০৪. পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে সন্তু জোজোকে জিজ্ঞেস করল, সব কটা লিখেছিস?

জোজো বলল, তোর এত দেরি হল কেন? আমি তো অনেক আগেই সব শেষ করে বসে আছি।

সন্তু বলল, আজ তো এক্ষুনি বাড়ি ফেরার কোনও মানে হয় না। এখন কী করা হবে, ভেবে রেখেছিস?

জোজো বলল, আগে এখান থেকে পালা! শিগগির!

সন্তু একটু অবাক হয়ে বলল, কেন, পালাতে হবে কেন?

জোজো সন্তুর হাত টেনে ধরে বলল, অন্য বন্ধুরা ধরবে! পরীক্ষা শেষ হলে সবাই দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যায়। একেবারে টিপিক্যাল। যেন আমরা অন্য সময় সিনেমা দেখি না। রাহুল, অনিন্দ্যরা আমাকে সিনেমা দেখার কথা বলেও রেখেছে। আমাদের নতুন কিছু করতে হবে।

প্রায় দৌড়েই ওরা রাস্তা পেরিয়ে চলে এল খানিকটা দূরে একটা পার্কের কাছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তা হলে নতুন কী করবি?

জোজো বলল, তুই মনুমেন্টের উপরে কখনও উঠেছিস?

সন্তু বলল, মনুমেন্ট! না। ওঠা যায় বুঝি?

জোজো বলল, কেন যাবে না? ভিতরে সিঁড়ি আছে। আজ আমরা মনুমেন্টের মাথায় উঠব। উঠে চিৎকার করে বলব। শোনো বন্ধু, শোনো! আজ আমাদের পরীক্ষা শেষ হল! আজ আমরা স্বাধীন! তা ধিন তা ধিন তা ধিন.

সন্তু হাসতে হাসতে বলল, স্বাধীন কী রে? পরীক্ষা শেষ হল, তা বলে তো পড়াশুনো শেষ হয়নি। এখনও আরও তিন বছর…!

জোজো বলল, তুই পড়বি! তুই তো ফিজিক্স পড়তে চাস। আমি আর এসব লাইনে নেই। আমি আর্ট কলেজে ভরতি হব।

সন্তু বলল, তুই আর্ট কলেজে চান্স পাবি?

জোজো দুই ভুরু তুলে বলল, আমি চান্স পাব না? আমি জোজোমাস্টার, মাত্র আঠারো সেকেন্ডে যে-কোনও মানুষের মুখ এঁকে দিতে পারি। ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হচ্ছে সতেরো সেকেন্ড। পিকাসো পারতেন, আমার এক সেকেন্ড বেশি লাগে।

সন্তু বলল, তুই যদি এতই ভাল পারিস, তা হলে তোর আর্ট কলেজে

আর শেখার দরকার কী?

জোজো বলল, ঠিক বলেছিস। এটা ভেবে দেখতে হবে। চল, এখন মনুমেন্টে যাই।

পরীক্ষার শেষদিন বলে ওদের দুজনেরই বাড়ি থেকে একশো টাকা করে হাতখরচ দেওয়া হয়েছিল। একটা ট্যাক্সি ধরে ওরা চলে এল ময়দানে মনুমেন্টের কাছে। যেখান দিয়ে মনুমেন্টে ঢুকতে হয়, সেখানে একটা লোহার দরজায় দুটো মোটা মোটা তালা ঝুলছে।

সন্তু হতাশভাবে বলল, যাঃ!

জোজো বলল, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? চাবি ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। আর চাবি যদি না পাই, তা হলে তালা দুটো ভেঙে ফেললেই হবে।

সন্তু বলল, সে কী রে, তালা ভাঙবি কী? তা হলে আমাদের পুলিশে ধরবে না? ওই দ্যাখ, একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।

কাছেই একজন কনস্টেবল এক আলুকাবলিওয়ালার কাছ থেকে আলুকাবলি খাচ্ছে।

জোজো তার কাছে গিয়ে বলল, অফিসার সাহেব, আপনার কাছে কি এই গেটটার চাবি আছে?

কনস্টেবলটি হাসিহাসি মুখে বলল, আমি অফিসারও নই, সাহেবও নই। এই চাবিও আমার কাছে নেই। এই চাবি থাকে লালবাজারে।

জোজো বলল, আপনি অফিসার নন, চাবিও আপনার কাছে নেই। তা হলে আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

কনস্টেবলটি জোজোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বলল, কেন, আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার আপত্তি আছে নাকি?

জোজো বলল, না, আপনি দাঁড়িয়ে থাকতে চান তো থাকুন। আমরা এই গেটের তালা দুটো ভাঙলে আপনি সেদিকে তাকাবেন না!

কনস্টেবলটি বলল, তালা ভাঙবে? তাই নাকি? তা হলে তো তোমাকে অ্যারেস্ট করতেই হবে! সোজা নিয়ে গিয়ে লকআপে পুরে দেব। বেশি তেড়িবেড়ি করলে ডান্ডা বেড়ি খেতে হবে।

জোজো বলল, তেড়িবেড়ি মানে কী? ডান্ডা বেড়ি মানেই বা কী?

কনস্টেবলটি বলল, সে যখন হবে, তখন বুঝবে!

জোজো এবার বেশ তেজের সঙ্গে বলল, আমাকে লকআপে পুরবেন? জানেন আমি কে? পুলিশ কমিশনার গৌতমমোহন চক্রবর্তী আমার মামা! আমি জোজো, তাঁর ভাগনে। আমার গায়ে হাত ছোঁয়াবার সাহস হবে আপনার? পরশুই তো গৌতমমামা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আমপোড়া শরবত খেতে। আমার মায়ের হাতের লাউ-চিংড়ি খেতেও উনি খুব ভালবাসেন।

কনস্টেবলটি এবার আলুকাবলিওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, গত সপ্তাহেই একটা পাগল এসেছিল, তুমি তো দেখেছিলে, তাই না? এইখানে ডিগবাজি খাচ্ছিল। আর বারবার বলছিল, পুলিশ কমিশনার তার মামা।

একবার বলেনি, অন্তত দশবার।

সে এবার জোজোর দিকে ফিরে বলল, সেও ভাগনে, তুমিও ভাগনে, তা হলে সেই পাগলটি কি তোমার ভাই?

জোজো বলল, নিশ্চয়ই! দুনিয়ার সব পাগলই আমার ভাই! আর পুলিশ কমিশনারদের অনেক ভাগনে থাকে।

সন্তু কাছে এসে জোজোর হাত ধরে টেনে বলল, অ্যাই, চল! এখানে সুবিধে হবে না। অন্য কোথাও যাই।

জোজো বলল, আমার মনুমেন্টে চড়তে ইচ্ছে করছে। অন্য কোথাও যাব কেন? কোথায় যাব?

সন্তু বলল, গঙ্গার ধারে গিয়ে বরং একটা স্টিমারে উঠে পড়ি।

এই সময় একটা আশ্চর্য কাণ্ড হল। পা পোঁ আওয়াজ করে তিনচারখানা পুলিশের গাড়ি এসে থামল কাছেই। ঝটপট করে কয়েকজন পুলিশ সেই সব গাড়ি থেকে নেমে সারবেঁধে দাঁড়াল। আর-একটা সাদা রঙের গাড়ি থেকে নামলেন একজন বেশ লম্বামতো মানুষ, তাঁর মাথার চুল ধপধপে সাদা। একজন মহিলা আর দুটি বাচ্চাও নামল সেই গাড়ি থেকে।

সন্তু বলল, চল জোজো, কেটে পড়ি। এখানে আর আমাদের দাঁড়াতে দেবে না।

জোজো বলল, আর-একটু দাঁড়া না, দেখি। এই ভদ্রলোক কে রে? পুলিশ এত খাতির করছে?

সন্তু বলল, ইনি তো আমাদের রাজ্যপাল, গোপালকৃষ্ণ গাঁধী। কাগজে ফোটো দেখিসনি?

