিন্দম জোজোর থুতনি ধরে নেড়ে দিয়ে বলল, আহা রে, চাঁদু! আমাদের বোকা পেয়েছিস? চিড়িয়াখানায় গেলেই তো হাতির পিঠে চাপা যায়।

জোজো মিটিমিটি হেসে বলল, চিড়িয়াখানায় নয়!

অরিন্দম বলল,তা হলে কোনও সাকাসের হাতি!

জোজো একইভাবে বলল, সাসেরও নয়।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আর উট আর সিংহ?

জোজো বলল, হ্যাঁ, সিংহ দেখাব। উটও দেখাব।

অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, তুই সার্কাসের জানোয়ার দেখিয়ে আমাদের ঠকাবি?

জোজো বলল, কোন সাকাসে সিংহ গাকে রে? তা ছাড়া বলছি তো, সাকাসের কোশ্চেনই উঠছে না।

অরিন্দম বলল, তুই এই সবগুলো একসঙ্গে আমাদের দেখাবি? তা হলে দশ টাকা বাজি!

জোজো বলল, ডান্! তা হলে চল, এক্ষুনি স্টার্ট করি।

বৃষ্টি বেশ জোর হয়েছে এখন। এর মধ্যে ট্রামে বাসে উঠতে গেলেও ভিজে যেতে হবে। তবু তিনজনে দৌড় লাগাল। বাস স্টপে এসেই পেয়ে গেল একটা শিয়ালদার বাস।

বাসে উঠে জোজো অরিন্দমকে বলল, তুই আমাদের তিনজনের টিকিটটা কেটে ফ্যাল তো!

অরিন্দম বলল, বাজির দশ টাকা থেকে এই বাসভাড়ার পয়সাগুলো কাটা যাবে।

সন্তু বলল, কাটা যাবে কী রে, যোগ হবে বল্। জিতব তো আমরাই। জোজো বলল, দ্যাখ না কী হয়! বাসে ভিড় বেশি নেই। ওরা আরাম করে বসল। সন্তু আর অরিন্দম পাশাপাশি, জোজো অন্য দিকে। এর মধ্যেই ওরা দুটো পার্টি হয়ে গেছে।

সন্তু আর অরিন্দম পরে আছে প্যান্ট আর শার্ট। জোজোর গায়ে একটা মেরুন রঙের গেঞ্জি, তাতে সাদা অক্ষরে লেখা ভিকট্রি।

ওই গেঞ্জিটা নাকি ব্রাজিল থেকে পেলে পাঠিয়েছে জোজোকে। জোজোর বাবার পাঠানো ফুল আর বেলপাতা পকেটে নিয়ে পেলে সব সময় খেলতে নামত।

জোজোর চেহারাটা সুন্দর, ওই গেঞ্জিটায় তাকে সুন্দর মানিয়েছে।

সন্তু ফিসফিস করে অরিন্দমকে বলল, আমরা তো যাচ্ছি ওর সঙ্গে কিন্তু জোজোর কাছ থেকে বাজির টাকা আদায় করতে পারবি?

অরিন্দম বলল; আমি ঠিক আদায় করে ছাড়ব। এর আগে তো কেউ জোজোর কথা চ্যালেঞ্জ করেনি।

জোজো তাকিয়ে থাকে জানলা দিয়ে। হঠাৎ সে একটা চলন্ত গাড়ি দেখে মুখ বাড়িয়ে হাসল, হাতছানি দিল।

তারপর বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে গেল জানিস?

অরিন্দম বলল, কী করে জানব?

হাসি-ঝলমলে মুখে জোজো বলল, কপিল দেব! আমার বাবার সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছে। জানতুম, আসতেই হবে। এবারে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে বাবার সঙ্গে দেখা করে যেতে ভুলে গেছে, তাই তো এই কাণ্ড!

অরিন্দম বলল, চুপ, একটু আস্তে বল। সবাই শুনতে পাবে।

জোজো বলল, তোরা বিশ্বাস করছিস না?

অরিন্দম বলল, আচ্ছা জোজো, তোর বাবা পরীক্ষায় পাশ করার কোনও মাদুলি-টাদুলি দ্যা?

জোজো সঙ্গে সঙ্গে বলল, না। ওইটা কক্ষনো দ্যান না। তা হলে আমিই তো সব পরীক্ষায় ফার্স্ট হতাম!

সন্তু মনে-মনে স্বীকার করল জোজোটার বুদ্ধি আছে। অরিন্দমের প্রশ্ন করার আসল উদ্দেশ্যটা ঠিক সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলেছে।

একটু বাদেই ওরা পৌঁছে গেল শিয়ালদায়। স্টেশনের মধ্যে ঢুকে অরিন্দম টিকিট কাউন্টারের দিকে এগোতে যাচ্ছে, সন্তু তার হাত টেনে ধরে বলল, ওদিকে যাচ্ছিস কী রে! আমাদের তো টিকিট লাগবে না। আমরা যাব স্পেশাল কম্পার্টমেন্টে!

জোজো বলল, চল, আগে বড় মামার সঙ্গে দেখা অরে আসি।

স্টেশন-মাস্টার লেখা একটা ঘরের সামনে এসে সে বন্ধুদের বলল, তোরা এখানে দাঁড়া, আমি এক্ষুনি ব্যবস্থা করে ফেলছি।

দরজার বাইরে একজন বেয়ারা বসে আছে টুলে। তাকে কিছু বলার সুযোগ দিয়েই জোজো দরজা ঠেলে গেল ভেতরে। বেয়ারাটি হা হা করে তেড়ে গেল তার পেছনে।

জোজো কিন্তু তক্ষুনি বেরিয়ে এল না। মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। তারপর বেরিয়ে এল হাসতে হাসতে।

সন্তু ভাবল, তা হলে সত্যিই কি জোজোর এত চেনাশুনো?

জোজো কাছে এসে বলল, একটা মজার ব্যাপার হয়েছে রে। আমার বড়মামাকে প্রাইম মিনিস্টার কী জন্য যেন ডেকেছেন। উনি তো দিল্লি চলে গেছেন কাল।

অরিন্দম বলল, তুই যখন দরজা ঠেলে ঢুকলি, তখন দেখলুম যে, ওদিকে চেয়ারে একজন বসে আছেন!

