এখন তো মৃতরাই প্রশ্নশীল

আমি কি এপ্রিলে মুগ্ধাবেশে
তোমাকে রঙিন পোস্টকার্ড, বহুদূর শহরের ছবিঅলা,
পাঠিয়েছিলাম? আজ রাতে
কিছুতেই মনে পড়ছে না। কখনও তন্দ্রার মেঘ
আমার অস্তিত্বে ছেয়ে এলে,
বহু ছবি, মূলত অস্পষ্ট, ভেসে ওঠে এলোমেলো
মনের নানান স্তরে বিমিশ্র স্মৃতিতে।
একটির সঙ্গে অন্যটির মিল নেই, আপাতত
ধারাবাহিকতা খুঁজে মেলা ভার। এই সেই মুহূর্ত যখন
একদা যা ঘটেছিল তার
হদিশ মেলে না আর যা ঘটেনি কোনো দিন,
তাকেই নিভাঁজ সত্য ঘটনার প্রতিবিম্ব মনে হয় বস্তুত আমার।

তোমার বাগানে আমি ছিলাম সে-রাতে
গোলাপ গাছের কাছে? আমি কি তোমাকে স্পর্শ করে
উচ্চারণ করেছি শপথ
নিসর্গের নামে, নক্ষত্রের নামে, হৃদয়ের নামে
সে-রাতে বাগানে উচ্ছ্বসিত ফোয়ারার পাশে দাঁড়িয়ে একাকী?
দেখেছি তোমার
বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে রুপালি পাখি চোখ
হয়ে গেঁথে গিয়েছিল আমার শরীরে? লহমায়
ফুরিয়েছে সে-প্রহর, গাড়িবারান্দায়
বিদায়ের ছায়াচ্ছন্ন ঠোঁটে জমেছিল
ক’ফোঁটা শিশির। নিসর্গের অন্তর্গত
ছিলে তুমি, ছিলে কোনো না-লেখা প্রেমের কবিতায়।
ছিল কি বাগান কোনো গোলাপে সাজানো? বাস্তবিক
ছিলে কি সেখানে তুমি সে-রাতে নবীনা? এক আমাকে বলে দেবে?

একদা জন্মেছি যে-শহরে তার হাড়-পাঁজরা সব
হয়েছে ঝাঁজরা হানাদারদের মর্টারের শেলে, শহরের
আনাচে-কানাচে
আজরাইলের তীক্ষ্ণ নখের আঁচড় অবিরত

পড়েছে ব্যাপক, এমনকি শহীদের করবেও বয়ে গেছে
বুলেটের ঝড়। চৌরাহায় মধ্যরাতে
নেকড়ের চিৎকারের মতো
দুরন্ত হাওয়ায়
হাতে তুলে নিয়েছি পতাকা বেদনার্ত মহিমায়
গুলিবিদ্ধ আমি, নিইনি কি?

আমার গলিতে যে-বালক খুব উঠেছিল বেড়ে
তমালের মতো, তাকে ওরা একাত্তরে
চোখ বেঁধে নিয়ে গেছে কালো বধ্যভূমিতে এবং
যাকে আমি ফ্রক ছেড়ে শাড়ি প’রে হেমন্ত-বিকেলে
বারান্দায় দাঁড়াতে দেখেছি, সে তরুণী
হয়েছে ধর্ষিতা বারংবার
শক্রর শিবিরে আর আমাদের প্রেমও
হয়েছে ভীষণ গুলিবিদ্ধ কোজাগরী পূর্ণিমায়।

অনেকের স্মরণের ল্যান্ডস্কেপে নেই যেন আজ
কোনো বধ্যভূমি, লক্ষ লক্ষ খুলি, স্মৃতিসৌধ কোনো।
আমারও কি নেই? কে আমাকে বলে দেবে?
এখন তো মৃতরাই প্রশ্নশীল বড়।