০৬. এক ঘন্টা বাদেই ফিরে এলেন কাকাবাবু

ঠিক এক ঘন্টা বাদেই ফিরে এলেন কাকাবাবু।

সন্তু ইজিচেয়ারে শুয়ে একটা বই পড়ছে। দরজাটা ভেজানো। দরজার বাইরে শোনা গেল তিন-চারজন লোকের গলার আওয়াজ। তারা খাতির করা সুরে বলছে, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না, সার। আমাদের একজন লোক সব সময় এখানে থাকবে। আপনার জন্য গাড়ি রেডি থাকবে।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আমার কিছু লাগবে না এখন। গুড নাইট।

সন্তু প্রথমে পুলিশ দেখে একটু চমকে উঠেছিল। পরে সে কাকাবাবুর সঙ্গে থানায় যেতে চেয়েছিল এই মজাটাই দেখার জন্য। যে পুলিশ দুজন এসেছিল, তারা কাকাবাবুকে চেনে না। কিন্তু থানায় গেলে এস. পি. কিংবা বড় অফিসাররা কাকাবাবুর পরিচয় পেলেই তাঁদের ব্যবহার বদলে ফেলবেন।

কাকাবাবু ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি বন্ধ করে দিতেই সন্তু বলল, আমি দুটো জিনিস জেনে গেছি।

কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি? তুই কী কী জেনেছিস শুনি?

সন্তু বলল, আমরা গোপালপুরে না এসে আসামের হাফলঙে চলে গিয়েছিলাম। পার্কে একটা লোক তোমাকে পাখির রহস্যের কথা বলে তোমার মন ভুলিয়ে দিয়েছিল। আসলে লোকটির মতলব ছিল তোমাকে এই সময় গোপালপুরে আসতে না দেওয়া।

কাকাবাবু বললেন, এটা ঠিক ধরেছিস। আমি যে পাখি ভালবাসি, তাও খবর রেখেছে লোকটা। অন্য কোনও রহস্যের কথা বললে কিংবা আমাকে কোনও তদন্তের ভার দিতে চাইলে আমি কিছুতেই যেতে চাইতাম না। জাটিংগার পাখিদের কথা বলল, আরও বলল, পরের দিনই একটা গাড়ি যাচ্ছে, আসামে, তাই চলে গেলাম।

সন্তু বলল, ঠিক সেই সময় আমাদের এই বাংলোর পাশের ঘরে আর একজন ভদ্রলোক থাকতেন। সেই ভদ্রলোককে কারা যেন ধরে নিয়ে গেছে। যারা এই কাজটা করেছে তারা তোমাকে ভয় পায়। তুমি এখানে উপস্থিত থাকলে তারা সেই ভদ্রলোককে চুরি করতে পারত না, সেই জন্য তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। কাকাবাবু বললেন, তুই এটা জানলি কী করে? আগেরটা তবু আন্দাজ করা যায়।

সন্তু বলল, এই বাংলোর একজন বেয়ারা আমাদের ঘরে এসেছিল জল দিতে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে পড়ল। সেই বলল, আমাদের পাশের ঘর থেকে একজন লোক রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে গেছে কয়েকদিন আগে। তখনই আমি দুই আর দুইয়ে চার করে নিলাম। লোকটি যেদিন নিরুদ্দেশ হল সেইদিন আমাদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল আসামে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। শুধু তাই নয়, আসামে আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, আমাদের পাশের ঘরে কে ছিল জানিস? রঘুবীর পদ্মনাভন! বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। ব্যাঙ্গালোরে এক সময় আমরা পাশাপাশি থাকতাম। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। সেই পদ্মনাভনকে পাওয়া যাচ্ছে না। ঘরের মধ্যে ওর সব জিনিসপত্র পড়ে আছে, এমনকী টেবিলের ওপর ওর ডায়েরির খাতাটাও খোলা, কিন্তু সে নেই। খবরের কাগজে দু-তিনদিন ধরে এসব খবর বেরুচ্ছে, কিন্তু আমরা কিছু জানতে পারিনি। শিলচর থেকে প্লেনে আসবার সময় কাগজ পড়েই আমি বুঝতে পারলাম, কেন আসামে টেনে নিয়ে খাদের মধ্যে আমাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আমি আর পদ্মনাভন একই সময় পাশাপাশি ঘরে থাকলে দুজনে আড্ডা দিতাম। তা হলে কি আর কেউ তাকে ঘর থেকে চুরি করে নিয়ে যেতে পারত?

