০২. ইংরেজ বড়লাটের নামে শহর

ইংরেজ বড়লাটের নামে শহর, তাই সন্তু আশা করেছিল, ক্যানিং বেশ সাজানো-গোছানো, সুন্দর, ছিমছাম জায়গা হবে। গাড়িটাকে একটা পেট্রোল পাম্পে রেখে ওরা খানিকটা হটবার পরেই বোঝা গেল, সেরকম কিছুই না। বেশ নোংরা আর ঘিঞ্জি শহর, কাদা-প্যাচপেচে ভাঙ রাস্তা, তার দু পাশে অসংখ্য ছোট-ছোট দোকান। সব জায়গায় কেমন যেন আঁশটে গন্ধ!

রাস্তার কাদায় কাকাবাবুর ক্রাচ বসে যাচ্ছে বলে তাঁর হাঁটুতে অসুবিধে হচ্ছে। তিনি বললেন, বছর সাতেক আগে আমি শেষবার ক্যানিং এসেছিলুম, তার চেয়েও জায়গাটা আরও খারাপ হয়ে গেছে। তবে, লঞ্চে ওঠার পর তোমাদের ভাল লাগবে। তার আগে থানাটা কোথায় চলো খোঁজ করা যাক।

লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ওরা থানায় পৌঁছে গেল।

কাকাবাবু জিপগাড়ি আর গোরুর গাড়ির দুর্ঘটনার কথা জানালেন। থানার বড় দারোগা বললেন যে, তিনি একটু আগেই টেলিফোনে ঘটনাটা জানতে পেরেছেন। ছোট দারোগাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে।

একটা খাতা টেনে নিয়ে বড় দারোগা বললেন, যাই হোক, আপনাদের নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে যান। পরে দরকার হতে পারে। উণ্ডেড লোকটাকে আপনারা ভর্তি করে দিয়েছেন তো?

সেই খাতায় নাম-টাম লিখে দেবার পর কাকাবাবু বললেন, দারোগীবাবু, আপনাকে আর-একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। বিদেশি যে-লঞ্চটা সমুদ্রে ভেসে এসেছে, সেটা এখন কোথায় আছে?

ভদ্রলোক চোখ তুলে কাকাবাবুকে একবার আপাদমস্তক দেখলেন। তারপর কড়া গলায় বললেন, কেন, সেটা আপনি জানতে চাইছেন কেন?

কাকাবাবু বললেন, একবার সেই লঞ্চটা একটু দেখতে চাই।

কেন? আপনারা কি কাগজের রিপোটার?

আজ্ঞে না। এমনই একটা কৌতূহল।

সেই লঞ্চটা দেখবার জন্য আপনারা কলকাতা থেকে এসেছেন?

হ্যাঁ।

এই কৌতূহলের কারণ জানতে পারি কি?

একটা বিদেশি লঞ্চ সমুদ্র দিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে এসেছে, সেটা দেখার জন্য তো কৌতূহল হতেই পারে, তাই না? লঞ্চটা দেখার কি কোনও বারণ আছে? অনেকেই তো দেখেছে, কাগজে কাগজে ছবি পর্যন্ত বেরিয়ে গেছে!

দারোগাবাবু কাকাবাবুর মুখের দিকে আর একবার ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, আপনার কী নাম বললেন? রাজা রায়চৌধুরী…মানে…সেই সবুজ দ্বীপের রাজা নামে বইটায়…

সন্তু পাশ থেকে বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ইনি সেই কাকাবাবু!

দারোগা আমনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ও, তাই বলুন! আমার প্রথম থেকেই মনে হয়েছিল…আপনার কত বড় বড় লোকের সঙ্গে চেনা…আপনি ইচ্ছে করলেই…কী খাবেন, স্যার, বলুন! চা? ডাবের জল?

কাকাবাবু বললেন, এখন কিছু খাব না। লঞ্চটা কোথায় আছে বলুন, আমাদের আজ রাতের মধ্যেই ফিরতে হবে।

বসুন, স্যার, বসুন আপনারা! একটু চা অন্তত খান। আমি সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। সুন্দরবন অঞ্চলটা ভাল করে চেনেন কি? নইলে বুঝতে পারবেন না!

বড় দারোগা একটা ম্যাপ বিছিয়ে ফেললেন টেবিলের ওপরে।

একটা পেন্সিলের উল্টোপিঠ দিয়ে বোঝাতে লাগলেন, এই যে দেখুন, ক্যানিং, আপনারা এখানে আছেন। তারপর বাসন্তী, তারপর এই গোসাবা। এখান থেকেই আসল সুন্দরবনের শুরু। জঙ্গলের পাশ দিয়ে এই চলে গেছে দত্তর গাঙ, সেটা গিয়ে পড়েছে হরিণভাঙা নদীতে। এদিকে দুপাশেই গভীর জঙ্গল কিন্তু। হরিণভাঙা নদী এখানে অনেক চওড়া হয়ে গিয়ে সমুদ্রে পড়ল। এ পাশটায় বাঘমারা ফরেস্ট। এইখানটায় এসে আটকে ছিল লঞ্চটা।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আটকে ছিল বলছেন কেন? এখন নেই?

