০৪. জয়ন্তী কাঁদতে শুরু করলেন

জয়ন্তী কাঁদতে শুরু করলেন।

রিনি বলল, মা, তুমি ঠিক দশ মিনিট কাদতে পারো। তারপর আর কাঁদবে না। বাবার সামনে একদম কান্নাকাটি করবে না।

সিদ্ধার্থ বলল, এখন কান্নাকাটি করলে আমরা ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারব না।

স্নিগ্ধা বলল, এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। বিল্টু! তাকে অন্য লোক ধরে রেখেছে! খবরের কাগজে এরকম ঘটনা প্রায়ই পড়ি, কিন্তু আমাদের বাড়িতে…

সিদ্ধার্থ বলল, লোকটায় কী আস্পর্ধা! বলে কিনা ব্যাবসার ব্যাপার। আগে ছিল ছেলেধরা, রাস্তা থেকে ছোট ছেলেদের ধরে নিয়ে পালাত। তারপর শুরু হল অ্যাবডাকশন।

রিনি বলল, অপহরণ আর মুক্তিপণ।

সিদ্ধার্থ বলল, আর এখন একেবারে খোলাখুলি ছেলে বিক্রির ব্যাবসা! আগে বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাইবে, বাবা-মা টাকা দিতে না পারলে বাইরে বিক্রি করে দেবে!

স্নিগ্ধা বলল, পুলিশ কিছুই করতে পারে না?

সিদ্ধার্থ বলল, ওই যে পুলিশে খবর দিলেই মেরে ফেলার ভয় দেখায়।

সেই ভয়েই বাবা-মায়েরা পুলিশের কাছে যায় না।

স্নিগ্ধা বলল, দু-একটা বাচ্চাকে তো সত্যি সত্যি মেরেও ফেলে। কাগজে যে বেরোল, গত সপ্তাহেই সোনারপুরে…

রিনি বলল, আঃ দিদি, ওসব কথা এখন ছাড়ো… সে মায়ের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করল।

জয়ন্তী কান্না থামিয়ে উভ্রান্তের মতো বললেন, কুড়ি লাখ টাকা আমরা কোথায় পাব? অত টাকা দিতে না পারলে…আমার সব গয়না বিক্রি করে দেব, তাতে কত টাকা হবে?

স্নিগ্ধা বলল, আমার গয়নাও সব বিক্রি করে দেব মা।

সিদ্ধার্থ বলল, গয়না বিক্রি করেও হবে না। আরও অনেক টাকা লাগবে।

রিনি বলল, এখন তো বাবাকে ফোন করতেই হয়।

সিদ্ধার্থ বলল, হ্যাঁ কর। তবে সবটা বলার দরকার নেই। শুধু জিজ্ঞেস কর, উনি কখন ফিরবেন। আর বলতে পারিস, মায়ের একটু শরীর খারাপ হয়েছে। কিংবা বলতে পারিস, আমরা এসেছি।

ফোন করতেই অমিতাভ বললেন, এই তো আমি বেরোচ্ছি। আমার কাজ হয়ে গিয়েছে। কিছু খাবারটাবার নিয়ে আসব। বিল্টু চাইনিজ খেতে চেয়েছিল।

রিনি বলল, না, বাবা, খাবার আনতে হবে না। আজ বাড়িতে অনেক রান্না হয়েছে।

অমিতাভ জিজ্ঞেস করলেন, বিন্দু কী করছে? পড়ছে না ছবি আঁকছে?

রিনি বলল, বিল্টু, ইয়ে এই একটুখানির জন্য পাশের বাড়ি গিয়েছে!

ফোনটা রেখে দিয়েই রিনি ওড়না দিয়ে চোখ চাপা দিল।

স্নিগ্ধা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, এবার তুই কাঁদছিস? মনটাকে শক্ত কর।

ওড়নাটা সরিয়ে রিনি ধরা গলায় বলল, বাবার কাছে আমি কখনও মিথ্যে কথা বলি না।

সিদ্ধার্থ বলল, এক কাজ কর, রিনি। ওই টেপটা চালা তো! কথাগুলো আর-একবার শুনি।

রেকর্ডিং বেশ পরিষ্কার হয়েছে। টেলিফোনের লোকটার গলা স্পষ্ট বোঝা যায়।

সবটা শোনার পর সিদ্ধার্থ ভুরু কুঁচকে বলল, জানিস রিনি, লোকটা যখন এইসব ভয় দেখাচ্ছে, তখন আমি মনে মনে ভাবছিলাম, এখনই কাকাবাবুকে খবর দিতে হবে। কাকাবাবু ঠিক একটা কিছু উপায় বের করবেন। তখনই লোকটা যেন ঠিক আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বলল, রাজা রায়চৌধুরীকে খবর দেওয়া চলবে না! ভাব তো ব্যাপারটা, এরকম একটা কাণ্ড হচ্ছে, অথচ কাকাবাবুর সঙ্গে আলোচনাও করতে পারব না?

