০২. কালিকটের প্লেন

কালিকটের প্লেন মুম্বই থেকে সকাল সাড়ে আটটায় ছাড়ে। কলকাতা থেকে ভোরের প্লেনে এলেও সেটা ধরা যায় না। তাই মুম্বই যেতে হল আগের দিন রাত্তিরে।

ওখানে কাকাবাবুর চেনাশুনো অনেক মানুষ আছে। কিন্তু কারও বাড়িতে উঠলেই সে অন্তত দু-তিনদিন ধরে রাখতে চাইবে। কিছুতেই পরের দিন যেতে পারবেন না।

সেইজন্য কাকাবাবু কাউকে কিছু না জানিয়ে মুম্বইয়ের একটা হোটেলে টেলিফোন করে দুটো ঘর বুক করে রেখেছেন।

প্লেন মুম্বই পৌঁছল রাত সাড়ে আটটায়। মালপত্র নিয়ে ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের দিকে এগোতেই একটা চোদ্দো-পনেরো বছরের মেয়ে দৌড়ে এসে কাকাবাবুর সামনে দাঁড়াল। তার দুচোখ ভরা বিস্ময়।

সে আস্তে আস্তে বলল, আপনি কাকাবাবু?

কাকাবাবু হেসে বললেন, হ্যাঁ, তুমি চিনলে কী করে?

মেয়েটি বলল, আমার বাবা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা দেখিয়ে দিলেন।

নিচু হয়ে সে কাকাবাবুর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তা

রপর সন্তু আর জোজোর দিকে তাকাল।

কাকাবাবু বললেন, এদের চিনতে পারোনি? এই হচ্ছে সন্তু, আর এ জোজো। তোমার নাম কী?

মেয়েটি বলল, নিশা সেন।

সে মুগ্ধভাবে জোজোর দিকে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট খাতা বার করে বলল, একটা অটোগ্রাফ দেবেন?

জোজো সই করে দেওয়ার পর সে সন্তু আর কাকাবাবুরও সই নিল।

কাকাবাবু তার মাথায় হাত রেখে বললেন, ভাল থেকো। এবার আমরা যাই?

নিশা বলল, আমরা এখানেই থাকি। কলকাতায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্লেনে আপনাদের দেখতে পাইনি। একবার আমাদের বাড়িতে চলুন না। একটু চা খেয়ে যাবেন।

কাকাবাবু কিছু বলার আগেই পাশ থেকে আর একজন তোক বলল, তা তো সম্ভব নয় ভাই। এখন ইনি আমার সঙ্গে যাবেন।

কাকাবাবু মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন কাছেই দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একজন হাত বাড়িয়ে সন্তুর কাছ থেকে একটা ব্যাগ নিতে যাচ্ছে।

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, আরে, অমল? তুমিও এই প্লেনে ফিরলে নাকি?

সেই যুবকটি পরে আছে সাদা প্যান্ট আর সাদা শার্ট। মুখে মিটিমিটি হাসি।

সে বলল, না। আমি আপনাদের নিতে এসেছি।

কাকাবাবু বললেন, তার মানে? আমরা যে আজ এখানে আসছি, তা তুমি জানলে কী করে?

সে বলল, বাঃ, আপনি বম্বে আসছেন, আমি জানব না? বম্বের বহু লোক জেনে গেছে।

কাকাবাবু বললেন, বাজে কথা বলো না, আমি কাউকেই জানাইনি। তুমি কী। করে খবর পেলে?

সে বলল, ধরে নিন ম্যাজিক।

কাকাবাবু সন্তু আর জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকাল দেখছি অনেকেই ম্যাজিকের চর্চা করছে। আসল ব্যাপারটা কী বলো তো?

