২৭. ইস্কুল না, কলেজ

কাকাবাবু হঠাৎ কাচটা তুলে খুব জোরে মারতেই তলোয়ারটা শিশির দত্তগুপ্তর হাত থেকে উড়ে গিয়ে পড়ল অনেক দূরে।

রাজকুমার আর অন্যরা দৌড়ে এসে কাকাবাবুকে চেপে ধরল। কর্নেল কাকাবাবুকে মারবার জন্য ঘুষি তুলতেই কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, দাঁড়াও! আমি তোমাদের গুপ্তধনের গুহা দেখিয়ে দিচ্ছি।

রাজকুমারের দিকে ফিরে তিনি ধমকের সুরে বললেন, তোমরা কথা রাখতে শেখোনি! সন্তুকে ফেরত দেবার কথা ছিল তোমাদের।

শিশির দত্তগুপ্তর দিকে ফিরে তিনি বললেন, আপনি সেনাপতি বংশের ছেলে! সেনাপতির মতন পোশাক পরলেই সেনাপতি হওয়া যায় না। তলোয়ারটা শক্ত করে ধরতেও শেখেননি?

রাজকুমার বলল, তোমার চালাকি অনেক দেখেছি। আর বেশি বকবক করতে হবে না! এবারে ভালয়-ভালয় জায়গাটা দেখাও!

শিশির দত্তগুপ্ত হুকুম দিল, ক্রাচ দুটো কেড়ে নাও ওর কাছ থেকে!

কাকাবাবু বললেন, তার দরকার নেই। আমি শুধু আপনাকে দেখিয়ে দিলাম যে, তলোয়ার ঠিকমতন ধরতে না শিখলে ও জিনিস নিয়ে ছেলেখেলা করতে নেই। এখান থেকে আরও খানিকটা দূরে যেতে হবে।

একটা ভাঙা দেয়ালের পাশ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন কাকাবাবু। একজন মশালধারী চলল তাঁর আগে আগে। আর বাকি সবাই পেছনে পেছনে। শিশির দত্তগুপ্ত তলোয়ারটা কুড়িয়ে নিয়ে খাপে ভরে নিয়েছে। এখন তার হাতে একটা রিভলভার। সেই রিভলভারের নল কাকাবাবুর পিঠে ঠেকানো।

কাকাবাবু বললেন, সেই গুপ্তধন পেলে কে নেবে? আপনি, শিশিরবাবু, সেনাপতির বংশ। আর, রাজকুমার বলেছে, সে রাজবংশের ছেলে। তা হলে?

শিশির দত্তগুপ্ত বলল, সে চিন্তা আপনাকে করতে হবে না!

কাকাবাবু বললেন, রাজা অমরমাণিক্য বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। তিনি তাঁর জিনিসপত্র এমন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছিলেন যাতে কেউ তার সন্ধান না পায়। সকলেই ভাবে যে, দেয়ালের গায়ে বা পাথরের ওপরে কোথাও কোনও বোতাম-টোতাম থাকবে, সেটা টিপলেই দরজা খুলে যাবে। সেইরকমভাবে গুপ্তধন খুঁজতে এসে বহুলোক এখানকার বাড়িঘর সব ভেঙেই ফেলেছে। এই যে ডান দিকের বড় পাথরটা, এর গায়েও গাঁইতির দাগ। আসলে এখানে সেরকম কিছুই নেই। যা কিছু আছে, সবই মাটির নীচে। মশালটা নীচের দিকে দেখাও, এখানে কোথাও একটা ঈগলপাখি আঁকা আছে!

অমনি দুদুটো মশাল নীচে নেমে এল, সবাই এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে লাগল। কিন্তু সেখানে কোনও পাখিটখির ছবি পাওয়া গেল না।

কাকাবাবু চারদিক ভাল করে দেখে নিলেন। মশালের আলোতে যেটুকু দেখা যায়, তা ছাড়া আর সব দিকেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশের চাঁদও মেঘে ঢাকা পড়েছে।

কাকাবাবু বললেন, পেলে না? তাহলে কি ছবিটা মুছে গেল? না। তা তো হতে পারে না! ভাল করে দেখো তো এখানে একটা বড় তেঁতুলগাছও আছে কি না?

কিন্তু সেখানে কোনও তেঁতুলগাছও নেই।

কাকাবাবু বললেন, এমনও হতে পারে, গাছটা কেউ কেটে নিয়ে গেছে। জঙ্গলের গাছ তো অনবরতই লোকরা কেটে নিয়ে যাচ্ছে। তা হলে চলল তো পাথরটার দিকে।

কাছাকাছি কোনও পাহাড় না থাকলেও সেখানে একটা বেশ বড় পাথরের চাঁই পড়ে আছে।

সেই পাথরের ওদিকটায় যেতেই মশালের আলোয় প্রথমেই চোখে পড়ল একটা সাদা রুমাল।

একজন লোক দৌড়ে গিয়ে রুমালটা তুলে নিল। শিশির দত্তগুপ্তর কাছে এনে সে বলল, স্যার, এই রুমালটা টাটকা। আজই কেউ ফেলে গেছে।

শিশির দত্তগুপ্ত রুমালটা মেলে ধরল। তার এক কোণে ইংরিজি অক্ষরে ভি লেখা।

কাকাবাবু বললেন, তার মানে আরও কেউ আজ এখানে গুপ্তধন খুঁজতে এসেছিল। দ্যাখো, সে আবার কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে কি না!

চারদিকে মশাল ঘুরিয়ে দেখা হল, মানুষজনের কোনও চিহ্ন নেই। কিন্তু একদিকে একটা তেঁতুলগাছ আছে। রুমালটা পড়ে ছিল সেই গাছটার কাছেই।

কাকাবাবু সেই দিকে এগিয়ে গিয়ে গাছটার গোড়ার কাছে বসে পড়ে বললেন, এই তো ঈগলপাখির ছবি!

সবাই প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল কাকাবাবুর ওপরে।

কাকাবাবু মুখ ফিরিয়ে শিশির দত্তগুপ্তকে বললেন, দেখি আপনার তলোয়ারটা।

শিশির দত্তগুপ্ত তলোয়ারটা খাপ থেকে খুলে দিতেই কাকাবাবু সেটা তুলে ধরে বললেন, আপনারা জঙ্গলগড়ের চাবি খুঁজছিলেন, এই দেখুন, এটাই জঙ্গলগড়ের চাবি। দেখবেন?

শুধু মাটির ওপরেই বেশ বড় একটা ঈগলপাখি আঁকা। মাটি কেটে কেটে তার ওপর চুন বা ওই জাতীয় কিছু ছড়িয়ে ছবিটা আঁকা হয়েছিল, বৃষ্টির জলে রং টং ধুয়ে মুছে গেলেও এখনও পাখির আকারটা বোঝা যায়। পাখির চোখ দুটো পাথরের।

কাকাবাবু তলোয়ারের খোঁচা দিয়ে পাখিটার ডান চোখটা তোলার চেষ্টা করলেন। সেটা সহজেই উঠে এল। সেই ফুটো দিয়ে আঙুল ঢুকিয়ে কাকাবাবু গর্তটাকে বড় করতে লাগলেন। তাতেও বিশেষ অসুবিধে হল না। গর্তটা হাত ঢোকাবার মতন বড় হতেই কাকাবাবু তার ভেতর থেকে একটা তামার নল টেনে বার করলেন।

তারপর বললেন, সেই অতদিন আগেও কী রকম চমৎকার কপিকল ব্যবস্থা ছিল দেখো! এটা দিয়ে কাজ সারতে বেশি গায়ের জোর লাগে না। একটা বাচ্চা ছেলেও পারবে।

কাকাবাবু সেই তামার নলটা ধরে ঘোরাতে লাগলেন। কয়েক পাক ঘুরিয়েই বললেন,কাজ হয়ে গেছে। এবারে দ্যাখো?

সবাই হাঁ করে ঈগলপাখির ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সেখানে কিছুই ঘটল না।

শিশির দত্তগুপ্ত কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, ওই পাথরটার কাছে আলো নিয়ে দেখুন! এখানে কী দেখছেন?