রিনি বলল, আমরা কাকাবাবুকে কোনও খবর দেব না। কিন্তু উনি নিজেই যদি জেনে যান!

স্নিগ্ধা জিজ্ঞেস করল, নিজে থেকে কী করে জেনে যাবেন?

রিনি বলল, সন্তু এ পাড়ায় প্রায়ই আসে। ওর বন্ধু জোজোর বাড়ি তো পাশের রাস্তায়। যদি কালই এসে পড়ে সন্তু? জোজোকে সঙ্গে নিয়েও আসতে পারে। তখন নিশ্চয়ই বিলুকে দেখতে চাইবে! কাল শনিবার, বিল্টুর স্কুল ছুটি। তখন সন্তুকে আমরা কী বলব?

সিদ্ধার্থ বলল, সন্তু বুদ্ধিমান ছেলে। আমাদের ব্যবহার দেখেই বুঝে যাবে যে, কিছু গন্ডগোল হয়েছে।

রিনি বলল, প্রাইজ নিতে বিল্টুর দিল্লি যাওয়ার কথা। কাকাবাবু বলেছিলেন, তিনিও ঠিক ওই সময় কী-একটা কাজে দিল্লি যাবেন। কাকাবাবু বির সঙ্গে একই প্লেনে যেতে চান।

সিদ্ধার্থ বলল, সন্তু বুঝে যাক কিংবা কাকাবাবু জেনে যান, যাই-ই হোক, তখন কাকাবাবুকে স্পষ্ট বলে দিতে হবে, তিনি যেন কোনওক্রমেই এর মধ্যে মাথা না গলান। আগে বিন্দুকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

জয়ন্তী বললেন, স্কুল থেকে ফিরলেই বিল্টুর খিদে পায়। আজ এখনও কিছু খায়নি।

রিনি বলল, ওরা নিশ্চয়ই খেতে দিয়েছে।

জয়ন্তী এবার রক্তচক্ষে বললেন, ওরা খেতে দেবে? ওরা অমানুষ! শয়তান! একটা ছোট ছেলেকে তার মার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যায়!

এবার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হল।

অমিতাভ উপরে এসে দেখলেন, বসার ঘরের মেঝেতে সকলে বসে আছে। সকলে একসঙ্গে তাকাল তার দিকে।

কোটটা খুলতে খুলতে অমিতাভ বললেন, খুব আড্ডা হচ্ছে বুঝি তোমাদের? বিল্টু এখনও ফেরেনি পাশের বাড়ি থেকে?

সিদ্ধার্থ অমিতাভকে স্যার বলে ডাকে। কারণ, অমিতাভ একসময় সিদ্ধার্থদের কলেজে পড়াতেন। সিদ্ধার্থ বলল, স্যার, আপনি আগে বসুন।

আপনার সঙ্গে আমার একটা জরুরি কথা আছে। আপনি কি চা খাবেন?

অমিতাভ ভুরু কুঁচকে বললেন, না, চা খাব না। জরুরি কথা? কী বলো তো?

রিনি তাড়াতাড়ি এক গেলাস জল এনে দিল বাবার হাতে।

সিদ্ধার্থ বলল, আমার কিছু টাকা দরকার।

অমিতাভ আবার বললেন, টাকার দরকার? কেন ব্যাবসা ট্যাবসা করবে নাকি? কত টাকা?

সিদ্ধার্থ বলল, বেশ কিছু টাকা। অন্তত কুড়ি লাখ!

অমিতাভ এবার হেসে ফেললেন। জলের গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? কুড়ি লাখ টাকা তো আমাকে বিক্রি করলেও পাওয়া যাবে না! গতমাসেই বাড়িটা সারালাম, হাতে প্রায় কিছুই নেই। বড়জোর এক-দেড় লাখ টাকা দিতে পারি।

রিনি বলল, বাবা, কুড়ি লাখ টাকা জোগাড় করতেই হবে।

এবার অমিতাভ বেশ অবাক হলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে রিনির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুই আবার টাকার কথা কী বলছিস? কী ব্যাপার বল তো?

রিনি বলল, বাবা, আমি একটা টেপ শোনাচ্ছি। আগে মন দিয়ে শোনো।

সে টেপটা চালিয়ে দিল।

অমিতাভ একটুখানি শুনেই বললেন, এটা কী? কোনও নাটক নাকি? এটা এখন শুনতে হবে কেন?

