০৫. চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে

চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে, বিল্টু বাড়িতে নেই। এরকম আগে কখনও হয়নি। কাল রাত থেকে এ বাড়ির কেউ কিছু খায়নি, কেউ শুতেও যায়নি। শুধু শেষ রাতে বসে বসেই ঘুমে চোখ তুলে এসেছিল।

পুলিশে খবর দেওয়ার কোনও উপায় নেই। অন্য কাউকে কিছু জানানো চলবে না। পাশের বাড়ির মেয়ে দুটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, বিল্টুর খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। সে আছে তার মামাবাড়িতে।

রান্না করে দেওয়ার জন্য এক রান্নামাসি আসে রোজ সকালে। আজ তাকে ছুটি করে দেওয়া হয়েছে। কখন কোন কথা সে শুনে ফেলবে, তারপর বাইরে গিয়ে বলে দেবে, তাই দরকার নেই। সেইজন্য রান্নাও বন্ধ। বাড়িতে পাঊরুটি আছে, ফ্রিজে আছে ডাল। দুপুরের দিকে স্নিগ্ধা ডাল গরম করে এনে সকলকে জোর করে একটু একটু খাওয়াল। অমিতাভ আর সিদ্ধার্থ অনবরত আলোচনা করে যাচ্ছে, কোথা থেকে টাকা জোগাড় করা যাবে। টাকা দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

মাঝে মাঝেই ফোন বেজে উঠছে। প্রতিদিনই তো কত ফোন আসে। আজ ফোন বাজলেই সকলে প্রথমে ভয়ে কেঁপে উঠছে! ওরা আবার কী বলবে কে জানে!

এ পর্যন্ত সবই অন্য লোকদের ফোন। কারও সঙ্গেই বেশি কথা বলা হচ্ছে। না।

রিঙ্কুমাসি প্রত্যেকদিন দুপুরবেলা জয়ন্তীর সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেন, অন্তত চল্লিশ মিনিট। আজ জয়ন্তী দু-চারটি কথা বলেই বললেন, দিদি, আজ আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তোমাকে আমি পরে ফোন করব। হ্যাঁ, আমরা সকলে ভাল আছি।

ফোনটা খালি রাখতে হবে। কখন ওদের ফোন আসবে ঠিক নেই।

 

সেই ফোন এল সন্ধেবেলা। গম্ভীর গলা শুনেই সিদ্ধার্থ ফোনটা দিয়ে দিল অমিতাভকে।

গম্ভীর গলা জিজ্ঞেস করল, কে কথা বলছেন?

অমিতাভ বললেন, আমি বিল্টুর বাবা।

লোকটি বলল, গুড! হেড অফ দ্য ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলা দরকার। টাকার কথাটা আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই।

অমিতাভ বললেন, আগে বলুন, আমার ছেলে কেমন আছে?

লোকটা বলল, কী যেন নাম ছেলেটার? গেরুয়া ধ্বজা?

অমিতাভ বললেন, নীলধ্বজ।

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, এত শক্ত নাম রাখেন কেন?

অমিতাভ বললেন, ওর একটা ডাকনামও আছে।

লোকটি বলল, যতবার ওকে জিজ্ঞেস করি, তোর ডাকনাম কী, ততবার বলে কুশগাজি!

অমিতাভ বললেন, কুশগাজি? সে আবার কী, ওর নাম নীলধ্বজ। অচেনা লোক ওর ডাকনাম ধরে ডাকলেও ও উত্তর দেয় না। কাল থেকে ও কিছু খেয়েছে?

লোকটি বলল, টোস্ট খেয়েছে। আলুভাজা খেয়েছে। একটা চকোলেট দেওয়া হয়েছিল, সেটা খায়নি, নিতেই চায়নি।

অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, রাতে ঘুমিয়েছে? লোকটি আবার ধমক দিয়ে বলল, ঘুমোবে না কেন? সব ছোট ছেলেই রাত্তিরে ঘুমোয়। একবারও কান্নাকাটি করেনি।

অমিতাভ বললেন, ও সহজে কাঁদে না, তা আমরা জানি।

লোকটি বলল, এসব বাজে কথা থাক। আমার বেশি সময় নেই। এবার কাজের কথা হোক। টাকার জোগাড় হয়েছে?

