০১. সকালবেলা কাকাবাবু দাঁতটাত মেজে

সকালবেলা কাকাবাবু দাঁতটাত মেজে বাথরুম থেকে বেরোতেই রঘু ফিসফিস করে বলল, আপনার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছেন, নীচের ঘরে বসে আছেন। খুব বড়লোক। কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, এত সকালে? তোকে বলেছি না, নটার আগে কাউকে ভিতরে বসাবি না? রঘু বলল, কী করব, দেখে যে মনে হল ভ্যাইপি! গম্ভীর গলা। এলেবেলে লোক হলে দরজাই খুলতাম না! ইনি খুব দামি সুট পরা।

রঘু আজকাল মাঝে মাঝেই ইংরেজি শব্দ বলে। তার নিজস্ব উচ্চারণে। আন্দাজে বুঝে নিতে হয়।

কাকাবাবু খানিকটা ধমকের সুরে বললেন, দামি সুট দেখেই তুই বুঝে গেলি ভি আই পি? অনেক চোর-ডাকাতও দামি পোশাক পরে! ধুতি কিংবা পাজামা পরা লোক বুঝি ভি আই পি হয় না?

রঘু সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে বলল, আজ্ঞে তাও হয়। এই তো আমাদের শিপ মিনিস্টার ধুতি পরা!

কাকাবাবু বললেন, ভি আই পি হোক বা যাই-ই হোক, এখন আমি কথা বলতে পারব না। বলে দে, নটার পর আসতে।

রঘু কাঁচুমাচুভাবে বলল, স্যার, আপনি তো নীচে নামবেনই, আপনিই বলে দিন না!

রঘু আগে বলত বাবু, এখন বলতে চায় স্যার। কাকাবাবু অনেকবার বারণ করেছেন, স্যার বলতে হবে না, তাও সে শুনবে না।

কাকাবাবু বললেন, কেন, তুই লোকটিকে ভয় পাচ্ছিস নাকি? ঠিক আছে, যা। চা-টা দিসনি তো? তা হলে আবার দেরি হবে।

রঘু জিভ কেটে বলল, আপনার বাথরুম থেকে বের হতে দেরি হচ্ছিল, তাই চা দিয়ে ফেলেছি। বিস্কুটও দিয়েছিলাম, বললেন, লাগবে না!

রঘু চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু পোশাক বদলাতে লাগলেন।

সারা বাড়িতে আর কেউ জাগেনি। কাল এক বিয়েবাড়িতে বাড়ির সকলের নেমন্তন্ন ছিল, ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। সন্তু এখনও ঘুমোচ্ছে, আজ ওর কলেজের ছুটি। যতই রাত জাগুন, কাকাবাবুর ঠিক ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায়। রোদ উঠবার আগেই তিনি বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে। অনেক দিনের অভ্যেস।

নীচে নেমে এসে কাকাবাবু দেখলেন, একজন লোক সোফায় বসে কাগজ পড়ছে।

লোকটির দশাসই চেহারা। লম্বায় ছফিট তিন-চার ইঞ্চি তো হবেই। রঘুর কথামতো, পরনের সুটটা খুব দামি ঠিকই। পায়ের কালো রঙের জুতো এমনই চকচকে পালিশ করা যে, মনে হয়, যেন মুখ দেখা যাবে। গায়ের রং বেশ ফরসা, নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো, মুখে পুরুষ্টু গোঁফ। প্রথম দেখেই মনে হয়, লোকটি পুলিশ কিংবা আর্মির অফিসার।

কাকাবাবুকে দেখেই লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, গুড মর্নিং মিস্টার রায়চৌধুরী।

কাকাবাবু হাত জোড় করে বললেন, নমস্কার।

লোকটির গলার আওয়াজ খুব ভরাট আর গম্ভীর। কিন্তু খুব বিনীতভাবে বলল, আমি খুব সকালে এসে পড়েছি। আপনি হয়তো বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ দরকার আছে।

কাকাবাবু বললেন, এই সময় তো আমি কোনও দরকার নিয়ে আলোচনা করি না।

লোকটি বলল, আমার বেশিক্ষণ লাগবে না।

কাকাবাবু বললেন, বেশি বা কম সময়ের প্রশ্ন নয়, প্রত্যেকদিন আমি মর্নিং ওয়াকে যাই। সেখান থেকে ফেরার আগে আমি কোনও কাজের কথা পছন্দ করি না।

লোকটি বলল, মর্নিং ওয়াক খুব ভাল অভ্যেস। আমিও যদি যাই আপনার সঙ্গে? হাঁটতে হাঁটতে আমার কথাটা সেরে নেব।

কাকাবাবু বললেন, আপনি নটার পর ঘুরে আসুন না।

লোকটি বলল, আমি কাল লেট নাইটে কলকাতায় পৌঁছেছি। আজই দিল্লি ফিরে যেতে হবে। সাড়ে আটটার মধ্যেই পৌঁছোতে হবে এয়ারপোর্টে। শুধু আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।

কাকাবাবু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, ঠিক আছে। চলুন।

বাইরে একটা সাদা রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অনেক হোটেলে এই ধরনের গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়।

লোকটি কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কত দূরে যাবেন?

কাকাবাবু হাত তুলে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, বেশি দূরে না। ওই যে পার্কটা দেখতে পাচ্ছেন, ওখানেই চারপাশে ঘুরি কয়েকবার।

লোকটি তার গাড়ির ড্রাইভারকে কিছু নির্দেশ দিয়ে ফিরে এসে বলল, ঠিক আছে, চলুন, মিস্টার রায়চৌধুরী।

ক্রাচ বগলে নিয়ে রাস্তায় নেমে কাকাবাবু বললেন, শুনুন, প্রথমেই বলে রাখি, কোনও চুরি-ডাকাতির ব্যাপার যদি হয়, আমি আপনাকে কিছু সাহায্য করতে পারব না। ওসব পুলিশের কাজ।

লোকটি বলল, না, না, সেরকম কিছু নয়। কোনও তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আপনাকে আমি বিরক্ত করতে আসিনি। আপনি ব্যস্ত মানুষ, আমি জানি।

কাকাবাবু বললেন, আমি এমন কিছু ব্যস্ত নই। মাঝে মাঝে আমিদু-একটা অ্যাডভেঞ্চারে যাই বটে, তাও নিজের শখে। টাকার জন্য ডিটেকটিভগিরি করা আমি মোটেও পছন্দ করি না। ওসব আমি পারি না। বেশির ভাগ সময়

আমি নিজের ইজিচেয়ারে শুয়ে বই পড়তে ভালবাসি।

লোকটি বলল, আপনি অনেক বই পড়েন, আপনি খুব জ্ঞানী মানুষ, তাও আমি জানি। আমার অবশ্য বইটই পড়ার অভ্যেস নেই। নিউজপেপারও পড়ি না। তবে, টিভিতে নিউজ দেখি।

কাকাবাবু বললেন, আপনি বেশ ভালই বাংলা বলছেন। কিন্তু আপনি বাঙালি নন, তাও বুঝতে পারছি। আপনি এত ভাল বাংলা শিখলেন কোথায়? কলকাতায় বাড়ি?

