০৫. সুকোমলের বাবা নিখিল মাহাতো

সকালবেলাতেই সুকোমলের বাবা নিখিল মাহাতো এসে হাজির।

বেশ গড়াপেটা, কালো রঙের লম্বা চেহারা, ছেলের মতনই ইনিও খুব বিনীত আর ভদ্র, মুখে একটা লাজুক ভাব। দেখলে পুলিশ বলে মনেই হয় না।

কাকাবাবু ভোরেই উঠেছেন, দ্বিতীয় কাপ চা খাচ্ছেন বাগানে বসে।

আজ আকাশে মেঘ নেই।

নিখিল মাহাতো নমস্কার করে বললেন, সার, আপনার সব কথাই জানি, কিন্তু আপনার সঙ্গে আগে আমি দেখা করতে আসিনি ভয়ে।

কাকাবাবু বললেন, ভয়ে কেন?

নিখিল মাহাতো বললেন, পুলিশের সব বড় বড় কর্তাদের সঙ্গে আপনার চেনাশোনা। আই জি, ডি আই জিরা আপনার ভক্ত। আমি অতি সাধারণ অফিসার। আমি এসে আপনার সময় নষ্ট করতে চাইনি! এখন আসতেই হল।

একটা চেয়ার খালি পড়ে আছে, নিখিল মাহাতো তবু বসছেন না।

কাকাবাবু বললেন, বসুন! বসুন! আমি নিজে কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ।

চেয়ারে বসে, পকেটে হাত দিয়ে একটা কাগজ বার করে নিখিল মাহাতো শুকনো গলায় বললেন, বিশেষ কাজে বারাসত গিয়েছিলাম, ফিরেছি অনেক রাতে। তার আগেই ডাকবাক্সে কেউ এই চিঠিটা দিয়ে গেছে।

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে চিঠিটা নিলেন। কাগজটার চারপাশে মোটা, কালো বর্ডার দেওয়া। ওপরের ডান দিকের কোণে একটা মানুষের খুলির ছাপ। ভেতরে গোটা গোটা অক্ষরে হাতে লেখা :

তোমার ছেলে সুকোমলের কোনও ক্ষতি হবে না। ৭ তারিখ রাত নটার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে এলে তাকে ফেরত পাবে। মাঝনদীতে নৌকো নিয়ে একজনমাত্র লোক টাকা নিয়ে আসবে। আমাদের নৌকো থেকে টর্চ জ্বালিয়ে সিগন্যাল দেওয়া হবে নদীর ঠিক বাঁকের মুখে। টাকা না পেলে কিংবা পুলিশ দিয়ে ঘেরাওয়ের চেষ্টা করলে ছেলের দায়িত্ব আমাদের নয়। আর কেউ যেন এর মধ্যে কেরানি দেখিয়ে নাক গলাতে না আসে। আমরা নজর রাখছি। টাকা দে, তা হলে ছেলে পাবি, না হলে পাবি না।

ইতি—
শঙ্খচুড়

চিঠিটা টেবিলের ওপর রেখে কাকাবাবু বললেন, লেখাটা দেখলে মনে হয়, কোনও লেখাপড়া জানা লোকই ইচ্ছে করে খারাপভাবে লিখেছে।

নিখিল মাহাতো বললেন, একেবারে অশিক্ষিত চোর-ডাকাতরা এসব কাজ করে না। আগের কয়েকটা কেসে দেখা গেছে, এর মধ্যে চেনাজানা লোকরাও জড়িত থাকে।

কাকাবাবুর মনে পড়ল, সুকোমলের খবরটা শুনে গগন সাহা প্রথমেই চিঠির কথা বলেছিল। চিঠি যে আসবে, সে জানত। যারা এ চিঠি পাঠিয়েছে তাদেরও হয়তো সে চেনে!

নিখিল মাহাতো দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন।

একজন পুলিশ অফিসারকে এরকম ভাবে কেঁদে ফেলতে কখনও দেখা যায় না। কিন্তু এখন তো তিনি পুলিশ নন, একটি ছেলের বাবা।

অন্য কাউকে কাঁদতে দেখলে কাকাবাবুরও চোখে জল এসে যায়। তিনি অন্যদিকে মুখ ফেরালেন।

একটু পরেই নিখিল মাহাতো রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, মাফ করবেন, হঠাৎ দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। এখন কী করি বলুন তো সার? আমার পাঁচ লাখ টাকা নেই। সে তো অনেক টাকা। তবু যদি ধরুন আমার স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে ধার করে টাকাটা জোগাড় করাও যায়, তবু তো সেভাবে আমি ছেলেকে ছাড়িয়ে আনতে পারব না। আমি সরকারি কাজ করি। এভাবে মুক্তিপণ দেওয়ায় সরকারের নিষেধ আছে, আমাকে ওপরওয়ালাদের কাছে জানাতেই হবে।

কাকাবাবু ওঁর মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

নিখিল মাহাতো আবার বললেন, মুশকিল হয়েছে কী জানেন, আমার স্ত্রী দারুণ কান্নাকাটি করছেন। পুলিশের সাহায্য নিতে তাঁর ঘোর আপত্তি। মাস দু-এক আগে এরকম একটা কেস হয়েছিল, পুলিশ খোঁজখবর পেয়ে একটা বাড়ি ঘিরে ফেলল। তারপর দেখা গেল, বদমাশগুলো ছেলেটার গলা টিপে মেরে রেখে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, একটা ব্যাপারে খটকা লাগছে। সাধারণত দেখা যায়, খুব বাচ্চা ছেলেদেরই কিডন্যাপ করা হয়। ফিরে এসে তারা বিশেষ কিছু বলতে পারে না। তেরো-চোদ্দো বছরের ছেলেকে আটকে রাখাও তো মুশকিল। সন্তুকে এই বয়েসে কয়েকবার ধরে নিয়ে গিয়েছিল, ও নিজেই পালিয়ে এসেছে!

নিখিল মাহাতো বললেন, আপনার ভাইপো সন্তু সম্পর্কেও সবাই জানে। তার মতন সাহসী ছেলে কজন হয়? আমার ছেলেকে তো দেখেছেন, স্বভাবটা খুব নরম। এখন আপনি সাহায্য না করলে ওকে উদ্ধার করা যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, নিখিলবাবু, আমি কী সাহায্য করব বলুন তো। আমি বনেজঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে বেড়াতে ভালবাসি, চোর-ডাকাত ধরার ক্ষমতা তো আমার নেই। ওসব তো আপনাদেরই কাজ।

নিখিল মাহাতো বললেন, আপনি অনেক কিছুই পারেন।

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, তা ঠিক নয়। লোকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে ভাবে। তা ছাড়া এই চিঠির মধ্যে আমার সম্পর্কে ইঙ্গিত আছে। আর কেউ যেন এর মধ্যে কেরানি দেখিয়ে নাক গলাতে না আসে। এই আর কেউ বলতে বোধ হয় আমাকেই বোঝাচ্ছে।

এইসময় জোজো দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, কাকাবাবু, একবার পুকুরধারে আসুন। শিগগিরই!

জোজোর গলায় আওয়াজ শুনে মনে হল, সে খুবই উত্তেজিত, আর কোনও কারণে ভয় পেয়েছে।

বাড়ির পেছন দিকে একটা পুকুর। খুব বড় নয়। একদিকে বাঁধানো ঘাট। আর একদিকে কয়েকটা তালগাছ।

জোজোর সঙ্গে নিখিল মাহাতো আর কাকাবাবু তাড়াতাড়ি পুকুরের কাছে এসে দেখলেন, ঘাটের একটা সিঁড়িতে চিত হয়ে শুয়ে আছে সন্তু। হাত-পা ছড়ানো।

দেখলে প্রথমেই মনে হয়, তার প্রাণ নেই।

কাকাবাবু থমকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে, জোজো?

জোজো ফ্যাকাশে মুখে বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না। পুকুরে লাল রঙের একটা বল ভাসছিল। সন্তু জলে নেমে সেটা তুলতে গেল। আমি ওদিকের একটা গাছে অনেক কামরাঙা হয়েছে, কয়েকটা পাড়তে গেলাম। হঠাৎ ফটাস করে একটা শব্দ হল! কীসের শব্দ বুঝতেই পারিনি। সন্তুকে ডাকলাম দুবার। কোনও সাড়া না পেয়ে দৌড়ে এসে দেখি, সন্তু এইভাবে পড়ে আছে। কেউ গুলি করেছে?

কাকাবাবু জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে বললেন, কীসের যেন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না!

নিখিল মাহাতো বললেন, হ্যাঁ, মনে হচ্ছে কোনও গ্যাসের গন্ধ।

কাকাবাবু বললেন, আপনারা দাঁড়ান। আগে আমি দেখি—

পকেট থেকে রুমাল বার করে জোজোকে বললেন, এটা ভিজিয়ে নিয়ে এসো তো! ঘাটের কাছে যেয়ো না। অন্য জায়গা থেকে।

জোজো ছুটে গিয়ে সেই রুমালটা ভিজিয়ে আনল।

কাকাবাবু সেটা মুখে বেঁধে, নাকচাপা দিয়ে এগিয়ে গেলেন। ক্রাচ নামিয়ে রেখে হাঁটু গেড়ে বসলেন সন্তুর পাশে।

তার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন, কোথাও রক্ত নেই, গুলির চিহ্ন নেই, ক্ষতও নেই। পাশে পড়ে আছে একটা লাল রঙের ফাটা বল।

কাকাবাবু শান্তভাবে দুবার ডাকলেন, সন্তু, সন্তু!

সন্তুর দুচোখ বোজা।

কাকাবাবু এবার নিজের নাক থেকে ভিজে রুমালটা খুলে ফেলে সেটা দিয়ে সন্তুর চোখ মুছে দিতে লাগলেন।

জোজো আর নিখিল মাহাতো কৌতূহল সামলাতে না পেরে এগিয়ে এসেছে। কাছে।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, রুমালটা আবার ভিজিয়ে আনন।

সেই ভিজে রুমাল দিয়ে সন্তুর মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে কাকাবাবু আবার ডাকলেন, সন্তু, সন্তু!

একটু পরেই সন্তু চোখ মেলে তাকাল।

জোজো বলল, উঃ বাবা, বাঁচলুম! সন্তু ধড়মড় করে উঠে বসে বলল, কী হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, এক্ষুনি উঠিস না। আর একটু শুয়ে থাক। তুই জল থেকে একটা লাল বল তুলে এনেছিলি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, বলটা জলে ভাসছিল। ঘাটের কাছেই। আমি সেটা তুলে আনতেই ফটাস করে ফেটে গেল আর ভেতর থেকে বিশ্রী ধোঁয়া বেরুতে লাগল।

নিখিল মাহাতো বললেন, বলটার মধ্যে গ্যাস ভরা ছিল। পুকুরে এরকম একটা বল এল কী করে?

জোজো চেঁচিয়ে উঠল, ওই যে, আর একটা। আর একটা!

কাকাবাবুরা মুখ তুলে তাকালেন। সত্যিই পুকুরে আর একটা লাল রঙের বল ভাসছে। পাঁচ নম্বরি ফুটবলের মতন। তবে সেটা ঘাট থেকে অনেকটা দূরে, প্রায় মাঝখানে।

সন্তু বলল, আগের বলটা ঠিক এইরকমই ছিল।

নিখিল মাহাতো বললেন, এরকম বল আমরা আগে এদিকে কোথাও দেখিনি।

কাকাবাবু বললেন, এরকম গ্যাসভরা বল তো এখানে ভাসতে দেওয়া যায়। অন্য কেউ দেখলেই ওটা ধরতে যাবে। সন্তু ঘাটের ওপর তুলে আনার পর ওটা ফেটেছে। তাই বেঁচে গেছে। অন্য কেউ যদি মাঝপুকুরে সাঁতরে গিয়ে ওটা ধরতে চায়, তখন ফেটে গেলে তো সে অজ্ঞান হয়ে জলে ড়ুবে যাবে।

নিখিল মাহাতো বললেন, ওটাকে আগেই ফাটিয়ে দেওয়া দরকার।

জোজো বলল, আমি এক্ষুনি ফাটিয়ে দিচ্ছি।

সে একটা ইটের টুকরো ছুড়ে মারল। লাগল না, সেটা চলে গেল বলটার অনেক ওপর দিয়ে।

নিখিল মাহাতোও একটা ঢিল ছুড়লেন, লাগাতে পারলেন না।

জোজো বলল, এখানে ভাল ঢিল নেই। একটা গুলতি পেলে আমি একবারেই—

কাকাবাবু নিখিল মাহাতোকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার সঙ্গে রিভলভার নেই?

নিখিল মাহাতো বললেন, না, সার, সঙ্গে আনিনি।

কাকাবাবু বললেন, জোজো, আমার ড্রয়ার থেকে রিভলভারটা নিয়ে এসো তো?

জোজো দৌড়ে চলে গেল।

সন্তু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তার মাথাটা এখনও ঝিমঝিম করছে।

বলটা ভাসছে পুকুরের জলে। দুলছে একটু একটু। দুটো ফড়িং সেটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে।

জোজো রিভলভারটা নিয়ে ফিরে এল।

কাকাবাবু সেটা হাতে নিয়ে টিপ করে ট্রিগারে আঙুল দিলেন।

সঙ্গে সঙ্গে ফেটে গেল বলটা। ভুস ভুস করে সেটা থেকে বেরোতে লাগল ধোঁয়া।

নিখিল মাহাতো মুগ্ধভাবে কাকাবাবুকে বললেন, দারুণ! একবারেই হিট।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এটা কী হল? আমি তো গুলি চালাইনি। ট্রিগার টেপার আগেই ওটা নিজে নিজে ফেটে গেল।

নিখিল মাহাতো অবাক হয়ে বললেন, নিজে নিজে ফেটে গেল? ঠিক এই মুহূর্তে!

পুকুরের ওপারে ঝোপের আড়াল থেকে কে যেন হেসে উঠল বিশ্রীভাবে হিহি করে।

তারপরই শোনা গেল একটা মোটর বাইকের স্টার্ট দেওয়ার শব্দ। কালো জামা পরা একজন লোক পুকুরের ওপাশের রাস্তা দিয়ে সেই বাইকে চেপে চলে গেল হুস করে।

জোজো আর নিখিল মাহাতো খানিকটা দৌড়ে গিয়েও লোকটিকে দেখতে পেল না ভাল করে।

কাকাবাবুর হাতে রিভলভার, তিনি ইচ্ছে করলে গুলি চালাতে পারতেন। কিন্তু শুধু হিহি করে হেসেছে বলেই তো একটা লোককে গুলি করে মারা যায় না।

তিনি সন্তুর হাত ধরে তুলে দাঁড় করিয়ে বললেন, এখন ঠিক আছিস তো?

সন্তু দুবার মাথাটা ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিক হয়ে গেছে। শুধু একটু বমি বমি ভাব হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, ভেতরে গিয়ে অনেকটা জল খেয়ে নে। তার পরেও যদি বমি পায়, বমি করে নিবি।

তিনি ফাটা লাল বলটা তুলে নিয়ে বললেন, এটার ভেতরে কী গ্যাস ছিল, পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

নিখিল মাহাতো ফিরে এসে বললেন, লোকটা পুকুরের ওপাশে কেন লুকিয়ে বসে ছিল, তা কিছুই বোঝা গেল না।

জোজো বলল, লোকটার মুখে মুখোশ পরা ছিল।

নিখিল মাহাতো বললেন, মুখোশ? আমরা তো শুধু পিঠের দিকটা দেখলাম!

জোজো বলল, একবার মুখ ফিরিয়েছিল। ওর হাতে একটা মোবাইল ফোন ছিল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, মোবাইল ফোন? তুমি ঠিক দেখেছ?

জোজো বলল, আমি কিছু ভুল দেখি না!

কাকাবাবু নিখিল মাহাতোকে বললেন, কাল থেকে একটা মোটরসাইকেল আমাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। এখানে কার কার মোটরসাইকেল আছে, খবর নিতে পারবেন? গগন সাহার একটা আছে জানি।

নিখিল মাহাতো বললেন, আরও বেশ কয়েকজনের আছে। এসব জায়গায় যারা হঠাৎ বড়লোক হয়, তারা আগে গাড়ি কেনে না, মোটরসাইকেল কেনে। মোটরসাইকেল বিকট আওয়াজ করে পাড়া কাঁপিয়ে যায়, সবাই তাকিয়ে দেখে, তাতেই মালিকের গর্ব হয়। আপনি গগন সাহাকে চেনেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কাল রাত্তিরে আলাপ হয়েছে।

নিখিল মাহাতো বললেন, গগন সাহা আজ সকালেই এসে ডায়েরি করে গেছে, তার মোটরসাইকেলটা চুরি হয়েছে।