অমিতাভ কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, অত টাকা এত তাড়াতাড়ি কী করে জোগাড় করব বলুন তো? আমি তো ব্যবসায়ী নই, একটা মোটামুটি চাকরি করি।

লোকটি বলল, সকলেই প্রথমে এই কথা বলে। আরে মশাই, টাকা ছাড়া কি পৃথিবী চলে? আপনি কী করেন, তা আমরা ভালই জানি। সব খোঁজ নিয়েছি। লোকে আপনাকে ধার দেবে। শুনুন, ঠিক তিনদিন সময়। টাকা ভরতি সুটকেস নিয়ে একজন মাত্র লোক যাবে। ঠিক কটার সময় আর কোথায়, তা পরশুদিন বলে দেব।

অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, মাত্র তিনদিন? তার মধ্যে যদি পুরো টাকাটা জোগাড় করতে না পারি?

লোকটি জোরে ধমক দিয়ে বলল, আবার ওই কথা? এক পয়সাও কমাব না। আপনার ছেলেকে ফেরত চান কি চান না, বলুন?

অমিতাভ অমনই ব্যস্ত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই ফেরত চাই। তার যেন কোনও ক্ষতি না হয়।

লোকটি বলল, ও ছেলেকে এখনই আরব দেশে বিক্রি করে দিলে অনেক বেশি দাম পাব। উটের দৌড়ের জন্য ওরা ছোট ছেলে চায়। তবে আমরা বাবা-মাকেই প্রথম অফার দিই। সেইজন্যই আর তিনদিন সময় দিয়েছি। দেরি হলে ও ছেলেকে আর জীবনেও দেখতে পাবেন না!

অমিতাভ বললেন, না, না, না, আমি চেষ্টা করছি। লোকটি বলল, তাই করুন। আপনারা পুলিশে খবর দেননি, তা আমরা জানি। কিন্তু ওই খোঁড়া লোকটা, রাজা রায়চৌধুরী, তাকে খবর দেননি তো?

অমিতাভ বললেন, না, তিনি কিছুই জানেন না।

লোকটি বলল, গুড! ও লোকটার সব কিছুতে মাথা গলানো অভ্যেস। এবার মাথা গলাতে এলে ওর মাথাটাও কেটে ফেলব আর আপনার ছেলেরও! ঠিক আছে, পরশুদিন আবার কথা হবে!

ফোনটা রেখে দিয়ে অমিতাভ অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আর মোটে তিনদিন সময় দিয়েছে।

সিদ্ধার্থ বলল, যেভাবেই হোক টাকাটা জোগাড় করতেই হবে। আপনার মনে নেই, গত বছর একটা কোম্পানির বড়সাহেব একদিন মর্নিংওয়ার্কে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে তাকে কয়েকজন কিডন্যাপ করে। ঠিক এইরকমই, পুলিশে খবর দিতে ভয় দেখানো হয়েছিল। ওঁর বাড়ির লোক মোটা টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ভদ্রলোককে উদ্ধার করেন। তারপর পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ কয়েকজনকে ধরেছে, কিছু টাকাও ফেরত পাওয়া গিয়েছে। আমাদেরও সেরকম করতে হবে।

অমিতাভ হতাশভাবে বললেন, আগে টাকা চাই! অত টাকা!

রিনি বলল, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। ডাক্তার সুপ্রিয় রায় নামে আগে যে একজন ফোন করেছিল, বিন্দুকে একটু পরেই ফেরত দেওয়ার কথা বলেছিল, সে কোথায় গেল?

জয়ন্তী বললেন, সে ধাপ্পা দিয়েছে!

রিনি বলল, কিন্তু সে বিল্টুর কথা জানে। কোন স্কুলে পড়ে তাও জানে।

সিদ্ধার্থ বলল, সে লোকটাও ওদেরই দলের। তোমাকে ফোন করে ওই কথা বলেছিল কেন জানো? যাতে তোমরা আগেই পুলিশে খবর না দাও। ততক্ষণে বিন্দুকে ওরা অনেক দূরে সরিয়ে ফেলেছে।

অমিতাভ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বদমাইশের দল! আমি এখন বেরোচ্ছি। দেখি, কোথায় কোথায় টাকা পাওয়া যায়!