০৯. সন্তু কিছু বুঝবার আগেই

সন্তু কিছু বুঝবার আগেই অন্ধকারের মধ্যে কেউ একজন তার মুখ চেপে ধরল। আর একজন তার কাঁধ ধরে তুলে নিল সিট থেকে।

টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে ট্রেন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সন্তু ছটফট করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না। টানেলটা শেষ হওয়ার একটু আগে লোক দুটো সন্তুকে নিয়ে ঝাঁপ দিল বাইরে।

ট্রেনের গতি এখানে বেশি নয়, ওদের তেমন লাগল না। ঝোঁক সামলে উঠে দাঁড়াবার আগেই একজন সন্তুর হাত দুটো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেলল। তারপর দুর্বোধ ভাষায় হুকুম দিল কী যেন।

সন্তু এখনও বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

চলন্ত ট্রেন থেকে কেউ যে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে, এরকম সে কল্পনাও করেনি একবারও। জোজো বারবার স্পাই-স্পাই করছিল বটে, ওটা তো জোজোর বাতিক। সব জায়গাতেই ও স্পাই দেখে।

এখানে সন্তু আর জোজোকে কে চেনে? ওদের পেছনে স্পাই লাগবে কেন?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, আমাকে কোথায় ধরে নিয়ে যাচ্ছ?

লোক দুটো ইংরেজি বা হিন্দি কিছু বোঝে না। ওরা কী যে উত্তর দিতে লাগল, তারও এক অক্ষর সন্তুর বোধগম্য হল না।

খুব একটা লম্বা-চওড়া চেহারা নয় ওদের। সন্তু ক্যারাটে জানে। কিন্তু হাত দুটো পেছনে বেঁধে ফেললে খুব মুশকিল হয়। হাত দুটো সামনে বাঁধা থাকলেও তবু ব্যবহার করা যায়, অনেক কিছু আটকানো যেতে পারে। বাধা দেওয়ার আগেই ওরা হাত দুটো পিছমোড়া করে দিল!

টানেলের বাইরে জঙ্গল, তার মধ্য দিয়ে ওরা সন্তুকে হাঁটাচ্ছে। পরিষ্কার দিনের আলো, এখন বেলা সাড়ে বারোটা-একটা হবে। এর মধ্যে দিয়ে ওরা

সন্তুকে হাত বাঁধা অবস্থায় নিয়ে যাবে, কেউ দেখবে না? জঙ্গলের মধ্যে মানুষজন দেখা যাচ্ছে না অবশ্য, কিন্তু কোথাও কি থাকবে না মানুষ?

সন্তু ভাবল, জোজো এখন কী করবে? ও বেচারি তো কিছুই বুঝতে পারবে। প্রথম মুখ চেপে ধরার সময় সন্তু একবার শুধু বঁহুঁ শব্দ করতে পেরেছিল, ট্রেনের আওয়াজে জোজো তা শুনতে পায়নি বোধ হয়। জোজো মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, একা হয়ে পড়লে খুব ঘাবড়ে যায়।

লোক দুটো মাঝে-মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে সন্তুকে। এই করে তারা ডাইনে কিংবা বাঁয়ে বোঝাচ্ছে। পাহাড় থেকে নীচের দিকে নামছে ওরা। যদিও কোনও পথ নেই।

এক জায়গায় কাঠ কাটার শব্দ শোনা গেল। দেখতেও পাওয়া গেল দুজন কাঠুরে একটা গাছ কাটছে। এই লোক দুটো লুকোবার চেষ্টা করল না, ওদের কাছ দিয়েই এগোচ্ছে। সন্তু চিৎকার করে উঠল, হেল্প, হেল্প। বাঁচাও, বাঁচাও!

কাঠুরে দুটো এদিকে ফিরল। ওদের হাতে কুড়ল, তবু তারা সন্তুকে বাঁচাবার জন্য এক-পাও এগোল না, বরং এই নোক দুটোর একজন ওদের দিকে চেঁচিয়ে কী যেন বলল, অন্যজন প্রথমে সপাটে এক চড় কষাল সন্তুর গালে। তারপর আর একটা জোর ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিল মাটিতে।

অর্থাৎ বোঝা গেল, এই লোকদুটো নিষ্ঠুর গুন্ডা হিসেবে এখানে পরিচিত, নিছক পরোপকার করার জন্য কেউ তাদের বাধা দেবে না।

সন্তু ভাবল, এবার নিশ্চয় ওরা তার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলবে।

ঠিক তাই, একজন চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল, তারপর নিজের জামা তুলে কোমরে গোঁজা রিভলভার দেখাল।

লক্ষ্মী ছেলের মতো মাথা নেড়ে সন্তু বলল, বুঝেছি। শুধু শুধু আর ওদের হাতে মার খেয়ে লাভ নেই। দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করলে গুলি করবে। দেখাই যাক, কোথায় নিয়ে যায়।

পাহাড় থেকে খানিকটা নীচে নামার পর একটা পাকা রাস্তা দেখা গেল। ওরা দাঁড়িয়ে রইল একটা গাছের আড়ালে। এই রাস্তা দিয়ে মাঝে-মাঝে ট্রাক যাচ্ছে। দূর থেকে একটা ট্রাকের নম্বর দেখে ওদের মধ্যে একজন রাস্তার মাঝখানে গিয়ে থামাল সেটাকে। ড্রাইভার এদের চেনা। তার সঙ্গে কী যেন কথা হল। তারপর তিনজনেই উঠে পড়ল ট্রাকে। ড্রাইভারটি সন্তু সম্পর্কে কোনও কৌতূহল প্রকাশ করল না।

ট্রাকটা অবশ্য ওদের বেশিদূর নিয়ে গেল না, নামিয়ে দিল এক জায়গায়। সেখান থেকে আবার একটা ট্রাক ধরে খানিকদূর যাওয়ার পর নেমে পড়ে শুরু হল হাঁটা। এখানেও চতুর্দিকে পাহাড়, তবে জঙ্গল বিশেষ নেই।

সন্তু মনে-মনে ভাবল, এইসব পাহাড়ের মাঝখানেই কোথাও কি আরাকু উপত্যকা? সেই জায়গাটা কেমন দেখতে, তা সন্তু জানে না, এদের কাছে কিছু জিজ্ঞেস করাও যাবে না।

প্রায় এক ঘণ্টা হাঁটার পর ওরা একটা গুহার মুখে পৌঁছল। সেখানে লোহার গেটে তালা ঝুলছে। ওদের মধ্যে একজন একটা পাথর নিয়ে গেটে ঠং ঠং করে একটুক্ষণ ঠোকার পর ভেতর থেকে একটা লোক এল। তার পিঠে বন্দুক ঝোলানো। সে তালা খুলে দিল।

গুহার ভেতরটা একেবারে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে নীচের দিকে। সন্তু দু-একবার হোঁচট খেয়ে পড়ল, হাত দিয়ে দেওয়াল ধরারও উপায় নেই। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর একটু-একটু আলো দেখা গেল। আলোটা কোথা থেকে আসছে, তা বোঝা যাচ্ছে না, কিংবা অন্ধকার চোখে সয়ে গেছে। গুহাটা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে, সন্তু দেখল, দেওয়ালের গায়ে কীসব যেন মূর্তি রয়েছে। কয়েকটা মূর্তি ভেঙে পড়ে আছে মেঝেতে। কাকাবাবু এই মূর্তিগুলোর কথাই বলেছিলেন? এরা তা হলে মূর্তি-চোর?

একটা জায়গায় হ্যাজাক বাতি জ্বলছে, সেখানে আর একটি লোক বসে আছে। দেওয়ালে হেলান দিয়ে। সেখানে ওরা থামল, একজন সন্তুর চুল ধরে জোর করে বসিয়ে দিল।

ওরাও বসল খানিকটা দূরে।

কিছুক্ষণ গল্প করার পর একজন খাবার নিয়ে এল; গোল হয়ে বসে ওরা খাবার খেতে লাগল। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই, সন্তুর মনে হচ্ছে, অনন্তকাল ধরে চলছে ওদের খাওয়া।

সন্তুকে কিছু দেয়নি। সন্তু ভাবল, ওদের খাওয়া হয়ে গেলে নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু ওদের শেষই যে হচ্ছে না! এতক্ষণ খাওয়ার কথা মনে পড়েনি। কিন্তু ওদের খেতে দেখে সন্তুর বেশ খিদে পেয়ে গেছে। অতিথিকে আগে খাবার দেওয়া উচিত ছিল না? বন্দিও তো এক হিসেবে অতিথি!

ওরা চেটেপুটে খেয়ে কোথায় যেন হাত ধুতে গেল। ফিরে এসে বিড়ি ধরিয়ে গল্প জুড়ে দিল আবার। সন্তুকে খাবার দেওয়ার কোনও নামই নেই।

আরও কিছুক্ষণ পরে সন্তু বুঝতে পারল, ওরা সত্যিই তাকে খাবার দেবে না। নিজেরা বসে বসে খেল, একটু চক্ষুলজ্জাও নেই। একজন আবার নির্লজ্জের মতো মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছে সন্তুর দিকে।

সন্তু ঠিক করল, খিদের কথা ভাববে না। ভাবলে বেশি কষ্ট হবে। মানুষ একদিন-দুদিন না খেয়ে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারে। বিপ্লবীরা দেশের জন্য কতদিন অনশন করেছেন। মহাত্মা গান্ধী প্রায়ই না খেয়ে থাকতেন। উঁহু, এসবও খাওয়ার চিন্তা, অন্যদিকে মন ফেরাতে হবে।

জোজো এখন কী করছে? জোজো আরাকু ভ্যালিতে পৌঁছে গেছে বহুক্ষণ আগে। নিশ্চয়ই কাকাবাবুকে সব খুলে বলেছে। এই জায়গাটা আরাকু ভ্যালি থেকে কতদূরে, তা সন্তু জানে না। কাকাবাবু ঠিক খুঁজে বার করবেন। কতক্ষণ লাগবে, সেই হচ্ছে কথা। ততক্ষণ না খেয়ে থাকতে হবে!

কপালটা চুলকোচ্ছে। কী একটা পোকা চলে গেল। হাত দুটো পেছন দিকে বাঁধা। চুলকোবার উপায় নেই। এ তো মহা মুশকিল! খাবার দিলে হাতের বাঁধন খুলতে হত, সেইজন্য দিল না?

চারটে লোককেই মনে হচ্ছে নিছক নিচু ধরনের গুন্ডা বা ডাকাত। লেখাপড়া জানে না। বুদ্ধিসুদ্ধি বিশেষ নেই। এখান থেকে মূর্তি ভেঙে-ভেঙে বিক্রি করে। এরা কাকাবাবুকে চিনবে কী করে? সন্তুকেই বা ধরে রাখবে কেন? এদের নেতা-টেতা কেউ নেই? এদের সঙ্গে যে কোনও কথাই বলা যাচ্ছে না!

যে দুজন লোক সন্তুকে ধরে এনেছিল, তারা একটু পরে চলে গেল। অন্য দুজন শুয়ে পড়ল পাশাপাশি। খাওয়া হয়েছে, এবার ঘুমোবে।

সন্তু আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। গুহার মুখটার দিকে যেতে গেলে ওই লোক দুটোর পাশ দিয়ে যেতে হবে। আগেই সে ঝুঁকি না নিয়ে সে পা টিপেটিপে হেঁটে গেল গুহার আরও ভেতরের দিকে।

সেদিকে অন্ধকার বেশ পাতলা। ক্রমেই আলো বাড়ছে, ওপরের কোনও জায়গা দিয়ে দিনের আলো ঢুকছে। এদিককার দেওয়ালে কোনও মূর্তি নেই। সব খুলে নিয়েছে। সন্তু দেখল, এক জায়গায় চায়ের পেটির মতো বড়বড় অনেক কাঠের বাক্স। ভেতরে কী আছে বোঝবার উপায় নেই, সন্তুর হাত বাঁধা। মূর্তিগুলোই ভরে রেখেছে মনে হয়!

আরও একটু এগোতে দেখা গেল এক জায়গায় জল জমে আছে। একটা ছোটখাটো পুকুরের মতো। নিশ্চয়ই ওপরে কোথাও ফাটল আছে, সেখান থেকে বৃষ্টির জল আসে। ফাটল অবশ্য দেখা যাচ্ছে না। জল বেশ পরিষ্কার।

সেই জলাশয়টা পেরোবার পর এক জায়গায় গুহাটা শেষ হয়ে গেছে। এখানে আবার আলো কম। শেষের জায়গাটায় পরপর তিনটে খুপরির মতো। মানুষ তৈরি করেনি, দেখলেই বোঝা যায়, আপনাআপনি তৈরি হয়েছে। একটা খুপরির দেওয়ালে পোড়া-পোড়া দাগ। সেখানে সন্তু বারুদের গন্ধ পেল। এই দেওয়ালে অনেক মূর্তি ছিল? বারুদের গন্ধ কেন?

পাশের খুপরিটাও একই রকম। তৃতীয় খুপরিটার সামনের দিকটা একটা বড় পাথর ফেলে আড়াল করা। সেখানে উঁকি দিয়েই সন্তু ঘেন্নায় নাক কুঁচকে পিছিয়ে এল, বিচ্ছিরি বিকট গন্ধ। খুব সম্ভবত ওটা বাথরুম।

সন্তু আবার ফিরে এল। লোক দুটো কি ঘুমিয়ে পড়েছে? গুহার মুখটার কাছে পৌঁছতে পারলে লোহার গেট পার হওয়ার একটা কিছু ব্যবস্থা করা যাবেই। কিন্তু কাছে আসতেই দেখল, ওদের মধ্যে একজন উঠে বসে বিড়ি খাচ্ছে। বন্দুকটা কোলের ওপর রাখা।

সন্তু কাছে এসে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ওয়াটার? পানি? বহুত পিয়াস লাগা।

লোকটা বন্দুকটা তুলে সন্তুর দিকে তাক করে পাশের লোকটিকে ডাকল। সে লোকটি কাঁচা ঘুম ভাঙায় বিরক্ত হয়ে উঠে এল সন্তুর কাছে। এমন আচমকা ঘুসি মারল যে, সন্তুর মাথা ঠুকে গেল দেওয়ালে। তারপর সন্তু বসে পড়তেই সে একটা শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে সন্তুর পা দুটোও বেঁধে ফেলল। সন্তু পা সরিয়ে নিতে পারছে না, কারণ অন্য লোকটির বন্দুকের নল তার বুকের দিকে।

এরা একেবারে যাচ্ছেতাই লোক। সন্তু চাইল জল, তা তো দিলই না, এখন পা দুটোর স্বাধীনতাও চলে গেল।

সন্তু সেখানেই পড়ে রইল একভাবে। লোক দুটি দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোল খানিকক্ষণ। সন্তুর চোখে ঘুম নেই। সে দেখতে লাগল বাইরের থেকে যে দিনের আলো আসছিল তা ফুরিয়ে গেল আস্তে-আস্তে।

সেই লোক দুটো সন্তুর দিকে আর মনোেযোগ দিল না একবারও। ওদের এখানে পাহারা দেওয়া ছাড়া কাজ নেই। এক সময় ওরা চা তৈরি করে বিস্কুট ভিজিয়ে খেল। এরা তো মূর্তি ভাঙার কাজও করে না? ভাল-ভাল মূর্তি সব ভাঙা হয়ে গেছে! এরা শুধু বাক্সগুলো পাহারা দিচ্ছে?

সন্ধের কিছু পরে আরও মানুষের গলার শব্দ পাওয়া গেল। একসঙ্গে ঢুকল। দুজন লোক। সাধারণ গুন্ডার মতো চেহারা এদের নয়। একজন সুট পরা। এদের মধ্যে একজন আবার মহিলা, সে পরে আছে জিন্স আর টি-শার্ট। মাথার চুল খোলা। সকলের হাতে টর্চ।

অন্যরা চলে গেল জলাশয়ের দিকে। শুধু মহিলাটি সন্তুর কাছে এসে উঁকি মারল। সন্তু তার চোখে চোখ রাখল। নিষ্ঠুর ধরনের দৃষ্টি সেই মহিলাটির। এর কাছ থেকে দয়া-মায়া পাওয়ার আশা নেই।

তবু সন্তু ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, ম্যাডাম, আমাকে ধরে রাখা হয়েছে। কেন, জানতে পারি কি?

মহিলাটি কর্কশ গলায় বলল, সময় হলেই জানতে পারবে।

সন্তু আবার বলল, কখন সেই সময় হবে?

মহিলাটি বলল, তোমার আঙ্কলকে আগে এখানে আসতে হবে। সে এলেই তুমি ছাড়া পেয়ে যাবে।

সন্তু বলল, আমার আঙ্কল কি খবর পেয়েছেন?

মহিলাটি এবার ধমকে বলল, শাট আপ! তারপর সে চলে গেল ভেতরের দিকে।

খানিক বাদে সন্তু দড়াম-দড়াম করে খুব জোর শব্দ শুনে চমকে উঠল। কেউ গুলি চালাচ্ছে? আওয়াজ আসছে গুহার শেষ প্রান্ত থেকে। ওখানে কে গুলি চালাবে? সন্তুর মনে পড়ল, দুটো কুঠরিতে সে পোড়া-পোড়া দাগ দেখেছিল। এরা এখানে গুলি চালানো প্র্যাকটিস করে?

সন্তু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারল না। দশ বারোবারের পর শব্দ থেমে গেল।

সবাই ফিরে এল হ্যাজাক বাতির কাছে। মেঝেতেই গোল হয়ে বসে কথা বলতে লাগল গম্ভীরভাবে। যেন কোনও গুরুতর বিষয় আলোচনা হচ্ছে। সন্তু কানখাড়া করে শোনার চেষ্টা করল। তার বিষয়েই কিছু বলছে? ওরা কথা বলছে তেলুগু ভাষায়, সন্তুর বোঝার সাধ্য নেই। মাঝে-মাঝে দু-একটা ইংরেজি শব্দ। টেস্টিং, কোয়ালিটি, স্ট্যান্ডার্ড, টুমরো এইরকম কয়েকটা শুধু শব্দ শুনেও কিছু বোঝা যায় না।

এক সময় সন্তু মাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে ওঃ ওঃ শব্দ করতে লাগল। বাচ্চারা অভিমান করে যেমন গড়াগড়ি দেয় সেইভাবে। সেইসঙ্গে কান্না। এবার ওরা সন্তুর দিকে মনোযোগ না দিয়ে পারল না।

মহিলাটি কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কুকুরের মতন চ্যাঁচাচ্ছ কেন?

সন্তু বলল, বাথরুম, বাথরুম। সারাদিন আমাকে বাথরুমে যেতে দেওয়া হয়নি।

মহিলাটি সুট-পরা পুরুষটির দিকে তাকাল। সে বলল, বাঃ, বাথরুমে যাবে না? এই জায়গাটা নোংরা করবে নাকি? পাঠাবার ব্যবস্থা করো।

একজন লোক এসে সন্তুর হাত আর পায়ের বাঁধন খুলে দিল। তার এক হাতে বন্দুক, অন্য হাতে বড় টর্চ। খানিকটা গিয়ে এক জায়গায় টর্চের আলো ফেলে বলল, ওইখান থেকে মগটা তুলে নাও। জল ভরো।

গুহার শেষে এখনও তীব্র বারুদের গন্ধ ভাসছে, তাতে বাথরুমের দুর্গন্ধ অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। সন্তুকে বাইরে জামা-প্যান্ট খুলতে হল। ভেতরে একটা গর্ত করা আছে, আর নিরেট পাথরের দেওয়াল। এদিক দিয়ে বেরোবার কোনও উপায় নেই।

সন্তুর সত্যিই খুব বাথরুম পেয়েছিল। মানুষ না খেয়ে তবু থাকতে পারে, কিন্তু বাথরুমে না গিয়ে কি পারে? সন্তুর বেশ আরাম লাগল।

বেরিয়ে প্যান্ট শার্ট পরার পর সন্তুকে আবার আনা হল আগের জায়গায়। সুট-পরা লোকটির দিকে তাকিয়ে সন্তু বলল, আমাকে সারাদিন একফোঁটা জল খেতে দেয়নি। কোনও খাবারও দেয়নি। তোমরা কীরকম মানুষ? পৃথিবীর সব দেশেই বন্দিদের খেতে দেওয়ার নিয়ম আছে।

সেই লোকটি এক পলক সন্তুকে দেখেই মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বিরক্তভাবে বলল, মঞ্চি, একে কিছু খেতে দাওনি কেন? এ ছোকরাটা অসুস্থ হয়ে পড়লে অনেক ঝঞ্ঝাট হবে। কাউকে বলো, আমার গাড়িতে কিছু কেক আছে, নিয়ে আসুক!

সারাদিন কিছু খেতে না দিয়ে এখন একেবারে কেক? এ যে রাজার মতো খাতির। সন্তু পেট ভরে কেক খেয়ে, দু গেলাস জল শেষ করে বলল, থ্যাঙ্ক ইউ?

তারপর সে শুয়ে একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর তো কিছু করার নেই। এখন শরীর বেশ ঠাণ্ডা হয়েছে।

তার ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। সবাই চলে গেছে, শুধু রয়েছে দুজন প্রহরী। তারা বসে বসে চা খাচ্ছে।

সন্তু হ্যাংলার মতো তাকিয়ে রইল। ওদের মালিকরা নিশ্চয়ই নির্দেশ দিয়ে গেছে, আজ এক ভাঁড় চা আর দুটো বিস্কুট নিয়ে এল একজন।

সন্তু বলল, হাত বাঁধা, খাব কী করে? হাত খুলল না, লোকটা নিজেই খাইয়ে দিল সন্তুকে।

তৃপ্তি করে খেয়ে, সন্তু মিষ্টি হেসে বলল, অনেক ধন্যবাদ, মেনি, মেনি থ্যাঙ্কস, বহুত শুক্রিয়া, আপনাদের ভাষায় কী যেন বলে তা আমি জানি না ভাই।

অন্য লোকগুলো হয়তো আবার রাত্তিরে আসবে, সারাদিন এদের দুজনের সঙ্গে কাটাতে হবে। এদের বোঝাতে হবে সে অতি শান্ত আর নিরীহ ছেলে। এবং ভিতু। না হলে মার খেতে হবে এদের হাতে। সুট-পরা লোকটার কথা শুনে বোঝা গেছে, সন্তুকে মেরে ফেলা হবে না, তাকে বাঁচিয়ে রাখাই উদ্দেশ্য। ওরা কাকাবাবুকে এখানে টেনে আনতে চায়।

খানিক পরে সন্তু বাথরুমে যেতে চাইল। একজন নিয়ে গেল তাকে। সন্তু কোনওরকম চালাকি না করে বাধ্য ছেলের মতো ফিরে এল। আবার হাত-পায়ের বাঁধন মেনে নিয়ে বসে রইল।

খানিকক্ষণ পরে একটা বাসন উলটে পড়ার ঢনঢ়ন শব্দে চমকে উঠল সন্তু। একটা বানর লাফাচ্ছে ভেতর দিকে। কোথাও কিছু রান্নাবান্নার জিনিসপত্র রাখা ছিল, তা নিয়ে টানাটানি করছে, প্রহরীরা রে-রে করে তেড়ে গেল। একটা নয়, তিনটে বানর, ওরা এল কোথা থেকে? বানরগুলো হুপ-হুপ শব্দে লাফালাফি করে এক সময় পালাল। ওরা কোথা থেকে এল, কোথায় গেল, ঠিক বোঝা গেল না।

বানরগুলোর জন্য তবু কিছুক্ষণ মজা পাওয়া গেল। প্রহরীরা ইচ্ছে করলেই বানরদের গুলি করতে পারত, কিন্তু এরা বানর মারে না। ভক্তি করে।

বসে বসে সময় কাটবে কী করে? কতদিন এখানে থাকতে হবে?

এক সময় প্রহরীরা রান্নার উদ্যোগ করতে লাগল। ওদের কাছে শুধু একটা স্টোভ আছে। আটা মেখে রুটি তৈরি করল, আর আলুর তরকারি। দূর থেকে সন্তু গুনছে, কটা রুটি সেঁকা হল। সবসুষ্ঠু পনেরোটা। ওরা সন্তুকে দেবে নিশ্চয়ই। সন্তুর তিনখানা পেলেই চলবে।

দুপুরে খাওয়ার সময় সন্তুর পিছমোড়া বাঁধন খুলে দিয়ে হাত দুটো সামনে এনে বেঁধে দিল। তা হলে সন্তুকে খাইয়ে দিতে হবে না। ওই অবস্থায় সে নিজেই খেতে পারে। সন্তু ঠিক যা ভেবেছে, তাই। ওরা নিজেরা ছখানা করে রুটি নিয়ে সন্তুকে দিল তিনখানা। ওর আর লাগবে কি না, তা জিজ্ঞেসও করল না। ওরা নিজেরা হাত ধুয়ে এল, সন্তুকে জল দিল না।

ওরা যখন শুয়ে পড়ার উদ্যোগ করছে, তখন সন্তু বলল, আর একবার বাথরুম যাব, প্লিজ!

বাথরুম শব্দটা এরা এখন বুঝে গেছে। বন্দুকধারীটি শুয়ে রইল, আর-একজন রিভলভার নিয়ে চলল সন্তুর সঙ্গে সঙ্গে। সন্তু গুনগুন করে একটা গান গাইছে।

বাথরুমে ঢুকেও সন্তু গান গাইতে লাগল। এবার তার বাথরুম পায়নি। তবু দুর্গন্ধের মধ্যে বসে রইল প্রায় দশ মিনিট। বাইরে থেকে লোকটা তাড়া দিয়ে কিছু বলছে। সন্তু তবু আরও খানিকটা দেরি করে বেরোল। লোকটা অধৈর্য হয়ে গেছে। প্যান্ট-শার্ট পরে নিয়ে সন্তু হাত দুটো বাড়িয়ে দিল বাঁধার জন্য।

লোকটি রিভলভারটা নামিয়ে রেখে দু হাত দিয়ে সন্তুকে যেই বাঁধতে গেল, সন্তু লাথি কষাল তার থুতনিতে। সে ছিটকে পড়ে যেতেই সন্তু এক লাফে তার বুকের ওপর বসে মাথাটা কয়েকবার ঠুকে দিল পাথরে। লোকটার জ্ঞান চলে গেল। নিজের দড়ি দিয়ে সন্তু বেঁধে ফেলল ওর হাত আর পা।

এবার সন্তুর দু হাত ভোলা, তার হাতে অস্ত্র আছে। তাকে কে আটকাবে? অন্য নোকটাকে পার হয়ে যেতে হবে গুহার মুখে।

অন্য লোকটা কী করে যেন টের পেয়ে গেছে। রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কী যেন বলল, তার সঙ্গীর সাড়া না পেয়ে সে গুলি চালাল সন্তুর দিকে। সন্তু ততক্ষণে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়েছে, রাইফেলের টিপ করা অত সহজ নয় সে জানে, গুলিটা চলে গেল অনেক দূর দিয়ে।

লোকটা এবার দৌড়ে আসছে সন্তুর দিকে। অন্য কোনও উপায় নেই, সন্তু অন্ধকারে সরে গিয়ে লোকটির দিকে গুলি চালাল। পরপর দুবার। লোকটি পড়ে গেল ধপাস করে। সন্তুর বুকটা ধকধক করতে লাগল। লোকটা মরে গেল নাকি? সে মানুষ খুন করল? সে না মারলে এই লোকটা নির্ঘাত তাকে মারত।

কাছে গিয়ে দেখল, দুটো গুলি লেগেছে লোকটার ডান কাঁধে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। তবে ও বেঁচে যাবে। ওর হাত-পা বাঁধার দড়ি নেই, সন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাল না, ওর এখনই জ্ঞান ফিরবে না। ওর পাশ থেকে টর্চটা তুলে নিল।

গুহার মুখের দিকে যাওয়ার আগে সন্তু উলটো দিকে গেল। একটা কৌতূহল তাকে মেটাতেই হবে। ওই বাক্সগুলোর মধ্যে কী আছে!

একটা বাক্সের ডালা খুলতেই দারুণ বিস্ময়ের চমক লাগল। মূর্তিটুর্তি কিছু নেই। থরে থরে সাজানো রয়েছে হ্যান্ড গ্রেনেড। যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয় যেসব হাতবোমা। এমনি কখনও এই বোমা দেখেনি সন্তু, অনেক যুদ্ধের ফিমে দেখেছে। লম্বা লম্বা আতার মতো।

এত বোমা এখানে কেন? এইসব বোমা তৈরি করে মিলিটারি। এই লোকগুলো বোমা তৈরি করে বিক্রি করবে। কাল রাত্তিরে তা হলে গুলির শব্দ শোনেনি, এই বোমাগুলোর কয়েকটা পরীক্ষা করছিল। তাই টেস্টিং শব্দটা কয়েকবার বলছিল ওরা। এইরকম মাটির অনেক নীচে, গভীর গুহার মধ্যে বোমা তৈরি করলেও পরীক্ষা করে দেখা খুব নিরাপদ। কেউ টের পাবে না।

বাক্সগুলো দেখে মনে হল, এখানে কয়েক হাজার বোমা আছে।

আর দেরি করার উপায় নেই। বাক্সটা বন্ধ করে সন্তু সুড়ঙ্গের মুখের দিকে দৌড় শুরু করল। এদিকে একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। টর্চ না থাকলে সন্তু একটুও এগোতে পারত না। বারকয় ধাক্কা খেতে হত। গুহাটা কোথাও বেশ সরু, কোথাও অনেক চওড়া। এই অন্ধকার জায়গাতেই দেওয়ালের গায়ে রয়েছে নানারকম মূর্তি।

গেটের তালার চাবি আনতে ভুলে গেছে সন্তু। কিন্তু গেটের ওপর দিকে খানিকটা খোলা। তরতর করে গেট বেয়ে উঠে সে অন্যদিকে লাফিয়ে পড়ল। মুক্তি, মুক্তি! এরা সন্তুকে চেনে না, চিনলে আরও সাবধান হত।

রাত্তিরবেলা লোকগুলো কোথা থেকে এসেছিল, তারা কতদূরে থাকে, তা জানে না সন্তু। হয়তো কাছাকাছি তাদের আস্তানা আছে। এখন লুকিয়ে পড়তে হবে। কোনও রাস্তাটাস্তা না খুঁজে সন্তু পাহাড়ের ওপরদিকে উঠে গেল। বড় বড় পাথরের আড়ালে গা-ঢাকা দেওয়া সোজা, কেউ দেখতে পাবে না।

মাঝে-মাঝে কিছু ঝোপঝাড় ছাড়া এ-পাহাড়ে বড় গাছ বিশেষ নেই। তবে চারদিকে যেরকম ঢেউয়ের মতো পাহাড়ের পর পাহাড়, এর মধ্যে থেকে কোনও লোককে খুঁজে বের করা চাট্টিখানি কথা নয়!

