০৩. সংক্ষেপে বি-বা-দী বাগ

যদিও নতুন নাম হয়েছে বিনয়বাদল-দীনেশ বাগ, সংক্ষেপে বি-বা-দী বাগ, তবু লোকের মুখে-মুখে এখনও ডালহৌসি স্কোয়ার নামটাই চলে। ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে চলে গেছে কত বছর আগে, এখনও রয়ে গেছে তাদের অনেক চিহ্ন।

দিনের বেলায় এই অফিসপাড়ায় কত ব্যস্ততা থাকে, কত মানুষজন, কত গাড়ি, কতরকম আওয়াজ। সন্ধের পর ফাঁকা, একেবারে শুনশান। একটা বেশ মস্তবড় চাঁদ উঠেছে। লালদিঘির জলেও সেই চাঁদটা দুলছে।

অফিসবাড়িটা খুঁজে পেতে দেরি হল না। পুরো বাড়িটা অন্ধকার, শুধু আলো জ্বলছে পেছনের কেয়ারটেকারের ঘরে।

সেখানে দরোয়ান-টরোয়ান আরও কয়েকজন থাকে। সামনের ছোট বারান্দায় একটা তোলা উনুনে রুটি সেঁকছে একজন, তার খালি গায়ে মোটা পৈতে।

একসঙ্গে এতজনের একটা দল আসতে দেখে সে লোকটি কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইল।

কাছে এসে কাকাবাবু বললেন, রুটি সেঁকার গন্ধটা চমৎকার লাগে। তুমিই মাখনলাল নাকি?

লোকটি নিঃশব্দে দু দিকে মাথা নাড়ল।

কাকাবাবু বললেন, মাখনলাল থাকে তো এখানে? সে কোথায়? লোকটি এবারেও মুখে কিছু না বলে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বারান্দার কোণের ঘর।

সে ঘরের দরজায় এর মধ্যেই একজন এসে দাঁড়িয়েছে।

এই লোকটিরও খালি গা, বেশ একখানা ভুঁড়ি আছে। মাঝবয়েসি, মালকোঁচা মেরে ধুতি পরা, তাকিয়ে আছে ভুরু কুঁচকে।

এগিয়ে গিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই মাখনলাল?

লোকটি বলল, হ্যাঁ, আপনারা কোথা থেকে আসছেন?

কাকাবাবু বললেন, ভবানীপুর থেকে। কিংবা লালবাজার থেকেও বলতে পারো। বিমল তোমার কে হয়?

মাখনলাল বলল, কে বিমল? অনেক বিমল আছে।

বিমল দুবে, পুলিশে কাজ করে। তার বোনকে তুমি বিয়ে করোনি?

ও সেই বিমল। হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

সে কি মাঝে-মাঝে আসে তোমার এখানে?

না তো! তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

কেন, ঝগড়া হয়েছে নাকি?

এসব কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন? সে কিছু করেছে? আমি অনেকদিন তার কোনও খোঁজখবর রাখি না।

দু-একদিনের মধ্যে সে তোমার কাছে আসেনি?

না।

তুমি দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আমরা একটু ভেতরে গিয়ে বসব। জল খাব। তোমার সঙ্গে আরও কথা আছে।

আসুন।

লোকটি সরে দাঁড়াল।

ঘরটা বেশ বড়। একপাশে একটা চৌকি পাতা। শুধু একটা মোড়া ছাড়া আর কোনও বসার জায়গা নেই। ক্যালেন্ডার থেকে কাটা অনেক ঠাকুর-দেবতার ছবি দেয়ালে সাঁটা রয়েছে। থালা বাসন, হাঁড়িকুড়ি ঘরের এককোণে জড়ো করা। তার পাশে একটা আলনায় ঝুলছে জামাকাপড়।

ঘরের চারদিকে চোখ বুলোতে বুলোতে কাকাবাবু বললেন, কই হে, এক। গেলাস জল খাওয়াও!

লোকটি কুঁজো থেকে একটা কাঁসার গেলাসে জল গড়িয়ে এনে দিল।

কাকাবাবু গেলাসটা নেওয়ার সময় লক্ষ করলেন, মাখনলালের হাত একটুএকটু কাঁপছে।

জলে একটিমাত্র চুমুক দিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বউ থাকে এখানে?