সে বলল, আসল ব্যাপারটা খুব সোজা। আমি সন্ধেবেলা আপনার বাড়িতে ফোন করেছিলাম। আপনার দাদা ফোন ধরে বললেন, রাজা আর সন্তু তো আজই বম্বে গেল। একটু আগে রওনা হয়েছে। ব্যস, আমি বুঝে গেলাম, আপনারা কোন ফ্লাইটে আসছেন। আরও অনেকে জানে, এটা কেন বললাম জানেন? আপনি তো রিজেন্ট হোটেলে ফোন করে দুটো ঘর বুক করেছেন, তাই না? সেই হোটেলের ম্যানেজার বাঙালি, তার নাম শেখর দত্ত, আমার খুব চেনা। সেও একটু আগে আমায় ফোন করে বলল, অমলদা, রাজা রায়চৌধুরীর নাম শুনেছেন তো? যাঁকে সবাই কাকাবাবু বলে। তিনি আজ আসছেন আমাদের হোটেলে। দেখা করবেন নাকি? আমি শেখরকে বললাম, দেখা করব তো বটেই। তবে, তোমার হোটেলের বুকিং ক্যানসেল করে দাও। উনি হোটেলে থাকবেন না।

কাকাবাবু বললেন, কেন, আমরা হোটেলে…

অমল বলল, অসম্ভব। আপনাদের কে হোটেলে যেতে দিচ্ছে? আমার বাড়ি একদম খালি।

নিশা নামের মেয়েটিকে তার বাবা ডাকছে, সে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

অমল এর মধ্যেই সন্তু আর জোজোর কাছ থেকে ব্যাগ দুটো নিয়ে নিয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, তোদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। এর নাম অমল ভট্টাচার্য। এঞ্জিনিয়ার আর কবি। অনেকদিন আফ্রিকায় ছিল। এখানে ও একটা ছাপার কালির কোম্পানিতে কাজ করে। তাই না অমল?

অমল বলল, কালি, রং, এরকম অনেক কিছু।

কাকাবাবু বললেন, সেইজন্যই ও সবসময় সাদা শার্ট-প্যান্ট পরে।

এয়ারপোর্টের বাইরে এসে অমল নিজের গাড়িতে সব মালপত্র তুলল। কাকাবাবু বসলেন সামনে।

গাড়ি ছাড়ার পর অমল বলল, একটা মজার জিনিস লক্ষ করলেন কাকাবাবু। ওই যে নিশা মেয়েটি, ও কিন্তু সন্তুর আগে জোজোর অটোগ্রাফ নিল। এমনকী আপনারও আগে। তার মানে কি জোজো আপনাদের দুজনের চেয়েও জনপ্রিয়?

কাকাবাবু বললেন, তা তো হতেই পারে। আমি খোঁড়া মানুষ, আর সন্তু সবসময় লাজুকের মতন আড়ালে থাকে। আমরা তিনজন একসঙ্গে থাকলে প্রথমে জোজোর দিকেই সকলের চোখ পড়ে। জোজোর অমন সুন্দর চেহারা, মেয়েরা তো ওকে বেশি পছন্দ করবেই।

জোজো গম্ভীরভাবে বলল, শুধু মেয়েরা নয়, অনেক ছেলেও আমার অটোগ্রাফ নেয়। একটা মজার ঘটনা শুনবেন? মারাদোনার নাম শুনেছেন। নিশ্চয়ই?

অমল বলল, মারাদোনা মানে, ফুটবল খেলার রাজা? তার নাম কে না শুনেছে?

সন্তু প্রতিবাদ করে বলে উঠল, মারাদোনাকে মোটেই ফুটবলের রাজা বলা যায় না। রাজা হচ্ছেন পেলে। অল টাইম গ্রেট। মারাদোনাকে বড়জোর সেনাপতি বলা যায়।

কাকাবাবু বললেন, ও তর্ক থাক। মজার ঘটনাটা কী শুনি?

জোজো বলল, আগেরবার যে ফুটবলের ওয়ার্ল্ড কাপ হল, সেটা তো আমি দেখতে গিয়েছিলাম। একদিন মারাদোনার মুখোমুখি পড়ে যেতেই আমি অটোগ্রাফ চাইলাম। মারাদোনা এমনিতে কাউকে অটোগ্রাফ দেয় না। অনেক টাকা চায়। আমাকেও প্রথমে দেবে না বলেও একটুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর সই করে দিয়ে ফস করে নিজের পকেট থেকে একটা অটোগ্রাফ খাতা বার করে বলল, তুমিও আমাকে একটা সই দাও। তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ভবিষ্যতে তুমি একজন বিখ্যাত লোক হবে!

কাকাবাবু বললে, বাঃ। মারাদোনার কথা এর মধ্যেই অনেকটা মিলে গেছে।

সন্তু বলল, তোর কাছে মারাদোনার অটোগ্রাফ আছে? একদিন আমায় দেখাস তো!

