০৪. মোট সাতখানা মোটা মোটা খাতা

মোট সাতখানা মোটা মোটা খাতা। লম্বাটে ধরনের, লাল কাপড় দিয়ে বাঁধানো।

কাকাবাবু খাতাগুলো দেখতে দেখতে বললেন, আগেকার দিনে এই ধরনের খাতাকে বলা হত খেরোর খাতা।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কেন, ওরকম নাম ছিল কেন? খেরো মানে কি হিসেব?

কাকাবাবু বললেন, না। এই লাল রঙের মোটা কাপড়কে বলে খেরো। এই কাপড় দিয়ে বাঁধালে খাতাগুলো মজবুত হয়। দেড়শো বছরের বেশি টিকে আছে।

নিজে একটা খাতার পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন, জোজো আর সন্তু, তোরাও দেখ তো, এইটিন ফিটি সেভেন আর ফিটি এইটের হিসেব কোন খাতায় আছে?

জোজো একটা খাতা নিয়ে বলল, এ তো ওড়িয়া ভাষা, পড়ব কী?

কাকাবাবু বললেন, ওগুলো বাদ দাও। প্রথম দিকেরগুলোই আমাদের দরকার।

সন্তু বলল, আমার কাছে এই খাতাটায় আঠারোশো চুয়ান্ন সাল থেকে শুরু হয়েছে… আর শেষ হয়েছে আঠারোশো উনষাটের জুন মাসে। কাকাবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, ওই খাতাটাই আমার দরকার।

অনেক লেখার কালি এমনই অস্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়েও পড়া যায় না। কোনও কোনও পাতা পোকায় খেয়েছে। তবু কাকাবাবু

কষ্ট করে পড়তে লাগলেন।

অধিকাংশই জিনিসপত্র কেনার হিসেব। নতুন পালকি ক্রয়, ঠাকুরের গয়না, বাবুদের ইংলিশ জুতো, চাল, ডাল, তিনজোড়া বন্দুক, আঠাশখানা তরবারি। একদিনের হিসেবে লেখা আছে, সাপের বিষে রাজকুমারের মৃত্যু ও পুনর্জীবন লাভ। ওঝা মহাশয়কে পুরস্কার একান্ন টাকা ও শাল।

কাকাবাবু পড়া থামিয়ে বললেন, এটা কী ব্যাপার বুঝতে পারলি? অনেক সাপেরই বিষ থাকে না। সেই সাপ কামড়ালেও মানুষ বেঁচে যায়। অনেকেই তো প্রথমে বুঝতে পারে না, সাপটার বিষ আছে কি না! তখন ওঝাকে ডাকে। ওঝা এসে লাফালাফি করে, মন্ত্রট পড়ে, তারপর সেই লোকটি বেঁচে উঠলেই ওঝার কৃতিত্ব হয়। রাজকুমারকেও নিশ্চয়ই সেরকম একটা চেঁড়া সাপ কামড়েছিল।

সন্তু বলল, আর যখন সত্যিই বিষাক্ত সাপে কামড়ায়, তখন তো বাঁচানো যায় না। সেইসময় ওঝা কী বলে?

কাকাবাবু বললেন, তখন ওঝামশাই কপাল চাপড়ে বলেন, অনেক চেষ্টা তো করলাম। কিন্তু নিয়তি তো খণ্ডানো যায় না, ওর এইসময় মৃত্যুযোগ ছিল। আয়ু ফুরিয়ে গেছে।

খাওয়ার টেবিলে জোজো কোনও কথা বলতে পারেনি। বেশিক্ষণ চুপ করে থাকলে ওর পেট ফুলে যায়।

সে এবার গম্ভীরভাবে বলল, খুব বিষাক্ত সাপে কামড়ালেও মানুষকে বাঁচানো যায়। একবার গারফিল্ড সোবার্সকে সাপে কামড়েছিল। সুন্দরবনে।

সন্তু বলল, সোবার্স সুন্দরবনে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলেন বুঝি?

জোজো বলল, না, কলকাতায় টেস্ট খেলতে এসেছিলেন, তারপর বেড়াতে গেলেন সুন্দরবনে। সেখানে কালকেউটে সাপে কামড়েছিল। বাঁ পায়ে।

সন্তু বলল, সোবার্স খেলা ছেড়ে দিয়েছেন আমাদের জন্মের আগে। তুই দেখলি কী করে?

