০৩. হোটেলের রিসেপশান থেকে ফোন

ঠিক সাড়ে ছটায় হোটেলের রিসেপশান থেকে ফোন এল। অশোক দেশাই দেখা করতে এসেছেন। তিনি ওপরে আসতে চান।

সন্তু দরজা খুলে দিল। সেই মাইক নামের ছেলেটি অশোক দেশাইকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে। আরও একজন লোক রয়েছে অশোক দেশাইয়ের সঙ্গে। ইনি একজন আফ্রিকান, পাক্কা সাহেবি পোশাক পরা। অশোক দেশাইয়ের পোশাকও সেইরকম। তাঁর গায়ের রং এত ফস যে, সাহেবদের মতনই দেখায়।

অশোক দেশাই দরজা দিয়ে ঢুকে কাকাবাবুর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, গুড ইভনিং মিঃ রায়চৌধুরি। আশা করি নাইরোবি আপনার ভাল লাগছে।

কাকাবাবু সন্তুর সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিলেন।

অশোক দেশাই তাঁর সঙ্গীর দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, ইনি মিঃ শ্যাম নিনজানে। ইনি এখানকার প্রেসিডেন্ট মই-এর আত্মীয়, এ-দেশের ফিনান্স সেক্রেটারি এবং আমার বিজনেস পার্টনার।

অশোক দেশাই এমনভাবে কথাগুলো বললেন, যাতে বোঝা গেল যে, তাঁর সঙ্গীটি একজন বিশেষ কেউ-কেটা লোক। প্রেসিডেন্টের আত্মীয় হওয়াটাই তো একটা বিরাট ব্যাপার।

মিঃ নিনজানে যে কাকাবাবুকে দেখে দারুণ অবাক হয়েছেন তা তিনি লুকোবার সামান্য চেষ্টাও করলেন না। তিনি প্রায় হাঁ করে একবার কাকাবাবুকে দেখছেন, একবার অশোক দেশাইয়ের দিকে তাকাচ্ছেন।

কাকাবাবু বললেন, বসুন, আপনারা বসুন!

মিঃ নিনজানে তবু দাঁড়িয়ে থেকেই অশোক দেশাইয়ের দিকে ফিরে বললেন, এই.এই ভদ্রলোকের কথাই আপনি বলেছিলেন? ইনি…একজন অ্যাডভেঞ্চারার? ইনি… মানে… ইনিই পৃথিবীর অনেক জায়গায়…

অশোক দেশাই বললেন, ইনিই মিঃ রাজা রায়চৌধুরী। আমার আংকল একে পাঠিয়েছেন।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই আমার মতন একজন খোঁড়া মানুষকে দেখে অবাক হয়েছেন?

মিঃ নিনজানে বললেন, হ্যাঁ, মানে, আমি ফ্র্যাংকলি বলছি, আমি অশোকের মুখে গল্প শুনেছিলাম, আপনি নাকি হিমালয় পাহাড়ে একদল ক্রুককে ধরবার জন্য এগারো-বারো হাজার ফিট ওপরে উঠেছিলেন? সেটা কি অনেক দিন আগের কথা?

কাকাবাবু বললেন, না, খুব বেশিদিন আগে না, বছর পাঁচ-ছয় হবে। আমার একটা পা অবশ্য তার আগেই অকেজো হয়ে গেছে।

কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব? এই পা নিয়ে আপনি হিমালয় পাহাড়ে উঠেছিলেন কী করে?

বুঝিয়ে বলছি। বসুন আগে। আমাদের সংস্কৃত ভাষায় একটা কথা আছে, পঙ্গু লঙ্ঘয়তে গিরিং। তার মানে হল, ভগবানের কৃপা হলে আমার মতন কানা-খোঁড়া-পঙ্গুরাও পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে পারে। আপনি ভগবান মানেন?

হ্যাঁ, অফ কোর্স ভগবান মানি। আমি একজন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান।

আমি ভগবান বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি মানুষের অফুরন্ত মানসিক শক্তিকে। মনের জোর থাকলে মানুষ সব কিছু পারে। পাহাড়ে উঠতে গিয়ে আমি পা পিছলে পড়ে মরে যেতেও পারি, তা বলে সেই ভয়ে আমি কোনওদিন পাহাড়ে উঠতে চাইব না, তা তো হয় না! কত লোক তো শহরের রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়েও মরে!

তা তো বটেই।তা তো বটেই!

আপনারা চা কিংবা কফি কী খাবেন বলুন। কিছু আনাব?

অশোক দেশাই এবারে বললেন, মিঃ নিনজানে সন্ধের পর বিয়ার ছাড়া অন্য কিছু খান না। আমার কোনও রকম নেশা নেই। পানও খাই না। আমি মিঃ নিনজানের জন্য বিয়ার বলে দিচ্ছি।

মিঃ নিনজানে হাত তুলে বললেন, আমি যথেষ্ট বিয়ার পান করে এসেছি। রাত্তিরে আর-একটা জায়গায় নেমন্তন্ন আছে, সেখানে গিয়ে অনেক খেতে হবে। এখন কিছু খেতে চাই না। এখন কাজের কথা হোক।

কাকাবাবু বললেন, কাজের কথা কিছু আছে নাকি? আমি তো তা জানতুম না। আমার ধারণ আমরা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি।

অশোক দেশাই বললেন, না, মানে, আপনার ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম নিয়ে দু-চারটে কথা বলার ছিল.

সন্তু ওঁদের কাছে না বসে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না। সে এক দৃষ্টিতে মিঃ নিনজানেকে লক্ষ করছে। ওঁকে অনেকটা বক্সার মহম্মদ আলির মতন দেখতে। কিন্তু ওঁর গলার আওয়াজটা কেমন যেন চেনা-চেনা। দুপুরে যারা ভয় দেখিয়ে টেলিফোন করেছিল, তাদের মধ্যে প্রথম যে-লোকটা চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজি বলছিল, তার গলার আওয়াজটা ঠিক মিঃ নিনজানের মতন নয়? কিন্তু তা কী করে সম্ভব? উনি কাকাবাবুকে ভয় দেখাতে যাবেন কেন?

কুবাবু বললেন, আমি মিঃ নিনজানেকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে মিঃ নিনজানে বললেন, নিশ্চয়ই। আপনার বয়েস কত?

হঠাৎ এই প্রশ্ন? মিঃ র্যাজা রায়চৌড্রি, আপনি আমাকে এই প্রশ্ন করলেন কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না তো!

এমনিই, কৌতূহল। আমি আফ্রিকানদের বয়েস বুঝতে পারি না। আপনার মুখের চামড়া একটু কুঁচকে গেছে, কিন্তু আপনার চুল কুচকুচে

আমার বয়েস আটান্ন!

তা হলে তো আপনি আমার চেয়েও বেশ কয়েক বছরের বড়। কিন্তু আপনার স্বাস্থ্য আমার চেয়েও ভাল, আপনার মাথায় কত চুল.আমি আজ পর্যন্ত একজনও টাক-মাথা আফ্রিকান দেখিনি।

মিঃ নিনজানে। এবারে অট্টহাসি হেসে উঠলেন। এতক্ষণ বাদে তাঁকে বেশ সহজ মনে হল। তিনি পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, চলবে?

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নাড়লেন।

মিঃ নিনজানে নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, তা হলে একটা মজার গল্প বলি শুনুন! আপনি ব্ৰাইট ক্রিম বলে চুলের একটা ক্রিম আছে, নাম শুনেছেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি, আমাদের দেশেও চলে।

একসময় আফ্রিকার কয়েকটা দেশে সেই ব্ৰাইট ক্রিমের খুব বিক্রি বেড়ে গেল। দোকানদাররা সাপ্লাই দিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারে না। তখন যে বিলিতি কোম্পানি এই ক্রিম বানায়, তাদের টনক নড়ল। তারা বুঝতেই পারল না, হঠাৎ আফ্রিকায় তাদের চুলের ক্রিমের বিক্রি বাড়ল কেন? আফ্রিকানদের তো এত পয়সা নেই। হেড-অফিস থেকে দুতিন জন সাহেব এল খোঁজ-খবর নিতে। তারা কিছুই বুঝতে পারল না। প্রত্যেক দোকানদার বলছে, সাহেব, আরও বেশি করে ব্ৰাইট ক্রিম পাঠাও! খদের ফিরে যাচ্ছে, আমরা গালাগালি খাচ্ছি!

তারপর আরও দুজন বড়সাহেব এল মার্কেট রিসার্চ করতে। তাদের জিনিস বিক্রি হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু কেন যে এত বেশি বিক্রি হচ্ছে, তা কিছুতেই ধরতে পারছে না। প্রত্যেক মাসে ডিমান্ড দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছো!

তখন কোম্পানি ঠিক করল, আফ্রিকার এই কয়েকটা দেশে এই সুযোগে আরও ব্রাইট বিলক্রিম পাঠাবে, বিক্রি আরও বাড়বে! প্রত্যেক কাগজে বড়-বড় করে বিজ্ঞাপন দিল, ব্রাইট ক্রিম চুলের স্বাস্থের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী। চুল ভাল রাখতে হলে প্ৰত্যেক দিন ব্রাইট ক্রিম ব্যবহার করুন!

শুধু খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন নয়, গ্রামে-গ্রামেও এই বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং টাঙানো হল। তার ফলে কী হল বলুন তো, এই বিজ্ঞাপন বেরোবার পর ব্ৰাইট ক্রিম বিক্রি একদম বন্ধ হয়ে গেল। আর কেউ ওটা কেনে না।

গল্প শেষ করে মিঃ নিনজানে বিরাট জোরে চেঁচিয়ে হাসতে লাগলেন।

কাকাবাবু বললেন, আমি কিন্তু গল্পটার মর্ম ঠিক বুঝতে পারলুম না?

অশোক দেশাই বললেন, বাকিটা আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। আসলে ব্যাপার কী জানেন, আফ্রিকার বিভিন্ন উপজাতির লোক ওই ক্রিম কিনত টোস্টে মাখিয়ে খাবার জন্য। জিনিসটার স্বাদও ভাল, দামেও মাখনের চেয়ে শস্তা। যখন তারা জানল ওটা চুলের ক্রিম, তখনই তারা কেনা বন্ধ করে দিল। চুলের যত্ন করার জন্য পয়সা দিয়ে কোনও চুলের ক্রিম কেনার কথা সাধারণ লোক কল্পনাই করতে পারে না।

কাকাবাবুও হেসে বললেন, ভাল গল্প। আশা করি এটা সত্যি।

মিঃ নিনজানে বললেন, মোটেই সত্যি নয়। নিছকই গল্প। তবে, আপনি আমাদের চুলের কথা তুললেন তো…। জানেন, আমাদের এখানে অনেকে

অশোক দেশাই বললেন, এবারে আমার কথা সেরে নিই। সাড়ে সাতটার সময় আমার আর-একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। মিঃ রায়চৌধুরী এখানে আপনার প্রোগ্রাম কী তা জানেন নিশ্চয়ই?

কাকাবাবু বললেন, প্রোগ্রাম তো সে-রকম কিছু নেই। ভুলাভাই দেশাই আমাকে বলেছেন। এখানে দু-একদিন থাকার পর আমরা অন্য একটা জায়গায় চলে যাব। মাসাইমারা ফরেস্টে নাকি আপনারা একটা নতুন হোটেল খুলেছেন? সেখানে আমাদের থাকার কথা।

অশোক দেশাই গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, সেই ব্যাপারেই আপনাকে দু-একটা কথা বলতে এসেছি। আপনি এই হোটেলে যতদিন খুশি থাকতে পারেন। যদি কোথাও বেড়াতে যেতে চান, ভিক্টোরিয়া লেক কিংবা কিলিমাঞ্জারো পাহাড়ে, তারও সব ব্যবস্থা করে দেওয়া যাবে। কিন্তু মাসাইমারা ফরেস্টে যে হোটেলে আপনাদের যাওয়ার কথা আমার কাকা আপনাদের বলে দিয়েছেন, সেখানে যাওয়াটা ঠিক হব কি না, তাতেই একটু সন্দেহ দেখা দিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা সেখানে গেলে আপনাদের অসুবিধে হবে? তা হলে থোক, যাব না?

