০৬. গাড়িটা ছাড়ল সন্ধে সাড়ে ছটায়

গাড়িটা ছাড়ল সন্ধে সাড়ে ছটায়। এখান থেকে মানালি পৌঁছতে তিন ঘণ্টা লাগার কথা। রাস্তা ভাল, রাত্তির বেলাতেও গাড়ি চালাতে কোনও অসুবিধে নেই।

কাকাবাবুদের সঙ্গে কিছু খাবার দিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর একটা বড় ফ্লাস্ক ভর্তি চা। টেলিফোনে মানালিতে একটা হোটেলও বুক করা হয়ে গেছে।

শহর ছাড়াবার পর সন্তু বলল, মূর্তি-চোরটার পরিচয় আর জানা হল না। ওটা রহস্যই রয়ে গেল!

জোজো ঠোঁট উলটে বলল, কোনও পুরস্কারও দিল না!

কাকাবাবু বললেন, জেলখানার ব্যাপারটায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল! মূর্তির ব্যাপারটা আর ওদের মনে নেই। তবু যা হোক গাড়িটার ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

।সন্তু বলল, ডিনামাইট দিয়ে জেলখানার পাঁচিল উড়িয়ে দিয়েছে। একবার সেটা দেখতে ইচ্ছে করছিল।

কাকাবাবু বললেন, না, না, একবার একটু আগ্রহ দেখালেই ওরা আমাদের জড়িয়ে ফেলত। শুধু শুধু বসে থাকতে হত মাণ্ডিতে।

তারপর হেসে বললেন, কোনও চেষ্টা না করেই আমরা মূর্তিটা উদ্ধার করে দিয়েছি। সে ভাবে তো আর কয়েদিদের ধরা যেত না। তাই এখান থেকে এখন

সরে পড়াই ভাল!

জোজো বলল, কাকাবাবু, আজ সকাল থেকে নৃপেন হালদারকে দেখতে পাইনি। অন্য একজন খাবার দিল।

কাকাবাবু বললেন, সেই লোকটিকে আমি জিজ্ঞেস করেছি। সে বলল, আজ নৃপেনের অফ ডে। সে নিজের বাড়িতে চলে গেছে।

জোজো বলল, আমার মনে হয়, নৃপেন ওই মূর্তিটা ফেরত আনার ব্যাপারে কিছু জানে।

কাকাবাবু বললেন, জানতেও পারে, না জানতেও পারে। তাই ওকে বেনিফিট অফ ডাউট দেওয়া গেল।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, বেনিফিট অব ডাউটের বাংলা কী হবে?

জোজো বলল, ডাউট মানে তো সন্দেহ?

কাকাবাবু বললেন, এসব তো ইংরেজদের তৈরি করা আইনের কথা। ঠিক বাংলা হয়নি। কিন্তু চেষ্টা করা যেতে পারে। না, জোজো ডাউট মানে সন্দেহ নয়। ডাউট মানে সংশয়। অর্থাৎ ঠিক না ভুল বুঝতে পারা না গেলে, তখনই সংশয় হয়, সুতরাং বেনিফিট অব ডাউট-কে সংশয়ের অবকাশ বলা যেতে পারে।

সন্তু বলল, অনেকটা রাস্তা, সময় কাটাতে হবে তো! একটা কিছু করা দরকার। বল তো জোজো, টুইংকল টুইংকল লিট্‌ল স্টার, এই লাইনটার বাংলা কী হবে?

জোজো বলল, টুইংকল মানে ঝিকমিক, তাই না? এর বাংলা বেশ সোজা, ঝিকিমিকি ঝিকিমিকি ছোট্ট তারা!

কাকাবাবু বললেন, বাঃ, চমৎকার হয়েছে। সন্তু, তুই পরের লাইনটা বল!

সন্তু বলল, হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর..কী যে তুমি, ভেবে আমি আত্মহারা…

বলতে বলতে সন্তু হঠাৎ উত্তেজিত ভাবে বলল, কাকাবাবু, সামনের গাড়িটা আমি চিনতে পেরেছি

কাকাবাবু বললেন, চিনতে পেরেছিস মানে? কোন গাড়ি?

সন্তু বলল,সেই যে মাথায় পাগড়িওয়ালা লোকটাকে তুমি খুঁজতে বলেছিলে? সে ভিড় ঠেলে একটা গাড়িতে উঠে গেল। এইটা সেই গাড়ি। নম্বরটা আমার মনে আছে।

কাকাবাবু কৌতূহলী হয়ে বললেন, তাই নাকি? গাড়িটা কে চালাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না।

সন্তু বলল, অন্ধকারে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। গাড়িতে দুজন লোক আছে।

জোজো বলল, এটা অন্তত বোঝা যাচ্ছে, কারও মাথায় পাগড়ি নেই।

সন্তু বলল, পাগড়ি খুলে রাখতে পারে।

কাকাবাবু ড্রাইভারকে বললেন, ওই গাড়িটার পেছন পেছন চলল। হারাতে দিয়ো না।

এই পাহাড়ি রাস্তায় সামনের গাড়িকে ওভারটেক করে যাওয়া মুশকিল। তাই এই গাড়ির লোকদের দেখার উপায় নেই। দুটো গাড়ি সমানভাবে চলল।

খানিক বাদে দেখা গেল, সামনের অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। কোনও কারণে ট্র্যাফিক জ্যাম। কাকাবাবুদের গাড়িও থামাতে হল।

সে গাড়ি থামতেই সন্তু নেমে গেল ঝট করে। দৌড়ে গেল সামনের দিকে। খানিক বাদে ফিরে এসে বলল, হ্যাঁ কাকাবাবু, সেই লোকটাই। পাগড়ি খুলে রেখেছে। সঙ্গে অন্য একটা লোক।

কাকাবাবু বললেন, গাড়িগুলো এখানে আটকে গেল কেন?

সন্তু বলল, পুলিশ সব গাড়ি চেক করছে।

কাকাবাবু বললেন, জেল-ভাঙা কয়েদিরা আছে কি না দেখছে। কিন্তু তারা কি আর এইভাবে প্রকাশ্যে পালাবে?

সব গাড়িই একে একে ছাড়া পেয়ে গেল। কাকাবাবুদের গাড়িটা নীল রঙের গাড়িটার পিছু ছাড়ল না।

আরও দশ-বারো কিলোমিটার যাওয়ার পর আগের গাড়িটা হঠাৎ ডান দিকে বেঁকল। সেটা একটা সরু রাস্তা, একটাই গাড়ি যেতে পারে, উঠে গেছে। ওপরদিকে।

এ-গাড়ির ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, এবার কী করব সার? এদের ফলো করব?

কাকাবাবু চিন্তিত ভাবে বললেন, না, গাড়িটা থামিয়ে রাখো। তারপর থুতনিতে হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।

সন্তু আর জোজো কিছুই বুঝতে পারছে না। সন্তু সাধারণত এই সময় কাকাবাবুকে কিছু জিজ্ঞেস করে না। সে জানে, কিছু বলার থাকলে কাকাবাবু নিজেই বলবেন।

কিন্তু জোজোর অত ধৈর্য নেই। সে বলল, কাকাবাবু, লোকটা কে?

কাকাবাবু বললেন, একেবারে নিশ্চিত না হয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। মনে হচ্ছে যেন চিনতে পেরেছি। লোকটিকে ফলো করার কোনও কারণ নেই। শুধু আমার একটা কৌতূহল হচ্ছে, একজন মানুষ কেন অন্যরকম সেজে থাকে?

জোজো বলল, চলুন, ওপরে গিয়ে ভাল করে লোকটাকে দেখি!

কাকাবাবু বললেন, এই সরু রাস্তায় আমাদের গাড়ি উঠলেই তো লোকটা টের পেয়ে যাবে। থাক, দরকার নেই। শুধু একটা কৌতূহল মেটাবার জন্য অনেক সময় নষ্ট হবে। চলো, আমরা মানালিতেই যাই।

জোজো বলল, আপনার কৌতূহল হলে সেটা মিটিয়ে নেওয়াই তো উচিত।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, এই রাস্তাটার ওপরে একটা গেট আছে। তাতে কী যেন লেখা আছে দেখছি!

অন্ধকারে পড়া যাচ্ছে না। সন্তু নেমে গিয়ে দেখে এসে বলল, হিল ভিউ লজ। ওপরে একটা হোটেল আছে।

কাকাবাবু এবার খানিকটা উৎসাহিত হয়ে বললেন, হোটেল? তা হলে তো যে-কেউ যেতে পারে। এক কাজ করলে হয়, এখন মানালি না গিয়ে আজ রাতটা আমরা এই হোটেলেই থেকে যেতে পারি। বেশ ফাঁকা জায়গা, ভালই লাগবে মনে হয়।

সন্তু বলল, ওই লোকটাও বোধ হয় হোটেলটাতেই গেল। আমার এখানেই থাকতে ইচ্ছে করছে।

গাড়িটা সরু রাস্তাটায় ঢুকে উঠতে লাগল ওপরদিকে। বেশ খাড়া রাস্তা। একটু ভুল হলেই গাড়ি নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ে যেতে পারে। বেশ উঁচুতে হোটেলটার সামনেই রাস্তাটা শেষ। আর কোনও বাড়ি নেই।

সেই নীল গাড়িটা এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকটা ঘরে আলো জ্বলছে, হোটেলে বেশ লোকজন আছে মনে হচ্ছে। এত উঁচুতে হোটেল, সেখানেও মানুষ আসে।

গাড়ি থেকে নামার পর ড্রাইভার বলল, আমাকে ছেড়ে দেবেন, সার? কাল সকালে আমার ডিউটি আছে, দিল্লি যেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, চলে যাও। হোটেল থেকে নিশ্চয়ই অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পারবে!

হোটেলের অফিসঘরের কাউন্টারে এসে দাঁড়ালেন ওঁরা তিনজন। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকল, সন্তু!

সন্তু চমকে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে দেখল, একটি কিশোরী মেয়ে নামছে, লাল রঙের ওভারকোট পরা।

কাকাবাবুও ঘুরে তাকিয়ে বললেন, আরে, এ তো দেবলীনা!

দেবলীনা তরতর করে নেমে এসে বলল, ও মা, কী মজার ব্যাপার! এখানে দেখা হয়ে গেল। তোমরা আজ এলে কেন? আগে আসতে পারোনি?

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তোরা এখানে কবে এসেছিস?

দেবলীনা বলল, তিনদিন আগে। কোনও মানে হয়, এই তিন দিন একা একা রইলাম!

সন্তু জিজ্ঞেস করল, একা একা মানে? তোর বাবা আসেননি?

দেবলীনা বলল, হ্যাঁ এসেছে। তোদের সঙ্গে দেখা হলে কত মজা হত। আমরা গুহা দেখতে গিয়েছিলাম কাল, এখানে একটা দারুণ গুহা আছে। ঠিক আছে, আমি যাব না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবি না?

দেবলীনা বলল, আমাদের তো একটু পরেই চেক আউট করার কথা। চলে যাচ্ছিলাম।

একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন দেবলীনার বাবা শৈবাল দত্ত।

তিনিও খুব অবাক হয়ে বললেন, আরে, কাকাবাবু, সন্তু! ইটস আ স্মল ওয়ার্ল্ড! এরকম একটা নামহীন জায়গাতেও চেনাশুনো কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবা যায়?

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এ রকম নামহীন জায়গার হোটেলে তোমরা এলে কেন?

শৈবাল বললেন, জানেনই তো, আমার মেয়ে কেমন পাগল। পাহাড় ওকে টানে। প্রত্যেক বছর ওকে একবার অন্তত পাহাড়ে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবেই। বেশিরভাগ হিল স্টেশনেই খুব ভিড় হয়। আমি আবার ভিড়ভাট্টা একেবারে পছন্দ করি না। তাই বেছে বেছে নির্জন জায়গার হোটেল খুঁজি।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এ হোটেলটা ভাল?

শৈবাল বললেন, খুবই ভাল। অনেক পাহাড় দেখা যায়, একটা জলপ্রপাতও আছে। খাবারদাবারও ভাল। হোটেলের মালিকের ব্যবহারও বেশ ভদ্র, ওই তো মালিক, আলাপ করে দেখবেন।

পাশেই ডাইনিং রুম। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটি লোক এ দিকেই চেয়ে আছে। এ সেই লোকটি, এখন মাথায় আবার সাদা পাগড়ি।

দেবলীনা কাকাবাবুর পিঠে একটা কিল মেরে বলল, তোমরা খুব খারাপ! হিমাচলে আসবে, আমাকে বলেনি কেন?

কাকাবাবু বললেন, আমাদের তো আগে থেকে ঠিক থাকে না। যাই হোক, দেখা তো হল!

দেবলীনা বাবার দিকে ফিরে বলল, তোমার দরকার থাকে তুমি চলে যাও, আমি এখানে আরও থাকব।

শৈবাল বললেন, তা কি হয়! প্লেনের টিকিট কাটা আছে।

কাকাবাবু বললেন, তোমাদের আজ এই রাত্তিরে চলে যেতে হবে কেন? কোথায় প্লেন? দিল্লিতে?

শৈবাল বললেন, না। কুলুর কাছে একটা ছোট এয়ারপোর্ট আছে। সেখান থেকে দিল্লিতে প্লেন যায়। কাল দিল্লিতে আমার খুব জরুরি কাজ আছে। মুশকিল কী জানেন, প্লেনটা ছাড়ে ভোর সাড়ে পাঁচটায়। এই হোটেলে থেকে অত ভোরে গিয়ে প্লেন ধরা খুব শক্ত। তাই এয়ারপোর্টের কাছে একটা হোটেলে রাত কাটাতে হবে।

দেবলীনা বলল, তুমি যাও, আমি যাচ্ছি না।

শৈবাল বলল, এই রে, আবার পাগলামি শুরু হল। কাকাবাবু, আপনি ওকে একটু বুঝিয়ে বলুন।

কাকাবাবু বললেন, দেবলীনা আমাদের সঙ্গে কয়েকটা দিন থেকে গেলে খুব অসুবিধে হবে? কয়েকদিন পর আমরাও দিল্লি ফিরব। ও আমাদের সঙ্গেই ফিরবে।

শৈবাল বললেন, ওকে রেখে যাওয়া যেত। কিন্তু আজ সকালেই টেলিফোন পেয়েছি, দিল্লিতে ওর মাসি থাকেন, হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাঁচবেন কি না সন্দেহ। তিনি ওকে খুবই ভালবাসেন। ওকে দেখতে চান। আমার তো কাজ আছেই, তা ছাড়াও প্লেনের টিকিট কিনেছি এই জন্যই।

মেয়ের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে খুকি, তুই তোর মাসিকে শেষ দেখা দেখতে চাস না?

দেবলীনা উত্তর না দিয়ে মুখ গোঁজ করে রইল।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে তো আর আটকানো যায় না। ঠিক আছে, এর পরেরবার আমরা একসঙ্গে কোনও পাহাড়ে যাব।

শৈবাল বললেন, আপনাদের রাত্তিরের খাওয়া হয়নি তো? চলুন, একসঙ্গে খেয়ে নিই। তারপর আমরা বেরিয়ে পড়ব।

কাকাবাবুদের জিনিসপত্র পাঠিয়ে দেওয়া হল ওপরের দুটি ঘরে।

সবাই মিলে বসলেন ডাইনিং হলের একটি টেবিলে। প্রথমেই এল জলজিরার শরবত।

দেবলীনা সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, এখানে বুঝি কোনও উল্কা পড়েছে? কিংবা চাঁদের পাথর চুরি গেছে?

সন্তু বলল, সেসব কিছু না। স্রেফ বেড়াতে এসেছি। আমার বন্ধু জোজোকে বোধ হয় তুমি আগে দেখনি?

দেবলীনা বলল, এই-ই জোজো? এ কি তোরই মতন ক্যাবলাকান্ত?

জোজো বলল, আমি আরও বেশি ক্যাবলা! দেবলীনা বলল, তোমার মুখ দেখলেই তা বোঝা যায়। বলো তো মানুষ কতটা লম্বা হয়?

শৈবাল কাকাবাবুকে বললেন, দেখছেন আমার মেয়ের কাণ্ড? কীভাবে কথা বলে? সন্তু কেন যে ওকে চাঁটি মারে না!

কাকাবাবু হাসতে হাসতে বললেন, দেবলীনার কাছে সন্তু জব্দ!

দেবলীনা জোজোকে খোঁচা মেরে বলল, বলতে পারলে না, মানুষ কত লম্বা হয়? এ তো সোজা! সব মানুষই সাড়ে তিন হাত।

জোজো বলল, যাঃ! এক-একজন মানুষ এক-একরকম। কেউ খুব বেঁটে, কেউ লম্বা!

দেবলীনা বলল, সাধে কি আর বলেছি ক্যাবলাকান্ত! নিজের হাতে মাপলে সবাই সাড়ে তিন হাত। বেঁটে লোকের হাত ছোট, লম্বা লোকের হাতও বড়।

দাড়িওয়ালা, মাথায় পাগড়ি পরা লোকটি খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে এই টেবিলের দিকেই তাকিয়ে আছে। শৈবাল হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে ডাকলেন।

তারপর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি হোটেলের মালিক ধরমবীর সিং। ইনি ছোটবেলা বিলেতে মানুষ হয়েছেন, আর ইনি রাজা রায়চৌধুরী, এঁর পরিচয়..কী বলব।

কাকাবাবু টেবিলের তলায় পা দিয়ে শৈবালকে একটা খোঁচা দিয়ে থামবার ইঙ্গিত করে বললেন, আমি একজন রিটায়ার্ড লোক, এমনিই বেড়াতে এসেছি।

কাকাবাবু আর ধরমবীর পরস্পরের দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

তারপর ধরমবীর ইংরিজিতে বললেন, ওয়েলকাম টু মাই হোটেল। আশা করি, আপনাদের এখানে ভাল লাগবে।

কাকাবাবু বললেন, আমিও তাই আশা করি। আপনার এখান থেকে গাড়িভাড়ার ব্যবস্থা করা যাবে?

ধরমবীর বললেন, হোটেলেরই নিজস্ব গাড়ি আছে। চাইলেই পাবেন। আর বিশেষ কথা হল না। খাবার এসে গেল।

দেবলীনা সন্তুকে বলল, পাহাড়ের ওপাশটায় একটা গুহা আছে। দেখতে ভুলিস না।

জোজো জিজ্ঞেস করল, গুহাটাতে কী আছে?

দেবলীনা বলল, গুহার মধ্যে আবার কী থাকবে? জলহস্তী? গুহা তো গুহাই! অনেকটা লম্বা।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, তুই ভেতরে গিয়েছিলি? শেষ পর্যন্ত?

দেবলীনা বলল, না, সবটা যাইনি। তুই থাকলে যেতাম। একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ভয় করছিল!

কাকাবাবু বললেন, দেবলীনাও তা হলে ভয় পায়?

দেবলীনা বলল, আমি চোর-ডাকাতকে ভয় পাই না। ভূতের ভয় পাই না। বাঘ-ভালুককেও ভয় পাই না। শুধু মাকড়সা..যদি ভেতরে বড় বড় মাকড়সা থাকে।

জোজো বলল, ট্যারান্টুলা। তুমি ট্যারান্টুলা দেখেছ? রাক্ষুসে মাকড়সা, আমি দেখেছি, সাউথ আমেরিকায়, আমাজন নদীর ধারের জঙ্গলে, একঝাঁক, ওদের সামনে পড়লে মানুষ বাঁচে না! ওরা গুলি করলে মরে না, ছোরা দিয়ে কাটা যায় না। আমি বুদ্ধি করে একটা স্প্রে গান নিয়ে গিয়েছিলাম, তা দিয়ে ওদের গায়ে ছিটিয়ে দিলাম কেরোসিন, ওদের খুব প্রিয় খাদ্য কেরোসিন, মাকড়সাগুলো চেটে চেটে কেরোসিন খাচ্ছে, আমি একটা দেশলাই কাঠি জ্বেলে ছুড়ে দিলাম ওদের দিকে। ব্যস!

