০২. সিমলা শহরে একটা নতুন হাসপাতাল

সিমলা শহরে একটা নতুন হাসপাতাল হয়েছে। হরি সিং নামে একজন সেনাবাহিনীর বড় অফিসার একবার এভারেস্ট পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন। শিরদাঁড়া জখম হওয়ার ফলে দুটো পা-ই নষ্ট হয়ে যায়। মাউন্ট এভারেস্টে উঠতে গিয়ে এরকম কত দুর্ঘটনা হয়, কত মানুষ মরে যায়, কত মানুষ আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে থাকে সারাজীবন। সেই জন্যই হরি সিং অনেক চেষ্টা করে, অনেকের সাহায্য নিয়ে খুলেছেন এই হাসপাতাল। নতুন-নতুন যন্ত্রপাতি, ভাল-ভাল ডাক্তার রাখা হয়েছে, এখানে শরীরের হাড়গোেড় ভাঙারই চিকিৎসা হয়। এখন অনেক পর্বত-অভিযাত্রী আহত হলেও এই হাসপাতালে চিকিৎসা করে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে।

কাকাবাবুর বন্ধু নরেন্দ্র ভার্মা ছুটি কাটাবার নাম করে কাকাবাবুকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে সিমলায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আসল উদ্দেশ্য, ওই নতুন হাসপাতালে কাকাবাবুর চিকিৎসা করানো। আজকাল কত নতুন-নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়েছে, অপারেশন করে প্রায় সবকিছু সারিয়ে দেওয়া যায়। কাকাবাবু সারাজীবন খোঁড়া থাকবেন কেন?

কাকাবাবুকে প্রায় জোর করেই ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল সেই হাসপাতালে। মনোহর যোশি নামে একজন তরুণ ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখে বলেছিল, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনার পা আমি এরকম মেরামত করে দেব যে, কদিন পরে আপনি আবার দৌড়তে পারবেন, লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠবেন। ক্রাচ দুটো ছুড়ে ফেলে দেবেন!

শেষপর্যন্ত অবশ্য কাকাবাবুর পা ভাল হয়নি!

আফগানিস্তানে সেই দুর্ঘটনার সময় কাবুলে ঠিক ভাল চিকিৎসা করা যায়নি। দিল্লিতে নিয়ে আসতে-আসতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। তখন এতরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। কাকাবাবুর একটা পায়ের গোড়ালির হাড় একেবারে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গেছে, ও আর এখন মেরামত করা যাবে না। একমাত্র উপায়, পায়ের খানিকটা একেবারে কেটে বাদ দিয়ে সেখানে নকল পা লাগিয়ে দেওয়া। নকল পা নিয়েও মোটামুটি হাঁটতে পারা যায়।

কাকাবাবু নকল পা লাগাতে রাজি নন। তিনি বলেছিলেন, এত বছর ধরে ক্রাচ নিয়ে হাঁটা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে, এখন আর ওসব ঝাট করার দরকার কী? এই বেশ আছি।

মনোহর যোশি খোঁজখবর নিয়ে বলেছিল, আর একটা উপায় আছে। সেজন্য ইংল্যান্ডে যেতে হবে। ইয়র্কশায়ারে একটা হাসপাতালে হাড়-ভাঙার আরও আধুনিক চিকিৎসা হয়। সেখানে পা কেটে বাদ দিতে হয় না, অপারেশন করেও সবরকম পা-ভাঙা সারিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু বিলেতে গিয়ে থাকা, সেখানে চিকিৎসা করবার অনেক খরচ। অত টাকা কে দেবে? কাকাবাবু বলেছেন, আমার অত টাকা নেই, আমি এই ভাঙা-পা নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেব।

তবে সিমলার হাসপাতালে গিয়ে কাকাবাবুর একটা উপকার হয়েছে। ওরা একজোড়া বিশেষ ধরনের জুতো বানিয়ে দিয়েছে, যা পরে থাকলে কাকাবাবু এক জায়গায় কিছুক্ষণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। হাঁটতে গেলে ক্রাচ লাগবে, শুধু দাঁড়িয়ে থাকার সময় লাগবে না।

ক্রাচ ছাড়া চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলে কাকাবাবুকে দেখলে মনে হবে, তাঁর পা ভাঙা নয়।

কাকাবাবু ফিরে আসার পর বাড়ির সবাই তাঁকে ঘিরে রইল। কাকাবাবু মজা করে বলতে লাগলেন সেই হাসপাতালের কথা। সন্তুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেন অপারেশন করালাম না জানো বউদি? তোমার কথা ভেবে। আমার খোঁড়া পা ঠিক হয়ে গেলে তুমি যদি জোর করে আমার বিয়ে দিয়ে দাও!