সন্তু বলল, কিন্তু একজন বৈজ্ঞানিককে চুরি করে নিয়ে গিয়ে কার কী লাভ হবে?

কাকাবাবু বললেন, অনেকের অনেকরকম মতলব থাকতে পারে। পদ্মনাভন খুব নামকরা বৈজ্ঞানিক, প্রতিভাবান। কিন্তু খানিকটা উদ্ধত আর অহঙ্কারী ধরনের। কড়া কড়া কথা বলে। দুঃসাহসী। এই ধরনের মানুষের শত্রু থাকা স্বাভাবিক।

সন্তু বলল, যারা এই কাণ্ডটা করেছে, বোঝাই যাচ্ছে, তারা বেশ একটা বড় দল। তা হলে নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এরা কি বিদেশি স্পাই?

কাকাবাবু বললেন, সেব্যাপারটা এখনও ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না। রাত্তিরবেলা দরজা-জানলা ভাল করে বন্ধ করে শুতে হবে, সন্তু। আমাদের ওপর আবার আক্রমণ হতে পারে। যদিও পুলিশ নজর রাখছে বাড়িটার ওপর, তা হলেও নিজেদের সাবধান থাকা দরকার। পদ্মনাভন উধাও হওয়ার পর পুলিশ আর কারুকে এখানে থাকতে দিচ্ছে না এখন। আমাদের আগে থেকে রিজার্ভেশান ছিল বলে ঢুকে পড়েছি।

সন্তু বলল, পুলিশ তাই প্রথমে আমাদের সন্দেহ করেছিল।

কাকাবাবু বললেন, পুলিশের বড় বড় কর্তারা সব এখন এখানে এসেছে। ডি. আই. জি. পট্টনায়ক আমাকে খুব ভাল চেনে। সন্তু, তুই কিন্তু একা-একা একদম বাইরে বেরুবি না।

সন্তু ঘাড় নেড়ে আবার বলল, একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না। বেয়ারাটি বলছিল, এখানে নাকি কিছুদিন আগে আকাশ থেকে একটা তারা খসে পড়েছিল। তার সঙ্গে পদ্মনাভনের উধাও হওয়ার সম্পর্ক আছে? তারা খসে পড়ার ব্যাপারটা আবার কী?

কাকাবাবু বললেন, সেটাই তো আসল ব্যাপার।

কাকাবাবু গায়ের শার্ট আর জুতো-মোজা খুলে ফেললেন। ব্যাগ থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি আর তোয়ালে বের করে বললেন, দাঁড়া, বাথরুম থেকে আসছি। তারপর শুয়ে-শুয়ে বাকিটা আলোচনা করা যাবে। তুই ততক্ষণ সব দরজা-জানলা বন্ধ করে দে। পুলিশের ধারণা, পদ্মনাভনকে যারা চুরি করেছে, তারা এখনও এখানেই রয়ে গেছে।

সন্তু সব বন্ধ করে দিল। তার মনে পড়ল, সে টিনটিনের একটা অ্যাডভেঞ্চার গল্প পড়েছিল, সেটার নাম শুটিং স্টার। আকাশ থেকে বিরাট একটা জিনিস খসে পড়েছিল। তারপর বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে টিনটিন গিয়েছিল সেটা দেখতে। কিন্তু সেটা একেবারে আজগুবি গল্প। গ্রিনল্যান্ডের কাছে সমুদ্রে পড়েও সেটার খানিকটা পাহাড়ের মতন উঁচু হয়েছিল। সেটা এমনই জিনিস যে, তার ওপরে একটা আপেলের বীজ ফেললে সঙ্গে-সঙ্গে আপেল গাছ হয়ে যায়, একটুক্ষণের মধ্যেই তাতে অসংখ্য আপেল জন্মায়। একটা ছোট্ট মাকড়সা হয়ে যায় বিরাট জানোয়ার। এরকম কখনও হতে পারে?

একটু বাদে কাকাবাবু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, আকাশ থেকে কখনও কোনও তারা পৃথিবীতে খসে পড়তে পারে? বেয়ারাটা নিশ্চয়ই বাজে কথা বলেছে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা যেগুলোকে তারা বলি, সেগুলো পৃথিবীতে খসে পড়ে না ঠিকই। সেরকম একটা তারা এসে ধাক্কা মারলে সঙ্গে-সঙ্গে পৃথিবীর বারোটা বেজে যাবে। তবে আকাশ থেকে কিছু-কিছু জিনিস পৃথিবীতে খসে পড়ে, এটা তো ঠিক! যেমন দেখলি না জাটিংগার পাখিগুলো? অম্বরের ধারণা, একদিন একটা সোনার পাখিও পড়বে!

কাকাবাবু হেসে ফেলতেই সন্তু বলল, ওগুলো নিশ্চয়ই আকাশ থেকে খসে পড়ে না। অন্য কোনও জায়গা থেকে উড়ে আসে।

কাকাবাবু বললেন, আচ্ছা, পাখির কথা থাক। আকাশ থেকে শিলাবৃষ্টি হয়, তা তো মানবি? শিলাবৃষ্টি বললে সাধারণত বৃষ্টির সময় বরফের টুকরো পড়ার কথা বোঝায়, কিন্তু কখনও কখনও পাথরের টুকরোও পড়ে।

সন্তু বলল, সে তো জানি। মিটিওর।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক হল না, মিটিওর আর মিটিওরাইট, এই দু ভাগে ওদের ভাগ করা যায়। বাংলায় ওদের আলাদা নাম নেই। সবগুলোকেই বলে উল্কা। এই উল্কাগুলো হচ্ছে ছোট-বড় নানা ধরনের পাথর কিংবা ধাতুর টুকরো, যেগুলো আকাশে ঘুরে বেড়ায়। রাত্তিরবেলা অনেক সময় দেখা যায় আকাশে একটা আলোর রেখার মতন একদিক থেকে অন্যদিকে ছুটে যাচ্ছে, তখন ছুটন্ত তারার মতনই মনে হয়। অনেকগুলো আবার নীচের দিকে নেমে আসে।…

এত জোরে এই উল্কাগুলো ছোটে, কত জোরে জানিস, প্রতি সেকেন্ড ষাট, সত্তর, আশি কিলোমিটার পর্যন্ত বেগে, পৃথিবীর আবহাওয়ার সঙ্গে ঘষা লাগলেই ওরা আগুন হয়ে জ্বলে ওঠে, তাতেই গলে-পুড়ে ছাই কিংবা ধোঁয়া হয়ে যায়। সব আমরা চোখেও দেখতে পাই না। প্রতিদিন নাকি কয়েক কোটি উল্কা এরকম পৃথিবীর হাওয়াতে এসে ছাই হয়। বৃষ্টির সঙ্গে ধুলোবালি হয়ে মেশে। কিন্তু কোনও-কোনওটা বেশ বড় টুকরো হলে পৃথিবীতে পড়ে। সেগুলোকে বলে মিটিওরাইট।

সন্তু বলল, তা হলে সত্যি-সত্যি আকাশ থেকে কিছু পৃথিবীতে খসে পড়ে?

কাকাবাবু বললেন, পড়ে তো বটেই। হঠাৎ দুম করে একটা মিটিওরাইট এসে পড়াটা অসম্ভব কিছু নয়। মাঝে-মাঝে পড়েছে একরম। এ-পর্যন্ত সবচেয়ে বড় যেটাকে পাওয়া গেছে, সেটার ওজন ৬০ টন! কত বিশাল বুঝতে পারছিস? কোনও একটা মিটিং-এর ওপর পড়লে শত-শত লোক মারা যেত। সেটা অবশ্য পড়েছিল আফ্রিকার জঙ্গলে। আমেরিকার আরিজোনাতেও এরকম একটা মিটিওরাইট বা উল্কা বহুকাল ধরে পড়ে আছে। অনেক সময় মাঠের মধ্যে কিংবা পাহাড়ের খাঁজে দেখা যায় একটা পুকুর কিংবা ছোটখাটো হ্রদ। কেউ সেগুলো বানায়নি। খুব সম্ভবত আকাশ থেকে উল্কা পড়ে সেসব জায়গায় গভীর গর্ত হয়ে গিয়েছিল, তারপর বৃষ্টির জলে ভরে গেছে। এই শতাব্দীতেই সাইবেরিয়াতে একটা মস্তবড় উল্কা পড়ে বহু গাছপালা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখানেও সেইরকম একটা মিটিওরাইট পড়েছে?