জোজো বলল, হ্যাঁ, উনি তো এখন অ্যাকটিং। ওঁকেও আমি খুব ভাল চিনি। উনি কী বললেন জানিস? আমাদের সোনারপুর যাওয়ার কথাটা উড়িয়েই দিলেন। উনি একটু বাদেই একটা ইনসপেকশানে দমদম যাবেন, আমাদেরও সেই সঙ্গে যেতে বললেন। যাবি দমদম?

অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, দমদমেও সিংহ আছে নাকি?

জোজো বলল, দমদম গেলে আমি তোদের ভাল চমচম খাওয়াতে পারি। একটা দোকানে চেনা আছে।

অরিন্দম বলল, কোথায় সিংহ আর কোথায় চমচম। আমি ভাই সিংহ দেখব বলে বাজি ফেলেছি।

সন্তু বলল, আমিও ভাই সিংহ দেখার জন্য এসেছি।

জোজো এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, তা হলে সোনারপুরেই যাওয়া যাক। এইটুকু তো মোটে রাস্তা, কতই বা টিকিটের দাম হবে। তোদের কাছে কত টাকা আছে রে?

সন্তু অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা অবশ্য বিনা পয়সায় ট্রেনে যাওয়া নিয়ে কোনও বাজি ফেলিনি।

অরিন্দম বলল, স্টেশন-মাস্টার প্রাইম মিনিস্টার না রেল-মিনিস্টার কার কাছে যারে, সে-বিষয়েও আমাদের তর্ক ভোলা উচিত নয়। সন্তু বলল, আমরা সোনারপুরে সিংহ দেখতে চাই। অরিন্দম বলল, দ্যাটস রাইট। তার সঙ্গে হাতি প্লাস উট। সন্তুর কাছে দুটাকা আছে। অরিন্দমের কাছে একটা পাঁচ টাকার নোট। জোজো বলল, দে, দে, ওতেই হয়ে যাবে।

অরিন্দম বলল, ফেরার ভাড়া রাখতে হবে।

জোজো বলল, ফেরার জন্য চিন্তা করিস না। ওখানে আমার ছোট মেলোমশাই থাকেন, তাঁর গাড়িতে ফিরে আসব।

বহু দূর দুর্গম জায়গা ঘুরে এলেও সন্তুর এই সামান্য দূরের একটা জায়গায় ট্রেনে করে যাওয়ার চিন্তায় বেশ উত্তেজনা হচ্ছে। দেখাই যাক না জোজোর গুলের দৌড় কতদূর যায়।

টিকিট কাটার পর প্ল্যাটফর্ম খুঁজে-খুঁজে ওরা সোনারপুর লোকাল দেখতে পেল। দুপুর বেলায় ট্রেন, একেবারে ফাঁকা।

ট্রেনটা ছাড়ার পর সবে মাত্র একটু দূর গেছে, এমন সময় জোজো জিভ কেটে বলে উঠল, এই রে, এতক্ষণে মনে পড়েছে! জায়গাটা তো সোনারপুর নয়। আমরা ভুল ট্রেনে চেপেছি। ট্রেনের একটা পাখা দারুণ শব্দ করে ঘুরছে। আর তিনটে পাখার জায়গায় কিছুই নেই। কামরার মেঝেতে অনেক মুড়ি ছড়ানো। কারুর হাত থেকে বোধহয় মুড়ির ঠোঙা পড়ে গিয়েছিল। সন্তু, জোজো আর অরিন্দম দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, যদিও বসবার জায়গা খালি আছে অনেক। বাইরে থেকে বৃষ্টির ছাঁট আসছে। খোঁচ-খোঁচা দাড়িওয়ালা একজন লোক বসে বসে শশা খাচ্ছে। সেই লোকটি বলল, আপনারা বসুন না, শুধু-শুধু ভিজছেন কেন?

জোজো বলল, আমরা ভুল ট্রেনে উঠে পড়েছি। আমরা যাব বারুইপুর, এটা তো সোনারপুরের ট্রেন।

সন্তু আর অরিন্দম চোখাচোখি করল। জোজোর চালাকি শুরু হয়ে গেছে। সিংহ-হাতি দেখাবার নাম করে কলা দেখাবে। এতক্ষণ সোনারপুর বলছিল, এবারে বারুইপুর হয়ে গেল। এরপর সিংহ হয়ে যাবে বেড়াল আর হাতি হয়ে যাবে ছাগল।

দাড়িওয়ালা লোকটি বলল, বারুইপুর যাবেন? তার জন্য কি ট্রেন থেকে লাফিয়ে নেমে পড়তে হবে নাকি? বসুন, এ ট্রেনেও যাওয়া যাবে।

ওরা তিনজনে এবারে এসে বসল।

সন্তু ভাবল, ওই দাড়িওয়ালা লোকটি নিশ্চয়ই এদিকেই থাকে। সোনারপুরের সিংহ-হাতির কথা জিজ্ঞেস করলে, ও নিশ্চয়ই বলতে পারবে?

সন্তু তবু কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে আবার ভাবল, থাক। ট্রেনে যখন উঠে পড়াই গেছে, তখন শেষ পর্যন্ত দেখাই যাক না কী হয়!

দাড়িওয়ালা লোকটি আবার জিজ্ঞেস করল, আপনারা বারুইপুরে কোথায় যাবেন?

জোজো বলল, অংশুমান চৌধুরীর বাড়ি, আপনি চেনেন? ওয়ার্ল্ড ফেমাস, সায়েন্টিস্ট।

লোকটি দুদিকে মাথা নেড়ে জানাল যে, চেনে না।

সন্তু আবার তাকাল অরিন্দমের দিকে। বারুইপুরে শুধু সিংহই থাকে না, বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিকরাও থাকে! জোজোর স্টকে আরও কত কী আছে!

