০১. হঠাৎ আলো নিভে গেল

হঠাৎ আলো নিভে গেল!

কলকাতার বাইরে এসেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি নেই। দার্জিলিং শহরেও যখন-তখন আলো নিভে যায়। প্রত্যেক সন্ধেবেলা একবার করে তো বিদ্যুৎ পালাবেই।

একটু আগে হোটেলের ডাইনিং রুমে রাত্তিরের খাওয়াদাওয়া সেরে ওপরে নিজেদের ঘরে ফিরে এসেছে সন্তু। কাকাবাবু এবেলা বিশেষ কিছুই খাবেন না আগেই বলেছিলেন, তাঁর জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল এক বাটি সুপ। বিকেলে জলাপাহাড়ের দিক থেকে এক চক্কর ঘুরে এসেই কাকাবাবু টেব্‌লল্যাম্প জ্বেলে কীসব লেখালেখি করতে বসেছেন।

ডাইনিংরুম আজ প্রায় ফাঁকা ছিল। সন্তু একা বসে ছিল একটা টেবিলে। হোটেল-রেস্তরাঁয় এরকমভাবে একা-একা বসে খেতে সন্তুর কেমন যেন লজ্জা করে। মনে হয়, অন্য টেবিলের লোকরা তাকে দেখছে। এই হোটেলের ম্যানেজার ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে সন্তুদের এখনও আলাপ হয়নি। কাকাবাবু তো চট করে অচেনা লোকদের সঙ্গে কথা বলতেই চান না।

কলকাতায় রাত্তিরের খাওয়াদাওয়ার পর সন্তু কিছুক্ষণ গানবাজনা শোনে কিংবা গল্পের বই পড়ে। সাড়ে এগারোটার আগে শুতে যায় না। কিন্তু এখানে সন্ধের পর থেকেই আর কিছুই করার নেই। ছটা বাজতে-নাবাজতেই সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, রাস্তা দিয়ে মানুষজন হাঁটে না। সন্তু তার ছোট ক্যাসেট-প্লেয়ারটা আনতে এবার ভুলে গেছে, তাই গান শোনার উপায় নেই। বই এনেছে দুখানা, কমপ্লিট শার্লক হোমস আর রাজশেখর বসুর মহাভারত। কিন্তু মাঝে-মাঝেই আলো নিভে গেলে কি বই পড়ার মেজাজ থাকে?

রাত এখন মাত্র সাড়ে নটা।

কাকাবাবু বসে আছেন জানলার ধারে টেবিলে, সন্তু শুয়ে পড়েছিল নিজের খাটে। সেখান থেকে নেমে সে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, মোম জ্বালব?

কাকাবাবু বললেন, ম্যানেজার তো বলেছিল, এদের জেনারেটর আছে। দ্যাখ সেটা চালায় কি না?

সন্তু বলল, কাল..পরশু..একদিনও তো জেনারেটরে আলো জ্বলেনি।

কাকাবাবু বললেন, সেটা নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আজ সারাবার কথা। দ্যাখ একটু অপেক্ষা করে। মোমবাতিতে তো আর লেখাপড়া করা যাবে না!

সন্তু অন্য জানলাটার কাছে এসে দাঁড়াল। বাইরে অবশ্য কিছুই দেখবার নেই। পুরো দার্জিলিং শহরটাই অন্ধকার। অনেক দূরে-দূরে দু-একটা বাড়িতে জোনাকির মতন মিটমিট করে মোম কিংবা লণ্ঠনের আলো জ্বলছে। আকাশ অদৃশ্য।

অথচ দিনের বেলা এই জানলা দিয়ে এমনই সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ে যে, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সন্তুদের ঘরটা হোটেলের তিনতলায়। এই জানলার দিকে থাক-থাক পাহাড় নেমে গেছে একটা উপত্যকার দিকে, তার ওপারে আবার পাহাড়। প্রায় সব সময়েই এখানে। মেঘের রাজত্ব। এক-একবার মেঘ এসে সব-কিছু ঢেকে দেয়, আবার একটু পরেই মেঘ ফুঁড়ে দূরের পাহাড়গুলো স্পষ্ট হয়। আর সেইসব পাহাড়েরও ওপাশে দৈবাৎ ম্যাজিকের মতন আচমকা ঝলমল করে ওঠে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই কদিনে সন্তু মাত্র তিনবার দেখতে পেয়েছে কাঞ্চনজঙ্ঘা, তাও কোনওবারই দু-এক মিনিটের বেশি না। দেখলেই আনন্দে বুক কেঁপে ওঠে। এই পৃথিবীতে যত পাহাড় আছে, তার মধ্যে কাঞ্চনজঙ্ঘা নামটাই সন্তুর সবচেয়ে সুন্দর মনে হয়।

কিন্তু রাত্তিরে তো কিছুই দেখার উপায় নেই। হঠাৎ সন্তুর মনে একটা প্রশ্ন জাগল, দার্জিলিং শহরে মাঝে-মাঝে রোদ তবু দেখা যায়, কিন্তু কোনও রাত্তিরে জ্যোৎস্না ওঠে? সন্ধের পর পুরোপুরিই তো মেঘের রাজত্ব। দার্জিলিং শহরে যারা সারা বছর থাকে, তারা কি কখনও ফটফটে জ্যোৎস্নামাখা আকাশ দেখেছে?

এই কথাটা মুখ ফিরিয়ে সন্তু জিজ্ঞেস করল কাকাবাবুকে।

কাকাবাবু একটু চিন্তা করে বললেন, হ্যাঁ, দেখা যায়। আমি নিজেই তো দেখেছি। দার্জিলিঙের মতন জায়গায় বেড়াবার সবচেয়ে ভাল সময় কখন জানিস? ডিসেম্বর-জানুয়ারি। লোকে শীতের ভয়ে তখন আসতে চায় না, কিন্তু সেই সময়েই আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার থাকে, অনেকক্ষণ ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যায়। হ্যাঁ, আমি একবার জানুয়ারিতে এসে রাত্তিরবেলা জ্যোৎস্না আর চাঁদও দেখেছি। এরকম বর্ষাকালে কিছুই দেখার নেই। এখন তো মেঘ থাকবেই!

এই বর্ষার সময় সন্তু আর কাকাবাবু অবশ্য শখ করে দার্জিলিং বেড়াতে আসেনি। ওরা এসেছে একটা কাজে। ঠিক কাজও বলা যায় না।

এখানকার মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে তেনজিং নোরগের একটা স্মরণসভা হচ্ছে খুব বড় করে। সেই সভার জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছেন কাকাবাবু। তেনজিং কাকাবাবুর খুব বন্ধু ছিলেন। তেনজিং কলকাতায় গেলেই কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতেন, সন্তু তাদের বাড়িতে তেনজিংকে দু-তিনবার দেখেছে। জাপান-ফ্রান্স-ইংল্যান্ড-আমেরিকা-সুইডেন থেকে অনেক নামকরা পর্বত-অভিযাত্রী এসেছেন এই সভায় যোগ দিতে। সার এডমন্ড হিলারি হচ্ছেন সভাপতি, তিনি বিশেষ করে কাকাবাবুকে আসতে লিখেছিলেন। দুদিন ধরে মিটিং চলছে, আগামীকালই শেষ, কালকেই আছে কাকাবাবুর বক্তৃতা।

অন্ধকারে চুপচাপ কেটে গেল কয়েক মিনিট। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন কাকাবাবু। এক সময় তিনি খুব চুরুট খেতেন। একবার নেপাল অভিযানে গিয়ে রাগ করে চিরকালের মতন চুরুট খাওয়া ছেড়ে দেন। এখন সিগারেট-চুরুটের গন্ধও সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু এখনও মাঝে-মাঝে ডান হাতের দুটো আঙুল ঠোঁটে চেপে ধরে হুশ হুশ শব্দ করেন।

এক সময় কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সত্ত, তুই তো শার্লক হোমস পড়ছিস। বল তো, কোনান ডয়েলের কোন লেখার মধ্যে এই কথাটা আছে, এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ওয়াটসন!

সন্তু বলল, এই ধাঁধাটা আমি জানি। লোকের মুখে-মুখে কথাটা রটে গেছে, কিন্তু শার্লক হোমসের কোনও গল্পেই ঠিক এইরকমভাবে, এলিমেন্টারি আর মাই ডিয়ার ওয়াটসন পাশাপাশি নেই।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা, মহাভারত থেকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছি। বল তো, অর্জুন কৃষ্ণের কে হয়?

সন্তু এবার একটু আমতা-আমতা করে বলল, কে হয় মানে..মানে…ওঁরা দুজন খুব বন্ধু..

কাকাবাবু বললেন, বন্ধু তো বটেই। তা ছাড়া অর্জুন কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই। কুন্তী ছিলেন কৃষ্ণের পিসি! আচ্ছা, আর একটা ব।

কাকাবাবুর অন্য প্রশ্নটা আর করা হল না, দরজায় খটখট শব্দ শোনা গেল।

কাকাবাবু আর সন্তু দুজনেই দরজার দিকে তাকাল। হোটেলের কাউন্টারে নির্দেশ দেওয়া আছে যে, আগে টেলিফোনে জিজ্ঞেস না করে কোনও লোককেই কাকাবাবুর কাছে পাঠানো চলবে না। কেউ যেন তাঁকে ডিসটার্ব না করে। তা হলে এই সময় কে এল?

আর-একবার দরজায় খটখট শব্দ হতেই কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, হু ইজ ইট?

বাইরে থেকে উত্তর এল, অ্যান আরজেন্ট মেসেজ ফর ইউ সার!

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এখন আবার কে মেসেজ পাঠাল? দ্যাখ তো সন্তু।

অন্ধকারে যাতে চেয়ারে আর খাটে ঠোক্কর খেতে না হয়, তাই সাবধানে হাতড়ে হাতড়ে দরজার কাছে পৌঁছল সন্তু। সে আবার জিজ্ঞেস করল, কে?

চিঠটি হ্যায়?

সন্তু দরজাটা খুলতেই একজন লোক তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে ভেতরে এসেই দরজা বন্ধ করে দিল চেপে। একটা টর্চ জ্বেলে কাকাবাবুর মুখের ওপর ফেলে কড়া গলায় ইংরেজিতে বলল, ফোনে হাত দেবার চেষ্টা করবেন না। নড়বেন না। আমি যা বলছি শুনুন, তা হলে আপনাদের কোনও ক্ষতি হবে না।

যার হাতে টর্চ থাকে, অন্ধকারের মধ্যে তাকে দেখা যায় না। তবু লোকটি ইচ্ছে করে নিজের ডান হাতের ওপর একবার টর্চের আলো বুলিয়ে নিল। সেই হাতে একটা রিভলভার।

একটা ধাক্কা খেয়েই সন্তু বুঝেছে যে, লোকটির গায়ে বেশ জোর। অস্পষ্ট সিলুয়েট দেখে মনে হয়, বেশ লম্বা-চওড়া পুরুষ। সন্তু অসহায়ভাবে দেওয়াল সেটে দাঁড়িয়ে গেল। কাকাবাবু এবারে দার্জিলিঙে কোনও রহস্য সমাধান করতে কিংবা কোনও অপরাধীকে ধরতে আসেননি, এসেছেন শুধু একটা মিটিং-এ বক্তৃতা দিতে। তবু তাঁর ওপর এখানে হামলা করতে আসবে কে? অবশ্য কাকাবাবুর শত্রুর অভাব নেই। হয়তো পুরনো কোনও শক্ত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দার্জিলিং পর্যন্ত তাড়া করে এসেছে।

কাকাবাবু যে টেবিলে বসে লিখছেন, তার ডান দিকের দেরাজেই কাকাবাবুর নিজের রিভলভারটা রাখা আছে, সন্তু জানে। কিন্তু কাকাবাবু কি দেরাজটা খোলার সুযোগ পাবেন।

আগন্তুকটি এক-পা এগিয়ে গিয়ে বলল, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী, আমি এসেছি আপনার ডায়েরিটা নিতে। ওটা আমাকে হ্যান্ড ওভার করে দিন, তা হলেই আমি চলে যাব।

কাকাবাবু বললেন, আমার ডায়েরি? সেটা এমনকী মূল্যবান জিনিস?

লোকটি বলল,ওই ডায়েরিটাই আমার চাই।

কাকাবাবু বললেন, এতে সব বাংলায় লেখা। আমার হাতের লেখাও জড়ানো। এই ডায়েরি তো আর কেউ পড়ে কিছু বুঝবে না।

লোকটি বলল, বেশি কথা বলার সময় নেই। ডায়েরিটা আমার হাতে তুলে দিন।

কাকাবাবু সন্ধে থেকে ওই ডায়েরিতেই লেখালেখি করছিলেন। এখনও তাঁর হাতে কলম ধরা। ডায়েরিটা একটা চামড়া দিয়ে বাঁধানো মোটা খাতা। পাতাগুলো রুল টানা। প্রায় পাঁচ-ছ বছর ধরে কাকাবাবু ওই ডায়েরিটা ব্যবহার করছেন।

কাকাবাবু কলমটা সরিয়ে, ডায়েরিটা বন্ধ করে টেবিলের এক পাশে ঠেলে দিয়ে বললেন, নিন তা হলে?

লোকটি বলল, আমার দিকে এগিয়ে দিন।

লোকটি দাঁড়িয়ে আছে কাকাবাবুর থেকে পাঁচ-ছ ফুট দূরে। হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা দেওয়া যায় না। কাকাবাবু চরম বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, ওটা আপনার দিকে ছুঁড়ে দেব?

লোকটি সঙ্গে সঙ্গে মত বদল করে বলল, না, না, ছুঁড়তে হবে না। ওটা ওখানেই রাখুন। আপনার হাতটা সরিয়ে নিন। আমি তুলে নিচ্ছি। নো ফানি বিজনেস, প্লিজ! কোনওরকম গণ্ডগোল করলেই কিন্তু আমি গুলি চালাব?

হোটেলটা পুরোপুরি কাঠের তৈরি। কিন্তু মেঝেতে পুরু কার্পেট পাতা বলেই চলাফেরার শব্দ হয় না। ঠাণ্ডার জন্য সব ঘরের লোকেই দরজা জানলা বন্ধ করে রাখে। এখান থেকে চিৎকার করলেও অন্য কেউ শুনতে পাবে না।

লোকটি ডায়েরির ওপর টর্চের আলোটা ফেলে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগল। একবার হঠাৎ পেছন ফিরে সন্তুর মুখে টর্চ ফেলে ধমকের সুরে বলল, কোনওরকম কায়দা দেখাবার চেষ্টা কোরো না, খোকা! তা হলে গুলি খেয়ে মরবে।

টেবিলের ওপর টর্চের আলো পড়েছে বলে সন্তু বুঝতে পারল, কাকাবাবু ডান দিকের দেরাজটা খোলার চেষ্টাও করেননি।

লোকটির এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে রিভলভার। কোন হাতে তা হলে মোটা খাতাটা নেবে? সন্তু এখন শুধু লোকটির পিঠের দিকটা আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছে।

লোকটি জ্বেলে রাখা অবস্থাতেই টর্চটি কোটের পকেটে ভরল। তারপর বাঁ হাত দিয়ে ডায়েরিটা তুলে নিতে গেল।

কাকাবাবু এতক্ষণ স্থিরভাবে বসে ছিলেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে বললেন, শয়তান।

চেয়ারের পাশেই যে কাকাবাবুর কাচদুটি ঠেস দিয়ে রাখা, তা এই লোকটি লক্ষই করেনি। কাকাবাবু বিদ্যুৎগতিতে একটা ক্রাচ তুলে নিয়ে লোকটির ডান হাতে মারলেন খুব জোরে।

রিভলভারটি ছিটকে গিয়ে প্রথমে লাগল ঘরের সিলিং-এ, তারপর সেটা একটা খাটের পাশের বেড-ল্যাম্পের ওপর গিয়ে পড়ল। কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ হল।

সন্তুও সঙ্গে সঙ্গে পেছন দিক দিয়ে এক লাফে লোকটির গলা দুহাতে আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়ল। এইরকমভাবে ধরলে যত গায়ের জোরই থাক কোনও লোকই সহজে ছাড়াতে পারে না।

ঠিক এই সময় আলো জ্বলে উঠল!

কালো কোট-প্যান্ট পরা লোকটি সত্যিই বেশ স্বাস্থ্যবান। মুখখানা এই অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষদের মতন, কিন্তু পাহাড়িদের তুলনায় লোকটি বেশ লম্বা।

ক্ৰাচটাকে রাইফেলের মতন তুলে ধরে কাকাবাবু বললেন, তুই এবার ছেড়ে দে, সন্তু! রিভলভারটা দ্যাখ কোথায় পড়ল, তুলে নে।

তারপর লোকটিকে বললেন, আমার এই ক্রাচের মধ্যে গুপ্তি আছে। তুমি আর কোনওরকম গোলমাল করবার চেষ্টা করলেই একটা লকলকে ছুরির ফলা তোমার বুক ফুটো করে দেবে। এবার বলো তো, তুমি কে? এইসব স্মলটাইম কুকদের নিয়ে মহা জ্বালাতন। এরা ভাবে যে, একটা সামান্য রিভলভার এনে নাড়াচাড়া করলেই রাজা রায়চৌধুরীকে জব্দ করা যায়। শুধু-শুধু সময় নষ্ট!

লোকটি এবার হে-হো করে হেসে উঠল।

সন্তু খাটের তলা থেকে রিভলভারটা তুলে এনে কাকাবাবুর পাশে এসে দাঁড়াল। এরকম একটা অস্ত্র হাতে নিলে তার মনে বেশ ফুর্তি আসে। লোকটাকে বেশ সহজেই ঢিট করা গেছে। মনে-মনে সে যেন জানত, লোকটা কাকাবাবুর ডায়েরি নিয়ে কিছুতেই এই ঘরের বাইরে যেতে পারবে না!

লোকটির পোশাক-পরিচ্ছদ বেশ দামি। মুখের ভাব দেখলে সাধারণ গুণ্ডা-বদমাইশ বলে মনে হয় না।

লোকটি হাসতে-হাসতেই বলল, দ্যাটস অফ, মিঃ রাজা রায়চৌধুরী! আপনি সত্যিই অসাধারণ! মাই স্যালিউট টু ইউ! আমি আপনার সম্পর্কে যতটা শুনেছি বা পড়েছি, আপনি তার চেয়েও অনেক বেশি গুণী! আমি চোর-গুণ্ডা নই, আমি আপনার সঙ্গে এতক্ষণ ঠাট্টা করছিলাম।

কাকাবাবু ভুরু তুলে বললেন, ঠাট্টা?

লোকটি বলল, আপনি বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। কিন্তু আপনার সঙ্গে আলাপ করার খুব ইচ্ছে আমার। সেইজন্যই এইভাবে…আপনার ডায়েরির ওপর আমার কোনও লোভ নেই। আমি বাংলা পড়তে জানিই না। আমার নাম ফিলিপ তামাং। আপনি শিংলাও জায়গাটার নাম শুনেছেন? লিটুল রংগিত নদীর ধার ঘেঁষে যেতে হয়। সেখানে আমার একটা ছোট্ট চা বাগান আছে।

লোকটি কোটের পকেট থেকে একটি কার্ড বার করে কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।

কাকাবাবু কার্ডটা উলটে-পালটে দেখে বললেন, এটা ফিলিপ তামাং নামে একজনের কার্ড হতে পারে। কিন্তু তুমিই যে সেই ব্যক্তি তা বুঝব কী করে? আর এইভাবে রিভলভার নাচিয়ে আলাপ করতে আসার মানেই বা কী?

লোকটি বলল, এই হোটেলের ম্যানেজারও আমাকে চেনে। সে সব প্রমাণ আপনি ঠিকঠাক পেয়ে যাবেন। আমি আর মিথ্যে কথা বলছি না। আপনার ওই ক্ৰাচটা এবার নামাবেন? যদি ফট করে ছুরির ফলাটা বেরিয়ে আসে? আমি গুপ্তি-টুপ্তি জাতীয় জিনিসকে খুব ভয় পাই।

কাকাবাবু কড়া গলায় বললেন, ঠিক আছে, বুঝলাম, আপনি ফিলিপ তামাং, একটা চা বাগানের ম্যানেজিং ডাইরেকটর। কিন্তু এভাবে ভয় দেখিয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য এত ব্যস্ততা কিসের জন্য? আর আপনি আলাপ করতে চাইলেই যে আমি আলাপ করব, তার কী মানে আছে?

লোকটি বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আমি আপনার একজন ভক্ত। আমি আপনার সব কটা অ্যাডভেঞ্চারের কথা পড়েছি। আপনি নেপাল হয়ে কালাপাথরের দিকে গিয়ে যেভাবে কেইন শিপটনের জারিজুরি খতম করেছিলেন, ওঃ অদ্ভুত আপনার সাহস। আর আপনার সঙ্গীটি, এই মাস্টার সন্তু, এও কম নয়। তাই ভেবেছিলাম, আপনাদের একটু চমকে দেব।

কাকাবাবু তবু বিরক্তভাবে বললেন, আপনি খুব খারাপ কাজ করেছেন। রিভলভার নিয়ে এরকম ছেলেখেলা করা চলে না। যদি ওর থেকে গুলি বেরিয়ে এসে কারও গায়ে লাগত? একটা সাঙ্ঘাতিক অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারত!

লোকটি হেসে বলল, সে রিস্ক আমি নিইনি। আমার রিভলভারে গুলি ভরা নেই একটাও। আপনি চেক করে দেখুন।

কাকাবাবু সন্তুর কাছ থেকে রিভলভারটা নিয়ে দেখলেন, তাতে সেফটি ক্যাচ লাগান। চেম্বারে সত্যিই কোনও গুলি নেই।

এতক্ষণ বাদে কাকাবাবু গোঁফের ফাঁকে সামান্য হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমার এই ক্রাচের মধ্যেও গুপ্তি-টুপ্তি কিছু নেই। তার কোনও দরকারও হয় না।

লোকটি ডান হাতখানা মুখের সামনে এনে ফুঁ দিতে দিতে বললেন, উঃ, খুব জোর লেগেছে। কবৃজিটা মচকে গেল কি না কে জানে। একটা রিভলভার দেখেও যে আপনি এত কুইকলি সেটা কেড়ে নেবার চেষ্টা করবেন, তা আমি কল্পনাই করিনি।

কাকাবাবু বললেন, আমার মুখের সামনে কেউ রিভলভার নিয়ে নাড়াচাড়া করলে আমি মোটেই তা পছন্দ করি না। আমার দিকে কেউ অস্ত্র তুললে আমি তাকে কিছু-না-কিছু শাস্তি না দিয়ে ছাড়ি না।

লোকটি বলল, আর আপনার এই ভাইপোটি যে ঠিক একই সঙ্গে আমার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল…আপনি কি অন্ধকারের মধ্যেও ওকে চোখের ইঙ্গিত করেছিলেন?

কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে ওসব কিছু বলতে হয় না। ঠিক কোন্ সময়ে কোন্ অ্যাকশান নিতে হয়, তা ও জানে।

লোকটি বলল, আমার হাতটায় একটু ঠাণ্ডা জল দিয়ে আসব? না হলে হাতটা ফুলে যাবে মনে হচ্ছে। আপনাদের বাথরুমটা একটু ব্যবহার করতে পারি?

কাকাবাবু মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।

লোকটি বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই কাকাবাবু টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিলেন ফোনটা। রিসেপশন থেকে একজন বলল, গুড ইভনিং, সার। বলুন?

কাকাবাবু ফোনটা আলগা করে ধরলেন, সন্তু সব কথা শুনতে পাচ্ছে পাশে দাঁড়িয়ে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ফিলিপ তামাং নামে কাউকে আপনি চেনেন?

ম্যানেজার বলল, হ্যাঁ সার, চিনি। একটা চাবাগানের ম্যানেজার। আমাদের হোটেলে প্রায়ই আসেন। আজও তো আমাদের লাউঞ্জে বসে দুজন লোকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আলো নিভে যাবার পর বোধ হয় চলে গেছেন। এখন আর দেখছি না।

লোকটি কি বেশ লম্বা?

হ্যাঁ, সার। লেপচাদের মধ্যে ওরকম লম্বা মানুষ খুব কম দেখা যায়। উনি একসময় ভাল ফুটবল খেলতেন। কলকাতাতেও খেলেছেন মোহনবাগানে। আপনি কি ফিলিপ তামাংকে খুঁজছেন? ডাইনিং রুমে আছে কি না দেখব?

না, ঠিক আছে। থাক।

কাকাবাবু ফোনটা রেখে দেবার পরেই ফিলিপ তামাং বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, আমি আপনার সঙ্গে শুধু-শুধু আলাপ করতে আসিনি। আমি একটা প্রস্তাবও নিয়ে এসেছি। তার আগে আমার পরিচয়টা দিয়ে নিই ভাল করে।

সন্তু বলল, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনার চেহারা দেখে আপনার পরিচয় যতটুকু বোঝা যায়, সেটা আমি বলে দিচ্ছি। দেখুন তো মেলে কি না?

ফিলিপ তামাং অবাকভাবে সন্তুর দিকে তাকাল।

সন্তু একটু এগিয়ে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে কার্পেট থেকে একটুখানি অদৃশ্য ধুলো তুলে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, আপনি প্রথমে এসে ঠিক এইখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আপনার জুতোর ছাপ পড়েছে। এটা দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আপনি হিন্দু নন, ক্রিশ্চান।

ফিলিপ তামাং হেসে বলল, আমার ফার্স্ট নেইম ফিলিপ, সেটা শুনেই বোঝা যাবে। এর সঙ্গে জুতোর কী সম্পর্ক?

সন্তু বলল, আপনি ক্রিশ্চান তো বটেই, তা ছাড়াও, আপনি নেপালি বা গোখা নন, আপনি লেপচা।

ফিলিপ তামাং বলল, এটা অবশ্য নাম শুনে বোঝা যায় না। তামাং নামটা সাধারণত নেপালিদেরই হয়। গুড গেস্। ত্যা মিলেছে। তারপর?

সন্তু বলল, আপনার দুপায়ের জুতোর ছাপ সমানভাবে পড়েনি। ডান পায়ের ওপর বেশি জোর দেন। এর থেকেই প্রমাণ হয়, আপনি একজন ফুটবল খেলোয়াড়, একসময় ভালই খেলতেন। খুব সম্ভবত স্ট্রাইকার পজিশানে…

ফিলিপ তামাং চোখ বড় বড় করে কাকাবাবুর দিকে তাকাতেই কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, ও শার্লক হোমসের গল্পগুলো বারবার পড়েছে তো। তাই খুব ছোটখাটো ব্যাপার থেকে অনেক কিছু জানতে শিখেছে।

ফিলিপ তামাং ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, ফ্যানট্যাস্টিক। আর কী, আর কী বলতে পারো তুমি?

সন্তু বলল, আপনি যেভাবে চেয়ারে বসলেন, তার থেকেই বোঝা যায়, আপনি বাঙালিদের সঙ্গে অনেক মেলামেশা করেছেন। আপনি বাংলা জানেন। নিজে ভাল বলতে না পারলেও বুঝতে পারেন সব। ঠিক কি না? ফিলিপ তামাং এবারে বাংলাতেই বলল, একেবারে ঠিক। আর? আর?

সন্তু বলল, ছেলেবেলায় আপনার একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। আপনার একটা পায়ে খুব চোট লেগেছিল।

ফিলিপ তামাং বলল, এটাও মিলেছে। কিন্তু কোন্ পায়ে?

সন্তু ওর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, ডান পায়ে। হাঁটুতে। তখন ঠিক বুঝতে পারেননি। কিন্তু এখন হাঁটুটায় মাঝে-মাঝে ব্যথা করে।

ফিলিপ তামাং কাকাবাবুর দিকে উদভ্রান্তভাবে তাকিয়ে বলল, আপনার এই ভাইপোটির সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে নাকি? অল্প বয়েসে আমি একবার পাহাড় থেকে অনেকখানি গড়িয়ে পড়েছিলাম। তখন খুব একটা ব্যথা পাইনি। কিন্তু এখন এই ডান দিকের হাটুটা মাঝে-মাঝে অসহ্য টনটন করে। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি, কেউ সারাতে পারে না। কিন্তু এসব কথা এই ছেলেটি জানল কী করে?

কাকাবাবুও কৌতূহলীভাবে সন্তুর দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কোনও মন্তব্য করলেন না।

সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনার সম্পর্কে মোটামুটি এইটুকু আমরা জানি। আপনার বাকি পরিচয়টা এবার বলুন।

ফিলিপ তামাং বলল, আমি এখনও বুঝতে পারছি না, তুমি কী করে এতসব..আচ্ছা, আর কী জানো?

সন্তু বলল, আপনি খুব বেশি সিগারেট খান।

ফিলিপ তামাং সঙ্গে সঙ্গে কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল, মাই গড! আমি এ পর্যন্ত একটাও সিগারেট ধরাইনি, তবু তুমি কী করে ধরলে?

কাকাবাবু এবার বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। মিঃ তামাং, এবার আপনি কী জন্য এসেছেন বলুন।

ফিলিপ তামাং সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার বার করে ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, আপনারা দুজনে মিলে একটা ইউনিক টিম! মিঃ রায়চৌধুরী, আমি সংক্ষেপে নিজের সম্পর্কে আরও একটু পরিচয় দিচ্ছি। আমার বাবা ছিলেন লেপচা, মা নেপালি। আমার অল্প বয়েসে বাবা মারা যান। মা একটা চার্চে বোয়া-মোছার কাজ করতেন। সেই চার্চের ফাদাররা আমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেন। আমার তখন মাত্র সাত বছর বয়েস। ফাদাররা আমাকে যত্ন করে লেখাপড়া শেখান। তারপর আমি কলকাতায় কলেজে পড়তে গেছি, সেখানে খেলাধুলোও করেছি। তারপর সেই চার্চের ফাদারদের সুপারিশেই আমি একটা চাবাগানে চাকরি পাই। সেটা ছিল খুব বড় চাবাগান, তখনও সেটার মালিক ছিল এক ইংরেজ সাহেব। আমি ভাল করে বাগানের কাজ শিখেছিলাম, মালিকও আমাকে পছন্দ করতেন। তারপর সেই ইংরেজ-সাহেব যখন চা বাগানটা বিক্রি করে দেন এক পাঞ্জাবির কাছে, তখন সেই বাগানের একটা ছোট অংশ তিনি আমাকে দিয়ে যান। ফ্রি গিট! সুতরাং আমি এখন একটা চা বাগানের মালিক। আমি অ্যাডভেঞ্চার-স্টোরি পড়তে খুব ভালবাসি। আমি আপনাদের সবকটা অভিযানের কাহিনী পড়েছি। আমি আপনার ভক্ত তো ছিলামই, এখন থেকে সন্তুরও ভক্ত হয়ে গেলাম। আমি আপনাদের কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।

কাকাবাবু একটু অধৈর্যভাবে বললেন, হ্যাঁ, সেটা বলুন!

ফিলিপ তামাং বলল, আপনি এখানে কনফারেন্সে বক্তৃতা দিতে এসেছেন। কালকে আপনার লেকচার হয়ে যাবে। তারপর কয়েকদিন আমার চা-বাগানে কাটিয়ে আসবেন চলুন! সেখানে বিশ্রাম নেবেন। আপনি কখনও কোনও চা বাগানে থেকেছেন?

কাকাবাবু একটা চাপা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, থেকেছি। একবার লংকাপাড়া টি-এস্টেটে দুসপ্তাহ কাটিয়ে গেছি।

ফিলিপ তামাং বলল, লংকাপাড়া? সে তো ড়ুয়ার্সে। আপনি পাহাড়ে তো থাকেননি। পাহাড়ের চা বাগান অন্যরকম।

কাকাবাবু বললেন, পাহাড়ে…, লোপচু চাবাগানেও থেকেছি একবার। এক সময় দার্জিলিংকালিম্পং অঞ্চলে আমার যথেষ্ট ঘোরাফেরা ছিল। মিঃ তামাং, আপনার আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু এবার আমাদের যাওয়া হবে না। পরশুই আমরা কলকাতায় ফিরব।

সন্তু অবশ্য কোনওদিন চাবাগানের মধ্যে গিয়ে থাকেনি। তার খুব আগ্রহ হচ্ছিল, তবু সে চুপ করে রইল।

ফিলিপ তামাং বলল, পরশুই ফিরে যাবেন? কেন, আপনি তো এখন রিটায়ার্ড শুনেছি, তা হলে আপনার এত তাড়া কিসের? কয়েকটা দিন আমার বাগানে বিশ্রাম নিয়ে যান। আমার লোকেরা আপনার খুব খাতির-যত্ন করবে। আপনার ভাল লাগবে।

কাকাবাবু বললেন, আমি রিটায়ার্ড বটে, কিন্তু এখনও বিশ্রামের জন্য তেমন ব্যস্ত নই। কলকাতাতে কিছু কাজ আছে।

ফিলিপ তামাং বলল, বিশ্রাম মানে আমি মিন অছি বেড়াবেন ওদিকটায়, সুন্দর ছোট নদী আছে একটা, গভীর জঙ্গল, আর আমাদের বাংলোর বাগানে বসেই পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘার রেইঞ্জ দেখা যায়। আরও কিছু অদ্ভুত জিনিসও আছে। ওখানে আপনি অ্যাডভেঞ্চারেরও অনেক সুযোগ পাবেন।