জোজো বলল, আমি দেখেছি তো বলিনি। শুনেছি। আমার মামার কাছে। মামার সঙ্গেই তো সোবার্স বেড়াতে গিয়েছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, বাধা দিচ্ছিস কেন? জোজোকে গল্পটা বলতে দে না!

জোজো বলল, এটা গল্প নয়। ফ্যাক্ট! কালকেউটে সাপে কামড়ালে ঠিক ছঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয়। মহা মুশকিল। কাছাকাছি কোনও ডাক্তার নেই, আমার বাবাকেও ডেকে নিয়ে যাবার সময় নেই। তা ছাড়া, আমার বাবা তখন ছিলেন অস্ট্রেলিয়ায়।

সন্তু বলল, হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া থেকে ডেকে আনা খুব মুশকিল তো বটেই।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তারপর? সোবার্স তো এখনও বেঁচে আছেন। কী করে বাঁচলেন?

জোজো বলল, সোবার্সকে সাপে কামড়েছিল নদীর ঘাটে। সেখানে বিরাট ভিড় জমে গেল। অনেকরকম লোক। ছোট, বড়, মাঝারি। ইয়ে, কয়েকজন মহিলাও ছিলেন। আমার মামা চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কি কারও নাম নীলকণ্ঠ? কিংবা নীলকণ্ঠ নামের কাউকে চেনো? সেখানে নীলকণ্ঠ নামের কেউ নেই, কিন্তু পাশের গ্রামের একজন নৌকোর মাঝি আছে ওই নামে। মামা বললেন, শিগগির সেই মাঝিকে তোমরা কেউ ডেকে আনো। আসতে না চাইলে জোর করে ধরে আনবে!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সোবার্স সাহেবের তখন কী অবস্থা? তিনি কথা বলতে পারছেন?

জোজো বলল, না, না, তিমি ঘুমিয়ে পড়ছেন, আর আমার মামা তার গালে চড় মেরে মেরে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। আধ ঘণ্টার মধ্যে এসে গেল নীলকণ্ঠ মাঝি। মামা তাকে বললেন, একমাত্র তুমিই বাঁচাতে পারো এই বিখ্যাত মানুষটাকে, না হলে আমাদের দেশের খুব বদনাম হয়ে যাবে! লোকটি বলল, আমি তো ওঝা নই। মন্তরও জানি না। মামা বললেন, মন্তরটন্তরের দরকার নেই। বাটি থেকে চুমুক দিয়ে যেমন লোকে দুথ খায়, তুমিও সেইরকম সাপে কামড়ানো জায়গাটায় চুমুক দিয়ে বিষ টেনে আনে। তোমার কোনও ভয় নেই। তোমার কোনও বিপদ হবে না। সেই মাঝি সোবার্সের ডান পায়ে সেই জায়গায় মুখ লাগিয়ে দুবার চুমুকের মতন টানল। ব্যস, সোবার্স অমনি ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, একী, এত ভিড় কেন? আমাকে কি বাঘে অ্যাটাক করেছিল?

কাকাবাবু বললেন, এটা দারুণ গল্প। মানে ফ্যাক্ট। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখ দিয়ে যারা বিষ টানতে যায়, তারা নিজেরাই মরে যায়। মুখের মধ্যে কোথাও যদি একটু ঘা থাকে, কিংবা গালে কোনও কাটাটাটা থাকে, তা হলেই সেই বিষ রক্তে মিশে গিয়ে দুজনেরই মৃত্যু হবে। কিন্তু যার নাম নীলকণ্ঠ, তার কোনও ভয় নেই, সে তো সব বিষ হজম করে ফেলতে পারে।

সন্তু বলল, সোবার্সের বাঁ পায়ে সাপ কামড়েছিল, লোকটি মুখ লাগাল ডান পায়ে। তাতেই কাজ হয়ে গেল!

জোজো সেকথা গ্রাহ্য না করে বলল, আর-একবার থাইল্যান্ডের রানিকে। সাপে কামড়েছিল…।

কাকাবাবু বললেন, থাক, আর সাপের গল্প নয়। অনেক পাতা পড়তে হবে!

সন্তু বলল, কাকাবাবু, এক মিনিট! হারে জোজো, তুই যে কাল বলছিলি, দিল্লির এয়ারপোর্টে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে দেখে তোর বাবা কী যেন বললেন, তারপর কী হল রে?

