০৪. রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর

রাত্তিরে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই বসেছে অতিথি ভবনের ছাদে।

সন্ধেবেলা আকাশে অত মেঘ ঘনিয়ে এলেও তেমন ঝড়-বৃষ্টি হয়নি। তবে এখনও এদিকে ফিনফিনে বাতাস বইছে।

এখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়, ঢেউয়ের শব্দও শোনা যায়। সমুদ্র এখন কালো। আকাশে চাঁদের সঙ্গে মেঘের লুকোচুরি খেলা চলছে।

কাকাবাবু এখনও গম্ভীর হয়ে আছেন। কেমন যেন অন্যমনস্ক।

এর মধ্যে জোজো একটা লম্বা, রোমহর্ষক গল্প শোনাল, তাতেও কাকাবাবু কোনও মন্তব্য করলেন না।

নরেন্দ্র ভার্মা কৌতূহলী চোখে লক্ষ করছেন কাকাবাবুকে। এক সময় তিনি বললেন, রাজা, তুমি কী চিন্তা করছ জানি না। তোমাকে একটা খুব সরল, সাধারণ প্রশ্ন করতে পারি?

কাকাবাবু বললেন, তোমার আবার প্রশ্ন করার জন্য অনুমতি লাগে নাকি? বলে ফেলো!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তুমি ভূত বিশ্বাস করো?

কাকাবাবু হঠাৎ রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, নরেন্দ্র, তুমি আমার সঙ্গে এতদিন ধরে মিশছ, তবু তুমি আমাকে চেনো না? এটা কি একটা প্রশ্ন হল? ছেলেমানুষি করছ আমার সঙ্গে?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এইজন্যই ভয় পাচ্ছিলাম। এ সম্পর্কে তোমার মত আমি জানি। কিন্তু বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের কিছু-কিছু মত তো বদলায়।

তা বলে বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত সত্য বদলে যাবে নাকি?

তাও কিছু কিছু বদলায়। একটা সহজ উদাহরণ দিচ্ছি। আগে ডাক্তাররা বলতেন, ছোট ছোট মাছ খাবে। বড় বড় চর্বিওয়ালা মাছ শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। এখন সেই মতটা উলটে গেছে। সব ডাক্তার বলছেন, মাছের চর্বিই আসলে খুব উপকারী। তেলালো মাছ, চর্বিওয়ালা মাছই খেতে হবে। তাতে নাকি মনও ভাল হয়ে যায়।

জোজো বলল, সেইজন্যই তো ইলিশ মাছ খেতে এত ভাল লাগে। পুঁটিমাছ। ভাল লাগে না।

কাকাবাবু তবু রাগ রাগ ভাব করে বললেন, কী আজেবাজে কথা বলছ। নরেন্দ্র? একবার বলছ ভূত, একবার বলছ মাছ …

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আহা, রাগ করছ কেন? আমি তোমার সঙ্গে মজা করছি না। বিশেষ কারণ আছে। ফ্রেড নামের বোটচালকটি আমার আদেশ অগ্রাহ্য করেও কেন দ্বীপটি ছেড়ে চলে এল জানো?

কাকাবাবু বললেন, সন্ধে হয়ে আসছিল। রাত্তিরে ও বোট চালাতে রাজি নয়। তা ছাড়া ঝড়বৃষ্টি …

আমি তো বলেছিলাম, আমাদের নামিয়ে দিয়ে ও চলে আসতে পারে।

তাতে আমাদের বিপদের আশঙ্কা ছিল। ও ঝুঁকি নিতে চায়নি।

সেটাও আসল কারণ নয়। ওর ধারণা, দ্বীপের মধ্যে ওই বাড়িটা ভূতের বাড়ি।

ওঃ, কোনও ফাঁকা মাঠের মধ্যে পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ি দেখলেই অনেকে বলে ভূতের বাড়ি। আসলে সেগুলো চোর-ডাকাতের আড্ডা। তারাই ভয় দেখায়।

পাঁচজন বৈজ্ঞানিকের একটা টিম ওই বাড়িতে রাত কাটিয়ে এসেছেন। তারা ভূত দেখতে পাননি বটে, কিন্তু কিছু ছবি তুলে এনেছেন, যার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। সেই ছবিগুলো আমার কাছে আছে। দেখবে? চলো, নীচে আমার ঘরে চলো-।

নরেন্দ্র, তুমি থাকো দিল্লিতে। তোমার বাড়ি আম্বালায়। তুমি এই দক্ষিণ ভারতের সমুদ্রে একটা নগণ্য দ্বীপের পোড়োবাড়ি নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন বলো তো?

দিল্লি থেকে আমাকে ওই বাড়িটার ব্যাপারেই পাঠানো হয়েছে। ওখানে একটা কিছু ঘটছে। এর মধ্যে তোমাকেও জড়িয়ে নিতে চাই। তোমাদের যে কোরাল রিফ দেখাতে নিয়ে গেলাম, তা কি এমনি এমনি? যদি বলতাম, চলো একটা ভূতের বাড়ি দেখে আসি, তা হলে তুমি মোটেই যেতে রাজি হতে না।

ও জায়গাটায় আমার আবার যাবার ইচ্ছে আছে।

সন্তু আর জোজো বলে উঠল, আমরাও আবার যাব।

কাকাবাবু বললেন, ভূতের বাড়ির যদি ব্যাপার হয়, তা হলে জোজোকে বলো। ও ভূতের এক্সপার্ট। এমনকী, ভূত ধরে বোতলে বন্দি করেও রাখতে পারে।

ছাদ থেকে নেমে এসে বসা হল নরেন্দ্র ভার্মার ঘরে। তিনি একটা অ্যাটাচি কেস খুলে একটা খালি খাম বার করলেন। তার মধ্যে চারখানা ছবি। বেশ বড় বড় প্রিন্ট, খাতার পাতার মতন।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, যে বিজ্ঞানীদের টিমটা ওখানে গিয়েছিল, তারা সন্দেহজনক কিছু দেখতে পাননি, কোনও আওয়াজ শোনেননি, চোর-ডাকাতদেরও আড্ডা হওয়ার কোনও চিহ্ন নেই। শুধু এই ব্যাপারটা দেখেছেন।

প্রথম ছবিটা রাত্তিরবেলা তোলা। পুরোটাই অন্ধকার, শুধু মাঝখানে তিনটে সাদা ছোপ।

দ্বিতীয় ছবিটাও প্রায় একই, তবে সাদা ছোপ তিনটের জায়গায় চারটে। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো কী? মশাল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা হতেও পারে। বৈজ্ঞানিকরা তাদের রিপোর্টে বলেছেন, রাত্তিরবেলা অনেক দূরে তারা জানলা দিয়ে এগুলো দেখেছেন। মশালের মতনই মনে হয়। তবে দাউ দাউ করে জ্বলেনি।

কাকাবাবু বললেন, কোথায় দেখেছে, জলের ওপর?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা ঠিক বলা যায় না। ওই বাড়িটার পেছন দিকে অনেকখানি জায়গা পড়ে আছে, সেখানে কোনও গাছপালা নেই, জোয়ারের সময় জল উঠে আসে, অন্য সময় কাদা কাদা হয়ে থাকে। সে সময় জোয়ার ছিল কি না, তা বোঝা যায়নি!

ওঁরা কাছে গিয়ে দেখলেন না কেন? এ ছবি তো মনে হচ্ছে টেলিফোটো লেন্সে অনেক দূর থেকে তোলা।

রাত্তিরবেলা ওঁরা বাইরে বেরুবেন না, এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। বিপদটিপদের কথাও তো চিন্তা করতে হবে। ওঁদের সঙ্গে অবশ্য আর্মড গার্ড ছিল।

তা ঠিক, বিপদের কথা চিন্তা করতেই হবে। অত নির্জন জায়গা। ওই আলোগুলো দেখা গেছে মাত্র কয়েক মিনিট। তারপর আবার সব অন্ধকার।

জোজো জিজ্ঞেস করল, কারা ওই মশাল নিয়ে যাচ্ছিল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, দ্যাট ইজ আ মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। ছবিগুলো ভাল করে দ্যাখো, কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। যতই অন্ধকার হোক, মশালের আলোতে মানুষের অস্পষ্ট চেহারা তো অন্তত ফুটে উঠবে? ওঁদের ক্যামেরায় খুব শক্তিশালী লেন্স, এরকম ছবি তুলেছেন প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা। সবই প্রায় একই রকম বলে আমি মাত্র চারটে এনেছি।

সন্তু বলল, যদি কেউ সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরে থাকে, আর মুখেও কালো রং মাখে, তা হলে রাত্তিরবেলা তার ছবি উঠবে না।

জোজো বলল, সকালবেলা সেই জায়গাটায় গিয়ে কারও পায়ের চিহ্নটিহ্ন দেখা যায়নি?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রোজই সকালবেলা সেখানে জোয়ারের জল আসে। তখন কিছুই বোঝার উপায় নেই।

কাকাবাবু বললেন, আর কোনও রহস্যময় ব্যাপার সেখানে ছিল না? শুধু গভীর রাতে কয়েকটা মশালের মতন আলো, কোনও লোক দেখা যাচ্ছে না। এর একটা সহজ ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে, তবে নিজের চোখে না দেখে কিছু বলা উচিত নয়।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, চতুর্থ ছবিটা দ্যাখো। এটা দিনের বেলা তোলা। এখানেও দুটো মশাল দেখা যাচ্ছে, কিন্তু কোনও লোক নেই। ঠিক যেন শূন্যে ঝুলছে।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে আপন মনে বললেন, দিনের বেলা মশাল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, প্রশ্ন তিনটে। কেন শুধু শুধু মশাল জ্বলে। কেন একটাও লোক দেখা যায় না। মশাল জ্বাললে মানুষ থাকবেই, তারা কোথায় লুকোয়? তাদের কেন ছবি ওঠে না?

কাকাবাবু বললেন, আমার তা হলে এখুনি কলকাতায় ফেরা হবে না। ওই দ্বীপে গিয়ে ঘাঁটি গাড়তে হবে।

নরেন্দ্র ভার্মা একগাল হেসে বললেন, আমিও তো সেটাই ভেবে এসেছি। অন্তত দুটো রাত যদি থাকা যায়।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু কী করে যাওয়া হবে। তোমার ওই অবাধ্য বোটচালককে দিয়ে কাজ চলবে না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, না, না, অন্য বোট জোগাড় করতে হবে। সঙ্গে খাবারদাবারের বন্দোবস্ত থাকবে।

শেষ রাত থেকেই তুমুল বৃষ্টি নামল।

পরদিন অনেক বেলা পর্যন্ত চলল সেই বৃষ্টি একটানা। এর মধ্যে বেরোবার কোনও উপায় নেই। কোনও বোটচালকই এসব দুর্যোগের মধ্যে সমুদ্রে বোট চালাতে রাজি হবে না।

সেই রাইফেলধারী পাহারাদারকে নেওয়া হবে কি হবে না?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমরা চারজন, বোটচালককে ধরলে পাঁচ, এর পর ওকে নিলে চাপাচাপি হয়ে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, দ্বীপে একজন অতিরিক্ত লোক কাজে লাগতে পারে। ও বেচারা পাহারা দিতে এসেছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ওই দ্বীপে পাহারা দেওয়ার দরকার হবে না। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ওখানে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার ঘটলেও বিপদের নামগন্ধ নেই। তা ছাড়া, তোমার আর আমার কাছে অস্ত্র থাকছে।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা, ওর সঙ্গে কথা বলে দেখা যাক।

পুলিশটির নাম লছমন রাও। সে আর রাইফেলটা হাতছাড়া করে না। সব সময় কাঁধে রাখে।

সে আসবার পর কাকাবাবু হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাড়ি কোথায় ভাই?

সে নরেন্দ্র ভার্মার মুখের দিকে তাকাল। সে তো হিন্দি বোঝে না।

কাকাবাবু বললেন, এই তো মুশকিল, নরেন্দ্র, তুমিই ওর বাড়ির খোঁজখবর নাও। তারপর জিজ্ঞেস করো, ও রান্না করতে জানে কি না।

শেষ প্রশ্নটা শুনে লোকটি জোরে জোরে দুদিকে মাথা দোলাতে লাগল। আমরা মাথা নেড়ে যেভাবে না বলি, সেটাই ওদের হ্যাঁ।

কাকাবাবু বললেন, নরেন্দ্র, জিজ্ঞেস করো, কী কী রাঁধতে পারে।

লছমন রাও বলল, ইডলি, ধোসা, সম্ভরম।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, সে তো খুবই ভাল। সাধারণ ভাত, রুটি বানাতে পারো না?

লছমন রাও জানাল যে, সে ওসবও পারে। এমনকী ঢ্যাঁড়স সেদ্ধ, আলু ভাজাও পারে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে ওকে নিয়ে যাওয়া হোক, পাহারা দেওয়ার দরকার নেই, দুবেলা রান্নার কাজ তো অন্তত করে দিতে পারবে!

সে চলে যাওয়ার পর নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, ওকে যে নিয়ে যাচ্ছ, ওর চেহারাটা দেখেছ? ও নিজেই তো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খেয়ে নেবে।

কাকাবাবু বললেন, আহা, তাতে আর কী হবে! বেশি করে চাল-ডাল নিয়ে নেবে।

বৃষ্টির বেগ একটু কমল বিকেলের দিকে। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। আজ আর বেরোবার কোনও মানে হয় না। একটা দিন নষ্ট। নরেন্দ্র ভার্মা একটার পর একটা ফোন করে সময় কাটালেন।

পরদিন সকালবেলা তিনি বললেন, সবাই তৈরি হয়ে নাও। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি, ঠিক দশটার সময় বোট আসবে। চাল-ডাল, খাবার-দাবার সে-ই হিসেব করে নিয়ে আসবে। এখানে তো কোনও দোকান নেই।

সন্তু আর জোজো দশটা বাজার অনেক আগেই রেডি।

সন্তু বলল, আমার ভূতটুত নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই। আমি গিয়েই জলে নামব।

জোজো বলল, ভূত যদি থাকে, তাতে কোনও প্রবলেম নেই। আমি একটা খালি কাচের বোতল নিয়ে যাচ্ছি। ওর মধ্যে ভূতটাকে ঠিক ঢুকিয়ে দেব। মন্ত্রটাও মনে পড়ে গেছে।

সন্তু বলল, একটা মোটে বোতল নিচ্ছিস? যদি অনেক ভূত থাকে?

জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে ঠোঁট উলটে বলল, একগাদা ভূত নিয়ে কী করব? একটাকে ধরলেই অন্যগুলো পালাবে ভয় পেয়ে।

সন্তু বলল, ভূতরাও মানুষকে ভয় পায়?

জোজো বলল, তেমন তেমন মানুষের পাল্লায় পড়লে হাউ মাউ করে কাঁদে। মুসোলিনির ভূতটা তো আমার বাবার পা ধরে ক্ষমা চেয়েছিল।

সন্তু বলল, ভূতরা তো আসলে মানুষকে ভয় দেখাতে চায়। সেটাই তাদের একমাত্র কাজ। কিন্তু ওই নির্জন দ্বীপে, যেখানে জনমনুষ্য নেই, সহজে কেউ যেতেও চায় না, সেখানে ভূতেরা কী করে?

জোজো বলল, সেটা আমি ওদের এক ব্যাটাকে ধরে জেরা করে সব জেনে নেব।

সন্তু বলল, তুই ওসব করিস। আমি যতক্ষণ পারি সমুদ্রে ড়ুব দিয়ে কোরাল রিফ দেখব। আঃ, অপূর্ব, অপূর্ব! জলের তলায় কী করে এত রকম রং থাকে?

জোজো বলল, দিনের বেলায় আমিও দেখব। জলে নামার ভয় আমার কেটে গেছে।

আজ বৃষ্টি পড়ছে না বটে, কিন্তু আকাশ মেঘলা। বোটটা চলে এল ঠিক সময়। এটা কালকের চেয়ে একটু বড়। মাঝখানে একটা ছোট ঘর আছে, বৃষ্টি পড়লে ওটার মধ্যে আশ্রয় নেওয়া যাবে।

আজকের বোটচালকের নাম সিরাজুদ্দিন তারিক। মাঝবয়েসি মানুষ, চোখে চশমা, কুর্তা-পাজামা পরা।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, তারিকসাহেব, সব জিনিসপত্র এনেছেন তো?

তারিক বললেন, হ্যাঁ, স্যার। অর্কিড লজের ম্যানেজারকে আপনি ফোন করেছিলেন, তিনদিনের জন্য খাবার-দাবার যা লাগতে পারে, সব গুছিয়ে দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, আমরা দুদিনের বেশি থাকব না। ওতেই হয়ে যাবে। তারিকসাহেব, আপনি রবার্ট আয়ল্যান্ডে গেছেন আগে?

তারিক বললেন, পাশ দিয়ে গেছি কয়েকবার। তবে দ্বীপে নামিনি কখনও।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ওই দ্বীপটা সম্পর্কে শুনেছেন কিছু?

তারিক বললেন, লোকে তো নানারকম কথাই বলে। ভূত-প্রেত আছে নাকি!

আপনি ওই দ্বীপে কখনও নামেননি কেন?

শুধু শুধু নামতে যাব কেন? ওই দ্বীপে তো একটা সেকেলে ভাঙা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। সাপটাপ থাকতে পারে।

আপনি ভূত-প্রেতের ভয় পান?

না, স্যার। আমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামাই না। বিশ্বাসই যদি না থাকে, তা হলে আর ভয় পাব কেন?.

ঠিক বলেছেন। আচ্ছা তারিকসাহেব, আপনি কি আমাদের পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসবেন, আবার দুদিন পর আসবেন? নাকি এই দুদিন থাকবেন আমাদের সঙ্গে। থাকলে ভাল হয়। হয়তো আমরা এদিক-ওদিক যেতে পারি।

না, না, আমি থেকে যাব। সেরকমই বলা হয়েছে। আপনাদের সঙ্গে দুটো দিন কাটাব, এ তো আমার সৌভাগ্য। আমি আপনার কথা শুনেছি স্যার। অর্কিড লজের ম্যানেজার বললেন, রাজা রায়চৌধুরী ইজ আ ভেরি ফেমাস ম্যান! আমি স্যার ভাল রান্না করতে পারি, আপনাদের বেঁধে খাওয়াব, আলাদা মশলা এনেছি।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আঃ, তা হলে তো পিকনিক বেশ ভালই জমবে মনে হচ্ছে! চলো, সবাই উঠে পড়ো।

বোটে উঠে সন্তু জোজোকে ফিসফিস করে বলল, আমাদের এই অভিযানটা নিয়ে যদি একটা গল্প লেখা যায়, তবে তার নাম হওয়া উচিত, ভূতের সঙ্গে পিকনিক।

জোজো বলল, গল্প লেখার আগেই নাম দিতে নেই। দ্যাখ, আগে ওখানে কত কী ঘটে। হয়তো ভূতের বদলে দেখা গেল জলদানব।

সন্তু বলল, কিংবা এমনও হতে পারে, আজ গিয়ে দেখা গেল দ্বীপটা ওখানে নেই। জলের তলায় চলে গেছে!

জোজো বলল, কিংবা সেখানে একটা মস্ত বড় জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু

তার সব লোক অজ্ঞান।

এইরকম গল্পে গল্পে সময় কাটতে লাগল।

আজ বেশ ঢেউ আছে, বোটটা লাফিয়ে উঠছে মাঝে-মাঝে।

সিরাজুদ্দিন তারিক অল্পবয়েসি দুজনের দিকে হাত তুলে বললেন, ভয় নেই, এ বোট কখনও ডোবে না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, দূরে আর একটা বোট দেখা যাচ্ছে।

সিরাজুদ্দিন তারিক বললেন, অনেক সময় মাছ ধরার বোট দেখা যায়।

সেই বোটটা ক্রমশ কাছে আসছে। দেখা গেল, দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, তাদের গায়ে খাকি পোশাক।

নরেন্দ্র ভার্মা ভুরু কুঁচকে বললেন, পুলিশের বোট নাকি? সেরকমই মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, পদ্মনাভন আমাদের পাহারা দেওয়ার জন্য এদেরও পাঠিয়ে দিয়েছে নাকি? সেটা বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সেরকম হলে আমি ওদের জোর করে ফিরিয়ে দেব!

অন্য বোটটা একেবারে এই বোটের গায়ে গায়ে লাগল। একজন তারিকের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, আমরা পুলিশ। তোমার স্টার্ট বন্ধ করে দাও।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কে পাঠিয়েছে?

পুলিশটি নরেন্দ্র ভার্মাকে বলল, আপনার কোনও প্রশ্ন করার রাইট নেই। আমরা যা জিজ্ঞেস করব, তার উত্তর দেবেন। এই বোটে গাঁজা আছে?

নরেন্দ্র ভার্মা হাসিমুখে বললেন, এ আবার কী ব্যাপার? না, এখানকার কেউ গাঁজা খায় না।

পুলিশটি বলল, আমাদের কাছে খবর আছে, এই বোটে গাঁজা স্মাল করা হচ্ছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, কী অদ্ভুত কথা! আমরা আমাদের পরিচয় দিচ্ছি, আমার নাম নরেন্দ্র ভার্মা, দিল্লির সি বি আই-এর জয়েন্ট ডিরেক্টর, আর উনি রাজা রায়চৌধুরী, সরকারি মহলে সবাই ওঁকে চেনে।

জোজো সন্তুকে চুপিচুপি বলল, গাঁজাখুরি ব্যাপার!

পুলিশটি গোঁয়ারের মতন নরেন্দ্র ভার্মার কথা গ্রাহ্যই করল না। সে আবার বলল, আমরা এ বোট সার্চ করে দেখব।

দুজনেই চলে এল এই বোটে।

লছমন রাও-ও যদিও পুলিশ, কিন্তু তার সাদা পোশাক। সে নিজের ভাষায় কিছু বলল, তার উত্তরে ওদের একজন বলল, শাট আপ!

নরেন্দ্র ভার্মা এবার রেগে গিয়ে বললেন, আপনারা এ কীরকম ব্যবহার করছেন! আপনাদের আইডেনটিটি দেখান!

এই যে দেখাচ্ছি, বলেই ওদের একজন একটা রিভলবার বার করে সোজা গুলি চালাল নরেন্দ্র ভার্মার দিকে।

আর একজন একটা রিভলভার ঠেকাল কাকাবাবুর কপালে।

অন্য বোটের তলার দিকে আর একজন লুকিয়েছিল। সে এবার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, আর একটা অস্ত্রও তোমার দিকে তাক করা আছে। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো, একদম নড়বে না।

এ সেই ডিমেলোর সহচর লম্বা লোকটি। সন্তুরা তাকে দেখামাত্র চিনে গেল।

যে-লোকটি নরেন্দ্র ভার্মাকে গুলি করেছে, সে রিভলভার উঁচিয়ে লছমান রাওয়ের রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিল সমুদ্রের জলে। তারপর সে তাকাল

সন্তু আর জোজোর দিকে।

চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, হুইচ ওয়ান?

লম্বা লোকটিও সন্তু আর জোজোর দিকে দ্রুত চোখ বুলিয়ে জোজোকেই বেছে নিল। সে নির্দেশ দিল, দ্যাট ওয়ান উইথ ইয়েলো শার্ট!

কাকাবাবু নিজের রিভলভার বার করার সময়ই পাননি। তিনি ভাবছেন নরেন্দ্র ভার্মার কথা। তিনি গুলি লাগার পর কোনও সাড়াশব্দই করলেন না। মরেই গেলেন নাকি? তা কি সম্ভব? কাকাবাবুর সঙ্গে তিনি কতবার কত জায়গায় গেছেন, এর চেয়েও অনেক বেশি বিপদে পড়েছেন, প্রত্যেকবার বেঁচে গেছেন। আর এখন এমন সামান্য কারণে প্রাণ দেবেন?

নরেন্দ্র ভার্মার চিন্তায় তিনি আর অত কিছুই ভাবতে পারছেন না।

লম্বা লোকটি বলল, রাজা রায়চৌধুরী, তোমাকে আমরা মারব না। এই ছেলেটিকে নিয়ে যাচ্ছি। যেমনভাবে পারো, ডিমেলোকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করো, ঠিক তিনদিন সময়, তার মধ্যে আমাদের কথা মতন কাজ

হলে, এ ছেলেটির মৃতদেহ তোমার দরজার কাছে পৌঁছে দেব। তারপর তুমি যাবে!

ওরা জোজোর কলার চেপে নিজেদের বোটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সন্তু বলল, আমিও যাব, আমিও যাব।

একজন রিভলভারের বাঁট দিয়ে মারল সন্তুর মাথায়। সে ঢলে পড়ে গেল জ্ঞান হারিয়ে।