লোকটি বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি বাঙালি নই। তবে, আমার বাবা কাজ করতেন কলকাতায়, তখন আমি কলকাতায় থেকেছি। আমার নবছর বয়স পর্যন্ত। আমাদের কলকাতায় বাড়ি ছিল ভবানীপুরে। সেখানে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলেছি। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়েছি। সেই তখনই যে বাংলা শিখেছিলাম, তা ভুলিনি একটুও। সেই নবছর বয়সের পর কলকাতা ছেড়ে যাই। তারপর দুবার কলকাতায় এসেছি, তাও দু-একদিনের জন্য মাত্র। এতদিন পরেও বাংলা ঠিক মনে আছে।

পার্কের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নামটাই তো এখনও জানা হয়নি।

লোকটি মুখ নিচু করে বলল, হ্যাঁ, আমার নাম জানানো হয়নি। নাম বলার একটু অসুবিধে আছে।

কাকাবাবু থমকে গিয়ে অবাক হয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, নাম বলার অসুবিধে আছে? অথচ আপনি আমার সঙ্গে কাজের কথা বলতে এসেছেন?

লোকটি বলল, কাজের কথা তো বলতে আসিনি। একটা বিষয় নিয়ে শুধু কথা বলতে এসেছি।

কাকাবাবু কোনওরকমে বিরক্তি চেপে রেখে বললেন, কোনও বিষয়টিষয় জানার আগ্রহ আমার নেই। যে লোক নিজের নাম জানায় না, তার কাছ থেকে আমি অন্য কিছু জানতে যাব কেন?

লোকটি বলল, আচ্ছা, ধরে নিন, আমার নাম ধ্যানচাঁদ।

কাকাবাবু আরও বিরক্ত হয়ে বললেন, ধরে নেব? কেন, ধরে নিতে যাব কেন? তার মানে, এটা আপনার আসল নাম নয়। ধ্যানচাঁদ তো ছিল এককালের এক বিখ্যাত হকি খেলোয়াড়ের নাম!

লোকটি বলল, ঠিক বলেছেন। আমি আপনার সঙ্গে একটা খেলার বিষয়েই কথা বলতে এসেছি। সেই জন্যই ওই নামটা নিলাম।

কাকাবাবু এবার বিরক্ত হওয়ার চেয়েও অবাক হলেন বেশি। ভুরু কুঁচকে বললেন, খেলা? মশাই, আপনি কি আমার সঙ্গে সকালবেলা ইয়ারকি করতে এসেছেন?

লোকটি এবার গোঁফের ফাঁকে সামান্য হেসে বলল, না, ইয়ারকি মোটেই নয়, খুবই সিরিয়াস ব্যাপার! পুরোটা শুনলে বুঝবেন।

কাকাবাবু বললেন, আর কিছুই আমি শুনতে চাই না। আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে! আচ্ছা মিস্টার ধ্যানচাঁদ, আপনি ওসব খেলাটেলার কথা অন্য কাউকে গিয়ে বলুন। আমি এখন একা থাকতে চাই।

ধ্যানচাঁদ বলল, অন্য কারও কাছে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। খেলাটা হবে আপনার সঙ্গে আমার।

কাকাবাবু বললেন, কী মুশকিল! বললাম না, ছেলেমানুষি খেলাটেলার বয়স আমার নেই।

ধ্যানচাঁদ বলল, ছেলেমানুষি ব্যাপার তো নয়, এটা একেবারেই বড়দের খেলা। আর এ-খেলাটা আপনাকে খেলতেই হবে!

একটা বকুলগাছতলায় দাঁড়িয়ে পড়ে কাকাবাবু বললেন, কী ব্যাপার বলুন তো? সকালবেলায় এসে আপনি আমায় কী খেলাটেলার কথা বলছেন? আমি তাতে রাজি না হলেও আমাকে খেলতেই হবে কেন? জোর করে আমায় খেলাবেন?

ধ্যানচাঁদ নিচু গলায় বলল, জোর করার প্রশ্ন নেই। খেলতে আপনি বাধ্য। নইলে আপনি খুন হয়ে যাবেন। আপনাকে আমি খুন করতে চাইব, আপনি বাঁচার চেষ্টা করবেন, অথবা আমাকে মারতে চাইবেন, এটাই হচ্ছে খেলা। নিজের প্রাণ বাঁচাবার জন্য আপনাকে খেলতেই হবে।

পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কিছু কিছু মানুষ। কেউ কেউ কাকাবাবুকে রোজই দেখেন বলে হাত তুলে নমস্কার জানাচ্ছেন। বকুলগাছটা থেকে টুপটাপ করে ঝরে যাচ্ছে একটা একটা ফুল। বাতাস বেশ ঠান্ডা। এরই মধ্যে একটা লোক শান্ত গলায় বলল খুন করার কথা!

কাকাবাবু একটুও বিচলিত হলেন না। এর আগেও কয়েকজন তাঁকে খুন করার হুমকি দিয়েছে। একজন তো পাহাড় থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিল, তবু বেঁচে গিয়েছেন শেষ পর্যন্ত।

কাকাবাবু বললেন, আপনি আমাকে মারতে চাইবেন কেন? আমি তো। আপনাকে চিনিই না। কখনও আগে দেখিনি। তবে কি কখনও না জেনে আপনার কোনও ক্ষতি করেছি?

ধ্যানচাঁদ বলল, আপনার রামকুমার পাধির কথা মনে আছে?

কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, রামকুমার পাধি? এরকম নাম কখনও শুনেছি বলেও মনে হয় না।

ধ্যানচাঁদ জোর দিয়ে বলল, হ্যাঁ শুনেছেন। আপনার মনে না-ও থাকতে পারে। শুনেছেন ঠিকই। ভোপালের ভীমবেটকার কথা ভুলে যাননি নিশ্চয়ই?

কাকাবাবু বললেন, ভীমবেটকা? সেটা তো একটা বিখ্যাত ঐতিহাসিক জায়গা। পাহাড়ের গায়ে অনেক গুহা আছে। সেখানে আমি কয়েকবার গিয়েছি। কেন, সেখানে কিছু হয়েছে নাকি?

ধ্যানচাঁদ বলল, এখন কিছু হয়নি। তবে, কয়েক বছর আগে সেখানেই এক রাত্তিরে আপনি রামকুমার পাধিকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, ও, সেই ডাকাতটা? যে তিনজন ইতিহাসের পণ্ডিতকে গলা কেটে খুন করেছিল? ওরে বাবা, সে তো শুনেছি সাংঘাতিক ডাকাত। সেসময় একটা গুজব রটেছিল যে, ভীমবেটকার একটা গুহার মধ্যে প্রচুর গুপ্তধন আছে। সেই গুপ্তধন খোঁজার জন্য প্রচুর লোক নেমে পড়ে, অনেক খুনোখুনি হয়। তারপর…

ধ্যানচাঁদ বলল, বাকিটা আমি বলছি। তারপর আপনার বুদ্ধিতেই এক রাতে সকলে ধরা পড়ে। তাদের মধ্যে ছিল ওই রামকুমার পাধি। যে এক কুখ্যাত ডাকাত।

কাকাবাবু বললেন, ওই ডাকাতটাকে আমি চিনতাম না। পুলিশ শনাক্ত করেছে।

ধ্যানচাঁদ জিজ্ঞেস করল, তারপর সেই ডাকাতটার কী হল?

কাকাবাবু অস্থির হয়ে বললেন, সকালবেলা এসে আমাকে এসব কথা জিজ্ঞেস করার কী মানে হয়? সে তো পাঁচ-ছ বছর আগেকার ব্যাপার, সব চুকেবুকে গিয়েছে। সে ডাকাতটার কী হয়েছে, তা আমি কী করে জানব? তার নামে অনেক কেস ছিল, ফাঁসি হয়েছে নিশ্চয়ই। আমি তো আর সেখানে ডাকাত ধরতে যাইনি, সেটা আমার কাজও নয়। ভীমবেটকায় ইতিহাসের খুব মূল্যবান সব চিহ্ন আছে। গুপ্তধন খোঁজার নামে কেউ যাতে সেগুলো নষ্ট না করে, সেটা আটকাতেই গিয়েছিলাম আমি। তখন যারা ধরা পড়েছে, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেছে পুলিশ। আমি আর কিছু জানি না।

ধ্যানচাঁদ কঠোরভাবে বলল, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনার সঙ্গে আমি আজেবাজে কথা বলতে আসিনি। রামকুমার পাধির ফাঁসি হয়নি, জেলের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছিল, তা আপনি অবশ্যই জানেন। তখনকার কাগজে আপনার মতামতও ছাপা হয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, ও হ্যাঁ, একটু একটু মনে পড়ছে। সেই ডাকাতটা জেলের মধ্যেই আত্মহত্যা করে। আমি বলেছিলাম বটে যে, ওকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আরও অনেক খবর জানা যেত।

ধ্যানচাঁদ বলল, না, মোটেই সে আত্মহত্যা করেনি। তাকে পুলিশরা পিটিয়ে মেরে ফেলে, তারপর তার লাশটা একটা দড়িতে ঝুলিয়ে দেয়। তাতেই বলা হয় যে, সে আত্মহত্যা করেছে।

কাকাবাবু বললেন, তা হতেও পারে। পুলিশরা এরকম কাজ অনেক সময় করে বটে। কিন্তু তার সঙ্গে আপনি যে আজ খুনোখুনির খেলার কথা বলছেন, তার কী সম্পর্ক বলুন তো? এসব কথা শুনতে আমার ভাল লাগে।

ধ্যানচাঁদ এবার কোটের ভিতরের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। সেটা একটা ইংরেজি খবরের কাগজের কাটিং। কাকাবাবুর দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা পড়ুন!

কাকাবাবু দেখলেন খবরটা। হিমাচল প্রদেশের মান্ডি শহরে দিনেরবেলা প্রকাশ্য রাস্তায় তিনজন লোক মোটরসাইকেলে চেপে এসে একজন লোককে পরপর ছটা গুলিতে ফুড়ে দেয়। লোকটি একটা চায়ের দোকানে বসে ছিল। সে কোনও বাধাই দিতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে সে মারা যায়, মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আততায়ীরা পালিয়ে যায়, কেউ তাদের ধরার চেষ্টাও করেনি। মৃত লোকটির পরিচয় জানা গিয়েছে। সে একজন দাগি আসামি! তার নামে অনেক খুন ও ডাকাতির মামলা ঝুলছিল। তার নাম রামকুমার পাধি। তার কাছেও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।

কাকাবাবু কাগজের টুকরোটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধ্যানচাঁদ বলল, তারিখটা লক্ষ করেছেন? মাত্র তেইশ দিন আগের ঘটনা। একই লোক কি দুবার মারা যেতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, তবে কি ওই ডাকাতটা জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল?

ধ্যানচাঁদ বলল, না, মোটেই না! জেলখানাতেই তার মৃত্যু হয়েছিল। সে। রেকর্ড আছে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে কি এক নামে দুজন লোক? তা তো থাকতেই পারে।

ধ্যানচাঁদ বলল, না, সে ব্যাপারও নয়। এই তেইশ দিন আগে মান্ডিতে যে রামকুমার পাধি মারা গিয়েছে, সেই আসল ডাকাত রামকুমার। তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। আর জেলখানার মধ্যে যাকে মারা হয়েছে, তার নাম মোটেই রামকুমার ছিল না। তার নাম ছিল সুরজকান্ত। সে মোটেই ডাকাতও ছিল না। পুলিশ কিছুতেই তা মানতে চায়নি, তাকেই রামকুমার সাজিয়ে অন্যায়ভাবে মেরে ফেলেছে।

এ-পাড়ারই দুটি ছেলে কাকাবাবুকে দেখে কাছে এসে দাঁড়াল। কাকাবাবু পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম নেওয়া পছন্দ করেন না, তা ওরা জানে। তাই হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে একজন জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আপনি এই শনিবার থাকছেন তো? ঠিক আসবেন কিন্তু।

কাকাবাবু বললেন, কোথায়? কী আছে শনিবার?

অন্য ছেলেটি বলল, আপনার বাড়িতে কার্ড দিয়ে এসেছি। এই শনিবার আমাদের নাটক আছে। আপনি চিফ গেস্ট।

কাকাবাবু হেসে বললেন, নাটকের আবার চিফ গেস্ট কী? ঠিক আছে, সময় পেলে দেখতে যাব, কিন্তু আমি স্টেজে উঠব না।

ছেলে দুটি আরও কিছু বলতে গেল, কাকাবাবু তাদের কাটিয়ে দিলেন।

ধ্যানচাঁদ অন্যদিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে।

এবার সে বলল, চলুন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যাক।

ওঁরা দুজনেই হাঁটতে লাগলেন। কিন্তু দুজনেই চুপ।

আর-একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পড়ে কাকাবাবুবললেন, হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা যায় না। হ্যাঁ, আপনি বলছিলেন, আসল ডাকাতের বদলে পুলিশ সুরজকান্ত নামের একজন নির্দোষ লোককে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তা যদি হয়, সেটা খুবই অন্যায় হয়েছে। এ-বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। কিন্তু আমি কী করতে পারি বলুন তো? পুলিশের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

কাকাবাবুর চোখের দিকে চোখ রেখে ধ্যানচাঁদ কেটে কেটে বলল, সেই সুরজকান্ত আমার ভাই। আমার নিজের ভাই।

কাকাবাবু একটু চমকে উঠে বললেন, আপনার ভাই? আমি খুবই দুঃখিত! আমি আপনাকে আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।

ধ্যানচাঁদ বলল, আমি কারও সিমপ্যাথি চাই না। আমার ভাই জীবনে কোনও অন্যায় করেনি। পড়াশোনায় ব্রিলিয়ান্ট ছিল। সে ইতিহাস নিয়ে রিসার্চ করত। সে ভীমবেটকায় কোনও খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি, গুপ্তধন খুঁজতেও যায়নি। সে ওখানকার গুহাগুলোতে যে প্রি-হিস্টোরিক আমলের ছবি আছে, সেই সব ছবির একটা লিস্ট তৈরি করার জন্য ভীমবেটকায় প্রায়ই

যেত।

কাকাবাবু বললেন, গুহার ছবির লিস্ট করার জন্য সে রাত্তিরবেলা যেত? সেখানে তো কোনও আলো ছিল না। পাহাড় আর জঙ্গল!

ধ্যানচাঁদ বলল, তার কাজের সুবিধের জন্য সে রাত্তিরবেলা যাবে কি দিনেরবেলা যাবে, তা সে নিজে ঠিক করবে। কেন, সেখানে রাত্তিরে যাওয়ার জন্য কি কোনও নিষেধ ছিল?

কাকাবাবু বললেন, না, তা অবশ্য ছিল না। তখন কোনও পাহারাও দেওয়া হত না।

ধ্যানচাঁদ বলল, মোট কথা, আমার ভাই ক্রিমিনাল ছিল না। সেই রাতে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সে ধরা পড়ে। পুলিশ তাকে প্রথমেই নটোরিয়াস ক্রিমিনাল রামকুমার পাধি বলে দাগিয়ে দেয়। সে হাজার বার অস্বীকার করেছে, তবু পুলিশ মানেনি। পুলিশ তো অনেক সময় এরকমই করে। কোনও নির্দোষ লোকের ঘাড়ে একটা মিথ্যে দোষ চাপিয়ে তারপর তাকে মেরে ফেলে।

কাকাবাবু বললেন, সেই সব পুলিশের বিচার হওয়া উচিত। আপনার ভাইয়ের এরকম মৃত্যুর জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত!

ধ্যানচাঁদ গম্ভীরভাবে বলল, আপনি শুধু দুঃখিত হলে তো চলবে না। আমার ভাইকে খুন করার জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।

কাকাবাবু রীতিমতো অবাক হয়ে বললেন, আপনার ভাইকে আমি খুন করেছি? এ কী অদ্ভুত কথা! শুনুন মিস্টার ধ্যানচাঁদ, আমি জীবনে অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছি, কিন্তু কখনও আত্মরক্ষার জন্যও একটা মানুষ মারিনি। কয়েকবার দু-একজন দুর্দান্ত প্রকৃতির ক্রিমিনাল একেবারে আমাকে সামনাসামনি মারতে এসেছে, তখনও আমি তাদের বুকে গুলি চালাইনি। হাতে কিংবা পায়ে মেরেছি, তারা কেউ মরেনি। মানুষ মারা আমার কাজ নয়। আপনার ভাইকে তো আমি চিনতামই না, আজই আপনার মুখে তার নাম প্রথম শুনলাম।

ধ্যানচাঁদ বলল, তবু তাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আপনিই দায়ী।

কাকাবাবু বললেন, সেই রাতে ভীমবেটকার একটা গুহায় গুপ্তধনের লোভে একদল লোক হামলা করবে, এ-খবর আমি জেনেছিলাম। তাই আমি গ্যাস বোমা ফাটিয়ে সেখানে যারা ছিল, অজ্ঞান করে দিয়েছিলাম সকলকে। আট-দশ জন, তাদের মধ্যে একজন সাধুও ছিল। পুলিশ অজ্ঞান অবস্থাতেই তাদের তুলে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কে ক্রিমিনাল আর কে নির্দোষ, তা প্রমাণ করা পুলিশের কাজ। আপনার ভাইকে রামকুমার পাধি বলে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। আমি কিছুই বলিনি, আমি কিছু জানতামও না তার সম্পর্কে।

ধ্যানচাঁদ বলল, এ সবই ঠিক, আমি জানি। তবু আপনাকে শাস্তি পেতে হবে। শুনুন মিস্টার রায়চৌধুরী, আর বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমাদের ফ্যামিলিতে একটা নিয়ম আছে। আমাদের ফ্যামিলির কোনও লোককে যদি কেউ খুন করে, তা হলে সেই খুনিকে কিংবা খুনির ফ্যামিলির কোনও একজনকে না মারতে পারলে আমাদের শান্তি নেই।

কাকাবাবু বললেন, ব্লাড ফর ব্লাড? আরব দেশে এরকম প্রথা ছিল। খুব খারাপ, বর্বর প্রথা। এ ফ্যামিলির একজন অন্য ফ্যামিলির একজনকে খুন করবে, তারপর সেই ফ্যামিলির একজন আবার এ ফ্যামিলির একজনকে, আবার এ ফ্যামিলি থেকে আর-একজন প্রতিশোধ নেবে, এরকম তো চলতেই থাকবে! পরপর খুনোখুনি! এ-যুগে এসব চলে নাকি? এখন আইনআদালত আছে, বিচারের ব্যবস্থা আছে…

ধ্যানচাঁদ বলল, বিচার অনেক সময় ভুল হয়। প্রমাণের অভাবে অনেক ডাকাত কিংবা খুনিও ছাড়া পেয়ে যায়। মিস্টার রায়চৌধুরী, সেই জন্যই তো আমি আপনাকে সব কথা আগে থেকে জানিয়ে রাখছি। আপনাকে আত্মরক্ষার পুরো সুযোগ দিচ্ছি। আমি ভদ্রলোক, আপনাকে কখনও পিছন দিক থেকে এসে মারব না। লড়াই হবে সামনাসামনি। আপনি যদি আমাকে আগেই মেরে দিতে পারেন, তা হলে আর আপনার কোনও ভয় নেই। আমাদের ফ্যামিলি থেকে আর কেউ আপনাকে মারতে আসবে না। লাইক আ স্পোর্টসম্যান, আমরা হার-জিত মেনে নেব। তা হলে কাল থেকে শুরু হোক আমাদের ডেথ-ডেথ খেলা!

কাকাবাবু এবার চেঁচিয়ে বললেন, না, আমি রাজি নই! এই ধরনের খেলা খেলে অশিক্ষিত, অসভ্য লোকরা! তা ছাড়া আপনার ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমি কোনওভাবেই দায়ী নই!

ধ্যানচাঁদ বলল, আপনার পজিশন হচ্ছে নম্বর থ্রি। এক নম্বর দায়ী হচ্ছে সেই পুলিশ অফিসার, যে আমার ভাইয়ের নামে মিথ্যে দোষ চাপিয়েছিল। তার নাম মহিম পান্ডে। তার উপরেই প্রতিশোধ নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সে গত বছর একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছে। আর যে-লোকটা জেলের মধ্যে আমার ভাইয়ের উপর অত্যাচার করেছিল, তার নাম সুলতান আহমেদ। সে আরও কয়েকবার এই কাণ্ড করে যাচ্ছিল, একবার ধরা পড়েছে। সে এখন দশ বছরের জন্য জেল খাটছে!

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তো তার শাস্তি হয়েছেই!

ধ্যানচাঁদ বলল, ও শাস্তির কোনও মানেই হয় না। কোনও পুলিশের লোকের যখন জেল হয়, সে জেলের মধ্যে দিব্যি আরামে থাকে। ভাল খাবারদাবার পায়। অন্য পুলিশরা তাকে সাহায্য করে। ওকে শাস্তি দিতে হলে আমাদের আরও দশ বছর অপেক্ষা করতে হবে। সেই জন্য আমাদের ফ্যামিলির লোকজন ঠিক করেছে, রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য মরতে হবে আপনাকেই।

কাকাবাবু বললেন, আমি মরার জন্য ব্যস্ত নই। অন্য কাউকে মারতেও চাই না! ব্যস, কথা শেষ! গুড বাই।

ধ্যানচাঁদ বলল, আমাকেও এয়ারপোর্টে গিয়ে প্লেন ধরতে হবে। আর বেশি সময় নেই। মিস্টার রায়চৌধুরী, আমার কথাগুলো হালকাভাবে নেবেন না। এ-খেলা আপনাকে খেলতেই হবে, না হলে আপনার প্রাণ বাঁচাতে পারবে না কেউ। আজ বারো এপ্রিল। খেলা শুরু কাল থেকে। মে-জুনজুলাই-অগস্ট-সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, এ ছমাস চলবে এই খেলা। তার মধ্যে যদি আপনাকে খুন করতে না পারি, তা হলেই খেলা শেষ। তখন আমি হার মেনে নেব। এই খেলায় আপনি অন্য কারও সাহায্য নিতে পারেন, আমারও একজন সহকারী থাকবে। তবে আবার বলে রাখছি, খেলাটা হবে সবসময় সামনাসামনি। পিছন থেকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ একেবারেই না!

কাকাবাবু বললেন, রাবিশ! খুনোখুনির নাম খেলা? আপনার যা ইচ্ছে হয় করুন, এসব বিচ্ছিরি কথা আমি আর শুনতে চাই না! গেট লস্ট!

ধ্যানচাঁদ কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, গুড বাই। মনে রাখবেন, কাল, তেরো এপ্রিল থেকে …। এর মধ্যে আপনি কোথাও পালাবার কিংবা লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করবেন না। তাতে কোনও লাভ হবে না।

তারপরই পিছন ফিরে সে হাঁটতে শুরু করল। গাছতলায় দাঁড়িয়ে কাকাবাবু তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। হাঁটার ভঙ্গি দেখেই মনে হয়, লোকটি একসময় আর্মিতে ছিল। পার্কের গেট পেরিয়ে সে বাইরে দাঁড়াতেই সাদা গাল্টিা চলে এল তার কাছে। তাকে নিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল হুশ করে।

কাকাবাবু হাঁটতে শুরু করে ভাবলেন, লোকটি ঠান্ডা মাথায় যেসব কথা বলে গেল, তা কি সত্যি হতে পারে? ওর ভাই সুরজকান্ত মারা গিয়েছে পাঁচ-ছ বছর আগে। এতদিন পর তার প্রতিশোধ নিতে এসেছে?