সিদ্ধার্থ বলল, স্যার, একটু শুনুন প্লিজ। প্লিজ।

এবার শুনতে শুনতে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। টেপটা শেষ হতেই তিনি গর্জন করে বলে উঠলেন, কী, বিন্দুকে এরা ধরে রেখেছে? এরা কোন রাস্কেলের দল? আমি এখনই পুলিশ কমিশনারকে ফোন করব। পুলিশ দিয়েই ওদের শায়েস্তা করতে হবে।

জয়ন্তী বললেন, না, না, আগে পুলিশ না, পুলিশ না। আগে বিল্টুকে বাঁচাতে হবে। তারপর ওদের শাস্তি। এখন যেমন করে থোক, টাকা জোগাড় করতেই হবে।

অমিতাভ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সকলের মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন। আপন মনে বললেন, অত টাকা…বিল্টু…এখন আমি কী করব? এক মিনিট সকলে চুপ।

তারপর জয়ন্তী বললেন, আমাদের সব গয়না বিক্রি করে দেব। তা ছাড়া ব্যাঙ্কে যা আছে, অফিস থেকে যা পাও, আর বাকিটা ধার করতে হবে।

অমিতাভ বললেন, কে টাকা ধার দেবে? সিদ্ধার্থ বলল, অনেক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ধার পাওয়া যায় শুনেছি।

অমিতাভ রিনিকে বললেন, কাগজ-কলম নিয়ে আয়, হিসেব করে দেখি।

এই সময় ফোন বেজে উঠল।

স্নিগ্ধা ফোনটা ধরেই বলল, হ্যালো। তারপরই বলল, আপনি এক মিনিট ধরুন, ফোনে হাত চাপা দিয়ে সে ফিসফিস করে বলল, কাকাবাবু! কাকাবাবু!

সকলে পাথরের মূর্তির মতো চুপ করে চেয়ে রইল।

কাকাবাবু নিজে থেকে সাধারণত ফোন করেন না। কখনও তার ফোন এলে সকলেরই কত আনন্দ হয়। আজ ভয় হচ্ছে।

সিদ্ধার্থ বলল, কথা বলো। কতক্ষণ ধরে থাকবেন উনি, কিছু একটা বলে দাও!

স্নিগ্ধার কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে রিনি বলল, হ্যালো কাকাবাবু, কেমন আছ তুমি?

কাকাবাবু বললেন, ভাল আছি। ফোনটা কে ধরেছিল রে?

রিনি বলল, আমার দিদি। তোমার গলা চিনতে পারেনি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বি কোথায় রে? আমি একটু ওর সঙ্গে কথা বলব।

রিনি বলল, বিল্টু? ইয়ে, ও তো পাশের বাড়িতে..ওকে ডাকতে

পাঠিয়েছি। কখন আসবে কে জানে?

কাকাবাবু বললেন, ও তো দেখছি পাশের বাড়িতেই বেশি সময় থাকে!

রিনি বলল, পাশের বাড়ির একটি মেয়ে তো বিল্টুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। সে-ও ছবি আঁকে। বিল্টু তাই…

কাকাবাবু বললেন, বির দিল্লি যাওয়া কবে ঠিক হল?

রিনি বলল, এখনও দিন ঠিক হয়নি। খুব সম্ভবত সামনের সপ্তাহে, দিল্লি থেকে টিকিট পাঠাবে।

কাকাবাবু বললেন, তারিখটা আমার জানা দরকার। আমিও সেদিন দিল্লি যাব। আর শোন, বিন্দুকে আমি একটা মাউথ অর্গান উপহার দেব বলেছিলাম। সেটা আমি কিনে ফেলেছি। সেটা আমি বিন্দুকে নিজের হাতে দিতে চাই। কাল সকালে আমি বেরোব, কাল আমি তোদের বাড়ি যাব।

রিনি চেঁচিয়ে বলে উঠল, কাল সকালে? না, না, কাকাবাবু, কাল সকালে এসো না।

ঘরের সকলে একেবারে চুপ, যেন নিশ্বাস ফেলতেও ভুলে গিয়েছে। সকলে তাকিয়ে আছে ফোনটার দিকে।

কাকাবাবু কিছু বলার আগেই রিনি গলার আওয়াজ বদলে ফেলে বলল, মানে, কাকাবাবু বলছি কী, কাল সকালবেলা আমরা সকলে মিলে চিড়িয়াখানায় যাচ্ছি তো, তাই তোমাকে আসতে বারণ করলাম।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, বিকেলবেলা যাব।

রিনি বলল, বিকেলবেলা, মানে, দুপুরে তো দিদির বাড়ি নেমন্তন্ন, কখন ফিরব ঠিক নেই। আমি তোমাকে ফোন করব।

কাকাবাবু কী বুঝলেন, কে জানে! আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলেন।

রিনি দুহাত জোড় করে বলল, কাকাবাবু, আমাকে ক্ষমা করো। এত মিথ্যে কথা আমি জীবনে বলিনি। কিন্তু…

তার দুচোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে!