০৭. গর্তে পড়ে যাওয়ার পর

গর্তে পড়ে যাওয়ার পর সন্তু আর জোজো দুজনেই প্রথমটা হকচকিয়ে গেল।

সন্তু বলল, এটা কী ব্যাপার হল রে জোজো?

জোজো বলল, উঃ উঃ, আমার খুব লেগেছে। আমার পা ভেঙে গেছে বোধহয়!

সন্তু বলল, যাঃ, তোর যখন-তখন পা ভাঙে। এখানে তো নরম মাটি দেখছি। আমার কিছু হয়নি।

জোজো বলল, পা ভাঙেনি বোধহয়। কিন্তু কীসে যেন খোঁচা লাগল, সাপে কামড়াল নাকি?

সন্তু বলল, সাপ আবার কোথায়? এখানে কিছু নেই। সাপ থাকলে ফেঁসফোসানি শোনা যেত!

জোজো বলল, ওই দুষ্টু মেয়েটা আমাদের ইচ্ছে করে এখানে ফেলে দিয়েছে। ও নিশ্চয়ই শত্রুদের দলের।

সন্তু বলল, শত্রু আবার কে? আমরা কি কারও কোনও ক্ষতি করেছি?

জোজো বলল, এখন কী হবে? আমরা এই গর্তের মধ্যে না খেয়ে মরব।

সন্তু বলল, দাড়া না, দেখা যাক কী করা যায়।

গর্তটার দেওয়ালে হাত বোলাতে বোলাতে সন্তু খাঁজ কাটা দিকটা পেয়ে গেল। সেদিকটা ধরে ধরে একটুখানি উঠে সন্তু বলল, এই তো উপরে ওঠার ব্যবস্থা আছে। চলে আয় জোজো।

জোজো বলল, তুই এদিকে আয়। এখানে বেরোনোর রাস্তা।

সন্তু সেখানে এসে দেখল, দেওয়ালের একটা অংশ ফাঁকা। সেখান দিয়ে একটা গোল সুড়ঙ্গের মতন দেখা যাচ্ছে।

সন্তু বলল, ওদিকে একটা দিকে দেওয়াল ধরে ধরে খাঁজে পা দিয়ে উপরে ওঠা। এদিকটায় ভিতরের দিকে যাওয়া যেতে পারে। কোন দিকে যাবি?

জোজো বলল, চল, উপরে উঠে যাই। এখানে বেশিক্ষণ থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসবে।

সন্তু বলল, আমার কিন্তু ইচ্ছে করছে, এই ভিতরের দিকটায় কী আছে দেখে আসি।

জোজো বলল, কী দরকার ওসব ঝঞ্ঝাট করে? অচেনা সুড়ঙ্গ টুড়ঙ্গের মধ্যে না যাওয়াই ভাল।

সন্তু বলল, রবীন্দ্রনাথের একটা গান আছে: অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে/ অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে…।

জোজো বলল, ওসব গানের মধ্যে শুনতেই ভাল লাগে। যদি ওই সুড়ঙ্গটার মধ্যে অজগর সাপ থাকে?

সন্তু ততক্ষণে সুড়ঙ্গটার মধ্যে মাথা গলাতে গলাতে বলল, অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, আমি আমি খাব পেড়ে। যেখানে সেখানে মোটেই অজগর সাপ থাকে না।

জোজো বলল, আমার ইচ্ছে করছে, এক্ষুনি উপরে উঠে গিয়ে ওই দুষ্টু মেয়েটার চুল টেনে দিতে।

সন্তু বলল, সে তো পরেও করা যেতে পারে। আগে এদিকটা দেখে নিই। আয়, ভিতরে চলে আয়।

সুড়ঙ্গটা বেশ সরু, দুদিকের দেওয়ালে হাত দিয়ে, মাথা নিচু করে কোনওরকমে একজন একজন করে এগোতে পারে।

কয়েক পা এগোনোর পর সন্তু বলল, এই সুড়ঙ্গটা কীসের বুঝতে পারছিস? আজ দুপুরে একটা পুকুর পাড়ের ভাঙা বাড়িতে যে সুড়ঙ্গটা দেখেছিলাম, বোধহয় সেইরকম।

কমলিকাদের বাড়ি থেকে এটা একটা পালানোর রাস্তা। কিংবা একসময় ওই ভাঙা দুৰ্গটা থেকেও এই পথে ও-বাড়িতে যাওয়া যেত।

জোজো বলল, তার মানে, তুই বলছিস, এইভাবে যেতে যেতে আমরা কমলিকাদের বাড়ির একতলায় পৌঁছে যাব? উঃ, উঃ!