জোজো বলল, বাকিটা বলিনি বুঝি? কতটা বলেছিলুম রে।

সন্তু বলল, তোর বাবা, এই রাজীব, শোনো, শোনো বলে ডাকলেন, তাই শুনে রাজীব গাঁধী কাছে এসে প্রণাম করলেন তোর বাবার পায়ে হাত দিয়ে…

জোজো বলল, হ্যাঁ, বাবা রাজীব গাঁধীর কপালের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠেছিলেন। উনি তখন সাউথ ইন্ডিয়ায় যাচ্ছিলেন। বাবা বললেন, রাজীব, তোমার পক্ষে এই সময়টা ভাল নয়, এখন সাউথ ইন্ডিয়ায় যেয়ো না, বাড়ি ফিরে যাও, তিনদিন বাড়ি থেকে বেরোবে না, অচেনা কারও সঙ্গে কথাও বলবে না। তা হলেই ফাঁড়া কেটে যাবে। রাজীব গাঁধী বললেন, তার তো উপায় নেই, ইলেকশন মিটিং আছে, এখন আর ক্যানসেল করা যাবে না। বাবার কথা না শুনে প্লেনে উঠে গেলেন, তারপর কী হল, তা সবাই জানে। বোমার ঘায়ে টুকরো টুকরো।

সন্তু বলল, তোর বাবার কথা শুনে চললে রাজীব গাঁধী বেঁচে থাকতেন আজও, আবার হতে পারতেন প্রধানমন্ত্রী।

কাকাবাবু আবার পড়া শুরু করেছেন। থেমে গেলেন এক জায়গায়। ম্যাগনিফায়িং গ্লাসটা মুছে ভাল করে পড়ার চেষ্টা করলেন দু-তিনবার।

তারপর জোজোকে বললেন, দ্যাখো তো কী লেখা আছে, ঠিক পড়া যাচ্ছে না।

জোজো বলল, লেখা আছে ধূধূ পথ। খাওয়া বাবদ খরচ সাত টাকা। ধুধু পথ দিয়ে কেউ খাবারদাবার সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল?

কাকাবাবু বললেন, এবার সন্তু পড়ে দ্যাখ তো!

সন্তু আতশ কাচ চোখে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ধুধু পথই লেখা আছে। তবে বানান ভুল করেছে। উপরে দুটো চন্দ্রবিন্দু আছে। ধুধু পথ।

কাকাবাবু বললেন, ধুধু পথ না হয়ে ওটা যদি কারও নাম হয়? খানিকটা ভুল করেছে।

সন্তু বলল, ধুধু পথ কারও নাম হতে পারে নাকি?

কাকাবাবু বললেন, ধুন্ধু পন্থ হতে পারে না? নানাসাহেবের নাম ধুন্ধুপন্থ। তারিখটাও মিলে গেছে, একুশে জুন, এইট্টিন ফিফটি এইট!

সন্তু বলল, তা হলে সত্যিই নানাসাহেব এখানে এসেছিলেন?

কাকাবাবু বললেন, হতেও পারে। এখানেও পুরোপুরি জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে এ-পর্যন্ত জানা গেছে, ইংরেজদের কাছে যাতে ধরা দিতে

হয়, সেজন্য নানাসাহেব প্রথমে পালিয়ে গিয়েছিলেন নেপালে। কিন্তু নেপালের রাজা তাকে আশ্রয় দিতে চাননি। ইংরেজদের ভয়ে তাকে নেপাল ছেড়ে চলে যাওয়ার হুকুম দিলেন। এরপর নানাসাহেব গোপনে গোপনে ঘুরলেন বেশ কয়েকটি ছোট ছোট রাজ্যে। কোনও রাজাই তাকে রাখতে রাজি হলেন না। সকলেরই ভয়, নানাসাহেবকে ধরার জন্য ইংরেজরা খবর পেলেই তাদের রাজ্য আক্রমণ করবে। সিপাহি বিদ্রোহের পর বড় ভয়ংকর, নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নিয়েছিল ইংরেজরা। তারপর তিনি খুব সম্ভবত জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এসে পড়েছিলেন এই ময়ূরভঞ্জে।

জোজো জিজ্ঞেস করল, উনি একা ছিলেন?

কাকাবাবু বললেন, না, না উনিও তো একজন রাজা। বারোজন খুব বিশ্বাসী সহচর নিয়ে ঘুরছিলেন। আর কানপুর ছেড়ে পালাবার আগে বেশ কিছু ধনরত্নও সঙ্গে নিয়েছিলেন।

জোজো বলল, বারোজন লোক? এখানে যে খাওয়ার খরচ লেখা আছে। মোট সাত টাকা? কী খেয়েছিল?

কাকাবাবু হেসে বললেন, তখনকার দিনে সাত টাকা মোটেই কম নয়। অনেক কিছু কেনা যেত। অনেক লোকের এক মাসের মাইনেই হত দশ-বারো টাকা। বিদ্যাসাগর মশাইয়ের বাবা চাকরি করে পেতেন দশ টাকা। এই হিসেবে দেখছি, পরপর তিনদিন ওদের খাওয়ার খরচ লেখা আছে। তারপর নেই।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তার মানে কী, তিনদিন পর ওঁরা চলে গেলেন?

কাকাবাবু বললেন, তা না-ও হতে পারে। প্রথম তিনদিন ছিলেন রাজার অতিথি। তারপর হয়তো আলাদা কোনও বাড়িতে ছিলেন, নিজেরাই খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।

জোজো বলল, না-ও হতে পারে। এ-রাজ্যের রাজাও ধুন্ধুমারকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

সন্তু বলল, ধুন্ধুমার নয়, ধুন্ধুপন্থ।

কাকাবাবু বললেন, সেটাও অসম্ভব নয়। আরও খোঁজ করতে হবে। শুধু এইটুকু অন্তত জানা গেল, এ-রাজ্যের রাজা পুরো দলটিকে তিনদিন খাইয়েছিলেন।

এইসময় দরজার কাছে এসে দাঁড়াল কমলিকা।

সে বলল, এই, তোমরা বেড়াতে যাবে না? সবসময় ঘরে বসে থাকবে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, চলো, একবার মন্দিরটা দেখে আসি। আমরা। তো তৈরিই আছি।

কমলিকা বলল, মন্দির দেখব, তারপর তোমাদের দিব্যগড়ে নিয়ে যাব।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সেখানে কী আছে?

কমলিকা বলল, একটা বেশ ভাঙা দুর্গ, তার ভিতরে একটা পুকুর, সেখানে এখনো পদ্মফুল ফোটে।

সবাই মিলে চেপে বসা হল জিপটায়।

এর ড্রাইভারের নাম গৌরাঙ্গ, বয়স বেশ কম, প্যান্ট-শার্ট পরা। নাম গৌরাঙ্গ হলেও তার গায়ের রং কিন্তু ফরসা নয়।

বাড়ির গেটের কাছে পাহারা দিচ্ছে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ। বন্দুক দুটো দেখেই বোঝা যায়, বহুকাল এ-বন্দুকে গুলি চালানো হয়নি। নলে মরচে ধরে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, একেই বলে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে! কাল রাতে কেউ পাহারা দেয়নি, এখন সিন্দুকটা চুরি যাওয়ার পর পুলিশ বসেছে। এখন কী পাহারা দেবে?

প্ৰবীর বলল, যারা চুরি করেছে, তারা এতক্ষণে তালাটালা ভেঙে ভিতরের সবকিছু নিয়ে নিয়েছে।

কিচকেশ্বরী মন্দিরটা খুব দূরে নয়। মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া গেল। সেখানে বেশ ভিড়, বাইরে থেকে অনেক টুরিস্ট এই মন্দির দেখতে আসে। কয়েকখানা গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে।

মূল মন্দিরটার চারপাশে আরও অনেক ছোট ছোট মন্দির। সেখানেও ঘুরছে অনেক লোক। কয়েকটা দোকান রয়েছে পাথরের জিনিসপত্রের।

কাকাবাবু বললেন, আমি ওই ভিড়ের মধ্যে যাব না। আমার অত মন্দির দেখার সাধ নেই। তোমরা দেখে এসো। পুকুরটা কোথায়? যেটা খোঁড়া হচ্ছে।

প্ৰবীর বলল, সেটা আছে ওপাশে। একটু হেঁটে যেতে হবে।

জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি মানুষের মাথার খুলিগুলো দেখবেন?

কাকাবাবু বললেন, সেগুলোই বা দেখে কী করব? সব মানুষের মাথার খুলিই তো একরকম।

জোজো বলল, কী আশ্চর্য, জ্যান্ত মানুষ কত আলাদা রকমের হয়, কিন্তু মড়ার খুলিগুলো কেন একরকম?

কাকাবাবু বললেন, তার কারণ, সব মানুষই আসলে একইরকম। একই জাতি। শুধু চামড়া আর গায়ের রঙের জন্য আলাদা মনে হয়। একজন সাদা সাহেবের মাথার খুলি আর একজন কালো মানুষের মাথার খুলিতে কোনও তফাত নেই!

প্ৰবীর বলল, ছেলে আর মেয়েদের মাথার খুলিতেও কোনও তফাত নেই। শুধু একটু ছোট-বড় হতে পারে। সে তো ছেলেদের চেহারাও ছোট-বড় হয়।

কাকাবাবু বললেন, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ছেলে মেয়েদের আলাদা করে চিনতে পারা যায়, কিন্তু কালো লোক, সাদা লোকের তফাত বোঝার কোনও উপায় নেই।

কমলিকা বলল, অ্যাডাম আর ইভের থেকেই তো মানুষ জাতটার জন্ম, ওরা তো ফরসা ছিল। তা হলে এত কালো মানুষ এল কী করে?

সন্তু বলল, কে বলল, অ্যাডাম-ইভ ফরসা ছিল?

কমলিকা বলল, বাঃ, কত ছবিতে দেখেছি!

সন্তু বলল, সেগুলো কি ক্যামেরায় তোলা ছবি, না আঁকা ছবি?

কমলিকা বলল, বাঃ, তখন বুঝি ক্যামেরা ছিল?

সন্তু বলল, আঁকা ছবি তো ইচ্ছেমতন রং দিয়ে আঁকা যায়। বাইবেলের ছবি সাহেবরা এঁকেছে, তাই সবাইকে ফরসা করে দিয়েছে।

প্ৰবীর বলল, ঠিক বলেছ, যিশুখ্রিস্টও সাহেবদের মতন ফরসা ছিলেন না। উনি তো মিল ইস্টের লোক।

সন্তু বলল, অ্যাডাম-ইভের কাহিনি তো গল্প। আমি ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছি, সায়েন্টিস্টরা বলেছেন, পৃথিবীর প্রথম মেয়েটি জন্মেছিল আফ্রিকায়। তার গায়ের রং কুচকুচে কালো। সে-ই আমাদের সকলের মা। তার নাম দেওয়া হয়েছে আফ্রিকান ইভ!

কাকাবাবু এদের আলোচনা শুনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। এখনকার ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু জানে। কত সহজে স্পষ্ট কথা বলে।

এবার তিনি সন্তুকে বললেন, যা, তাড়াতাড়ি মন্দির টন্দির দেখে আয়। আমি বসছি।

ওরা নেমে যাবার পর কাকাবাবু ড্রাইভার গৌরাঙ্গকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও দেখতে যাবে নাকি? যেতে পারো।

গৌরাঙ্গ বলল, না স্যার, আমি কতবার দেখেছি। রাজবাড়িতে কোনও অতিথি এলে তো আমাকেই দেখাতে আনতে হয়।

কাকাবাবু বললেন, তা তো ঠিকই। আচ্ছা, তুমি গুরুপদ রায়কে চেনে?

গৌরাঙ্গ বলল, কোন গুরুপদ? মুখপোড়া গুরুপদ? মোটর গ্যারাজে কাজ করে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। গাড়িও চালায়। ওর মুখোনা ওইভাবে পুড়ল কী করে?

গৌরাঙ্গ বলল, তা কে জানে! ও মাঝে মাঝে কোথায় যেন চলে যায়, দুমাস-তিন মাস ফেরে না। একবার ফিরল, ওইরকম কালো পোড়া-মুখ নিয়ে। কেউ জিজ্ঞেস করলে শুধু বলে অ্যাকসিডেন্ট। আর কিছু না। একবার ও এক জায়গায় ডাকাতির দায়ে ধরা পড়েছিল। হয়তো নিজে ডাকাতি করেনি, দলের লোকদের চিনত। সেবার তো আমাদের বাবুই ওকে বাঁচিয়ে দিলেন।

তোমাদের কোন বাবু? কিরণচন্দ্র…

আজ্ঞে না। তিনি তো এখানে প্রায় থাকেনই না। ছোটবাবু। উনি অনেক মানুষের উপকার করেন।

আচ্ছা, তোমাদের এই ছোটবাবু কি যাত্রা-থিয়েটার করেন?

গৌরাঙ্গ চমকে উঠে বলল, আপনি স্যার কী করে জানলেন? হঠাৎ কেন জিজ্ঞেস করলেন?

কাকাবাবু বললেন, এমনিই। কেন যেন মনে হল।

গৌরাঙ্গ বলল, হ্যাঁ, স্যার, এখানে মাঝে মাঝেই থিয়েটার হয়। ছোটবাবুকে ছাড়া চলেই না। রাজা-মহারাজার পার্টে ওঁকে খুব ভাল মানায়।

কাকাবাবু বললেন, তা তো মানাবেই। এখন রাজত্ব নেই বটে, তবু তো রাজবংশের সন্তান।

গল্প করতে করতে খানিকটা সময় কেটে গেল। তারপর ফিরে এল সন্তুরা।

কমলিকা বলল, মাথার খুলিগুলো ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলেছে। দেখলে আর ভূত-ভূত মনে হয় না।

সন্তু বলল, কপালে আবার চন্দনের ফোটা পরিয়ে দিয়েছে।

জোজো বলল, আমি একজন পুরুতঠাকুরকে জিজ্ঞেস করলুম, আগে কি এই মন্দিরে হিউম্যান স্যাক্রিফাইস, মানে নরবলি হত? তিনি খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন, না, না, না! আসলে নরবলি হত।

কমলিকা বলল, তুমি কী করে জানলে?

জোজো বলল, পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি, একটা খুলি আমায় ফিসফিস করে বলল, আমাদের বলি দিয়েছে। মুন্ডু কেটে জলে ফেলে দিয়েছে!

কমলিকা বলল, ওঃ, সন্তুটা কী গুল মারে!

সন্তু বলল, সত্যি, সন্তুকে নিয়ে আর পারা যায় না। আমাকে নকল করতে চায়, কিন্তু জানে না কিছুই!

প্ৰবীর বলল, চলুন, তা হলে পুকুরটার কাছে যাওয়া যাক।

কাকাবাবু জিপ থেকে নেমে পড়লেন। মন্দিরগুলোর পিছন দিক দিয়ে খানিকটা হাঁটতে হল।

পুকুরটা বেশ বড়। বাঁধানো ঘাট আছে, কিন্তু জল প্রায় নেই। মাঝখানে থিকথিকে কাদা। কিছু লোক আজ মাটি খোঁড়ার কাজ করছে।

কমলিকা বলল, ওই যে দেখছেন এক জায়গায় একটা বাঁশ পোতা, ওইখানে সিন্দুকটা পাওয়া গেছে। সেই সিন্দুকের মধ্যে সাতটা মানুষের মুন্ডু!

প্ৰবীর বলল, আবার তুই উলটোপালটা বকছিস? সিন্দুকটা তো খোলাই যায়নি। মুন্ডুগুলো ভিতরে থাকবে কী করে?

কমলিকা বলল, সরি, সরি!

কাকাবাবু ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, সন্তু, দ্যাখ তো, এখানে একটা পাথরের ফলকে কী লেখা আছে? উপরে শ্যাওলা জমে গেছে।

সন্তু একটা রুমাল ঘষে ঘষে শ্যাওলা খানিকটা তুলে ফেলল। পাশে দাঁড়িয়ে জোজো বলল, কী সব লেখা আছে হিন্দিতে।

সন্তু বলল, হিন্দি না, সংস্কৃত। অনেক অনুস্বর বিসর্গ আছে। সব পড়া যাচ্ছে না। মাতৃ… উৎসর্গ।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কোনও তারিখ লেখা আছে?

সন্তু বলল, হ্যাঁ, সন বারোশো দশ।

কাকাবাবু বললেন, তার মানে কেউ তার মায়ের নামে এই পুকুরটা উৎসর্গ করেছিল। আগেকার দিনে লোকে মনে করত, পুকুর কাটালে পুণ্য হয়। ঠিকই মনে করত। কত লোক ব্যবহার করতে পারত সেই পুকুর। এটা বেশ পুরনো।

কমলিকা বলো তো, এটা বাংলা কত সন?

কমলিকা জানে না। প্রবীর, জোজোও বলতে পারল না। সন্তু একটু চিন্তা করে বলল, চোদ্দোশো এগারো।

কাকাবাবু বললেন, তার মানে পুকুরটার বয়স কত?

কমলিকা বলল, নাইনটি নাইন।

কাকাবাবু বললেন, তুমি দেখছি অঙ্কে খুব ভাল। চট করে বলে দিলে।

সন্তু আর জোজো হাসছে দেখে কমলিকা বলল, ভুল হয়েছে, তাই না? আসলে তো আমি ভাল ছবি আঁকতে পারি, তাই অঙ্ক জানি না।

জোজো বলল, আমি তো ইংরেজিতে ফার্স্ট হই, তাই আমি সাঁতার জানি না।

সন্তু বলল, আমি তো শিঙাড়া খেতে ভালবাসি, তাই আমাকে মশা কামড়ায়।

কমলিকা বলল, এই, আমার সঙ্গে ইয়ারকি হচ্ছে! এমন মজা দেখাব!

প্ৰবীর বলল, তোমরা আমার বোনকে আর রাগিয়ো না, তা হলেই ভা করে কেঁদে ফেলবে!

কমলিকা বলল, মোটেই আমি ভা করে কাঁদি না। আমি উউ করে কাদি।

কাকাবাবু হাসছিলেন ওদের কথা শুনে। এবার বললেন, ওই পাশের বাড়িটা কী বলো তো? ওখানেও ভিড় দেখছি।

প্রবীর বলল, ওটা একটা খুব পুরনো ভাঙা বাড়ি। কেউ থাকে না। আমার জন্ম থেকেই এরকম দেখছি। লোকে বলে ভূতের বাড়ি।

কাকাবাবু বললেন, ওই লোকগুলো কি ভিড় করে ভূত দেখতে যাচ্ছে। নাকি? এই দিনেরবেলা!

প্ৰবীর বলল, ওই বাড়িটায় একটা সুড়ঙ্গ আছে। ভিতরে গেলে গা ছমছম করে। বাচ্চা বয়সে আমরা ওর মধ্যে খেলতে যেতাম। তবে বেশি দূর যাওয়া যায় না।

কাকাবাবু বললেন, আগেকার দিনে অনেক জমিদার বাড়িতে কিংবা রাজবাড়িতে এরকম সুড়ঙ্গ থাকত। শত্রুসৈন্য কিংবা ডাকাতের দল আক্রমণ করলে ওখানে লুকিয়ে থাকা যেত কিংবা পালিয়েও যাওয়া যেত অন্য দিক দিয়ে।

কথা বলতে বলতে কাকাবাবু এগিয়ে গেলেন সেই বাড়িটার দিকে।

সেখানে একজন লোক নোম বিক্রি করছে। অনেক লোক কিনছে একটা করে লাল রঙের মোম। যে-লোকটি বিক্রি করছে তার পিছনে একটা চৌকো টিনের সাইন বোর্ড। তাতে ইংরেজিতে লেখা, আব্দুল লতিফস ফেমাস ক্যান্ডেল শপ। ইচ রুপিজ ফাইভ। লোকটির চেহারা বেশ সুন্দর, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা।

কাকাবাবুদের দেখে লোকটি উৎসাহের সঙ্গে বলল, আসুন স্যার। মোম নিন। সুড়ঙ্গ দেখে আসুন। ভেরি থ্রিলিং! ভেরি ডার্ক। হয়তো ভূতেরও দেখা পেতে পারেন!

কাকুবাবু সন্তুদের জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, দেখতে যাবি নাকি?

সন্তু বলল, নাঃ! অনেক সুড়ঙ্গ দেখেছি! আর দিনেরবেলা ভূত দেখার কোনও মজা নেই!

কাকাবাবু আব্দুলকে জিজ্ঞেস করলেন, ওই সুড়ঙ্গে কি শুধু ভূতই আছে? পেতনি নেই, শাকচুন্নি নেই?

আব্দুল বলল, মেয়ে-ভূতের কথা বলছেন তো? তাও আছে গোটাচারেক!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নিজে ওর ভিতরে গেছ? তুমি ভূত দেখেছ কখনও?

আব্দুল এদিক-ওদিক চাকিয়ে নিচু গলায় বলল, আপনি তো ভালই জানেন স্যার, ভূত বলে কিছু নেই। ওসব গাঁজাখুরি গল্প। আমি বেকার, চাকরি-বাকরি পাইনি, তাই মোম বিক্রি করে চালাচ্ছি! ভূতটুতের কথা বললে, বিক্রি ভাল হয়।

কাকাবাবু বললেন, তা তো ভালই।

প্ৰবীর বলল, আব্দুলদা থিয়েটারে খুব ভাল পার্ট করেন। আমার ছোটকাকার থিয়েটারের দল আছে। আগেরবার এসে আমি একটা থিয়েটার দেখেছিলাম, কী যেন নামটা… হ্যাঁ, রাজা চলি গিলা বনবাস। তাতে আব্দুলদা সেনাপতি কীর্তি সিংহর পার্ট করেছিল। তাই না আব্দুলদা?

