সাধুবাবার হাত (গল্প)

সন্তু বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলেজে যাবার জন্য বাসে উঠতে যাবে, এই সময় একটি বেশ জবরদস্ত চেহারার সাধু তার মুখোমুখি দাঁড়াল। সাধুটির মাথায় জটা, মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল, চোখ দুটি জ্বলজ্বল করছে। বেশ লম্বা চেহারা, পরনে একটা গেরুয়া আলখাল্লা।

মেঘের ডাকের মতন গম্ভীর গলায় ভাঙা-ভাঙা বাংলায় সে বলল, এই লেড়ক, কুথা যাচ্ছিস? কলেজে? আজ তোর কলেজে যাওয়া হোবে না। গেলে তোর খুব বিপদ হবে। যা যা, ঘরে ফিরে যা।

সন্তু শুনে হাসল, একজন সাধুর কথা শুনে সে কলেজে যাওয়া বন্ধ করবে, এমন ছেলেই সে নয়। আর কলেজে গেলে যদি তার বিপদের সম্ভাবনা থাকে, তা হলে তো সে আরও বেশি করে যাবে। বিপদের গন্ধ পেলেই তার মন চনমান করে ওঠে।

সে বলল, আচ্ছা সাধুবাবা, নমস্কার। তোমার কথা যদি মিলে যায়, তা হলে তোমাকে পরে একদিন মিষ্টি খাওয়াব! এখন চলি।

হন হন করে পা চালিয়ে সে এগিয়ে গেল মােড়ের দিকে। দূরে বাস আসছে। হঠাৎ সন্তু পকেটে হাত দিল। এই রে, সে তো পয়সা আনেনি। জামা বদলেছে একটু আগে, আগের জামার পকেটে পয়সাগুলো রয়ে গেছে। বাসে উঠলে সে ভাড়া দিতে পারত না।

আবার তাকে ফিরে আসতে হল, বাড়ির সামনে সেই সাধুবাবা দাঁড়িয়ে অন্য একটি লোকের হাত দেখছে। সন্তুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসল। ভাবখানা যেন এই, কী বলেছিলুম না, কলেজে যেতে পারবি না।

সন্তু মনে মনে ঠোঁট উল্টে বলল, বাস ভাড়া নিতে ভুলে গেছি, এটা আবার একটা বিপদ নাকি? কী আর হত, বড় জোর মাঝপথে বাস থেকে নামিয়ে দিত। এক্ষুনি আমি আবার পয়সা নিয়ে কলেজে যাব।

বাড়িতে ঢুকে সন্তু আগের জামাটা খুঁজতে গিয়ে দেখল সেটা সে ভুল করে বাথরুমে ছেড়ে এসেছে, আর মা এখন বাথরুমে ঢুকে বসে আছেন।

তা হলে একটু দেরি করতে হবে। কলেজের ফার্স্ট পীরিয়ডটা বোধহয় আর করা হবে না।

এই সময় ঝনঝন করে বেজে উঠল টেলিফোন।

সন্তু টেলিফোনের রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে ভেসে এল তার বন্ধু জোজো-র গলা।

জোজো বললে, কী রে, তুই কলেজে যাবার জন্য বেরিয়ে পড়িসনি তো? যাক, ভাল করেছিস। আজ কলেজ ছুটি হয়ে গেছে।

সন্তু চমকে উঠে বলল, অ্যাঁ? কলেজ ছুটি? কেন?

জোজো বললে, আমাদের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল মারা গেছেন। হঠাৎ। আমি গিয়ে দেখি নোটিস ঝুলছে। তুই বাড়িতে থাক, আমি দুপুরবেলা যাচ্ছি। তোর কাছে।

টেলিফোনটা রেখে দিয়ে সন্তু একটুক্ষণ ভুরু কুচকে বসে রইল। ব্যাপারটা কী হল? রাস্তার একজন সাধুবাবা তাকে দেখে একটা কথা বললেন, আমনি সেটা মিলে গেল? পুরোটা মেলেনি অর্ধেকটা। সত্যি তো তার কলেজে যাওয়া হল না।

দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখল, সাধুবাবা তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে একজন লোকের হাত দেখছেন।

কৌতূহলী হয়ে সন্তু সেখানে গিয়ে দাঁড়াল।

ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোকের হাত ধরে সাধুবাবা বলছেন, তুমি যব ছোটা থা, একবার তোমার পা ভেঙে গেল? ঠিক কি না?

লোকটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সাধুবাবা পা ভেঙেছিল। দুমাস বিছানায় শুয়ে ছিলাম।

সাধুবাবা মাথা নেড়ে আবার বললেন, এখন তোমার পেট মে দরদ আছে। পেট বেথা করে মাঝে মাঝে? ঠিক কি না? শনি বক্রি আছে, শনি কাটাতে হবে।

লোকটি বলল, হ্যাঁ, মাঝে মাঝে পেটের ব্যথায় খুব কষ্ট পাই।

তুমি নোকরি করে…না, বেওসা? হাঁ হাঁ, হাতে লেখা দেখছি বেওসা।

হাঁ সাধুবাবা, আমি ছোটখাটো একটা ব্যবসা করি। তবে ইদানীং আমার ব্যবসার…

তুমার এক বন্ধু জিগরি দোস্ত, তুমকে চোট দিয়েছে। তোমার বেওসা ক্ষতি করে দিয়েছে।

লোকটি এবারে কাঁদো কাঁদো ভাব করে বলল, হ্যাঁ, সাধুবাবা, আমার এক বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করে আমার ব্যবসার সর্বনাশ করে দিয়েছে।

সাধুবাবা গম্ভীরভাবে বললেন, শনি বক্রি আছে। আংটি ধারণ করতে হবে। সন্তু রীতিমতন অবাক। সাধুবাবা প্ৰত্যেকটি কথা মিলিয়ে দিচ্ছেন কী করে? হাত দেখে এরকম বলা যায়? কাকাবাবু তো একদিন তাকে বলেছিলেন। যে হাত দেখার ব্যাপারটা একেবারে গাঁজাখুরি? আংটি বা মাদুলি ধারণ করাটাও কুসংস্কার।

সন্তু মুখ তুলে দেখল কাকাবাবু ও-বাড়ি থেকে বেরুলেন তক্ষুনি। সে ডেকে উঠল, কাকাবাবু, এদিকে এসো, একবার দ্যাখো।

সাধুবাবাকে দেখে কাকাবাবু হাসি মুখে কাছে এসে বললেন, কী আংটি বিক্রি করার চেষ্টা হচ্ছে বুঝি?

সন্তু তাড়াতাড়ি বললে, কাকাবাবু, এই সাধুবাবা হাত দেখে যা বলছেন, সব মিলে যাচ্ছে।

সন্তুর কথায় মন না দিয়ে কাকাবাবু ধুতিপরা ভদ্রলোকটিকে বললেন, ও মশাই, সাধুবাবাজী আপনার হাত দেখে কী কী বলেছে? ছোটবেলােয় আপনার একবার হাত কিংবা পা ভেঙেছিল? আপনার পেটে কিংবা বুকে ব্যথা? আপনার অফিসের চাকরি কিংবা ব্যবসার অবস্থা এখন ভাল নয়? একজন বন্ধু আপনার ক্ষতি করেছে।

এবারে সন্তু আর সেই ভদ্রলোক দুজনেই স্তম্ভিত। কাকাবাবু এসব কথা জানলেন কী করে?

কাকাবাবু বললেন, মশাই, ছেলেবেলায় কার না একবার হাত-পা ভেঙেছে। আমাদের সবারই ও-রকম হয়। অনেক বাঙালিরই পেটের রোগ থাকে, মুখ দেখেই বোঝা যায়। চাকরি কিংবা ব্যবসার ব্যাপারেও সকলেরই কিছু না-কিছু অভিযোগ থাকে। বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে যাওয়াও এমন কিছু নতুন কথা নয়। বিশেষ করে আপনাদের বয়েসেই বেশি হয়।

সাধুবাবা কটমট করে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুম কেয়া বোলতা হ্যায়? তুম ভাগো হিঁয়াসে।

কাকাবাবু একটু ভয় পাবার ভান করে বললেন, ওরে বাবা ভস্ম করে দেবে নাকি?

সাধুবাবা বললেন, তুমি আপনা রাস্তামে যাও। তুম জানো আমি কে আছি? আমি মানুষের অতীত ভবিষ্যৎ বর্তমান সব কিছু দেখতে পারি।

কাকাবাবু ধুতিপরা ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই সব আংটির পাথর-টাথরের সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের কোনও যোগ নেই, বুঝলেন? এটা আমার কথা নয়, পঁচাত্তর জন নোবেল পুরস্কার-প্রাপ্ত বৈজ্ঞানিক এই কথা বলেছেন। পেটের রোগ কিংবা ব্যবসার রোগ আংটিতে সারে না।

সাধুবাবা এবারে কাকাবাবুর কাঁধে এক চাপড় মেরে বললেন, বেওকুফ, তুই আমার কথা অবিশ্বাস করছিস। তুই দেখবি আমার ক্ষমতা? দ্যাখ।

সাধুবাবা এবারে নিজের মাথার জটা থেকে কয়েকটা চুল ছিড়লেন পট করে। তারপর ধুতিপরা ভদ্রলোকটিকে ধমকে বললেন, ফুঁ দেও! ফুঁ দেও!

ভদ্রলোকটি ভয় পেয়ে ফুঁ দিলেন সেই চুলে কয়েকবার। সাধুবাবা তারপর হাতটা একবার ঘুরিয়ে কাকাবাবুর মুখের সামনে এনে মুঠো খুললেন।

দেখা গেল সেই মুঠোতে চুল নেই, রয়েছে খানিকটা ছাই!

