০৩. একটুক্ষণ গাড়িটা চলার পর

একটুক্ষণ গাড়িটা চলার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বাড়ি কি এ পাড়ায় নাকি?

লোকটি বলল, না, আমার বাড়ি এখানে নয়। এ পাড়ায় এসেছিলুম একটা কাজে। কী অদ্ভুত যোগাযোগ বলুন তো, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

কাকাবাবু পেছনের সিটের দিকে হাত দেখিয়ে বললেন, এ আমার ভাইপো সন্তু।

লোকটি বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওকেও তো চিনি! সন্তুও কিন্তু লোকটিকে কোথাও আগে দেখেছে কি না মনে করতে পারছে। না। তবে গলার আওয়াজটা যেন একটু চেনা-চেনা লাগছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নামটা কী বলুন তো? ঠিক মনে করতে পারছি না।

লোকটি হা-হা শব্দে হেসে বলল, আমার নাম মনে নেই তো? ভাবুন, আর একটু ভাবুন, যদি মনে পড়ে।

কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকালেন। সন্তু চুপ। কাকাবাবু বললেন, আপনি একটু আগে এসে পড়লে বেশ হত। তিনটে গুণ্ডা-মতন ছেলে আমাদের ওপর হামলা করতে এসেছিল।

এই রকম কথা শুনলে সবাই জিজ্ঞেস করে, তাই নাকি? কী করেছিল? তারপর কী হল?

কিন্তু এই গাড়ির চালকের সেরকম কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। সে অকারণে হা-হা করে হেসে উঠল।

সাউথ গড়িয়াহাট রোডে পড়ে গাড়িটা ডান দিকে বেঁকতেই কাকাবাবু বললেন, আমার বাড়ি ওদিকে নয়। বাঁ দিকে যেতে হবে, ভবানীপুরের দিকে।

লোকটি কাকাবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে হালকাভাবে বলল, জানি, আপনার বাড়ি কোথায়। এখন একটু অন্য দিকেই চলুন না। আমার বাড়িতে বসে একটা চা খেয়ে যাবেন।

কাকাবাবু বললেন, অনেক রাত হয়ে গেছে। এখন তো আর চা খাব না। আপনার বাড়িতে অন্য একদিন যাব।

লোকটি গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিল হু-হু করে।

কাকাবাবু বললেন, আরে, এ যে অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। আমি এখন বাড়ি ফিরতে চাই। আপনার বাড়ি একেবারে উলটো দিকে দেখছি, আপনি বরং আমাদের এখানে নামিয়ে দিন। এখান থেকে ট্যাক্সি পেয়ে যাব।

লোকটি বলল, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, চলুন না, চলুন না?

কাকাবাবু এতক্ষণ উপকারী লোকটির সঙ্গে বিনীতভাবে কথা বলছিলেন, এবারে দৃঢ় গলায় বললেন, আপনি এখানে গাড়ি থামিয়ে দিন।

লোকটি খুব আলগাভাবে ডান দিকের ড্যাশ বোর্ড থেকে একটা রিভলভার বার করে বলল, আশা করি এটা ব্যবহার করার দরকার হবে না। চুপ করে বসে থাকুন। আমার বাড়িতে চলুন। সেখানে আপনার সঙ্গে আমার একটা বোঝাপড়া আছে।

কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কী ব্যাপার বলা তো, সন্তু! আজি সন্ধে থেকেই খালি ছোরা-ছুরি। আর রিভলভার দেখতে হচ্ছে!

সন্তু পেছনের সিটে বসে আছে। লোকটি সন্তুকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেনি। সন্তুর কাছে যে একটা ছুরি আছে তা সে জানে না।

সন্তু বলল, আপনি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আমাদের নামিয়ে দিন এখানে!

লোকটি ধমক দিয়ে বলল, খোকা, চুপ করে বসে থাকো!

সন্তু ছুরিটা বার করেই চেপে ধরল লোকটার ঘাড়ে। তারপর সে-ও হুকুমের সুরে বলল, এক্ষুনি গাড়ি থামান। হাত সরাবার চেষ্টা করবেন না। তা হলেই আমি এটা বসিয়ে দেব ঘাড়ে।

লোকটি একটুও ভয় না পেয়ে বরং অট্টহাসি করে উঠল। তারপর বলল, এ ছেলেটা দেখছি সেই রকমই বিছু আছে। বদলায়নি একটুও। পকেটে আবার ছুরি নিয়ে ঘোরে। কত বড় ছুরি?

কাকাবাবু বললেন, ছুরিটা বেশ বড়ই। মানুষ মারা যায়।

লোকটি বিদ্রূপের সুরে বলল, একটা ছুরি থাকলেই বুঝি মানুষ মারা যায়? সবাই কি মানুষ মারতে পারে? তার জন্যও ট্রেনিং লাগে! এই খোকা, চালাও দেখি ছুরি, দেখি তুমি কেমন পারো?

সন্তুর বুক ধড়ফড় করতে লাগল। লোকটা যা বলল, সেই কথাগুলো সে আগে যেন কোথাও শুনেছে? কোথায়? হ্যাঁ, হ্যাঁ, ত্রিপুরায়। জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা বাড়িতে। এই লোকটাই সেই রাজকুমার!

স্টিয়ারিংয়ের ওপরেই লোকটির দুই হাত রাখা, এক হাতে রিভলভার। ও হাত ওঠাবার আগেই সন্তু ওর ঘাড়ে ছুরি বসিয়ে দিতে পারে। কিন্তু হাত কাঁপছে। সত্যি-সত্যি কি একজন মানুষকে মেরে ফেলা যায়?

সে আবার ভয় দেখাবার জন্য বলল, শিগগির গাড়ি থামান, নইলে কিন্তু… এই কথা বলার সময় তার গলাও কেঁপে গেল।

লোকটি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, বললুম তো গাড়ি থামাব না, তুই কী করতে পারিস দেখি!

কাকাবাবু বললেন, ছুরিটা সরিয়ে নে সন্তু। ইনি ভয় পাচ্ছেন না। ইনি যখন এত করে বলছেন, তখন এর বাড়িতে একটু চা খেয়েই আসা যাক। চা ছাড়া আমরা আর কিছু খাব না কিন্তু!

সন্তু আশা করেছিল কাকাবাবু লোকটিকে অন্যমনস্ক করে দিয়ে কিছু একটা করবেন। কিন্তু কাকাবাবু সেরকম কিছুই করলেন না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ও মশাই, আপনার বাড়ি আর কত দূরে?

লোকটি গম্ভীরভাবে বলল, আর একটু দূর আছে।

এই রাস্তা এখনও তেমন ফাঁকা নয়। বাস চলছে। বৃষ্টির মধ্যেও কিছু লোক হেঁটে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একটা চলন্ত গাড়ির ভেতরে যে রিভলভার আর ছুরির খেলা চলছে, তা কেউ বুঝতে পারছে না।

যাদবপুর পেরিয়ে গিয়ে একটা নির্জন জায়গার কাছাকাছি এসে গাড়িটা গতি কমিয়ে একেবারে থেমে গেল। লোকটি এবারে রিভলভারটি ডান হাতে উঁচিয়ে, মুখ ফিরিয়ে সন্তুকে বলল, গাড়ি থামাতে বলেছিলি, এই তো থামালুম, এবারে তুই নেমে যা।

কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, আপনি বসে থাকুন। আরও খানিকটা দূরে যেতে হবে।

সন্তু বলল, আমি এক নেমে যাব?

লোকটি বলল, হ্যাঁ, তোকে আমার দরকার নেই। এখান থেকে বাস পেয়ে যাবি। বাসভাড়া না থাকে তো বল, আমি দিয়ে দিচ্ছি!

সন্তু বলল, কাকাবাবুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই এক যাব না।

কাকাবাবু বললেন, তুই চালেই যা সন্তু। যতদূর মনে হচ্ছে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বেশি রাত হলে দাদা-বউদি চিন্তা করবেন তোর জন্য।

লোকটি কণ্ঠহাসি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তা বেশ দেরি তো হবেই!

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আপনাকে ফেলে রেখে আমি এক ফিরে গেলে মা-বাবা আরও বেশি চিন্তা করবেন।

আমি কিছুতেই নামব না।

তবে ছুরিটা দে আমার কাছে। চুপ করে বসে থাকবি। একদম মুখ খুলবি না।

সন্তু তবু বলল, কাকাবাবু, এই লোকটা হচ্ছে রাজকুমার! সেই যে ত্রিপুরায় জঙ্গলগড়ের চাবি খোঁজার সময়…

কাকাবাবু বললেন, প্রথমটায় চিনতে পারিনি। তখন দাড়ি ছিল না, চেহারাটাও রোগ ছিল, তাই না?