অশোক দেশাই একটু জোরে বলে উঠলেন, না, না, আমাদের অসুবিধে কিছু নেই। আপনি গেলে আমরা খুশিই হব। কিন্তু আপনি আমাদের মাননীয় অতিথি, সেখানে গিয়ে যদি আপনার খারাপ লাগে, মানে…

কেন, সেখানে খারাপ লাগবে কেন! আপনার কোকা সে-জায়গাটার উচ্চ প্ৰশংসা করছিলেন। মাসাইমারা ফরেস্ট আমারও দেখার খুব ইচ্ছে আছে। বিশ্ববিখ্যাত ফরেস্ট, আমার ভাইপোকে নিয়ে এসেছি, ওরাও খুব ভাল লাগবে এই আশা করে…

তা হলে পুরো ব্যাপারটা আপনাকে খুলে বলতে হয়।

বলুন।

মাসাইমারা গেইম রিজার্ভের একেবারে মাঝখানে কয়েকটা হোটেল আছে। তার মধ্যে একটা আমরা নিয়েছি। এখনও কিনিনি। আপাতত ম্যানেজমেন্টের ভার নিয়েছি। ছ। মাস দেখার পর পুরোপুরি কিনে নেব, এরকম কথা আছে। সেই হোটেলের নাম লিটল ভাইসরয়।

অদ্ভুত নাম তো। ভাইসরয় আবার লিটল?

এ-নামটারও একটা ইতিহাস আছে। আগে ওখানে শুধু ভাইসরয় নামে একটা হোটেল ছিল। তারপর খুব কাছাকাছিই আর-একটা হোটেল খোলা হল, তার নাম দেওয়া হল লিটল ভাইসরয়। আসলে কিন্তু দ্বিতীয় হোটেলটা, যেটা নতুন সেটাই বেশি বড়। ক্রমে এক সময় মূল ভাইসরয় হোটেল উঠে গেল, কিন্তু অন্য হোটেলের নাম লিট্‌ল ভাইসরয়ই রয়ে গেল। এই হোটেলটাই এখন আমাদের।

সেখানে আমি গেলে আপনাদের কি অসুবিধে হবে?

না না, আমাদের অসুবিধের কোনও প্রশ্নই নেই। বরং আপনার মতন একজন মানুষ গেলে আমাদের খুবই উপকার হতে পারে। আমার কাকা সেই কথা ভেবেই আপনাকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ভাল-মন্দ সব দিক আপনাকে আগে জানানো দরকার বলে আমি মনে করি। সেটাই আমার নীতি।

মন্দ দিক কিছু আছে বুঝি?

মিঃ রায়চৌধুরী, লিটল ভাইসরয় খুব দামি হোটেল। ওটা চালাবার খরচ অনেক। প্রধানত ইউরোপিয়ান ও আমেরিকানরাই ওখানে বেড়াতে যায়। কিন্তু গত তিন-চার মাস ধরে ওখানে টুরিস্টের সংখ্যা খুবই কমে গেছে। লোকে ভয়ে ওখানে যেতে চাইছে না। হোটেলের দুজন বোর্ডার রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে গেছে। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।

খুঁজে পাওয়া যায়নি মনে হারিয়ে গেছে, না কোথাও কোনও জন্তু-জানোয়ারের হাতে পড়েছে?

প্রথমত ওখানে আমরা খুব সাবধানতা অবলম্বন করি। জন্তু-জানোয়ারের হাতে পড়ার প্রায় কোনও সম্ভাবনাই নেই। দ্বিতীয়ত, কোনও জন্তু-জানোয়ারের মুখে যদি দৈবাৎ পড়েও যায়, কোনও জানোয়ারই তো মানুষের জামা-কাপড় সুন্ধু খেয়ে ফেলে না। তাদের কোনওরকম চিহ্নই পাওয়া যায়নি।

সন্তু ফশ করে বলল, যদি কুমির কিংবা জলহস্তী জলের তলায় টেনে নিয়ে যায়?

অশোক দেশাই সন্তুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, দুজন মানুষকে এক সঙ্গে জলের তলায় টেনে নেবে? এরকম ঘটনা এখানকার ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। তা ছাড়া লোক দুটি তো বোকা নয়, দুজনেই জার্মান ব্যবসায়ী।

কাকাবাবু বললেন, সেই ঘটনাটি রটে গেছে, তাই টুরিস্ট যেতে চায় না?

