০১. সন্তু তার কুকুরটাকে নিয়ে বাইরে বেরোতে যাচ্ছে

ভোর সাড়ে পাঁচটার সময় সন্তু তার কুকুরটাকে নিয়ে বাইরে বেরোতে যাচ্ছে, এমন সময় জোজো এসে হাজির। সন্তু তার ভুরু দুটো অনেকখানি ওপরে তুলে বন্ধুর দিকে চেয়ে রইল। অবাক হওয়ার মতনই ব্যাপার। জোজো সাঙ্ঘাতিক ঘুমকাতুরে। সাড়ে আটটা-নটার আগে বিছানা ছেড়ে ওঠেই না।

সে এই সাত সকালে ছুটে এসেছে কেন?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কি রে, বাড়িতে কোনও বিপদ হয়েছে নাকি?

জোজো বলল, বিপদ? আমাদের কক্ষনো কোনও বিপদ হয় না। কোনও বিপদকে আমরা বিপদ বলে গ্রাহ্যই করি না। আমার বাবা তো সব আগে থেকেই টের পেয়ে যান। একবার কী হয়েছিল জানিস? আমরা বেড়াতে গেছি বোমডিলা। ডিসেম্বর মাস, দারুণ শীত। বোমডিলা জায়গাটার বিশেষত্ব হচ্ছে, ওখানে কোনও মশা-মাছি নেই। তবু দ্বিতীয় দিন রাত্তিরে বাবা বললেন, আমাকে মশারি টাঙিয়ে শুতে হবে। ওখানে মশারি পাওয়া যায় না, কখনও দরকারই হয় না। তবু বাবা জোর করতে লাগলেন, অতিকষ্টে একটা মশারি জোগাড় হল। সেটা আমার বিছানায় টাঙিয়ে দেওয়া হল। তারপর কী হল বল তো?

সন্তু হাসল। সকালবেলাতেই জোজোর কল্পনাশক্তি বগাছাড়া ঘোড়ার মতন ছুটতে শুরু করেছে। এসব শুনতে সন্তুর ভালই লাগে।

সন্তু বলল, আমি কী করে জানব?

জোজো চোখ বড় বড় করে বলল, সকালবেলা দেখি যে সেই মশারির ওপরে একটা বিষাক্ত সাপ। ফণা তুলে বসে আছে। মশারি না টাঙালে সেটা নিঘাত আমাকে ঘুমের মধ্যে ছোবল মারত। বাবা আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলেন।

সন্তু বলল, খুব শীতের মধ্যে বিষাক্ত সাপ বুঝি ফণা তুলতে পারে?

জোজো বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, বোমডিলার সাপগুলো যে আলাদা, জাতের, তা তুই জানিস না বুঝি? ওরা কালনাগিনীর বংশধর!

সন্তুর কুকুরটা ছটফট করছে। প্রত্যেকদিন এই সময় ওর পার্কে গিয়ে দৌড়নো অভ্যেস। সাদা ধপধপে কুকুর। ওর নাম রকুকু। সন্তু কখনও ওকে চেন দিয়ে বাঁধে না।

রকুকু লাফিয়ে লাফিয়ে সন্তুর জামা ধরে টানছে। বাড়ির দরজা বন্ধ করে রাস্তায় পা দিয়ে সন্তু জোজোকে জিজ্ঞেস করল, তা হলে মহাশয়ের এই অসময়ে আগমনের কারণ কী তা জানতে পারি?

জোজো বলল, একটা মুশকিলে পড়ে গেছি। পিন হেড মাশরুম কোথায় পাওয়া যায় বলতে পারিস, সন্তু?

পিন হেড মাশরুম, সে আবার কী জিনিস?

সকাল সাতটার মধ্যে জোগাড় করতেই হবে। না হলে ব্রেকফাস্টের টাইম পেরিয়ে যাবে। তারপর আর উনি কিছু খাবেন না!

উনি মানে কিনি?