মাখনলাল বলল, থাকে, এখন নেই।

কোথায় গেছে? বাপের বাড়ি?

না। হাসপাতালে আছে। তার টাইফয়েড হয়েছে।

কোন হাসপাতালে? যেখানে বিমল দুবে পাহারায় ছিল?

বিমল কোথায় পাহারায় ছিল, তা আমি জানি না।

তোমার বউ কোন হাসপাতালে আছে?

পি জি।

কাকাবাবু রফিকুলের দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচালেন? তিনি মাথা নাড়লেন দুবার।

কাকাবাবু সন্তুদের জিজ্ঞেস করলেন, তোরা কেউ জল খাবি? আর কারও তেষ্টা পায়নি।

কাকাবাবু হঠাৎ আলনার পাশের একটা বড় মাটির জালার দিকে ক্রাচটা তুলে বললেন, এটার মধ্যে কী আছে?

মাখনলাল বলল, চাল, শস্তার সময় আমি চাল কিনে রাখি।

কাকাবাবু সেটার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি বুঝি রুটির চেয়ে ভাত বেশি পছন্দ করো?

মাখনলাল বলল, আমি দুবেলাই ভাত খাই। আমার বউও ভাত ভালবাসে।

কাকাবাবু বললেন, বেশ, আমিও ভাত ভালবাসি৷ সেদ্ধ চাল, না আতপ চাল?

খানিকটা চাল তিনি তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন। মাখনলালের দিকে তাকিয়ে যেন অকারণেই হাসলেন একটু।

তারপর সন্তকে বললেন, এটার মধ্যে হাত ড়ুবিয়ে দেখ তো, চাল ছাড়া আর কী আছে?

মাখনলাল সন্তুকে বাধা দিতে আসতেই তিনি ক্রাচটা তুলে তার মুখের সামনে আটকালেন।

সন্তু জালাটার মধ্যে অনেকখানি হাত ঢুকিয়ে একটা কাগজের প্যাকেট বার করে আনল। তার মধ্যে গোছা-গোছা টাকা।

কাকাবাবু হাসিটা চওড়া করে বললেন, কী করে বুঝলাম বলো তো রফিকুল? মাখনলালের হাত কাঁপছে আর বারবার এই জালাটার দিকে না তাকিয়ে পারছিল না।

রফিকুল বললেন, সেটা আমিও লক্ষ করেছি। ওর ভাবভঙ্গি দেখেই বোঝা গিয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, ওহে মাখনলাল, তোমার তো দেখছি অনেক টাকা। ব্যাঙ্কে না রেখে চালের মধ্যে রেখেছ কেন? তাতে কি ভাতের স্বাদ আরও ভাল হয়?

মাখনলালের মুখোনা শুকিয়ে গেছে। সে কোনও কথা বলতে পারল না।

সবই পাঁচশো টাকার নোট। অন্তত পঁচিশ-তিরিশ হাজার টাকা হবেই।

রফিকুল এগিয়ে এসে মাখনলালের কাঁধে হাত রেখে বন্ধুর মতন জিজ্ঞেস করলেন, এগুলো তোমার নিজের টাকা, না কেউ রাখতে দিয়েছে?

মাখনলাল বলল, আমার নয় … ও টাকা …ওখানে কে রেখেছে, আমি জানিনা!

এবারে রফিকুল ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দারুণ ধমক দিয়ে বললেন, ফের মিথ্যে কথা বলছিস? ভূতে এসে তোর ঘরে টাকা রেখে গেছে?

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তা হলে তো ভালই হল। ও বলছে। টাকাটা ওর নয়, কে রেখে গেছে তাও জানে না। তা হলে টাকাগুলো আমরাই নিয়ে যেতে পারি!

রফিকুল মাখনলালকে বললেন, বিমল দুবের সঙ্গে তোর পি জি হাসপাতালে দেখা হয়নি?

মাখনলাল বলল, আমি তার সঙ্গে কথা বলি না।

ঝগড়া হয়েছে? তোর বউ কথা বলে?

সে বলতে পারে।

টাকাটা বিমল তোকে কিংবা তোর বউকে রাখতে দিয়েছে, তাই না? সত্যি করে বল?

কাকাবাবু হঠাৎ বলে উঠলেন, দরজার কাছ থেকে কে সরে গেল? ধরো তো লোকটাকে।

সন্তু আর জোজো ছুটে বেরিয়ে গেল।

সত্যিই একজন লোক দৌড়ে পালাচ্ছে। ওরা দুজন আরও জোরে ছুটে জাপটে ধরল লোকটাকে। সে দুহাতে ঘুসি চালাতে লাগল।

রফিকুলও বেরিয়ে এসেছেন। কড়া গলায় বললেন, এই, এদিকে আয়। হাত দুটো তুলে রাখ।

লোকটি সঙ্গে সঙ্গে সন্তুদের ছেড়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়াল আর পায়ে পা ঠুকে। স্যালুট করল রফিকুলকে।

রফিকুল জিজ্ঞেস করলেন, এই, পালাচ্ছিলে কেন?

লোকটি বলল, সার, আপনাকে দেখে ভয় পেয়েছিলাম।

তোমার নাম বিমল দুবে?

ইয়েস সার।

মাখনলাল তোমার ভগ্নিপতি?

ইয়েস সার।

মাখনলাল যে বলল, তোমার সঙ্গে তার ঝগড়া? তবু তুমি এখানে এসেছিলে কেন?

আমার বোনের অসুখ, তার খবর নিতে এসেছিলাম।

ঘরের মধ্যে চলো। এবার আসল কথাটা বলো। তুমি ঘুষ খেয়ে হাসপাতালের বন্দিদুটোকে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছ?

ঘুষ? না, সার, আমাকে কেউ ঘুষটুস দেয়নি। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সেটা আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমার ঘুমের মধ্যে আসামিদুটো পালিয়েছে।

তা হলে এই টাকাগুলো এখানে এল কী করে? আমার বোন ওই একই হাসপাতালে আছে। সে বলেছিল, কে যেন তার বিছানায় একটা টাকার বাণ্ডিল ফেলে গেছে। আমার বোন জিজ্ঞেস করেছিল, টাকাটা দিয়ে কী হবে? আমি বলেছিলাম, সে তোমরা যা ইচ্ছে করতে পারো।

আমি কিছু জানি না!

মাখনলাল এবার চেঁচিয়ে বলে উঠল, মিথ্যে কথা! সার, ও টাকা আমি ছুঁইনি। কিছুই জানি না। ওই নিশ্চয়ই কখনও এসে টাকাটা এখানে লুকিয়ে রেখে গেছে।

বিমলও আরও জোরে বলে উঠল, বাজে কথা! আমি সাত দিনের মধ্যে এ বাড়িতে আসিনি!

মাখনলাল বলল, তুই পরশুই এসেছিলি। আমি তখন গোসল করতে গিয়েছিলাম, দরজা খোলা ছিল।

বিমল আরও কিছু বলতে গেলে কাকাবাবু হাত তুলে বললেন, চুপ! দুজনের মিথ্যে কথা বলার প্রতিযোগিতা আমরা দেখতে চাই না। কী হয়েছে, আমরা বুঝে গেছি। বিমল, এই দেওয়ালের কাছে এসে দাঁড়াও, আমার দিকে তাকিয়ে থাকো, চোখের পলক ফেলবে না। আমার একটা অন্য খবর জানা দরকার। যা জিজ্ঞেস করছি, সত্যি উত্তর দেবে।

কাকাবাবু বললেন, জোজো ঠিকই বলেছে। পরশু রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।

হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে তিনি বললেন, কাল কেন, আজই এখন গিয়ে দেখা যেতে পারে। হাসপাতালের পাশে, ভাতের হোটেল, খুঁজে পাওয়া শক্ত হবে না।

বিমলের চোখে-মুখে জলের ছিটে দিতেই সে ধড়মড় করে উঠে বসল। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়ার মতন বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

কাকাবাবু বললেন, অনেক কিছু হয়েছে। আপাতত কয়েকদিন তোমায় থানায় বন্দি থাকতে হবে।

দেবলীনা এর পরেও বারাসতে যাওয়ার জন্য আবদার ধরল, কাকাবাবু তা গ্রাহ্য করলেন না। জোজোকে বললেন ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।

তারপর বিমলকে কাছাকাছি একটা থানায় জমা দিয়ে রফিকুলের গাড়ি ছুটল বারাসতের দিকে।