১৪. কাকাবাবু বসে আছেন একটা জেলখানার মধ্যে

কাকাবাবু বসে আছেন একটা জেলখানার মধ্যে। সেখানে টেবিল ও চেয়ার রয়েছে অবশ্য। টেবিলের ওপর অনেক কাগজ ছড়ানো। তিনি একমনে লিখে যাচ্ছেন কীসব।

লোহার দরজা খোলার শব্দ হতে তিনি ফিরে তাকালেন।

মৃগাঙ্কমৌলী আর আলম এসেছেন দেখা করতে।

নমস্কার জানিয়ে মৃগাঙ্কমৌলী জিজ্ঞেস করলেন, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো রাজাদা?

কাকাবাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, না, অসুবিধে কিছু নেই। প্রথমে আমি রাজি হইনি। এখন দেখছি জেলের মধ্যে আমাকে রেখে ভালই করেছ।

আলম বললেন, এখন আপনার নিজের বাড়িতে থাকা কোনওক্রমেই সেফ নয়। আপনি একবার বেঁচে গেছেন, ওরা আপনাকে মেরে ফেলার আবার চেষ্টা করবেই। আপনার বাড়ির লোকেরও বিপদ হতে পারত।

কাকাবাবু বললেন, তা ঠিক। এখানে বেশ নিরিবিলিতে কাজ করা যাচ্ছে। খাবারদাবারও ভাল দিচ্ছে। জেলখানায় বুঝি এত ভাল খাবার দেয়?

মৃগাঙ্কমৌলী হেসে বললেন, না, এ-খাবার শুধু আপনার জন্য।

আলম বললেন, আপনাকে তো আর ক্রিমিনাল হিসেবে আটকে রাখা হয়নি। আপনি আমাদের অতিথি। ওই সাংকেতিক লিপি কিছু উদ্ধার করতে পারলেন? দিল্লির এক্সপার্টরা তো এখনও কিছু বুঝতে পারছে না।

কাকাবাবু বললেন, একটা সূত্র পেয়েছি। এরপর আর বেশি সময় লাগবে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, রাজাদা, আপনার পিঠে যে জিনিসটা বাঁধা ছিল তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। সাঙ্ঘাতিক একটা বিস্ফোরক আর ডি এক্স নয়, ওই ধরনেরই এক্সপ্লোসিভ। একসঙ্গে দশ-বারোজন লোককে মেরে ফেলতে পারে।

আলম বললেন, বাপরে বাপ, আপনি রাইটার্স বিল্ডিংসে যখন আমাদের সামনে বসে ছিলেন, তখন আপনার পিঠে ওটা বাঁধা ছিল। আমাদের কিছু বলেননি।

কাকাবাবু বললেন, বলার উপায় ছিল না। ওটা খুলতে গেলে রিমোট কন্ট্রোলে ফাটিয়ে দিতে পারত। তাতে তোমরাও বাঁচতে না। মাত্র আধঘণ্টা সময় দিয়েছিল আমাকে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, অতদূর থেকে কি রিমোট কন্ট্রোল কাজ করে?

কাকাবাবু বললেন, তা জানি না। ওরা তো সেইরকমই ভয় দেখিয়েছিল। ঝুঁকি নেওয়া যায় না। যদি সত্যি হয়? আজকাল বিজ্ঞান তো অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে দিচ্ছে।

আলম বললেন, তা হলে জলে ঝাঁপ দিলেন কী করে? সেখানেও তো বিস্ফোরণ হতে পারত।

কাকাবাবু বললেন, তা হলেও শুধু আমি মরতাম, আর কারও ক্ষতি হত না। ওরা আমাকে মৃত্যুভয় দেখিয়েছিল। কিন্তু নিজে বাঁচবার জন্য আমি কি এরকম একটা সাঙ্ঘাতিক জিনিস ওদের হাতে তুলে দিতে পারি? তা ছাড়া, আমার সন্দেহ হয়েছিল, ওই জিনিসটা জলের মধ্যে কাজ করে না। শঙ্খচূড় নামের লোকটা জলকে ভয় পায়। সত্যিই তো, জলের মধ্যে ওটা ফাটল না। জলের মধ্যে গা ড়ুবিয়ে রেখে ওটা খুলে ফেললাম।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, রাজাদা, আপনি অসাধ্যসাধন করেছেন বলা যায়। আপনি একবারও ভয় পাননি?

কাকাবাবু বললেন, ভয়? হ্যাঁ, মানে, মনে হয়েছিল, এবার বুঝি আর বাঁচা যাবে না। আমি মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়েছিলাম। মানব-বোমা তো সত্যি অনেক দেশে দেখা যাচ্ছে।

আলম বললেন, দিল্লি থেকে রিপোর্ট এসেছে, কোনও একটি বিদেশি শক্তি আমাদের সারা দেশে দারুণ সব ধ্বংসের কাজ চালাবে। একসঙ্গে একই দিনে কোনও এয়ারপোর্ট উড়িয়ে দেবে, ব্রিজ উড়িয়ে দেবে, বহু মানুষ মরবে। আগে থেকে জানতে না পারলে আমরা তো আটকাতেও পারব না।

কাকাবাবু বললেন, এই সাঙ্ঘাতিক লেখাগুলোয় সেইরকমই একটা পরিকল্পনার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আপনি কতটা পড়তে পেরেছেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি অনেকরকম পরীক্ষা করে অতি কষ্টে একটা নিয়ম ধরে ফেলেছি। তোমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। যেমন ধরো, একটা লেখা ফুটে উঠেছে। ZHQONQS,এর কোনও মানেই হয় না। এখানে এর ইংরেজি পরের অক্ষর দিয়ে বদলে দিতে হবে। Z-এর পর কী? আবার A, তাই না? H এর পর I, Q-এর পর R, এইভাবে এটা হয়ে গেল AIRPORT.তারপর রয়েছে AZFCNFQZ, এটা হয়ে যাবে BAGDOGRA, তারিখগুলোও লেখা আছে সংখ্যা দিয়ে নয়। অক্ষরে। বাগডোগরা এয়ারপোর্টটা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা আছে ২৪ তারিখ, তার মানে আর চারদিন পরে। পাঁচজন লোকের নামও দেওয়া আছে।

আলম বললেন, এরকম তো অনেক লেখা আছে দেখছি।

কাকাবাবু বললেন, সবগুলির জন্য একই নিয়ম খাটবে না। বার করতে সময় লাগবে। মৃগাঙ্ক, তোমরা এক কাজ করো। আজই প্রেস কনফারেন্স করে ঘোষণা করে দাও যে, আমরা সবই সাংকেতিক অক্ষর পড়ে ফেলেছি। জায়গার নাম, লোকগুলোর নাম জেনে গেছি। তাতে ওরা পরিকল্পনা বাতিল করবে নিশ্চয়ই।

আলম বললেন, তা ছাড়া এক্ষুনি তো বাগডোগরা এয়ারপোর্ট ঘিরে ফেলার ব্যবস্থা করতে হয়।

কাকাবাবু বললেন, ওই পাঁচটা লোক খুব সম্ভবত শিলিগুঁড়িতে লুকিয়ে আছে, তাদের ধরে ফেলার ব্যবস্থা করো।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এয়ারপোর্ট উড়িয়ে দিতে চায়? এদের এত ক্ষমতা। রাজাদা, ওই শঙ্খচূড় নামের লোকটা যদি মানব-বোমা পাঠায়? তাদের তো আটকানো যায় না?

কাকাবাবু বললেন, ঠিকই বলেছ, ওই শঙ্খচূড়ের ডেরাটা খুঁজে বার করতেই হবে।

আলম বললেন, আপনাকে কোথায় আটকে রেখেছিল, সেই জায়গাটা চিনতে পেরেছেন?

কাকাবাবু বললেন, না। আমাকে অজ্ঞান করে নিয়ে গিয়েছিল। বেরিয়ে আসার সময় চোখ বাঁধা ছিল। তবে গাড়ি করে রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে নিয়ে এসেছে, তাতে মোটামুটি সময় লেগেছে চার ঘণ্টা। আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়েছে, যাতে আমার ঝাঁকুনি না লাগে। তা হলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, কলকাতা থেকে সেই জায়গাটার গাড়িতে দূরত্ব অন্তত সাড়ে তিন ঘণ্টা।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, কিন্তু কোন দিকে, তা বোঝা যাবে কী করে? মুর্শিদাবাদ-বহরমপুরের দিকে হতে পারে, দুর্গাপুরের দিকে কিংবা আসানসোল যেতেও ঘণ্টাচারেক লাগে। কোন দিকে খোঁজ করব?