সন্তু বলল, কী হল?

জোজো বলল, মাথা ঠুকে গেল! এত কষ্ট করে যাওয়ার দরকার কী রে সন্তু? উপর দিয়েই তো সোজা যাওয়া যেত।

সন্তু বলল, আমাদের ধারণাটা ঠিক কি না, তা মিলিয়ে দেখতে হবে না? আমার আরও একটা কথা মনে হচ্ছে। একটু আগে আমরা যে চোখ-বোজা সাধুবাবাকে দেখলাম, আজ একেবারে চোখ-খোলা, পোশাকও অন্যরকম, সে এই সুড়ঙ্গ থেকেই ওপাশে বেরিয়েছে?

জোজো বলল, হ্যাঁ, ওকে আচমকা দেখা গিয়েছিল, যেন মাটি খুঁড়ে উঠল, ওরকম ফিলিং হয়েছিল। কিন্তু এই বিচ্ছিরি সুড়ঙ্গে সাধুবাবা কী করবে? তপস্যা করবে?

সন্তু বলল, কিছু চুরি করার মতলব থাকতে পারে। সাধু সেজে অনেকে পাকা চোরও তো হয়। ওর হাতে একটা হাতুড়ি ছিল লক্ষ করিসনি?

জোজো বলল, হ্যাঁ, দেখেছি তো হাতুড়িটা। বলল, বাঘ মারার জন্য সঙ্গে রেখেছে। হাতুড়ি দিয়ে কেউ বাঘ মারতে পারে, এমন কথা জন্মে শুনিনি। মনে হয়েছিল, ঠাট্টা করছে আমাদের সঙ্গে। কিন্তু সন্তু, তোর ধারণা যদি সত্যিও হয়, তা হলেও সাধুবেশে পাকা চোরটি কমলিকাদের রাজবাড়ি থেকে কী চুরি করবে? প্রায় কিছুই তো নেই। তা ছাড়া, তখন ওর কাছে হাতুড়ি ছাড়া আর কিছু ছিল না।

সন্তু বলল, চুরি করতে এসে কিছু না পেয়ে হতাশ হয়েছে? হয়তো পরে জানা যাবে।

জোজো বলল, লোকটি কিন্তু ইংরেজি টিংরেজি জানে। বলেছিল, হাউন্ড অফ বাস্কারভিলস পড়েছে।

সন্তু বলল, ইংরেজি জানলে বুঝি চোর হতে পারে না? খবরের কাগজে দেখিস না, বড় বড় লোক কত টাকা চুরি করে!

জোজো বলল, আর কতক্ষণ যাব রে? এ যে ফুরোচ্ছেই না। কমলিকাদের বাড়ি তো এতটা দুর নয়।

সন্তু বলল, উপর দিয়ে গেলে কিছুই মনে হত না। এখানে এত কষ্ট করে যেতে হচ্ছে তো, তাই এত দূর মনে হচ্ছে। আমরা কিন্তু বেশিক্ষণ আসিনি।

জোজো বলল, আমার হাত ছড়ে যাচ্ছে। আমি একটু বিশ্রাম নেব।

দেওয়াল ছেড়ে সে বসে পড়ে হাঁপাতে লাগল।

সন্তু থেমে গিয়ে বলল, সুড়ঙ্গটা মনে হচ্ছে একটু একটু চওড়া হচ্ছে। এবার আর দুদিকের দেওয়াল ধরতে হবে না।

জোজো বলল, তোর যত উদ্ভট শখ! গর্তটা থেকে উপরে ওঠার ব্যবস্থা আছে যখন, তখন কষ্ট করে এদিকে আসার কী দরকার ছিল? চল। বরং ফিরে যাই।

সন্তু বলল, আবার অতটা ফিরে যাব? এখন সুড়ঙ্গটা চওড়া হচ্ছে, এখন আর এগোতে তত কষ্ট হবে না। চল, উঠে পড়।

আবার খানিকটা এগোতেই সুড়ঙ্গটা অনেক চওড়া হয়ে গেল, প্রায় একটা ঘরের মতন। সামনের দিকে এক জায়গায় মিটমিট করে একটা আলো জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে সন্তু কিছু বলতে যেতেই হঠাৎ ঝুপ করে কী যেন উপর থেকে পড়ল গায়ের উপর।

জোজো চিৎকার করে উঠল, সাপ! সাপ! ওরে বাবা রে!

সন্তু প্রথমে খুব চমকে উঠেছিল। তারও সাপের কথাই মনে হয়েছিল, কিন্তু হাত দিয়ে দেখল, সাপ নয়, অনেকখানি দড়ি।

তারপর সেই দড়ি আঁট হয়ে জড়িয়ে গেল সারা গায়ে।

সন্তু বলল, আমরা জালে আটকা পড়েছি।

জোজো চেঁচিয়ে উঠল, এই, এই, কে জাল ফেলল? কে? খুলে দাও। আমার গলায় আটকে যাচ্ছে। খুলে দাও।

সন্তু বলল, হাত তুলতে পারছিস তো? হাত দিয়ে গলার কাছটা আলগা করে রাখ।

জোজো জিজ্ঞেস করল, এটা কী ব্যাপার হল রে সন্তু? কে জাল ফেলল?

সন্তু বলল, দেখা যাক। ঘাবড়াসনি। কেউ-না-কেউ আসবে নিশ্চয়ই।

জোজো বলল, ঘাবড়াব কেন? এই সামান্য দড়ির জাল দিয়ে তোকে আমাকে কে আটকাবে? তবে কিনা আমার পিঠের ডান দিকটা চুলকোচ্ছে, আমি ডান হাতটা নড়াতে পারছি না!

সন্তু বলল, এদিকে সরে আয়, দেখি যদি চুলকে দিতে পারি। ঠিক তখনই একটু দূরে একটা মশাল জ্বলে উঠল।

সেই মশালটা হাতে নিয়ে একজন লোক এগিয়ে আসতে লাগল ওদের দিকে।

জোজো বলল, একটা গন্ধ পাচ্ছিস সন্তু? একে বলে বিপদের গন্ধ।

সন্তু বলল, না, ওটা আগুনের গন্ধ। বদ্ধ জায়গায় আগুন জ্বললে এরকম একটা গন্ধ হয়।

জোজো বলল, লোকটা থপথপ করে আসছে। আমাদের মারবে নাকি?

সন্তু বলল, হঠাৎ মারতে যাবে কেন? আমরা কিছু দোষ করেছি?

যে লোকটি মশাল ধরে আছে, তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। একেবারে কাছে আসার পর বোঝা গেল, সে বেশ একজন তাগড়া জোয়ান লোক, মুখোনা এমনই কালো যে, মনে হয়, আলকাতরার পোঁচ দেওয়া।

সন্তু খুব অবাক হয়ে বলে উঠল, আরে, এ যে আমাদের সেই কালকের

ড্রাইভার!

জোজো বলল, ইয়েস। পলাতক গুরুপদ রায়। ইনি এখানে লুকিয়ে আছেন?

লোকটি কাছে এসে একদৃষ্টে ওদের দিকে তাকিয়ে রইল।

সন্তু বলল, নমস্কার ড্রাইভারবাবু, কাল অ্যাক্সিডেন্টের পর আপনি কোথায় চলে গেলেন?

লোকটি চুপ।

সন্তু আবার বলল, আপনার কোথাও চোট লাগেনি তো? আমরা চিন্তা করছিলাম আপনার জন্য।

লোকটি এবারও উত্তর দিল না।

জোজো বলল, ইনি কথা খরচ করতে চান না।

সন্তু বলল, ড্রাইভারবাবু, দেখুন তো, কোথা থেকে একটা জাল এসে আমাদের বেঁধে ফেলল! এটা বোধহয় জন্তু-জানোয়ার ধরার জন্য। একটু খুলে দিন না প্লিজ।

জোজো বলল, কাল অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল বটে, কিন্তু আপনি খুব ভাল ড্রাইভার। অত স্পিডে চালাচ্ছিলেন, কিন্তু একটুও হাত কাঁপেনি।

লোকটি এবার জালের উপরের দিকে হাত রাখল।

জোজো বলল, দিচ্ছে, দিচ্ছে, খুলে দিচ্ছে। গুরুপদবাবু খুব ভাল লোক। কিন্তু ভোলার বদলে জালটা আরও আঁট হয়ে গেল।

জোজো বলল, উলটো দিকে, উলটো দিকে ঘোরান, তা হলে আলগা হয়ে যাবে।

সে-কথায় কর্ণপাত না করে লোকটি একটু সরে গেল। তারপর মশালটা আটকে দিল দেওয়ালের একটা হুকে। পিছন ফিরে চলে গেল জোরে জোরে হেঁটে।

জোজো বলল, যাঃ বাবা! কোনও কথাই শুনল না?

সন্তু বলল, হয়তো কানে শুনতেই পায় না। কালা!

জোজো বলল, কিংবা বোবা। বোবা হলে তো কালা হবেই। কিন্তু লোকটা মিটমিটে শয়তান। দেখলি না, চোখ দুটো কেমন কুটিলের মতন।

সন্তু বলল, আচ্ছা, ওর নাম গুরুপদ না গুরুচরণ? আমার মনে হচ্ছে, গুরুচরণ। নাম ভুল বললে অনেকে রেগে যায়।

জোজো বলল, গুরুপদ আর গুরুচরণে কোনও তফাত আছে? কোনটা গুরুতর? এমনও হতে পারে, ওর নাম নিবারণচন্দ্র।

সন্তু একটু নড়াচড়ার চেষ্টা করে বলল, আগে তবু ভাল ছিল। ও এসে আরও আঁট করে দিয়ে গেল, কোনও হাতই তুলতে পারছি না।

জোজো বলল, এ তো দেখছি পাটের দড়ি। আমরা ছিড়তে পারব না? বেশ পুরনোও হয়ে গেছে। একবার আমরা লোহার জাল কেটে বেরিয়েছি, এই দড়ি তো কোন ছার!

সন্তু বলল, আমরা মানে?

জোজো বলল, তুই আর আমি। সিঙ্গাপুরে! সন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, আমি তো কখনও লোহার জাল কেটে বেরোইনি। আর সিঙ্গাপুরেও যাইনি।

জোজো হা হা করে হেসে বলল, তুই সব ভুলে যাস। আমি ঠিক মনে রাখি। কিন্তু কথা হচ্ছে, কতক্ষণে জালটা ছেঁড়া হবে। আমি বেশিক্ষণ এভাবে থাকতে চাই না। আর-একটু পরেই তো খিদে পেয়ে যাবে।

সন্তু বলল, আমি কিন্তু পারছি না রে জোজো। অন্য কারও সাহায্য দরকার। আর তো কারও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

জোজো বলল, আমাদের এইভাবে জালে বেঁধে রেখে চলে গেল। লোকটা অতি নিমকহারাম।

এই সময় কিচ কিচ করে শব্দ হল। শব্দটা এদিকেই আসছে।

জোজো এতক্ষণ হালকা গলায় কথা বলছিল। এবার একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ওটা কীসের শব্দ রে?

সন্তু বলল, বোঝাই তো যাচ্ছে, ইঁদুর।

অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল একটা ধেড়ে ইঁদুর। প্রায় খরগোশের মতন সাইজ!

জোজো বলল, ওরে বাবা রে! এত্ত বড়! এখানে ইঁদুর এল কী করে?

সন্তু বলল, ইঁদুর কোথায় নেই। বোধহয় মঙ্গল গ্রহেও আছে। ইঁদুর দেখে অত ভয় পাওয়ার কী আছে? ইংদুর তো মানুষকে কামড়ায় না।

জোজো বলল, আমি জানি, এক ধরনের ইঁদুর মানুষের মাংস খায়।

প্রথমটার পিছু পিছু আরও তিনটে ইঁদুর বেরিয়ে এল। তারপর আরও চারটে।

একেবারে জালটার কাছে এসে ওদের দুজনের দিকে একটা ইঁদুর তাকিয়ে রইল জুলজুল করে। তার চোখ দুটো যেন দুটি আগুনের ফুলকি।

সন্তু ফিসফিস করে বলল, জোজো, একদম নড়বি না, চুপ করে থাক।

প্রথম ইঁদুরটা স্প্রিং-এর মতন এক লাফ দিয়ে উঠে জোজোর সামনের দড়ি কামড়ে ধরল।

জোজো দারুণ ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাবা রে, ওরে বাবা রে!

সে ঝটাপটি করে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করল ইঁদুরটাকে।

তখন সব কটা ইঁদুর ঝাঁপিয়ে পড়ল দড়ির জালের উপর।

মশালটাও নিভে গেল এই সময়।