জোজো বলল, হ্যাঁ, সেইজন্যই চেনা চেনা মনে হচ্ছিল।

পুলিশরা রাজ্যপালকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, যাতে কেউ কাছে না যায়। জোজো হঠাৎ এক পুলিশের বগলের তলা দিয়ে গলে দৌড়ে রাজ্যপালের কাছে গিয়ে হাজির হল। তারপর বলল, স্যার, আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই!

একজন পুলিশ অফিসার জোজোর কাঁধ ধরে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, রাজ্যপাল তাকে বারণ করলেন।

তিনি বাংলা শিখেছেন, বাংলাতেই মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমাকে কী বলতে চাইছিলে, বলো!

জোজো বলল, স্যার, আমি আর আমার বন্ধু, ওই যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে, আজ আমাদের পার্ট-টু পরীক্ষা শেষ হল। আমরা এই মনুমেন্টের উপরে আজ উঠে দেখতে চাই। পুলিশরা আমাদের উঠতে দিচ্ছে না।

রাজ্যপাল বললেন, ও, এই কথা! আমিও তো আজ এর উপরে উঠব বলেই এসেছি। এটার ভিতরের অবস্থাটা কেমন, তাও দেখতে হবে। তোমরা দুজনেও এসো আমার সঙ্গে। পুলিশ কিছু বলবে না।

জোজো এবার বিজয়ীর ভঙ্গিতে পিছন ফিরে বলল, অ্যাই সন্তু, চলে আয়। আমরা মনুমেন্টের উপরে উঠব। তোকে বলেছিলুম না…!

প্রথম দেখা কনস্টেবলটির দিকেও হাত নেড়ে দিয়ে জোজো বলল, টা টা।

সে বেচারি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছে।

মনুমেন্টের ভিতরে ঘোরানো সিঁড়ি, অন্ধকার অন্ধকার। বোঝাই যায়, রাজ্যপাল আসবেন বলে আজ কিছুটা পরিষ্কার করা হয়েছে। একটুখানি

ওঠার পর হঠাৎ ফরফর শব্দ হতেই জোজো ভয় পেয়ে থেমে গেল।

সন্তু বলল, ভয়ের কিছু নেই। ওগুলো চামচিকে।

জোজো বলল, ভয় পাইনি। বিচ্ছিরি গন্ধ।

সন্তু বলল, এখানে অনেকদিন মানুষ ঢোকেনি মনে হচ্ছে। তাই কীরকম যেন ভ্যাপসা গন্ধ। চামচিকে ছাড়া বাদুড়ও থাকতে পারে।

জোজো বলল, বাদুড়? তা হলে আমি উঠব না।

বাদুড় অবশ্য দেখা গেল না। রাজ্যপাল আস্তে আস্তে উঠছেন, ওরা দুজন আগে উঠে গেল তরতরিয়ে। সবচেয়ে উঁচুতে। এখানে হু হু করছে হাওয়া। মনে হয়, পুরো কলকাতা শহরটাই দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। খানিক পরে রাজ্যপাল এসে প্রথমে জানতে চাইলেন, ওরা দুজন কোথায় থাকে, কী পড়ে।

জোজো বলল, এটার গেট তালাবন্ধ থাকে কেন? সবাই এসে কেন দেখতে পারে না?

রাজ্যপাল বললেন, পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছি সেকথা। আগে প্রতি রোববার দর্শকদের জন্য খোলা থাকত। স্কুলগুলো থেকে দলবেঁধে আসত ছেলেমেয়েরা। এখন পুলিশ বলছে, এটা খুব পুরনো হয়ে গিয়েছে তো, বেশি লোক এলে যদি ভেঙেটেঙে পড়ে, তাই আর গেট খোলা হয় না।

জোজো বলল, পুরনো হয়েছে, সারিয়ে নিলেই পারে।

রাজ্যপাল বললেন, ঠিক। বলব সেকথা। তবে কী জানো, এটা যখন তৈরি হয় তখন তো কলকাতা শহরে এর চেয়ে বড় কিছু ছিল না। চারদিকটা অনেক ফাঁকা ছিল। তখন নাকি এখান থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত দেখা যেত। এখন তো প্রায় সবদিকেই উঁচু উঁচু বাড়ি। হরাইজন, হরাইজন-এর বাংলা কী যেন?