জোজো বলল, দুঃখের কথা কী জানিস, সেই অটোগ্রাফ খাতাটা কিছুদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছি না। তার মধ্যে আরও কত বড় বড় লোকের সই ছিল।

অমল বলল, তোমারটা হারিয়ে গেলেও মারাদোনা নিশ্চয়ই তার অটোগ্রাফ খাতা হারায়নি। তার মধ্যে তোমার সই রয়ে গেছে। শুধু সই করেছিলে, না কিছু লিখেও দিয়েছিলে?

জোজো বলল, বাংলায় লিখে দিয়েছিলাম, চালিয়ে যা পঞ্চা!

অমল হো হো করে হেসে উঠে বলল, চমৎকার! জোজোর তুলনা নেই। কাকাবাবু, এই রত্নটিকে কোথায় পেলেন?

কাকাবাবু বললেন, জোজোর সত্যি অনেক গুণ আছে।

জোজো বলল,সন্তু, ওই যে মেয়েটি অটোগ্রাফ নিল, নিশা নামের মানে কী রে?

সন্তু বলল, রাত্রি। নিশা, নিশি, নিশীথিনী, সব মানেই এক।

অমল বলল, রবীন্দ্রনাথের গান আছে, ভরি দিয়া পূর্ণিমা নিশা, অধীর অদর্শন তৃষা—।

সুর করে সে গানটা গেয়ে উঠল।

গান থামতে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, অমল, তোমার সঙ্গে যে আর একজন লোক ছিল, সে গাড়িতে উঠল না?

অমল বলল, আমার সঙ্গে তো আর কেউ ছিল না।

কাকাবাবু বললেন, তোমার পাশেই একজন দাঁড়িয়ে ছিল, আমাদের পেছন পেছন গাড়ির কাছাকাছিও এল—

সন্তু বলল, আমিও লক্ষ করেছি, জুলপিদুটো বেশ বড়, মাথার সামনের দিকে একটু টাক।

অমল বলল, আমার সঙ্গে আসেনি। হয়তো অন্য কোনও বাঙালি আপনাদের চিনতে পেরে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

কাকাবাবু বললেন, একটা চকোলেট রঙের গাড়ি অনেকক্ষণ ধরে আমাদের পেছন পেছন আসছে।

অমল বলল, তাই নাকি? কাকাবাবু, আপনি বুঝি সবসময় রহস্য খোঁজেন? আমাদের কে ফলো করবে?

কাকাবাবু বললেন, কোনও কারণ নেই। তবে অনেকক্ষণ ধরে গাড়িটা দেখছি ঠিকই৷

আর খানিকটা বাদে অমলের গাড়ি থামল একটা উনিশতলা ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে। কাকাবাবু নামতেই পাশ দিয়ে একটা চকোলেট রঙের গাড়ি বেরিয়ে গেল। কাকাবাবু সেদিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন।

অমল থাকে সতেরোতলায়। তার বউ, ছেলেমেয়েরা গেছে কলকাতায়, ফ্ল্যাটটা ফাঁকা।

অমল দুহাত ছড়িয়ে বলল, আমি রান্নাবান্না সব করে রেখেছি। আপনারা আরাম করে বসুন। এখন জমিয়ে গল্প হবে।

কাকাবাবু বললেন, তুমি রান্না করতেও জানো নাকি?

অমল বলল, বাংলায় একটা কথা আছে, যে রাঁধে, সে কি চুল বাঁধে না? সেইরকমই বলা যায়, যে কবিতা লেখে, সে কি রাঁধতে পারে না? রান্নার জন্য আমি বন্ধুবান্ধব মহলে বিখ্যাত।

কাকাবাবু বললেন, আমি কবিতা লিখতেও পারি না, রান্নাও জানি না। আচ্ছা অমল, তুমি আজ কলকাতায় আমাকে ফোন করেছিলে কেন?