কাকাবাবু মনে মনে বললেন, ওর ভাই সুরজকান্তকে আমি মোটেই ধরিয়ে দিইনি। অন্য অনেকের সঙ্গে সে ধরা পড়েছিল। সে দোষী না নির্দোষ, তাও আমি জানি না। অত রাতে সুরকান্ত ভীমবেটকায় গিয়েছিল কেন? প্রায় এক ঘণ্টা পার্কে ঘোরাঘুরি করে কাকাবাবু বেরিয়ে এলেন। রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির দরজার সামনে আসতেই পাশের গলি থেকে বেরিয়ে এল একটা সাদা গাড়ি। কলকাতার রাস্তায় কত সাদা গাড়িই তো থাকে। কিন্তু এই গাড়িটা ছুটে আসছে সোজা কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবু ফুটপাতে উঠে দাঁড়ালেন। গাড়িটা কিন্তু কাকাবাবুকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করল না। কাছে এসে থেমে গেল।

জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল ধ্যানচাঁদ। তার হাতে একটা রিভলভার দেখা যাচ্ছে।

হাসিমুখে ধ্যানচাঁদ বলল, দেখছেন তো মিস্টার রায়চৌধুরী, এই মুহূর্তে আমি গুলি চালিয়ে আপনাকে ঝাঝরা করে দিতে পারতাম। কেউ আমাকে ধরতে পারত না। দিচ্ছি না কেন বলুন তো? কারণ, আমাদের খেলা শুরু হবে কাল থেকে। আমি ভদ্রলোক, কথা রাখি। মনে রাখবেন, আমি এ-কথাও দিয়েছি, ছমাসের মধ্যে আপনাকে আমি খুন করবই।

কাকাবাবু কোনও উত্তর দিলেন না।

গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল।

উপরে উঠে এসে কাকাবাবু হাঁক দিয়ে বললেন, রঘু, আমায় কফি দে!

তিনখানা খবরের কাগজ ভাঁজ করে রাখা আছে ছোট গোল টেবিলটার উপরে। কাকাবাবু রকিং চেয়ারে বসে পড়ে একটা কাগজ খুললেন। কিন্তু কাগজ পড়ায় তার মন বসল না। শুধু মনে পড়ছে ওই লোকটার কথা। সকালবেলা ওই লোকটা একটা রিভলভার দেখিয়ে শাসিয়ে গেল? কাকাবাবু মরতে ভয় পান না। এর আগে কতবার তিনি কতরকম বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছেন, যখন-তখন মরে যেতে পারতেন। ভয় থাকলে তো তিনি ওইসব বিপদের মধ্যে যেতেনই না। বাড়িতে বসে থাকতেন। খোঁড়া পা নিয়েও তিনি পাহাড়ে-জঙ্গলে দৌড়েছেন কতবার। কোনও একটা উদ্দেশ্য নিয়েই গিয়েছেন। একদিন না-একদিন তো সব মানুষেরই মৃত্যু হয়। তা বলে একজনের সঙ্গে জোর করে খুনোখুনির খেলা খেলতে হবে? কী বিচ্ছিরি ব্যাপার!

লোকটার নাম ধ্যানচাঁদ। ওটা ওর আসল নাম নয়। ইন্ডিয়া যখন হকি খেলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ছিল, তখন ধ্যানচাঁদ ছিলেন সেই টিমের ক্যাপ্টেন। বিখ্যাত মানুষ, ভাল মানুষ। তার নাম নিয়েছে একজন খুনি! এটাও তো অন্যায়।

রঘু কফি নিয়ে এল, সঙ্গে দুখানা টোস্ট।

কাকাবাবু বললেন, টোস্ট খাব না। নিয়ে যা।

রঘু বলল, খালি পেটে গরম কফি খাবেন? তাতে পেট জ্বালা করে।

কাকাবাবু বললেন, কে বলল, পেট জ্বালা করে? তুই খেয়ে দেখেছিস?

রঘু বলল, আমি জীবনেই কফি খাইনি স্যার। কিন্তু লোকে যে বলে!

কাকাবাবু বললেন, জীবনে কফি খাসনি? আজ এক কাপ খেয়ে দ্যাখ। দুচামচ চিনি দিবি, নইলে খুব তেতো লাগবে।

আপনি তো চিনি-দুধ কিছুই নেন না। এই কালো কালো জিনিসটা কী করে যে খান! একটা অন্তত টোস্ট ড়ুবিয়ে ড়ুবিয়ে খেয়ে ফেলুন আগে।

তোকে আর সর্দারি করতে হবে না। বলছি, টোস্ট দুটো নিয়ে যা!

না, নিয়ে যাব না। একটা অন্তত খেতেই হবে। খেয়ে নিন কাইন্ডলি।

কাইন্ডলি? খুব ইংরেজি শেখা হয়েছে! নিয়ে যাবি, না ছুড়ে ফেলে দেব?

রঘু এবার ধমক খেয়ে টোস্ট দুটো তুলে নিয়ে মুখ চুন করে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কাকাবাবুর একটু অনুতাপ হল। অত বকলেন কেন রঘুকে? ও তো ভাল কথাই বলছিল। হঠাৎ তার মেজাজ গরম হয়ে গেল, এরকম তো হয় না! ওই ধ্যানচাঁদই তার মেজাজ খারাপ করে দিয়ে গিয়েছে। একবার মেজাজ খারাপ হলে অনেকক্ষণ ধরে মাথার মধ্যে সেটাই ঘোরে। মেজাজ ঠিক করতে হলে গান গাইতে হয়। কফিতে এক চুমুক দিয়ে কাকাবাবু গুনগুন করে গান ধরলেন :

তবে রে রাবণ ব্যাটা
তোর মুখে মারব ঝাটা
……………………….
তোরে এখন বাঁচায় কে’টা বল!

তোর মুখের দু পাটি দন্ত
ভাঙিয়া করিব অন্ত
এখনি হবে প্রাণান্ত
আয় রে ব্যাটা যমের বাড়ি চল।

মারব ঝ্যাঁটার পর আর-একটা কী লাইন আছে, মনে পড়ছে না। গানের লাইন ভুলে গেলে খুব অস্বস্তি লাগে। কাকাবাবু দু-তিনবার গেয়ে গেয়ে লাইনটা মনে আনবার চেষ্টা করলেন।

দরজার কাছ থেকে সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, আজ মর্নিং ওয়াকে গিয়েছিলে?