সাইমন বুবুম্বা। তিনি তো আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে আছেন, কাল সন্ধেবেলা থেকে। চুপ, কাউকে যেন বলিসনি। খুব গোপন ব্যাপার।

কাকে বলব! উনি কে তাই-ই তো আমি জানি না।

তুই সাইমন বুবুম্বার নাম শুনিসনি? আফ্রিকার একটা খুব বড় রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। ওঁর এত ক্ষমতা যে গাদ্দাফি আর সাদ্দাম হোসেনকে যখন-তখন ধমক দিতে পারেন। আফ্রিকার ওই দেশটায় সোনার খনি আছে তো, তাই টাকা-পয়সার শেষ নেই। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সাহেবের একটাই দুঃখ, তাঁর কোনও ছেলে নেই। তাই আমার বাবার কাছে এসেছেন কুষ্ঠি দেখাতে। ওঁর তো এমনিতেই সাতাশটা বউ। আর একটা বিয়ে করলে ছেলে হবে কি না জানতে চান।

সন্তু শুনেছে যে, জোজোর বাবা একজন খুব বড় জ্যোতিষী। পৃথিবীর বড় বড় বিখ্যাত লোকেরা নাকি তাঁর কাছে হাত দেখাতে আর ভাগ্য গণনা করতে আসেন। সন্তু অবশ্য তাঁদের একজনকেও এ-পর্যন্ত চোখে দেখেনি।

সন্তু বলল, আফ্রিকার একটা দেশের প্রেসিডেন্ট গোপনে এসে তোদের বাড়িতে রয়েছেন, এই তো! তার জন্য তোকে সকালবেলায় ছুটোছুটি করতে হবে কেন?

জোজো বলল, ওই যে বললুম পিন হেড মাশরুম! প্রেসিডেন্ট সাহেব ব্রেকফাস্টের সময় চারখানা ডিমের ওমলেট ছাড়া কিছু খান না। সেই ওমলেটে থাকবে রসুন আর মাশরুম। তাও যে-কোনও মাশরুম হলে চলবে না।

মাশরুম বুঝি অনেক রকম হয়?

হয় না? একরকম হয় ছাতার মতন। তাই বাংলায় এর নাম ব্যাঙের ছাতা। আর একরকম আছে কোটের বোতামের মতন, তার নাম বাটুন মাশরুম। আর একরকম খুবই ছোট, আলপিনের ডগার মতন। প্রেসিডেন্ট সাহেব সেই মাশরুম ছাড়া খাবেন না।

সে কি আমাদের দেশে পাওয়া যায়?

বাবা তো বলে বসলেন, হ্যাঁ পাওয়া যায়। আমাকে বললেন, যা খুঁজে নিয়ে আয়।

কোথায় খুঁজবি?

একবারটি কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস কর না। উনি নিশ্চয়ই জানেন। কাকাবাবু সব জানেন।

দুঃখিত, জোজো। এই সময়ে আমি কাকাবাবুর ঘুম ভাঙিয়ে এরকম একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করতে পারব না। কোন দোকানে কী পাওয়া যায়, কাকাবাবু সেসব খবর কিচ্ছু রাখেন না। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, সুন্দরবনের মধু কোথায় পাওয়া যায় রে, নিউ মার্কেটে?

ঠিক বলেছিস, নিউ মার্কেট! ওখানে নাকি বাঘের দুধ, হাতির দাঁত, ময়ূরের পালক, হরিণের শিং, সব পাওয়া যায়। তা হলে কি আর সবরকম ব্যাঙের ছাতা পাওয়া যাবে না? চল সন্তু, চট করে একবার নিউ মার্কেট ঘুরে আসি।

রকুকু অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল, সন্তু শিস দিয়ে তাকে কাছে ডাকল।

তারপর বলল, আমি রকুকুকে নিয়ে বেড়াতে যাচ্ছি, এখন নিউ মার্কেট যাব কী করে? তা ছাড়া এত সকালে কি নিউ মার্কেট খোলে?

জোজো বলল, ট্রাম চলতে শুরু করেছে, আমরা ট্রামে যাব। এইসব দোকান ভোরবেলাতেই খুলে যায়।

সন্তু তবু অনিচ্ছার সঙ্গে বলল, কুকুর নিয়ে ট্রামে উঠতে দেবে না।

জোজো বলল, আলবাৎ দেবে! এখন বেশি ভিড় হয় না।

তারপর সন্তুর কানের কাছে মুখ এনে বলল, কেন তোর সাহায্য চাইছি, জানিস? আমার পেছনে স্পাই ঘুরছে। ওই দ্যাখ না বড় রাস্তার মুখে একজন দাঁড়িয়ে আছে।

সন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, কেন, তোর পেছনে স্পাই ঘুরবে কেন?

জোজো বলল, প্রেসিডেন্ট বুবুম্বা সাহেবের যে অনেক শত্রু। তারা এ-পর্যন্ত ধাওয়া করে এসেছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট সাহেব যে কোথায় উঠেছেন, তা এরা এখনও জানে না।

সন্তু দূরের লোকটির দিকে একবার তাকাল। গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে একজন বড় গোঁফওয়ালা লোক একটা ল্যাম্প পোস্টে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটিকে বাঙালি বলে চেনা যায়। আফ্রিকার একজন প্রেসিডেন্টের জন্য বাঙালি স্পাই কেন জোজোর পেছনে ঘুরবে তা বুঝতে পারল না সন্তু। তবে, জোজোর কথা সে সম্পূর্ণ অবিশ্বাসও করতে পারল না। এত ভোরে কষ্ট করে উঠে এসে কি জোজো নিছক একটা মিথ্যে গল্প বানাবে?

ওরা এগিয়ে গেল ট্রাম স্টপের দিকে।

ঠন-ঠন করতে-করতে একটা ট্রাম এল একটু বাদেই। যাত্রী মাত্র কয়েকজন। গত দুদিন খুব বৃষ্টি হওয়ার দরুন এই গ্রীষ্মকালের সকালেও শীত-শীত ভাব আছে বলে বেশি লোক রাস্তায় বেরোয়নি।

রকুকুকে কোলে তুলে নিয়ে ট্রামে উঠে পড়ল সন্তু আর জোজো। সেই গোঁফওয়ালা লোকটিও উঠল ওদের পেছন পেছন।

জোজো সন্তুর দিকে চোখের ইঙ্গিত করল।

সন্তু ভাবল, এমনও তো হতে পারে, লোকটি ট্রামের জন্যই অপেক্ষা করছিল।

ওরা বসতে না বসতেই ট্রাম-কন্ডাক্টর কাছে এসে বলল, এ কী, না, না। কুকুর নিয়ে যাওয়া চলবে না।

জোজো বলল, আমরা কুকুরেরও টিকিট কাটব।

কন্ডাক্টর বলল, টিকিট কাটতে হবে না। তোমরা নেমে যাও!

অন্য যাত্রীরা মুখ ফিরিয়ে রকুকুকে দেখছে।

গোঁফওয়ালা লোকটি বলল, যাক না। বেশ তো সুন্দর কুকুর।

কন্ডাক্টর বলল, চলবে না। নেমে পড়ো। আমি কুকুর দেখলেই ভয় পাই। একবার আমাকে কুকুর কামড়েছিল, আর চোদ্দটা ইঞ্জেকশান নিতে হয়েছিল।

সন্তু বলল, আমার কুকুর অকারণে কাউকে কামড়ায় না!

এই সময় রকুকু ছটফটিয়ে সন্তুর কোল থেকে নেমে পড়ল লাফিয়ে। তারপর সে চলন্ত ট্রামের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল।

কন্ডাক্টরটি একটা সিটের ওপর দাঁড়িয়ে উঠে, ভয়ে চোখ কপালে তুলে চ্যাঁচাতে লাগল, ওরে বাবা, আমাকেই কামড়াবে, আবার চোদ্দটা ইঞ্জেকশান!

সন্তু আর জোজো সিট ছেড়ে ধরবার চেষ্টা করল রকুকুকে। গোঁফওয়ালা লোকটাও জিভ চুকচুক করে বলতে লাগল, আয় আয়, এদিকে আয়—

কেউ রকুকুকে ধরতে পারছে না, সে ফুড়ত-ফুড়ত করে পালিয়ে যাচ্ছে। সিটের তলায় ঢুকে পড়ল। সব যাত্রীরা তটস্থ!

রকুকু একবার কন্ডাক্টরটির সামনে এসে মুখ তুলে ভুক-ভুক করে ধমকের সুরে ডাকল, যেন তাকে অপমান করা হয়েছে বলে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

তারপর রকুকু আবার দৌড়ে দরজার কাছে গিয়ে এক লাফে নেমে পড়ল রাস্তায়।

জোজো ট্রাম থামাবার জন্য জোরে-জোরে বেল বাজাতে লাগল। তার মধ্যেই সন্তু লাফিয়ে পড়েছে। আছাড় খেতে খেতে কোনও রকমে সামলে নিয়ে সন্তু শিস দিয়ে ডাকল, রকুকু, রকুকু!

অমনই বেশ শান্তশিষ্ট ভাবে রকুকু সন্তুর কাছে এসে লেজ নাড়তে লাগল।

ট্রামটা একটু দূরে থেমেছে। সেখান থেকে জোজো ছুটে এসে হাসিমুখে বলল, খুব ভাল হয়েছে। খুব ভাল হয়েছে। রকুকু আমাদের বাঁচিয়ে দিল।

সন্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তার মানে?

স্পাইটা নামতে পারেনি! ও আর আমাদের পিছু ধরতে পারবে না!

ও লোকটা সত্যিই স্পাই ছিল?

আলবাৎ! দেখলি না। রকুকুকে ধরবার চেষ্টা করছিল!

স্পাইরা বুঝি কুকুর ধরতে যায়? যাক গে যাক! কিন্তু এখন নিউ মার্কেট অবধি যাওয়া যাবে কী করে? হেঁটে যাওয়া যাবে না। অনেক দূর।

তুই কুকুরটাকে বাড়িতে রেখে চলে এলে পারতি, সন্তু!

রকুকু রোজ সকালে আমার সঙ্গে বেড়াতে যায়। ওকে নিয়ে না গেলে ও ডেকে ডেকে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙিয়ে দিত।

তা হলে এক কাজ করা যাক। ওই দ্যাখ একটা দোতলা বাস আসছে। ওকে লুকিয়ে কোলে নিয়ে আমরা একেবারে দোতলায় উঠে যাব। কন্ডাক্টর দেখতে পাবে না। আর যদি দেখতেও পায়, তার সঙ্গে তর্ক করতে করতে আমরা চলে যাব অনেকখানি। তারপর নেমে পড়ে আমরা আর একটা বাসে। উঠব।

কিন্তু রকুকু যদি বাসের দোতলা থেকে ঝাঁপ দেয়?

এবার ওকে শক্ত করে ধরে থাকব। ওই যে বাস এসে পড়েছে, চল, চল, উঠে পড়ি।

ভোরবেলা প্রথমে ট্রাম চলে। বাস বেরোতে দেরি হয়। কিন্তু একটা দোতলা বাস সত্যিই চলে এসেছে সকাল-সকাল। ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। রাস্তার অনেকের গায়েই সোয়েটার বা শাল জড়ানো। নরম-নীল আকাশ। এখনও ধুলো-ময়লা উড়তে শুরু করেনি, এই সময় কলকাতা শহরটাকে বেশ ভালই দেখায়।

বাস থামতেই রকুকুকে সোয়েটারের মধ্যে চাপাচুপি দিয়ে ওরা দুজনে উঠে গেল দোতলায়। বসল গিয়ে একেবারে সামনে, জানলার কাছে। রকুকুকে রাখল দুজনের মাঝখানে। ওদের পাশের সিটটাতে চাদর মুড়ি দিয়ে বসে আছে। ওদেরই বয়েসী আর একটা ছেলে। তার চোখে গোল চশমা।

সন্তু আর জোজো দুজনেই রকুকুকে চেপে ধরে রাখলেও রকুকু ওই অবস্থায় থাকতে রাজি হবে কেন? সে ছটফটিয়ে দুবার ভুক-ভুক করে ডেকে উঠল!

পাশের সিটের ছেলেটি চোখ গোল-গোল করে এদিকে তাকাল।

জোজো বলল, ওঃ কী শীত, ভররর! ভররর!

রকুকু আরও দুবার ডেকে উঠল।

জোজো বলল, সন্তু, তুই সেই গানটা জানিস, হেমো গয়লার গান…। উত্তর পাওয়ার আগেই সে নিজে গানটা গেয়ে উঠল :

হেমো গয়লার ছিল যে এক চাষাবাড়ি
চাষা-বাড়ি-ই-ই-ই
সেথায় ছিল মস্ত বড় একটা কুকুর পাল
হেথায় করে ঘেউ ঘেউ, হোথায় করে ভুক ভুক
হেথায় ঘেউ, হোথায় ভুক
ভুক ভুক ভুক ভুক ভুক
হেমমা গয়লার ছিল যে এক…

গানটা শেষ হতেই পাশের সিটের চশমা-পরা ছেলেটা এক গাল হেসে বলল, তোমরা বুঝি একটা কুকুর লুকিয়ে নিয়ে যাচ্ছ?

জোজো সঙ্গে-সঙ্গে না বলতে যাচ্ছিল, সন্তু বলল, হ্যা! ধরা পড়ে গেলি রে, জোজো। তোর গানটা কোনও কাজে লাগল না।

চশমা-পরা ছেলেটি বলল, আমিও রোজ নিয়ে যাই। এই দ্যাখ না!

গায়ের চাদর সরিয়ে সে একটা সুন্দর, ছোট্ট কুকুর দেখাল। সেই কুকুরটা কুঁই-কুঁই করে ডেকে উঠল।

অন্য কুকুরের সাড়া পেতেই রকুকু পিঠ উঁচু করে বেরোবার চেষ্টা করে ডেকে উঠল ভু-ভু-ভু-ক! ভু-ভু-ভু-ক!

দুটো কুকুরে শুরু হয়ে গেল ডাকাডাকি প্রতিযোগিতা।

পেছন দিকের একজন যাত্রী বিরক্ত হয়ে বলল, এ কী, বাসের মধ্যে এত কুকুরের ডাক শুরু হয়ে গেল কী করে? সক্কালবেলা একটু নিশ্চিন্তে ভগবানের নাম করারও উপায় নেই!

আর একজন যাত্রী বলল, বাড়িতে কুকুর, রাস্তায় কুকুর, আবার বাসের মধ্যেও কুকুর? ওঃ, আর পারা যায় না!

কন্ডাক্টর নীচে ছিল, এবার উঠে এল ওপরে। একেবারে সামনের দুটো সিটের মাঝখানে গাট হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কী, ব্যাপারটা কী?

কুকুর দুটোকে আর গোপন করার উপায় নেই। তারা ডেকেই চলেছে!

পেছনের দুজন যাত্রী বলল, ও কন্ডাক্টর দাদা, নামিয়ে দিন, ওদের নামিয়ে দিন?

কন্ডাক্টর বলল, হ্যাঁ, কুকুর নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই! নেমে যেতে হবে।

জোজো বলল, নিয়মটা কোথায় লেখা আছে, একবার দেখান তো!

কন্ডাক্টর বলল, নিয়ম দেখাতে হবে? তার আগে কুকুরটা দেখি তো ভাল করে?

নিচু হয়ে রকুকুর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, বাঃ, এ তো ভাল জাতের কুকুর। কী সুন্দর। আমার নিজের দুটো কুকুর আছে।

তারপর সন্তুর চোখে চোখ রেখে বন্ধুর মতন ভঙ্গিতে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কত দূর যাবে ভাই?

সন্তু বলল, নিউ মার্কেট।

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অন্য যাত্রীদের শুনিয়ে বলল, না। কুকুর নিয়ে তো বাসে চাপা যায় না। আচ্ছা ভাই, তোমাদের এই কুকুরটার বয়েস কত?

সন্তু বলল, আড়াই বছর।

কন্ডাক্টর বলল, ওঃ, বাচ্চা কুকুর! আমাদের নিয়ম হচ্ছে চার বছর বয়েস ছয়ে গেলে সে কুকুরকে বাসে তোলা যায় না। তার কম বয়েস হলে কোলে দুরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আচ্ছা, কুকুরটা লম্বায় কতখানি?