লঞ্চটাকে ওখান থেকে গোসাবায় নিয়ে আসার কথা। এর মধ্যে পৌঁছে গেছে কি না সে খবর আমরা পাইনি। আপনারা এক কাজ করুন। পুলিশের একটা লঞ্চ যাচ্ছে ওদিকে। কলকাতা থেকে দুজন বড় অফিসার এসেছেন। মিঃ ভট্টাচার্যি আর মিঃ খান, তাঁরা যাচ্ছেন এস. পি. সাহেবের লঞ্চে। আপনার নাম শুনলে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবেন ওঁরা।

কাকাবাবু বললেন, ভটচার্যি মানে…অ্যাডিশনাল আই. জি.?

হ্যাঁ, হ্যাঁ!

ওঁকে আমি ভাল করেই চিনি। তা হলে ওঁদের লঞ্চে গেলেই তো ভাল হয়!

এক্ষুনি জেটিঘাটে চলে যান স্যার। ওঁদের লঞ্চ তাড়াতাড়ি ছাড়বে। মানে, আমারও তো জেটিঘাটে যাবার কথা ছিল, বুঝলেন না, বড়সাহেবরা সব এসেছেন, কিন্তু আমার কলেরার মতন হয়েছে, প্ৰতি দশ মিনিট অন্তর বাথরুমে.সেইজন্য ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি…

থানা থেকে বেরিয়ে ওরা রওনা দিল জেটিঘাটের দিকে। কাকাবাবু বললেন, আমি তো আর এ-রাস্তায় তেমন তাড়াতাড়ি যেতে পারব না। বিমান, তুমি আর সন্তু আগে আগে চলে যাও। পুলিশের লঞ্চ ছেড়ে চলে যেতে পারে। তোমরা গিয়ে আমার নাম করে একটু অপেক্ষা করতে বলো?

বিমান আর সন্তু ছুটি লাগাল। ওরা তো চেনে না, তাই লোককে জিজ্ঞেস করতে লাগল জেটিঘটি কোন দিকে। এমন সরু আর পিছল রাস্তা, তাতেও বেশ ভিড়। রাস্তােটা বড় পুকুরের পাশ দিয়ে নদীর ধারে বাঁধের উপর উঠেছে। এই বাঁধের ওপর দিয়ে আবার অনেকটা যেতে হয়।

জেটিঘাটের কাছে অনেকগুলো লঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে কোনটা যে পুলিশের লঞ্চ, তা বোঝবার উপায় নেই।

টিকিট ঘরের কাছে গিয়ে বিমান জিজ্ঞেস করল, পুলিশের লঞ্চ কখন ছাড়বে বলতে পারেন?

টিকিটবাবুটি গোমড়া মুখে প্রায় ধমক দিয়ে উত্তর দিল, পুলিশের লঞ্চ কখন ছাড়বে, তার আমি কী জানি! বন-বালা ছাড়বে পাঁচ মিনিটের মধ্যে, যদি টিকিট কাটতে চান তো বলুন!

বিমান বলল, না, আমাদের পুলিশের লঞ্চটাই দরকার। সেটা কোনখানে আছে, একটু দেখিয়ে দেবেন?

লোকটি বলল, আচ্ছা মুশকিল তো! আমি পুলিশের লঞ্চের খোঁজ রাখতে যাব কোন দুঃখে? আমি কি চোর না ডাকাত?

সন্তু এগিয়ে গেছে। জলের দিকে। তারই বয়েসি একটি ছেলে মাথায় করে কোনও যাত্রীর সুটকেস বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তার পাশে গিয়ে সন্তু জিজ্ঞেস করল, ভাই, বলতে পারো, এর মধ্যে পুলিশের লঞ্চ কোনটা?

ছেলেটি থেমে গিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বলল, হেথা নাই গো বাবু!

তারপর নদীর মাঝখানে একটা চলন্ত লঞ্চ দেখতে পেয়ে আবার বলল, হুই যে পুলিশের লঞ্চ। হুই যে যায়, মন-পবন।

বিমান ততক্ষণে সেখানে চলে এসেছে। ছেলেটির কথা শুনে সে বলল, এই রে, ছেড়ে চলে গেছে? কী হবে! লঞ্চটাকে থামানো যায় না?

মালবাহক ছেলেটি বলল, কোন যাবে না? আপনি বন-বালার সারেঙসাহেবকে গিয়ে বলেন না, হুইসিল বাজিয়ে থামিয়ে দেবে?

সারেঙকে এখন কোথায় পাব?

ঐ যে ডেকের উপরে চেক-লুঙ্গি পরে দাঁড়িয়ে আছে। উনিই তো সারেঙ সাহেব!

লঞ্চের ওপর থেকে একটা লম্বা কাঠের পাটাতন ফেলে দেওয়া হয়েছে। জেটির ওপর। একজন লোক পাশে একটা বাঁশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সেই বাঁশ ধরে, পাটাতনের সিঁড়ি দিয়ে লঞ্চে উঠতে হয়।

বিমান সেই পাটাতনের সিঁড়ির কাছে গিয়ে চেক-লুঙ্গি-পরা লোকটিকে ডেকে বলল, সারেঙসাহেব, হুইস্ল বাজিয়ে ঐ পুলিশের লঞ্চটা থামাবেন? আমাদের বিশেষ দরকার।

গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা সারেঙসাহেব একমনে গোঁফে তা দিচ্ছিলেন, বিমানের কথাটা শুনে একটা অদ্ভুত হাসি দিয়ে বললেন, অ্যাঁ? কী বললেন, পুলিশের লঞ্চ থামাব? কেন? কোথাও ডাকাতি হয়েছে?

বিমান একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, না, মানে সেসব কিছু নয়, এমনিই আমাদের খুব দরকার

সারেঙসাহেব বললেন, আপনার দরকার হয়, আপনি নিজেই হাঁক পাড়ুন। আমায় এর মধ্যে জড়াচ্ছেন কেন?

তারপর সারেঙসাহেব। আর একখানা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে ঢুকে গেলেন নিজের কেবিনে। পুলিশের লঞ্চ মন-পবন ততক্ষণে আরো দূরে চলে গেছে।

নিরাশ হয়ে সন্তু আর বিমান এল টিকিটঘরের দিকে।

বিমান বলল, আমি প্লেন চালাই আর এই সারেঙ সামান্য একটা লঞ্চ চালায়, কিন্তু সারেঙের কীরকম পাসোনালিটি দেখলি? আমাকে একেবারে আউট করে দিল।

সন্তু বলল, সারেঙসাহেবের গোঁফটা দেখেছি? ঠিক কাকাবাবুর মতন!

টিকিটঘরের ছোকরা বাবুট বলল, আপনারা কি বন-বালায় যাবেন? নইলে এখান থেকে একটু সরে দাঁড়ান।

বিমান বলল, কী ব্যাপার রে সন্তু? এখানে সবাই যে ধমকে কথা বলে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এর পরের লঞ্চ আবার কখন ছাড়বে?

আবার আড়াই ঘন্টা বাদে। আমি এক্ষুনি কাউন্টার বন্ধ করে দিচ্ছি।

বন-বালা লঞ্চ ছাড়ার টং টং শব্দ হল। পাটাতনের সিঁড়িও তুলে নেওয়া হল ওপরে।

সন্তু বলল, এই রে, কাকাবাবু তো এখনও এলেন না? তা হলে কি আমাদের এখানে আড়াই ঘন্টা বসে থাকতে হবে?

দূরে বাঁধের ওপর দেখা গেল কাকাবাবু আস্তে আস্তে আসছেন। বাঁধের ওপরেও মাঝে মাঝে কাদা জমে আছে, ক্র্যাচ ফেলার খুবই অসুবিধে।

বিমান টিকিটবাবুকে বলল, না, না, আমাদের এটাতেই যেতে হবে। আপনি বন-বালাকে একটু থামান অন্তত

টিকিটবাবু বলল, বন-বালাকে থামাব? কেন?

বিমান বলল, একজন লোক ঐ যে আসছেন। তাঁকে এটাতেই যেতে হবে!

একজন লোক আসছে বলে আমায় লঞ্চ লেট করাতে হবে? এ কি আবদার পেয়েছেন?

সন্তু বলল, একজন তো নয়, তিনজন। উনি এসে পৌঁছলে আমরাও যাব।

ও, তিনজন। তাই বলুন! তিনজনের জন্য থামানো যেতে পারে!

এই বলে টিকিটবাবু একটা হুইসলফ-র-র-র করে বাজালেন বেশ জোরে। বন-বালা। ততক্ষণে জেটি ছেড়ে গেছে। আবার ঘ্যাস-ঘ্যাস, টং-টাং শব্দ করে ধারে ভিড়ল।

কাকাবাবু এসে পৌঁছতেই সব কথা জানাল বিমান। কাকাবাবু বিশেষ বিচলিত হলেন না। তিনি বললেন, কী আর করা যাবে, এই লঞ্চেই গোসাবা পর্যন্ত যাওয়া যাক।

পকেট থেকে টাকা বার করে তিনি সন্তুকে দিয়ে বললেন, তিনখানা টিকিট কেটে নে?

পাটাতনের সিঁড়ি দিয়ে সন্তু লঞ্চে উঠে গেল সহজেই। বিমানেরও কোনও অসুবিধে হল না। মুশকিল হল কাকাবাবুকে নিয়ে। অত সরু পাটাতনের ওপর ক্র্যাচ ফেলা মুশকিল, তার ওপর আবার এক হাতে বাঁশের রেলিং ধরে ব্যালান্স রাখতে হবে। একটু এদিক-ওদিক হলেই নীচের জলকাদার মধ্যে ধপাস।

কাকাবাবু কী করে ওঠেন, সেটা দেখার জন্য একদল যাত্রী ডেকের ওপর ভিড় করে এল। যেন এটা একটা মজার ব্যাপার।

কাকাবাবু পাটাতনের ওপর এক পা দিয়ে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর ক্র্যাচ দুটো লঞ্চের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, সন্তু, ধর!

এবারে তিনি এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে সেই সিঁড়ি দিয়ে চলে এলেন।

একদল যাত্রী হাততালি দিয়ে উঠল। যেন এটা একটা সার্কাসের খেলা।

সন্তুর খুব রাগ হয়ে গেল। কিন্তু কিছু বলাও যায় না।

লঞ্চটা একেবারে যাত্রীতে ঠাসা। একতলায় একটুও জায়গা নেই। ছাদের ওপরে খোলা জায়গায় রোদ্দুরের মধ্যে ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে হল। বিমান একটু চলে গেল সারেঙসাহেবের কেবিনের দিকে, তাঁর সঙ্গে ভাবি জমাতে, আর এই সুযোগে কাকাবাবুর চোখের আড়ালে গিয়ে একটা সিগারেট টানতে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এটা কী নদী?

কাকাবাবু বললেন, এই নদীর নাম মাতলা। এক সময় খুব বিরাট আর দুদন্তি নদী ছিল। এখন মাঝখানে চড়া পড়ে গেছে! সব নদীগুলোরই অবস্থা এখন কাহিল।

পারের দিকে একটা পুরনো আমলের মস্ত বড় বাড়ির দিকে আঙুল তুলে কাকাবাবু বললেন, ঐ যে বাড়িটা দেখছিস, ওটা ছিল হামিলটন সাহেবের কাছারিবাড়ি। হ্যামিলটন সাহেব ছিলেন জমিদার, সুন্দরবনের এদিককার অনেক উন্নতি করেছেন। গোসাবায় গিয়ে আরও দেখতে পাবি।

বিমান ফিরে এসে বলল, সারেঙসাহেবের নাম হাসান মিজা। আমায় কোনও পাত্তাই দিল না। আমি বললুম, আমি প্লেন চালাতে জানি, আমার একটু লঞ্চ চালাতে শিখিয়ে দেবেন? তা শুনে মিজাসাহেব বললেন,  আপনার পেট গরম হয়েছে আপনি চা খাওয়া একদম বন্ধ করে দিন। সকালবেলা কুলখ ভিজিয়ে খান? কুলখ কলাইকী জিনিস, কাকাবাবু?

কাকাবাবু খুব হাসতে লাগলেন।

সন্তু বলল, বিমানদা, তুমি প্লেন চালাও শুনে সারেঙ ভেবেছে তুমি গুল মারছ, কিংবা পাগল হয়ে গেছ?

বিমান বলল, কী ঝঞ্ঝাট! যারা চালায়, তারা বুঝি সুন্দরবনে বেড়াতে আসতে পারে না? আর সুন্দরবনে বেড়াতে এলে তো এই সব লঞ্চেই চাপতে হবে।

তারপরেই নদীর দুধারে তাকিয়ে বিমান বলল, কই, জঙ্গল দেখতে পাচ্ছি না তো!

কাকাবাবু বললেন, আসল জঙ্গল এখনও অনেক দূর! তবে মাঝে-মাঝে এমনি জঙ্গল দেখতে পাবে।

বিমান বলল, বেশ লাগছে কিন্তু। ভাগ্যিস এসেছিলুম। আপনাদের সঙ্গে! সেই কলেজে পড়ার সময় একবার গঙ্গায় চেপেছিলুম, তারপর আর কখনও লঞ্চে করে বেড়াইনি।

সন্তু বলল, তুমি আজ সুন্দরবনের নদীতে বেড়াচ্ছ, আবার দুদিন বাদেই নিউ ইয়র্কে চলে যাবে। তোমার বেশ মজা, না বিমানদা?

বিমান বলল, রোজ রোজ প্লেন চালাতে আর অত ভাল লাগে না রে! নিউ ইয়র্কে আমি অন্তত একশো বার গেছি। তার চেয়ে এই বাড়ির কাছেই নতুন জায়গায় বেড়াতে বেশি ভাল লাগছে।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই এক কাজ কর তো। এখানে না দাঁড়িয়ে তুই বরং সারা লঞ্চটা একবার টহল দিয়ে আয়। যদি কোথাও শুনিস যে, লোকেরা সেই বিদেশি লঞ্চটা নিয়ে আলোচনা করছে, তাহলে মন দিয়ে শুনবি।

সন্তু চলে যেতেই গেরুয়া কাপড় আর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা, মুখে কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা একজন লোক কাকাবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল। দু হাত তুলে বলল, নমস্কার, রায়চৌধুরী মশাই! এদিকে কোথায় চললেন?

কাকাবাবু বেশ অবাক হলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, আপনাকে চিনতে পারলুম না তো! আপনিই বা আমায় কী করে চিনলেন? আপনি কে?

লোকটি বলল, আমার নাম ছোট সাধু। আমার আর অন্য কোনও নাম নেই। আমার বাবাকে সবাই বলত বড় সাধু, সেই হিসেবে আমি ছোট সাধু।

আপনি আমায় চেনেন? আপনাকে কখনও দেখেছি বলে তো মনে হয়।!

আপনি আমায় মনে রাখেননি। কিন্তু আমি মনে রেখেছি। আপনি খোঁড়া মানুষ, আপনাকে একবার দেখলেই চেহারাটা মনে থাকে।

বিমান বিরক্ত হয়ে সাধুটির দিকে তাকাল। সত্যিকারের খোঁড়া লোককে কেউ মুখের ওপর খোঁড়া বলে? এ আবার কী রকমের সাধু?

কাকাবাবু, কিন্তু না রেগে গিয়ে হাসলেন। লোকটির চোখের উপর চোখ রেখে বললেন, হ্যাঁ, আমাকে একবার দেখলে মনে রাখা সহজ। কিন্তু আমারও তো স্মৃতিশক্তি খারাপ নয়। মানুষের মুখ আমি চট করে ভুলি না। আপনার সঙ্গে আমার কোথায় দেখা হয়েছিল, বলুন তো?

কথাটার উত্তর না দিয়ে ছোট সাধু এদিক-ওদিক তাকালেন। আরও অনেক লোক কাকাবাবুর দিকে কৌতূহলী চোখে চেয়ে আছে। লঞ্চের যাত্রীরা আর-সবাই স্থানীয় লোক, কাকাবাবু আর বিমানকে দেখলেই বোঝা যায়, ওঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন।

অন্যরা যাতে শুনতে না পায় এই জন্য ছোট সাধু কাকাবাবুর কানের কাছে মুখ এনে ফিস ফিস করে বললেন, জেলখানায়! ব্যাস, ও সম্বন্ধে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। আপনি কি রাঙাবেলের মাস্টারবাবুর কাছে যাচ্ছেন? তা হলে আমার আশ্রমে একবার আসবেন। আমিও রাঙাবেলেতেই থাকি।

এই সময় একটা বাচ্চা ছেলে এসে বিমানের জামা ধরে টেনে বলল, ও দাদা, সারেঙসাহেব আপনাকে ডাকছেন।

বিমান ছেলেটির সঙ্গে চলে গেল।

ছোট সাধু বললেন, রায়চৌধুরীসাহেব, আপনার মতন মানুষ এই রকম সাধারণ লঞ্চে যাচ্ছেন কেন? আপনি চাইলেই গবরমেন্টের এসপেশাল বোট পেতে পারতেন। এই ভিড়ের মধ্যে আপনার কষ্ট হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, কিসের কষ্ট? তবে একটু বসতে পারলে ভালহ লগত। গোসাবা যেতে কতক্ষণ লাগবে?

তা ধরেন, তিন সাড়ে-তিন ঘন্টা তো বটেই। এদিকে থাকবেন বুঝি কিছুদিন?

না, আজই রাতে ফিরব।

আজ আপনার ফেরা হবে না।

তার মানে? কেন ফেরা হবে না?

আপনারা তো সাধু-সন্ন্যাসীতে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু দেখবেন, আমার কথাটা ফলে কি না। আজ আপনি ফিরতে পারবেন না।

আমি রাঙাবেলিয়া যাচ্ছি না। শুধু গোসাবা পর্যন্ত যাব।

দেখুন কী হয়।

বিমান ফিরে এসে উত্তেজিতভাবে বলল, আমাদের খুব গুড লাক, কাকাবাবু, পুলিশের লঞ্চটা মাঝ-নদীতে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এখন এই লঞ্চটা ওর পাশে ভিড়তে পারে। সারেঙসাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, পুলিশের কর্তারা আমাদের চিনতে পারবেন তো?

কাকাবাবু বললেন, অ্যাডিশনাল আই. জি. রণবীর ভট্টাচাৰ্য আছেন ঐ লঞ্চে, তিনি আমায় ভালই চেনেন।

একটু বাদেই দুটো লঞ্চ পাশাপাশি হয়ে গেল। পুলিশের লঞ্চের ওপরের ডেকটা একদম খালি, শুধু সারেঙ-এর পাশে বসে আছে। একজন পুলিশ অফিসার।

কাকাবাবু সেই পুলিশটিকে চেঁচিয়ে বললেন, রণবীর ভট্টাচার্যকে বলুন, আমার নাম রাজা রায়চৌধুরী। খুব জরুরি দরকারে এক্ষুনি তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।

পুলিশটি জিজ্ঞেস করল, আপনি কি খবরের কাগজের লোক? গোসাবায় গিয়ে দেখা করবেন। সাহেব এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন!