সন্তু সদ্য ঘুম থেকে উঠে এসেছে। এখনও চোখমুখ ধোয়নি। মাথার চুলও খোঁচা খোঁচা। হাতে টুথব্রাশ। সে কাকাবাবুর বাথরুমটা ব্যবহার করে।

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যাব না কেন? এই তো ঘুরে এলাম।

সন্তু বলল, কাল আমরা বাড়ি ফিরেছি রাত দুটোয়। তুমি এত কম ঘুমোও কী করে?

কাকাবাবু বললেন, আমার বেশি ঘুমের দরকার হয় না। তোর মতো বাচ্চারাই বেশি ঘুমোয়।

সন্তু হেসে বলল, আমি আর কী ঘুমোই! জোজো? জোজো যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়ে। কাল আমরা বাসে করে যাচ্ছিলাম, বসার জায়গা পাইনি। জোজো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঝিমোচ্ছিল।

কাকাবাবু বললেন, আমরা কে কতদিন বাঁচব ঠিক নেই। তার মধ্যে অর্ধেকটা সময় যদি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই, তা হলে অনেক কিছুই দেখা হবে না, অনেক কাজও করা হবে না। জীবনের চার ভাগের এক ভাগ ঘুমের জন্য বরাদ্দ। সেটাই যথেষ্ট।

সন্তু বলল, তার মানে দিনে ছঘণ্টা তো? আমি তার বেশি ঘুমোই না। এক-এক দিন হয়তো বেশি ঘুমিয়ে ফেলি, কিন্তু আবার এক-এক দিন, মানে ধরো, পরীক্ষার সময় যে রাত জেগে পড়াশোনা করি, তখন তিন ঘণ্টার বেশি ঘুম হয় না। তা হলে অ্যাভারেজে সেই ছঘণ্টা!

কাকাবাবু বললেন, তোর বন্ধু জোজোকেও সেকথা বুঝিয়ে দিস।

আমি তোমার বাথরুমে যাব?

যা।

বিকেলে কটার সময় ট্রেন? আজ তো আমাদের শিমুলতলা যাওয়ার কথা।

উঁ উঁ, আজ যাব কিনা ভাবছি।

কেন? এখন আমাদের ছুটি আছে। চলো, চলো!

দাঁড়া, একটু ভেবে দেখি।

সন্তু বাথরুমে চলে গেল। কাকাবাবু একটুক্ষণ ভুরু কুঁচকে বসে রইলেন।

কারণটা অতি সামান্য। আসলে বেড়ানোটাই মূল উদ্দেশ্য। তাই সন্তু আর জোজো শিমুলতলায় যাওয়ার জন্য উৎসাহে মেতে আছে। কিন্তু এখন কি যাওয়া উচিত? ধ্যানচাঁদ বলে গেল, কোথাও পালাবার কিংবা লুকোবার চেষ্টা করবেন না। শিমুলতলায় গেলে যদি সে ভাবে, তিনি কলকাতা ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন? সে নিশ্চয়ই নজর রাখবে। অথচ, সে তো দিল্লি ফিরে গেল। তা হলে নজর রাখবে কী করে? সে যাই-ই হোক, শিমুলতলায় যাওয়ার প্রোগ্রাম আগে থেকেই ঠিক করা আছে। ওই লোকটার হুমকিতে তিনি প্রোগ্রাম বদলাবেন কেন? ট্রেনের টিকিটও কাটা আছে, তা হলে যেতেই হবে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে কাকাবাবু একটা স্টিলের আলমারি খুললেন। এই আলমারিটা নানারকম জিনিসে ঠাসা। প্রায় সব জিনিসই তাঁর দেশ-বিদেশের ভক্তরা উপহার দিয়েছে। অনেক কিছুই ব্যবহার করা হয় না। সুন্দর সুন্দর মূর্তি, দুখানা দেওয়ালঘড়ি, অনেক রকমের জামা, মাথার টুপি, সুন্দর খাপওয়ালা চারখানা ছোরা। একজোড়া ক্রাচও রয়েছে। কাকাবাবু যে ক্রাচ দুটো ব্যবহার করছেন, তা অনেক দিনের পুরনো। রং চটে গিয়েছে। কাকাবাবু পুরনো জিনিসই বেশি পছন্দ করেন। একেবারে অকেজো না হলে তিনি কিছুই ফেলতে চান না।

কাকাবাবু ক্ৰাচজোড়া বের করলেন। ভারী সুন্দর দেখতে। ঝকঝকে পালিশ করা কালো রঙের, হাতলের কাছে হাতির দাঁতের কারুকাজ। এ ছাড়াও রয়েছে নানারকম কায়দা, পরপর কয়েকটা বোতাম। একটা বোতাম টিপলে ইচ্ছেমতো কাচটাকে ছোট কিংবা বড় করা যায়। সুইডেনে কাকাবাবুর বন্ধু গুনার মিডডাল এই ক্রাচ দুটো উপহার দিয়েছিলেন। তিনি বারবার বলেছিলেন, রাজা, তুমি এই ক্রাচ অবশ্যই ব্যবহার করবে। তোমাকে কত জায়গায় যেতে হয়। দেখবে, এটা খুব কাজে লাগবে। বেশি ভারীও নয়!

সকলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে বলে কাকাবাবু এত দিন ব্যবহার করেননি। নিজের পুরনো ক্রাচ দুটো চালান করে দিলেন খাটের নীচে। কয়েকটা জামাও বের করে নিলেন। এগুলোও পরে ফেলাই ভাল। শুধু শুধু ফেলে রেখে লাভ কী? মরে গেলে তো আর পরাই হবে না। সন্তুর গায়েও ফিট করবে না এইসব জামা।

হঠাৎ মরার কথা মনে আসছে কেন বারবার? ওই ধ্যানচাঁদ নামের লোকটা সত্যিই তাকে খুন করতে পারবে? তার চেয়েও বড় কথা, আত্মরক্ষার জন্য কাকাবাবু কি বাধ্য হবেন ওকে খুন করতে? কিন্তু তিনি যে তা চান না। যত বড় ক্রিমিনালই হোক, তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে চান না কাকাবাবু। একটা বেশ মোটা মতো জামাও বের করলেন। এ জামা খুব ঠান্ডার দেশে পরবার মতো। শিমুলতলায় শীত হবে না। এখন গরমকাল। তবু কাকাবাবু জামাগুলো একটা ছোট সুটকেসে ভরে নিলেন।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে সন্তু জিজ্ঞেস করল, তা হলে কী ঠিক হল? আমরা শিমুলতলায় যাচ্ছি তো?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যাচ্ছি। দুপুর সাড়ে বারোটায় ট্রেন। জোজোকে খবর দে।

সন্তু বলল, জোজো এগারোটার মধ্যে এসে যাবে। কাকাবাবু, আমরা ওখানে কদিন থাকব?

