০২. অমল আর মঞ্জু

বিকেল চারটের সময় অমল আর মঞ্জু এসে উপস্থিত। কাকাবাবু একটু আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন, আর সন্তু বসে-বসে ত্ৰৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ভূতের গল্প পড়ছে, এখানে সে ওই একটা বইই সঙ্গে এনেছে।

দুপুরে ওরা হোটেল থেকে বেরিয়ে কাছাকাছি একটা রেস্তোরাঁয় খাবার খেয়ে নিয়েছিল। জেব্রা-জিরাফের মাংস নয়, চিনে খাবার। তাদের হোটেলেই অনেক রকম খাবারের ব্যবস্থা আছে, কিন্তু কাকাবাবু ছোটখাটো দোকানে বসে খেতে ভালবাসেন বলে বেরিয়েছিলেন। একটা ব্যাঙ্কে গিয়ে তিনি টাকা ভাঙালেন, পোস্ট অফিসে গিয়ে এ-দেশের কিছু স্ট্যাম্পও কিনলেন। খাওয়ার পর খানিকটা হাঁটা হল এদিক-ওদিক। রাস্তার দুপাশে সাজানো দোকানপাট। সন্তুর আশ্চর্য লাগল। দেখে যে, প্ৰায় সব দোকানই চালাচ্ছে ভারতীয়রা।

হোটেলে ফেরার পর রিসেপশান কাউন্টার থেকে কাকাবাবুকে একটা স্লিপ দেওয়া হয়েছিল। তাতে লেখা আছে যে অশোক দেশাই নামে একজন লোক ফোন করেছিল, সে সন্ধে সাড়ে ছাঁটার সময় কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করবার জন্য হোটেলে আসবে।

তারপর নিজেদের সুইটে এসে কাকাবাবু বলেছিলেন, তুই তো প্লেনে খুব মুক্তি দিয়েছি, সন্ধু! আমার যুদ্ধ হন। আমি এখন একটু ঘুমিয়ে

অমল এসেই হইচই করে বলল, এ কী, চুপচাপ বসে আছ? এমন চমৎকার দিনটা হোটেলে বসে কাটাবার কোনও মানে হয়? চলো, বেরোবে না? তৈরি হয়ে নাও

কাকাবাবুর খুব পাতলা ঘুম, তিনি সঙ্গে-সঙ্গে চোখ মেলে তাকালেন।

মঞ্জু অমলকে মৃদু বকুনি দিয়ে বলল, তুমি কাকাবাবুর ঘুম ভাঙিয়ে দিলে তো? তুমি এত জোরে কথা বলো কেন?

কাকাবাবু উঠে বসে বললেন, যা ঘুমিয়েছি, তাতেই যথেষ্ট হয়েছে। এখন বেশ ফ্রেশ লাগছে।।

অমল বলল, চলুন, সিংহ দেখতে যাবেন না? নাইরোবিতে এলে সবাই প্ৰথমে তো তাই-ই করে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কত দূরে যেতে হবে বলে তো? আমাকে সাড়ে ছাঁটার মধ্যে হোটেলে ফিরতে হবে, একজন দেখা করতে আসবে।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার মধ্যেই ফিরে আসা যাবে। বেশি দূর নয়।

এইটুকু সময়ের মধ্যে যাব। আর সিংহ দেখে আসব? চিড়িয়াখানায় নাকি?

অমল হা-হা করে হেসে উঠে বলল, মঞ্জু এবারে তুমি বলে দাও! গত বছর অনিলন্দা যখন এসেছিল, তাকে আমরা প্রথমদিনই সিংহ দেখিয়েছিলুম কি না।

মঞ্জু বলল, নাইরোবি শহরটাকেই বলতে পারেন চিড়িয়াখানা, মানুষরা এর মধ্যে থাকে। আর বাকি খোলা জায়গায় জন্তু-জানোয়াররা স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। সত্যি, বেরোলে দেখবেন, শহরের এক দিকটায় মাইলের পর মাইল লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। ওই জালের মধ্যে আমরা আছি, আর জন্তু-জানোয়াররা আছে বাইরে। মনে করুন, কলকাতা শহরটার একদিক জাল দিয়ে আটকানো আর বেলেঘাটা, দমদম, ওইসব জায়গায় সিংহ, হাতি, গণ্ডার, এইসব ঘুরে বেড়াচ্ছে!