মশালের আলো সেদিকে নিতেই দেখা গেল যে, পাথরের চাঁইটা খানিকটা সরে গেছে, সেখানে একটা গর্ত বেরিয়ে পড়েছে।

সবাই ছুটে গেল সেদিকে। গর্তটার ভেতরে অন্ধকার। ভেতরে কিছুই দেখা যায় না।

কাকাবাবু সেখানে গিয়ে বললেন, এটা হল সুড়ঙ্গে ঢোকার পথ। সুড়ঙ্গটা সোজা নয়। এখান থেকে নীচে নামলেই সামনের দিকে আসল সুড়ঙ্গটা দেখা যাবে।

সবাই একসঙ্গে হুড়মুড় করে সেই গর্ত দিয়ে নামতে যাচ্ছিল, শিশির দত্তগুপ্ত রিভলভার তুলে বলল, খবদার! আর কেউ যাবে না। প্রথমে শুধু আমি যাব।

কর্নেল বলল, স্যার, প্রথমেই আপনি যাবেন? ভেতরে যদি সাপখোপ থাকে?

শিশির দত্তগুপ্ত বলল, যাই থাকুক, প্রথমে আমি গিয়ে দেখব। দরকার হলে তোমাদের ডাকব। কারুর কাছে টর্চ আছে?

কেউ টর্চ আনেনি। কাকাবাবু নিজেই তাঁর পকেট থেকে একটা সরু টর্চ বার করে বললেন, এটা দিতে পারি। এবারে আমাকে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করুন।

শিশির দত্তগুপ্ত কাকাবাবুর কাছ থেকে টর্চটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে কঠোরভাবে বলল, একে ধরে রাখো। পালাবার যেন চেষ্টা না করে। ফিরে এসে এর ব্যবস্থা করব। আমি ভেতর থেকে যদি ডাকি, তা হলে তোমরা কেউ যাবে।

টর্চের আলোয় দেখা গেল, সেই গর্তটা এক-মানুষের চেয়ে কিছুটা বেশি গভীর! ওপর থেকেই সবাই দেখতে পেল, শিশির দত্তগুপ্ত সেই গর্তের মধ্যে নেমে আবার হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

সেই কুড়িয়ে পাওয়া রুমালটা নিয়ে কাকাবাবু হাওয়া খেতে লাগলেন। তার কপালে ঘাম ফুটে উঠেছিল, এখন মুখখানা বেশ প্রসন্ন দেখাচ্ছে।

সবাই উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে। প্রত্যেকটা মুহূর্তকে মনে হচ্ছে ভীষণ লম্বা। তবু প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেল, শিশির দত্তগুপ্তর কোনও সাড়াশব্দ নেই।

গর্তটার মুখের কাছে মুখ দিয়ে রাজকুমার চিৎকার করে ডাকল, স্যার! স্যার।

কোনও উত্তর এল না।

রাজকুমার এইরকম ডেকে চলল অনেকবার। তার ডাকেরই খানিকটা প্রতিধ্বনি শোনা গেল কিন্তু আর কোনও শব্দ নেই।

রাজকুমার বলল, কী হল? স্যার কোনও উত্তরও দিচ্ছেন না কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি কী জানি! সে তোমাদের স্যারের ব্যাপার।

কর্নেল বলল, আর একজন কারুর ভেতরে গিয়ে দেখা দরকার।

রাজকুমারও গর্তে নেমে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে গেল সুড়ঙ্গে। ওপর থেকে কর্নেল জিজ্ঞেস করল, কী হল, কিছু দেখতে পাচ্ছেন, রাজকুমার?

ভেতর থেকে শোনা গেল, বড্ড অন্ধকার। কিছু দেখতে পাচ্ছি না।

কর্নেল বলল, আমরা ডাকলে সাড়া দেবেন। স্যারের টর্চের আলো দেখতে পাচ্ছেন না?

রাজকুমারের কাছ থেকে আর কোনও উত্তর এল না! এবার কর্নেল শুরু করল ডাকাডাকি। রাজকুমার একেবারে নিশ্চুপ।

কর্নেল মুখ তুলে বলল, কিছু নিশ্চয়ই পেয়েছে। সেইজন্য সাড়া দিচ্ছে। না। সাপ-টাপ থাকলেও সঙ্গে সঙ্গেই তো কিছু একটা হয়ে যায় না!

কাকাবাবু বললেন, এবারে তুমি নেমে দেখবে নাকি?

কর্নেল বলল, নিশ্চয়ই। আমি কি ভয় পাই?

কর্নেল-এর কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল, সেটা খুলে নামিয়ে রেখে সে গর্তটার মধ্যে পা ঝুলিয়ে দিল। তারপর লাফিয়ে নেমে পড়ে প্রথমেই সুড়ঙ্গে না ঢুকে সেখান থেকেই ডাকতে লাগল, স্যার! রাজকুমার! আপনারা কোথায়?

কোনও উত্তর না পেয়ে সে সুড়ঙ্গে মাথা ঢোকাতেই কেউ যেন ত্যাঁচকা টান মেরে তাকে ঢুকিয়ে নিল ভেতরে।

অন্য যারা ছিল, তারা দারুণ ভয় পেয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

কাকাবাবু তাদের বললেন, ওহে, তোমরা যদি বাঁচতে চাও তো পালাও। ভেতরে জুজু আছে মনে হচ্ছে।

লোকগুলো কী করবে ঠিক করতে পারছে না। তখুনি দেখা গেল গর্তটার ভেতর থেকে কার মাথা বেরিয়ে আসছে। কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, হাতটা দাও, আমি টেনে তুলছি!

গর্ত থেকে উঠে এলেন নরেন্দ্র ভার্মা। তাঁকে দেখেই কর্নেল-এর দলবল দৌড় মারল।

গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, যাক, ওগুলো যাক। আলি চাঁইগুলো ধরা পড়ে গেছে! খুব বুদ্ধি বার করেছিলে তুমি, রাজা!

কাকাবাবু বললেন, এখানে আসার আগে পর্যন্ত আমি বুঝতে পারিনি যে, শিশির দত্তগুপ্তই নাটের গুরু! লোকটা ভালই অভিনয় করে। পুলিশের কত বলেই ও বড় বড় সব ক্রিমিনালকে নিজের কাজে লাগিয়েছে। তোমার রুমালটা প্রথমে না দেখতে পেয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলুম।

নরেন্দ্র ভার্ম গর্তের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, কেয়া হুয়া? উ লোগকো বাঁধকে উপারে লে আও!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ভেতরে থাকতে তোমার কষ্ট হয়নি তো? দুটো বেশ বড় বড় ঘর।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমাকে এবারে সারপ্রাইজ দেব, রাজা! বলো তো ভিতরমে কে কে আছে?

কাকাবাবু বললেন, তার মানে?

নরেন্দ্র ভামা একগাল হেসে বললেন, সন্টু! দ্যাট নটি বয়!

কাকাবাবু সত্যিকারের অবাক হয়ে বললেন, সন্তু! ওর ভেতরে?

নরেন্দ্র ভাম বললেন, হাঁ! কেয়া আজিব বাহ্! ও ছেলেটার কিন্তু বুদ্ধি সাঙ্ঘাতিক।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু এখানে? এ সুড়ঙ্গের পথই বা কী করে জানল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, জানেনি। লেকিন, আর একটু হলেই জেনে ফেলত। তোমার ম্যাপ পেয়ে তো আমি দলবল নিয়ে বিকালেই এখানে পহুছে গেছি। তুমি শর্টকাট রাস্তা বাতলে দিয়েছিলে। এখানে এসে দেখি, ওই ঈগলের পাথরের আখ নিয়ে সন্তু নাড়াচাড়া করছে। পাশে অন্য একটা লোক।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু কি রাজকুমারের কাছ থেকে পালিয়ে এসেছিল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ। তারপর গন্ধ শুঁকে-শুঁকে ঠিক এখানে হাজির হয়ে গেছে। ওদের দুজনকেও আমরা সুড়ঙ্গের অন্দরমে নিয়ে গেলাম। ওই তো সন্তু উঠছে!

তলা থেকে কেউ ঠেলে তুলেছে সন্তুকে, দুহাতের ভর দিয়ে সে ওপরে উঠে এল। তারপর কাকাবাবুর দিকে চেয়ে সে লাজুকভাবে হাসল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক আছিস তো? কোথাও লাগে-টাগেনি তো?

সন্তু বলল, না।

কাকাবাবু বললেন, এবারে সত্যিই তোর জন্য চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলুম। এ লোকগুলো বড় সাঙ্ঘাতিক। চল্, কালই ফিরে যেতে হবে কলকাতায়। তোর ইস্কুল খুলে গেছে না?

সন্তু বলল, ইস্কুল না, কলেজ!