কাকাবাবু বললেন, সবদিকেই। তবে আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে, বর্ধমান-দুর্গাপুরের মাঝামাঝি কোথাও হতে পারে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, কী করে আপনার এই সন্দেহ হল? আপনার চোখ বাঁধা ছিল বললেন—

কাকাবাবু বললেন, কী করে সন্দেহ হল, তা শুনলে হয়তো তোমরা হাসবে। অনেক ছোটখাটো জিনিস থেকেই বড় ব্যাপার জানা যায়। আমাকে যখন নিয়ে আসে, তখন সঙ্গের লোকেরা মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে এক জায়গা থেকে মিষ্টি কিনেছিল—

আলম ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল, ওরা জায়গাটার নাম বলেছিল?

কাকাবাবু বললেন, না, জায়গাটার নাম বলেনি। সেই মিষ্টি আমাকে একটা খেতে দিয়েছিল। সেটার স্বাদ আমার চেনা চেনা মনে হল। সেটা ল্যাংচা। কোথাকার ল্যাংচা বিখ্যাত?

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, শক্তিগড়ের।

কাকাবাবু বললেন, বর্ধমানের দিকে যারা গাড়িতে যাতায়াত করে, তারা অনেকেই শক্তিগড়ে গাড়ি থামিয়ে ল্যাংচা কেনে, তাই না?

আলম বললেন, আপনি চোখ-বাঁধা অবস্থায় একটা মিষ্টি খেয়েই বুঝে গেলেন, সেটা শক্তিগড়ের ল্যাংচা?

কাকাবাবু বললেন, আমি অনেকরকম বিখ্যাত মিষ্টি খেয়েই মোটামুটি বলে দিতে পারি কোথাকার তৈরি। হয়তো দু-একটা ভুলও হতে পারে। যাই হোক, বর্ধমানের দিকেই প্রথম খোঁজাখুঁজি শুরু করতে হবে। শোনো, এখন খুব জরুরি হচ্ছে দুটো ব্যাপার। সমস্ত খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোকে জানিয়ে দাও যে, আমরা ইলেকট্রনিক নোট বুকটা থেকে সমস্ত গুপ্ত সাংকেতিক লিপি উদ্ধার করে ফেলেছি, বিদেশি চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেছে। তাতে ওরা থমকে যাবে। আর শঙ্খচূড় যাতে নতুন কিছু শুরু করতে না পারে, তার ডেরাটা খুঁজে বার করতেই হবে।

মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আমি প্রেসে আর টিভি চ্যানেলগুলোয় এক্ষুনি খবর পাঠাবার ব্যবস্থা করছি।

কাকাবাবু বললেন, যে-গাড়িটা আমাকে নিয়ে এসেছিল, সেটাকে আটকানো যায়নি শেষ পর্যন্ত?

আলম বললেন, না, গেল না। দুটো লোক গুলি চালাতে লাগল, গাড়িটা দারুণ স্পিডে, একটা লোককে চাপা দিয়ে পালিয়েছে। তবে ওদের সঙ্গে বোধ হয় একটা কুকুর ছিল, সেটাকে গাড়িতে তোলার সময় পায়নি। সেটা সাঙ্ঘাতিক হিংস্র কুকুর, পাগলের মতন ছোটাছুটি করছিল ডালহৌসি স্কোয়ারে, লোকজন ভয়ে পালাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত দুজন ডগ ক্যাচারকে দিয়ে কুকুরটাকে ধরা হয়েছে।

কাকাবাবু দারুণ উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কুকুর? খুব বড় সাইজের কুকুর?  আলম বললেন, হ্যাঁ, ডোবারম্যান, দারুণ হিংস্র। ডাক শুনলে বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়।

কাকাবাবু বললেন, টবি, টবি! শঙ্কচুড়ের পোষা কুকুর। ওই কুকুরটাই তো ওর প্রভূর ডেরায় আমাদের পৌঁছে দিতে পারবে।

আলম বললেন, কুকুর, কি একশো-দুশো মাইল দূরের বাড়িও খুঁজে বার করতে পারে? সেটা বোধ হয় অসম্ভব!

কাকাবাবু বললেন, আপাতত শক্তিগড় পর্যন্ত তো গাড়িতে যাওয়া যাক!

 

আধঘণ্টার মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল।

মৃগাঙ্কমৌলী রয়ে গেলেন প্রেস কনফারেন্স ডাকার ব্যবস্থা করার জন্য। টবি

কুকুরকে নিয়ে কাকাবাবু আর আলম চাপলেন একটা স্টেশন ওয়াগনে। পেছন পেছন আর-একগাড়ি পুলিশ।

টবি আর সবাইকেই কামড়াতে যায়, কিন্তু কাকাবাবু তাকে একটু আদর করে দিলেই সে চুপ করে।

কাকাবাবু বললেন, ও একমাত্র আমাকেই চেনে এখন। এমনিতেই কোনও কুকুর আমাকে কামড়ায় না, ওরা বোঝে আমি কুকুর ভালবাসি।

আলম বললেন, আমিও কুকুর পছন্দ করি, কিন্তু ছোট কুকুর। এত বড় কুকুর দেখলে আমার ভয় লাগে।

কাকাবাবু বললেন, মজার ব্যাপার এই, কুকুরটাকে পাঠানো হয়েছিল আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য, এখন সে-ই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।

শক্তিগড় পৌঁছোতে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গেল। টবিকে নিয়ে কাকাবাবু গাড়ি থেকে নামলেন। টবি অমনই খুব জোরে ডাকতে ডাকতে চেন ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।

কাকাবাবু আলমকে বললেন, তা হলে শক্তিগড় পর্যন্ত ঠিকই এসেছি।

তিনি টবির চেন ছেড়ে দিলেন। টবি ছুটতে লাগল সামনের দিকে।

কাকাবাবু চট করে গাড়িতে উঠে পড়ে বললেন, ওকে ফলো করো, দেখা যাক, ও কোথায় যায়!

টবি সোজা ছুটল জি টি রোড ধরে।

কাকাবাবু বললেন, দ্যাখো আলম, টবি থামছে না, ডাইনে-বাঁয়ে বেঁকছে না, তার মানে ও এদিককার রাস্তাঘাট চেনে।

আলম বললেন, অদ্ভুত ওদের ঘ্রাণশক্তি।

কাকাবাবু বললেন, কিছু কিছু ব্যাপার মানুষও পারে না। কুকুর পারে। মানুষ বিশ্বাসঘাতক হয়, কুকুর হয় না। টবি ওর প্রভুকে খুঁজে বার করবেই।

বর্ধমানের কাছে এসে টবি শহরের দিকে গেল না। ছুটল বাইপাস ধরে।

আলম জিজ্ঞেস করলেন, একটা কুকুর কতক্ষণ ছুটতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, ঘণ্টা দু-এক তো পারবেই।

একসময় টবি বড় রাস্তা ছেড়ে ঢুকে পড়ল একটা ছোট রাস্তায়। দুটো গাড়ি যাচ্ছে তার পেছনে পেছনে কিছুটা দূরত্ব রেখে।

একদিকের আকাশ লাল হয়ে গেছে, একটু পরেই সূর্যাস্ত হবে।

হঠাৎ খানিক দূরে দুম দুম শব্দ হতে লাগল। সেইসঙ্গে বহু লোকের চিৎকার। সামনে খানিকটা জঙ্গলের মতন। তার পেছনে লাল আভা।

আর একটু এগোতেই দেখা গেল আগুনের শিখা।

অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা বাড়ি, তার সবটা জুড়ে জ্বলছে আগুন দাউ দাউ করে।

দেখলেই বোঝা যায়, হঠাৎ আগুন লাগেনি। খুব সম্ভবত ইচ্ছে করে আগুন লাগানো হয়েছে, কেউ নেভাবারও চেষ্টা করছে না।

কাকাবাবু বললেন, এটাই শঙ্খচূড়ের আস্তানা। সব পুড়িয়ে প্রমাণ নষ্ট করে দিচ্ছে!

আলম হতাশভাবে বললেন, যাঃ!

আগুন দেখে টবি থমকে দাঁড়িয়ে গেছে আর ডাকছে তারস্বরে।

আলম বললেন, আর কি শঙ্খচূড়কে ধরা যাবে?

কাকাবাবু বললেন, সে নানারকম ছদ্মবেশ ধরতে পারে।

আগুন দেখতে কাছাকাছি গ্রাম থেকে লোক ছুটে আসছে এদিকে। তার মধ্যে একটা মোটরবাইকের শব্দ শুনে কাকাবাবু ফিরে তাকালেন।

সেই বাইক চালাচ্ছে গগন সাহা। তার পেছনে সন্তু।

সন্তুই আগে বাইক থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে ছুটে এল কাকাবাবুর দিকে।

কাকাবাবু রীতিমতো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা এ সময়ে কী করে এখানে এলি?

সন্তু বলল, তোমাকে খুঁজতে।

কাকাবাবু বললেন, এই জায়গাটা চিনলি কী করে?

সন্তু বলল, এটাই তো শঙ্খচূড়ের ডেরা। গগনদা চিনিয়ে এনেছেন।

কাকাবাবু, সুকোমলকে আমরা উদ্ধার করেছি। আরও তিনজনকে। গগনদা সাহায্য করেছেন।

গগন কাছে এসে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, কাকাবাবু, আপনার কাছে আমার অপরাধের শেষ নেই।

কাকাবাবু বললেন, সেসব কথা পরে শুনব। এদিকে যে পাখি উড়ে গেল মনে হচ্ছে। কোনও চিহ্নও রাখল না।

হাওয়ায় সেই প্রচণ্ড আগুনের আঁচ খানিকটা দূর থেকেও টের পাওয়া যাচ্ছে।

আলম বললেন, এদিক দিয়ে আমরা কোনও গাড়ি যেতে দেখিনি। পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে যদি সে পালায়, তা হলে আমাদের এক্ষুনি ধাওয়া করা উচিত।

আলমের গাড়ির ড্রাইভার বলল, সার, আমি এদিকটা চিনি। এর পরে আর পাকা রাস্তা নেই। গ্রামের কাঁচা রাস্তা।

কাকাবাবু বললেন, সে রাস্তা দিয়েও সে পালাবার চেষ্টা করতে পারে। কিংবা ছদ্মবেশে গ্রামের লোকদের মধ্যে মিশে থাকতেও পারে। সে ভাল বাংলা জানে। কিংবা লোকটা হয়তো আসলে বাঙালি, আমার সঙ্গে ইচ্ছে করে বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে বাংলা বলছিল। পেছনের রাস্তাটায় যাওয়ার আগে টবিকে নিয়ে আর-একটা পরীক্ষা করা যাক।

টবি জ্বলন্ত বাড়িটার দিকে এগোচ্ছে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে যাচ্ছে।

কাকাবাবু একটা ক্রাচ ফেলে দিয়ে শুধু একটা ক্রাচ নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে টবির গলার চেনটা ধরলেন। তারপর তাকে টেনে নিয়ে চললেন সামনের দিকে।

আগুন দেখতে গ্রামের লোক একদিকে ভিড় করে আছে। জ্বলন্ত বাড়িটার একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে আট-দশজন নারী-পুরুষ। তাদের পোশাকও সাধারণ, তবু ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, তারা ঠিক এখানকার গ্রামের লোক নয়।

কাকাবাবু সেই দলটার দিকেই এগোতে এগোতে আলমদের বললেন, তোমরা আমার পেছনে পেছনে এসো!

অনেকটা কাছে গিয়ে কাকাবাবু টবির মাথায় চাপড় মেরে বললেন, গো টবি, গো টু ইয়োর মাস্টার!

তার চেনটা ছেড়ে দিতেই সে তীব্রবেগে ছুটে গেল, তারপর সেই দলটার মধ্যে একজন মহিলার পায়ের কাছে গিয়ে মাথা ঘষতে লাগল, লুটিয়ে পড়ে কুঁইকুই শব্দ করতে লাগল।

আলম কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, একজন মহিলা! এ কি শঙ্খচূড়ের বউটউ নাকি?

কাকাবাবু বললেন, বউ হোক বা না হোক, শঙ্খচূড়ের ঘনিষ্ঠ কেউ নিশ্চয়ই। নইলে সকলের মধ্যে শুধু এর কাছে গিয়েই টবি এরকম করত না। এ-মহিলাকে ধরে রাখতে হবে। এর কাছ থেকে অনেক কিছু জানা যাবে।

আলম রিভলভার তাক করে সেই মহিলাকে বললেন, ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। আপনি এগিয়ে আসুন।

মহিলাটি নাকি নাকি গলায় বলল, আমি কিছু জানি না। আমি আগুন দেখতে এসেছি। এই কুকুরটা কেন এরকম করছে, আমি বুঝতে পারছি না।

আলম বললেন, আপনি এগিয়ে আসুন, নইলে হাতকড়া পরাতে বাধ্য হব। আপনাকে থানায় যেতে হবে।

তখন সেই মহিলা মাথার ঘোমটা সরিয়ে ফেলে গম্ভীর পুরুষের গলায় বলল, খবরদার, কেউ আমার কাছে আসবে না। সবাই আমার পাশ থেকে সরে যাও!

কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, রায়চৌধুরী, আমাকে জীবন্ত ধরার সাধ্য কারও নেই। আমি কিছুতেই ধরা দেব না। ধরা দেওয়ার আগেই মরব। আমার গায়ে আর ডি এক্স বাঁধা আছে। আমাকে কেউ ছুঁলেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আমি যেমন খতম হয়ে যাব, তেমনই যে আমাকে ছোঁবে সেও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে!

কাকাবাবু তবু এক পা এগোলেন তার দিকে।

শঙ্খচূড় বলল, রায়চৌধুরী, তুমি একবার বেঁচে গেছ, এবার কিন্তু বাঁচবে না। যদি আমাকে ধরার চেষ্টা কর, তা হলে আমরা দুজনেই একসঙ্গে মরব। এত জোর বিস্ফোরণ হবে যে, এই পুলিশটুলিস এরাও কেউ বাঁচবে না।

কাকাবাবু বললেন, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না। যারা নির্মমভাবে অন্য মানুষ মারে, তারা নিজেরা মরতে ভয় পায়। তারা কাপুরুষ। তুমি নিজের গায়ে আর ডি এক্স বাঁধার ঝুঁকি নেবে না।

শঙ্খচূড় বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, তা হলে এসোই না, আমাকে ধরার চেষ্টা করে দ্যাখো! আমি এখনও সাবধান করে দিচ্ছি, এখান থেকে সরে যাও, আমাকে গাড়িতে উঠতে দাও।

হঠাৎ পেছন থেকে ছুটে এল গগন। সে কাকাবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কাকাবাবু, আপনারা পিছিয়ে যান, আমি ওকে ধরছি। যদি আমি মরি, তাতে ক্ষতি নেই। আপনারা সরে যান।

আলমের কাছ থেকে রিভলভারটা চেয়ে নিয়ে এক পা এক পা করে সে এগোতে লাগল শঙ্খচূড়ের দিকে।

শঙ্খচূড় বলল, তুই? তুই এসেছিস আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে। তুই কিছুতেই প্রাণে বাঁচবি না।

গগন বলল, আর আমাকে কী প্রাণের ভয় দেখাচ্ছ! আমি মরতে রাজি আছি। কিন্তু তোমাকেও আর বাঁচতে দেব না।

গগন একেবারে কাছাকাছি পৌঁছোতেই শঙ্খচূড়ের মুখ শুকিয়ে গেল। সে পেছন ফিরে দৌড় লাগাতেই গগন বাঘের মতন লাফিয়ে পড়ল তার ঘাড়ে।

কোনও বিস্ফোরণ হল না।

কাকাবাবু ঠিকই বলেছিলেন, এইসব নিষ্ঠুর খুনিরা নিজেরা মরতে ভয় পায়।

টবি গগনকে হিংস্রভাবে আক্রমণ করে কামড়াতে শুরু করেছিল, কাকাবাবু দ্রুত এসে তার চেনটা ধরে টেনে সরিয়ে নিলেন।

গগন রিভলভারের বাঁট দিয়ে শঙ্খচূড়ের মাথায় এমন মারতে শুরু করেছে যে, তার মাথাটা চৌচির হয়ে যেতে পারত, আলম এসে তাকে চেপে ধরে বললেন, ও কী করছেন, ও কী করছেন? ওকে আমরা জ্যান্ত ধরতে চাই।

শঙ্খচূড় ততক্ষণে অজ্ঞান হয়ে গেছে।