কাকাবাবু ধমক দিয়ে বললেন, আপনার সাহেবকে গিয়ে আমার নামটা বলুন! এখন বেলা এগারোটা বাজে, এখন বিশ্রাম নেবার সময় নয়।

এই লঞ্চের কিছু লোক এই কথায় হেসে উঠল। ঐ লঞ্চের ভেতর থেকে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন একজন খুব লম্বা মানুষ। নীল রঙের প্যান্ট সাদা হাওয়াই শার্ট পরা। মুখের ভাব দেখলেই বোঝা যায় তিনি একজন বড় অফিসার।

মুখে সরাসরি রোদ পড়েছে বলে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে তিনি বললেন, কী হয়েছে? আরে, কে? কাকাবাবু নাকি? আপনি এখানে…চলে আসুন, চলে আসুন, এই লঞ্চে চলে আসুন।

দুটো লঞ্চ একেবারে গায়ে-গায়ে ঘেঁষে দাঁড়াল। সন্তু ততক্ষণে উঠে এসেছে ওপরে। একে একে ওরা যেতে লাগল। অন্য লঞ্চটাতে। কাকাবাবু ছোট সাধুকে বললেন, চলুন, আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন।

ছোট সাধু হঠাৎ যেন ভয় পেয়ে বললেন, না, না, আমি কেন যাব!

কাকাবাবু বললেন, আপনি গোসাবা পর্যন্ত যাবেন তো? ঐ লঞ্চটা আগে পৌঁছবে, সেখানে আপনাকে নামিয়ে দেব। আপনার সঙ্গে গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে।

গোসাবায় না, আমি আগে বাসন্তীতে নামব, সেখানে আমার অন্য কাজ আছে।

বেশ তো সেখানেই আপনাকে নামিয়ে দেওয়া যাবে।

না, তার দরকার নেই। আমি এই লঞ্চেই নিয়মিত যাই, সবাই আমায় চেনে–

কাকাবাবু ছোট সাধুর কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, চলুন, চলুন, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে?

খুব অনিচ্ছার সঙ্গেই ছোট সাধু এলেন পুলিশের লঞ্চে। অন্য লঞ্চটা আবার দূরে চলে গেল।

রণবীর ভট্টাচাৰ্য হাসতে হাসতে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, মহাকাশ থেকে কোনও উল্কা সুন্দরবনে খসে পড়েছে। নাকি? কিংবা জঙ্গলের মধ্যে কোথাও কণিষ্কর মুণ্ডু পাওয়া গেল? নইলে আপনি এদিকে.

কাকাবাবু বললেন, এদের নিয়ে সুন্দরবনে বেড়াতে এসেছি। সন্তুকে তো তুমি চেনো, আর এ হচ্ছে বিমান, আমাদের পাড়ার ছেলে। আর এই সাধুটির সঙ্গে নতুন পরিচয় হল।

রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, চলুন, চলুন, নীচে চলুন, ওপরে যা রোদ।

বিমান জিজ্ঞেস করল, আপনাদের লঞ্চটা হঠাৎ থেমে গেল কেন?

রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, একটা মাছ ধরার নৌকে যাচ্ছিল, তাতে বেশ বড় বড় পার্শে মাছ রয়েছে। তাই আমি খালাসিদের বললুম, নৌকোটাকে ডেকে দুতিন কিলো মাছ কিনে নাও। এরকম টাটকা মাছ তো কলকাতায় পাওয়া যায় না।

বিমান বলল, ভাগ্যিস লঞ্চটা থেমেছিল, নইলে তো আপনাদের ধরতেই পারতুম না!

নীচে একটা টেবিলের চারপাশে অনেকগুলো চেয়ার। সেখানে আরও দুজন পুলিশ অফিসার বসে আছেন। টেবিলের ওপর তাস বেছানো। তিনজন খেলোয়াড়, অথচ চার জায়গায় তাস দেওয়া হয়েছে।

রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, আমরা কাটগ্রেট ব্রিজ খেলছিলুম। আপনার গলা শুনে আমি ওপরে উঠে গেলুম। ইনি হলেন চব্বিশ পরগনার এস. পি আকবর খান, ইনি এখানকার এস. ডি. পি. ও. প্রশান্ত দত্ত। আর ইনি কাকাবাবু, তোমরা চেনো তো? কাকাবাবুর নাম রাজা রায়চৌধুরী, কিন্তু এখন তো সবাই কাকাবাবু বলেই ডাকে। আমি দিল্লি গিয়েছিলুম, হোম সেক্রেটারি পর্যন্ত জিজ্ঞেস করলেন, কাকাবাবু কেমন আছেন? কনভে মাই রিগার্ডস টু হিম!