সাধুবাবা হুংকার দিয়ে বললেন, দেখ দেখ? মাথার চুল ছাই হয়ে গেল।

কাকাবাবু বললেন, এ তো অতি সাধারণ ম্যাজিক। আমিও ও-রকম দু-একটা ম্যাজিক জানি। ওসব থাক। সাধুবাবাজী তুমি যে লোকজনের হাত দেখে বেড়াও, তোমাকে দু-একটা প্রশ্ন করি। তুমি জাপানের হিরোসিম নাগাসিকার নাম শুনেছ? ওই দুটো শহরে অ্যাটম বোমা পড়েছিল। অ্যাটম বোমা ফাটার কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক লক্ষ লোক মারা যায়। এখন বলো তো, ওই সব লোকের হাতে কি লেখা ছিল যে, তারা একসঙ্গে মারা যাবে?

সাধুবাবা বললেন, কেয়া অ্যাটম বোম! বোম ভোলানাথ।

কাকাবাবু বললেন, ও তুমি অ্যাটম বোমা কি তা জানো না! ঠিক আছে, ট্রেন কাকে বলে জানো তো? গত সপ্তাহে ট্রেন দুর্ঘটনায় যে আড়াই শো লোক মারা গেল; তাদের কি হাতে লেখা ছিল যে, তারা একই দিনে একসঙ্গে মরবো?

সাধুবাবা ধমক দিয়ে বললেন, ও সব বাত ছোড়ো! তুমার হাত দেখে আমি যদি সব কুছ বলে দিতে পারি?

কাকাবাবু বললেন, আমার হাত দেখার দরকার নেই। তোমার হাতটা বরং দেখি তো?

কাকাবাবু খপ করে সাধুবাবার বাঁ হাতটা চেপে ধরে উৎফুল্লভাবে বললেন, বাবা, হাতে সব লেখা আছে দেখছি! বাড়ি কোথায় ছিল বিহারে, তাই না?

সাধুবাবা আপত্তি করতে পারলেন না। মুখটা একটু হাঁ হয়ে গেল।

কাকাবাবু আবার বললেন, যব লেড়কী থা, একবার হাত ভেঙেছিল না?

সাধুবাবা মাথা দুদিকে জোরে জোরে নেড়ে বললেন, নেহি! নেহি মিলা!

কাকাবাবু বললেন, ও হাত না, পা! পা ভেঙেছিল! ঠিক না?

সাধুবাবা এবারে হাতটা ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেন।

কাকাবাবু বললেন, দাঁড়াও দাঁড়াও, আরও বলছি। তুমি যে সাধু হবে, তা তোমার হাতেই লেখা আছে, দেখছি। কেন সাধু হলে? আচ্ছা সাধুবাবা, তোমাদের গ্রামে একটা খুন হয়েছিল না? সত্যি কথা বলো…

সাধুবাবা এবারে এক ঝটিকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে উল্টো দিকে ফিরে এক দৌড় লাগালেন। মিলিয়ে গেলেন চোখের নিমেষে।

কাকাবাবু হাসতে লাগলেন হো হো করে।

ধুতিপরা লোকটি ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, ও মশাই, আপনি যা বললেন, তা সত্যি নাকি? আপনি কী করে জানলেন? হাত দেখে বলে দিলেন, ওদের গ্রামে খুন হয়েছে?

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, আন্দাজে, সব আন্দাজে বলেছি।

2 Comments
Collapse Comments
মশিউর রহমান June 19, 2020 at 2:42 pm

শেষ করলাম কাকাবাবুসমগ্র।খুবই খারাপ লাগছে কারণ পর্বটা শেষ হয়ে গেল।আরো অনেক থাকতো যদি, খুব খুশি হতাম।আসলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতি আমার অন্যরকম একটা শ্রদ্ধা জন্মে গেছে।কাকাবাবুর প্রতিটি ঘটনা তিনি ভিন্ন জায়গায়,ভিন্ন কায়দায়,ভিন্ন সমাধানে তৈরি করেছেন।এটাই একটা বিস্ময়ের ব্যাপার।রহস্যগল্প পড়তে আমি ভীষণ পছন্দ করি।সত্যি কথা বলতে এযাবৎকালে আমার পড়া রহস্যগল্পের মধ্যে কাকাবাবুসমগ্রকেই শ্রেষ্ঠ বলব।বেঁচে থাকলে আমি অবশ্যই সুনীলবাবুর সাথে দেখা করতে যেতাম।কিন্তু সে সৌভাগ্য আমার হলো না।তবুও তাকে আমি হ্রদয় থেকে ভালোবাসি।সবিশেষ বাংলা লাইব্রেরীর সকল সদস্যকে এত পরিশ্রম করে পিডিএফ তৈরি করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।সকলের জন্য শুভকামনা রইলো।ও একটা কথা ! আমি কিন্তু সন্তুর বয়সী !

ভালো লেগেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *