০৯. আকাশের অন্ধকার কাটিয়ে চাঁদ উঠল

সন্ধের একটু পরেই আকাশের অন্ধকার কাটিয়ে চাঁদ উঠল। এখন আর মেঘও নেই। ফুরফুরে হাওয়ায় ঠান্ডা হবে।

এই দ্বীপের জেটিটা একেবারে ভাঙা। কাকাবাবু খুব কায়দা করে বোটটা সেখানে ভেড়ালেন। তবু খানিকটা জলে পা দিয়েই নামতে হল।

ওপরে এসেই রাধা জিজ্ঞেস করল, এখানে কচ্ছপ নেই?

সেলিম বললেন, খুঁজে দেখতে হবে। তবে সব জায়গায় কচ্ছপ আসে না। ওদের স্বভাবই হচ্ছে, প্রতি বছর ঠিক এক জায়গায় ডিম পাড়তে আসে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কচ্ছপের ডিম খাওয়াও কি নিষেধ?

কাকাবাবু বললেন, সঙ্গে এত হাঁস-মুরগির ডিম আছে, এর ওপর আবার কচ্ছপের ডিম খেতে চাস?

জোজো বলল, আমি একটা টেস্ট করে দেখব। কচ্ছপের ডিম পিং পং বলের মতন, তাই নয়?

জিনিসপত্রগুলো সব নামানো হল বোট থেকে। মোট দুটো চর্চও আছে দলটির সঙ্গে।

কমান্ডোটির নাম প্রসন্ন। সেলিম তাকে আগে আগে যেতে বললেন।

ওপরের মাটি ভিজে ভিজে। কাকাবাবু টর্চ জ্বেলে দেখতে লাগলেন মাটি। কারুর পায়ের ছাপ কিংবা কোনও কিছু টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ নেই।

ভাঙা বাড়িটার কাছে পৌঁছতে বেশিক্ষণ লাগল না।

বাইরে দাঁড়িয়ে সেলিম চিৎকার করে বললেন, আমরা পুলিশের লোক। ভেতরে কেউ থাকলে বেরিয়ে এসো।

এরকম তিনবার বলার পরেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

সেলিম এবার সামনের দরজাটা জোরে ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। ভেতরে টর্চ ফেলে বললেন, কেউ নেই। মেঝেতে ধুলো জমে আছে। কোনও জীবজন্তু ঢোকেনি।

এবার সবাই ঢুকে পড়লেন ভেতরে।

বাড়িটি একসময় দোতলা ছিল, কিন্তু ওপরের ঘরগুলো এখন একেবারেই ভাঙা। কোনওটার ছাদ নেই, কোনওটার দেওয়াল ধসে গেছে। তবে নীচে প্রায় চারখানা ঘর ব্যবহার করা যায়।

কাকাবাবু বললেন, মেজেতেই শুতে হবে। ধুলোটুলোর কথা চিন্তা করলে চলবে না।

সন্তু বলল, এখানে গরমও নেই। ঠান্ডাও নেই। আমরা বাইরে মাঠে শুতে পারি না?

সেলিম বললেন, তোমার দেখছি খুব সাহস। তবে প্রথম রাতটাতেই বাইরে শোওয়া ঠিক হবে না।

কাকাবাবু বললেন, যখন-তখন বৃষ্টি আসতে পারে। সেইজন্যই ঘরে শুতে হবে। রবার্টসাহেব বাড়িটা বেশ যত্ন করেই বানিয়েছিলেন। বড় বড় জানলা, সব কাচ ভেঙে গেছে অবশ্য।

সেলিম বললেন, নিশ্চয়ই পাগলাটে লোক ছিলেন। নইলে এরকম নির্জন দ্বীপে এত খরচ করে কেউ বাড়ি বানায়? তাও বাড়িসুদ্ধ পুরো দ্বীপটাই যে চলে যেতে পারে জলের তলায়, সে কথাও ভাবেননি। এ বাড়িটা যে একবার ড়ুবে গিয়েছিল, তার প্রমাণ দেখুন না, দেওয়ালে শ্যাওলা লেগে আছে।

রাধা বলল, আজ রাত্তিরে যদি আবার ড়ুবে যায়?

কাকাবাবু বললেন, তা তো যেতেই পারে। তুমি একটা দ্বীপে থাকতে চেয়েছিলে। অনেক দ্বীপই ড়ুবে যায়। তুমি সাঁতার জানো?

রাধা বলল, হ্যাঁ, খুব ভাল জানি।

সন্তু বলল, জোজোকে নিয়েই মুশকিল হবে। জোজো সাঁতার শেখেনি।

জোজো বলল, তাতে মুশকিলের কী আছে। জল আসছে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে বোটে উঠে পড়ব। বোট তো আর ড়ুবছে না। তোমাদের খিদে পায়নি?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, খাওয়ার ব্যাপারটা তাড়াতাড়িই সেরে নেওয়া যাক।

সেলিম বললেন, একটা খুব বোকামি হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে মাত্র দুবোতল জল আছে। এতে আর কতক্ষণ চলবে এতগুলো মানুষের? চারদিকে। এত বড় সমুদ্র, কিন্তু তার জল তো খাওয়া যায় না। সেই যে কোলরিজের কবিতা আছে, Water, water every where, not a drop to drink.

জোজো বলল, আমাদের বোটে অনেক খাবার জল আছে। অন্তত এক ডজন বোতল।

কাকাবাবু বললেন, খানিকবাদে বোট থেকে জল নিয়ে আসতে হবে। এখন

তো চলুন।

সেলিম বললেন, ডিম তো কাঁচা খাওয়া যাবে না। সেদ্ধ বা ভাজা করতে হবে। তা কী করে হবে?

কাকাবাবু বললেন, এ বাড়িতে তো রীতিমতন রান্নাঘর আছে। একসময় একটা বিজ্ঞানীর দল এসে এখানে থেকেছে, তারা নিশ্চয়ই রান্না করে খেয়েছে।

চলো, সেটা দেখা যাক।

জোজো বললেন, আমি কাঁচা ডিমও খেতে পারি। একবার বালাতেন লেকের ধারে ভূমিকম্পে আটকা পড়ে গিয়েছিলুম। তখন চারদিন শুধু কাঁচা ডিম খেয়ে কাটিয়েছি।

রাধা জিজ্ঞেস করল, বালাতোন লেক কোথায়?

জোজো বলল, হাঙারিতে। তাও জানো না?

সন্তু খুব অবাক হবার ভান করে জিজ্ঞেস করল, ভূমিকম্পে আটকা পড়ে গিয়েছিলি? অনেক বাড়িঘর ভেঙে গিয়েছিল?

জোজো বলল, অনেক, অনেক। আমরা একটা ভাঙা বাড়ির তলায় আটকা পড়ে গিয়েছিলাম, দুবছর আগে ওখানে কী দারুণ ভূমিকম্প হয়েছিল, কাগজে পড়িসনি?

সন্তু বলল, অত বাড়িঘর ভাঙল, আর ডিমগুলো ভাঙল না।

হো হো করে হেসে উঠলেন সেলিম। কাকাবাবুও মুচকি হাসলেন।

জোজো এতে দমবার পাত্র নয়। সে জোর দিয়ে সন্তুকে বললেন, ভাঙবে না কেন? কয়েক হাজার ডিম ভেঙে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তার মধ্যেও কিছু আস্ত ছিল, সেগুলো বেছে বেছে তুলতে হয়েছে। সে বাড়িটা কী ছিল জানিস? একটা হাঁসমুরগির ফার্ম! হাঁসগুলো সব লেকের জলে ঝাঁপ দিয়েছিল আর মুরগিগুলো পালিয়ে গিয়েছিল জঙ্গলে।

রান্নাঘরে এসে দেখা গেল একটা পাথরের তৈরি উনুন বানানো আছে আর এককোণে পড়ে আছে কিছু কাঠকুটো। সেগুলো একটু ভিজে ভিজে। তবু সেগুলো দিয়েই অতি কষ্টে ধরানো হল উনুন, চায়ের কেটলিতে ফুটিয়ে নেওয়া হল কয়েকটা ডিম।

তারপর ডিম-পাউরুটি আর খেজুর-বাদাম দিয়ে বেশ ভালই খাওয়া হল।

কোনও ঘরেই কোনও খাট কিংবা চেয়ার নেই। তবে জানলাগুলোর সঙ্গে অনেকটা জায়গা, সেখানে উঠে বসা যায়।

কাকাবাবু একটা জানলার ধারে বসে তাকিয়ে আছেন বাইরের দিকে। এবাড়িটা সমুদ্রের বেশ কাছে, তারপরে অনেকখানি খোলা জায়গা। দ্বীপের অন্য প্রান্তটা দেখা যায় না।

কাকাবাবু একসময় বললেন, অশান্ত সমুদ্রের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

নাইড়ুর দূরবিনটা সেলিম রেখে দিয়েছেন, সেটা দিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, দূরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। রায়চৌধুরী সাহেব, আপনি দেখবেন?

কাকাবাবু দূরবিনটা তার কাছ থেকে নিয়ে চোখে লাগালেন। কয়েক মিনিট ধরে দেখে তিনি বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি। ওটা কী বলে মনে হয় আপনার?

সেলিম বললেন, মশাল হতে পারে না?

কাকাবাবু বললেন, ওটা এক জায়গায় নেই। সরে সরে যাচ্ছে।

সেলিম বললেন, মশাল হাতে নিয়ে যদি কেউ দৌড়ায়, তা হলে ওই রকমই। মনে হতে পারে।

আর একটু দেখে কাকাবাবু বললেন, মশাল নিয়ে কে দৌড়বে? কেন দৌড়বে?

সন্তু বলল, আমি ওখানে গিয়ে দেখে আসব?

সেলিম বললেন, না। প্রথম রাত্তিরটা বাইরে বেরুবার দরকার নেই। আগে সব কিছু বুঝে নেওয়া যাক। পালা করে রাত জেগে পাহারাও দিতে হবে।

রাধা এরই মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েছে। জোজোরও চোখ জুড়ে আসছে।

কাকাবাবু বললেন, ওই অস্পষ্ট আলোটা যদি মশাল হয়, তা হলে কেউ একটা ছোট্ট জায়গায় ওটা নিয়ে একবার এদিক একবার ওদিক যাচ্ছে। ব্যায়াম করছে নাকি?

সেলিম বললেন, একটা আলো তো দেখা যাচ্ছে ঠিকই।

কাকাবাবু বললেন, অন্ধকার রাত্তিরে যদি সমুদ্রের ধারে বসে থাকেন, তা হলে দেখতে পাবেন, একসময় দূরের ঢেউগুলোর ওপর আলো রয়েছে। ঠিক যেন আলোর মালা।

সেলিম বলল, জানি, ওগুলো ফসফরাস। সমুদ্রের জলে খুব বেশি থাকে, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে। কিন্তু এটা তো জলে নয়, মাটিতে, একটু উঁচুতে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি উইল-ও-দা-উইল্প কাকে বলে জানেন? কিংবা জ্যাক-ও-ল্যানটার্ন?

সেলিম বললেন, না, জানি না তো?

কাকাবাবু বললেন, আমরা বাংলায় একে বলি আলেয়া। অগভীর জলাভূমি, যেখানে মানুষজন বেশি যায় না, সেখানে এই আলেয়া দেখা যায়। নির্জন মাঠের মধ্যে অনেকে এই দেখে ভূতের ভয় পায়। কেউ ভাবে ঘোমটা দেওয়া পেত্নি, কেউ ভাবে মানুষ নেই, তবু শূন্যে মশাল জ্বলছে। কেউ বা সাহস করে ওটাকে ধরতে যায়। কিন্তু ওটাকে ধরা তো যায়ই না। ওর দিকে এগোলেই দূরে সরে যায়। যেমন সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় ফসফরাসের আলো কি ধরা যায়? এই আলোও আসলে ফসফরাস, তার সঙ্গে হাইড্রোজেন মিশে যে গ্যাস হয়, সেই গ্যাসটাকেই এক-এক সময় আলোর মতন মনে হয়। সেই আলোটা লাফায়, ঠিক যেন মনে হয় নাচছে, কিংবা মানুষের মতন দৌড়োচ্ছ। নির্জন রাত্রিতে তা দেখে ভয় লাগতেই পারে। প্রকৃতির কত বিচিত্র রূপ।

দূরবিন দিয়ে আর একবার দেখে নিয়ে কাকাবাবু আবার বললেন, অবশ্য এই আলোটা আলেয়া নাও হতে পারে। কাল দিনের বেলা জায়গাটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। আপনি আর আমি যাব।

সেলিমের কাছ থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে কাকাবাবু তাকিয়ে দেখলেন। সেলিম দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সন্তু জোজো সবাই শুয়ে পড়েছে মাটিতে।

কাকাবাবুর একবার হাই উঠল।

তিনি অবাক হয়ে ভাবলেন, এত তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল সবাই? রাত তো বেশি হয়নি।

হাওয়ার তেজ বেড়েছে, শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে।

কমান্ডোটি বাইরে বসে আছে। কাকাবাবু একবার ভাবলেন, তার সঙ্গে কথা বলবেন।

কিন্তু তাঁরও খুব ক্লান্ত লাগল। সারাদিন কম ধকল তো যায়নি। তা ছাড়া দুশ্চিন্তা ছিল খুব। সেসব মিটে গেছে বলেই শরীরটা বিশ্রাম নিতে চাইছে।

কাকাবাবু ভাবলেন, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যাক। প্রতি রাত্তিরেই তাঁর দু-তিনবার ঘুম ভাঙে। মাঝরাতে উঠে কমান্ডোকে ছুটি দিয়ে তিনি পাহারা দেবেন।

সেই জানালার রেলিং-এ হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন কাকাবাবু।

সকালের আলো চোখে লাগবার পর তাঁর ঘুম ভাঙল।

প্রথমেই তাঁর লজ্জা হল। রাত্তিরে একবারও জাগেননি, কমান্ডোকে ছুটি দেওয়া হয়নি।

সন্তুরা সবাই এখনও ঘুমিয়ে আছে।

কাকাবাবু তাড়াতাড়ি বাইরে এসে দেখলেন, অস্ত্রটা পাশে রেখে কমান্ডোও দিব্যি ঘুমোচ্ছে নাক ডাকিয়ে। এই তার পাহারা দেওয়ার ছিরি।

রাত্তিরে অবশ্য কিছুই ঘটেনি। দিনের আলোয় পুরো দ্বীপটা খালি পড়ে আছে, কোনও জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। দূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্র।

ঘরে এসে কাকাবাবু সন্তুর নাম ধরে ডাকতেই সে উঠে বলল। দুহাতে চোখ মুছতে মুছতে বলল, এ কী, সকাল হয়ে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, খুব ঘুমিয়েছিস!

সন্তু বলল, কখন যে ঘুমিয়ে পড়লুম, টেরই পাইনি। সন্তু ডেকে তুলল জোজোকে, একে একে সবাই উঠল।

সেলিমও খুব লজ্জা পেয়ে গেছেন। ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে কাকাবাবুকে বললেন, ছি ছি ছি, আমারও পাহারা দেবার কথা ছিল, শরীরটা যে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, বুঝতে পারিনি। আপনি অনেকক্ষণ জেগেছিলেন, তাই না?

কাকাবাবু বললেন, আমিও একটানা ঘুমিয়েছি। আপনার লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

সেলিম চলে গেলেন চা বানাতে। অন্যরাও রান্নাঘরে গিয়ে ভিড় করল, শুধু কাকাবাবু বসে রইলেন জানালার বেদিতে। তাঁর কপাল কুঁচকে গেছে।

চা এল কাগজের গেলাসে। তাতে চুমুক দিতে দিতে সেলিম বললেন, যাই বলুন, এমন চমৎকার গাঢ় ঘুম বহুদিন হয়নি। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে।

কাকাবাবু বললেন, ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোবার মতন, তাই না?

সেলিম বললেন, ঠিক বলেছেন। প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মতন ঘুম।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, অথচ আমরা কেউই ঘুমের ওষুধ খাইনি। সবাই মিলে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়াটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। যতই ক্লান্তি থাক, আমি কখনও সারা রাত একটানা ঘুমোতে পারি না। অথচ কাল একবারও জাগিনি। এটা জোজোদের বোটের মতন ব্যাপার নয়।

সেলিম বিস্মিতভাবে বললেন, সবাই একসঙ্গে একটানা ঘুমিয়েছি? কী করে এমন হল?

কাকাবাবু বললেন, তা আমিও জানি না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, তুমি একটা বাঁশির আওয়াজ শুনেছিলে?

কাকাবাবু বললেন, বাঁশির আওয়াজ? না শুনিনি।

সন্তু বলল, সত্যি শুনেছি, না স্বপ্ন দেখেছি, তা জানি না। তবে মনে হচ্ছিল, হাওয়ার শব্দের সঙ্গে খুব মৃদুভাবে বাঁশির মতন একটা কিছু বাজছে।

রাধা বলল, আমিও শুনেছি বাঁশির আওয়াজ।

সন্তু বলল, দুজনে একই জিনিস শুনলে তো তা স্বপ্ন হতে পারে না।

কাকাবাবু বললেন, কে বাঁশি বাজাবে? কেউ তো ছিল না?

জোজো বলল, অনেকে মনে করে, ভূতেরা বাঁশি বাজাতে পারে না। কিন্তু জার্মানিতে একটা ভূতের বাড়িতে আমি নিজের কানে শুনেছি। সে বাঁশি শুনলেই ঘুম পায়।

জোজোর কথায় পাত্তা না দিয়ে সেলিম বললেন, বাঁশি বাজুক আর না বাজুক আমরা একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছি, এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার। চলুন, কাকাবাবু, আগে আমরা কাল রাতের সেই আলেয়ার জায়গাটা দেখে আসি।

মুখটুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে সবাই মিলে গোটা দ্বীপটাই ঘুরে দেখা হল। কোথাও মানুষ থাকার কোনও চিহ্ন নেই। এক জায়গায় কিছু গাছপালা আছে, সেখানে কিছু কিছু পুরনো গাছের ডাল মাটিতে পড়ে পচেছে। সেখানকার মাটি বেশ ভিজে ও মাঝে-মাঝে গর্ত, সেই গর্তে জল ভরতি, অর্থাৎ দ্বীপের এই দিকটায় মাঝে-মাঝেই সমুদ্রের জল উঠে আসে। কয়েকটা মরা মাছও দেখা

গেল।

নরম মাটিতে কাকাবাবুর ক্রাচ গেঁথে গেঁথে যাচ্ছে। তাঁর অসুবিধে হচ্ছে হাঁটা-চলায়।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমি আর জোজো একটু এগিয়ে যাব। সমুদ্রে স্নান করে আসব।

কাকাবাবু বললেন, যা, জোজোর হাত ধরে থাকিস। তবে, সেই চশমা তো নেই, স্নরকেলিং করার সুবিধে হবে না।

রাধাও চলে গেল ওদের সঙ্গে।

সেলিম বললেন, এই ঘুমের ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তুলল। যদি কেউ আমাদের ঘুম পাড়িয়ে থাকে, তবে তার উদ্দেশ্য কী? আমাদের তো কোনও ক্ষতি করেনি।

কোনও মন্তব্য না করে কাকাবাবু বললেন, হুঁ।

সেলিম বললেন, এমনও হতে পারে। এখানকার বাতাসে কোনও জীবাণু বা বীজাণু আছে, কোনও ভাইরাস, তাতে বেশিক্ষণ নিশ্বাস নিলেই ঘুম পায়।

কাকাবাবু বললেন, এমন কোনও ভাইরাসের কথা আমি কখনও শুনিনি।

সেলিম বললেন, হয়তো আর কোথাও নেই, শুধু এখানেই আছে। এই কথাটা একবার রটে গেলে এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে টুরিস্ট ছুটে আসবে। শুধু ভাল করে ঘুমোবার জন্য।

কাকাবাবু বললেন, সেটা খুব ভাল হবে না। এখানে কোরাল রিফ আছে। আপনি জানেন? বেশি লোক এলে তা নষ্ট হয়ে যাবে!

সেলিম বললেন, কোরাল রিফের কথা শুনিনি তো?

কাকাবাবু বললেন, দুপুরের দিকে আমিও সমুদ্রে নামব। তখন আপনাকে দেখাব।

বাড়িটাতে ফিরে এসে কাকাবাবু বললেন, আর একবার চা কিংবা কফি খেলে হয় না? এবার আপনি বসুন, আমি বানিয়ে আনছি।

সেলিম বললেন, না, না, রান্নাটা আমার দায়িত্ব। আপনি বসুন। আকাশ পরিষ্কার ছিল, হঠাৎ ঘনিয়ে এল মেঘ। তারপরই ঝড় উঠল। সমুদ্রে এরকম যখন তখন ঝড়বৃষ্টি হয়। কিন্তু এখানে মেঘ যেন দৌড়োচ্ছে, এক এক জায়গায় মেঘের মধ্যে ঝড়ের তোলপাড় হচ্ছে, এ দৃশ্য সব সময় দেখা যায় না।

একবারও মেঘের গর্জনও শোনা গেল না, দেখা গেল না বিদ্যুতের ঝলক।

এরকম ঝড় বোধহয় শুধু সমুদ্রের মধ্যে কোনও দ্বীপে বসেই দেখা যায়।

কাকাবাবু সন্তুদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়লেন। ওরা এখনও জলের মধ্যে থাকলে এই ঝড় ওদের অনেক দূরে টেনে নিয়ে যেতে পারে। তিনি জানলার দিকে চেয়ে রইলেন।

সেলিমও বললেন, ছেলে-মেয়েরা সমুদ্রে গেল..এই ঝড়ের মধ্যে…

সন্তুরা প্রায় তখনই ফিরে এল দৌড়াতে দৌড়োতে।

কাকাবাবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

রাধা বলল, আকাশের অবস্থা দেখে আমি কিন্তু জলে নামিইনি।

জোজো বলল, ঝড়ের সময় সমুদ্রে স্রোত খুব বেড়ে যায়। আমাদের আর একটু হলে স্রোতের টানে ভেসে যেতে হত। আমি এর মধ্যেই অনেকটা সাঁতার শিখে গেছি।

সন্তু একেবারে গম্ভীর। কোনও কথাই বলছে না।

একটু পরে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোর কী হয়েছে রে সন্তু?

সন্তু কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, কাকাবাবু, আমি তোমাকে একটা কথা বলব। এখানে না। তুমি একটু পাশের ঘরে আসবে?

কাকাবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, কেন, পাশের ঘরে যেতে হবে কেন? যা বলবার, এখানে বল না!

সন্তু তবু চুপ করে রইল।

কাকাবাবু সেলিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, লোকজনের সামনে কানে কানে কথা বলা কিংবা একপাশে ডেকে গোপন কথা বলা খুবই অভদ্রতা। আমি একদম পছন্দ করি না। সন্তু তা জানে। তবু যখন ও জোর করছে, নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। কিছু মনে করবেন না।

তিনি সন্তুকে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

সন্তু মুখ নিচু করে বলল, ওদের সামনে কিছু বলতে চাইনি, কেউ বিশ্বাস করবে না, শুনে হয়তো হাসবে। তুমিও বিশ্বাস করবে কি না জানি না!

কাকাবাবু সন্তুর কাঁধে হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, আমি কি তোর কোনও কথায় অবিশ্বাস করতে পারি?

সন্তু বলল, আমি জলে ড়ুব দিয়ে কোরালগুলো দেখছিলাম, হঠাৎ একটা ব্যাপার হল। আমি তার কোনও মানেই বুঝতে পারছি না। ড়ুবসাঁতার কাটছি, এক জায়গায় কীসের সঙ্গে যেন খুব জোরে আমার মাথা ঠুকে গেল। অথচ সেখানে কিছু নেই। পাথর নেই, এমনকী কোনও মাছও নেই, শুধু জল। সেই জলই যেন পাথরের মতন কঠিন। আমি আবার সেখানটায় যেতেই আবার ধাক্কা, এবার ছিটকে গেলাম দূরে, মাথায় বেশ লেগেছে। যেন একটা পাথরের দেওয়ালের সঙ্গে…অথচ দেওয়াল-টেওয়াল কিছু নেই।

সন্তু কপালের এক পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, এইখানটায় খুব লেগেছে!

কাকাবাবু দেখলেন, সন্তুর কপালের সেইখানটা ফুলে গেছে, রক্ত জমে কালচে দেখাচ্ছে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, জল তো পাথরের মতন শক্ত হতে পারে না। তবে কি আমার মনের ভুল?

কাকাবাবু বললেন, মনের ভুল হলে কপাল ফুলে যায় না। শোন সন্তু, আমারও ঠিক এইরকম হয়েছিল। আগের দিন, জলের নীচে কিছুর সঙ্গে আমারও জোর ধাক্কা লেগেছিল, কিন্তু সেখানে পাথরটাথর কিছু ছিল না। শুধু জল। আমারও একবার খটকা লেগেছিল। জল যদি বরফ হয়ে জমে যায়, তাতে ধাক্কা লাগতে পারে, বরফ অনেক সময় পাথরের মতনই শক্ত হয়, কিন্তু বরফরফ কিছু ছিল না।

সন্তু যেন খানিকটা স্বস্তি পেয়ে বলল, তোমারও এরকম হয়েছিল। সত্যি? কী করে হয় এমন?

কাকাবাবু বললেন, আমিও বুঝতে পারছি না। সেদিন থেকে ভেবে চলেছি। আবার ঠিক ওই জায়গাটায় নেমে দেখতে হবে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, দ্বিতীয়বার আমার মনে হয়েছিল, শুধু ধাক্কা লাগেনি। কেউ বা কিছু আমাকে ঠেলে দিল। জ্যান্ত কিছু। অথচ দেখা যাচ্ছে না। অদৃশ্য কোনও প্রাণী হতে পারে?

কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীতে অদৃশ্য কোনও প্রাণী আছে বলে তো শোনা যায়নি। অদৃশ্য শক্তি আছে। যেমন ধর ইলেকট্রিসিটি। যেমন মাধ্যাকর্ষণ। চুম্বকের টানও এইরকম। জলের মধ্যে ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি হতে পারে কিনা, তা জানি না। কোনও বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞেস করতে হবে। তার আগে আমি ওই জায়গাটায় গিয়ে দেখব।

সন্তুর হাত ধরে সামনের ঘরে নিয়ে এসে কাকাবাবু বললেন, সেলিমসাহেব, সন্তু আপনাদের সামনে কথাটা বলতে চায়নি, কারণ আপনারা হয়তো বিশ্বাস করতেন না। তবু আপনাদের জানা উচিত। জলের অনেকটা নীচে সন্তুর গায়ে কোনও একটা কঠিন জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল, অথচ সেখানে কিছুই ছিল না, জল ছাড়া। সন্তু এটা বানায়নি। এরকম অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে।

জোজো বলল, ও বুঝেছি। ইলেকট্রিক ফিশ। এক ধরনের ইল মাছ। কাছাকাছি গেলেই কারেন্ট মারে।

সন্তু বলল, সেখানে কোনও মাছই ছিল না। ইল মাছ কি অদৃশ্য হতে পারে নাকি?