অমল সন্তুকে জানলার কাছে টেনে এনে বলল, ওই যে দূরে ফাঁকা জায়গা দেখতে পাচ্ছ, আমরা ওইখানটায় যাব।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। তার আগে একটু চা খেয়ে নেওয়া যাক। সন্তু, রুম সার্ভিসে চার কাপ চা বলে দে তো!

সন্তু টেলিফোন তুলে চায়ের অর্ডার দিল। অমল জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, সন্ধেবেলা আপনার সঙ্গে কে দেখা করতে আসবে জানতে পারি কি?

অশোক দেশাই। তুমি চেনো?

ওরে বাবা, তাকে কে না চেনে। সে তো বিরাট লোক।

বিরাট মানে? খুব মোটা?

না, বিরাট বড়লোক। জানেন-তো, গুজরাটিরাই এখানকার অনেক ব্যবসা কন্ট্রোল করে। এই অশোক দেশাই তাদের মধ্যে আবার টপে। তবে, আজকালকার বড়লোকরা কিন্তু মোটা হয় না। বাড়িতে নিজস্ব সুইমিং পুলে সাঁতার কাটে, টেনিস খেলে…এই অশোক দেশাই তো চালচলনে পাক্কা সাহেব।

এই অশোক দেশাইয়ের এক আত্মীয়, তার নাম ভুলাভাই দেশাই, সে থাকে আমেদাবাদে। কিছুদিন আগে তার আমি একটা উপকার করেছি বলে সে আমাদের এখানে পাঠিয়েছে।

নিশ্চয়ই কোনও কেস হাতে নিয়ে এসেছেন? না, না, আমি আগে থেকে জানতে চাই না, আস্তে-আস্তে শুনব। কিন্তু এই নাইরোবি শহরটা এক হিসাবে নিরামিষ জায়গা, এখানে চুরি-ডাকাতি অবশ্য রোজ লেগেই আছে, খুন-টুনও হয়, কিন্তু তার চেয়ে বড় কিছু ঘটে না! আপনি তো আর সাধারণ খুন বা ডাকাতির ব্যাপারে আসবেন না।

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আরে না, না, আমি কোনও কাজ নিয়ে আসিনি, শুধু বেড়াতে এসেছি। জিজ্ঞেস করো না। সন্তুকে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আপনারা পি. আর. লোহিয়া বলে কাউকে চেনেন?

অমল ভুরু কুঁচকে বলল, পি. আর. লোহিয়া? না, কে বলে তো?

মঞ্জু বলল, পি আর লোহিয়া মানে পুরুষোত্তম রতনদাস লোহিয়া। বিরাট উকিল। লন্ডনেও কেস লড়তে যান। কাগজে প্রায়ই নাম বেরোয়।

অমল বলল, ও হ্যাঁ হ্যাঁ, সে তো অতি ধুরন্ধর লোক। সরকারের উঁচু মহলে খুব চেনা শুনো। প্রেসিডেন্টের প্রাইভেট সেক্রেটারি তার বন্ধু। ওই অশোক দেশাইয়ের সব কোম্পানিরও উনি বাঁধা ল-ইয়ার। তুমি তাকে চিনলে কী করে?

সন্তু বলল, আসবার সময় প্লেনে দেখা হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, লোহিয়া আমাকে বলেছিল, সে এখানে ব্যবসা করে।

মঞ্জু বলল, বোধহয় নিজের আসল পরিচয়টা জানাতে চায়নি।

সন্তু একবার ভাবল, দুপুরবেলা টেলিফোনের হুমকির ব্যাপারটা অমলদের জানাবে কি না! বাথরুম থেকে বেরিয়ে সন্তুর মুখে ওই টেলিফোনের কথাটা শুনে কাকাবাবু কোনও গুরুত্বই দেননি। উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এটা নিশ্চয়ই ওই ছেলেটি, এয়ারপোর্টে যার সঙ্গে আলাপ হল, সেই অমলের কাণ্ড। তোর সঙ্গে প্র্যাকটিক্যাল জোক করেছে।

সে অমলের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝবার চেষ্টা করল, কাকাবাবুর অনুমান সত্যি কি না! কিছুই বোঝা গেল না। সন্তুর অবশ্য দৃঢ় বিশ্বাস, টেলিফোন করেছিল। অন্য লোক।