সন্তু বলল, দিগন্ত।

রাজ্যপাল বললেন, ইয়েস, দিগন্ত। দিগন্ত আড়াল হয়ে গিয়েছে।

উলটো দিকে ফিরে তিনি বললেন, এই দিকটা তবু ফাঁকা আছে। গঙ্গা নদী। অনেক জাহাজ দেখা যাচ্ছে।

জোজো বলল, জাহাজ দেখলেই আমার ইচ্ছে করে উঠে পড়ে কোনও দূর দেশে চলে যাই।

রাজ্যপাল বললেন, আমারও ছেলেবেলায় সেরকম ইচ্ছে হত। সব বালকই বোধহয় দূরে কোথাও যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমি বন্দরে গিয়ে বসে থাকতাম। আমার কোথায় যেতে ইচ্ছে করত জানো? সাউথ আফ্রিকায়। ওখানে আমার গ্র্যান্ডফাদার, মানে ঠাকুরদা থাকতেন তো একসময়।

সন্তু বলল, মহাত্মা গাঁধী। তখন উনি ব্যারিস্টার ছিলেন।

রাজ্যপাল মাথা নাড়লেন।

জোজো বলল, আমাদেরও খুব আফ্রিকায় যেতে ইচ্ছে করে। কেনিয়ায়।

রাজ্যপাল ভুরু কুঁচকে বললেন, কেনিয়ায়। সেখানে কেন? সেখানে তোমাদের চেনাশুনো কেউ থাকে?

জোজো বলল, থাকেন না, আমাদের কাকাবাবু সেখানেই গিয়েছেন। অনেকবার কাকাবাবু যেখানে যান, আমাকে আর আমার এই বন্ধু সন্তুকে সঙ্গে নিয়ে যান। এবারে তিনি আমাদের না নিয়ে একাই চলে গিয়েছেন। রাজ্যপাল জিজ্ঞেস করলেন, এবারে তোমাদের সঙ্গে নেননি কেন?

জোজো বলল, আমাদের তো পরীক্ষা চলছিল। আজই শেষ হয়ে গেল। কাকাবাবু যদি আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতেন, তা হলে আমরাও যেতে পারতাম! জানেন, আমাদের কাকাবাবু খুব বিখ্যাত মানুষ, তিনি…!

সন্তু জোজোর পিঠে একটা চিমটি কাটল।

কাকাবাবু অন্যদের কাছে তাঁর সম্পর্কে বড় বড় কথা বলা একদম পছন্দ করেন না। বারণ করে দিয়েছেন। জোজোর মনে থাকে না। সন্তুর চিমটি খেয়ে সে থেমে গেল। রাজ্যপালও এই সময় মুখ ফিরিয়ে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন।

রাজ্যপাল আবার এদিকে তাকাতেই জোজো বলল, স্যার, আপনি একটু ব্যবস্থা করে দিন না। একটা জাহাজ কোম্পানিকে বলে দিন, আমাদের কেনিয়া নিয়ে যাবে।

রাজ্যপাল হেসে বললেন, তুমি তো ভারী দুষ্টু ছেলে? ভেবেছ, রাজ্যপালকে দিয়ে যা খুশি করিয়ে নেওয়া যায়? জাহাজ কোম্পানি আমার কথা শুনবে কেন? তা ছাড়া কাকাবাবু তোমাদের নিয়ে যাননি, ভালই করেছেন। পরীক্ষা শেষ হলেও তোমাদের পড়াশুনো তো শেষ হয়নি। এই বয়সটায় স্বপ্ন দেখবে, বড় হয়ে সত্যি সত্যি বেড়াতে যাবে দূর দূর দেশে।

তারপর তিনি সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেলেটি বেশ শান্ত। ভাল ছেলে।

জোজো বলল, ভাল ছেলে? আপনি জানেন না, ও কীরকম রিভলবারে গুলি চালাতে পারে।

রাজ্যপাল চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ গুলি চালায়?