অমল বলল, অনেকদিন আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। তা ছাড়া একটা বই পড়ছিলাম, একটা জায়গা বুঝতে পারিনি। তাই ভাবলাম, কাকাবাবুকে ফোন করলে উনি ঠিক বলে দিতে পারবেন। আমার এমন সৌভাগ্য, ফোনে কথা বলার বদলে আপনাকে সশরীরে পাওয়া গেল। অফিস থেকে কাল-পরশু ছুটি নিচ্ছি, আপনাদের সারা বম্বে ঘুরিয়ে দেখাব। কাছাকাছি অনেক সুন্দর জায়গা আছে।

কাকাবাবু বললেন, আমরা তো বম্বে বেড়াতে আসিনি। কাল সকালে কালিকট যাব।

কয়েকদিন পরে সেখানে যাবেন।

প্লেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে।

টিকিট পালটানো খুব সোজা। কাল সকালেই ফোন করে দেব।

কিন্তু আমি ওদের কালিকট দেখাব বলে নিয়ে এসেছি। কী রে, তোরা কি বম্বেতে থাকতে চাস?

জোজো ঠেটি উলটে বলল, আমি এখানে অন্তত দশবার এসেছি। দেখার কিছু নেই।

সন্তু বলল, আমি একবার এসেছি অবশ্য। সেবারেই অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে। কালিকট গেলেই ভাল হয়।

অমল কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে ওদের দিকে চেয়ে থেকে বলল, কালিকটে কী আছে? সেখানে তো কেউ বেড়াতে যায় না।

কাকাবাবু বললেন, আমরা ঠিক করেছি, বড় বড় শহরের বদলে মাঝে মাঝে আমরা ছোটখাটো জায়গায় ঘুরে আসব।

অমল বলল, অফিসের কাজে আমাকে দু-একবার যেতে হয়েছে কালিকটে। ওখানে দেখার মতন কিছু নেই।

কাকাবাবু বললেন, অফিসের কাজে গেলে তো আর বেড়ানো হয় না!

হঠাৎ অমলের চোখদুটো বড় বড় হয়ে গেল। নতুন কিছু আবিষ্কার করার মতন আনন্দে সে চেঁচিয়ে উঠল, ও বুঝেছি! বুঝেছি! নতুন অভিযান। কালিকটে নিশ্চয়ই সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটেছে, আপনি তার সমাধান করতে যাচ্ছেন। আমি যাব, আমি আপনাদের সঙ্গে যাব! কাকাবাবু, আমি সাঁতার জানি, বক্সিং জানি, বন্দুক চালাতে জানি, ঘোড়ায় চড়তেও জানি!

কাকাবাবু হেসে ফেলে বললেন, তুমি কবিতা লেখা ছাড়াও এত কিছু জানো! কারও সঙ্গে লড়াই করতে গেলে তোমাকে তো সঙ্গে নিতেই হবে। কিন্তু কালিকটে সেরকম কোনও সম্ভাবনাই নেই। তুমি শুধু শুধু অফিস কামাই করবে কেন?

অমল তবু জোর দিয়ে বলল, না কাকাবাবু, আমি যাবই আপনাদের সঙ্গে। আমার অনেক ছুটি পাওনা আছে।

এবার জোজো বলল, আসল ব্যাপার কী জানেন তো? কালিকটে আমার এক মাসির বাড়ি। আমার এই মাসি সাউথ ইন্ডিয়ান বিয়ে করেছেন। অনেকদিন দেখা হয়নি, অনেকবার আসতে বলেছেন। নায়ারমামা চমৎকার লোক, ভাল বাংলা জানেন, বড় ব্যবসায়ী। আমরা সেখানে যাচ্ছি।

অমল বলল, মাসির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছ খুব ভাল কথা। কিন্তু ভাই মাসির বর তো মামা হয় না!

জোজো বলল, ও সরি সরি, নায়ারমেসো। ভুল করে মামা বলে ফেলেছি!

অমল বলল, আমাকে বলেছ বলেছ, ওখানে গিয়ে যেন অমন ভুল কোরো না!

কাকাবাবু বললেন, আমরা বরং ওখান থেকে ফেরার সময় তোমার এখানে দিন দু-এক থেকে যাব।

অমল বলল, তা তো থাকতেই হবে। জানেন কাকাবাবু, বেশিরভাগ লোকেরই কালিকট বন্দরের নাম শুনলেই ভাস্কো ডা গামার নাম মনে পড়ে। সবাই ইতিহাসে পড়েছে। এখনকার কালিকটে কিন্তু সেসব ইতিহাসের কোনও চিহ্নও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওখানে দেখার মধ্যে আছে শুধু নারকোল গাছ। আর এই সময়টায় অসহ্য গরম!

কাকাবাবু আর কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন।