০৪. দিল্লি শহরে খুব গণ্ডগোল

সেদিন দিল্লি শহরের অনেক রাস্তাতেই খুব গণ্ডগোল, মারামারি চলল। পরের দিন কারা যেন ডেকে বসল। হরতাল। বাস, ট্যাক্সি, অটো রিকশা সব বন্ধ। সকালের দিকে কয়েকটা প্ৰাইভেট গাড়ি বেরুলেও লোকেরা বন্ধ করে দিল ইট-পাটকেল মেরে। দিল্লির চওড়া-চওড়া রাস্তাগুলো একেবারে ফাঁকা।

এত বড় একটা ব্যস্ত শহরকে দিনের বেলা একেবারে শুনশান দেখলে কেমন অদ্ভুত লাগে!

আগের রাত্তিরে সন্তু ফিরে এসেছিল গেস্ট হাউসে। সকাল থেকে সে ছটফট করছে। কী করে সেই নার্সিংহোমে কাকাবাবুর সঙ্গে দেখা করতে যাবে? গাড়ি বন্ধ বলে নরেনকাকাও আসতে পারবেন না। সন্তু যে রাস্তা চেনে না। না হলে সন্তু হেঁটেই চলে যেতে পারত।

বেলা এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর সন্তু আর থাকতে পারল না, বেরিয়ে পড়ল। সন্তু জানে, হরতালের দিন রাস্তা দিয়ে হাঁটলে কেউ কিছু বলে না। কয়েকটা সাইকেলও চলছে।

বেশিদূর যেতে হল না, একটু পরেই একটা পুলিশের গাড়ি এসে থামল সন্তুর পাশে। ড্রাইভারের পাশ থেকে নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, উঠে পড়ো সনটু! একেলা কোথা যাচ্ছিলে?

একটু বাদেই ওরা পৌঁছে গেল নার্সিং হোমে।

কাকাবাবু খুব উদ্‌গ্ৰীব হয়ে বসে ছিলেন। ওদের দেখেই ব্যস্ত হয়ে বললেন, এসেছ? আমি ভাবছিলাম যে কী করে আসবে! শোনো নরেন্দ্র, রফি মার্গ কোথায়? এখান থেকে হেঁটে যাওয়া যায়?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, রফি মার্গ? সে তো এখান থেকে অনেক দূর। এটা চিত্তরঞ্জন পার্ক আর রফি মার্গ সেই কনট প্লেসের কাছে। হেঁটে যাওয়া অসম্ভব।

কাকাবাবু বললেন, নেপোলিয়ন কী বলেছিলেন জানো না? অসম্ভব বলে কিছু নেই তাঁর ডিকশনারিতে।

সেটা নেপোলিয়নের বেলা সত্যি হতে পারে। কিন্তু সকলের পক্ষে নয়। কী ব্যাপার, তুমি রফি মার্গ পর্যন্ত হেঁটে যেতে চাও নাকি?

হ্যাঁ। আর দেরি করে লাভ নেই। চলো, বেরিয়ে পড়া যাক।

কাকাবাবু উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন, নরেন্দ্ৰ ভার্মা বাধা দিয়ে বললেন, আরে, ঠারো, ঠারো! হঠাৎ রফি মার্গ হেঁটে যেতে হবে কেন সেটা শুনি!

কাকাবাবু বললেন, আল মামুন ফোন করেছিল একটু আগে।

তোমার এ-ঘরে তো ফোন নেই?

দোতলায় আছে। সেখানে নেমে গিয়ে আমি ফোন ধরেছি।

এখনও তোমার ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, এই অবস্থায় সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্যায় করেছ। যাই হোক, তারপর কী বলল, টেলিফোনে?

গুরু, মুফতি মহম্মদ আবার ঘোরের মাথায় ছবি আঁকতে শুরু করেছেন। আজ আর ওখানে কোনও লোকজন নেই। আমরা এখন গেলে দেখতে পারি।

এই যে শুনেছিলুম উনি মাঝরাতে ছবি আঁকেন?