জোজো ওদের দিকে ফিরে বলল, তোদের আগে এই অংশুমান চৌধুরীর কথা বলিনি, না? আমার পিসেমশাই হন। উনি কী করেছেন জানিস? সাইবেরিয়াতে বরফের তলায় সাত ফুট খুঁড়ে কয়েকটা গমের দানা পাওয়া গিয়েছিল। তার মানে, ওখানে গমের খেত ছিল, কোনও এক সময় বরফে চাপা পড়ে গিয়েছিল। ওই গমের দানাগুলো দশ হাজার বছরের পুরনো।

অরিন্দম জিজ্ঞেস করুল, কী করে জানল, ওই গমের দানাগুলো, অত বয়েস?

জোজো বলল, ওসব টেস্ট করে বলে দেওয়া যায়। মাটির তলা থেকে যে কয়লা তোলা হয়, তাও টেস্ট করে বলা যায় কতদিনের পুরনো।

সন্তু মাথা নাড়ল। এটা জোজো বানিয়ে বলছে না। কাকাবাবুর কাছ থেকে সেও কার্বন টেস্টের কথা শুনেছে।

সে জোজোকে জিজ্ঞেস করল, তোর পিসেমশাই ওই গমের দানাগুলো সাইবেরিয়া থেকে খুঁড়ে বার করেছেন?

জোজো বলল, না, উনি খুঁড়ে বার করেননি। তা করেছে ওখানকার লোকোই। পিসেমশাই সাঙ্ঘাতিক একটা কাণ্ড করেছে। উনি ওই দশ হাজার বছরের পুরনো গমের দানা মাটিতে পুঁতে গাছ তৈরি করেছেন। সেই গাছে আবার গম ফলেছে।

অরিন্দম বলল, তাতে কী হয়েছে?

জোজো বলল, তুই বুঝতে পারছিস না? কত বড় ব্যাপার! দশ হাজার বছরের পুরনো গম থেকে আবার গাছ হল!

অরিন্দম বলল, ধুস! এটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। পুঁতেছে, তা থেকে আপনা আপনি গাছ হয়েছে। এতে তোর পিসেমশাইয়ের কৃতিত্বটা কী? তিনি কি ফুঁ দিয়ে দিয়ে গাছটা বড় করেছেন!

জোজো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, তুই এসব বুঝবি না!

দাড়িওয়ালা লোকটি বলল, ধান চাষের চেয়ে গমের চাষ অনেক সহজ।

অরিন্দম বলল, জোজো, তোর ওই পিসেমশাই আর কী কী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার করেছেন শুনি?

জোজো বলল, তোরা অ্যামির ধূমকেতুর নাম শুনেছিস?

অরিন্দম বলল, সেটা আবার কী, হ্যালির ধূমকেতুর ছোট ভাই নাকি?

জোজো বলল, ঠিক তাই। তবে ছোট ভাই না বলে বড় ভাই বলতে পারিস। এই ধূমকেতুটা পৃথিবীতে ফিরে আসবে দুশো বছর অন্তর অন্তর। আমার পিসেমশাই এটা আবিষ্কার করেছেন। দেখিসনি সব কাগজেই তো খবরটা বেরিয়েছিল!

জোজো সন্তুর দিকে সরু চোখে তাকাল। অর্থাৎ সে বুঝিয়ে দিতে চায়, শুধু তার বাবা নয়, তার পিসেমশাইও সন্তুর কাকাবাবুর চেয়ে অনেক বেশি বিখ্যাত।

অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, ওই ধূমকেতুটার নাম অ্যামি কেন?

জোজো বলল, পিসেমশাইয়ের নাম অংশুমান, মানে এ. এম.। তার থেকে অ্যামি।

অরিন্দম বলল, নামটা একটু অদ্ভুত শোনাচ্ছে। নাম দেওয়া উচিত ছিল চৌধুরীজ কমেট। যাক গে! উনি আর কী আবিষ্কার করেছেন?

জোজো বলল, এরকম অনেক আছে

অরিন্দম বলল, উনি আকাশে ধূমকেতু আবিষ্কার করছেন। আবার বরফের তলা থেকে গমের দানা বার করছেন। প্রফেসর শঙ্কু নাকি?

জোজো বলল, প্রফেসর শঙ্কু তো ফিকটিশাস্ ক্যারেকটার। আমার পিসেমশাইকে বারুইপুরে গেলেই দেখতে পাবি।

উনি বুঝি সিংহের পিঠে চেপে রোজ হাওয়া খেতে যান?

সিংহের সঙ্গে ওঁর কোনও সম্পর্কই নেই। উনি জন্তু-জানোয়ার একদম পছন্দ করেন না। এমনকী, বেড়াল দেখলেও ভয় পান। একবার কী হয়েছিল জানিস? পিসেমশাইকে কেনিয়া থেকে ডেকেছেন খুব জরুরি কাজে। উনি যেতে রাজি হলেন না। কারণ, নাইরোবি শহরে যখন-তখন সিংহের গন্ধ পাওয়া যায়।

সন্তু, তুই কাকাবাবুর সঙ্গে একবার নাইরোবি গিয়েছিলি না?

সন্তু মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, দুবছর আগে। কী হয়েছিল রে সেখানে?

সন্তু বলল, এখন আমার সেটা বলতে ইচ্ছে করছে না। জোজো একবার প্রশান্ত মহাসাগরের কোন্ দ্বীপে গিয়েছিল ওর বাবার সঙ্গে, সেই গল্পটা বরং শোনা যাক।

ট্রেন এসে থেমেছে বালিগঞ্জ স্টেশনে।

জোজো জানলায় মুখ রেখে বলল, দ্যাখ এদিকে বৃষ্টি নেই। একটু বাদাম কেন না, অরিন্দম। বেশ খিদে পেয়ে গেছে।

ট্রেন থামা মাত্রই ছেড়ে দেয় বলতে গেলে। অরিন্দম একটা বাচ্চা বাদামওয়ালাকে ডাকতেই সে লাফিয়ে কামরায় উঠে পড়ল।

সন্তু বলল, এদের কী মজা তাই না? টিকিট কাটতে হয় না, যখন যে-ট্রেনে ইচ্ছে উঠে পড়ে, যে-কোনও স্টেশনে নেমে পড়ে।

অরিন্দম বলল, আমারও ইচ্ছে করে এরকম ট্রেনে-ট্রেনে ঘুরে বেড়াতে। কলেজের পড়া ছেড়ে দিয়ে বাদাম বিক্রির কাজ নিলে কেমন হয়?

সন্তু বলল, তাতে তোর একটা ক্ষতি হবে এই যে, তুই জোজোর গল্পগুলো শুনতে পাবি না।

অরিন্দম বলল, সেটা একটা বড় ক্ষতি।

জোজো বলল, আমি গল্প বলি না, আমি যা বলি সব সত্যি।

তিন ঠোঙা বাদাম কেনা হল। এই স্টেশনে ওদেরই বয়েসি আর কয়েকটি ছেলে উঠে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শুরু করে দিল খেলার আলোচনা।,সন্তুদের আর গল্প জমল না। ওরাও শুনতে লাগল সেই গল্প।

সন্তুর শুধু ভয় হতে লাগল, এই ছেলেগুলোর সামনে জোজো যদি হঠাৎ বলে বসে যে, সুনীল গাভাসকার যে-বার ব্রাডম্যানের চেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করল সেবারে সে ওর বাবার কাছ থেকে মাদুলি নিতে এসেছিল, কিংবা কপিলদেব এখন ওদের বাড়িতে গিয়ে বসে আছে, তা হলে এরা কি শুধু হাসবে না চাঁটি মারতে শুরু করবে।

জোজো অবশ্য মুখ খুলল না। সে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে। তার চোখ বোজা।

অরিন্দম একটু পরে তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, এই জোজো, ঘুমিয়ে পড়লি নাকি?

জোজো যেন মুখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, না রে, আমি কক্ষনো দিনের বেলা ঘুমোই না। তবে মাঝে-মাঝে চোখ বুজে একটু ধ্যান করে নিই।

ধ্যান করিস? কেন?

তোরা ধ্যান করার উপকারিতা তো জানিস না। মাঝে-মাঝে করে দেখলে পারিস। ঠিকমতন ধ্যান করা শিখলে চোখ বুজে ভবিষ্যতের অনেক জিনিস দেখতে পাওয়া যায়।

মহা ঋষি মহেশ যোগী তোর কাকা না মামা কী যেন?

তুই অনেকটা ঠিক ধরেছিস। মহেশ যোগী আমার জ্যাঠামশাইয়ের গুরু-ভাই। আমার জ্যাঠামশাই-ই মহেশ যোগীকে সব কিছু শিখিয়েছেন।

তোর জ্যাঠামশাই কোথায় থাকেন?

গত কুড়ি বছর ধরে আমার জ্যাঠামশাইকে দেখতে পাওয়া যায়নি। উনি মহেশ যোগীকে সব কিছু শিখিয়ে দিয়ে হিমালয়ের আরও গভীরে চলে গেছেন। শুনেছি, উনি এভারেস্টের ঠিক নীচেই থাকেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কে যেন বলেছিল, তোর জ্যাঠামশাই দুটো ইয়েতি পুষেছিলেন। লোকে যেমন বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর পোযে, সে রকম তোর জ্যাঠামশাইও তাঁর গুহা পাহারা দেওয়ার জন্য দুটো ইয়েতিকে রেখেছিলেন। সন্তু, তুই শুনিসনি?

জোজো এমনভাবে একটা অবজ্ঞার হাসি দিল, যেন অরিন্দম নিছক একটি শিশু। তারপর বলল, তুই আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিস? ইয়েতি বলে আবার কিছু আছে নাকি? সন্তু ওর কাকাবাবুর সঙ্গে একবার নেপাল থেকে কোথায় যেন গিয়েছিল, তারপর ফিরে এসে ইয়েতি সম্পর্কে গাঁজাখুরি গল্প রটিয়েছিল। আমার জ্যাঠামণি কোনওদিন ইয়েতি দেখেননি!

সন্তু বলল, বারুইপুরে যদি আমরা সিংহ, হাতি, উট দেখতে পাই, তা হলে সেটা হবে ইয়েতি দেখার চেয়েও আশ্চর্য ব্যাপার।

জোজো বলল, বাজি তো ধরাই আছে, আর একটুখানি ধৈর্য ধরে থাক!

অরিন্দম বলল, ওর পিসেমশাইকেও দেখে আসতে হবে।

গড়িয়া স্টেশনে এক সঙ্গে অনেকে নেমে গেল। দাড়িওয়ালা লোকটি এখন একটা খবরের কাগজ পড়ছে। বাইরের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এদিকটায় আজ এক ফোঁটাও বৃষ্টি হয়নি। মাটি একেবারে শুকনো।

সন্তু জানলা দিয়ে দেখছে বাইরের দৃশ্য। জোজো আর অরিন্দম কী কথা বলছে সে আর শুনছে না মন দিয়ে। সিংহ দেখা যাক বা না যাক, ট্রেনে করে এই যে হঠাৎ খানিকটা ভ্রমণ হল, তাই-ই বা মন্দ কী! সন্তুর বেশ ভালই লাগছে।

লাইন সারানো হচ্ছে বলে এখান দিয়ে ট্রেন যাচ্ছে আস্তে আস্তে। দুদিকেই। ফাঁকা মাঠ, একদিকে ট্রেনের লাইন ঘেঁষে একটা সরু রাস্তা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে একসময় সন্তু চমকে উঠল।

মুখ ফিরিয়ে সে দেখল, জোজো আর অরিন্দম যেন কী নিয়ে তর্কে মেতে উঠেছে। সন্তু জোজোর গায়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, তুই কি বারুইপুরে আমাদের ভাল্লুক দেখাবার কথাও বলেছিলি?

জোজো মাথা নেড়ে গম্ভীরভাবে বলল, না, তা বলিনি। ওখানে ভালুক নেই।

সন্তু জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আছে। তুই জানিস না। ওই দ্যাখ ভালুক! সবাই ছুটে এসে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল। কিন্তু অরিন্দম বা জোজো কিছুই। দেখতে পেল না। জোজো তো ধরেই নিয়েছে যে, সন্তু মিথ্যে কথা বলেছে। তাদের চমকে দেওয়ার জন্য, অরিন্দম অবশ্য সন্তুকে অবিশ্বাস করে না। সন্তু একেবারে বাজে কথা বলবে না। ওরা দুজনেই বলতে লাগল, কই? কই? ট্রেনটা এত আস্তে যাচ্ছে যে চলছে কি না বোঝাই যাচ্ছে না। লাইনের ধারে ধারে কাজ করছে কয়েকজন লোক। ঝাঁঝাঁ করছে রোদ। এর মধ্যে একটা ভাল্লুক দেখতে পাওয়ার চিন্তাটাই অসম্ভব বলে মনে হয়।

সন্তু বলল, দেখতে পাচ্ছিস না? ওই যে বড় গাছটার নীচে…ভাল করে চেয়ে দ্যাখ!

দৃশ্যটা অতি সুন্দর। একটা ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছের গোড়ায় বসে আছে। একজন আধবুড়ো নোক, তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে একটা ভাল্লুক। ভাল্লুকটার গায়ের রোঁয়া উঠে গেছে খাল্লা-খালা। লোকটার এক হাতে ড়ুগড়ুগি, আর এক হাতে সে ভাল্লুকটার মাথা চাপড়ে দিচ্ছে, ঠিক যেন ঘুম পাড়াচ্ছে।

বোঝাই যায় যে, এই লোকটা নাচের খেলা দেখায়। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তাই গাছতলায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তা ছাড়া এই দুপুরের রোদ্দুরে কেইবা ভাল্লুক-নাচ দেখবে।

জোজো বলল, ধুস্‌, এটা একটা ঘেয়ো মার্কা ভাল্লুক! তুই এমন চমকে দিয়েছিলি, সন্তু!

অরিন্দম বলল, তুই বুঝি বারুইপুরে আমাদের তাগড়া তাগড়া জোয়ান সিংহ দেখাবি? যদি শেষ পর্যন্ত দেখাতে পারিস তো দেখব সার্কাসের একটা হাড়-জিরজিরে সিংহ!

জোজো বলল, কতবার বলছি না, সার্কাসের নয়! সাকাসে বাঘ কিংবা হাতি থাকে, কিন্তু কোনও সাকাসে সিংহের খেলা দেখেছিস? ওরা সিংহ পাবে কোথায়। সিংহ কি আর গাছে ফলে!

সন্তু বলল, বারুইপুরের গাছে সিংহ ফলে নিশ্চয়!

অরিন্দম বলল, একী, ট্রেনটা যে একেবারে থেমে গেল।

সত্যিই থেমে গেছে। কামরায় অন্য যে সব ছেলেরা একটু আগে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে খেলার আলোচনা করছিল, এখন তারা সবাই চোখ বুজে ঘুমোচ্ছে। ওদের অভ্যেস আছে। ওরা নিশ্চয়ই জানে যে, প্রতিদিন এখানে ট্রেন থেমে যায়।

জোজো বলল, এই রে, ট্রেন এইভাবে টিকটিকিয়ে চললে যে বাড়ি ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তোরা তো কেউ বাড়িতে কিছু বলে আসিসনি!

সন্তু বলল, সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরতেই হবে।

অরিন্দম বলল, তা হলে আর কী হবে, চল ট্রেন থেকে নেমে উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করি। এখন থেকে হাঁটলে সন্ধের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে যাব নিশ্চয়ই। আজ আর সিংহটিংহ দেখার দরকার নেই। কী রে, সন্তু তাই করবি?

জোজো বলল, তোরা যদি হাঁটতে চাস, আমার আপত্তি নেই। আমি একবার চার ঘন্টায় তিরিশ মাইল হেঁটে গিয়েছিলাম?

অরিন্দম হো-হো করে হেসে উঠে সন্তুকে বলল, দেখলি, দেখলি! জোজো জানত এ লাইনের ট্রেন বেশি দূর এগোয় না। সিংহ-টিংহ সব ফক্কা!

জোজোও হেসে উঠল একই রকমভাবে।

অন্য যাত্রীরা দু একজন ঢুলুঢুলু চোখে তাকাল ওদের দিকে। এরা এরকম পাগলের মতন হাসছে কেন?

ট্রেনটা হঠাৎ আবার চলতে শুরু করে দিল। জোজো হাসি বন্ধ না করেই বলল, তা হলে আমাদের ফেরা হচ্ছে না!

এক সময় ওরা পৌঁছে গেল বারুইপুর স্টেশনে। জোজোর মুখে কিন্তু কোনও উদ্বেগের ছায়া নেই। এবার যে তার জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। তার জন্যও ভয় নেই ওর।

ওদের মধ্যে শুধু অরিন্দমের হাতেই ঘড়ি আছে। জোজো বলল, কটা বাজে দ্যাখ তো।

অরিন্দম বলল, দুটো পনেরো! জোজো বলল, ওঃ, ঢের সময় আছে। আমরা ঠিক সময়েই বাড়ি ফিরে যেতে পারব। ভয় নেই, তোদের হেঁটে যেতে হবে না।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে জোজো বলল, দুটো রিকশা নিতে হবে। সন্তু আর অরিন্দম একটা রিকশায় ওঠ, আমি আর একটাতে উঠছি।

নিজের রিকশায় উঠে জোজো বেশ জোরে জোরে বলল, যে বাড়িতে সিংহ আছে সেই বাড়িতে চলো তো?

রিকশাওয়ালার চোখ বড় বড় হল না, মুখ হাঁ হল না, সে কোনও প্রতিবাদ করল না। ঘাড় নেড়ে প্যাডেলে চাপ দিল।

সন্তু আর অরিন্দমেরই বিস্ময়ে চোখ গোল গোল হয়ে গেল। তা হলে এখানে সত্যিই সিংহ আছে নাকি? বাড়িতে পোষা সিংহ?

সাইকেল রিকশা চলতে লাগল অনেক রাস্তা ঘুরে ঘুরে। তারপর আমাদের আগেকার আমলের মতো মস্ত বড় একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে থামল। জোজো আগের রিকশা থেকে নেমে মুখ ঘুরিয়ে ওদের জিজ্ঞেস করল, গন্ধ পাচ্ছিস?

সত্যিই বাতাসে একটা জন্তু জন্তু গন্ধ ভাসছে।

লোহার গেট পেরিয়ে এক পাশে একটা বেশ উঁচু ঘর। তার সামনেটা লোহার গরাদ দিয়ে ঘেরা। তার ভেতরে তাকাবার আগেই ওরা শুনতে পেল সিংহের চাপা গর্জন।

ভেতরে রয়েছে একখানা তাগড়া, জ্যান্ত সিংহ। মোটেই রোগা, হাড়-জিরজিরে নয়, সোনালি রঙের গা, মাথাভর্তি কেশর।

সন্তু আর অরিন্দম বিস্ময়ে কিংবা লজ্জায় কথাই বলতে পারছে না।

একটু বাদে অরিন্দম বলল, জোজোর মুখে সত্যি কথা? বাজি হেরে গেছি, তা স্বীকার করছি। কিন্তু এখনও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। হ্যাঁ রে, জোজো, এটা কি ম্যাজিক নাকি?

জোজো বলল, ঠিক ধরেছিস! এটা কার বাড়ি জানিস? এটাকে ম্যাজিকের বাড়ি বলতে পারসি। এটা পি. সি. সরকার জুনিয়ারের বাড়ি, তিনিই এই সিংহটা পুষেছেন।

সিংহ পুষেছেন? এখানে তিনি সিংহ পেলেন কোথায়?

আফ্রিকার কোনও রাজা কিংবা প্রেসিডেন্ট ওঁকে একটা বাচ্চা সিংহ প্রেজেন্ট করেছিলেন, সেটাকেই তিনি খাইয়ে-দাইয়ে এত বড় করেছেন।

উনি ম্যাজিকে এই সিংহটা অদৃশ্য করে দিতে পারেন?

ওঁর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। এইবার চল, তোদের হাতি আর উট দেখাব! সাইকেল রিকশা দুটোকে সেই জন্য ছাড়িনি।

থাক, আর কিছু দেখবার দরকার নেই।

না, না, না, তোদের দেখতেই হবে। তোরা আমার কথা অবিশ্বাস করেছিলি। ভেবেছিলি জোজো সব সময় গুল মারে, তাই না?

সন্তু ভাবল, জোজো আসলে খুব চালাক ছেলে। সবাই ওর কথা অবিশ্বাস করে বলে, মাঝে-মাঝে জোজো দুএকটা অদ্ভুত ধরনের সত্যি কথা বলে সবাইকে চমকে দেয়। এখন জোজোর কাছে বাজি হেরে যাওয়ার পর ওরা যদি শোনে যে, জোজো ওর বাবার সঙ্গে একবার মঙ্গল গ্রহ ঘুরে এসেছে, তাহলে কি চট করে উড়িতে দিতে পারবে?

গেট থেকে বেরিয়ে জোজো বলল, এর আগেরবার যখন এই সিংহটা দেখতে আসি, তখন কী হয়েছিল জানিস?

অরিন্দম বলল, সিংহটা খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসেছিল আর তুই খালি হাতে ওকে পোষ মানিয়েছিলি? তা হতে পারে, হতে পারে, আমি তোকে আর অবিশ্বাস করছি না রে, জোজো।

জোজো পাতলা হেসে বলল, না, সে রকম কিছু হয়নি। তোর যত সব অদ্ভুত ধারণা! সেবার আমরা বাবার সঙ্গে এসেছিলুম। আমার বাবা তো সব জীবজন্তুর ভাষা জানেন। বাবা এই সিংহটার সঙ্গে এক ঘন্টা আলাপ করে আফ্রিকা সম্পর্কে অনেক নতুন খবর জেনে নিয়েছিলেন।

সন্তু হাসি চাপতে পারল না। জোজো এখন যা ইচ্ছে বলে যাবে। প্রতিবাদ করার উপায় নেই। সে তবু বলল, তোর বাবা সিংহের সঙ্গে কীভাবে কথা বললেন? হালুম হালুম করে?

জোজো বলল, তুই একটা ইডিয়েট! জন্তু-জানোয়ারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে চ্যাঁচামেচি করতে হয় না। মনে মনে বলতে হয়, অবশ্য ভাষাটা জানতে হয়।

সন্তু হার স্বীকার করে বলল, ও!

অরিন্দম বলল, সেবারে আর কী হয়েছিল?

জোজো বলল, আর বিশেষ কিছু হয়নি। চল, হাতি দেখতে যাবি চল!

খানিক দূরের আর একটা ঘরে রয়েছে একটা হাতি। দুটি পা লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা। হাতিটা তখন মনের আনন্দে একটা কলাগাছ খাচ্ছে।

জোজো বলল, এটার পিঠে চাপবি?

সন্তু আর অরিন্দম দুজনেই একই সঙ্গে বলে উঠল, না, না, দরকার নেই।

জোজো বলল, কোনও অসুবিধে নেই। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ভয়েরও কিছু নেই।

সন্তু আর অরিন্দম দুজনে আবার জোর দিয়ে না বলল।

জোজো বলল, হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আগের বার আর-একটা কাণ্ড হয়েছিল। আগের বার ভুলে এই হাতিটার পিঠে চেপেই আমার পিসেমাইয়ের বাড়ি চলে গিয়েছিলুম। তার ফলে গুলি খেয়ে মরছিলুম আর একটু হলে!

সন্তু বলল, কেন? কে গুলি করতে এসেছিল?

বাঃ, তোদের বলিনি যে আমার পিসেমশাই জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারেন না! ওঁর বাড়িতে গোরু-ছাগল ঢোকে না, উনি কুকুর পোষেন না। বেড়াল নেই, ইঁদুর নেই, এমনকী আরশোলাও নেই।

অরিন্দম বলল, আরশোলাও নেই সে বাড়িতে?

হ্যাঁ, আরশোলাও নেই, সত্যি!

তা হলে তো দারুণ কাণ্ড করেছেন বলতে হবে। আরশোলা তাড়ানো কি সোজা কথা; শুনেছি অ্যাটমবোমায় পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও আরশোলারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না!

আমার পিসেশমাই একটা যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন, তার ভাইব্রেশানে আরশোলা-পোকামাকড়ও সব মরে যায়।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তোর পিসেশমাই তোকে দেখতে পেয়েও গুলি করতে এসেছিলেন?

জোজো বলল, হয়তো আমাকে চিনতে পারেননি। আমি হাতির পিঠে চেপে ও বাড়ির গেটের দিকে এগোচ্ছি। এমন সময় শুনতে পেলুম ছাদের ওপর থেকে উনি চেঁচিয়ে বলছেন, আর এক পা এগোলে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব গুলি করে। আসলে অবশ্য কথাটা উনি নিজে বলেননি। ছাদে একটা ইলেকট্রনিক যন্ত্র ফিট করা আছে। কেউ কোনও জীব-জন্তু নিয়ে ওই বাড়ির এক শো গজের মধ্যে এলেই ওই যন্ত্র থেকে আপনি আপনি ওই রকম ভয়-দেখানোর কথা বেরিয়ে আসে।

সন্তু উৎসাহের সঙ্গে বলল, চল, তোর পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।

জোজো বলল, এখনও যে উট দেখা বাকি আছে? সন্তু অরিন্দম আর উট দেখতে রাজি নয়। তারা বাজিতে হেরে গেছে। তারা এখন অংশুমান চৌধুরীকে দেখতে চায়।

জোজো বলল, চল তা হলে।

বাড়িটা আধখানা নতুন, আধখানা পুরনো। পুরনো বাড়িটার মাঝখান দিয়েই নতুন একটা দোতলা বাড়ি উঠেছে, সেই বাড়িটার রং হলদে, আর পুরনো অংশটার দেওয়ালে শ্যাওলা জমে আছে। সেদিককার দেওয়াল ফাটিয়ে উঠেছে একটা বেশ তেজি অশখ গাছ। গাছটা বাড়ির ছাদটার কাছে ছাতার মতন হয়ে আছে। বাড়ির ছাদে টিভি অ্যান্টেনা ছাড়া আরও যন্ত্রপাতি রয়েছে।

বাড়ির লোহার গেটটা মস্ত বড়, কিন্তু মর্চে-ধরা। ওপরের দিকে বশাবশা করা ছিল, তার মধ্যে ভেঙে গেছে কয়েকটা। গেটটা আধখানা খোলা, কাছাকাছি কেউ নেই। ভেতরে দেখা যায় খানিকটা বাগানের মতন, সেখানে একটা নাদুস-নুদুস চেহারার গোরু আপন মনে ঘাস খাচ্ছে।

অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁরে, তোর পিসেমশাইয়ের বাড়িতে ঢুকতে গেলে কী আগে থেকে খবর দিতে হয়? ছাদ থেকে কেউ গুলি টুলি করবে না তো!

জোজো একটু ফ্যাকাসে ভাবে হেসে বলল, না, না, আমার নিজের পিসেমশাইয়ের বাড়ি। আমি যখন খুশি যেতে পারি। তবে, কথা হচ্ছে…

জোজো থেমে যেতেই অরিন্দম বলল, তবে মানে?

সে ভয়ে-ভয়ে ছাদের দিকে তাকাল।

জোজো বলল, আমি ভাবছি লোহার গেটটা ইলেট্রিফায়েড ছিল। হাত দিলে যদি শক্ মারে?

সন্তু ভেতর-দিকটা দেখেছিল। সে বলল, এই জোজো, তুই যে বললি তোর পিসেমশাই কোনও জন্তু-জানোয়ার পছন্দ করেন না, বাড়িতে গোরু-ছাগল ঢোকে না? ওই যে দেখছি একটা গোরু?

জোজো বলল, তাই তো।

সন্তু বলল, এটাকে তো বাইরের গোরু মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে পোষা!

অরিন্দম বলল, হ্যাঁরে, এটা ঠিক তোর পিসেমশাইয়ের বাড়ি তো? ভুল করে অন্য বাড়িতে আসিসনি?

জোজো বলল, বাঃ, আমার পিসেমশাইয়ের বাড়ি আমি চিনব না? কতবার এসেছি! হ্যাঁ, গোরুটার কথা মনে পড়েছে। তবে প্রত্যেকদিন সকালে এই গোরুটাকে কার্বলিক অ্যাসিড মাখিয়ে চান করানো হয়।

সন্তু বলল, তারপর বোধহয় পাউডারও মাখানো হয়। দেখছিস না ওর গাটা কেমন ধপধপ করছে!

জোজো চেঁচিয়ে ডেকে উঠল, কেষ্ট! কেষ্ট!

কয়েকবার এই রকম ডাকার পর বাড়ির ভেতরের দরজা খুলে একজন মাঝ বয়েসি মহিলা মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কে?

জোজো বলল, কেষ্ট আছে?

মহিলাটি এবারে বেরিয়ে এলেন। লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা, হাতে একটা কাটারি।

তিনি বললেন, কেষ্ট আবার কে? ও নামে তো কেউ এখানে থাকে না!

সন্তু আর অরিন্দম তাকাল জোজোর দিকে। জোজো বলল, এখানে বাগানের যে মালি ছিল..

মহিলাটি বললেন, বলছি তো কেষ্ট বলে কেউ নেই! জোজো বলল, তা হলে বোধ হয় ওর নাম বিটু! এখানে কেষ্ট-বিষ্ণু কেউ থাকে না! ওঃ হো, মনে পড়েছে। তার নাম ভোলানাথ!

তুমি কি বাছা এখানে সব ঠাকুর-দেবতার নাম করতে এসেছ? ওই নামেও কেউ নেই।

অরিন্দম ফিসফিস করে সন্তুকে বলল, আর দরকার নেই, চল, ফিরে যাই!

সন্তুও মাথা নাড়ল।

অরিন্দম জোজোর পিঠে হাত দিতেই জোজো হো-হো করে হেসে উঠে হাত দিয়ে ঠেলে খুলে ফেলল লোহার গেটটা। তারপর ভেতরে ঢুকে বলল, শিবুর মা, আমায় চিনতে পারছ না। আমি জোজো! পিসেমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি!

মহিলাটির ভুরু কোঁচকানো ছিল, আস্তে আস্তে তা সোজা হয়ে গেল। তারপর মুখে হাসি ফুটল। তিনি বললেন, ওমা, জোজো! তাই তো, চিনতেই পারিনি, তোমার যে একটু-একটু গোঁপ উঠে গেছে! তারপর ওখানে দাঁড়িয়ে কী সব কেষ্ট-বিষ্ণুর নাম বলছিলে?