সন্তু অন্যদিকে কথা ঘোরাবার জন্য বলল, আমরা চাঁদের পাহাড় দেখতে যেতে পারি না? বিভূতিভূষণের লেখায় যে পাহাড়টার কথা পড়েছি।

মঞ্জু বলল, হ্যাঁ, যেতে পারে, তবে সেটা কেনিয়ায় নয়, উগান্ডায়। পাশের দেশ।

অমল বলল, সেখানে এখন মিলিটারির রাজত্ব। যখন তখন রাস্তা থেকে লোক তুলে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। অবশ্য কাকাবাবুকে কেউ মারতে পারবে না।

এই সময় একজন এসে চা দিয়ে গেল। মঞ্জু চা ঢেলে দিল সবাইকে।

কাকাবাবু একটা চুমুক দিয়ে বললেন, স্বাদটা অন্যরকম।

অমল বলল, এখানকার চা। এতে আমাদের দাৰ্জিলিংয়ের ফ্লেভার তো পাবেন না। সেইজন্য আমি কফি খাই। এখানকার কফি খুব ভাল।

সন্তু দুচুমুক দিয়ে রেখে দিল। তার এমনিই চা খেতে ভাল লাগে না।

একটু পরেই ওরা নেমে এল নীচে। হোটেলের ফুটপাথে অনেক গাড়ি রয়েছে বলে আমল তার গাড়ি পার্ক করেছে একটু দূরে। রাস্তা পার হয়ে যেতে হবে।

অমল বলল, কাকাবাবু, আপনারা এখানে দাঁড়ান, আমি গাড়িটা নিয়ে আসছি।

কাকাবাবু বললেন, তার দরকার নেই, চলো, আমার গাড়ির কাছেই যাচ্ছি।

অমল কাকাবাবুর হাত চেপে ধরে বলল, না! রাস্তা পার হতে আপনার অসুবিধে হবে, দেখছেন না, কত গাড়ি যাচ্ছে! আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি চট করে নিয়ে আসছি গাড়িটা?

কাকাবাবুর কিছু-কিছু ছেলেমানুষি জেদ আছে। কেউ যদি তাঁকে কোনও অসুবিধের কথা বলে, তা হলে তিনি সেটা করবেনই। ক্রচ নিয়ে তাঁর হাঁটুড়ে

অসুবিধে হবে, এরকম অনেকেই মনে করে।

তিনি জোর দিয়ে বললেন, কোনও অসুবিধে নেই, আমরা গাড়ি পর্যন্ত হেঁটে যাব।

মঞ্জু বলল, সেটাই সুবিধে হবে, গাড়িটা আনতে গেলে অনেকটা ঘুরে আসতে হবে।

ওরা মাঝ-রাস্তায় আসতেই হঠাৎ একটা থেমে-থাকা স্টেশান ওয়াগন ইউ টার্ন নিয়ে ছুটে এল ওদের দিকে। সোজা ওদের ওপর দিয়ে চলে যাবে মনে হল। চোখের নিমেষে যে-যেদিকে পারল লাফ দিল, কে যেন হাত ধরে টান মারাল সন্তুর।

তারপরেই সে ঘুরে দেখল স্টেশান ওয়াগনটা অন্য দুটো গাড়িকে ধাক্কা মারতে মারতে কোনওরকমে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, আর রাস্তার মাঝখানে পড়ে আছে কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো।

রাস্তার দুপাশে লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে। একটা বিরাট দুর্ঘটনা হতে-হাতে বেঁচে গেল। সন্তু দেখল, কাকাবাবু একটু দূরে দাঁড়িয়ে জামার ধুলো ঝাড়ছেন। সন্তু তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, দরকারের সময় আমি এই খোঁড়া পায়েই প্ৰায় হনুমানের মতন লাফাতে পারি। দ্যাখ তো, আমার ক্রাচ দুটো ঠিক আছে কি না?

মঞ্জু ছুটে এসে বলল, আপনাদের লাগেনি তো?

অমল মুখ ভেংচিয়ে বলল, এখানকার কিছু-কিছু লোক এমন বিচ্ছিরি গাড়ি চালায়, ট্রাফিকের কোনও নিয়ম মানে না…নিশ্চয়ই ওই ড্রাইভারটা নেশা করেছিল, নইলে এমন ভিড়ের রাস্তায় কেউ অত জোরে ইউ টার্ন নেয়?