মাঝরাতেই যে আঁকবেন, তার কোনও মানে নেই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে আকিতে শুরু করেন। শুনলুম যে, উনি কাল সারারাত ঘুমোননি, বিছানার ওপর ঠায় বসেছিলেন, ঘুমিয়েছেন সকাল আটটায়। চলো, চলো, আর দেরি করে লাভ নেই।

শোনো রাজা, নেপোলিয়ন যাই-ই বলুন, তোমার পক্ষে এখন যাওয়া অসম্ভব। ডাক্তার তোমাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই বারণ করেছেন। আর তুমি ক্রাচ নিয়ে অতদূর যেতে চাও?

আরো ডাক্তারদের কথা সব সময় মানলে চলে না। আমি ভাল আছি বেশ। অনায়াসে যেতে পারব।

পগলামি কোরো না, রাজা। আমাদের মতন লোকেরই হেঁটে যেতে তিন-চার ঘণ্টা লাগবে। আর তুমি ক্ৰাচ নিয়ে কতক্ষণে পৌঁছবে? পুলিশের গাড়িটা ছেড়ে দিলাম…ঠিক আছে টেলিফোনে আর-একটা গাড়ি আনাচ্ছি, সেই গাড়িতে যাব।

কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, তা চলবে না। সে-কথা আগেই ভেবেছিলাম। আল মামুনকে আমি বলেছিলাম, আজ তো গাড়িঘোড়া চলছে না, যেতে গেলে পুলিশের সাহায্য নিতে হবে। আল মামুন তীব্র আপত্তি করে বলেছে, না পুলিশের গাড়িতে যাওয়া কিছুতেই চলবে না। ও-বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি থামলেই সকলের চোখে পড়ে যাবে। মুফতি মহম্মদের মতন সম্মানিত মানুষের কাছে পুলিশ এসেছে, এ-কথা জানলে তার শিষ্যরা চটে যাবে খুব?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, তাও একটা কথা বটে। পরদেশি নাগরিক, বটাকিসে ওদের কাছে পুলিশের গাড়ি যাওয়া ঠিক নয়। তা হলে কী উপায়?

হেঁটেই যেতে হবে। শুধু শুধু দেরি করছ, কেন?

রাজা, তুমি বুঝতে পারছ না, ক্র্যাচ নিয়ে হেঁটে পৌঁছতে তোমার কম সে কম চার ঘণ্টা লেগে যাবে। ততক্ষণ কি তোমার ঐ বুঢ়া-বাবা বসে বসে ছবি আঁকবেন?

কাকাবাবু এবারে ব্যাপারটা বুঝলেন। মুখখানা গভীর হয়ে গেল। এ তো আর পাহাড়ে ওঠা নয়, শুধু শুধু একটা শহরে চার-পাঁচ ঘণ্টা হাঁটার কোনও মানে হয় না!

একটু চুপ করে থেকে কাকাবাবু বললেন, আর একটা উপায় আছে, কোনও ডাক্তারের গাড়ি যেতে পারে, তাই না? ডাক্তারের গাড়ি কিংবা হাসপাতালের গাড়ি নিশ্চয়ই আটকাবে না?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, হা, তা হতে পারে। দেখি কোনও ডাক্তারের গাড়ি জোগাড় করা যায় কি না।

সন্তু বলল, সাইকেলেও যাওয়া যায়। আমি দেখলুম রাস্তায় সাইকেল চলছে।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছিস। তা হলে দেখলি তো সাইকেল শেখারও উপকারিতা আছে। এক-এক সময় কত কাজে লাগে। ডাক্তারের গাড়ি যদি করা না য়ায়, তাহলে তুই আর নরেন্দ্র সাইকেলে চলে যেতে পারবি। পায়ের জন্য আমি তো আজকাল আর সাইকেল চলাতে পারি না।

নরেন্দ্ৰ ভামানীচে থেকে ঘুরে এসে বললেন, এখন তো একটাও ডাক্তারের গাড়ি নেই। তবে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভ্যান একটু বাদেই ফিরবে।

কাকাবাবু অস্থিরভাবে বললেন, একটু বাদে মানে কতক্ষণ বাদে? দ্যাখো, না হয় দুটো সাইকেলই জোগাড় করো।

শেষ পর্যন্ত তাই-ই করতে হল। নানান জায়গায় টেলিফোন করেও কোনও ডাক্তারের গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেল না। সবাই বলেছে, আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারে। কাকাবাবু অত দেরি করতে রাজি নন। নার্সিং হোমের দরোয়ানদের কাছ থেকে দুটো সাইকেল জোগাড় হল, তাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সন্তু আর নরেন্দ্ৰ ভামা।

এ রকম ফাঁকা রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে আরাম। হরতালের দিন কলকাতার রাস্তায় ছেলেরা ফুটবল খেলে, কিন্তু দিল্লিতে সে-রকম কিছু দেখা যাচ্ছে না। রাস্তায় মানুষজন খুব কম।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সেই কলেজ-জীবনের পর আর সাইকেল চালাইনি। তোমার কাকাবাবুর পাল্লায় পড়ে কত কী যে করতে হয় আমাকে! অবশ্য, খারাপ লাগছে না। আচ্ছা সনটু, একটা সত্যি কথা বলবে?

হ্যাঁ, বলুন।

একটা বুড়া সাধু কী সব ছবি আঁকছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার কি কোনও মানে আছে? আমরা কি বুনোহাঁস তাড়া করছি না?

সব ব্যাপারটা আমি এখনও বুঝতে পারছিনা, নরেনকাকা।

চলো, গিয়ে দেখা যাক!

সাইকেলে রফি মার্গ পৌঁছতেই এক ঘণ্টার বেশি লেগে গেল। নরেন্দ্ৰ ভার্মা দিল্লির সব রাস্তা খুব ভাল চেনেন, তাই ঠিকানা খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না।

এই রাস্তার সব বাড়িই অফিসবাড়ি বলে মনে হয়। তারই মধ্যে একটি ছোট, হলদে রঙের দোতলা বাড়ি। ছোট হলেও বাড়িটি দেখতে খুব সুন্দর, সামনে অনেকখানি ফুলের বাগান।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, এই রাস্তা দিয়ে কতবার গেছি, কিন্তু এ-বাড়িতে যে ইজিপশিয়ানরা থাকে, কোনও দিন জানতেই পারিনি। দিল্লিতে যে কত কিসিমের মানুষ থাকে।

গেটের সামনে একজন দরোয়ান বসে আছে। তার কাছে আল মামুনের নাম করতেই সে দোতলায় উঠে যেতে বলল।

সারা বাড়িটা একেবারে নিস্তব্ধ, কোনও মানুষ আছে বলে মনেই হয় না। দোতলাতেও সিঁড়ির মুখে কোলাপসিবল গেট। ওরা সেখানে এসে দাঁড়াতেই আল মামুন একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওদের কোনও রকম শব্দ করতে নিষেধ করলেন। তারপর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, হোয়ার ইজ মিঃ রায়চৌধুরী?

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, গাড়ি জোগাড় করা যায়নি বলে তিনি আসতে পারেননি।

আল মামুনের মুখে একটা হতাশার চিহ্ন ফুটে উঠল। তিনি বললেন, আপনাদের তো ডাকিনি। আপনাদের দিয়ে কোনও কাজ হবে না। আপনারা ফিরে যান।

এই কথা বলে আল মামুন পেছন ফিরতেই নরেন্দ্ৰ ভার্মা গেটের মধ্য দিয়ে হাত ঢুকিয়ে আল মামুনের একটা হাত চেপে ধরলেন। তারপর খুব আস্তে অথচ দৃঢ় গলায় বললেন, আমি ভারত সরকারের প্রতিনিধি। মিঃ রায়চৌধুরী আমাকে আর তাঁর ভাইপোকে পাঠিয়েছেন। এখানে কী ঘটছে, তা দেখে গিয়ে রিপোর্ট করবার জন্য। এই হরতালের দিনেও আমরা কষ্ট করে এমনি-এমনি ফিরে যাবার জন্য আসিনি। গেট খুলুন।

নরেন্দ্ৰা ভার্মা এমনিতে হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু এক-এক সময় তাঁর মুখখানা এমন কঠিন হয়ে যায় যে, দেখলে ভয় লাগে।

আল মামুন আর দ্বিরুক্তি না করে গেট খুলে দিলেন। তারপর বললেন, জুতো খুলে ফেলুন!

খালি পায়ে একটা টানা বারান্দা পেরিয়ে এসে ওরা ঢুকল একটা মাঝারি সাইজের ঘরে। সে-ঘরে খাট-বিছানা পাতা, কিন্তু বিছানাতে কেউ নেই। বিছানার ঠিক পাশেই অন্য একটা ঘরে যাওয়ার দরজা।

আল মামুন ওদের ইশারা করলেন সেই দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে।

অন্য ঘরটিতে রয়েছে একটা টেবিল আর কয়েকখানা চেয়ার। একটা চেয়ারে বসে আছেন একজন খুবই লম্বা মানুষ, পরনে একটা কালো রঙের আলখাল্লা। তাঁর মাথার চুল ধপধাপে সাদা উলের মতন, আর মুখভর্তি সাদা দাড়ি পাতলা তুলোর মতন। হাতে একটা লাল ফেলটি পেন, টেবিলের ওপর একটা বড় হলদে কাগজে তিনি ছবি আঁকছেন।

সত্যি, দেখলে মনে হয় যেন তিনি ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে আঁকছেন। চোখ দুটি প্ৰায় বোজা, হাতের কলমটা দিয়ে একটা দাগ কেটে থেমে যাচ্ছেন, তারপর খানিকক্ষণ চুপচাপ। আবার একটা দাগ কাটছেন।

সন্তু আর নরেন্দ্ৰ ভার্মা প্রায় নিম্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। এই দৃশ্য। একজন সাতানব্বই বছরের বৃদ্ধ চেয়ারে সোজা হয়ে বসে ছবি আঁকছেন, এ যেন বিশ্বাসই করা যায় না।

মুফতি মহম্মদ একবার হঠাৎ এই দরজার দিকে তাকালেন। তাঁর চোখ দুটো খোলা, তবু তিনি ওদের দেখতে পেলেন কি না বোঝা গেল না। একটুও বিরক্ত হলেন না। বরং তাঁর মুখে যেন একটা পবিত্ৰ ভাব ফুটে আছে। দেখলেই ভক্তি জাগে।

আবার মুখ ফিরিয়ে ছবি আঁকাতে মন দিলেন।

নরেন্দ্র ভ্যামাসতুকে চোখের ইঙ্গিতে বললেন, এবার চলো!

ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে খানিকটা আসতেই সিঁড়িতে ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দ উঠল।

আল মামুন ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। সিঁড়ির মুখের কোলাপসিবল গেট তিনি ভুল করে খোলা রেখে এসেছিলেন। তিনি গেট পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই ভেতরে ঢুকে এলেন ক্রাচ বগলে নিয়ে একজন মানুষ।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, আনডনটেড রাজা রায়চৌধুরী! তাঁকে কেউ পেছনে ফেলে রেখে আসতে পারে না!

কাকাবাবু হাসিমুখে বললেন, তোমরা চলে আসার পরেই একটা অ্যামবুলেন্স পেয়ে গেলাম।

তারপর তিনি আল মামুনকে জিজ্ঞেস করলেন, খবর কী? এখনও ছবি আঁকছেন?

