১০. ছিপ দিয়ে মাছধরার খুব শখ

সকালবেলা কাকাবাবু বললেন, আজকের দিনটা একটু অন্যরকমভাবে কাটাব ভাবছি। সন্তু, জোজো, অংশু, তোমরা বরং আজ এখানে বসেই গল্পটল্প করো। আমি একবেলার জন্য ঘুরে আসি।

জোজো জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথা থেকে ঘুরে আসবেন?

কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন মাছ ধরিনি। এক সময় আমার ছিপ দিয়ে মাছধরার খুব শখ ছিল।

জোজো বলল, এখানে কোথায় মাছ ধরবেন? পুকুরটুকুর দেখিনি একটাও।

কাকাবাবু বললেন, এখান থেকে খানিকটা দূরে গেলে ছোট-ছোট পাহাড়ের শ্ৰেণী আছে। সেখান দিয়ে বয়ে যাচ্ছে চমৎকার একটা নদী। আগেরবার এসে সেখানে আমি মাছ ধরেছিলাম মনে আছে।

সন্তু জোর দিয়ে বলল, আমরা মোটেই বাড়িতে বসে থাকব না। আমরাও যাব।

জোজো বলল, আমি দারুণ মাছ ধরতে পারি। একবার কাস্পিয়ান হ্রদে একটা স্টার্জন মাছ ধরেছিলাম, সেটার ওজন ছিল বাইশ কিলো!

কাকাবাবু বললেন, বাপরে, তা হলে তো তোমার সঙ্গে আমি পারব না?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, অতবড় মাছ নিয়ে কী করলি?

জোজো বলল, পেট কেটে শুধু ডিম বার করে মাছটা ফেলে দিলাম!

অংশু বলল, সে কী! অতবড় মাছ ফেলে দিলে?

জোজো অবজ্ঞার হাসি দিয়ে বলল, কিছুই জানো না। স্টার্জন মাছের ডিমেরই আসল দাম।

কাকাবাবু হেসে বললেন, তা ঠিক। জোজো, তুমি অতবড় মাছ ধরেছ, এখানে ছোটখাটো মাছধরা দেখতে তোমার ভাল লাগবে কেন? এখানে বড়জোর এক কিলো-দেড় কিলো মাছ।

জোজো বলল, জলের ধারে গেলেই আমার ভাল লাগে।

কাকাবাবু বললেন, অংশু তুমি কী করবে? তোমার তো পড়া মুখস্থ করতে হবে?

সবাইকে অবাক করে দিয়ে অংশু সেই চার লাইন কবিতা ঠিকঠাক গড়গড় করে মুখস্থ বলে গেল!

জোজো বলল, কাল অনেক রাত জেগে ওকে দুলে-দুলে মুখস্থ করতে দেখেছি।

অংশু বলল, খুব ছেলেবেলায় পড়া আর-একটা কবিতা আমার মনে পড়ে গেছে। বলব?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, শোনাও।

অংশু বলল :

চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে
কদমতলায় কে
হাতি নাচছে, ঘোড়া নাচছে
সোনামণির বে।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, বাঃ, তা হলে তো তোমার চাকরি পাকা। তা হলে বেরিয়ে পড়া যাক।

জোজো বলল, মাছ ধরবেন, ছিপ পাবেন কোথায়? ভাল চার লাগবে।

কাকাবাবু বললেন, বাজারে পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই।

জলখাবার খেয়ে, সঙ্গে বেশ কিছু স্যান্ডউইচ আর জলের বোতল নিয়ে বেরিয়ে পড়া হল। কামালের পাঠানো স্টেশন ওয়াগন গাড়িটা এসেছে। পুলিশের গাড়িটাও অপেক্ষা করছে বাইরে। কাকাবাবু পুলিশ পাহারায় মাছ ধরতে যেতে রাজি নন।

তিনি পুলিশের অফিসারকে ডেকে বললেন, এখন আমরা শহরে যাচ্ছি। সেখানে তো আপনাদের ফলো করার দরকার নেই। দুপুরবেলা আমরা আজ আবার খাজুরাহো যাব, তখন আপনাদের লাগবে। আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। শহর থেকে কয়েকটা জিনিস কেনাকাটা করে আমরা এখানেই ফিরে আসছি।

বাজারে তিনটি দোকানে মাছধরার সরঞ্জাম পাওয়া যায়। কাকাবাবুর কোনও ছিপই পছন্দ হয় না। তিনি এক দোকান থেকে আর-এক দোকানে ঘুরতে লাগলেন। দোকানদারদের মাছ ধরার বিষয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন নানারকম।

শেষপর্যন্ত তিনি দুখানা বেশ মজবুত, হুইল দেওয়া ছিপ কিনলেন। আর অনেকখানি নাইলনের দড়ি। দোকানের সামনের রাস্তাটা যেন নদী, এইভাবে তিনি ছিপ দুটো পরীক্ষা করলেন কয়েকবার। তাঁকে দেখার জন্য ভিড় জমে গেল।

গাড়িতে উঠে কাকাবাবু গেস্ট হাউসের উলটো দিকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি এতক্ষণ ধরে ছিপ কিনলেন যে, সারা শহর জেনে গেল আপনি মাছ ধরতে যাচ্ছেন। কালকের কাগজে খবর ছাপা হয়ে যাবে।

কাকাবাবু হেসে বললেন, এর পর যদি মাছ ধরতে না পারি, খুব লজ্জার ব্যাপার হবে, তাই না? আগেকার দিনে বাবুরা কী করত জানিস? সকালবেলা সেজেগুজে মাছ ধরতে যেত, একটা মাছও ধরতে না পারলে বাজার থেকে মাছ কিনে এনে বাড়িতে বলত, এগুলো আমি ধরেছি!

অংশু বলল, কেউ-কেউ ইলিশমাছও কিনে এনে বলতে, পুকুরে ধরেছি।

কাকাবাবু বললেন, এখানকার শহরের অনেক ছেলেমেয়ে জানেই না যে, ইলিশমাছ কখনও পুকুরে পাওয়া যায় না।

অংশু বলল, এইসব দিকে ইলিশ পাওয়া যায় না! ইলিশ শুধু পাওয়া যায় আমাদের পশ্চিমবাংলায় আর বাংলাদেশে।

কাকাবাবু বললেন, এটা বাঙালিদের ভুল ধারণা। আরও অনেক দেশে ইলিশ পাওয়া যায়। ইলিশ হচ্ছে সমুদ্রের মাছ, বিভিন্ন দেশের নদী দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে ডিম পাড়ার জন্য। অবশ্য সব জায়গায় ইলিশের স্বাদ সমান নয়। আমেরিকায় কিন্তু বেশ ভাল আর বড়-বড় ইলিশ ধরা পড়ে।

জোজোকে বারবার পেছনদিকে তাকাতে দেখে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জোজো, নীল রঙের ফিয়াট গাড়িটা আজও দেখা যাচ্ছে?

জোজো বলল, না, এখনও দেখতে পাচ্ছি না।

সন্তু বলল, আমরা কোথাও গেলে কামালকাকুকে ডেকে নেওয়ার কথা ছিল?

কাকাবাবু বললেন, থাক, ওর অনেক কাজ আছে। কাল দুপুরে আমরা ওকে কাজে যেতে দিইনি। পুলিশের গাড়িটাকেও ফাঁকি দেওয়া গেছে। আজ বেশ নিরিবিলিতে মাছধরা যাবে।

খানিকটা বাদেই পাহাড়ি রাস্তা শুরু হয়ে গেল। এখানকার রাস্তা ভাল নয়, গাড়িটা ওপরে উঠতে পারছে না। মাঝে-মাঝে ঘরর ঘরর শব্দ হচ্ছে। কাকাবাবু জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছেন, এক জায়গায় এসে বললেন, ব্যস, এখানে থামাও। এখানেই নামব।

সবাই নেমে পড়ার পর তিনি গাড়ির ড্রাইভারকে বললেন, তোমার অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমরা এখানে দুপুর অবধি থাকব। তুমি ঠিক চারটের সময় এখানে ফিরে এসো।

গাড়িটা চলে যাওয়ার পরই সব জায়গাটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। এ-রাস্তায় গাড়িটাড়ি চলে না বিশেষ। ছোট-ছোট পাহাড়, সবুজ গাছপালায় ভর্তি, মাঝে-মাঝে সরু পায়েচলা পথ।

একটা পথ নেমে গেছে নীচের দিকে। সেই রাস্তা ধরে কাকাবাবু তাঁর দলটি নিয়ে এগোলেন। কয়েক মিনিট বাদেই জল চোখে পড়ল।

জায়গাটা ভারী সুন্দর। আসার পথে নদীটা একবার চোখে পড়েছিল, তেমন কিছু বড় নয়, কিন্তু এখানে সেটা হঠাৎ এত চওড়া হয়ে গেছে যে, একটা লেকের মতন মনে হয়। পরিষ্কার টলটলে জল। এপাশে-ওপাশে কয়েকটা নৌকো বাঁধা আছে। কয়েক জায়গায় বেঞ্চ বানিয়েও দেওয়া হয়েছে। পিকনিক করার পক্ষে আদর্শ। আজ ছুটির দিন নয় বলে লোকজন নেই।

কাকাবাবু প্রথমে চার তৈরি করে জলে ছিটিয়ে দিলেন। তারপর বঁড়শিতে টোপ গেঁথে জলে ফেলে নিজে একটা পাথরের ওপর বসলেন। সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফাতনার দিকে।

পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই জোজো বলল, কই, মাছ উঠছে না?

কাকাবাবু বললেন, এর মধ্যেই? ধৈর্য না থাকলে তো মাছ ধরা যায় না।

অংশু বলল, এখানে বড় মাছ আছে কিনা, তাই-ই বা কে জানে? এই ছিপে ছোট মাছ ধরা যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, সবাই এরকম কথা বললে তো পুঁটিমাছও উঠবে না। আওয়াজ শুনলেই মাছরা ভয়ে পালিয়ে যায়।

একটুক্ষণ তিনি কী যেন চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, আজ তোমাদের একটা পরীক্ষা নিতে চাই। ধরো, এখন থেকে বেলা তিনটে পর্যন্ত একেবারে চুপ করে থাকতে পারবে? একটা কথাও বলা চলবে না। কী, রাজি?

তিনজনেই মাথা নাড়ল।

কাকাবাবু বললেন, জোজোরই বেশি কষ্ট হবে। একদিন সংযম দেখাও! তোমরা তিনজন এক জায়গায় বসতেও পারবে না। আলাদা-আলাদা আমি জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি না ডাকলে কেউ আমার কাছে আসবে না। কাকাবাবু পাহাড়ের ওপরদিকে তিনটে জায়গা বেছে দিলেন ওদের জন্য।

তারপর নিজের কোমর থেকে রিভলভারটা বার করে সন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তুই এটা রাখ সন্তু। যদি কিছু ঘটনা ঘটে, তবু তুই হুট করে গুলি চালাবি না। যদি গুলি করতেই হয়, আমি ইঙ্গিত দেব। আমার ডান হাতটা কানের কাছে তুলব।

সন্তু বলল, যদি কেউ এসে পড়ে আগেই তোমাকে গুলি করে? যদি হাত তুলতে না পারো?

কাকাবাবু বললেন, সেরকম যদি হয়, নিজের বুদ্ধিমতন কাজ করবি। তার আগে পর্যন্ত কিছুতেই না, আমার ইঙ্গিত ছাড়া কিছুতেই না! আর অন্যদের আবার বলছি, আমি না ডাকলে কিছুতেই আমার কাছে আসবে না! এখন যাও, যে-যার পজিশান নিয়ে বোসো। ধরে নাও, এটা একটা খেলা। মাছ ধরার মতন এ-খেলাতেও কিন্তু খুব ধৈর্য লাগবে! কোনও শব্দ করবে না।

ওরা তিনজন ওপরের দিকে উঠে গেল, কাকাবাবু আবার মাছধরতে বসলেন। অন্যদের কথা বলতে বারণ করেছিলেন, নিজেই গুনগুন করে শুরু করলেন গান, আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি।

সময় যেন কাটতেই চায় না, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, আধ ঘণ্টা…

এক ঘণ্টার একটু পরে কাকাবাবু হ্যাঁচকা টান দিয়ে একটা মাছ ধরে ফেললেন। প্রায় এক কিলো ওজনের একটা কাতলামাছ।

ওপরের লুকনো জায়গা থেকে জোজো প্রায় চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, কাকাবাবুর নিষেধ মনে পড়ায় নিজেই নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। অংশু একটু এগিয়ে উঁকি মেরে দেখতে গেল, খচমচ শব্দ হল গাছের পাতায়। সন্তু মাছধরা দেখছে না, সে রিভলভারটা নিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে।

কাকাবাবু মাছটাকে বঁড়শি থেকে ছাড়িয়ে সেটাকে আবার ছুঁড়ে জলে ফেলে দিলেন। যেন মাছধরাতেই তাঁর আনন্দ, জ্যান্ত মাছ ধরে খাওয়ার লোভ নেই।

আবার অপেক্ষা।

জোজো শুয়ে পড়ে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মেঘলা দিন, রোদ্দুরের তাপ নেই। অন্যদিকে অংশু ঘুমিয়ে পড়েছে একটা গাছে হেলান দিয়ে। সন্তু একটা পাথরের আড়ালে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে।

দু ঘণ্টা কেটে যাওয়ার পর খুব জোরে একটা গাড়ি এসে ওপরের রাস্তায় থামল। তার থেকে দুজন লোক লাফিয়ে নেমে পড়ে খানিকটা ছুটে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। তাদের চেহারা ডাকাতের মতন, দুজনের হাতেই রাইফেল। গাড়ি চালাচ্ছিল একজন প্রায় বুড়ো লোক, মাথার চুল ধপধপে সাদা, লম্বা-চওড়া চেহারা, সে গাড়ি থেকে নামল একটা ছড়ি হাতে নিয়ে। ছড়িতে ভর দিয়ে ঝুঁকে-ঝুঁকে হেঁটে সে এগিয়ে এল খানিকটা।

সন্তুর বুকটা ধক করে উঠল। দুজন লোকের হাতে রাইফেল, এখন সে কী করবে? কাকাবাবুর যেন ভ্রূক্ষেপই নেই, পেছনে ফিরে তাকালেনও না।

চুলপাকা লোকটি হেঁকে বলল, রায়চৌধুরী সাব, নমস্তে। কটা মছলি পাকড়ালেন?

কাকাবাবু এবার মুখ ফিরিয়ে যেন খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, আরে সূর্যপ্রসাদ যে! নমস্তে-নমস্তে। কেমন আছ?

সূরপ্রসাদ বলল, হনুমানজির কৃপায় ভাল আছি। আপনার চারদিকে এত শত্রু, তবু আপনি একা-একা মাছ ধরতে এসেছেন?

কাকাবাবু বললেন, তোমার ভরসাতেই তো এসেছি। তোমার চিঠি পেয়েছি আমি। অন্য কেউ মারতে এলে তুমি বাঁচাবে।

সূর্যপ্রসাদ বলল, হ্যাঁ, তা তো জরুর বাঁচাব। অন্য কেউ তোমাকে মারতে পারবে না। তা হলে আমি তোমার ওপর প্রতিশোধ নেব কী করে?

সে একজন রাইফেলধারীকে বলল, ওর কাছে কী অস্তরটস্তর আছে, সার্চ করে দ্যাখ। সাবধান, এ-লোকটা মহা ফন্দিবাজ!

সে দৌড়ে এসে কাকাবাবুর প্যান্টের পকেট ও কোমরটোমর সব টিপে দেখল। কিছুই নেই। তখন সে রাইফেলের নলটা কাকাবাবুর বুকে ঠেকিয়ে রাখল।

কাকাবাবু বললেন, মাছ ধরতে এলে কি কেউ সঙ্গে বন্দুক-পিস্তল রাখে নাকি? তুমি আমাকে মেরে ফেলতে এসেছ? তুমি তো আগে শুধু মূর্তি-চুরি আর পাচার করতে, খুনটুন তো করতে না। এখন লাইন পালটেছ?

সূরপ্রসাদ বলল, এত কম্পিটিশান, টিকে থাকতে হলে লাইন পালটাতেই হয়। তবে তোমাকে আমি জানে মারব না। তুমি আমাকে অপমান করেছিলেন, আজ তার শোধ নেব। তোমাকেও আজ নাকে খত দিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, আমি কেন নাকে খত দেব? আমি তো কোনও খারাপ কাজ করিনি। তুমি মূর্তি চুরি করেছিলে, তোমাকে জেলে দেওয়ার বদলে আমি ওইটুকু শাস্তি দিয়েছি!

সূরপ্রসাদ রাগে দাঁত কড়মড় করে বলল, আমার জেলে যাওয়া অনেক ভাল ছিল। আমাদের লাইনে জেল কেউ পরোয়া করে না। কিন্তু নাকে খত দিয়েছি বলে আমার শত্রুরা এখনও হাসে। নাও, আরম্ভ করো।

কাকাবাবু বললেন, এই পাথরের রাস্তায় নাকখত দিতে হবে? এটা ঠিক হচ্ছে না। তোমাকে আমি খত দিইয়েছিলাম খাজুরাহো মন্দিরে, সেটা প্লেন জায়গা ছিল। এই পাথরে নাক ঘষলে আমার নাক ছিঁড়েখুঁড়ে রক্তারক্তি হয়ে যাবে যে!