আব্দুল কাকাবাবুকে বলল, সামনের শনিবার আবার প্লে আছে। রায়চৌধুরীবাবু, আপনি থাকবেন তো? দেখে যান না?

কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, তুমি আমার নাম জানলে কী করে?

আব্দুল বলল, স্যার! আপনি সিন্দুকটা উদ্ধার করার জন্য কলকাতা

থেকে এখানে আসছেন, তা তো সবাই জানে!

কাকাবাবু প্রবীরের দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে বললেন, কী ব্যাপার বলো

তো? আমি আমি যে এখানে আসব, তা আগে থেকে কে রটিয়ে দিয়েছে? আর সিন্দুকটার সঙ্গেই বা আমার নাম জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কেন?

প্ৰবীর বলল, কে রটিয়েছে, তা তো আমি জানি না। আমি কাউকে বলিনি। মানে, বলার কথা মনেই আসেনি। কমলিকা—

কমলিকা ঠোঁট উলটে বলল, ওসব কথা বলতে আমার বয়েই গেছে!

প্ৰবীর বলল, আমি তো জানি, আপনি আমাদের বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন। কোনও কাজের জন্য আসেননি!

সন্তু বলল, কাল রেল স্টেশনেই একটা লোক বলেছিল…

জোজো বলল, সে লোকটা জ্যোতিষী!

সন্তু বলল, আর-একজন চোখ-বোজা সাধু, সেও মনে হল জানে।

কাকাবাবু বললেন, উঃ, এখানটায় দারুণ রোদ। আর দাড়াতে পারছি।

জোজো বলল, এবার ফিরে যাওয়া যাক। খিদে পেয়ে গেছে!

কমলিকা বলল, তোমরা দিব্যগড় যাবে না? আগে দিব্যগড় দেখে নাও!

জোজো বলল, খালি পেটে কোনও দুর্গ দেখতে নেই, মহাভারতে লেখা আছে!

সন্তু বলল, মহাভারতে না, বাইবেলে!

কমলিকা আর আপত্তি করল না। চোখ কুঁচকে একটু ভেবে বলল, খাওয়ার পরে যাওয়াই ভাল। খেতে দেরি হলে বাবা আপত্তি করবেন। চলুন বাড়ি ফিরে যাই।

দুপুরে দারুণ খাওয়াদাওয়া হল।

এরকম ভাঙা বাড়ি। সারা বছর প্রায় কেউই থাকে না, তবু যত্নের কোনও ত্রুটি নেই। তিনরকম মাছ কী করে জোগাড় হল, তাই-ই বা কে জানে? এখানে এত ভাল রাবড়ি পাওয়া যায়। কমলিকা খুব যত্ন করে খাওয়াল।

তারপরই সে বলল, কাকাবাবু এবার চলুন, দুর্গ দেখতে যাই। কিংবা রোদ্দুরের মধ্যে আপনার যেতে কষ্ট হবে?

কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছ! এত খাওয়ালে, এরপর একটু বিশ্রাম না নিলে কি চলতে পারে? এখন একটু বিছানায় শুয়ে গড়াব। আমার পা দুটোকে মাঝে মাঝে বিশ্রাম দিতে হয়।

কমলিকা বলল, তা হলে সন্তু আর জোজো চলুক!

জোজো বলল, রোদ্দুরের মধ্যে দুর্গ দেখার বারণ আছে উপনিষদে।

কমলিকা চোখ পাকিয়ে বলল, আবার বাজে কথা! আমি বুঝি বুঝি না? ওসব কিছু লেখা নেই। চলো, চলো…

সন্তু জোজোকে বলল, ঠিক আছে, চল রে সন্তু, ঘুরেই আসি!

কমলিকা প্রায় জোর করেই ওদের দুজনকে নিয়ে গেল বেড়াতে।

কাকাবাবু ঘরে এসে শুয়ে পড়লেন।

সেই হিসেবের খাতাটা পড়তে লাগলেন মন দিয়ে।