জোজো বলল, হ্যাঁ, পারে। ইল মাছ নিজেই নিজের শক খেয়ে মাঝে মাঝে অদৃশ্য হয়ে যায়। একবার বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কাছে পাঁচজন নাবিক ইলেকট্রিক শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, অথচ সেখানে কিছুই ছিল না। পরে, জানা গেল, ওটা অদৃশ্য ইল মাছের কাণ্ড।

রাধা দুদিকে মাথা দুলিয়ে বলল, না, ভাই, আমি বইতে পড়েছি, ইল মাছ নিজে কখনও শক খায় না। মাকড়সা যেমন নিজের জালের আঠায় আটকা পড়ে না। আর শক খেলেও কেউ অদৃশ্য হতে পারে না। কোনও প্রাণীর পক্ষে সম্ভব নয়।

জোজো বলল, হ্যাঁ, সম্ভব। অনেক প্রাণীই অদৃশ্য হতে পারে। যেমন জোনাকি, যেমন মশা, যেমন চোখ গেল পাখি, আর ভূত হলে তো কথাই নেই। মাছেরাও, মানে খুব বড় মাছও মরে গেলে ভূত হয়। একবার সিডনিতে…

সন্তু বলল, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের সব গল্পই বানানো। আর জোজো, তোর মাছভূতের গল্পও আমরা এখন শুনতে চাই না। এটা সিরিয়াস ব্যাপার।

সেলিম মুগ্ধ দৃষ্টিতে জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, এ ছেলেটির তো দারুণ ক্ষমতা। চোখের নিমেষে গল্প বানাতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, ঝড় থামলে আমি ওখানকার জলে নেমে দেখব।

সেলিম বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন, এ ঝড় থামবার তো কোনও লক্ষণই নেই।

কাকাবাবু বললেন, তবু কমে আসছে।

সন্তু বলল, কারা যেন আসছে এদিকে।

দরজার বাইরে দাঁড়ানো কমান্ডোটিও বলল, কিছু লোক আসছে। ফায়ার করব?

কাকাবাবু বললেন, না, না, আগেই গুলি ছুড়ো না। কাছে আসুক একটু।

ঝড়ের মধ্যে কোনওরকম মাথা ঢাকা দিয়ে দুলে দুলে আসছে দুজন। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না।

কাকাবাবু আর সেলিমও রিভলভার বার করে জানলাটার দুপাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন।

আর একটু কাছে আসার পর সেই আগন্তুকদের একজন চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, এনিবডি হোম? এনিবডি?

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, এ কী, এ তো আমার বন্ধু নরেন্দ্র ভার্মার গলা।

সে দারুণ অসুস্থ, সে আসবে কী করে?

জোজো বলল, অন্য কেউ নরেন্দ্রকাকার গলা নকল করতে পারে। আমি তো আমাদের প্রধানমন্ত্রীরও গলা নকল করতে পারি।

কাকাবাবুও চেঁচিয়ে বললেন, আপনারা কে? মাথার ওপর হাত তুলে এগিয়ে আসুন।

ওদের একজন বলল, আমি দুঃখিত। আমার পক্ষে হাত তোলা সম্ভব নয়!

তারপর হেসে উঠল হা-হা করে।

এবার দেখা গেল, সত্যিই নরেন্দ্র ভার্মা আর তাঁর সঙ্গে নাইড়ু। নরেন্দ্র ভার্মার একটা হাত নিয়ে কাঁধ ও বুকজোড়া মস্ত ব্যান্ডেজ। নাইড়ুর হাতে একটা রাইফেল।

কাকাবাবু এখনই অবিশ্বাসের সুরে বললেন, নরেন্দ্র, তুমি! এই অবস্থায় এলে কী করে?

নরেন্দ্র ঘরের মধ্যে এসে বললেন, কেমন আছ তোমরা সবাই দেখতে এলাম। রাজা, আমার হাতে গুলি লেগেছে। পায়ে তো কিছু হয়নি। আর বাঁ হাত দিয়েও

আমি রিভলভার চালাতে পারি।

কাকাবাবু নাইড়ুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ঝড়ের মধ্যে আপনারা বোট চালিয়ে এলেন কী করে?

নাইড়ু বললেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। আমরা এতখানি বোট চালিয়ে এলাম, সমুদ্রে কোথাও ঝড়-বৃষ্টি নেই। শুধু এত ঝড় এই দ্বীপটায়। এটা কী করে সম্ভব?

নরেন্দ্র বললেন, হতে পারে। প্রকৃতির মধ্যে এখনও এমন অনেক কিছু হয়, যার আমরা ব্যাখ্যা জানি না। রাজা, শোনো, একটা ভাল খবর আছে। তোমরা রকেট হায়দরাবাদি আর অন্যদের গ্রেফতার করেছ, দারুণ সাহস দেখিয়েছ।

কাকাবাবু বললেন, আমরা কিছুই করিনি। ওরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ধরা দিয়েছে।

নরেন্দ্র বললেন, শোনোই না। ওদের আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য। জোজোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওরা আমাদের দৃষ্টি এদিকে ফিরিয়ে রাখতে চেয়েছিল। আর দলের অন্য লোক প্ল্যান করেছিল, জেল থেকে ডিমেলোকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। এটা একটা পুরনো কায়দা। অনেক জায়গাতেই ক্রিমিনালরা একদিকে নজর ঘুরিয়ে রেখে অন্য দিকে একটা বড় কাণ্ড করে। সেইটা আঁচ করে কাল একটা ফাঁদ পাতা হয়েছিল। ডিমেলোকে জেল থেকে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, একটা গাড়িতে, সঙ্গে একজন মাত্র গার্ড। ঠিক এক জায়গায় অন্য একটা গাড়ি এসে পাঁচজন বন্দুকধারী ডিমেলোকে উদ্ধার করতে গেল। পুলিশ কমিশনার দুগাড়ি পুলিশ নিয়ে তৈরি ছিলেন, সব কটাকে জালে তোলা হয়েছে। ওদের পুরো দলটাই এখন শেষ! রাজা, এর জন্য তোমার কৃতিত্ব অনেকখানি!

কাকাবাবু বিরক্তভাবে বললেন, ধ্যাত। লোকে শুনে বিশ্বাস করবে যে কয়েকটা সাংঘাতিক ক্রিমিনাল সন্ধে হতেনা-হতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল, আর আমরা তাদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছি। একথা শুনলে লোকে হাসবে। আসল রহস্যটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

নরেন্দ্র বললেন, তোমরা কাল রাত্তিরে কী দেখলে বলল। নতুন কিছু ঘটেছে?

সেলিম বললেন, আমরা দূরে কয়েকটা আলো দেখেছি মাত্র। আর কিছুই না। কোনও শব্দ শুনিনি। কেউ আমাদের ঘুমের ব্যাঘাত করেনি।

কাকাবাবু বললেন, কেন আমরা সাত তাড়াতাড়ি এক সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লাম, সেটা বলুন! সেটা মোটেই স্বাভাবিক নয়।

রাধা বলল, আর সেই বাঁশির শব্দ?

নরেন্দ্র বললেন, বাঁশি? বাঁশি কে বাজাল?

কাকাবাবু বললেন, তা জানি না। ঝড়ের শব্দও হতে পারে। তা ছাড়া, এখানে জলের তলাতেও এমন কিছু ঘটেছে—

নাইড়ু এবার বললেন, মিস্টার রায়চৌধুরী, ওসব কথা পরে শুনব। আমাদের মন্ত্রীমশাই আমার ওপর খুব রাগ করেছেন। দুটি অল্পবয়েসি ছেলে, একটি মেয়ে, তা ছাড়া আপনি, মানে, আপনার একটা পা ভাঙা, আপনাদের আমি এই দ্বীপে রেখে গেছি শুধু সেলিমের ভরসায়, এটা খুবই অন্যায় হয়েছে। যদি আপনাদের কোনও বিপদ হয়, তা হলে সবাই আমাদের সরকারকে দোষ দেবে। তাই আমার ওপর অর্ডার হয়েছে, আপনাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তৈরি হয়ে নিন, আমরা এক্ষুনি যাব।

কাকাবাবু বললেন, বিপদ তো কিছু হয়নি। এত ভয়ের কী আছে?

নাইড়ু বললেন, বিপদ হলে তো মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না? এখানে যা যা ঘটছে, তা তো স্বাভাবিক নয় মোটেই! আমাকে গভর্নমেন্টের অর্ডার মানতেই হবে।

কাকাবাবু বললেন, এই ঝড়ের মধ্যে যাবে কী করে। এখন বোট চালানোও তো বিপজ্জনক।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এই ঝড়টাও তো অদ্ভুত। বোটে চেপে একটুখানি গেলেই আর ঝড় নেই।

কাকাবাবু বললেন, আমার এখন যাবার ইচ্ছে নেই!

নরেন্দ্র বললেন, রাজা, তুমি না গেলে সন্তু আর জোজোও যেতে চাইবে না। আমি জানি। শোনো, তুমি আর আমি বিপদ নিয়ে খেলা করতে পারি। কিন্তু ওদের জীবনের ঝুঁকি নেওয়া চলে না। বিশেষত যে বিপদকে চোখে দেখা যাচ্ছে না।

কাকাবাবু বুঝলেন, আর তর্ক করে লাভ নেই।

সব জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়া গেল। ঝড় এখনও চলছে। সঙ্গে সামান্য বৃষ্টি, তবে বড় বড় ফোঁটা। মেঘের কোনও শব্দ নেই।

ওঁরা লাইন বেঁধে এগোচ্ছেন বোটের দিকে, একেবারে সামনে কমান্ডো আর পেছনে সেলিম।

হঠাৎ এক জায়গায় দপ করে আলো জ্বলে উঠল। খুব বেশি দূরে নয়। এত ঝড়ের মধ্যেও মশালের মতন আলো। একটু একটু কাঁপছে মাত্র। সাধারণ মশাল হলে নিভে যেত। আবার একটা আলো জ্বলে উঠল। আরও একটা।

সব মিলিয়ে প্রায় নদশটা মশালের মতন। কারা যেন হাতে নিয়ে চলেছে, অথচ কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

এই দলটি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

সেলিম ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, এই কি আপনার সেই আলেয়া হতে পারে?

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, না। অন্য কিছু। নাইড়ু বলে উঠলেন, স্ট্রেঞ্জ! স্ট্রেঞ্জ! ওদিকে দেখুন।

সেই আলোগুলো পর পর নেমে গেল সমুদ্রে, আবার সমুদ্র থেকে উঠে আসতে লাগল আলো।

নরেন্দ্র বললেন, এ আলোতে আগুন নেই। জলেও নেভে না।

জল থেকে উঠে এসে কয়েকটা আলো পরপর সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। মাটি থেকে খানিকটা উঁচুতে। ঠিক যেন মনে হয়, কয়েকজন সেই মশাল ধরে আছে।

নরেন্দ্র বললেন, আমার কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছে যে কয়েকজন মানুষ আমাদের দেখছে। অথচ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। রাজা, কোনও মানুষ কি সত্যিই অদৃশ্য হতে পারে?

কাকাবাবু আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, না। আমরা দেখতে না পেলেও তাকে অদৃশ্য বলা যায় না। যেমন জলের রঙের মধ্যে সাতটা রং লুকিয়ে থাকে, তা কি আমরা সব সময় দেখতে পাই? রামধনু উঠলে দেখি। তেমনি অন্য কোনও রঙের মধ্য দিয়ে দেখলে হয়তো দেখা যেত। ওখানে সত্যিই কিছু মানুষ কিংবা

অন্য কোনও প্রাণী ওই মশাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

নরেন্দ্র বললেন, তোমারও মনে হচ্ছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে? আমাদের দেখছে?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। কিন্তু কোনও শব্দ করছে না। রাধা কাকাবাবুর গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তার মুখে ভয়ের ছাপ।

জোজো বলল, আমি দেখতে পাচ্ছি। অন্য গ্রহের প্রাণী। অনেকটা মানুষেরই মতন।

নরেন্দ্র বললেন, জোজো, এখন চুপ করো। হঠাৎ সন্তু ছুটে গেল সেই মশালগুলোর দিকে। নরেন্দ্র চেঁচিয়ে বললেন, এই সন্তু, যেয়ো না, যেয়ো না! সন্তু শুনল না। সে দৌড়ে গিয়ে একটা মশাল ধরতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মশালটা উঠে গেল একটু ওপরে। সন্তু লাফিয়ে লাফিয়ে সেটাকে ধরার চেষ্টা করল। তারপরই কে যেন এক ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল সন্তুকে। সে মাটিতে ছিটকে পড়ে গেল।

নরেন্দ্র বললেন, রাজা আমার কোটের ডান পকেটে একটা সান গ্লাস আছে। সেটা বার করে দেখো তো। কোনও সুবিধে হয় কি না।

কাকাবাবু নরেন্দ্রর সান গ্লাসটা চোখে লাগিয়েই উত্তেজিতভাবে বললেন, হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি, খুবই অস্পষ্ট। অন্য কোনও রঙের কাচ হলে আরও সুবিধে হত বোধহয়। এখন যা দেখছি, ঠিক যেন কোনও আকার নেই, ঠিক জলের মতন, বরফ না হয়েও যেন জল জমে গেছে, চোখমুখ বোঝা যাচ্ছে না। নরেন্দ্র বললেন, দেখি, দেখি আমাকে একবার দাও তো।

তিনি নেওয়ার আগেই জোজো একটা কাণ্ড করল। সে দুপা সরে গিয়ে মুখ দিয়ে বিকট শব্দ করতে লাগল আর খুব জোরে জোরে ঝাঁকাতে লাগল মাথা। যেন সে পাগল হয়ে গেছে!

নরেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললেন, এখন জোজোর এই সব দুষ্টুমি আমার মোটেই ভাল লাগছে না!

জোজো এত জোরে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, যেন তার মাথাটা ছিঁড়ে যাবে। আর এমন সব অদ্ভুত আওয়াজ করছে, টিভির চ্যানেল গোলমাল হলে যেমন আওয়াজ হয়, সেইরকম।

সন্তু উঠে এসে জোজোকে ধরতে যেতে যেতে বলল, এই জোজো। এখন কী ছেলেমানুষি করছিস?

জোজো সরে গেল আরও খানিকটা। কাকাবাবু তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললেন, ওকে ছেড়ে দে সন্তু!

জোজো এবার গলা দিয়ে একবার ঘড়ঘড় শব্দ করেই একেবারে স্বাভাবিক গলায় বলল, আমরা তোমাদের কোনও ক্ষতি করব না।

জোজো এই কথাটাই বলতে লাগল বারবার। কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কে? কোথা থেকে আসছেন?

জোজো বলল, আমরা আকাশে অনেক দূরে থাকি। আমরা আকাশে অনেক দুরে থাকি। আমরা আকাশে অনেক দূরে থাকি। তোমাদের ভাষা জানি না। তাই এই ছেলেটির মনের মধ্যে ঢুকে কথা বলছি। আমরা এখান থেকে কিছু কিছু জিনিসের নমুনা নিতে এসেছি। জলের তলায় এখানে অনেক কিছু থাকে, আমাদের ওখানে সেসব নেই।

কাকাবাবু বললেন, আপনাদের পরিচয় আর একটু ভাল করে বলবেন?

জোজো বলল, বিদায়, বিদায়, বিদায়। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল খুব হালকা একটা বাঁশির শব্দ। ভারী মিষ্টি আওয়াজ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এরা ধপাধপ শুয়ে পড়তে লাগল মাটিতে। তারপরই ঘুমে আচ্ছন্ন।

কাকাবাবুও মাটিতে পড়ে গিয়ে অতি কষ্টে চোখ খুলে দেখতে চাইলেন। দেখলেন, মশালের মতন আলোগুলো ক্রমেই উঠে যাচ্ছে ওপরে।

তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।

সবারই প্রায় ঘুম ভাঙল একসঙ্গে। বিকেলের দিকে। ঝড় থেমে গেছে। আকাশ পরিষ্কার, ঝকঝকে নীল।

একে একে উঠে বসলেন, কাকাবাবু, নরেন্দ্র, সেলিমরা।

কাকাবাবু প্রথমেই বললেন, জোজোর কোনও ক্ষতি হয়নি তো। জোজো, শোনো—

জোজো খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, কেন ক্ষতি হবে?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, জোজো যা করছিল, তা কি সত্যি? জোজো নানা রকম অভিনয় করতে পারে!

জোজো বলল, কী অভিনয় করেছি রে সন্তু আমার কিছু মনে পড়ছে না কেন?

নাইড়ু বলল, এরকম একটা অভিজ্ঞতা, জীবনে ভুলব না। কী যে ব্যাপার হল। হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়লাম কেন?

সেলিম বলল, স্যার, সব ব্যাপারটাই রহস্যময়। কিন্তু এমন চমৎকার ঘুম কিন্তু আমার কখনও হয়নি। শরীরটা খুব ঝরঝরে আর মনটা ফুরফুরে লাগছে।

নাইড়ু বললেন, তা ঠিক। জোজো উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তোমাদের কারুর খিদে পায়নি? সবচেয়ে রহস্যময় ব্যাপার কী জানিস সন্তু, ঠিক সময়ে কেন খিদে পায়? আর পাউরুটি নেই? আগে তো খানিকটা খেয়ে নিই, তারপর অন্য রহস্যের কথা ভাবা যাবে।

সে কাঁধের ব্যাগ খুলে বলল, আরে, গোটাকতক খেজুরও রয়ে গেছে। চমৎকার।

সে টপাটপ খেজুর খেতে লাগল।

————-