সূরপ্রসাদ বলল, রায়চৌধুরী, তুমি আমার সঙ্গে মজাক করছ? তোমার ঘাড় ধরে মাটিতে চেপে ধরব, তাই-ই চাও?

কাকাবাবু বললেন, না, না, সেটা আরও খারাপ হবে। ঠিক আছে, কোথা থেকে শুরু করব বলো!

সূর্যপ্রসাদ বলল, এখানে এসে আমার পায়ের কাছে মাথা ঠেকাবে, তারপর নাকেখত দিয়ে ওই ওপরের রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে আবার নেমে আসবে।

কাকাবাবু বললেন, বাবাঃ, এ যে অনেকটা। ঠিক আছে, অন্য কেউ আর দেখছে না।

সূর্যপ্রসাদ বলল, ক্যামেরা এনেছি, ছবি তুলে রাখব। কাকাবাবু ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এলেন সূর্যপ্রসাদের দিকে। হঠাৎ ওপর থেকে হুড়মুড় করে অংশু লাফিয়ে পড়ল একজন রাইফেলধারীর কাঁধে। দুজনে মাটিতে গড়াগড়ি করে অংশু কোনওক্রমে ছিনিয়ে নিল রাইফেলটা। কিন্তু সে উঠে দাঁড়াবার আগেই অন্য লোকটি তাক করে ফেলেছে তার দিকে।

কাকাবাবু হাত দুটো মুঠো করে আছেন, অর্থাৎ সন্তুকে কোনও ইঙ্গিত দিচ্ছেন। না। নিরীহভাবে জিজ্ঞেস করলেন, আরে, এ লোকটা কে?

সূর্যপ্রসাদ চিৎকার করে বলে উঠল, এ তোমার দলের লোক। তোমার দলে আরও ছেলে ছিল, তারা কোথায় গেল!

কাকাবাবু বললেন, তাদের তো আমি নিয়ে আসিনি। এ কী করে চলে এল?

সূরপ্রসাদ বলল, কুছ পরোয়া নেই। রায়চৌধুরী, আমার পায়ে মাথা দাও!

হাতের ছড়িটা দিয়ে সে সপাং করে এক ঘা কষাল অংশুর পিঠে।

কাকাবাবু এবার কঠোরভাবে বললেন, সূর্যপ্রসাদ, ওকে মেরো না। শোনো আমার কথা। তুমি আমাকে নাকে খত দিতে বাধ্য করালে তারপর আমি তোমাকে ছাড়ব? এবার ঠিক জেলে ভরে দেব!

সূর্যপ্রসাদ বলল, আরে বাঙালি, তোমার কত মুরোদ, এবার দেখব। তোমাকে আগে নাকে খত দিইয়ে সেটা ফোটো তুলে সবাইকে দেখাব। এখান থেকে যাওয়ার আগে তোমাকে খুন করে সেই লাশ জলে ভাসিয়ে দেব!

কাকাবাবু বললেন, আমাকে খুন করা এত সোজা? দেব না নাকে খত, তুমি কী করতে পারো?

সূরপ্রসাদ কাকাবাবুকে মারার জন্য ছড়িটা তুলতেই তিনি সেটা ধরে ফেলে হ্যাঁচকা টান দিলেন। তারপর কানে হাতে দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওপর থেকে ছুটে এল একটা নয়, দুটো গুলি। একজন রাইফেলধারী মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগল। একটা গুলি লাগল সূর্যপ্রসাদের কাঁধে। অন্য। রাইফেলধারীটা ওপরের দিকে তাক করতে করতে আবার দুটো গুলি ছুটে এল। সেও ঘায়েল হয়ে গেল! দুদিক থেকে দুটো গুলি আসায় কাকাবাবুও অবাক! তিনি ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছেন কামাল।

কাকাবাবু বললেন, আরে, তুমি কোথা থেকে এলে?

কামাল বললেন, আপনি মাছ ধরতে গেছেন শুনেই বুঝলাম, ইচ্ছে করে বিপদ ডেকে এনেছেন। তাই সঙ্গে রাইফেল নিয়ে ছুটে এসেছি। এসেই দেখি, দলবল নিয়ে উপস্থিত সূরপ্রসাদ।

কাকাবাবু বললেন, দলবল তো নয়, মাত্র দুটো লোক। এদের আমরাই ব্যবস্থা করতে পারতাম। সন্তুকে তুমি টিপ দেখাবার চান্সই দিলে না। সূর্যপ্রসাদকে নিয়ে এখন কী করা যায়? আবার নাকখত দিইয়ে ছেড়ে দেব?

কামাল বললেন, কিছুতেই না। ওকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে। বুড়ো বয়েসেও ওর লোভ যায়নি। জেলই ওর ঠিক জায়গা।

কাকাবাবু বললেন, দড়ি এনেছি, ওদের বেঁধে রাখো।

জোজো আর সন্তুও নেমে এসেছে। সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি ইঙ্গিত দিতে এত দেরি করছিলে কেন?

কাকাবাবু বললেন, দেখছিলাম গুলি না চালিয়েও ওদের জব্দ করা যায় কি না। আচ্ছা অংশু, তুমি কোন সাহসে একজনের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়লে? আমি বারণ করেছিলাম না?

অংশু বলল, আপনাকে নাকে খত দিতে বলল শুনেই রাগে আমার গা জ্বলে উঠল। আর থাকতে পারলাম না। আমি ভাবলাম, আমি একজনকে ধরতে পারলেই সন্তু আর একজনকে গুলি করবে।

কাকাবাবু বললেন, রেলের ডাকাতরা তো এত সাহসী হয় না। তোমার সাহস দেখে আশ্চর্য হয়ে গেছি।

অংশু বলল, ও-কথা আর বলবেন না সার। আমি চিরকালের মতন ওই লাইন ছেড়ে দিয়েছি। আপনি আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, তা হলে তোমাকে পুলিশই একটা চাকরি দেওয়া যেতে পারে। তোমার মতন লোকরাই চোর-ডাকাতদের ভাল সামলাতে পারবে।

কামাল আর সন্তু মিলে তিনজনকেই বেঁধে ফেলেছে। এই সময় ভটভট শব্দ করতে-করতে এঞ্জিন লাগানো একটা নৌকো এদিকে এগিয়ে এল। তাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন লম্বামতন মানুষ, চোখে কালো চশমা। হাতে তার বড় একটা অস্ত্র। স্টেনগান কিংবা এ. কে. ফরটি সেভেন।

চোখের নিমেষে এই অস্ত্র থেকে একসঙ্গে অনেক গুলি ছুটে আসে।

লোকটি কর্কশ গলায় বলল, সবাই হাত তুলে দাঁড়াও! যে নড়াচড়া করবে, তার আগে প্রাণ যাবে।

ওর হাতের অস্ত্রটি দেখলেই ভয় করে। সবাই হাত তুলতে বাধ্য হল। কাকাবাবু অস্ফুট স্বরে বললেন, এ আবার কে?

কামাল বললেন, গলার আওয়াজটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।

নৌকোটা পারের কাছে আসতেই লোকটি একলাফে নেমে পড়ল। একহাতে অস্ত্রটা উঁচিয়ে রেখে নৌকোর দড়িটা বাঁধল একটা গাছের সঙ্গে। তারপর খুলে ফেলল চোখের কালো চশমাটা।

কামাল প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, এ কী?

কাকাবাবু বললেন, অবোধরাম!

অবোধরাম বলল, রায়চৌধুরী, মনে আছে আমাকে?

কাকাবাবু বললেন, মনে থাকবে না? কী আশ্চর্য যোগাযোগ! কদিন ধরে আমরা তোমার কথাই বলছিলাম। এই ছেলেদের সেই গল্প শোনাচ্ছিলাম। আর তুমি এসে হাজির! গল্পের মধ্যে গল্পের ভিলেনের সশরীরে আবিভাব!

অবোধরাম বলল, মনে নেই, আমি বলেছিলাম, আবার দেখা হবে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তাও মনে আছে। কিন্তু সেটা তো কথার কথা! তোমার তো যাবজ্জীবন জেলে থাকার কথা ছিল। তুমি এখানে কী করে?

সত্যি তুমি এসেছ, না ভুল দেখছি!

অবোধরাম বলল, সত্যি কি ভুল তা একটু পরেই মালুম হবে! তোমার স্যাঙাতটাও এখানে রয়েছে দেখছি! এর কথা আমার মনেই ছিল না।

কাকাবাবু বললেন, জেল থেকে বেরোলে কী করে? আগেই ছেড়ে দিল?

অবোধরাম বলল, আমাকে আটকে রাখতে পারে, পৃথিবীতে এমন কোনও জেল নেই। প্রতিশোধ নেব বলেছিলাম। আমরা কখনও অপমান ভুলি না!

কাকাবাবু হতাশ হওয়ার ভাব দেখিয়ে বললেন, কত লোকই যে আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। কিন্তু কেউ পারে না শেষ পর্যন্ত। তুমি একা এসেছ? তোমার সাহস তো কম নয়! আমরা এখানে এতজন আছি।

অবোধরাম বলল, আমি একাই একশো। আমার হাতে কী আছে দেখেছ? এক মিনিটেই তোমাদের সবাইকে শেষ করে দিতে পারি।

কাকাবাবু বললেন, এসব অস্ত্র তোমরা জোগাড় করো কী করে?

অবোধরাম হঠাৎ ধমক দিয়ে বলল, চোপ! বড় বেশি কথা বলছ। কয়েক পা এগিয়ে এল। সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে। তারপর বলল, এই ছেলেগুলোকে আমার দরকার নেই। রায়চৌধুরী, তুমি আর তোমার স্যাঙাত নৌকোয় ওঠো। তোমাদের দুজনকে আমি নিয়ে যাব।

কাকাবাবু কিছুই না বোঝার ভান করে বললেন, নৌকোয় উঠব কেন? বেড়াতে নিয়ে যাবে নাকি আমাদের?

অবোধরাম চিৎকার করে বলল, ওঠো বলছি! তোমাদের দুজনকে আমি এমন জায়গায় পাঠাব যে, কেউ আর কোনওদিন খুঁজেও পাবে না।

কাকাবাবু বললেন, অবোধরাম পালোয়ান, চেঁচিয়ো না। তুমি ফাঁদে পড়ে গেছ। এবার আর তোমার পালাবার আশা নেই।

অবোধরাম অট্টহাসি দিয়ে বলল, ফাঁদ! কীসের ফাঁদ? চালাকি করতে যেয়ো না রায়চৌধুরী, তা হলে এই ছেলেগুলোও মরবে! নৌকোয় ওঠো!

কাকাবাবু বললেন, যদি না উঠি?

অবোধরাম বলল, তা হলে তোমার চোখের সামনে একজন একজন করে মারব। সবশেষে তোমাকে!

কাকাবাবু বললেন, ওহে পালোয়ান, একটা ওইরকম অস্ত্র জোগাড় করলেই হয় না, ঠিকমতন চালানো শিখতে হয়। তুমি চলে এসেছ আমাদের মাঝখানে। আমাদের সবাইকে আগে একসার দিয়ে দাঁড় করানো উচিত ছিল।

অবোধরাম অমনই কাকাবাবুর বুকের দিকে তাক করে উঠল, দাঁড়াও, সবাই এক লাইন করে দাঁড়াও!

কাকাবাবু বললেন, আহা, হা, এখন আর কেউ নড়বে না। এখন তুমি আমাদের মধ্যে শুধু একজনকেই মারতে পারবে। একজনকে যে-ই মারবে, অমনই পেছনদিক থেকে একজন তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমাদের মধ্যে একজন কে প্রাণ দেবে? আমি, আমার যথেষ্ট বয়েস হয়েছে, আমি মরলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু তারপর তুমি বাঁচবে না, অবোধরাম।

একটু হেসে কাকাবাবু বললেন, নাও, আমাকে মারো, তোমার ঠিক পেছনে চলে এসেছে কামাল, তার হাতে রয়েছে ছুরি। ডান দিকে আমার ভাইপো সন্তু, তার হাতের টিপও দারুণ। এবার এসো অবোধরাম, প্রতিশোধ নাও!

অবোধরাম চকিতে পেছন ফিরে কামালকে দেখার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু বিদ্যুতের মতন একটা ক্রাচ তুলে প্রচণ্ড জোরে মারলেন তার হাতে। অস্ত্রটা পড়ে যেতেই সন্তু চোখের নিমেষে সেটা তুলে নিল!

কাকাবাবু বললেন, যাঃ অবোধরাম, তোমার যে আর প্রতিশোধ নেওয়া হল!

অবোধরামের মুখোনা বিবর্ণ হয়ে গেছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

কামাল হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, দাদা, দাদা, আপনি যে অসাধ্যসাধন করলেন! এবার যে বাঁচব, ভাবতেই পারিনি। এ লোকটা যদি আগে আমার দিকে গুলি চালিয়ে দিত!

কাকাবাবু বললেন, আমি আগে অনেকবার দেখেছি, কারও চোখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে আমি যদি ধমকে বলি, মারো, আমায় মারো, তাতে অন্যরা তক্ষুনি গুলি করতে পারে না।

জোজো বলল, হিপনোটাইজড হয়ে যায়। আমার বাবা একবার স্পেনে গুণ্ডার দলের মধ্যে পড়ে…

জোজোকে গল্প বলতে না দিয়ে কামাল বললেন, সন্তু, এসো, একে আগে বেঁধে ফেলা যাক।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, ওই অস্ত্রটা সম্বন্ধে সাবধান। ভারী ডেঞ্জারাস। ওটা নামিয়ে রাখো বরং।

সন্তু সেটা নামাবার আগেই অবোধরাম লাফিয়ে গিয়ে জোজোকে চেপে ধরল। তার হাতে একটা লম্বা ছুরি। ছুরির ডগাটা সে জোজোর গলায় চেপে ধরেছে। বিকৃত গলায় বলে উঠল, রায়চৌধুরী, এবার? আমার অস্ত্রটা ফেরত দাও, না হলে এ-ছেলেটা মরবে!

কাকাবাবু বললেন, আঃ, বারবার এই ভুল হয়। একজন যে দুটো অস্ত্র রাখতে পারে, সেটা মনে থাকে না। আগেই ওকে সার্চ করা উচিত ছিল।

অবোধরাম বলল, দাও, অস্ত্রটা ফেরত দাও!

কাকাবাবু বললেন, নাঃ, ওই অস্ত্র তুমি ফেরত পাবে না।

কামাল বললেন, এবারেও তোমার সুবিধে হবে না অবোধরাম। ওই ছেলেটাকে মারার চেষ্টা করলেই আমরা তোমাকে গুলি করব। আমাদের দলের বড়জোর একজন মরবে।

অবোধরাম জোজোকে টানতে-টানতে নৌকোর কাছে নিয়ে গেল। এখন তার পেছনদিকে আর কেউ নেই। এখন অস্ত্রটা হাতে পেলে সে একসঙ্গে সকলের দিকে গুলি চালাতে পারবে।

অবোধরাম বলে উঠল, আমি ঠিক পাঁচ গুনব, তার মধ্যে অস্ত্রটা ফেরত না দিলে আমি এই ছেলেটাকে নিয়ে নৌকোয় উঠে চলে যাব। এক–দুই–তিন–চার।

কাকাবাবু হাত তুলে বললেন, দাঁড়াও! জোজো পরের বাড়ির ছেলে। আমরা ওর জীবনের ঝুঁকি নিতে পারি না। সন্তু, অস্ত্রটা আমাকে দে। তোরা সব আড়ালে চলে যা। আমি ওকে অস্ত্রটা ফেরত দেব।

অবোধরাম বলল, ছুড়ে দিলে চলবে না। এই ছেলেটাকে আমার সামনে দাঁড় করাব, তারপর ওটা আমার হাতে তুলে দেবে।

কাকাবাবু অস্ত্রটা হাতে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। তাঁর মুখের একটা রেখাও কাঁপছে না। অস্ত্রটা হাতে পেলে অবোধরাম যে প্রথমে তাঁকে ধরবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

একেবারে কাছে এসে তিনি বললেন, জোজো, কোনও ভয় নেই। তোমার কোনও ক্ষতি হবে না।

তিনি অস্ত্রটা অবোধরামকে দেওয়ার জন্য উঁচু করলেন, অবোধরাম একহাত বাড়াল।

ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা গুলি এসে লাগল অবোধরামের সেই হাতে। সে আঃ করে এক দৌড় লাগাতেই জোজো এক দৌড় লাগাল।

ঠিক পাশের বড় পাথরটার ওপর এসে দাঁড়াল একজন মানুষ, তার হাতে রিভলভার। সে বলল, খেল খতম! আর কেউ আছে নাকি?

সবাই ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেই মানুষটি নরেন্দ্র ভার্মা!

নরেন্দ্র ভার্মা আবার বললেন, অবোধরাম, আমি ইচ্ছে করে তোমার মাথায় গুলি চালাইনি। তুমি নৌকোয় ওঠার চেষ্টা করলে কিন্তু প্রাণে বাঁচবে না! কামালসাহেব, ওকে বেঁধে ফেলুন!

পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে নেমে এলেন নরেন্দ্র ভার্মা। হাসতে-হাসতে কাকাবাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, রাজা, তা হলে তোমার অপারেশান সাকসেসফুল!

কাকাবাবু বললেন, আঃ নরেন্দ্র, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না! তুমি খুব নাটক করতে ভালবাসো, তাই না? এমন ভাবে হঠাৎ এসে উদয় হলে, যেন সিনেমার নায়ক। ওই পাথরের আড়ালে কতক্ষণ ধরে ঘাপটি মেরে বসে আছ?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা প্রায় ঘণ্টাদেড়েক হবে?

কাকাবাবু বললেন, তার মানে, এতক্ষণ ধরে এখানে যা-যা ঘটেছে, সব তুমি দেখেছ?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সব, সব। তোমাদের এখানেই তো যতরকম নাটক হল। তবে আগে আমি দেখা দিইনি, কিংবা গুলি চালাইনি, তার কারণ, দেখছিলাম, তোমরা নিজেরা কতটা ম্যানেজ করতে পারো। তোমাদের কৃতিত্বে বাধা দিতে চাইনি।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে এখনই বা গুলি চালালে কেন? অবোধরামকেও আমরা ঠিক ম্যানেজ করে নিতাম।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সে কী! তুমি স্টেনগানটা ওকে ফিরিয়ে দিতে যাচ্ছিলে। আর একবার হাতে পেলে ও কাউকে ছাড়ত না। ওর বিবেক বলে কোনও বস্তু নেই।

কাকাবাবু বললেন, ওকে ফিরিয়ে দিতে যাওয়া, আর সত্যি সত্যি হাতে তুলে দেওয়ার মধ্যে অনেক তফাত! মাঝখানের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই অন্য কিছু ঘটে যেতে পারে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, না রাজা, আর আমি ঝুঁকি নিতে চাইনি। তুমি যেই এই ছেলেটাকে বাঁচাবার জন্য ওকে স্টেনগানটা ফেরত দিতে এলে, তখনই ভাবলাম, এই রে, আর তো উপায় নেই, এবার খেলা শেষ করা যাক!

অন্যদের বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। চোখ বড় বড় করে সব শুনছে। জোজোই প্রথম বলল, কাকাবাবু, আপনি জানতেন যে, নরেন্দ্র ভার্মা আমাদের বাঁচাবার জন্য এখানে লুকিয়ে আছেন?

কাকাবাবু বললেন, না, তা জানতাম না। ও তো আগে থেকে কিছু বলে না। তবে আমার একটু-একটু সন্দেহ হয়েছিল। নীল রঙের ফিয়াট গাড়ি করে কে আমাদের অনুসরণ করবে? কে আমাদের বাঁচাবার চেষ্টা করবে? আমার তো এই সাতনায় সেরকম বন্ধু কেউ নেই। কামালের কথা বাদ দিচ্ছি, সে গগাপনে অনুসরণ করবে কেন? তা হলে কে হতে পারে?

তারপর নরেন্দ্র ভার্মার দিকে ফিরে বললেন, তুমি এবারেও আমাকে টোপ ফেলেছিলে, তাই না? আমি যে এখানে এসেছি, সে-খবর তুমিই ছড়িয়েছ। খবরের কাগজে আমার কথা ছাপাবার ব্যবস্থা করেছ।

নরেন্দ্র ভামা সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, মাছধরার জন্য যেমন টোপ লাগে, সেইরকম বড়-বড় অপরাধীদের ধরার জন্য তুমি বেশ ভাল টোপ। এই ব্যাটা অবোধরাম জেল ভেঙে পালিয়েছে কয়েক মাস আগে, কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না, তখন ভাবলাম, ও নিশ্চয়ই তোমার ওপর প্রতিশোধ নিতে আসবে। কলকাতায় তোমার বাড়িতে বোমা ছোড়ার ঘটনা শুনে মনে হল, সেটা অবোধরামেরই কীর্তি। রাজা, তুমি যখন সাতনায় বেড়াতে আসতে চাইলে, তখনই ঠিক করলাম, তা হলে অবোধরামকেও এখানে টেনে আনা যাক। তাই তোমার এখানে আসার খবর ছড়িয়ে দিলাম। অবোধরাম তোমাকে মারতে আসবে, আমি পেছন থেকে ওকে এসে ধরব!

কাকাবাবু বললেন, আমিও ভাবলাম, কেউ যখন আমার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছে, তখন বাড়িতে লুকিয়ে বসে থেকে কিংবা পুলিশের সাহায্য নিয়ে বেঁচে থাকা যাবে না। হঠাৎ বোমা ছুড়বে কিংবা চলন্ত গাড়ি থেকে গুলি চালাবে। তার চেয়ে ওদের প্রকাশ্য জায়গায় মুখোমুখি টেনে আনাই ভাল। বাজারে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিলাম যে, মাছ ধরতে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি। সে-খবর পেয়ে ওরা আসবেই। তবে একবার সূর্যপ্রসাদ, একবার অবোধরাম, এরকম যে পরপর আসবে, সেটা চিন্তা করিনি!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, ওই সূর্যপ্রসাদ তো চুনোপুঁটি। ওর কথা আমিও ভাবিনি। ওকে ফাউ হিসেবে পাওয়া গেছে। অবোধরামই রাঘব বোয়াল।

অংশু বলল, সার, একটা কথা বুঝতে পারছি না। আপনি পুলিশ-টুলিশ না নিয়ে এখানে চলে এলেন। নির্জন জায়গা, ওরা যদি প্রথমেই রাইফেল দিয়ে কিংবা স্টেনগান দিয়ে ট্যারা-রা রা করে গুলি চালিয়ে দিত, আপনি কী করে বাঁচতেন?

কাকাবাবু বললেন, অপরাধীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হয়। প্রথমেই গুলি এরা চালায় না। ভাড়াটে খুনিরা দূর থেকে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়। কিন্তু যারা দলের সর্দার ধরনের, তাদের প্রত্যেকেরই খুব অহঙ্কার থাকে। তারা সামনে এসে মারার আগে অনেক কথা বলে। নিজের যে কত বুদ্ধি আর শক্তি, সেটা প্রমাণ করতে চায়। এরা যত কথা বলবে, ততই সময় পাওয়া যাবে। যত সময় পাওয়া যায়, ততই ওদের সঙ্গে আরও কথা বলে রাগিয়ে দিতে হয়। রেগে গেলে ওরা অসাবধানী হয়ে পড়ে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা রায়চৌধুরী খুব লাকি। আগেও অনেকবার দেখেছি, ও কী করে যেন ঠিক বেঁচে যায়।

কাকাবাবু তার পিঠে একটা কিল মেরে বললেন, আমি লাকি, তাই না? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা। এর পরের বার তোমাকে টোপ হিসেবে দাঁড় করাব।

অবোধরাম হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চিত হয়ে শুয়ে আছে। গুলি লেগেছে তার কনুইতে, রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। আহত অবস্থাতেও সে চেয়ে আছে কটমটিয়ে।

সন্তু একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার মুখের দিকে। এবার বলল, কিন্তু কাকাবাবুর অসুখের সময় আমাদের বাড়িতে কালো চশমা পরে কে এসেছিল? সে তো এই লোকটা হতে পারে না! অবোধরাম বাঙালি নয়, কিন্তু সে পরিষ্কার বাংলায় কথা বলেছিল। তা ছাড়া, খুব সম্ভবত তার একটা চোখ পাথরের।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, না, সে এ নয়। তার নাম কানা হাবলু। পোশাকি নাম হাবুল সিং। সে বাঙালি হলেও অমৃতসর শহরের লোক। কখনও বাঙালি সাজে, কখনও পাঞ্জাবি। মাথায় বুদ্ধি বিশেষ নেই, কিন্তু গায়ে খুব জোর। একটা ব্যাঙ্ক ডাকাতির কেসে ধরা পড়ে দিল্লির এক জেলে অবোধরামের সঙ্গে ছিল। অবোধরামের বুদ্ধিতেই সেও জেল থেকে একসঙ্গে পালায়। অবোধরাম তাকেই কলকাতায় পাঠিয়েছিল তোমার গতিবিধি জানবার জন্য। গ্যাস বোমা বোধ হয় নিজের বুদ্ধিতেই সে ছুড়েছিল। ঠিক বলেছ সন্তু, কানা হাবলুর একটা চোখ পাথরের।

কামাল বললেন, আমাকেও বোধ হয় সেই লোকটাই একবার আক্রমণ করতে এসেছিল।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হতেই পারে। তবে সে কয়েকদিন আগে ধরা পড়ে গেছে, তাকে জেরা করে সব জানা যাবে!

কাকাবাবু বললেন, একটা মজা কী জানো, সন্তু আর জোজো আমাদের আফগানিস্তানের সেই প্রথম অভিযানের কাহিনীটা খুব শুনতে চেয়েছিল, কদিন ধরে কামাল আর আমি সেটা ওদের বলছিলাম। ওই সময়ই অবোধরাম এসে হানা দিল!

নরেন্দ্র ভার্মা অবোধরামের দিকে তাকিয়ে বললেন, পেহলবান, এই স্টেনগানটা জোগাড় করলে কোথা থেকে? তোমার টাকার অভাব নেই, চুপচাপ কোনও গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে থাকলে তোমাকে খুঁজে বার করা যেত না। রাজা রায়চৌধুরীকে খোঁচাতে এসেই তুমি ধরা পড়লে।

অবোধরাম গম্ভীর গলায় বলল, কোনও জেল আমায় ধরে রাখতে পারবে না। আমি আবার বেরোব। তোমাদের ওপর ঠিক প্রতিশোধ নেব।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? যদি সত্যিই আবার বেরিয়ে আসতে পারো, তা হলে সেবারে নরেন্দ্রকে টোপ রাখব!

কামাল বললেন, ওর ডান হাতের পাঞ্জাটা একেবারে ভেঙে দিলে কেমন হয়? তা হলে আর কোনওদিন ও আর বন্দুক পিস্তল ধরতে পারবে না।

কাকাবাবু বললেন, না, না, ওসব করতে যেয়ো না! আমরা তো বিচারক নই, আদালত ওকে যা শাস্তি দেবে, সেটাই ও ভোগ করবে।

কামাল বললেন, ও দু-দুবার আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল, আমার ইচ্ছে করছে।

নরেন্দ্র ভার্মা তাঁর কাধে হাত দিয়ে বললেন, মাথা ঠাণ্ডা করুন কামালসাহেব! দেখছেন না, রাজা কেমন ফুর্তিতে আছে। চলো রাজা, এবার যাওয়া যাক। আর এখানে থেকে কী হবে?

কাকাবাবু বললেন, তোমরা এই লোকগুলোকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি এখন যাচ্ছি না। মাছ ধরতে এসেছি, এইবার মন দিয়ে মাছ ধরতে হবে।

কাকাবাবু জলের ধারে এগিয়ে গিয়ে ছিপ নিয়ে বসলেন। গুনগুন করে গান ধরলেন, আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি/ সন্ধ্যাবেলার চামেলি গো, সকালবেলার মল্লিকা/আমায় চেন কি?