দেবলীনা সন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছেলেটা খুব গুল মারে, তাই না?

সন্তু হাসি চেপে বলল, না, জোজো অনেক দেশ-বিদেশে ঘুরেছে।

দেবলীনা বলল, ও পকেটে দেশলাই রাখে কেন? বিড়ি খায় বুঝি?

শৈবাল ধমক দিয়ে বললেন, এই খুকি, কী হচ্ছে কী! চুপ কর!

কাকাবাবু বললেন, ওর চটাস চটাস কথা শুনতে আমার খুব ভাল লাগে।

শৈবাল বললেন, মেয়েটা আমার পাগল একেবারে!

দেবলীনা বলল, আমি পাগল? পাগল বুঝি ফার্স্ট হয়?

জোজো সঙ্গে সঙ্গে বলল, হ্যাঁ হয়। পাগলামিতে ফার্স্ট!

সন্তু হাততালি দিয়ে বলল, এইবার জোজো একখানা ভাল দিয়েছে?

দেবলীনা উঠে পড়ে বলল, আমি হাত ধুয়ে আসছি।

কাকাবাবু বললেন, সন্তু, তুই ওর সঙ্গে যা। ও মেয়েকে বিশ্বাস নেই। হঠাৎ দৌড় মারতে পারে।

শৈবাল বললেন, যা বলেছেন। এর মধ্যে আরও একবার বাড়ি থেকে পালিয়েছিল জানেন তো?

কাকাবাবু বললেন, এই নিয়ে চারবার হল?

শৈবাল বললেন, হ্যাঁ, চারবার। আগেরবার আপনি উদ্ধার করেছিলেন। এবারেও আপনাকে খবর দেব দেব ভাবছিলাম, তখনই খবর পেলাম আসানসোল স্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে।

একটু পরে দেখা গেল, সন্তু দেবলীনার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। কাছে এসে বলল, হোটেল থেকে বেরিয়ে পালাবার চেষ্টা করছিল।

দেবলীনা কাকাবাবুর কাছে এসে তাঁর বুকে মাথা রেখে বাচ্চা মেয়ের মতন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কী করি বলো তো? আমার ছোটমাসিকে দেখতেও খুব ইচ্ছে করছে, আবার তোমাদের সঙ্গে থাকতেও ইচ্ছে করছে খুব!

কাকাবাবু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, পাহাড় তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আবার আসা যাবে। মাসি তোমায় দেখতে চেয়েছেন, যদি পরে দেখা না হয়?

কাঁদতে কাঁদতেই দেবলীনা গাড়িতে উঠল। কাকাবাবুরা বাইরে এসে বিদায় জানালেন।

ওদের গাড়ি ছাড়বার পর জোজো বলল, বাপ রে, চলে গেছে, বাঁচা গেছে। যা বিচ্ছু মেয়ে!

কাকাবাবু বললেন, অল্প বয়েস থেকে ওর মা নেই। তাই খানিকটা জেদি আর খেয়ালি। কিন্তু পড়াশুনোয় দারুণ ভাল। সাহসও আছে খুব।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, ধরমবীর সিং এই হোটেলের মালিক। একে আমরা আগে কোথায় দেখতে পারি?

কাকাবাবু বললেন, বেশ জটিল ব্যাপার। আজ রাতটা কাটুক। কাল সকালে ভাল করে খোঁজখবর নিতে হবে। যদিও, এতে আমাদের মাথা ঘামাবার কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু কৌতূহল না মিটিয়ে যেতে পারছি না।

ওপরে যে দুখানা ঘর দেওয়া হয়েছে, তা পাশাপাশি নয়। বারান্দার দুই কোণে দুটো। মাঝখানের ঘরগুলো বন্ধ।

কাকাবাবু বললেন, কোণের ঘরই ভাল। দুদিক দেখা যায়। তোদের কোনটা পছন্দ, বেছে নে।

সন্তুরা দুটো ঘরই দেখে নিয়ে ডান দিকেরটায় ঢুকে পড়ল।

কাকাবাবু নিজের ঘরে এসে পোশাক বদলালেন। ঘরটি বেশ বড়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। জানলা খুলে একবার বাইরেটা দেখে নিলেন। একটা পাহাড়ের চূড়ায় বরফের ওপর জ্যোৎস্না পড়েছে। সেই জ্যোৎস্নার রং যেন অনেকটা নীল। তাকালে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছে করে না।

খানিকক্ষণ বই পড়ার পর শুয়ে পড়লেন কাকাবাবু।

সামান্য একটু খুট খুট শব্দেই একসময় ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। বাইরে থেকে কেউ চাবি দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করছে।

বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা নিয়ে তিনি বিছানা থেকে নামতে না নামতেই দড়াম করে দরজাটা খুলে গেল। তিনজন লোক হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে এসে দাঁড়াল তিনদিকে। একজন আলো জ্বেলে দিল।

তখন দেখা গেল, তিনজনের হাতেই রিভলভার। তাদের মধ্যে একজন ধরমবীর সিং।

কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, এই অবস্থায় গুলি চালিয়ে কোনও লাভ নেই।

ধরমবীর গম্ভীরভাবে বলল, ড্র দ্যাট গান!

কাকাবাবু রিভলভারটা ফেলে দিলেন বিছানার ওপর।

ধরমবীর কাছে এসে সেটা তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, পার্সে ভু ফ্রাঁসে?

কাকাবাবু ইংরিজিতে বললেন, শুনলে বুঝতে পারি। বলতে গেলে অসুবিধে হয়। তোমার যা বলার, ইংরিজিতেই বলো।

ধরমবীর বলল, তুমি আমার পেছনে লেগেছ কেন? আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি।

কাকাবাবু বললেন, আমিও তো তোমার ক্ষতি করিনি। শুধু একটা কৌতূহল মেটাতে এসেছি।

কীসের কৌতূহল?

একজন মানুষ কেন চেহারা বদলে অন্য মানুষ সাজে। কোন উদ্দেশ্যে? আমার মুশকিল হচ্ছে, আমার স্মৃতিশক্তি বড় বেশি। একবার কিছু দেখলে ভুলতে পারি না। তোমায় আগে কোথায় দেখেছি, সেটাই শুধু মনে রাখতে অসুবিধে হচ্ছিল।

এখন কৌতূহল মিটেছে?

হ্যাঁ। তুমি ধরমবীর সিং নও। এটা তোমার ছদ্মনাম, ছদ্মবেশ।

তুমি আমাকে আগে কোথায় দেখেছ?

আসলে আমি তোমাকে আগে কখনও দেখিনি।

কী উলটোপালটা বকছ! এই বললে, আগে দেখেছ। আবার বলছ দ্যাখোনি।

তোমাকে আগে দেখিনি। তোমার ছবি দেখেছি।

শুধু ছবি দেখে? আমাকে এই চেহারায় চেনা যায়? অসম্ভব। তুমি মিথ্যে কথা বলছ!

ছদ্মবেশ ধরে মানুষ অনেক কিছু বদলাতে পারে। কিন্তু চোখ দুটো বদলানো যায় না।

বটে? তুমি আমাকে কতটা চিনেছ, তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এখন তোমার হাত দুটো বাঁধা হবে, বাধা দেওয়ার চেষ্টা কোরো না। তাতে সুবিধে হবে না। আমি গুলি চালাব।

ধরমবীরের ইঙ্গিতে অন্য দুজন কাকাবাবুর হাত, পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে বেঁধে ফেলল।

ধরমবীর এবার লোকদুটিকে বলল, তোমরা এবার গিয়ে ওই ছেলেদুটিকে বাঁধো। এর সঙ্গে আমি কথা বলছি।

লোকদুটি চলে যাওয়ার পর ধরমবীর একটা চেয়ারে বসে পড়ে বলল, তোমার নাম রাজা রায়চৌধুরী, তোমার সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। সদ্য শুনেছি। তোমার সঙ্গে আমার কোনও শত্রুতা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমি ছদ্মবেশ নিয়েছি, যাতে আমাকে অন্য কেউ চিনতে না পারে সেইজন্য। তাই তো? তবু যদি কেউ চিনে ফেলে, তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়াই আমার উচিত। ঠিক কি না? অতএব তোমাকে মেরে ফেলতেই হবে।

কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, তুমি সত্যিই আমাকে চেনো না। এর আগে অনেকেই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু কেউই পারেনি। তুমিও পারবে না।

ধরমবীর ভুরু কুঁচকে বলল, পারব না? এই রিভলভারে ছটা গুলি আছে। একটা গুলি খরচ করাই যথেষ্ট। দেখবে?

কাকাবাবু বললেন, মরে গেলে আর দেখব কী করে? যাই হোক, তুমি চেষ্টা করে দ্যাখো।

রিভলভারটা নামিয়ে ধরমবীর বলল, তোমার সাহস আছে, স্বীকার করতেই হবে। তোমার স্মৃতিশক্তিও অবিশ্বাস্য! এ পর্যন্ত একজনও আমাকে চিনতে পারেনি। শুধু ছবি দেখে তুমি আমাকে চিনেছ। ঠিক আছে, চিনতে পেরেছ ঠিকই। এবার কী করতে চাও?

কাকাবাবু বললেন, আর একটা কৌতূহল রয়ে গেছে। একজন লোক ছদ্মবেশ ধরে নিজের পরিচয় গোপন করে কেন? নিশ্চয়ই কোনও মতলব থাকে। তুমি নিশ্চয়ই এই হোটেল চালাবার জন্য ছদ্মবেশ ধরেনি। তার কোনও দরকার ছিল না। সেই উদ্দেশ্যটা জানার জন্য কৌতূহল হচ্ছে।

তুমি কী ভেবেছ, সেটা আমি তোমাকে বলে দেব?

না বললেও জানা যায়। অনেকটা আন্দাজ করতে পেরেছি।

শোনো মিস্টার রায়চৌধুরী, তুমি যাই-ই বলল, তোমাকে এক্ষুনি মেরে ফেলা শক্ত কিছু না। তারপর তোমার মৃতদেহটা কোনও একটা পাহাড়ের খাঁজে ফেলে রাখলে কেউ খুঁজে পাবে না। কিন্তু নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি মানুষ খুন করি না। তোমাকে মুক্তি দিতে পারি এক শর্তে, কাল ভোরবেলা তুমি সোজা দিল্লি চলে যাবে। আমার ব্যাপার নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করবে না।

বাঃ, তুমি যে এত সরল তা তো জানতাম না। তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে, আমি দিল্লি না গিয়ে যদি মাণ্ডি থেকে একদল পুলিশ নিয়ে ফিরে আসি?

তার জন্য জামিন রাখা হবে। তোমার সঙ্গে যে দুটি ছেলে আছে, তাদের একজনকে রেখে দেব। তোমরা দুজন দিল্লি যাবে। অন্য ছেলেটিকে তিনদিন পর আমরাই দিল্লি পৌঁছে দেব।

তাকে ফেরত পাওয়ার পর যদি পুলিশের কাছে যাই?

তখন পুলিশে খবর দিয়েও কোনও লাভ হবে না। ততদিনে দেখবে পাখি উড়ে গেছে! কী করবে ভেবে নাও। এক ঘণ্টা সময় দিলাম।

ধরমবীর বেরিয়ে গেল, কাকাবাবু বিছানার ওপর বসলেন।

হাতদুটো এমনভাবে বেঁধেছে, খোলার উপায় নেই। একবার তিনি ভাবলেন, এই ব্যাপারটায় নাক না গলালেই হত। এখানে না এসে এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়া যেত মানালি। কিন্তু স্বভাব যে যায় না। কোনও ব্যাপারে কৌতূহল হলে তা মেটাতেই হয়!

একটু পরেই ধরমবীর আর অন্য লোকদুটি ফিরে এল।

ধরমবীর বলল, তোমার এ-ঘরে থাকা হবে না। অন্য একটা জায়গায় যেতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, হাত বাঁধা থাকলে আমি যাব কী করে? ক্রাচ ছাড়া আমি চলতে পারি না।

ধরমবীর বলল, তোমায় চলতে হবে না। ওরা দুজন তোমাকে বয়ে নিয়ে যাবে!

কাকাবাবু এবার প্রচণ্ড জোরে ধমক দিয়ে বললেন, তোমরা ভেবেছ কী? আমি কি ছেলেমানুষ নাকি যে আমাকে বয়ে নিয়ে যাবে? হাত খুলে দাও, তোমরা যেখানে যেতে বলবে যাব!

ওদের মধ্যে একজন টাকমাথা তোক এক ঘুসি কষাল কাকাবাবুর মুখে। কাকাবাবুর নাক দিয়ে টপ টপ করে রক্ত পড়তে লাগল।

কাকাবাবু তার দিকে ফিরে ঠাণ্ডা কঠিন গলায় বললেন, তোমার মালিক। হুকুম দেওয়ার আগেই তুমি আমাকে মারলে কেন? আমার গায়ে কেউ হাত তুললে তাকে আমি শাস্তি না দিয়ে ছাড়ি না। তুমিও শাস্তি পাবে!

লোকটি আবার মারবার জন্য হাত তুলতেই ধরমবীর তাকে বাধা দিয়ে বলল, ঠিক আছে, ওর বাঁধন খুলে দাও! রায়চৌধুরী, আশা করি, তুমি ভদ্রলোকের মতন আমাদের সঙ্গে আসবে, চ্যাঁচামেচি করবে না।

ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসা হল একতলায়। এখন কোনও ঘরে আলো জ্বলছে না। হোটেলের পেছনদিকের একটা দরজা দিয়ে বের হয়ে হাঁটতে হল এবড়োখেবড়ো রাস্তায়। ঠিক রাস্তাও নয়, বড় বড় পাথর ছড়ানো, অন্ধকার, কাকাবাবু কয়েকবার হোঁচট খেতে খেতে সামলে নিলেন।

খানিক বাদে দেখলেন, এক জায়গায় আলো জ্বলছে।

সেটা একটা গুহার মুখ। হাতে হ্যাজাক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। দেবলীনা কি এই গুহাটার কথাই বলেছিল?

গুহাটার মধ্যেও অনেকটা যেতে হল। মাঝে মাঝে আলো রাখা আছে। একটা জায়গা বেশ চওড়া, হঠাৎ যেন গুহাটার পেট মোটা হয়ে গেছে। সেখানে দুদিকে দুটো লোহার বেঞ্চ পাতা। একটাতে বসে আছে সন্তু আর জোজো, পাশে একজন রিভলভারধারী পাহারাদার। সেখানে দেওয়ালে একটা মশাল জ্বলছে।

ধরমবীর বলল, শোনো রায়চৌধুরী আমাদের এখন অনেক জরুরি কাজ আছে, তোমাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামাবার সময় নেই। তুমি আর একটি ছেলে কাল ভোরে দিল্লি চলে যাবে। একটি ছেলেকে আমরা রেখে দেব। তুমি কোনও গণ্ডগোল না করলে, ছেলেটি দিল্লি পৌঁছে যাবে তিনদিন পরে। কোন ছেলেটি থাকবে? আচ্ছা, একেই রেখে দেওয়া যাবে!

সে জোজোর কাঁধে একটা চাপড় মারতেই জোজো সিঁটিয়ে সরে গেল।

সন্তু বলল, ওকে কিছু বলার দরকার নেই, যা বলার আমাকে বলুন!

ধরমবীর বলল, বেশ, তুমিই থাকো। তুমি চলো আমাদের সঙ্গে।

কাকাবাবু বললেন, সে প্রশ্নই ওঠে না। একজনকে রেখে কিছুতেই আমি যেতে রাজি নই। হয় তিনজনই একসঙ্গে যাব, অথবা তিনজনই থাকব।

ধরমবীর এবার গলা চড়িয়ে ধমকে বলল, তোমাদের সঙ্গে আমি যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করেছি। অন্য কেউ হলে এতক্ষণে তিনজনকেই সাবাড় করে দিত। আমি তোমার কথা শুনে বলব নাকি? এই ছেলেটাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি।

এই সময় আর-একজন লোক গুহার মধ্যে এসে ধরমবীরের কানে কানে ফিসফিস করে কী যেন বলতে লাগল।

তাকে দেখে চমকে উঠল এরা তিনজন। নৃপেন হালদার!

তার কথা শুনতে শুনতে ধরমবীর বলতে লাগল, গুড! গুড! এভরিথিং ইজ রেডি।

সে কথা শেষ করার পর নৃপেন কাকাবাবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, সার, এই আদমি ভেরি ডেঞ্জারাস হ্যায়। আর এই ছেলেটা, সন্তু, ভেরি বিচ্ছু। দয়ামায়া দেখাবেন না সার!

জোজো বাংলায় বলল, আপনি বাঙালি হয়ে আমাদের সঙ্গে এরকম বিশ্বাসঘাতকতা করলেন?

নৃপেন ভেংচি কেটে বলল, ইস, বাঙালি! বাংলায় কেউ আমায় চাকরি দিয়েছে? ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়িয়েছি। তোমাদের এ ব্যাপারে নাক গলাতে

কে বলেছিল?

কাকাবাবু বললেন, চাকরি না পেলেই যদি কেউ খুনে-গুণ্ডাদের দলে যোগ দেয়, তা হলে সে বাঙালি না, বিহারি না, মাড়োয়ারি না, পাঞ্জাবি না, শুধুই একটা খারাপ লোক। চাকরি না করেও মানুষ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে!

নৃপেন বলল, চোপ! আবার বড় বড় কথা! আমাদের সাহেব ইচ্ছে করলেই তোমাদের এক্ষুনি খতম করে দিতে পারে।

ধরমবীর বলল, রায়চৌধুরী, ইংরিজিতে একটা কথা আছে, কিউরিয়েসিটি কি দ্য ক্যাট! বেশি কৌতূহল দেখালে অনেক সময় প্রাণ দিতে হয়। তোমরা যথেষ্ট কৌতূহল দেখিয়েছ। এখন থেকে আমি যা বলছি তাই শুনতে হবে। এই ছেলেটাকে আমি সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। চলো—

সে ইঙ্গিত করতেই রিভলভারধারী প্রহরীটি সন্তুকে জাপটে ধরল।

সন্তু ভালমানুষের মতন কয়েক পা গেল তার সঙ্গে। তারপরই হঠাৎ নিচু হয়ে লোকটির এক পা জড়িয়ে ধরে মারল এক আছাড়। তার হাতের রিভলভারটা ছিটকে পড়ে গেল।

সন্তু চেঁচিয়ে বলল, কাকাবাবু, ওটা ধরো।

কাকাবাবু সেদিকে ঝুঁকবার আগেই দুড়ুম করে শব্দ হল। ধরমবীরের রিভলভারের একটা গুলি কাকাবাবুর কাঁধ ঘেঁষে চলে গেল।

ধরমবীর বলল, এনাফ ইজ এনাফ! তোমাদের যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি। এইটুকু ছেলে, এত ভাল ক্যারাটে জানে! কিন্তু আমার এখন এসব কথা বলার সময় নেই।

সন্তুর দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, বয়, যদি খোঁড়া না হতে চাও, আমাদের সঙ্গে চলো।

সন্তু কাকাবাবুর দিকে তাকাল, কাকাবাবু চোখের ইঙ্গিতে তাকে বোঝালেন, এখন আর বাধা দিয়ে লাভ নেই।

ধরমবীর কাকাবাবুকে বলল, এই গুহার উলটোদিকে বেরুবার কোনও পথ নেই। সামনের মুখটাও পাথর দিয়ে বন্ধ থাকবে। হাজার চ্যাঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। আমার শর্তে যদি রাজি না হও, তা হলে এখানেই না খেয়ে পচে মরবে! কাল ভোরে আমি একবার আসব। শুভরাত্রি, আ রেভোয়া!

সন্তুকে ওরা ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে চলে গেল।