সন্তু কখনও মেপে দেখেনি, আন্দাজে বলল, এক ফুটের মতন হবে!

কন্ডাক্টর বলল, বাঃ, দেড় ফুট হয়ে গেলে সে কুকুর নট অ্যালাউড। এক ফুট পর্যন্ত চলতে পারে।

চশমা-পরা ছেলেটি বলল, আমার কুকুর তার চেয়েও ছোট। বয়েস মাত্র দেড় বছর! আর দশ ইঞ্চি হাইট।

কন্ডাক্টর বলল, তা হলে তোমরা স্বচ্ছন্দে নিয়ে যেতে পারো। এত ছোট তো কুকুর হয় না, কুকুরের বাচ্চা!

জোজো চেঁচিয়ে বলে উঠল, ঠিক, ঠিক। আমার বড়মামা ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার, তাঁর কাছ থেকে আমি আগেই জেনে নিয়েছি।

পেছন থেকে একজন রাগী গলায় বলল, এ রকম অদ্ভুত নিয়ম আমরা তো কখনও শুনিনি। এক ফুট কুকুর তোলা যাবে আর দেড় ফুট তোলা যাবে না! যত সব বাজে কথা।

আর-একজন বলল, এই যে কন্ডাক্টর দাদা, কুকুর সুষ্ঠু ওদের নামিয়ে দিন।

কন্ডাক্টর বলল, আমাকে তো নিয়ম মেনে চলতে হবে। নিয়মের বাইরে আমি যেতে পারি না!

রাগী লোকটি বলল, ঘোড়ার ডিমের নিয়ম! কুকুরের বয়েস বোঝা যায় নাকি? আমি যদি বলি, ওই কুকুরটার বয়েস তিন বছর নয়, দশ বছর!

চশমা-পরা ছেলেটি বলল, খবদার, আপনি আমার কুকুরের বয়েস বাড়াবেন না।

জোজো বলল, আমার ছোটকাকা ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার। তিনি এই নিয়ম বানিয়েছেন। আপনি ঘোড়ার ডিমের নিয়ম বলে তাঁকে অপমান করতে পারেন না!

অন্য একজন বলল, এই যে একটু আগে বললে তোমার বড় মামা ট্রান্সপোর্ট মিনিস্টার? এর মধ্যে সে ছোটকাকা হয়ে গেল?

জোজো সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিল, আমার বড় মামাকে তাঁর পাড়ার ছেলেরা ছোটকাকা বলে ডাকে, তাই আমিও মাঝে-মাঝে বলে ফেলি!

কন্ডাক্টর হাত তুলে বলল, আস্তে আস্তে! আপনারা একটু চুপ করে বসুন। নীচের তলায় আমার পার্টনার আছে, তার কাছ থেকে আমি ভাল করে নিয়মটা জেনে আসছি।

কন্ডাক্টর ধুপধাপ করে নেমে গেল নীচে।

কয়েকজন যাত্রী রাগে গজগজ করতে লাগল। কিছু যাত্রী এ সব ব্যাপারে মাথা না গলিয়ে জানলা দিয়ে চেয়ে রইল বাইরের দিকে। জোজো আর। চশমা-পরা ছেলেটি হাসতে লাগল মিটিমিটি। দু দিকের দুটো কুকুর ভুক-ভুক আর কুঁই কুঁই করে ডেকেই চলল!

কন্ডাক্টর আর আসেই না!

সেই রাগী যাত্রীটি কিছুক্ষণ পরে অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ডাকল ও কন্ডাক্টর দাদা, কী হল, আপনার পার্টনারকে খুঁজে পাচ্ছেন না?

কন্ডাক্টর আবার সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে এসে বলল, হ্যাঁ। ওদের নেমে যেতে হবে। নেমে যাও ভাই তোমরা। নিউ মার্কেট এসে গেছে। নিউ মার্কেট!

জোজো আর সন্তু রকুকুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। সিঁড়ির দিকে যেতে-যেতে রাগী লোকটির দিকে এক ঝলক হাসি ছুড়ে দিল জোজো।

সন্তু কন্ডাক্টরকে বলল, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! চশমা-পরা ছেলেটিও নেমে এসেছে ওদের সঙ্গে সঙ্গে। সে বলল, আমিও এই কাছেই একটা বাড়িতে যাব।

সন্তু আর জোজো নিউ মার্কেটের কাছে এসে দেখল সব বন্ধ। মেইন গেটে তালা। শুধু বাইরের দিকের এক কোণে কয়েকটা ফুলের দোকান খুলেছে।

জোজো বলল, যাঃ, কী হবে? আমাকে যে সাতটার মধ্যে জিনিসটা নিয়ে পৌঁছতেই হবে?

সন্তু বলল, তা হলে চল ওই ফুলের দোকানগুলোতে জিজ্ঞেস করি। ওরা হয়তো বলতে পারবে, পিন হেড মাশরুম কোথায় পাওয়া যায়।

জিনিসটা সরু-সরু দেশলাই কাঠির মতন। কচ কচ করে কাঁচাই চিবিয়ে খেতে হয়।

তুই খেয়েছিস?

বাবার সঙ্গে যেবার আফ্রিকা গিয়েছিলাম, তখন কত খেয়েছি। ওগুলো খেলে গায়ে দারুণ জোর হয়। সেইজন্যেই তো আমি এক ঘুষিতে একটা নারকোল ফাটিয়ে দিতে পারি।

পারিস?

তুই একটা নারকোল নিয়ে আয়, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি?

এই সকালবেলা আমি নারকোল কোথায় পাব, জোজো?

ঠিক আছে, তোর সঙ্গে চ্যালেঞ্জ রইল, সন্তু। তোকে আমি নারকোল ফাটিয়ে দেখিয়ে দেব।

সন্তু ফুলের দোকানটার দিকে এগিয়ে গেল।

এত সকালেই এরা এত ফুল কী করে জোগাড় করে কে জানে! দোকান ভর্তি নানারকম ফুল। কতরকম গোলাপ! উঁই, রজনীগন্ধা, স্থলপদ্ম। আরও এমন ফুল আছে, সন্তু সেগুলোর নাম জানে না। দুজন লোক বড় বড় বালতি ভর্তি জলে ফুলগুলো ডোবাচ্ছে, কাঁচি দিয়ে ডাল ছাঁটছে, আর একজন রং-তুলি নিয়ে লাল গোলাপকে বেশি লাল করছে।

এখনও গাড়ি-ঘোড়া চলতে শুরু করেনি, নিউ মার্কেটের সামনেটা একেবারে ফাঁকা। রকুকু মনের আনন্দে সেখানে ছোটাছুটি করতে লাগল।

সন্তু একজন দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের কাছে ব্যাঙের ছাতা আছে?

দোকানদারটি গম্ভীরভাবে বলল, এটা ছাতার দোকান নয়, ফুলের দোকান।

সন্তু বলল, আমি ছাতা বলিনি। ব্যাঙের ছাতা। ব্যাঙের ছাতাকেও একরকম ফুল বলা যেতে পারে।

দোকানদারটি মুখ ভেংচি কেটে বলল, মোটেই না! এঃ, সক্কালবেলা ব্যাঙের ছাতার নাম শুনলেই খারাপ লাগে!

জোজো বলল, আর একটা ফুলগাছের নাম বাঁদরলাঠি!

দোকানদারটি বলল, এখান থেকে যাও তো ভাই, বিরক্ত কোরো না।

জোজো ওপরের দিকের এক গোছা ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ওগুলো কী? পিংক রজনীগন্ধা মনে হচ্ছে।

দোকানদার বলল, না, ওগুলো অন্য ফুল!

জোজো বলল, আলবাৎ পিংক রজনীগন্ধা! আমি ফুল চিনি না? জানিস সন্তু, এগুলো খেতে দারুণ লাগে। পিন হেড মাশরুম যখন পাওয়া যাচ্ছে না, তখন এতেই চলবে। আমাদের ওই প্রেসিডেন্ট এই পিংক রজনীগন্ধা খেতেও খুব ভালবাসেন। এতেও আমার কাজ হয়ে যাবে।

জোজো হাত বাড়িয়ে সেই ফুলের খানিকটা ছিঁড়ে নিয়ে কচ কচ করে চিবিয়ে বলল, বাঃ, খুব টাটকা। স্বাদও ভাল। সন্তু, একটু খেয়ে দেখবি নাকি?