সন্তু কাঠবিড়ালির মতো তরতর করে উঠে যেতে লাগল এক পাথর থেকে অন্য পাথরে। তারপর একটা ছায়াঘেরা জায়গা দেখে বিশ্রাম করতে লাগল।

ওই লোকগুলো তাকে ধরে রেখেছিল কেন, সন্তু চিন্তা করতে লাগল। এরা মূর্তি-চোর নয়, বোমার চোরাকারবারি। মানুষ খুনের ব্যবসা। দেশের কত জায়গায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লড়াই হয়, সেইসব জায়গায় এরা বোমা বিক্রি করে। হয়তো দু পক্ষের কাছেই। সীমান্ত অঞ্চলে কত বিদ্রোহী, উগ্রপন্থী দল আছে, এইসব বোমা চলে যাবে তাদের হাতে। তারা যে এ-দেশের কত ক্ষতি করছে, তা নিয়ে এই ব্যবসায়ীরা মাথা ঘামায় না। হাজার-হাজার মানুষ মরুক, এরা নিজেদের টাকা পেলেই খুশি।

কিন্তু এদের সঙ্গে কাকাবাবুর সম্পর্ক কী? কাকাবাবুর মুখে বোমাটোমার কথা তো কিছু শোনেনি সন্তু। কাকাবাবু কতকগুলো নতুন আবিষ্কার করা মূর্তি দেখতে এসেছিলেন। সেগুলো কি এই গুহার দেওয়ালের গায়ের মূর্তি? কাকাবাবু এই গুহায় আসতে চেয়েছিলেন। ইতিমধ্যে এরা এই গুহাটা দখল করে নিয়ে এখানে বোমা তৈরি করছে। কাকাবাবু সেটা জেনে ফেললে ওদের মহা বিপদ। হুঁ, ব্যাপারটা আসলে তাই। কিন্তু কাকাবাবুর তো এর মধ্যেই এই গুহায় চলে আসা উচিত ছিল, উনি এখনও পৌঁছলেন না কেন? ভাইজাগ থেকে চলে এসেছেন তিনদিন আগে…তা হলে কি উনি এদের কথা টের পেয়ে গেছেন? তৈরি হয়ে নিচ্ছেন?

কাল দুপুরে যে দুটো লোক সন্তুকে ধরে এনেছিল, তারা কি আজও আসবে? এলেই সন্তুর পালানোর ব্যাপারটা জেনে যাবে। নিশ্চয়ই মালিকদের ভয়ে তারা মরিয়া হয়ে খুঁজবে সন্তুকে। সন্তুর পক্ষে এক্ষুনি পাহাড় ছেড়ে রাস্তায় নামা ঠিক হবে না। সে শুয়েই রইল।

আরও একটা কথা মনে হল সন্তুর। এই গুহার মধ্যে বোমার স্টকের কথা সন্তু জেনে ফেলেছে। সন্তু যদি আবার ধরা না পড়ে, তা হলে ওরা নিশ্চয়ই এইসব বোমা এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। আবার কোনও জায়গায় লুকোবে। কিংবা বিক্রি করে দেবে! হাজার-হাজার বোমা, কত মানুষ মরবে, কত বাড়ি ধ্বংস হবে। এইসব জিনিসের ব্যবসা যারা করে, তারা তো আসলে নরপশু!

সন্তুর হাত নিশপিশ করছে। ইস, কেন সে বোমাগুলো নষ্ট করে দিয়ে এল না! কোনওরকমে জায়গাটায় আগুন ধরিয়ে দিলে হত। কিন্তু সন্তু পালাবার চিন্তায় ব্যস্ত ছিল। খালি মনে হচ্ছিল, আরও যদি কেউ এসে পড়ে!

বিকেল ফিকে হয়ে এল ক্রমশ। সন্তু শুয়ে-শুয়ে নিজের সঙ্গে তর্ক করে যাচ্ছে। তার মনের মধ্যে দুটো ভাগ হয়ে গেছে। এক ভাগ বলছে, ছিঃ সন্তু, তুমি অত মানুষ মারার অস্ত্র দেখেও কিছু না করে চলে যাবে?

অন্য ভাগ বলছে, আমি কী করব? তখন পালানোটাই ছিল বড় কথা। মানুষ আগে নিজে বাঁচতে চায়।

স্বার্থপরের মতন কথা বোলো না। কত লোক এই বোমার আঘাতে মরবে, তার তুলনায় তোমার নিজের জীবনটা বড় হল? ইচ্ছে করলে তুমি এখনও সেই লোকদের বাঁচাতে পারো।

কী করে?

ওই গুহার মধ্যে আবার ফিরে যাও!

আবার? সাধ করে কেউ আর ওখানে মাথা গলায়? ধরা পড়লে এবার নির্ঘাত খুন হয়ে যাব।

ধরা পড়বে কেন?

বারবার কি একই রকম ভাবে বাঁচা যায়?

ভয় পাচ্ছ সন্তু? তুমি রাজা রায়চৌধুরীর ভাইপো সুনন্দ রায়চৌধুরী। তোমার এরকম ভয় পাওয়াটা মানায় না।

ভয়ের কথা হচ্ছে না। শুধু-শুধু গোঁয়ার্তুমি করার কী মানে হয়? আবার ফিরতে হলে, ওই সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে, ভেতরে অত অন্ধকার, টর্চ না জ্বেলে উপায় নেই। ভেতরে কেউ থাকলে সেই টর্চের আলো দেখে খুব সহজে আমাকে গুলি করতে পারবে।

হয়তো অন্য কোনও পথ আছে। বানরগুলো ঢুকেছিল কী করে? তারা কোনদিক দিয়ে পালাল? সেই পথটা খুঁজে দেখো।

বানরটানরের কথা ছাড়ো তো! আবার ফিরে যাওয়ার গোঁয়ার্তুমিটা কাকাবাবু সমর্থন করতেন?

কাকাবাবু তোমার জায়গায় থাকলে ঠিক আবার ফিরে যেতেন। কাকাবাবু তো এইরকমই গোঁয়ার! জেদি!

ভেতরে যদি অনেক লোক এসে থাকে, আমি একা কী করে লড়ব?

অনেক সময় একাই দাঁড়াতে হয় সন্তু। যতই লোক থাকুক বিপক্ষে, তবু সত্যের জন্য একা দাঁড়াতে হয়। ইবসনের অ্যান এনিমি অব দ্য পিল নাটকটা তুমি কিছুদিন আগেই তো পড়েছ, মনে নেই? যে-নাটকের শেষে আছে, যে একলা দাঁড়াতে পারে, সে-ই সবচেয়ে শক্তিশালী। দ্য স্ট্রংগেস্ট ম্যান ইজ হি, হু স্ট্যান্ডস অ্যালোন।

সন্তু ধড়মড় করে উঠে বসল, সত্যি তো, বানরগুলো ঢুকেছিল কোথা দিয়ে? তারা গুহার মুখের দিকেও ছুটে পালায়নি। তা হলে সত্যি আর একটা রাস্তা আছে ঢোকার। একটা বানর বেশ বড় ছিল।

সন্তুর মনের দুটো ভাগ একসঙ্গে মিলে গেছে। সে ঠিক করে ফেলেছে, সে এখন এখান থেকে যাবে না। আজ রাতের মধ্যেই যদি ওরা বোমার বাক্সগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, সন্তু ওদের অনুসরণ করবে। ওগুলো কোথায় নিয়ে যায়, তা দেখতে হবে। আর যদি বোমাগুলো না সরায় আজ, তা হলে কাল সকালে সে আবার ওই গুহায় ফিরে যাবে। বানরদের ঢোকার পথটা খুঁজে বার করতে হবে।

পাহাড় থেকে খানিকটা নেমে এল সন্তু। যাতে গুহার প্রবেশপথটায় নজর রাখা যায়। জেগেই বসে রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। মাঝে-মাঝে ঝিমুনি আসছে, আবার উঠে বসছে। ভাগ্যিস দুপুরে তিনটে রুটি খেয়েছে, তাই তেমন খিদে পাচ্ছে না।

রাতে কেউ এল না। সেই পাঁচ-ছজন এলে নিশ্চয় কোনও গাড়ির শব্দ পাওয়া যেত, তারা তো হেঁটে আসবে না। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ল সন্তু।

চোখে রোদ লাগায় তার ঘুম ভাঙল।

একটু এগিয়ে এসে দেখল, গুহার মুখের লোহার গেটটা খোেলা। দুজন লোক একটা রবারের চাকা লাগানো ছোট ঠেলা গাড়ি সেই গুহার মধ্যে ঢোকাবার চেষ্টা করছে। সন্তু চমকে উঠল। ওই ঠেলাগাড়িতে করেই বাক্সগুলো বার করবে। এর আগেও কিছু বার করে ফেলেছে নাকি?

আর সময় নেই। ঠেলাগাড়িটাকে শেষপর্যন্ত নিয়ে যেতে বেশ কিছুক্ষণ লাগবে, কারণ গুহার অনেক বাঁক, কোথাও বেশ উঁচু-নিচু। ওটা পৌঁছবার আগেই সন্তুকে বানরদের ঢোকার পথ খুঁজে বার করতে হবে।

সন্তু গুহার ছাদের ওপর দিয়ে দৌড়ল।

এক জায়গায় একটা বেশ বড় ঝুপসি বটগাছ, তাতে দোল খাচ্ছে অনেক বানর। এইখানেই তা হলে পাওয়া যেতে পারে।

প্রথমে সন্তু গর্ত-টর্ত কিছু দেখতে পেল না। তবে এক জায়গায় দেখল পাথরের দুটো ভাঁজ। মাঝখানটায় ফাঁক। ইচ্ছে করলে কোনও মানুষ শুয়ে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে সেই ভাঁজের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে। সন্তু আগে একবার পা গলিয়ে দেখে নিল।

কয়েকটা বানর কাছাকাছি এসে খ্যাঁক খ্যাঁক করছে। তাদের নিজস্ব যাতায়াতের পথটা অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দিতে চায় না। রিভলভারটা কোমরে গুঁজে, এক হাতে টর্চ নিয়ে চিত হয়ে শুয়ে সেই ভাঁজের মধ্যে ঢুকে পড়ল সন্তু।

বেশ খানিকটা যেতে হল। এইখান দিয়ে জল চুইয়ে পড়ে, শ্যাওলা জমে আছে, এখনও ভিজে ভিজে। হঠাৎ পাথর শেষ হয়ে গেল, তারপরেই গুহা।

সন্তু প্রথমে খুব সন্তর্পণে মাথাটা বার করে দেখল। তলাতেই সেই জলভর্তি জায়গাটা। ভালই হল, প্রহরীরা খানিকটা দূরে বসে। কিন্তু এখান থেকে গুহার মেঝে অনেক নিচু, নামা যাবে কী করে? ঝাঁপ দিলে একেবারে জলাশয়ে পড়তে হবে। বানরগুলো নিশ্চয়ই সেইভাবে নামে না।

এদিক-ওদিক হাত বুলিয়ে সন্তু পেয়ে গেল গাছের মোটা শিকড়। ওপরেই একটা বটগাছ রয়েছে। বটের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত যায়। সেই শিকড় ধরে যা থাকে কপালে ভেবে ঝুলে পড়ল সন্তু।

শিকড়গুলো ঝুলছে, একেবারে শেষপর্যন্ত পৌঁছয়নি। শেষের দিকে সন্তুকে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে নীচে নামতে হল। সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালে সেঁটে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মিনিট।

কাল যেখানে সন্তু হাত-পা বাঁধা অবস্থায় শুয়ে ছিল, সেখানে বসে আছে দুটো লোক। এদিকে পিঠ ফেরানো। ঠেলাগাড়িটার জন্য অপেক্ষা করছে। যে লোক দুটো গাড়িটা ঠেলে আনছে, তাদের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা এসে পড়লে চারজন হবে।

সন্তু নিঃশব্দে ছুটে গেল কাঠের বাক্সগুলোর দিকে। একটা হ্যান্ড গ্রেনেড তুলে দেখল। সিনেমায় সে দেখেছে, সৈন্যরা মুখ দিয়ে কী যেন একটা খুলে তারপর ছুড়ে মারে। সন্তু এগুলোতে খোলার কিছু দেখল না। এগুলো বোধ হয় উন্নত ধরনের।

বাঁ হাতে রিভলভারটা নিয়ে ডান হাতে সন্তু সেই বোমাটা ছুড়ে মারল খুব জোরে। লোক দুটোর গায়ে নয়, পাশের দেওয়ালে।

বিরাট শব্দে সেটা ফাটল, খসে পড়ল পাথরের চাপড়া, দেখা গেল আগুনের ঝলকানি। বোমাটা যে এতখানি শক্তিশালী, তা সন্তু আন্দাজ করতে পারেনি।

লোক দুটো আর্তনাদ করে শুয়ে পড়েছিল, আবার উঠে দাঁড়াতেই সন্তু আর একটা বোমা ছুড়ল ওদের পায়ের কাছে। ওরা আর রাইফেল তুলে নেওয়ার সময় পেল না, সুড়ঙ্গের মুখের দিকে দৌড় দিল।

সন্তু তাড়া করে গিয়ে আরও দুটো বোমা পরপর ছুড়ে দিল ওদের দিকে। বোমা ফাটার শব্দ ছাড়াও হুড়মুড় করে আর একটা শব্দ হল। ওরা অন্ধকারে গিয়ে পড়েছে সেই ঠেলা গাড়িটার ওপর। আঁ-আঁ করে একটা কাতর চিৎকারও শোনা গেল, একজন বোধ হয় পড়ে গেল খাদে।

