০১. খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে

খবরের কাগজটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, অপদার্থ! ঘরে আর কেউ নেই, তবু তিনি যেন সামনে কাউকে বকছেন, এইভাবে ধমক দিয়ে আবার বললেন, যতসব অপদার্থের দল! ছি, ছি!

সন্তু তিনতলার ঘর থেকে নেমে আসছে সিঁড়ি দিয়ে, কাকাবাবুর গলা শুনে থমকে দাঁড়াল। কে এসেছে এখন? কাকাবাবু ঘুমের মধ্যে কথা বলেন সে জানে, কিন্তু এখন তো ঘুমের সময় নয়।

সে উঁকি দিল দরজার কাছে এসে।

তাকে দেখতে পেয়ে কাকাবাবু বললেন, দেখেছিস কী কাণ্ড? ওরা দুজনে পালিয়েছে।

সন্তুর ভুরুদুটো একটু কুঁচকে গেল। ওরা মানে কারা?

কাকাবাবু মেঝে থেকে খবরের কাগজটা কুড়িয়ে নিয়ে বললেন, পড়ে দ্যাখ। প্রথম পাতাতেই বেরিয়েছে।

খবরটা পড়েও সন্তুর বিস্ময় কমল না। হাসপাতাল থেকে দুই কয়েদি উধাও! গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় দুজন কয়েদিকে জেলহাজত থেকে পাঠানো হয়েছিল একটা হাসপাতালে, একজন পুলিশ তাদের পাহারাতেও ছিল, কিন্তু সেই পুলিশটির চোখে ধুলো দিয়ে আসামি দুজন পালিয়ে গেছে। তাদের নামও অদ্ভুত, ভাংলু আর ছোটগিরি।

এরকম তো মাঝে-মাঝেই হয়, কাকাবাবু হঠাৎ এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? ওই দুজন কয়েদির নাম আগে শোনেনি সন্তু। কাকাবাবু ওদের ধরেননি। এরকম ছোটখাটো ঘটনা নিয়ে মাথাও ঘামান না কাকাবাবু। সাধারণ চোর-ডাকাত ধরা তাঁর কাজ নয়।

কাকাবাবু বেশ রেগে আছেন বোঝা যায়। রাগ হলে তিনি তাঁর থুতনিতে চিমটি কাটেন।

আপন মনে আবার বললেন, পুলিশগুলো হয়েছে যত নিষ্কর্মার দল।

মুখ তুলে সন্তুকে বললেন, দ্যাখ তো রফিকুলকে ফোনে পাওয়া যায় কিনা! এখনও হয়তো বাড়ি থেকে বেরোয়নি!

রফিকুল আলম সদ্য ডি আই জি হয়েছেন, বড় বড় অপরাধীদের তাড়া করে বেড়ান। কাকাবাবুর খুব ভক্ত। এ-বাড়িতে প্রায়ই আসেন। মানুষটিকে দেখতে যেমন ভাল, কথাবার্তাও তেমনই ঝকঝকে।

এখন টেলিফোনে কাউকে পাওয়া খুব সহজ। এরকম বড়বড় অফিসারদের সবার কাছেই মোবাইল ফোন থাকে, বাড়িতে বা অফিসে বা চলন্ত গাড়িতেও কথা বলা যায়। রফিকুল আলমের মোবাইল ফোনের নম্বরে রিং হতেই সন্তু তাদের কর্ডলেস ফোনটা কাকাবাবুর হাতে দিল। সে ধরেই নিল, আলমদা খুব ধমক খাবেন।

কাকাবাবু কিন্তু নরম আর বিনীত গলায় বললেন, আদাব, রফিকুল আলমসাহেব। আপনাকে অসময়ে বিরক্ত করলাম। আপনার কি দু মিনিট কথা বলার সময় হবে?

রফিকুল বেশ হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, আপনি কে কথা বলছেন? কাকাবাবু তো?

কাকাবাবু বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী।

রফিকুল বললেন, নমস্কার সার। আপনি হঠাৎ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, আপনারা ব্যস্ত মানুষ, আমি একজন রিটায়ার্ড সাধারণ লোক। তবু দু মিনিট যদি কথা বলার সুযোগ দেন!

রফিকুল বললেন, কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই কোনও কারণে আমার ওপর রেগে গেছেন!

না, না, রাগের কী আছে।

আমি আসছি আপনার কাছে।

না, না, আসতে হবে না, আসতে হবে না। শুধু দুটো কথা জিজ্ঞেস করব।

আমি বেশি দূরে নেই। পার্ক স্ট্রিটে। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে যাব।

বলছি তো আসতে হবে না। আমার কাছে এসে কেন সময় নষ্ট করবেন?

আমি আপনার সময় নষ্ট করতে চাই।

কাকাবাবু আর কিছু বলার আগেই রফিকুল ফোন বন্ধ করে দিলেন।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই ভাংলু আর ছোটগিরি কে?

কাকাবাবু আবার গলার আওয়াজ বদলে ফেলে রাগের সুরে বললেন, কে আবার! দুটো মানুষ! কিংবা অমানুষও বলা যেতে পারে। সন্তু বুঝে গেল, এখন আর বিশেষ কিছু জানা যাবে না।

সে আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখন কফি খাবে?

কাকাবাবু দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ওই ছোকরা আসুক, মিনিট পনেরো পরে দুকাপ কফি পাঠিয়ে দিতে বলো!

সন্তু নীচে নেমে গেল।

ব্যাপারটা সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

তার মনটা কৌতূহলে ছটফট করছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে কাকাবাবু ইজিপ্টের একটা ম্যাপ নিয়ে খুব মেতে ছিলেন। সেখানে কোনও জায়গায় মাটির তলায় খুব প্রাচীনকালের একটা বিশাল কবরখানা সদ্য আবিষ্কার করা হয়েছে। এমন কয়েকটা মূর্তিও পাওয়া গেছে, যেরকম দেখা যায়নি আগে।

ইজিপ্টের সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন কাকাবাবুকে, আর পাঁচদিন পর কাকাবাবুর কায়রো যাওয়ার কথা, সন্তুও সঙ্গে যাবে, সব ঠিকঠাক। এর মধ্যে হঠাৎ ভাংলু আর ছোটগিরি এরকম অদ্ভুত নামের দুজন কয়েদিকে নিয়ে কাকাবাবু হঠাৎ এত মাথা ঘামাচ্ছেন কেন?

ভাংলু আর ছোটগিরি! খবরের কাগজে দেখা যায়, চোর-ডাকাতদের নামই এইরকম হয়, ছেনো, ল্যাংড়া, ছগুলাল, খোঁচন…। ওরা কি ইচ্ছে করে নিজেদের এইসব খারাপ নাম দেয়?

সন্তু বসবার ঘরে এসে দেখল, তার মায়ের সঙ্গে গল্প করছে দেবলীনা।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই কখন এলি?

সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দেবলীনা বলল, এই, তুই মুখোনা ওরকম বেগুনভাজার মতন করে আছিস কেন রে?

সন্তু বলল, তুই একদিন একটা বেগুনভাজাকে জিজ্ঞেস করিস, তোমার মুখটা চাঁদের মতন নয় কেন?

মা হাসতে হাসতে বললেন, ও মা, সন্তু, তুই মেনে নিলি যে তোর মুখোনা বেগুনভাজার মতন?

দেবলীনা বলল, আয়নার সামনে দাঁড়ালে ও নিজেই তো দেখতে পায়।

মা বললেন, আমার ছেলের মুখোনা না হয় তোর মতন এত সুন্দর নয়, তা বলে তুই ওকে বেগুনভাজা বলে কষ্ট দিবি?

দেবলীনা বলল, আমার বাবা শিখিয়েছেন, কানাকে কানা বলতে নেই, খোঁড়া লোককে খোঁড়া বলতে নেই, কিন্তু বেগুনভাজাকে বেগুনভাজা বলা যাবে না, তা তো জানতাম না!

সন্তু বলল, মা, তুমি ওর মুখটা সুন্দর বললে?

দেবলীনা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, খবরদার, মাসিমা, আমার চাঁদপানা মুখ বলবেন না। শুনলেই বিচ্ছিরি লাগে। আমার মুখোনা কি গোল নাকি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, গোলই তো! তোর নাম চন্দ্রিমা হলে ভাল মানাত! একমাত্র কান্নার সময় তোর মুখটা লম্বা হয়ে যায়।

দেবলীনা বলল, তুই আমাকে কখনও কাঁদতে দেখেছিস?

মা বললেন, এই তোরা সক্কালবেলাতেই ঝগড়া করিস না! লীনা, তুই কী খাবি বল?