কাকাবাবু বললেন, সেইরকমই তো শোনা যাচ্ছে। অনেক লোক দেখেছে যে, আকাশ থেকে জ্বলন্ত তারা ছুটে আসছে, সেটা শেষ পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে গেল না। ঝপাং করে সমুদ্রের জলে পড়ল।

কাকাবাবু নিজের খাটে শুয়ে পড়ে গায়ের চাদরটা টেনে দিলেন।

সন্তুর এক্ষুনি শুতে ইচ্ছে করছে না। কাকাবাবুকেও সে কখনও এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে দ্যাখেনি। এমনিতে তাঁর অনেক রাত পর্যন্ত বই পড়া অভ্যেস। তা হলে নিশ্চয়ই এখনও কাকাবাবুর জ্বর আছে।

কাছে এসে সে কাকাবাবুর কপালে হাত দিয়ে দেখল বেশ গরম।

সে বলল, কাকাবাবু, তোমার তো বেশ জ্বর। তুমি কোনও ওষুধ খাবে না?

কাকাবাবু বললেন, না, আর দরকার নেই। আমি বুঝতে পারছি, একটু একটু করে কমছে। এবার আপনি সেরে যাবে। তুই এক কাজ কর, পকেট থেকে রিভলভারটা এনে দে, বালিশের নীচে রাখব। তারপর আলো নিভিয়ে দে।

পাশাপাশি দুটো খাট। মাথার দিকে জানলা। সব দরজা-জানলা বন্ধ থাকলেও শোনা যাচ্ছে সমুদ্রের জলের ঝাপটার শব্দ। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ হচ্ছে। বোধ হয় ঝড় উঠেছে।

ঘর অন্ধকার করে দেওয়ার পর সন্তু শুয়ে পড়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, কাকাবাবু, এই উল্কাগুলো কী দিয়ে তৈরি হয়?

কাকাবাবু বললেন, পাথর। কিংবা লোহা। কখনও কখনও একটু দস্তাও মিশে থাকে। ওগুলো তো পৃথিবীর মতন গ্রহ-ট্ররই টুকরো। এমনিতে ওগুলোর কোনও দাম নেই।

তা হলে ওই একটা উল্কাপাতের সঙ্গে পদ্মনাভনের অদৃশ্য হওয়ার সম্পর্ক কী?

অনেকের ধারণা, ওই উল্কার টুকরোগুলোর মধ্যে সোনা কিংবা প্লাটিনামের মতন কোনও দামি ধাতু থাকতে পারে। তার চেয়েও বড় কথা, কেউ-কেউ মনে করে, ওর মধ্যে এমন একটা কোনও ধাতু পাওয়া যেতে পারে, যা এ-পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। পৃথিবীর কেউ সেরকম ধাতুর কথা জানে না। যদি সত্যিই সেরকম কোনও ধাতু বৈজ্ঞানিকের হাতে পড়ে, তা হলে তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়ে যাবেন!

ও, এই ব্যাপার। কিন্তু এখানকার উল্কাটা তো সমুদ্রের জলে ড়ুবে গেছে?

হ্যাঁ, ড়ুবেই গিয়েছিল। উল্কাটা যখন পড়ে, তখন পদ্মনাভন এখানে ছিল না। সে এসেছিল ভুবনেশ্বরে একটা সেমিনারে বক্তৃতা দিতে। উল্কাটা পড়ার তিনদিন বাদে এখানকার একটা জেলের জালে একটা পাথর ওঠে। গোপালপুরের কাছে সমুদ্র খুব গভীর নয়। এক-এক জায়গায় অনেক দূর পর্যন্ত কোমরজল। মাছ ধরতে গিয়ে একজন জেলে একটা অদ্ভুত ধরনের পাথর পেয়ে গেল। সেটা একটা ফুটবলের ঠিক আদ্ধেকটার মতন। ফুটবলের মতন একটা গোল পাথরকে যদি আধখানা করে কাটা যায়, তার একটা টুকরো যেমন হয়।

সমুদ্রে তো নানারকম পাথর পাওয়া যায়। কী করে বোঝা গেল যে, সেটা একটা উল্কার টুকরো?

তুই ঠিক ধরেছিস। সেটা উল্কার টুকরো হতেও পারে, নাও হতে পারে। তবে সেটাকে দেখলে নাকি মনে হয়, সেটাকে সদ্য ভাঙা হয়েছে। আকাশ থেকে ওইরকম একটা গোল পাথর পড়তে-পড়তে ছোট হয়েছে। শেষ মুহূর্তে দুটুকরো হয়ে একটা টুকরো পড়েছে গভীর সমুদ্রে, অন্যটা কাছাকাছি। মাছ-ধরা জেলেটি ওইরকম একটা টুকরো পাওয়ার পর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও দ্বিতীয় টুকরোটা পায়নি।

জেলেটা কী করে বুঝল, সেটা কোনও দামি জিনিস?

সাধারণ উল্কার টুকরো হলেও সেটা এমন কিছু দামি হত না। কিন্তু সেই জিনিসটার ওপরের দিকটা নাকি সাধারণ পাথরের মতন, কিন্তু ভেতরের দিকটা গাঢ় সবুজ আর খুব ঝকঝকে উজ্জ্বল। অন্ধকারের মধ্যে জ্বলজ্বল করে।

সবুজ পাথর? তা হলে নিশ্চয়ই পান্না!

পান্না? তুই কী করে জানলি যে, পান্না সবুজ হয়?

রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে। আমার চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ, চুনী উঠলো রাঙা হয়ে। এই লাইন দুটো মুখস্থ রাখলেই জানা যায় যে, পান্না হয় সুবজ আর চুনী হয় লাল।

বাঃ, বেশ তো। এটা আমার জানা ছিল না। সবুজ পাথরটা পান্না হতে পারে, আবার অনেক সাধারণ পাথরও সবুজ হয়। তবে আলো পড়লে যদি সত্যিই জ্বলজ্বল করে, তা হলে সেটা পান্না ছাড়াও অন্য কিছু হতে পারে। জেলেটার কাছে সেই পাথর দেখে এখানকার অনেক টুরিস্ট সেটা কিনতে চাইল। ঘর সাজাবার জন্য। কেউ পঞ্চাশ টাকা, কেউ একশো টাকা দাম দিতে চায়। জেলেটা দাম হাঁকল এক হাজার টাকা! অত টাকা কেউ দিতে চায় না। তবু দর উঠতে লাগল। পাঁচশো, সাতশো পর্যন্ত। তারপর এক বড়লোক মাড়োয়ারি বলল, সে এক হাজার টাকাই দেবে। জেলেটা তখন আরও দাম বাড়াল। সে বলল, এক হাজার টাকাতেও সে দেবে না। তার আড়াই হাজার টাকা চাই।

পদ্মনাভন তখন কোথায়?

সে তখনও ভুবনেশ্বরে। এখানে একজন জেলে একটা অদ্ভুত পাথর পেয়েছে যেটা উল্কার টুকরো হতে পারে, এই খবর কয়েকটা কাগজে ছাপা হয়েছিল। সেই খবর পদ্মনাভনের নজরে পড়ে। তখন সে কারুকে কিছু না জানিয়ে ভুবনেশ্বরে চলে আসে। পাথরটার দাম এর মধ্যে আরও বেড়ে গেছে। পদ্মনাভন পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাথরটা কিনে নিল।

এতসব খবর কি তুমি আগে জানতে, কাকাবাবু?

কিছু না। কলকাতার কাগজে কিছু বেরোয়নি। আজই পুলিশের কাছে সব শুনলাম। পুলিশও জেনেছে পরে। একটা জেলে যে একটা অন্যরকম পাথর পেয়েছে, তা নিয়ে অনেক হইচই হচ্ছে, সে ব্যাপারেও পুলিশ মাথা ঘামায়নি। পদ্মনাভন এসেই টপ করে অত দাম দিয়ে পাথরটা কিনে নেওয়ার পর অনেকে জানতে চাইল লোকটি কে? তার পরিচয়টাও বেরিয়ে গেল। যখন লোকে। শুনল যে, একজন অতবড় বৈজ্ঞানিক ছুটে এসে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটা পাথর কিনেছে, তখন সকলেরই কৌতূহল বেড়ে গেল। তা হলে আকাশ থেকে নিশ্চয়ই দারুণ কিছু একটা মাটিতে নেমে এসেছে।

জাটিংগার সেই সোনার পাখির মতন? এটা বেশ মজা না, আমরা আসামে গিয়েছিলাম আকাশ থেকে পড়া পাখি দেখতে, আর সমুদ্রের ধারে এসেও শোনা যাচ্ছে আকাশ থেকে পড়া এক পাথরের কথা!

তাই তো দেখছি রে!

তারপর কী হল?

পদ্মনাভন পাথরটা কেনার পর তা নিয়ে নানারকম গুজব ছড়াতে লাগল। সত্যি-মিথ্যে অনেক কাহিনী ছাপা হতে লাগল এখানকার কাগজে। বোম্বের টাইমস অব ইন্ডিয়া কাগজেও উল্কাপাথরে নতুন ধাতু? এইরকম একটা খবর বেরুল। এতদিনে টনক নড়ল এখানকার পুলিশের। আকাশ থেকে সত্যিই যদি কোনও সোনার পাখি কিংবা দামি পাথর খসে পড়ে, তবে তার মালিক হবে গভর্নমেন্ট। মাটির তলা থেকে কিছু পাওয়া গেলেও একই নিয়ম। পুলিশ এসে পদ্মনাভনকে বলল সেই পাথরটা থানায় জমা দিতে। কিন্তু ছোটখাটো পুলিশ অফিসারকে পদ্মনাভন পাত্তা দেবে কেন? সে যেমন খামখেয়ালি, তেমনই বদমেজাজি। পুলিশদের ধমক দিয়ে সে বলল, সে নিজেই সরকারের লোক। তার কাছে পাথরটা থাকা মানেই গভর্নমেন্টের কাছে থাকা। কথাটা মিথ্যে নয়। সে ব্যাঙ্গালোরের একটা সরকারি বিজ্ঞান সংস্থার হেড। ধমক খেয়ে পুলিশ চলে গেল বটে, কিন্তু এই বাংলোর সামনে পাহারা বসাল। পদ্মনাভনও অদ্ভুত কাণ্ড করল, সে পাথরটা নিয়ে ব্যাঙ্গালোর ফিরে গেল না, এখানেই রয়ে গেল সাতদিন। সব সময় দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকত। তাতে লোকের কৌতূহল বাড়তে লাগল আরও।

ঠিক সেই সময়টায় আমাদের এখানে আসবার কথা ছিল?

হ্যাঁ। কিন্তু আমরা চলে গেলাম আসাম। এর মধ্যে পদ্মনাভন একদিন উধাও। বাইরে পুলিশ পাহারা ছিল। পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে কেউ তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে।

পাথরটাও নেই?

সেটা তো থাকবেই না।

আচ্ছা কাকাবাবু, এমন হতে পারে না? পাথরটা যদি সত্যিই মহা মূল্যবান হয়, তা হলে পদ্মনাভন অন্যদের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য নিজের জিনিসপত্র সব ফেলে শুধু পাথরটা নিয়ে নিজেই চলে গেছেন?

সেরকমও হতে পারে হয়তো। পদ্মনাভন বিচিত্র ধরনের মানুষ। তবে, পদ্মনাভনের জুতো, চটি সবই পড়ে আছে। সে খালি পায়ে গেছে। আমি পদ্মনাভনকে যতটা চিনি, তাতে সে খালি পায়ে কোথাও যাবে, এমন মনে হয় না।

কিন্তু যারা পাথরটা চুরি করতে চায়, তারা পদ্মনাভনকে শুধু-শুধু এতদিন আটকে রাখবে কেন?

যারা আমাদের পাহাড়ের খাদে ঠেলে ফেলে দিয়েছে, তারাই যদি এই ব্যাপারটায় জড়িত থাকে তবে পদ্মনাভনকে খুন করা তাদের পক্ষে কিছুই না। কিন্তু পদ্মনাভনের ডেড বডি পাওয়া যায়নি। আমার ধারণা, পদ্মনাভনকে এখনও আটকেই রাখা হয়েছে। আর তাকে আটকে রাখার একটাই কারণ থাকতে পারে।

কী সেটা, কী?

থাক, সে-সম্পর্কে আমি এখন কিছু আলোচনা করতে চাই না। এখন ঘুমো তো!

এত তাড়াতাড়ি আমার ঘুম আসছে না, কাকাবাবু। তা হলেও চোখ বুজে থাক। একটু বাদে ঘুম এসে যাবে। শোন, সন্তু, আমরা এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছি। এখানে একটা উল্কা খসে পড়েছে কিংবা পড়েনি, কিংবা পদ্মনাভন কেন উধাও হয়ে গেল, তা নিয়ে আমাদের বেশি মাথা ঘামাবার তো দরকার নেই। কেউ আমাদের সেই দায়িত্ব কি দিয়েছে? আমরা এসেছি শরীর ভাল করতে।

আর কোনও কথা না বলে সন্তু আপনমনে একটু হাসল।

এখানে এতসব রহস্যময় কাণ্ডকারখানা ঘটেছে, তা নিয়ে কাকাবাবু মাথা ঘামাবেন না, তা কখনও হতে পারে? কেউ দায়িত্ব দিক বা না দিক কাকাবাবু এর শেষ না দেখে ছাড়বেন না। কাকাবাবুর স্বভাব সে ভালই জানে।

কাকাবাবু পাশ ফিরে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লেন মনে হল।

সন্তু এপাশ-ওপাশ ছটফট করল খানিকক্ষণ। সমুদ্র আর বাতাসের গর্জন বেশ বেড়েছে। সন্তুর খুব ইচ্ছে করছে, দরজা খুলে বারান্দায় যেতে। কিংবা একেবারে জলের ধারে গিয়ে বসতে। রাত্তিরবেলার সমুদ্রের একটা আলাদা রূপ আছে।

কিন্তু কাকাবাবুর পাতলা ঘুম। দরজা খুললেই তিনি টের পেয়ে যাবেন। আজ সকালেই দমদম এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে কাকাবাবুর কাছে কয়েকটা প্রতিজ্ঞা করেছে। আজই উলটোপালটা কিছু করলে কাকাবাবুর কাছে খুব বকুনি খেতে হবে!

একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।

আবার কিছুক্ষণ পর তার ঘুম ভাঙল বিকট কোনও শব্দে। গুলির আওয়াজ। পরপর দুবার।

কাকাবাবু সন্তুর আগেই উঠে পড়ে আলো জ্বেলেছেন। রিভলভারটা হাতে নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, তোকে উঠতে হবে না সন্তু, আমি দেখছি!

সন্তু তবু তড়াক করে নেমে পড়ল খাট থেকে।

বাইরে এবার গোলমাল শোনা যাচ্ছে। তার মধ্যে বাংলোর একজন বেয়ারার গলা চেনা যায়। কাকাবাবু দরজাটা খুলে ফেললেন।

বাংলোর বাইরে চৌকিদার, বেয়ারা ও দুজন পুলিশ একসঙ্গে চ্যাঁচামেচি করে কী যেন বলছে। কাকাবাবু কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে? কে গুলি ছুঁড়ল?

একজন পুলিশ কাকাবাবুকে স্যালুট করে বলল, সার, চোর এসেছিল। আপনাদের পাশের ঘরের জানলা ভেঙে ঢুকেছিল। তারপর যখন পালাচ্ছে, তখন আমরা ঠিক দেখে ফেলেছি।

কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, ঘরের মধ্যে ঢুকেছিল?

পুলিশটি বলল, হ্যাঁ সার। দেখুন না, জানলা ভাঙা। ভেতরের অনেক কিছু ওলোটপালট করেছে।

সন্তু বলল, আহা, কী পাহারা দেওয়ার ছিরি! চোর যখন জানলা ভেঙে ঢুকল, তখন পুলিশ টেরও পায়নি। চোর যখন বেরিয়ে আসছে, তখন দেখেছে?

পুলিশটি আবার বলল, দুজন ছিল। একজনের পায়ে বোধ হয় গুলিও লেগেছে। কিন্তু ধরা গেল না। ওরা মোটর বাইক এনেছিল। আপনারা ভেতরে যান, সার, কোনও চিন্তা করবেন না। আমরা রাত জেগে পাহারা দেব।

পাশের ঘরটি পদ্মনাভনের ঘর। কাকাবাবু বললেন, আমি ঘরটা একবার দেখব।

সে-ঘরের দরজায় চাবি দেওয়া ছিল, খোলা হল। ভেতরটা একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। টেবিলের সবকটা ড্রয়ার ওলটানো, জামা কাপড়গুলো মেঝেতে ছড়ানো। কার্পেটের একটা দিক খানিকটা গুটিয়ে গেছে।

কাকাবাবু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সবদিকে তাকিয়ে ভাল করে দেখলেন খানিকক্ষণ।

তারপর বললেন, যাক, কোনও কিছুতে হাত দেওয়ার দরকার নেই। কাল সকালে ডি. আই. জি. সাহেব এসে দেখবেন।

তারপর তিনি নিচু গলায় বললেন, মনে হচ্ছে, আমার থিয়োরিটাই ঠিক।