কাকাবাবু বললেন, বাদশা তো বলেছে, অন্তত দিনসাতেক থেকে আসতে। অতদিন ওখানে থেকে কী করব? আমি তো ভাবছি, বড়জোর দিনতিনেক …

সন্তু বলল, না, না, সাতদিনই ভাল। ওদিকে অনেক বেড়ানোর জায়গা আছে।

কাকাবাবু বললেন, দেখা যাক, গিয়ে যদি ভাল লাগে! তবে ভূতটুত আমার বেশিদিন সহ্য হয় না।

সন্তু বলল, বাদশাদা তো বলে গিয়েছেন, ভূত দেখা যাবেই। গ্যারান্টি। বাদশাদা তো বাজে কথা বলার লোক নন। তা হলে কি আমরা এবার সত্যি সত্যি ভূত দেখব!

কাকাবাবু বললেন, ধুত। যত সব বাজে কথা!

 

এগারোটার মধ্যেই ঠিক জোজো এসে হাজির। সঙ্গে একটা ঢাউস ব্যাগ। সেটা আবার একদিকে লাল, আর একদিকে কালো। তার উপরে সাদা অক্ষরে কী যেন লেখা। দু-এক জায়গা একটু কুঁচকে আছে বলে লেখাগুলো ঠিক পড়া যাচ্ছে না।

সন্তু বলল, এ কী রে, এত বড় ব্যাগ এনেছিস কেন?

জোজো বলল, এখানে কদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। ওখানেও বৃষ্টি হতে পারে। বৃষ্টিতে জামা-প্যান্ট ভিজবে। কাদায় আছাড় খেতে পারি। তাই বেশি জামা-প্যান্ট নিয়েছি।

সন্তু ভুরু তুলে বলল, এত বড় ব্যাগ ভরতি শুধু জামাকাপড়?

জোজো বলল, না, তা নয়। বাবা বললেন, শিমুলতলায় যাচ্ছিস? বাঃ, বেশ ভাল স্বাস্থ্যকর জায়গা। ওখানকার জল খেলে খুব খিদে পায়। তাই আমি ভাবলুম, যখন-তখন খিদে পেলে কী খাব? কখন কী পাওয়া যাবে, তাও তো জানি না। সেই জন্য দশ প্যাকেট বিস্কুট আর চিজ নিয়েছি। আর ডিমের পাউডার।

ডিমের পাউডার আবার কী?

আমরা এখন ডিমের পাউডার বানাচ্ছি বাড়িতে। আস্ত ডিম সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনেক ঝামেলা, ভেঙেটেঙে যায়। তাই আগে ডিমের অমলেট বানাই। সেটাকে শুকিয়ে, গুঁড়ো করে ফেলি। তারপর ইচ্ছেমতো সেই গুঁড়ো খানিকটা জলে মিশিয়ে গরম করলেই আবার অমলেট হয়ে যায়। একই রকম খেতে লাগে। কাকাবাবু, আপনি খেয়ে দেখবেন তো?

দেখব টেস্ট করে। জোজো, তোর ব্যাগের উপর কী লেখা রে?

জোজো ব্যাগের কোঁচকানো জায়গাগুলো ঠিক করল। তখন পড়া গেল, দু লাইনে লেখা :

এবার যাব শিমূলতলায়
গান শুনব ভূতের গলায়।

নিজেই সেই লাইন দুটো উচ্চারণ করে পড়ে জোজো বলল, কাল থেকে পোয়েট্রি লিখতে শুরু করেছি, ইংলিশে আর বাংলায়। প্রথমে লিখেছিলাম, এবার যাব শিমূলতলা। চেপে ধরব ভূতের গলা! কিন্তু সেটা ঠিক পছন্দ হল না। কাকাবাবু, এটা বেটার হয়নি?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এটাই বেটার। কিন্তু এখানে ভূতদের মধ্যে যদি ব্ৰহ্মদত্যি থাকে, তা হলে তোমার এই লেখা দেখে গান শোনাবার বদলে রেগে গিয়ে তোমারই গলা চেপে ধরবে।

কেন, কেন, রেগে যাবে কেন?

বামুন মরলে তো ব্রহ্মদত্যি হয়। সাধারণত তারা লেখাপড়া জানে। ভুল বানান সহ্য করতে পারে না। তোমার ওই লেখায়…

কী, ভুল লিখেছি? মূল বানান ম-এ দীর্ঘ ঊ না?

তা ঠিক। কিন্তু এটা তো সে মূল নয়। শিমুল একটা গাছের নাম। সংস্কৃতে যাকে বলে শাল্মলি। সেই শাল্মলি থেকে চলতি কথায় শিমুল। তুমি পোয়েট্রি লিখছ, ভুল বানান তো চলবে না।

আপনার কথা শুনেই আমার নেক্সট দুলাইন মনে এসে গেল! বলব?

যদি দেখি ব্রহ্মদত্যি
তবে বলব তিন সত্যি!

এটা লিখে রাখতে হবে।

সন্তু বলল, ইংরেজিতে কী কবিতা লিখেছিস, শোনা তো!

জোজো বলল,

There was a man Called Kissinger
Who was a very bad singer.

সন্তু বলল, বাঃ, আর-একটা শোনা।

কাকাবাবু বললেন, পরে হবে। পরে হবে।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনার এই ক্রাচ দুটো দারুণ দেখতে তো!

কাকাবাবু বললেন, দারুণ বলেই এতদিন ব্যবহার করিনি। আজ ভাবলাম, শুধু শুধু ফেলে রেখে লাভ কী? চলো, তা হলে।