ওদের দিকে আরও একটা বোমা ছুড়ে সন্তু ফিরে এল বাক্সগুলোর কাছে। সাত-আটটা বোমা প্যান্টের দু পকেটে আর জামার মধ্যে ভরে সন্তু বটগাছের শেকড় ধরে সরসর করে উঠে এল ওপরে। সেই পাথরের ভাঁজের আড়ালে গিয়ে সে একটা একটা করে বোমা ছুড়ে মারতে লাগল কাঠের বাক্সগুলোর দিকে। প্রথম দুটো ফসকে গেল। তৃতীয়টা ছুড়ল মাথা ঠাণ্ডা করে। এবারে ঠিক লাগল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে গুহাটা কেঁপে উঠল। বাক্সটায় আগুন ধরে গিয়ে বাজির মতন অন্য বোমাগুলো ফাটছে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে পাথর।

আরও কয়েকটা বোমা ছুড়ে সন্তু উঠে পড়ল। তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এই বোমায় আর মানুষ মরবে না। এই বোমাগুলো আর কেউ উদ্ধার করতে পারবে না।

এর পরের দৃশ্যটি ভারী সুন্দর। দু গাড়ি পুলিশ এসে গেছে সেই মুহূর্তে। কাকাবাবু, নরেন্দ্র ভার্মা আর রাজমহেন্দ্ৰী হেঁটে আসছেন আগে-আগে। গুহা থেকে ছুটতে-ছুটতে বেরোল তিনজন, সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গেল। গুহার মধ্যে তখনও বিস্ফোরণ চলেছে। কাকাবাবুরা থমকে দাঁড়ালেন।

জোজোই প্রথম দেখতে পেয়ে বলল, ওই তো সন্তু।

গুহার ছাদের ওপর সন্তু হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। কাকাবাবুকে দেখেই তার মনে হয়েছে, সব পরিশ্রম সার্থক!

লাফিয়ে লাফিয়ে সে নীচে নেমে এসে কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, গুহার ভেতরে কী হচ্ছে রে সন্তু?

সন্তু বলল, বোমা ফাটছে। এই যে, এই বোমা।

তার পকেটে এখনও একটা আছে, সে বার করে দেখাল।

নরেন্দ্র ভার্মা আর কাকাবাবু চোখাচোখি করলেন। কাকাবাবু বললেন, কাল রাত্তিরে আমার মনে হয়েছে, এই গুহার মধ্যে ওরা বোমার কারবার করছে। সেইজন্যেই আমাকে আর ভার্গবকে আসতে দিতে চায়নি।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আর দু-একদিন পরে এলে কিছুই দেখতে পেতেন। ওদের কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আজই সব বোমা পাচার করে দিত। ওদের ব্যাড লাক যে, আপনি এর মধ্যেই মূর্তি দেখার জন্য এসে পড়লেন।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, কত বোমা ছিল এর মধ্যে?

সন্তু বলল, গুনিনি। কয়েক হাজার তো হবেই। তবে আমি সব শেষ করে দিয়েছি।

নরেন্দ্র ভার্মা শিস দিয়ে উঠলেন। তারপর সন্তুর কাঁধ চাপড়ে বললেন, ব্রাভো। ওয়েল ডান, সন্তু! তুমি একাই তো কেল্লা ফতে করে দিলে!

কাকাবাবু সস্নেহে বললেন, আজকাল ও একাই অনেক কিছু পারে। আমার সাহায্যের দরকার হয় না। তোর লাগেনি তো কোথাও? ডান হাতে কী হয়েছে, রক্ত পড়ছে?

কোনও এক সময় পাথরে ঘষে গিয়ে ডান কাঁধের কাছটা খুবলে গেছে। রক্ত বেরোচ্ছে সেখান থেকে। সন্তু এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। সে বলল, ও কিছু না।

জোজো সন্তুকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, কাকাবাবু হারিয়ে গিয়েছিলেন, আমিই তাঁকে খুঁজে বার করেছি, বুঝলি! কাল রাত্তিরে আমি কাকাবাবুকে বললুম, মূর্তি-চুরিটুরির কথা এখন থাক। আগে সন্তুকে উদ্ধার করতে হবে। আমি ঠিক জানতুম, তোকে একটা গুহার মধ্যে আটকে রেখেছে। আমার কথাতেই তো পুলিশ নিয়ে এখানে আসা হল।

সন্তু জোজোর কাঁধে হাত রেখে বলল, তাই নাকি? ভাগ্যিস তোরা এসে পড়েছিস, না হলে আমার খুব বিপদ হত! তুই ঠিক বুদ্ধি দিয়েছিস জোজো। আমি জানতুম, তুই যখন আছিস, আমি উদ্ধার পাবই। তুই-ই তো এবারের হিরো।

জোজো বলল, রাধা গোমেজ নামে একটা মেয়েকে আমরা ধরে রেখেছিলাম, আমিই বুদ্ধি দিয়েছিলাম কাকাবাবুকে বুঝলি? এই রাধার বাবাই হচ্ছে চোরা চালান চক্রের সর্দার। কাল শেষ রাতে আমাদের হোটেল খুঁজে ওই গোমেজ সর্দার দলবল নিয়ে এসে আক্রমণ করে। আগেই পুলিশের ফাঁদ পেতে রাখা হয়েছিল, সবাই ধরা পড়ে গেছে। গোমেজ এমন হিংস্র যে ওই অবস্থাতেও আমাকে প্রায় খুন করে ফেলেছিল আর কি! নরেন্দ্র ভার্মা ঠিক সময় আটকে দিলেন, তিনি এক গুলিতে গোমেজের মাথার খুলি উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, কাকাবাবু বাধা দিয়ে বললেন, যাক, যাক। ওকে প্রাণে মারতে হবে না। আমি রাধাকে কথা দিয়েছি। আমি অবশ্য এক ঘুসিতে পাঁচখানা দাঁত ভেঙে দিয়েছি ওর।

কাকাবাবু গুহার মধ্যে ঢুকতে যাচ্ছিলেন, মুখ ফিরিয়ে বললেন, জোজো, গুনে দেখেছিলে, ঠিক পাঁচটা?

জোজো বলল, অন্তত চারটে তো হবেই!

কাকাবাবু বললেন, ওপরের দাঁত না নীচের দাঁত?

জোজো বলল, ওপরের দুটো আর নীচের একটা তো আমি মাটিতে পড়ে থাকতেই দেখেছি!

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, তোমার ঘুসিটা ফসকে গিয়ে আমার গায়ে লেগেছিল। আমার কিন্তু একটা দাঁতও ভাঙেনি।