সন্তু বলল, মোটেই আমি গুলি চালাই না। আমার কাকাবাবু আমাকে রিভলবার চালানো শিখিয়ে দিয়েছেন। যাতে খুব বিপদে পড়লে আত্মরক্ষা করতে পারি।

রাজ্যপাল বললেন, গুড। আশা করি, সেরকম বিপদে তোমাকে কখনও পড়তে হবে না।

রাজ্যপালকে তাঁর স্ত্রী ডাকতেই তিনি ওদের বললেন, এবার তো আমায় চলে যেতে হচ্ছে।

রাজ্যপাল নেমে যাওয়ার পর পুলিশও আর ওদের থাকতে দিল না।

নীচে নেমে এসে সন্তু বলল, আয়, এবার ফুচকা খাই।

জোজো নাক কুঁচকোল।

সন্তু এসব ভালবাসে, জোজো রাস্তার খাবার একেবারে পছন্দ করে না। দোকানের কচুরি-তরকারি তার ভাল লাগে।

সন্তু বলল, কচুরি-তরকারি পরে খাব। ওই যে ফুচকা পাওয়া যাচ্ছে।

জোজো অগত্যা রাজি হল। জোজো একদম ঝাল খেতে পারে না, সন্তুর আবার ঝাল চাই। জোজো কোনওরকমে খেল দুটো ফুচকা, সন্তু খেল দশটা।

মুখটুখ মুছে জোজো বলল, এবার আমি একটা সিগারেট খাব!

সন্তু ভুরু কুঁচকে বলল, সিগারেট? তুই খাস নাকি?

জোজো বলল, খাইনি কখনও। পরীক্ষা শেষ হলে খেতে হয়। তুই খাবি?

সন্তু বলল, না! আমার গন্ধটা ভাল লাগে না। জোজো চোখ নাচিয়ে বলল, গন্ধটা ভাল লাগে না? নাকি ভয় পাচ্ছিস? বাড়িতে বকবে। মুখে গন্ধ পাবে।

সন্তু বলল, ভয়ের কী আছে? আমার বাবা একসময় খুব সিগারেট খেতেন, এখন অবশ্য ছেড়ে দিয়েছেন। কাকাবাবুও তো আগে চুরুট খেতেন খুব। ঠিক আছে, চল, একটা টেনে দেখি।

জোজো একটা দোকান থেকে দুটো সিগারেট কিনল। দোকানদারের কাছ থেকেই চেয়ে আনল দেশলাই।

প্রথম সিগারেট ধরানো মোটেই সহজ নয়। সাত-আটটা কাঠি খরচ করে ফেলল জোজো। ধোঁয়া বেরোতেই টান মারল দুই বন্ধু।

দুবার টানার পরই দুজনেই কাশতে লাগল খকখক করে।

আর-একবার টেনে সন্তু অর্ধেক সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, ধুত, আমার পোষাবে না। লোকে কেন খায় এটা এত কষ্ট করে?

জোজোও আর টানতে পারল না। সে-ও ফেলে দিল। তবু বীরের মতো বলল, আমি পরে আবার প্র্যাকটিস করব। বড় আর্টিস্ট হতে গেলে ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে রাখতে হয়। ফোটোয় দেখিসনি?

সন্তু বলল, তা হলে তোকে দাড়িও রাখতে হবে।

জোজো বলল, তা তো রাখবই। নতুন স্টাইলের দাড়ি। ফ্রেঞ্চকাটও নয়, রবীন্দ্রনাথের মতোও নয়।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এখন আমরা কী করব?

জোজো বলল, দেখলি, মনুমেন্টে চড়ব বলেছিলুম, ঠিক চড়া হয়ে গেল।

সন্তু বলল, সত্যি, তুই পারিসও বটে! রাজ্যপালের সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেললি?