লোকটি বলল, চিনেছেন তা হলে? কতদিন পর দেখা বলুন? অনেক কথা জমে আছে, না? তাই আপনাকে দেখে মনে হল, আপনাকে বাড়িতে নিয়ে যাই, খানিকক্ষণ গল্প-টল্প করা যাব।।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, গল্প ভালই জামবে মনে হচ্ছে।

রাজকুমার আবার গাড়িতে স্টার্ট দিল। তারপর কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না। গড়িয়া পেরিয়ে আরও কিছুদূর যাবার পর গাড়িটা ঘুরে গেল। ডান দিকে। এখানে একেবারে অন্ধকার ঘুরাঘুট্টি রাস্তা। রাজকুমার এমনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে যে, মনে হয় এদিককার পথঘাট তার বেশ ভালই চেনা।

মাঝে মাঝে রাস্তার কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করছে গাড়িটাকে। কাছাকাছি কোনও বাড়িতেই আলো জ্বলছে না। পথটা গেছে। একেবেঁকে, হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে পাশে বড়-বড় পুকুর। গাড়িটা এত স্পিডে যাচ্ছে যে, হঠাৎ কোনও পুকুরে নেমে যাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়।

এক সময় গাড়িটা একটা বেশ বড় বাড়ির লোহার গেটের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজকুমার হর্ন বাজাল খুব জোরে-জোরে। শার্ট-পরা একজন লোক এসে খুলে দিল গেট।

কাকাবাবু বললেন, অনেক দূর! এখান থেকে রাত্তিরবেলা ফিরব কী করে?

রাজকুমার বলল, আজ রাত্তিরেই যে ফিরতে হবে, তার কী মানে আছে? এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন?

কাকাবাবু হঠাৎ ভুরু কোঁচকালেন। যেন অন্য কোনও কথা তাঁর মনে পড়ে গেছে।

লোহার গেটের পরে একটা বাগান। এখানেও একটা বিরাট কুকুর ডেকে উঠল বুক কাঁপিয়ে। রাজকুমার দুতিনবার শিস দিতেই নেকড়ে বাঘের মতন কুকুরটা তার পায়ের কাছে এসে ল্যাজ নাড়তে লাগল।

সন্তু নেমে দাঁড়িয়েছে, কাকাবাবু গাড়িতে বসেই রইলেন। রাজকুমার এসে বলল, কী হল, নামুন।

যেন একটা ঘোর ভেঙে কাকাবাবু বললেন, ও, হ্যাঁ, নামছি।

কাকাবাবু নেমে চারপাশটা দেখে বললেন, বাঃ, বেশ বাড়িটা তো। আপনার নিজের নাকি?

রাজকুমার বলল, প্রায় আমারই বলতে পারেন।

সন্তু ভাবল, বাড়ি আবার প্ৰায় আমার হয় কী করে? বাড়ি কি বই যে অন্য কারুর কাছ থেকে চেয়ে এনে ফেরত না দিলেই প্ৰায় নিজের হয়ে যায়?

এত বড় বাড়িতে একটাও আলো জ্বলছে না।

রাজকুমার বলল, লোডশেডিং মনে হচ্ছে। তিনতলায় উঠতে হবে, আপনার অসুবিধে হবে না তো, মিঃ রায়চৌধুরী?

কাকাবাবু হেসে বললেন, না, না, অসুবিধের কী আছে? অন্ধকারে ক্রাচ নিয়ে তিনতলার সিঁড়ি ভাঙা, এ তো খুব আনন্দের ব্যাপার!

রাজকুমার কার উদ্দেশে যেন বলল, এই, একটা টর্চ নিয়ে আয়। সিঁড়িতে আলো দেখা!

বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়েও থমকে গিয়ে রাজকুমার বলল, কিছু মনে করবেন না, মিঃ রায়চৌধুরী। একটা জিনিস চেক করে দেখতে চাই। আপনার হাত দুটো একবার ওপরে তুলুন।

কাকাবাবু বললেন, আমার সঙ্গে কোনও অস্ত্ৰ আছে কি না দেখতে চান তো? কলকাতা শহরে সন্ধেবেলা বেড়াতে বেরুবার সময় আমি বন্দুক-পিস্তল সঙ্গে নিয়ে ঘুরি না। অবশ্য এখন বুঝতে পারছি, সঙ্গে একটা কিছু রাখাই উচিত ছিল।

রাজকুমার তবু কাকাবাবুর সারা শরীর থাবড়ে-থাবড়ে দেখল। তারপর বলল, ঠিক আছে, চলুন।

টর্চের আলোয় দেখা গেল ভেতরে একটা বেশ চওড়া, টানা বারান্দা। তার একপাশ দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি।

কাকাবাবু বললেন, একতলায় ঘর নেই? সেইখানে বসে গল্প-গুজব সেরে নিলে হয় না?

রাজকুমার এবারে বেশ কড়াভাবে বলল, না, ওপরেই যেতে হবে। আপনার ভাইপো আগে-আগে চলুক, আপনি মাঝখানে, তারপর আমি।

কাকাবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, চল রে, সন্তু, দেরি করে লাভ নেই। সন্তু তিনতলায় পৌঁছতেই অন্ধকারের মধ্যে একজন কেউ চেঁচিয়ে উঠল, কোন? কোন?

পেছন থেকে রাজকুমার বলল, ঠিক আছে, টাইগার, আমি আছি। তুমি পাঁচ নম্বর ঘরটা খোলো। আলো নেই কেন? কখন থেকে লোডশেডিং?

অন্ধকারের মধ্যেই টাইগার নামের লোকটি বলল, লোডশেডিং নেহি। মালুম হচ্ছে কি লাইনমে কুছু গড়বড় হয়েছে!

একটা তালা খোলার শব্দ হল। রাজকুমার টর্চের আলো ফেলে বলল, মিঃ রায়চৌধুরী, এগিয়ে যান, বা দিকের তিন নম্বর দরজা। আপনারা দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়ান। আমি বাইরে আছি। টাইগার, আমার ঘর থেকে টিউবলাইটটা নিয়ে এসো।

টাইগার বলল, আপনার ঘরের চাবি তো হামার কাছে না আছে।

রাজকুমার বলল, ও, হ্যাঁ, তাই তো। ঠিক আছে, আমিই নিয়ে আসছি। তুই দরজার বাইরে দাঁড়া। মিঃ রায়চৌধুরী, টাইগারকে ঘটাতে যাবেন না যেন। ও বড্ড গোঁয়ার।

মিশমিশে অন্ধকার ঘরটার মধ্যে ঢুকে সন্তু হাতড়ে-হাতড়ে দেয়ালের কাছে গেল। তারপর সারা দেয়ালটা হাত ঝুলিয়ে দেখল। সে-দেয়ালে কোনও জানলা নেই। আর-এক দিকে যেতে সে কিসের সঙ্গে যেন ঠোক্কর খেল। হাত দিয়ে বুঝল, সেটা একটা খাট।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই তখন নেমে গেলেই পারতিস। বাড়ি পৌঁছে যেতিস এতক্ষণ।

সন্তু বলল, বাড়ি গিয়ে মা-বাবাকে কী বলতুম? একজন তোমাকে রিভলভার দেখিয়ে জোর করে ধরে নিয়ে গেল, আর আমি পালিয়ে এলুম?

কাকাবাবু বললেন, আমাকে কি এত সহজে ধরে আনা যায়? আমি অনেকটা ইচ্ছে করেই এসেছি। দেখাই যাক না। এদের কাণ্ড-কারখানাটা কী।

এবারে একটা টিউবলাইট হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে ফিরে এল রাজকুমার। সেই আলোয় দেখা গেল, ঘরটা বেশ বড়, দুপাশে দুটি খাট, মাঝখানে একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার। ঘরে একটাও জানলা নেই, দেয়ালে সাদা-সাদা তুলোর মতন কী যেন লাগানো। বোঝা যায়, বিশেষভাবে ঘরটা তৈরি।

বাতিটা টেবিলের ওপর রেখে রাজকুমার বলল, একটু বসুন, আমি এক্ষুনি আসছি।

কাকাবাবু ক্ৰাচ দুটো দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখে খাটে বসলেন। কোনও জানিলা নেই বলে ঘরটায় বেশ গরম। একটা পাখা আছে বটে, কিন্তু এখন বিদ্যুৎ নেই বলে সেটা চলছে না।

কাকাবাবুর বাঁ পায়ে একেবারেই শক্তি নেই, তবু তিনি সেই পায়ে গোলমতন একটা জুতো পরে থাকেন। ডান পায়ে স্বাভাবিক জুতো। তিনি জুতোর ফিতে খুলতে-খুলতে বললেন, তুইও জুতোমোজা খুলে ফ্যাল, সন্তু, রাত্তিরটা তো এখানেই থাকতে হবে মনে হচ্ছে।

রাজকুমার ফিরে এসে বলল, আপনাদের খাবার ব্যবস্থা করে এলুম। এবারে নিশ্চিন্তে বসে কথা বলা যাবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আপনাদের খাবার এসে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা কী খাব জিজ্ঞেস করলেন না তো? আমি রাত্তিরে রুটি খাই।

রাজকুমার বলল, ভাত আর রুটি দুরকমই থাকবে। যেটা ইচ্ছে খাবেন। আর মাংস।

কাকাবাবু বললেন, মাংসতে যেন ঝাল না দেয়। ত্রিপুরার লোক বড় ঝাল খায়। আমি আজকাল ঝাল খেতে পারি না।

রাজকুমার বলল, না, না, একদম ঝাল নেই। এখানে ইওরোপিয়ান স্টাইলে রান্না হয়। স্টু-এর মতন।

সেই সঙ্গে খানিকটা স্যালাড।

হ্যাঁ, স্যালাড তো থাকবেই। আর যদি সুইট ডিশ কিছু চান…

সন্তুর মনে হল কাকাবাবু যেন কোনও হোটেলে এসে খাবারের অর্ডার দিচ্ছেন। অথচ রাজকুমারের হাতে এখনও রিভলভার ধরা।

রাজকুমার একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে বলল, আপনাদের ডাবলি বেডঘর দিয়েছি। থাকার কোনও অসুবিধেই হবে না। সঙ্গে অ্যাটাচুড বাথরুম আছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কিতদিন থাকতে হবে? ব্যবস্থা তো বেশ ভালই দেখছি।

রাজকুমার বলল, থাকুন না। আমি তো বলেছি, ব্যস্ত হবার কিছু নেই।

ত্রিপুরা ছেড়ে এখন এখানেই থাকা হয় নাকি? জেল থেকে বেশ তাড়াতাড়িই ছেড়ে দিল তো।

হ্যাঁ, ইলেকশনের সময় ছাড়া পেয়ে গেলাম। ভেতরে কিছু কলকাঠিও নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। সেবারে খুব জব্দ করেছিলেন আমাদের।

তোমরা তো আমার কথা বিশ্বাসই করেনি। খুব গুপ্তধন-গুপ্তধন বলে লাফালে। শেষ পর্যন্ত জঙ্গলগড়ে গিয়ে দেখা গেল কিছুই নেই। মানে, টাকা পয়সা নেই, কিন্তু অন্য জিনিস ছিল, যার দাম তোমরা বুঝবে না।

সেবারে আমাদের হাত ফসকে খুব জোর পালিয়েছিলেন। আর আপনার ভাইপো এই ছেলেটা, ওঃ কী সাংঘাতিক বিচ্ছু!

কলকাতায় এখন কী করা হচ্ছে? ব্যবসা-ট্যবসা?

ঠিক ধরেছেন। অর্ডার সাপ্লাই-এর ব্যবসা করছি। চলছে বেশ ভালই। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল, তাই ভাবলুম, পুরনো দিনের গল্প-টল্প করা যাক।

আমি আবার পুরনো গল্প একদম ভালবাসি না। আমার সঙ্গে কি হঠাৎ দেখা হয়ে গেল, না অন্য কোনও ব্যবস্থা ছিল?

এসব জিনিস কি হঠাৎ হয়? আপনাকে রাস্তায় দেখলুম। আর টপ করে তুলে নিয়ে এলুম? আপনি হচ্ছেন রাজা রায়চৌধুরী, অতি ধুরন্ধর ভি আই পি। আপনার জন্য অনেক রকম বন্দোবস্ত করতে হয়েছে। বেশ কিছু টাকাও খরচ হয়ে গেছে।

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন রাজকুমারের মুখের দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, শুধু আমার সঙ্গে গল্প করার জন্য এত ব্যাপার? টাকা খরচও করতে হয়েছে? কেন, আমাকে কি মেরো-টেরে ফেলার ইচ্ছে আছে নাকি তোমার?

রাজকুমার হেসে বলল, আরে না, না। ওসব কী বলছেন? পুরনো শক্ৰতা অত আমি মনে রাখি না। খুন-টুনের মধ্যে আমি এখন নেই। বললুম না, এখন আমি ব্যবসা করছি।

চেয়ার ছেড়ে উঠে রাজকুমার বলল, আচ্ছা, আবার কাল গল্প হবে। আজ আমি টায়ার্ড। তা ছাড়া খুব খিদেও পেয়ে গেছে। শুনুন, বাইরে টাইগার নামের লোকটি রাত্তিরে সব সময় থাকবে। ভুলেও কিন্তু ওকে ডাকবেন না। ও আমার কথা ছাড়া আর কারুর কথা শোনে না। কেউ ওকে কোনও কিছুর জন্য রিকোয়েস্ট করলে ও তার মাথায় ডাণ্ডা মারে! ওর কাছে একটা রবারের ডাণ্ডা আছে। সেটা দিয়ে মারলে রক্ত বেরোয় না, কিন্তু লাগে ভীষণ।

কাকাবাবু বললেন, না, না, আমিও টায়ার্ড, খাবারটা এলে খেয়ে শুয়ে পড়ব। টাইগারকে ডাকার দরকারই হবে না। আচ্ছা, একটা ব্যাপার জানার কৌতূহল হচ্ছে।

রাজকুমার বলল, কৌতূহল কক্ষনো চেপে রাখতে নেই। পেট ফুলে যায়। বলে ফেলুন, বলে ফেলুন!

কাকাবাবু বললেন, আজি সন্ধেবেলা যে আমি আনোয়ার শা রোডে আসব, সেটা তুমি জানলে কী করে? আমার তো আসবার ঠিক ছিল না!

রাজকুমার বলল, ও, এই ব্যাপার? এটা আর এমন শক্ত কী? দিন দশেক ধরে আপনার বাড়ির ওপর নজর রাখা হয়েছিল। আপনি তো মশাই আচ্ছা! ঘরকুনো লোক। বাড়ি থেকে বেরুতেই চান না!

সকালবেলা একবার পর্কে ঘুরে আসতে যাই।

সে-সময় পার্কে অনেক লোক থাকে। তা ছাড়া, দিনের বেলা এসব কাজ হয় না।

ওই পার্কেই একবার একজন আমার পিঠে গুলি করেছিল?

না, না, আমি ওই সব গুলি-ফুলির মধ্যে নেই। মানে নেহাত দরকার না। পড়লে.যেমন এখন আপনি পালাবার চেষ্টা করলে আমায় গুলি চালাতেই হবে। কিন্তু সেটা আশা করি আপনিও চাইবেন না, আমিও চাইব না।

না, না, পালাবার চেষ্টা করব কেন? যখন যেতে ইচ্ছে হবে, তখন নিজেই চলে যাব, সেটাই তো ভাল, তাই না?

রাজকুমার আটহাসি করে উঠল। কাকাবাবুও হাসলেন। সন্তু ক্রমশ আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই রকম বিপদের মধ্যেও কাকাবাবুইয়ার্কির সুরে কথা বলছেন! কাকাবাবুর যে কী উদ্দেশ্য সেটাই সে বুঝতে পারছে না।

কাকাবাবু আবার বললেন, দিন-দশেক ধরেন আমার বাড়ির সামনে লোক রেখেছিলে? খুব গরজ দেখছি? কী ব্যাপার?

রাজকুমার বলল, হ্যাঁ, গরজ একটু ছিল বটে। আপনি সকালবেলা একবার পার্কে যান, আর সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকেন। বেশ মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলুম। সেই জন্য আপনার জন্য একটা টোপ ফেলতে হল।

টোপ?

এখন ওসব কথা থাক। আবার কাল সকালে গল্প হবে। আপনাদের খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাবার পর ব্যাটারি-লাইটটা কিন্তু নিয়ে যাব।

লোকটি দরজার একটা পাল্লা খুললে কাকাবাবু বললেন, তুমি কিসের ব্যবসা করছ, সেটা তো বললে না?

সেটা সিক্রেট! পরে আস্তে-আস্তে সবই জানতে পারবেন। গুডনাইট মিঃ রায়চৌধুরী! গুডনাইট সন্তু!