অন্য দুজনের মধ্যে আকবর খানকেই শুধু জাঁদরেল পুলিশ সাহেবের মতন দেখতে। ফসর্গ রং, মুখে পাকানো গোঁফ আর খুব শক্তিশালী চেহারা। রণবীর ভট্টাচার্যকে দেখলে কিন্তু পুলিশের কতা বলে মনেই হয় না, মনে হয় যেন কোনও কলেজের প্রফেসার। আর প্রশান্ত দত্তের বয়েস অন্য দুজনের তুলনায় বেশ কম, মনে হয় ক্রিকেট-খেলোয়াড়।

ছোট সাধুর দিকে তাকিয়ে প্রশান্ত দত্ত কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, একে আপনি কোথায় পেলেন? আগে থেকে চিনতেন?

কাকাবাবু বললেন, আমি চিনি না, কিন্তু ইনি আমাকে চেনেন বললেন। এবার বলুন তো, সাধুমহারাজ, আপনার সঙ্গে আমার জেলখানায় কেন দেখা হয়েছিল? আপনি জেলখানায় কী করছিলেন? আমিই বা সেখানে গিয়েছিলুম কেন?

ছোট সাধু বললেন, সে প্রায় সাত-আট বছর আগেকার কথা। আমি তখনও সাধু হইনি, একটু অন্য লাইনে গিয়েছিলুম। এখন আর স্বীকার করতে লজ্জা নেই, চুরি-জোচুরিতে হাত পাকিয়েছিলুম। অসৎ সঙ্গে পড়লে যা হয়! ছ। মাস জেল খেটে শায়েস্তা হয়ে গেছি। তারপর থেকেই ধর্মে-কর্মে মন দিয়েছি। দেখুন স্যার, ঋষি বাল্মীকিও তো আগে ডাকাত ছিলেন, পরে সাধু হন।

রণবীর ভট্টাচার্য হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, বাঃ! বাঃ! তা আপনিও কি এখন রামায়ণের মতন কোনও কাব্য-টাব্য লিখছেন নাকি?

ছোট সাধু বললেন, না, স্যার! অত বিদ্যে আমার নেই। তবে ভগবান আমাকে দয়া করেছেন। স্বপ্নে আমি একটা ওষুধ পেয়েছি, সেই ওষুধে যাবতীয় পেটের রোগ নিঘাত সেরে যায়। এই এলাকার অনেক লোক আমার কাছে ওষুধ নিতে আসে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোন জেলে ছিলেন? সেখানে আপনার সঙ্গে আমার দেখা হল কী করে?

ছোট সাধু বললেন, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানে শোভনলাল বলে একজন ফাঁসির আসামী ছিল। ফাঁসির আগের দিন সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল। আপনি দেখা করতে গিয়েছিলেন। শোভনলাল আপনার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদল খুব। অতবড় একজন দুদন্তি খুনে যার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, সেই মানুষকে কি ভোলা যায়? সেইজন্যই আপনার কথা আমার মনে আছে।

রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, ও, সেই শোভনলালের কেস? সে আপনাকেও খুন করতে গিয়েছিল না, কাকাবাবু?

কাকাবাবু ছোট সাধুকে বললেন, তা। আপনি জেল থেকে ছাড়া পাবার পরেই সাধু হয়ে গেলেন?

ছোট সাধু বললেন, আঞ্জে হ্যাঁ স্যার। বিশ্বাস করুন, তারপর আর আমি কোনওদিন খারাপ লাইনে যাইনি। তাছাড়া আমার বাবাও স্বর্গে গেলেন, আমাকে আশ্রমের ভার নিতে হল।

প্রশান্ত দত্ত বলল, এই সাধু সম্পর্কে আমার কাছে কিন্তু অন্যরকম রিপোর্ট আছে। সুন্দরবনের দিককার বড় বড় স্মাগলাররা গভীর রাত্রে এই সাধুর আশ্রমে যাতায়াত করে। তারা কেন আসে বলুন তো!

আকবর খান বললেন, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি এর কথা।

ছোট সাধু বললেন, তারা পেটের রোগের ওষুধ নিতে আসে, স্যার। যে আসে, তাকেই দিই। তাদের মধ্যে কে স্মাগলার আর কে ভাল লোক তা আমি কী করে চিনব বলুন তো?

প্রশান্ত দত্ত বলল, আপনি প্রত্যেক সপ্তাহে দু তিনবার কলকাতায় যান, সে খবরও পেয়েছি। আশ্রম ছেড়ে এত ঘনঘন কলকাতায় যান কেন আপনি?

আমার ওষুধ বানাবার জন্য মালপত্র কিনতে যেতে হয়। অনেক রকম গাছের শেকড় লাগে, সেগুলো কলকাতা ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।

সেজন্য সপ্তাহে দু তিনবার যেতে হয়? আজও কলকাতা থেকে ফিরছেন?

রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আরে, আমারও তো নানান রকম পেটের রোগ, কোনও ওষুধেই সারে না। এবারে তাহলে আপনার ওষুধ খাব। দিন দেখি, সাধুবাবা, আমায় কিছু ওষুধ দিন।

ওষুধ তো সঙ্গে নেই, স্যার  নেই?

তাহলে কলকাতা থেকে কী সব গাছের শেকড়-বাকড় কিনে আনলেন, সেগুলো একটু দেখান তো! কবিরাজি ওষুধের ওপর আমার খুব বিশ্বাস আছে। কই, দেখান?

ছোট সাধু আমতা আমতা করে বললেন, না, স্যার, এবারে কোনও শেকড়-বাকড় আনিনি। হাতিবাগান বাজারে একটা দোকানে অর্ডার দিয়ে এসেছি, পরের বার গিয়ে নেব।

আপনার জামাটা একবার খুলুন তো!

রণবীর ভট্টাচার্যের হঠাৎ এই কথায় ছোট সাধু একেবারে হকচকিয়ে গেলেন। ভুরু দুটো কপালে তুলে বললেন, কী বলছেন স্যার, জামা খুলিব? কেন?

রণবীর ভট্টাচার্য হাসিমুখে বললেন, আরে, খুলুন না মশাই, দেখি, আপনার স্বাস্থ্যখানা কেমন! জানো প্রশান্ত, সাধুদের স্বাস্থ্য খুব ভাল হয়। ভাল ঘি-দুধ খায় তো! কই, খুলুন, খুলুন।

ছোট সাধু বললেন, দেখুন, স্যার, আমি এই লঞ্চে আসতে চাইনি। রায়চৌধুরীসাহেব আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে এলেন। তা বলে আপনারা আমাকে হুকুম দিয়ে জামা খোলাবেন? এ ভারী অন্যায়!

রণবীর ভট্টাচার্য বললেন, হুকুম দিলাম কোথায়? জামাটা খুলবেন, আপনার বুকের ছাতির মাপটা একটু দেখব। এতেই আপনার আপত্তি?

ছোট সাধু বললেন, হ্যাঁ স্যার, আমার আপত্তি আছে। বাসন্তী বোধহয় এসে গেল, আমায় সেখানে নামিয়ে দিন।

আকবর খানের চেয়ারের পায়ের কাছে একটা কাল রঙের ছোট সুটকেস রয়েছে। সেটা তিনি তুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। সুটকেসটি খুলে তার মধ্য থেকে একটা রিভলভার বার করে প্রথমে নলটায় দুবার ফুঁ দিলেন, তারপর সেটা সোজা ছোট সাধুর কপালের দিকে তাক করে খুব ঠাণ্ডাভাবে বললেন, শুনুন, সাধুবাবা, একখানা গুলি ছুঁড়লেই আপনি অক্কা পাবেন। তারপর আপনার ডেডবডিটা জলে ফেলে দেব। এখন ভাটার সময়। জলের টানে আপনার বডিটা সোজা চলে যাবে। কেউ কোনওদিন কিছু জানতেও পারবে না। সেটা আপনি চান, না জামাটা খুলবেন?

রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, আরো আকবর, তুমি শুধু শুধু সাধুবাবাকে ভয় দেখাচ্ছ। উনি এমনিতেই খুলবেন জামাটা। কী, তাই না?

কাকাবাবু বললেন, কী কুক্ষণেই আপনি যেচে আজ আমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলেন! নইলে আপনাকে এরকম বিপদে পড়তে হত না। আর উপায় নেই, এবারে জামাটা খুলে ফেলুন!

কাকাবাবুর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে ছোট সাধু আস্তে আস্তে জমাটা খুলে ফেললেন। তখন দেখা গেল, তাঁর সারা বুকে ব্যাণ্ডেজ জড়ানো।

এবারে প্রশান্ত দত্ত উঠে গিয়ে সেই ব্যাণ্ডেজ ধরে এক টান দিতেই তার ভেতর থেকে ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগল একশো টাকার নোট।

রণবীর ভট্টাচাৰ্য বললেন, প্রশান্ত, টাকাগুলো গুনে রাখো কত আছে।

তারপর সন্তুর দিকে ফিরে তিনি বললেন, বুঝলে তো সন্তু, এই সাধুবাবা স্মাগলারদের চোরাই মালপত্তর কলকাতায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে। সাধুর পোশাকে থাকে তো, তাই ওকে কেউ সন্দেহ করে না। তবে, এ অতি ছোটখাটো ব্যাপার!

বিমান বলল, মাই গড়। লোকটিকে দেখে আমি একবারও সন্দেহ করিনি!

এই সময়ে ওপরে যে পুলিশটি ছিল, সে দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বলল, স্যার, স্যার, নদী দিয়ে একটা লাশ ভেসে যাচ্ছে। কী করব, লঞ্চ থামাব?