শুধু সেই জন্যই নয়। এর পরেও যারা গেছে, তারা ফিরে এসে অভিযোগ করেছে যে, রাত্তিরে তারা ঘুমোতে পারে না। কিসের যেন একটা অস্বস্তি হয়। যদিও আমাদের ব্যবস্থার কোনও ক্রুটি নেই.হোটেলটা চালাতে গিয়ে এখন আমাদের খুবই ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। এখন আপনি ভেবে দেখুন। সেখানে যাবেন কি না।

মিঃ নিনজানে বললেন, আপনার কোনও বিপদ হোক, তা আমরা কেউ চাই না।

কাকাবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, হ্যারি ওটাংগোর ঠিক কী হয়েছিল। আপনারা জানেন?

দেশাই আর নিনজানে দুজনেই যেন চমকে উঠল। এ-ওর মুখের দিকে তাকাল। নিনজানে একটা রুমাল বার করে কপাল মুছল, অশোক দেশাই বলল, আপনি…আপনি হ্যারি ওটাংগোর নাম জানলেন কী করে?

কাকাবাবু বললেন, উনি বিখ্যাত লোক, সারা পৃথিবীর লোক ওঁর নাম জানে। উনি কয়েক মাস আগে অদ্ভুতভাবে মারা গেলেন, কাগজে পড়েছি।

দেশাই বলল, উনি কোনও হিংস্ৰ জন্তুর সামনে পড়ে গিয়ে মারা গেছেন, এইটুকুই আমরা জানি।

নিনজানে খানিকটা রুক্ষ গলায় বলল, ওই ওটাংগোর সঙ্গে আমাদের হোটেলের কী সম্পর্ক? মাসাইমারায় গেলে আপনাদের যাতে কোনও বিপদ না হয়, সেটা দেখা আমাদের দায়িত্ব।

কাকাবাবু হেসে বললেন, আমি নিজেই নিজের দায়িত্ব নিতে পারি। আমি সেজন্য ও-কথা জিজ্ঞেস করিনি।

দেশাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আপনি বেড়াতে এসেছেন, মনের সুখে বেড়ান। এখানকার ঝঞাটি নিয়ে মাথা ঘামাবেন কেন? সেজন্যই আপনাকে ওই হোটেলটায় পাঠাতে চাইছিলাম না। আবার পরের বছর আসনু না! তখন হোটেলটা ঠিকমতন চালু হয়ে যাবে।

কাকাবাবু হাসিমুখে তাকালেন সন্তুর দিকে। তারপর বললেন, আমাদাবাদের ভুলাভাই দেশাই অতি চালাক লোক। এখানে আমাদের পাঠাবার সময় এমনভাবে কথা বলল, যেন আমাকে কোনও কাজ করতে হবে না, মাথা খাটাতে হবে না, শুধু বেড়ানো আর বিশ্রাম। কিন্তু তার মনে একটা মতলব ছিল ঠিকই, এখন সেটা বোঝা যাচ্ছে।

অশোক দেশাই বললেন, আপনি ওখানে না যেতে চাইলে আমরা মোটেই ইনসিস্ট করব না। আপনি যত দিন খুশি বিশ্রাম নিন, ইচ্ছে মতো বেড়ান, তারপর ফিরে যান।

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু বিপদের গন্ধ পেলে আমি যে সেখানে না গিয়ে পারি না। মাসাইমারা যেতেই হবে। কী বলিস, সন্তু?

সন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ল।

কাকাবাবু বললেন, আপনারা আমাদের যাবার ব্যবস্থা করুন।

আরও দু-একদিন বরং ভেবে দেখুন, তারপর ঠিক করুন।

না, না, কালই যাব। দেরি করার কোনও মনে হয় না। ফেরার সময় না। হয় নাইরোবি শহর ভাল করে দেখে যাব। এখান থেকে কী ভাবে যেতে হয়?

ছোট প্লেনে। আমাদের চাটরি করা প্লেন আছে।

তা হলে কাল সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়তে চাই। তার আগে দু-একটা ব্যাপার জেনে নেওয়া দরকার। এই যে হোটেলটা আপনারা চালাচ্ছেন, আপনাদের কোনও কমপিটিটর আছে?

কমপিটিটর মানে? মিঃ নিনজানে আর আমি একটা জয়েন্ট কোম্পানির মালিক। এই কোম্পানির নামেই কয়েক মাস বাদে পুরোপুরি হোটেলটা কিনে নেবার কথা। এক সুইস কোম্পানি ওই হোটেলটার মালিক ছিল। তারা বিক্রি করে দিতে চাইছে।

আর কোনও কোম্পানি কি ওটা কেনার ব্যাপারে আগ্রহী?

আর কে কিনবে? অনেক টাকার ব্যাপার। ওই হোটেলটা যে কত বড় আর জঙ্গলের মধ্যে ওই রকম হোটেল চালানো যে কী শক্ত ব্যাপার, তা আপনি গেলেই বুঝবেন।

মিঃ নিনজানে বললেন, আমি যে হোটেল কিনতে চাইছি, সেটা কিনতে এ-দেশে আর কোনও লোকের সাহস হবে না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কাছাকাছি অন্য কোনও হোটেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতা নেই!

অশোক দেশাই বললেন, খুব কাছে অন্য কোনও হোটেল এখন আর নেই। সরকার থেকে আর কোনও হোটেল তৈরি করার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে না।

দুজন লোক যে উধাও হয়ে গেছে, সে সম্পর্কে পুলিশ থেকে খোঁজখবর আমরা সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানিয়েছিলাম। নাইরোবি থেকে স্পেশাল ফোর্স নিয়ে সবরকম তদন্ত করেছে, কিন্তু তারাও কোনও হদিস পায়নি।

ঠিক আছে, তা হলে ব্যবস্থা করুন, আমি আর আমার ভাইপো ওখানে গিয়ে দিন-সাতেক থাকব।

মিঃ নিনজানে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যদি আপনি মিষ্ট্রিটা সলভ করতে পারেন, তা হলে আপনি পঁচিশ হাজার শিলিং পাবেন। আমরা আগে থেকেই ওই পুরস্কারটা ডিক্লেয়ার করে রেখেছি; গুড লাক, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী।

ওঁরা দুজন বেরিয়ে যাবার পর কাকাবাবু বললেন, তা হলে দুপুরে টেলিফোনটা কে করেছিল? অমলই নিশ্চয়ই ঠাট্টা করেছিল তোর সঙ্গে?

সন্তু বলল, গলার আওয়াজটা কিন্তু ঠিক মিঃ নিনজানের মতন!

অমল অনেকদিন এ-দেশে আছে, ও আফ্রিকানদের গলার আওয়াজ নকল করতে পারবে। এতে আর আশ্চর্য কী আছে। একটা জিনিস লক্ষ করেছিস? মিঃ নিনজানের মাথার চুল? উনি ব্ৰাইট ক্রিমের গল্প বললেন বটে। কিন্তু নিজে মাথায় কলপ মাখেন। এ-দেশের মানুষদেরও চুল খুব ঘন আর কোঁকড়া হয়, সহজে টাক পড়ে না, কিন্তু বয়েস বাড়লে সাদা হয় ঠিকই। মিঃ নিনজানের সব চুল কুচকুচে কালো। অশোক দেশাই সম্পর্কেও একটা ব্যাপার বুঝলাম না। অমল বলেছিল, ওঁর অনেকগুলো ব্যবসা, অনেক টাকা। কিন্তু উনি এই হোটেলটা নিয়ে খুব চিন্তিত। এই হোটেলটা নিয়ে যখন এত গণ্ডগোল, তখন উনি না। কিনলেই তো পারেন। এখনও তো কেনা হয়নি। ঝুঁকি নেওয়ার দরকার কী?

সন্তু বলল, একবার কিনবেন ঠিক করেছেন তো, তাই জেদ চেপে গেছে বোধহয়।

ঠিক বলেছিস, জেদের বশে মানুষ অনেক সময় অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করে।

কাকাবাবু, আমরা রাত্তিরে কোথায় খাব?

কেন, তোর খিদে পেয়ে গেছে নাকি? রাত্তিরে আমরা এই হোটেলেই খেয়ে নেব। রুম সার্ভিসে বলে দিলেই হবে। রাত্তিরে রাস্তায় বেরোলে যদি কেউ আবার গাড়ি চাপা দিতে আসে। সেই এক ঝামেলা। —

বিকেলে সত্যিই ওই গাড়িটা যে আমাদের চাপা দিতে এসেছিল, তা তুমি বিশ্বাস করো না?

চাপা দেবার চেষ্টা করলেও আমার মতন একটা খোঁড়া লোককে মারতে পারল না? লোকটা খুবই আনাড়ি বলতে হবে। যাক, তুই কেনিয়ার ম্যাপিটা বার কর তো! আমি খাবার অর্ডার দিচ্ছি, খাবার আসতে আসতে ম্যাপটা দেখে নিই।

সন্ধেবেলা ফেরার পথে ম্যাপটা কেনা হয়েছিল, সন্তু সেটা এনে টেবিলের ওপর খুলে দিল।

কাকাবাবু একটা পেনসিল তুলে বললেন, এই যে নাইরোবি শহর, আর এই হচ্ছে নাইরোবি ন্যাশনাল পার্ক, এখানে আমরা গিয়েছিলাম। বেশ বড় জায়গা। লেক ভিকটোরিয়া দেখেছিস? পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম পানীয় জলের হ্রদ, এর তিন দিকে তিন দেশ, কেনিয়া, তানজানিয়া আর উগাণ্ডা। এখানে আরও অনেকগুলা হ্রদ আছে, সেগুলোও আমার দেখার ইচ্ছে আছে, সেসব হ্রদের নাম নাইভাসা, গিলগিল, নুকুরু, বারিংগো এই সব। কেনিয়ার একটা নদীর নাম হিরামন, কী চমৎকার না! কিন্তু সেটা অনেক দূরে, সেদিকে যাওয়া যাবে না। এবারে মাসাইমারা কোথায় তুই খুঁজে বার কর তো!

সন্তু খুব মন দিয়ে খুঁজে খুঁজে একসময় আঙুল দেখাল।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, দ্যাখ, তানজানিয়ার বর্ডারের একেবারে কাছেই। তানজানিয়ার ওপাশটায় আছে বিশ্ববিখ্যাত সেরিংগেট ফরেস্ট। এই অঞ্চলটা খুব ইন্টারেস্টিং, দু-একটা মৃত আগ্নেয়গিরি আছে…

ওরা দুজনে ম্যাপ দেখতে দেখতে একেবারে তন্ময় হয়ে গিয়েছিল, এক সময় দরজায় ঠকঠক শব্দ হল।

কাকাবাবু মুখ তুলে বললেন, দ্যাখ তো, খাবার এসে গেছে বোধহয়।

সন্তু উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখল, সেই মাইক নামে ছেলেটি হাতে একটা ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ট্রের ওপরে একটা লম্বা সাদা খাম।

মাইক সরল সাদা হাসি হেসে বলল, তোমার আংকেলের জন্য একটা চিঠি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কে দিয়েছে?

মাইক বলল, একজন জেন্টলম্যান দিয়ে বলল, এক্ষুনি পৌঁছে দিতে। দ্যাখো, আমি সঙ্গে-সঙ্গে এনেছি, একটুও দেরি করিনি। কিন্তু!

কাকাবাবু বললেন, চিঠিটা নিয়ে আয়।

সন্তু খামটা কাকাবাবুর হাতে দিলে তিনি সেটা ছিঁড়ে একটা কাগজ বার করলেন। তাতে মাত্র একটা লাইন লেখা আছে। সেটা পড়ে কাকাবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল, তিনি কাগজটা সন্তুর দিকে এগিয়ে দিলেন।

কাগজটাতে টাইপ করা অক্ষরে লেখা আছে :

Dont Go To Masai-Mara.

সন্তু বিবৰ্ণ মুখে বলল, আমরা যে এখানে আছি, তা তো মাত্র দুজন লোক ছাড়া এখনও আর কেউ জানে না?

ভাঙানো আছে, তার থেকে ওকে দশটা শিলিং দিয়ে দে!