জোজো বলল, চল, এবার খিদিরপুরে যাব। ওই যে কয়েকটা জাহাজ দেখা গেল, ওর মধ্যে একটা ফরেন জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বলব, আমাদের আফ্রিকা পৌঁছে দিতে।

সন্তু বলল, পাগল নাকি? বিদেশি জাহাজের ক্যাপ্টেনকে বললেই আমাদের নিয়ে যাবে? টিকিটের পয়সা লাগবে না?

জোজো বলল, তুই কিছু জানিস না। আজকাল এইসব জাহাজে যাত্রী নেয়ই না। শুধু মালপত্র নিয়ে যায়। আমরা যাব ক্যাপ্টেনের গেস্ট হয়ে। সুতরাং টিকিট লাগার প্রশ্নই নেই। ই নানাবতীর নাম শুনেছিস?

সন্তু দুদিকে মাথা নাড়ল।

জোজো বলল, আর পি নানাবতী আমার কাকার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমরা ডাকতাম নানুকাকু। উনি ছিলেন ইন্ডিয়ান নেভির চিফ। পৃথিবীর সমস্ত জাহাজের ক্যাপ্টেন ওঁর নাম জানেন আর খুব সম্মান করেন। আমি গিয়ে নানুকাকুর নাম বলব, আর দেখবি ক্যাপ্টেনরা আমাদের কত খাতির করবেন।

সন্তু বলল, আজ থাক। আমি এখন বাড়ি যাই।

জোজো এক ধমক দিয়ে বলল, ধ্যাত! এখন সন্ধেও হয়নি, তুই এর মধ্যেই বাড়ি বাড়ি করছিস? পরীক্ষার শেষদিনে রাত আটটার আগে বাড়ি ফেরার নিয়ম নেই। বাড়ির লোকরাই এখন আমাদের ফিরতে দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। আটটার জায়গায় নটায় ফিরলে ক্ষতি নেই!

সন্তু বলল, আজই আফ্রিকায় গেলে আটটা-নটার মধ্যে ফিরব কী করে?

জোজো বলল, যদি জাহাজ পাওয়া যায়, তা হলে আর ফিরবই না। বাড়িতেও কোনও খবর দেব না। বাড়ির লোক চিন্তা করবেন ভাবছিস তো? চিন্তা করুন না। মাঝে মাঝে চিন্তা ভাল। আমরা জাহাজে ভেসে পড়ব, বাড়ির লোক ব্যস্ত হয়ে থানায় খবর দেবেন, হাসপাতালে ছুটবেন। কোথাও আমাদের পাত্তা না পেয়ে কাঁদতে শুরু করবেন। আমরা কাল ভোরে মাঝসমুদ্র থেকে ফোনে আমাদের খবর জানিয়ে দেব। আজকাল টেলিফোনের কতরকম সুবিধে হয়ে গিয়েছে। মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া থেকেও ফোন করা যায়। তারপর কাকাবাবুর কাছে পৌঁছে গেলে তো আর কোনও কথাই নেই। সে খবর জানার পর বাড়ির লোকদের কান্না একেবারে থেমে গিয়ে মুখে হাসি ফুটবে। আমরা পিকচার পোস্টকার্ড পাঠাব। সন্তুর সারামুখে হাসি ঝলমল করছে।

জোজো অবাক হয়ে বলল, হাসছিস যে বড়? আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? চল, খিদিরপুরে চল, দেখিয়ে দিচ্ছি, আমার কথা মেলৈ কি না।

সন্তু বলল, মিলতে তো পারেই তোর কথা। আমি বলি কী, খিদিরপুরে যাওয়ার আগে এদিককার গঙ্গার ঘাটে আগে যাই। ফেরিঘাটে একটা স্টিমারে চড়ে কিছুক্ষণ ঘুরে নিই। সমুদ্রে যাওয়ার আগে একবার গঙ্গায় ঘুরে বেড়ানো ভাল নয়?