ওরা তিনজনই এক সঙ্গে মাথা নাড়ল।

কাকাবাবু বললেন, চলো। আমি একটু দেখি। ওঁর সঙ্গে আমার কথা বলা খুব দরকার।

আল মামুন সজোরে মাথা নেড়ে বললেন, নো নো নো, দ্যাট ইজ আউট অব কোয়েশেচন। ওঁকে এই অবস্থায় কিছুতেই ডিসটার্ব করা যাবে না।

কাকাবাবু বললেন, আমার কথা বলাটা অত্যন্ত জরুরি। আপনারা বুঝতে পারছেন না, কারুর সঙ্গে কথা বলার জন্যই উনি ওই ছবিগুলো আঁকছেন?।

আল মামুন বললেন, কী করে কথা বলবেন আপনি? ওঁর গলার আওয়াজ নষ্ট হয়ে গেছে, উনি কোনও উত্তর দিতে পারবেন না। আপনার ইংরেজি প্রশ্নও উনি বুঝবেন না।

নরেন্দ্ৰ ভার্মা বললেন, আমিও সেই কথা ভাবছিলুম। রাজা, উনি তোমার প্রশ্ন বুঝবেন কী করে? আল মামুন যদি বুঝিয়ে দেন, তা হলেই বা উনি কী করে উত্তর দেবেন?

কাকাবাবু বললেন, উনি যে ভাষা বোঝেন, সেই ভাষাতেই আমি প্রশ্ন করব।

জামার পকেট থেকে কাকাবাবু একটা ভাঁজ-করা কাগজ বার করলেন। তারপর দেখালেন সেটা খুলে। তাতেও কতকগুলো ছোট-ছোট ছবি আঁকা।

কাকাবাবু বললেন, এই ছবির ভাষা তোমরা কেউ বুঝবে না, উনি হয়তো বুঝতে পারেন।

কাকাবাবুকে নিয়ে আসা হল সেই ঘরে। সন্তু আর নরেন্দ্ৰ ভার্মা দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার কাছে। আল মামুন কাকাবাবুকে নিয়ে ঢুকলেন পাশের ঘরে।

কাকাবাবুর ক্রাচের শব্দ পেয়ে চোখ তুলে তাকালেন মুফতি মহম্মদ। আল মামুন খুব বিনীতভাবে কিছু বললেন তাঁকে। খুব সম্ভবত কাকাবাবুর পরিচয় দিলেন।

কাকাবাবু কপালের কাছে হাত ছুইয়ে বললেন, আদাব।

তারপর তাঁর ছবি-আঁকা কাগজটা ছড়িয়ে দিলেন টেবিলের ওপর।

মুফতি মহম্মদ এখন নিশ্চয়ই জেগে উঠেছেন পুরোপুরি। কেননা, সেই কাগজক্ট দেখেই তাঁর মুখে দারুণ অবাক ভাব ফুটে উঠল। একবার কাগজটার দিকে, আর একবার কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকাতে লাগলেন তিনি।

তারপর হাতছানি দিয়ে কাকাবাবুকে কাছে ডাকলেন। কাকাবাবু তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই তাঁর লম্বা ডান হাত রাখলেন কাকাবাবুর মাথায়, নিজে চোখ বুজে রইলেন একটুক্ষণ। ঠিক যেন তিনি কাকাবাবুকে আশীবাদ করছেন ভারতীয়দের প্রথায়।

একটু পরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে লাল কলমটা তুলে ছবি আঁকতে শুরু করলেন।

কিন্তু তাঁর হাত যেন চলছেই না। খুব অলসভাবে দাগ কাটছেন, বোঝা যায় তাঁর হাত কেঁপে যাচ্ছে। একটুখানি একেই তিনি তাকাচ্ছেন কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবুঘাড় নাড়ছেন।

মাত্র তিনটি ছবি কোনওক্রমে আঁকার পরেই তাঁর হাত থেকে কলামটা খসে পড়ে গেল মাটিতে। মুখখানা বুকে পড়ল বুকের ওপর, তারপর একেবারে নুয়ে টেবিলের ওপর পড়ে যাবার আগেই কাকাবাবু আর আল মামুন দুদিক থেকে ধরে ফেললেন তাঁকে।