জোজো বন্ধুদের দিকে ফিরে বলল, আয়!

তারপর সে মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করল, পিসেমশাই আছেন তো?

মহিলা বললেন, হ্যাঁ, আছেন। তবে ঘুমোচ্ছেন। রাত্তিরে তো ঘুমোন না, দুপুরে এই সময়টা ঘুমিয়ে নেন। তোমরা ওপরে গিয়ে বোসো গে!

সন্তু অরিন্দমের দিকে তাকাল। জোজো আজ আগাগোড়াই নতুন কায়দা দেখাচ্ছে। সে এমনভাবে কথা বলছে যেন সন্তুআর অরিন্দম অবিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। তারপর সবগুলোই মিলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করে সে কেষ্ট আর বিষ্ণুর নাম বলছিল।

বাড়ির ভেতর দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সেখানে টানা একটা বারান্দার মাঝখানে একটা দরজা। সেই দরজা খুলে একটা ছাদ দেখা গেল, সেটা পুরনো বাড়ির অংশ। এই ছাদের ওপরেও ছাতা মেলে আছে অশখ গাছটা।

জোজো তার বন্ধুদের নিয়ে এল সেই ছাদে। সেখানে কয়েকটা বেতের চেয়ার ছড়ানো রয়েছে। আজ কলকাতায় বৃষ্টি হলেও এখানে বৃষ্টির কোনও চিহ্ন নেই।

জোজো বলল, ব্যাস, আর কোনও চিন্তা নেই। পিসেমশাই আমাদের ফেরার ব্যবস্থা করে দেবেন। যদি একটু দেরিও হয়, সন্তু বাড়িতে খবর দিয়ে দেওয়া যাবে টেলিফোনে!

সন্তু ছাদের এক পাশের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দেওয়ালের মুখোমুখি সেঁটে রয়েছে দুটি বেশ তাগড়া চেহারার টিকটিকি। জোজো বলেছিল, ওর পিসেমশাই কোনও পোকামাকড়ও সহ্য করতে পারেন না, এ বাড়িতে আরশোলাও নেই। তা হলে টিকটিকি রয়েছে কেন? অবশ্য টিকটিকি বাইরে থেকে চলে আসতে পারে। কিন্তু পোকামাকড় না থাকলে টিকটিকি আসবে কেন?

অশত্থ গাছটার ডালেও কিচির-মিচির করছে অনেক পাখি। জোজোর পিসেমশাই পাখি অপছন্দ করলেও কোনও উপায় নেই, আকাশ দিয়ে পাখির ওড়াওড়ি তো তিনি আটকাতে পারবেন না।

জোজো বলল, ওই যে শিবুর মাকে দেখলি, উনি নারকেল-কোরা, মুড়ি আর চিনি দিয়ে একটা চমৎকার খাবার তৈরি করেন। একটু বলে আসি, তোদের খিদে পায়নি?

অরিন্দম বলল, খুব! শুধু মুড়ি-নারকেল কেন, আর কিছু পাওয়া যাবে না?

জোজো বলল, দেখছি!

জোজো নীচে নেমে চলে গেল। সন্তু আর অরিন্দম চেয়ারে না বসে দাঁড়াল এসে পাঁচিলের পাশে।

অরিন্দম বলল, সন্তু, দেখছিস তো, আজ জোজো তোকে খুব ডাউন দিয়ে দিচ্ছে। যা যা বলছে সব মিলে যাচ্ছে।

সন্তু বলল, জোজোটার সত্যি খুব বুদ্ধি আছে। আমি ভাবছি, ওর পিসেমশাই মানুষটি কেমন হবেন! শুনলাম তো, রাত্তিরে ঘুমোন না, দুপুরে ঘুমোন।

অরিন্দম বলল, বৈজ্ঞানিকরা এইরকম হয়! একটু পাগল না হলে বোধহয় বৈজ্ঞানিক হওয়া যায় না। আইনস্টাইন নাকি অন্য লোককে জিজ্ঞেস করতেন, আমি কি খেয়েছি? আর নিউটন একটা খাঁচায় দুটো পাখি পুষে খাঁচাটার দুটো দরজা বানিয়েছিলেন। বড় দরজা বড় পাখিটার জন্য, আর ছোট পাখিটার জন্য একটা ছোট দরজা!

সন্তু হেসে উঠল।

অরিন্দম বলল, ওর পিসেমশাইয়ের গাড়ি আছে বলল জোজো। গাড়িটা কোথায়? দেখছি না তো?

জোজো তক্ষুনি ফিরে এসে বলল, আসছে, অনেক রকম খাবার আসছে। প্রথমে আসছে ডাবের জল। আয়, চেয়ারে বসি।

বেতের চেয়ারগুলোতে বসবার পর সন্তু আবার দেওয়ালটার দিকে তাকাল। টিকটিকি দুটো তখনও এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে। অদ্ভুত প্রাণী এই টিকটিকি, সারাদিনে যে কতটুকু নড়াচড়া করে তার ঠিক নেই। দুটো টিকটিকি

পরস্পরের দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে কী দেখছে!

হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। টিকটিকি দুটো টপটপ করে দেওয়াল থেকে খসে পড়ে গেল মাটিতে। সন্তু অবাক হয়ে গেল। টিকটিকি তো এমনি-এমনি পড়ে যায় না। নীচে পড়ে গিয়েও ওরা নড়ছে না।

সন্তু চেয়ার ছেড়ে গিয়ে আরও অবাক হয়ে গেল। টিকটিকি দুটো উল্টো পড়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায়, ওদুটো মরে গেছে।

সন্তু চেঁচিয়ে বলল, দ্যাখ, দ্যাখ!

ওরা দুজনও উঠে এল সন্তুর কাছে। সন্তু বলল, দ্যাখ, দ্যাখ, এই টিকটিকি দুটো হঠাৎ এমনি এমনি মরে গেল।

জোজো বলল, টিকটিকি? এ বাড়ির দেওয়ালে? ও, বুঝেছি, তা হলে পিসেমশাই জেগে উঠেছেন?