সন্তুর মুখখানা আড়ষ্ট হয়ে গেছে। এটা সাধারণ কোনও অ্যাকসিডেন্টের ব্যাপার নয়। লোকটা ইচ্ছে করেই তাদের চাপা দিতে এসেছিল। এক ঝলকের জন্য সন্তু ড্রাইভারটার মুখ দেখতে পেয়েছিল। গাল-ভর্তি দাড়ি, চোখে কালো চশমা, মাথায় ফেল্টের টুপি। টেলিফোনে যে ভয় দেখিয়েছিল, সে বলেছিল হোটেল থেকে না বেরোতে। সে বলেছিল, কাকাবাবুর প্রাণের ভয় আছে।

অমল ক্রাচ দুটো কুড়িয়ে এনে বলল, আপনার একটা ক্রাচ। ড্যামেজ হয়ে গেছে। বদলাতে হবে। তার কোনও অসুবিধে নেই। ক্রাচ দুটো চট করে ছেড়ে দিয়ে আপনি ভাল করেছেন।

মঞ্জু বলল, ক্রাচ সঙ্গে নিয়ে তো লাফানো যায় না! ইশ, আর-একটু হলে কী কাণ্ড হয়ে যেত।

কাকাবাবু বললেন, চলো, শেষ পর্যন্ত কারও তো কিছু হয়নি। সুতরাং এটাকে অ্যাকসিডেন্ট বলা যায় না। ওই গাড়ির নম্বর টুকে রাখলেও কোনও কাজে লাগত না।

মঞ্জু বলল, বাবাঃ, আমার এখনও বুক কাঁপছে।

গাড়িতে ওঠার পর কাকাবাবু ক্ৰাচ দুটো ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন। অমল তখনও বাইরে দাঁড়িয়ে। কাকাবাবু সামনের সিটে বসেছেন, ক্ৰাচ নিয়ে নাড়াচাড়া করলে গাড়ি চালানো যাবে না।

অমল জিজ্ঞেস করল, তা হলে কি আগে আপনার ক্রাচটা বদলে আনব?

কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ, তার দরকার হবে না। তার দিয়ে বেঁধে কাজ চালাতে হবে। আমার বিশেষ একটা চেনা দোকান ছাড়া আমি অন্য যে-কোনও জায়গার ক্ৰচ ব্যবহার করি না। তারপর, যেন একটা মজার কথা বলছেন, এইভাবে হাসতে হাসতে বললেন, লোকটা আনাড়ির মতন গাড়ি চালিয়ে আমার একটা ক্রাচের ক্ষতি করে দিয়েছে, এজন্য ওর কিছু একটা শাস্তি পাওয়া উচিত। কী বলো?

অমল বলল, ওকে আর আপনি পাচ্ছেন কোথায়?

মঞ্জু বলল, তাড়াতাড়ি চলো, এরপর সন্ধে হয়ে যাবে।

ওরা ঠিকই বলেছিল, ন্যাশনাল পার্কের গেটে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না। সেই গেটে টিকিট কেটে নিয়ে নিজস্ব গাড়িতেই ভেতরে ঢুকে পড়া যায়। একটা পিচ-বাঁধানো রাস্তা সোজা চলে গেছে, একটু পরেই ডান-দিকে বী-দিকে মেঠো পথ কিংবা ইচ্ছে করলে মাঠের মধ্যেও নেমে পড়া যায়।

মাঝে-মাঝে একটা-দুটো বড় গাছ। আর সবই প্ৰায় ঘাসজমি, কোথাও কোথাও পাথুরে শুকনো মাটি। আমাদের দেশের ন্যাশনাল পার্ক বলতে যে বিশাল-বিশাল গাছের ঘন জঙ্গল বোঝায়, তার সঙ্গে কোনও মিলই নেই।

মিনিট-পাঁচেকের মধ্যেই দেখা গেল এক ঝাঁক হরিণ।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, পোষা?

মঞ্জু বলল, ধ্যাত? এখানে কোনও কিছুই পোষা নয়। এরপর এত ঝাঁকে-ঝাঁকে হরিণ দেখবে যে, তুমি একসঙ্গে অত গোরু-ছাগলও কখনও দ্যাখোনি।

সত্যি তা-ই, নানারকম হরিণের ঝাঁক চোখে পড়তে লাগল। অনবরত। এক জায়গা থেকে বেশ খানিকটা দূরে দেখা গেল দুটো উটপাখি, অমল দ্রুত গাড়ি চালিয়ে গেল সেদিকে, কিন্তু তার আগেই ধুলো উড়িয়ে ছুটে সেই বিশাল পাখি দুটো উধাও হয়ে গেল যেন কোথায়!

আধঘণ্টার মধ্যেই ধৈৰ্য হারিয়ে অমল জিজ্ঞেস করল, সিংহ কোথায়? এই মঞ্জু, সিংহ দেখা যাচ্ছে না কেন?

মঞ্জু বলল, আমি কী করে বলব? আমি কি আগে থেকে অর্ডার দিয়ে সিংহ রেডি করে রাখব?

অমল বলল, কিন্তু সেবার যে অনিলন্দাকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সিংহ দেখানো হল?

অনিলদার লোক ভাল ছিল! সিংহরা তো সব সময় এক তল্লাটে থাকে না।

জানেন কাকাবাবু, মঞ্জু এখানে এক-একা চলে আসে। ও মানুষের চেয়ে জন্তু-জানোয়ার দেখতে বেশি ভালবাসে। ও এলেই নাকি সিংহ দেখতে পায়।

হ্যাঁ। আমার সিংহ দেখতে ভাল লাগে। যতবার দেখি, ততবারই ভাল লাগে। সিংহর কত ছবি তুলে নিয়ে গেছি, তাতেও তোমার বিশ্বাস হয়নি?

এখানকার সিংহরা এমন ট্রেইন্ড হয়ে গেছে যে, ক্যামেরার সামনে দিব্যি পোজ মেরে দাঁড়ায়।

সন্তু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, ওটা কী? ওটা কী?

সবাই একসঙ্গে ডান দিকে তাকাল। একটু দূরে ঘাসজমির পাশে একটা মস্ত বড় হরিণ শুয়ে ছটফট করছে, তার পেটটা চিরে গেছে। অনেকখানি, সেখান থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে রক্ত।

অমল ফিসফিস করে বলল, হরিণটাকে মেরেছে, তা হলে সিংহটা নিশ্চয়ই কাছাকাছি আছে।

মঞ্জু বলল, উহুঁ তা মনে হয় না। সিংহ তো এমনি-এমনি হরিণ মারে না। খিদে পেলেই মারে, তারপর সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করে। ফেলে রেখে তো চলে যায় না।

কাকাবাবু বললেন, আমি যতদূর জানি, সিংহর বদলে সিংহীই শিকার করে বেশি। সিংহরা অলস হয়।

মঞ্জু বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন। সিংহ-পরিবারে বউরাই খাটাখাটনি করে বেশি। তারাই খাবার জোগাড় করে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে বোধহয় একটা সিংহী এইমাত্র হরিণটাকে মেরে রেখে তার ছানাপোনা আর অলস স্বামীকে ডাকতে গেছে।

অমল জিজ্ঞেস করল, মঞ্জু, এই হরিণটাকে বাঁচাবার চেষ্টা করা যায় না? আমাদের গাড়িতে যদি তুলে নিই, গেটের সামনেই ওদের হাসপাতাল আছে।

সন্তু বলল, হ্যাঁ, চলুন, তুলে নিই!

সন্তু গাড়ির দরজা খুলতে যেতেই মঞ্জু তার হাত চেপে ধরে বলল, তোমরা কি পাগল হয়েছ? এসব জায়গায় কক্ষনো গাড়ি থেকে নামতে নেই। গাড়ি থেকে নামলে যখন-তখন বিপদ হতে পারে। এই ঘাসবনে যদি কোনও লেপার্ড লুকিয়ে থাকে…ওরা কী রকম পাজি হয় তোমরা জানো না…

কাকাবাবু বললেন, সে-কথা ঠিক, গাড়ি থেকে নামটা বিপজ্জনক। আইনেও বোধহয় নিষেধ আছে। তা ছাড়া, আমার তো মনে হয়, জঙ্গলের রাজত্বে জন্তু-জানোয়ারদের ব্যাপারে আমাদের হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়।

সন্তু তবু ক্ষুণ্ণভাবে বলল, এখানে সিংহ-টিংহ কিছু নেই। গাড়ির আওয়াজ শুনে পালিয়েছে। হরিণটা শুধু শুধু…

মঞ্জু বলল, আফ্রিকার সিংহ গাড়িটাড়ি দেখে ভয় পায় না, গ্রাহ্যই করে না!

এই সময় আর-একটা গাড়ি এসে একটু দূরে দাঁড়াল। সন্তু অমনি উত্তেজিতভাবে বলল, ওই তো, ওই তো, সেই গাড়িটা?

অমল জিজ্ঞেস করল, সেই গাড়িটা মানে! ও হ্যাঁ, এটাও তো দেখছি একটা স্টেশন ওয়াগন, অনেকটা একই রকম দেখতে, তবে সেটার রং খয়েরি ছিল না?

সন্তু বলল, না, মেরুন ছিল। এই গাড়িটা আমাদের চাপা দিতে এসেছিল।

অমল বলল, এই একইরকম গাড়ি নাইরোবি শহরে অনেক আছে। আমাদের অফিসেও একটা আছে। মঞ্জু, তুমি সেই গাড়িটার নম্বরটা দেখে রেখেছিলে?

না। এমন আচমকা এসে পড়েছিল যে, খেয়ালই করিনি। তবে ড্রাইভারটার চেহারা যেন দেখেছিলুম এক পলক।

সন্তু বলল, ড্রাইভার বদলে গেছে। তখন ড্রাইভারের দাড়ি-গোঁফ ছিল, এর কিছু নেই। এ অন্য লোক হতে পারে, কিন্তু এটাই সেই গাড়ি!

অমল হেসে বলল, এটা তুমি কী করে বলছি, সন্তু? বললুম না, এই একই মডেল, একই রঙের অনেক স্টেশান ওয়াগন আছে নাইরোবি শহরে। তুমি কি ভয় পাচ্ছ?

কাকাবাবু শান্ত গলায় বললেন, তোমরা অনর্থক কথা বলে সময় নষ্ট করছি। ওই দ্যাখো, সিংহীটা এসে গেছে?

সত্যিই এর মধ্যে একটি সিংহী এসে মুমূর্ষ হরিণটার পেটের কাছে কামড়ে ধরে টানাটানি করছে। হরিণটার গলা দিয়ে বেরোচ্ছে একটা বিকৃত আওয়াজ। সিংহীটার পেছনে রয়েছে দুটো বাচ্চা সিংহ।

কাকাবাবু বললেন, সিংহীটার বোধহয় শিগগিরই ডিভোর্স হয়ে গেছে, তাই ওর স্বামী আসেনি, ছেলেমেয়েরা এসেছে।

অমল লাফিয়ে উঠে বলল, ক্যামেরা! মঞ্জু, তোমার ব্যাগ থেকে ক্যামেরটা বার করে।

মঞ্জু কচুমাচু মুখে বলল, এই যাঃ! ক্যামেরাটা আছে, কিন্তু আসবার সময় ফিলম কিনে আনব ভেবেছিলুম!

অমল নিজের মাথার চুল চেপে ধরে বলল, হোপলেস! এরকম একখানা

সন্তু আগে কখনও সিংহী। দেখেনি। সিংহ বলতেই কেশর সমেত প্ৰকাণ্ড মাথাওয়ালা পশুরাজের কথা মনে পড়ে। সেই তুলনায় সিংহীকে দেখতে এমন কিছুই না। প্রায় একটা খুব বড়সড় কুকুরের মতন।

সিংহীটা একটা জ্যান্ত হরিণের পেট ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। এ-দৃশ্য সন্তুর দেখতে ইচ্ছে হল না। সে আবার স্টেশান ওয়াগনটির দিকে তাকাল। ড্রাইভার ছাড়া সে-গাড়িতে আর কোনও যাত্রী নেই। তা হলে শুধু শুধু অতবড় গাড়ি নিয়ে একলা একটা লোক এখানে এসেছে কেন? ড্রাইভারটাও সিংহীটার হরিণ-খাওয়া দেখছে না, যেন ও ব্যাপারে তার কোনও আগ্রহই নেই। সে-ও তাকিয়ে আসে সন্তুদের গাড়ির দিকে। তার দাড়িগোঁফ নেই, মাথায় টুপি নেই কিন্তু চোখে কালো চশমা।

ওই লোকটা যদি তার বড় গাড়ি নিয়ে সন্তুদের গাড়িটা ধাক্কা মেরে উলটিয়ে দেয়, তা হলেও কেউ জানতে পারবে না এখানে। সন্তুর দৃঢ় ধারণা হল, ওই লোকটা সেই মতলবেই এসেছে। কাকাবাবুকে সাবধান করে দেওয়া উচিত।

সন্তু কিছু বলবার আগেই আরও দুটি গাড়ি এসে থামল সেখানে। একটা জিপ, আর একটা স্টেশান ওয়াগন। এখানকার নিয়মই এই কোথাও একটা-দুটো গাড়ি থামলেই অন্য গাড়িরা সেখানে এসে ভিড় করে কিছু দেখতে পাবার আশায়। দুটি গাড়িরই ছাদ খোলা ভর্তি আমেরিকান টুরিস্ট! তাদের কাছে নানা রকম ক্যামেরা, মুভি ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরাই তিন চারটে।

দেখা গেল, এই সিংহীটার ছবি তোলার ব্যাপারে বেশ আপত্তি আছে। সে সবেমাত্র তার ছানা দুটোকে ডিনার খাওয়া শেখাচ্ছিল, ভিডিও ছবি তোলার আলো তার গায়ে এসে পড়ায় সে একবার বিরক্তভাবে এদিকে তাকাল, তারপর হরিণটার পেটে একটা বড় কামড় বসিয়ে টানতে টানতে ঘাসবনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। হরিণটা তখনও ডাকছে।

আরও কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করা হল, কিন্তু সিংহীটাকে আর দেখা গেল না।

অমল বলল, তা হলে এবার ফেরা যাক! দেখা তো হল!

পরে যে গাড়ি দুটো এসেছিল, সে দুটোও স্টার্ট নিয়েছে। কিন্তু মেরুন রঙের স্টেশান ওয়াগনটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। কালো চশমা পরা ড্রাইভারটা তাকিয়ে আছে সন্তুদের দিকে।

সন্তু বলল, আগে ওই গাড়িটা চলে যাক!

অমল বলল, কী ব্যাপার, সন্তু, ভয় পেয়ে গেলে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, সন্তু যখন ভাবছে ওই গাড়িটা আমাদের চাপা দিতে এসেছিল, তখন একবার চেক করে দেখা উচিত। সন্তু তো সহজে ভুল করে না। অমল, তুমি গাড়িটা নিয়ে ওই গাড়িটার একেবারে কাছে চলো তো। ওই ড্রাইভারের সঙ্গে একবার কথা বলব।

অমল বলল, হ্যাঁ, তা বলা যেতে পারে।

সে তার গাড়িটাকে ব্যাক করতে লাগল। একটু বেশি পেছনে চলে গিয়ে সেটা নেমে গেল রাস্তার নীচে। তার ফলে, গাড়িটা আবার তুলতে খানিকটা সময় লাগল। সেইটুকু সময়ের মধ্যেই স্টেশান ওয়াগনটা হুশ করে বেরিয়ে গেল উলটো দিকে।

অমল গাড়িটা সোজা করার পর জিজ্ঞেস করল, ওকে ফলো করব?

কাকাবাবু বললেন, নাঃ, তার দরকার নেই। চলো, এবারে গেটের দিকে ফিরে চলো।

মঞ্জু বলল, আমার মনে হয়, তুমি ভুল করছ সন্তু। এই গাড়িটা নিরীহ, নির্দোষ।

সন্তু আর কিছু বলল না।

অমল বলল, আর-একটু ঘুরব? এইভাবে হাতি-টাতি দেখতে পাওয়া যেতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, না, এখন ফেরা দরকার। তা ছাড়া, ওই তো আকাশে হাতি দেখা যাচ্ছে।

সামনের আকাশে এমনভাবে মেঘ জমে আছে, ঠিক যেন মনে হয় দুটো ঐরাবত গুড় তুলে লড়াই করছে। এখানে আকাশ বহুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। শেষ সূর্যের আলোয় অনেক রকম রং ঠিকরে পড়ছে। অপূর্ব দৃশ্য। সন্তু অনেকদিন একসঙ্গে এতখানি আকাশ দ্যাখেনি।

অমল বলল, ফ্যান্টাস্টিক! এখানে সবাই শুধু জন্তু-জানোয়ার দেখতে আসে, অন্য কোনও দিকে তাকায়ই না। ডান পাশের গাছটায় দেখুন, কী রকম বড়-বড় জবাফুল ফুটে আছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, জবাফুলের এত বড় গাছ হয়? এ তো বেশ শক্তপোক্ত গাছ দেখছি।

অমল বলল, হয়তো এ-ফুলের অন্য কোনও নাম আছে। কিন্তু ঠিক জবাফুলের মতন দেখতে না?

ফেরার পথে আরও অনেক হরিণ দেখা গেল। গোটা-পাঁচেক জেব্রা একেবারে রাস্তার ওপর এসে পড়ে ভয় পেয়ে দৌড়তে লাগল। গাড়ির সামনে সামনেই।

অমল বলল, জেব্রাগুলো একেবারে বোকা হয়। আসলে গাধা তো! ওদের গুলি করে মারা কত সহজ দেখুন।

মঞ্জু বলল, এত সুন্দর প্রাণী, ওদের দেখে তোমার গুলি করে মারার কথা মনে এল?

অমল থতমত খেয়ে বলল, আমি কি মারব নাকি? বলছি যে, গুলি করে মারা সহজ। আগে সাহেবরা কত মেরেছে।

মঞ্জু বলল, এক সময় নাইরোবি শহরে জেব্রা-টানা গাড়ি চলত। আমি ছবিতে দেখেছি। আমাদের দেশে যেমন গোরুর গাড়ি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখন বুঝি জেব্রা কমে গেছে।

মঞ্জু বলল, কমেছে কী, বেড়েছে! এখন মারা নিষেধ তো। শহর ছেড়ে একটু বেরোলেই শত শত জেব্রা দেখা যায়। অনেক সময় জেব্রার জন্য গাড়ি আটকে যায়।

অমল একবার জোরে হর্ন বাজাতেই জেব্রার দলটা আরও ভয় পেয়ে পাশের দিকে নেমে গেল হুড়মুড়িয়ে। এমনভাবে তারা লাফাল যে, দেখলে হাসি পায়।

অমল বলল, আজ জিরাফ দেখা গেল না। জিরাফগুলো গাড়ির সামনে এসে পড়লে আরও মজা লাগে। একবার নাইভাসা লোক দেখতে যাবার সময় রাস্তায় কতগুলো জিরাফ এসে পড়েছিল, তোমার মনে আছে, মঞ্জু?

মঞ্জু বলল, আমার জিরাফ দেখলে খুব মায়া হয়। অতবড় চেহারা, কিন্তু কী রকম ছোট্ট মুখখানা। এত জন্তু থাকতে ভগবান শুধু ওদেরই যে কেন বোবা করেছেন, তাই-ই বা কে জানে?

অমল বলল, আমার জিরাফ দেখলেই মনে হয় ইনকমপ্লিট। তোমাদের ভগবান যেন জিরাফকে গড়তে গড়তে হঠাৎ ভুলে গিয়ে অন্য কোনও কাজে মন দিয়ে ফেলেছেন।

গল্প করতে করতে গোট পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া গেল। মঞ্জু বলল, এখন আমাদের বাড়িতে একটু চা খেয়ে যাবেন?

কাকাবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, সাড়ে ছাঁটার মধ্যে ফিরতে হবে, দেরি হয়ে যাবে। কাল যাব বরং। এখন আমাদের হোটেলে পৌঁছে দাও!

সন্তুর আবার চোখ আটকে গেছে সামনের দিকে। একটু দূরে সেই স্টেশন ওয়াগনটা থেমে আছে।

সে বলল, আমলদা, ওই যে দেখুন!

অমল মুখ ফিরিয়ে হেসে বলল, নাইরোবি শহরে ঠিক এই একই রঙের, একই মডেলের অন্তত একশোটা স্টেশান ওয়াগন আছে, এটা তার মধ্যে তৃতীয়টা।

মঞ্জু বলল, তা ছাড়া সেটা তো উলটো দিকে চলে গেল। আমাদের আগে ফিরবে। কী করে?

অমল বলল, তা অবশ্য পারে, ফেরার অনেকগুলো রাস্তা আছে। আমরা আস্তে আস্তে এসেছি।

কাকাবাবু বললেন, দ্বিতীয় গাড়িটার নম্বর আমি লক্ষ করেছিলুম। এটা সেটাই। চলো, ওর কাছে গিয়ে ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ করা যাক।

অমল নিজের গাড়িটা সেই গাড়িটার সামনে নিয়ে পার্ক করে নেমে দাঁড়াল। কাকাবাবুও নামলেন। কিন্তু স্টেশান ওয়াগনটিতে এখন কোনও ড্রাইভার নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়েও কাউকে দেখতে পাওয়া গেল না।