কাকাবাবু চেয়ারটা খানিকটা সরিয়ে বললেন, আমার এই পা-টা দেখেছেন? আমি খোঁড়া মানুষ। এক সময় এইসব পাহাড়-অঞ্চল খুবই ভালবাসতাম, এখন পাহাড়ে উঠতে-নামতে খুব কষ্ট হয়।

আপনাকে বেশি ঘোরাঘুরি করতে হবে না। কোথাও গিয়ে চুপ করে বসে থাকাও যে আমার ধাতে নেই।

আপনি একবার গিয়েই দেখুন, মিঃ রায়চৌধুরী, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না। যদি ভাল না লাগে, দু দিন পর ফিরে আসবেন।

আমি দুঃখিত, মিঃ তামাং, আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়।

মিঃ রায়চৌধুরী, ওখানে একটা সাঙ্ঘাতিক মিস্ত্রি আছে, আপনি যদি সেটা সভ করতে পারেন…

আমি আর কোনও মিস্ত্রি-টিস্ত্রির কথা শুনতে চাই না। দার্জিলিঙে এসেছি তেনজিং-এর স্মরণসভা অ্যাটেন্ড করতে, তা ছাড়া অনেক পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, সেইজন্য। পরশু আমরা ডেফিনিটলি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি।

এর পরও কিছুক্ষণ ফিলিপ তামাং কাকাবাবুকে নিয়ে যাবার জন্য ঝুলোঝুলি করতে লাগল, কাকাবাবু কিছুতেই মত বদলালেন না।

এক সময় বেশ কঠোরভাবে কাকাবাবু বললেন, আপনার আমন্ত্রণের জন্য অনেক ধন্যবাদ, মিঃ তামাং। কিন্তু আমাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এবার আমি ঘুমোতে যাব। গুডনাইট!

ফিলিপ তামাং নিরাশভাবে উঠে দাঁড়াল। রিভলভারটা ভরে নিল পকেটে। অনিচ্ছকভাবে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, আর-একটু ভেবে দেখুন, যদি আপনি মত পালটান, তা হলে কাল আমাকে জানাবেন। কাল আপনার সঙ্গে আবার দেখা হবে।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা।

ফিলিপ তামাং সন্তুর দিকে হাত তুলে বলল, বাই বাই, ওয়ান্ডার বয়!

তারপর ফিলিপ তামাং বেরিয়ে যেতেই সন্তু দরজাটা লক করে দিল।

কাকাবাবু হাঁফ ছেড়ে বললেন, উঃ, নাছোড়বান্দা একেবারে! রিভলভার দেখিয়ে আলাপ করতে আসা, এ আবার কী ধরনের বদ রসিকতা! এই ধরনের লোকদের আমি মোটেই পছন্দ করি না।

ফিলিপ তামাং যেখানে বসে ছিল, তার পাশ থেকে ছাইদানিটা তুলে নিয়ে সন্তু বলল, লোকটা মাত্র কুড়ি-পঁচিশ মিনিটে চারটে সিগারেট খেয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, যারা বেশি সিগারেট খায়, তাদের হাতের দুটো আঙুলে হলদে ছোপ পড়ে যায়। যারা ফরসা, তাদের বেশি বোঝা যায়। তুই ওর হাতের হলদে ছোপ দেখে ধরেছিলি যে, লোকটা বেশি সিগারেট খায়। তাই না?

সন্তু মাথা নাড়ল।

কাকাবাবু বললেন, ওর ফুটবল খেলার কথাটা বলে ওকে খুব চমকে দিয়েছিলি। আর কলকাতায় যখন কয়েক বছর কাটিয়েছে, তখন কিছুটা বাংলা। জানবেই। কিন্তু একটা কথা বলে তুই আমাকে অবাক করেছিস। ওর যে ছোটবেলায় পায়ে চোট লেগেছিল, সেটা তুই কী করে বললি?

সন্তু লাজুকভাবে হেসে বলল, আন্দাজে। পাহাড়ে যারা থাকে, তারা কি ছোটবেলায় একবার না একবার গড়িয়ে পড়ে না?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আর কী করে বুঝলি, ডান পায়ের হাঁটুতে ব্যথা?

সন্তু বলল, আমি অ্যাকসিডেন্টের কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই লোকটা একবার চট করে ডান পায়ের হাঁটুতে হাত রেখেই আবার হাত সরিয়ে নিল। আমি ঠিক দেখে নিয়েছি। হাঁটুটা ধরা দেখেই বুঝলুম, এখনও ব্যথা হয়।

কাকাবাবুও এবার হেসে বললেন, গুড অবজারভেশান! শার্লক হোমসও তো এইরকমভাবে খুঁটিনাটি দেখেই লোককে চমকে দিত। তুই আরও ভাল। করে কোনান ডয়াল পড়, সন্তু। তুইও একটা খুদে শার্লক হোমস হয়ে উঠতে। পারবি মনে হচ্ছে!