দেবলীনা চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়াল। সে একটা ফিকে নীল রঙের শালোয়ার কামিজ পরে-আছে, এই রংটা তার খুব পছন্দ। সন্তুর চেয়ে দু বছরের ছোট, কিন্তু লম্বায় প্রায় সন্তুর সমান।

এই জানলা দিয়ে পাশের একটা ছোট পার্ক দেখা যায়।

সেখানে পাড়ার ছেলেদের ক্রিকেট খেলা চলছে। কিছু লোক দেখছেও সেই খেলা।

মা আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী খাবি বললি না?

দেবলীনা বলল, লুচি আর বেগুনভাজা!

মা সন্তুর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলেন।

মা রান্নাঘরে চলে যাওয়ার পর দেবলীনা আবার চেয়ারে ফিরে এসে বসল, এই সন্তু, তোরা কবে কায়রো যাচ্ছিস রে?

সন্তু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, কায়রো যাচ্ছি? কে বলো তোকে?

যাচ্ছিস কি না বল!

কায়রো কিংবা কাস্কাটকাও যেতে পারি। কিংবা কেনিয়া, কিংবা কেপ অব গুড হোপ। কিংবা কেন্টাকি, কিংবা কালিকট। না, না, কালিকট বাদ, সেখানে আমরা গতবার গিয়েছিলাম, তা হলে কাঁচরাপাড়া কিংবা কেওনঝড়ও হতে পারে। কাকাবাবুর ওপর নির্ভর করছে।

কাকাবাবু বুঝি ক-দিয়ে যেসব জায়গার নাম, শুধু সেসব জায়গাতেই যান?

এক-একবার এক-একরকম।

এবার আমি যাবই যাব। আমার তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু জোজো রাজি হবে না।

ওই জোজোটাকেই এবার বাদ দিয়ে দে।

ঠিক তখনই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জোজো বলে উঠল, কে আমায় বাদ দিচ্ছে?

দেবলীনা বলল, এই রে, অসময়ে যমদূতের আবির্ভাব।

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, যমদূতরা যখনই আসে, তখনই অসময়।

সন্তু বলল, জোজো দেখ তো, এই মেয়েটার মুখটা ঠিক চাঁদের মতন সুন্দর নয়?

বলার সময় সন্তু একটা ভুরু সামান্য কাঁপাল, তাতেই বুঝে নিয়ে জোজো বলল, হ্যাঁ, অবিকল পূর্ণিমার চাঁদের মতন!

সন্তু বলল, আমরা এখন থেকে দেবলীনাকে চন্দ্রিমা বলে ডাকব?

দেবলীনা বলল, অ্যাই ভাল হবে না বলছি। আমিও তা হলে তোদের এমন খারাপ নাম দেব—

সন্তু বলল, তুই আমাকে বললি বেগুনভাজা, আর জোজোকে বললি যমদূত। এর চেয়ে খারাপ আর কী হতে পারে? আমরা কিন্তু তোর ভাল নাম দিয়েছি।

জোজো বলল, তোকে নিয়ে কবিতা লিখলে ভাল মিলও দেওয়া যাবে। তন্দিমা! ভঙ্গিমা! কাঁদিসনি মা!

দেবলীনা চটি পরে নিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে যেতে গেল।

সন্তু বলল, ধর, ধর, জোজো।

সদর দরজায় পৌঁছবার আগেই দেবলীনাকে ধরে ফেলল জোজো।

এই সময় সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন কাকাবাবু। শার্ট-প্যান্ট-জুতো পরা, বাইরে বেরোচ্ছেন বোঝা গেল। মুখোনা গম্ভীর।

সন্তু ঘড়ির দিকে তাকাল।

রফিকুল আলম দশ মিনিটের মধ্যে এসে যাবেন বলেছিলেন, এর মধ্যে পনেরো মিনিট কেটে গেছে।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ন্যাশনাল লাইব্রেরি যাচ্ছি। বউদিকে বলিস, একটু দেরি করে ফিরব, সবাই যেন খেয়ে-টেয়ে নেয়।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুমি কফি খাবে না?

কাকাবাবুর বললেন, না, দরকার নেই।

রান্নাঘর থেকে এসে মা বললেন, রাজা, তুমি বেরোচ্ছ? একটু বসে যাও। গরম-গরম লুচি ভাজছি, খেয়ে যাও দুখানা।

কাকাবাবু বললেন, লুচি? না, এখন লুচিটুচি খাব না।

দেবলীনা জোজোর কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, কাকাবাবু, তুমি আমাকে হাজরার মোড়ে বাসে তুলে দেবে?

মা অবাক হয়ে বললেন, লীনা, তুই চলে যাবি মানে? তুই-ই তো লুচি খাবি বললি!

জোজো বলল, এ মেয়ের রাগ হয়েছে। দুখানা বেশি খাবে।

কাকাবাবু ক্রাচদুটো বগলে লাগিয়ে নিলেন।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আলমদা এলে কিছু বলতে হবে?

কাকাবাবু বললেন, আমি তো তাকে আসতে বলিনি। যদি তার নিজের কিছু বলার থাকে তো শুনে নিস।

কাকাবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর জোজো বলল, কী ব্যাপার রে সন্তু, কাকাবাবুর খুব মেজাজ খারাপ মনে হল। আমার দিকে একবার তাকালেনও না!

দেবলীনা বলল, তুমি কী এমন ইম্পট্যান্ট লোক যে তোমার দিকে তাকতেই হবে!

জোজো বলল, তুই তো খুব ইম্পর্ট্যান্ট, তোর সঙ্গেও তো কথা বললেন না।

সন্তু বলল, সকাল থেকেই কাকাবাবুর মেজাজটা খাট্টা হয়ে আছে। খুব রেগে আছেন পুলিশদের ওপর।

কেন? ঠিক বুঝতে পারছি না। কাগজের একটা খবর পড়ে… খুবই ছোটখাটো ব্যাপার, হাসপাতাল থেকে দুজন কয়েদি পালিয়ে গেছে।

সে খবরটা তো আমিও পড়েছি। অদ্ভুত নাম, ভোগলু আর খণ্ডগিরি।

ভোগলু না, ভাংলু, খণ্ডগিরি না, ছোটগিরি।

সে যাই-ই হোক। লোকদুটো পালিয়েছে তো তাতে কাকাবাবু রেগে যাবেন কেন? কাকাবাবুই কি ওদের ধরিয়ে দিয়েছিলেন?

নাঃ! তা হলে তো আমি জানতাম।

মা দুটো বড় প্লেট ভর্তি লুচি আর বেগুনভাজা এনে রাখলেন টেবিলের ওপর। বললেন, গরম গরম খেয়ে নাও!

জোজো বলল, মাত্র এই কখানা? মাসিমা, আরও ভাজুন।

মা বললেন, খেতে শুরু করো তো!

দেবলীনা জোজোকে বলল, এই তুই হাত না ধুয়েই খেতে শুরু করলি যে?

জোজো বলল, লেডি চন্দ্রিমা, তুমি আমার হয়ে তোমার দুটো হাতই ভাল করে ধুয়ে এসো। তাতেই হবে। সামনে গরম লুচি দেখলে আমার এক সেকেন্ডও দেরি সহ্য হয় না।

ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই এসে উপস্থিত হলেন রফিকুল আলম।

তিনি সন্তুদের দিকে তাকিয়ে হেসে হাত তুলে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাচ্ছিলেন, সন্তু ডেকে বলল, আলমদা, এখানে এসে বসুন। লুচি খাবেন?

রফিকুল বললেন, দাঁড়াও, আগে কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি।

সন্তু বলল, কাকাবাবু তো বেরিয়ে গেলেন একটু আগে।

রফিকুল থমকে গিয়ে বললেন, আমার দেরি হয়ে গেল, পার্ক স্ট্রিটে এমন জ্যাম ছিল… কাকাবাবু এর মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন? নিশ্চয়ই খুব রেগে গেছেন আমার ওপর!

সন্তু বলল, তা একটু রেগে আছেন ঠিকই।

রফিকুল বললেন, সন্ধেবেলা এসে ক্ষমা চেয়ে নেব।

খাবার টেবিলের কাছে এসে বললেন, ব্রেকফাস্ট করে এসেছি, তবু লুচি দেখে লোভ হচ্ছে। একখানা খেয়েই দৌড়তে হবে। অনেক কাজ।

জোজো বলল, এমন চমৎকার বেগুনভাজা দেখেও যদি অবহেলা করেন, তা হলে স্বর্গে গিয়ে কৈফিয়ত দিতে হবে।

রফিকুল বললেন, পুলিশরা কি আর স্বর্গে যায়? তাদের জন্য দোজখে, মানে নরকে আলাদা জায়গা করা আছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আলমদা, ভাংলু আর ছোটগিরি, এই দুজন কীসের জন্য ধরা পড়েছিল?

রফিকুল বললেন, সন্তু, সকালবেলায় তো ওরকম বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি নাম উচ্চারণ কোরো না। ভাল কিছু বলল, ওরা কারা?

ওই যে দুজন হাসপাতাল থেকে পালিয়েছে?

ও হ্যাঁ, কাগজে পড়েছি বটে। ওদের নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন?

আমার নয়, কাকাবাবুর। ওই খবরটা পড়েই তো তিনি পুলিশের ওপর রেগে গেলেন।

তাই নাকি? এই রে, আমি তো ওদের বিষয়ে বিশেষ কিছু জানি না।

সে কী, আপনি এতবড় অফিসার, আপনি সব খোঁজ রাখেন না?

সব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে তো মাথা ঘামাতে পারি না। অন্য অফিসাররা দেখেন। পরশু একটা বিরাট ব্যাঙ্ক ডাকাতি হয়েছে জানো তো—

হ্যাঁ জানি, পার্ক সার্কাসে, কুড়ি-বাইশ লাখ টাকা।

তাই নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি, একজন ডাকাত ধরাও পড়েছে। তাকে কাল জেরা করেছি প্রায় সারারাত ধরে—

দেবলীনা বলল, একটা ডাকাত ধরা পড়েছে? তাকে কীরকম দেখতে?

এর মধ্যে দুটো লুচি খেয়ে ফেলেছেন রফিকুল। মা আরও লুচি এনে দিলেন।

রফিকুল বললেন, কীরকম দেখতে? ভালই চেহারা, চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েস, প্যান্ট-শার্ট পরা, খানিকটা লেখাপড়াও জানে। ওর ডাকনাম কচি। ভাল নাম গোপাল।

দেবলীনা আবার জিজ্ঞেস করল, সারারাত ধরে কী জেরা করলেন?

রফিকুল বললেন, এই, টাকাগুলো কোথায় লুকিয়েছে, তার সঙ্গী-সাথিরা কোথায়, এইসব।

জোজো জিজ্ঞেস করল, খুব মারলেন তাকে?

রফিকুল বললেন, খুব না, একটু-আধটু তো মারতেই হয়। ভয় দেখাতে হয়।

কিছু স্বীকার করল? ঝড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলে। ওদের মার খাওয়া অভ্যেস আছে। মাঝে-মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার ভান করে।

ভান করে? সত্যি-সত্যি অজ্ঞান হয় না?

দুবার ভান করার পর আমাদের এত রাগ হয়ে যায় যে, সত্যি-সত্যি মেরে অজ্ঞান করে দিতে হয়। শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, দ্যাখ কচি, তুই যেমন ধরা পড়েছিস, তেমনই তোর সঙ্গী-সাথিরাও ঠিকই ধরা পড়বে শেষ পর্যন্ত। টাকাগুলো ভোগ করতে পারবি না। তবু তোরা বোকার মতন কেন এরকম কাজ করতে যাস?

সব ডাকাত ধরা পড়ে?

বেশিরভাগই। নাইনটি নাইন পারসেন্ট। অথবা ওরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে।

সব ডাকাত যে ধরা পড়ে, তা তো জানতাম না। ডাকাতির খবর যেমন ফলাও করে কাগজে বেরোয়, ধরা পড়ার খবরগুলো তেমনভাবে বেরোয় না। জোজোবাবু, তোমার যদি ভবিষ্যতে ডাকাতি করার প্ল্যান থাকে, তা হলে জেনে রেখো, বাকি জীবনটা তোমায় নির্ঘাত জেলে কাটাতে হবে।

ডাকাতি ফাকাতি আমার ধাতে পোষাবে না। আমি একটা হিরের খনি আবিষ্কার করব। সে খনিটা কোথায় আছে, তাও মোটামুটি জেনে গেছি।

চমৎকার। তখন আমাকে সঙ্গে নিয়ে।

হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে রফিকুল সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কাকাবাবু কেন ওই হাসপাতাল থেকে পালানো কয়েদিদুটো সম্পর্কে জানতে চাইছেন, তা তুমি বলতে পারো?

সন্তু মাথা নেড়ে বলল, না। আমারও অদ্ভুত লাগছে।

রফিকুল বললেন, ওই ছিচকে চোরদুটোর কী সৌভাগ্য, কাকাবাবুর মতন মানুষ ওদের সম্পর্কে কৌতূহলী হয়েছেন। ঠিক আছে, আমি সন্ধের মধ্যে সব খবর নিয়ে আসছি কাকাবাবুর কাছে। দেরি করে আসার জন্য তুমি আমার হয়ে মাফ চেয়ে নিয়ো।