সন্তু বলল, না, না।

জোজো দোকানদারকে জিজ্ঞেস করল, এই এক ডজন ফুল কত দাম?

দোকানদার বলল, ও ফুল বিক্‌কিরি হবে না!

জোজো বলল, কেন?

দোকানদার বলল, যারা ফুল খায়, তাদের আমরা ফুল বিক্‌কিরি করি না!

জোজো বলল, ইল্লি আর কী! আমি দাম দিলে আপনি বিক্রি করবেন না কেন? কেনার পর আমি সে ফুল দিয়ে পুজো করি কিংবা খেয়ে ফেলি, তাতে আপনার কী?

দোকানের অন্য একজন লোক বলল, সকালবেলা প্রথম খদ্দের ফেরাতে নেই। তাতে অকল্যাণ হয়। ঠিক আছে, এক ডজন ফুল নিয়ে যান, দশ টাকা দিন।

জোজো বলল, অত দাম? মোটেই না। পাঁচ টাকা দিতে পারি।

লোকটি বলল, এ ফুল অত শস্তা নয়। প্রথম খদ্দের, তাই শস্তায় দিচ্ছি। আট টাকা লাগবে। তার কমে হবে না।

জোজো বলল, তা হলে আমি চার টাকা দেব।

অ্যাঁ! এই যে বললেন পাঁচ টাকা দেবেন?

দোকানদার যা দাম বলবে, তার আদ্ধেক দেব, এই আমার নিয়ম!

প্রথমে পাঁচ টাকা বলেছিলেন, পাঁচ টাকাই দিন অন্তত।

তা হলে আমি আড়াই টাকা দেব।

ওরে বাবা, প্রথম খদ্দের নিয়ে এত ঝামেলা…আপনাকে..আপনাকে আমি বিনা পয়সায় দিচ্ছি, যান, নিয়ে যান।

বিনা পয়সায় দিলে আমাকে দু ডজন দিতে হবে!

ওরে বাবারে, আজ যে কার মুখ দেখে উঠেছি, দিনটা কী সাঙ্ঘাতিক যাবে, সকালবেলাতেই এত লোকসান, হায় রাম, হায় রাম, প্রথম খদ্দের, যান, দু ডজনই নিয়ে যান, কিছু দিতে হবে না। আর কিছু চাইবেন না তো?

সন্তু জোজোর দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে।

জোজো এবার একগাল হেসে ফেলে বলল, আমার বন্ধু রাগ করছে। আমি বিনা পয়সায় কারও কাছ থেকে কিছু নিই না। মরদ কা বাত, হাতি না দাঁত! প্রথমে পাঁচ টাকা বলেছি, দিচ্ছি পাঁচ টাকা, এক ডজন দিন!

ফুল হাতে নিয়ে সে-দোকান থেকে খানিকটা দূরে সরে এসে জোজো বলল, মাশরুমের বদলে বেশ ভাল জিনিসই পাওয়া গেল। পিংক রজনীগন্ধা। স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব ভাল। এই ফুলের একটা আমি খাব, একটা বাবা খাবেন। আর বাকি দশটা প্রেসিডেন্ট সাহেব খেয়ে ফেলবেন ডাঁটা সুষ্ঠু। কী তাড়াতাড়ি যে উনি খেয়ে ফেলবেন, তুই কল্পনাই করতে পারবি না, সন্তু।

সন্তু বলল, জোজো, আমি তোর বাড়িতে এখন যাব? এত ফুল একজন মানুষ কী করে খেতে পারে, একবার দেখব!

জোজো চোখ কপালে তুলে বলল, ভেরি সরি, এখন কাউকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া বারণ। প্রেসিডেন্ট সায়ে যে আমাদের ওখানে আছেন, সেটা টপ সিক্রেট। তুই যেন মুখ ফসকে কাউকে বলে ফেলিস না!