মা বললেন, পায়ে একটু খুঁত থাকলে বুঝি মানুষের বিয়ে হয় না! তোমার ওপর জোর খাটাবার সাধ্য আছে আমার?

কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, নতুন জুতো পরে আমার একটা খুব উপকার হয়েছে। এখন আমি গাড়ি চালাতে পারি। দিল্লিতে ফিরে চালালাম একদিন।

অনেকদিন প্র্যাকটিস নেই, তবু ভুলিনি। ড্রাইভার রাখতে হবে না, বিমানের গাড়িটা আমিই চালাতে পারব!

পরদিন ড্রাইভার হয়ে কাকাবাবু মাকে নিয়ে গেলেন কালীঘাটের মন্দিরে, তারপর বরানগরে মাসির বাড়ি। তারপর নিউ মার্কেটে মা অনেকক্ষণ ধরে কেনাকাটি করলেন মনের সুখে। আজ তো আর ট্যাক্সি খুঁজতে হবে না।

অনেকদিন পর গাড়ি চালাতে শুরু করে কাকাবাবু খুব উৎসাহ পেয়ে গেছেন। ভোরবেলা উঠেই বললেন, চল সন্তু, কলকাতার বাইরে কোনও জায়গা থেকে একটা চক্কর দিয়ে আসি। দিনটা সুন্দর, আমারও খানিকটা প্র্যাকটিস হবে।

সন্তু বলল, জোজো ডায়মন্ড হারবার যেতে চেয়েছিল। ওকে তুলে নিয়ে যাব?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! জোজো না থাকলে জমেই না। তা হলে ডায়মন্ড হারবারই যাওয়া যাক।

জোজোর তৈরি হতে বেশি সময় লাগে না। তার বাড়িতে গিয়ে হর্ন দিয়ে ডাকতেই জোজো পাঁচ মিনিটের মধ্যে জামা-প্যান্ট পরে বেরিয়ে এল।

গাড়িতে উঠেই জোজো বলল, কাকাবাবু, আপনি সিকিম লটারির টিকিট কাটবেন?

কাকাবাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, কেন বলো তো? আমি তো কখনও লটারির টিকিট কাটি না। হঠাৎ এ-কথা জিজ্ঞেস করলে কেন?

জোজো বলল, ওই লটারির ফার্স্ট প্রাইজ পঁচিশ লাখ টাকা। ওই টাকাটা আপনি পেয়ে গেলে বিলেতে গিয়ে পায়ের অপারেশন করিয়ে আসতে পারবেন। আমি সব শুনেছি, আপনি টাকার জন্য বিলেতে যেতে পারছেন না।

কাকাবাবু বললেন, লটারির টিকিট কাটলেই আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়ে যাব? এমন আশ্চর্য কথা তো কখনও শুনিনি।

জোজো বলল, টিকিটটা আপনি কেটে আমাকে দেবেন। আমার বাবা সেই টিকিটে এমন মন্ত্র পড়ে হাত বুলিয়ে দেবেন যে ওই টিকিট নির্ঘাত ফার্স্ট প্রাইজ পাবে!

কাকাবাবু ভুরু দুটো তুলে জোজোর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, এরকম মন্ত্র আছে নাকি? মন্ত্রের এত জোর! তা হলে জোজো, তুমি নিজেই আগে কেন লটারির টিকিট কিনে ফার্স্ট প্রাইজ জিতে নাওনি!

জোজো সঙ্গে-সঙ্গে বলল, না, না, সেরকম নিয়ম নেই। সেটা চলবে না! এই মন্ত্র যে জানে, সে কখনও নিজের জন্য কিংবা নিজের ছেলেমেয়ের জন্য ব্যবহার করতে পারে না। তাতে মন্ত্রের গুণ নষ্ট হয়ে যায়। বাবা অন্যদের জন্যও এটা করতে চান না। আপনার জন্য স্পেশ্যাল কেস। এর আগে একবার শুধু একজন শিল্পীর সাত বছরের ছেলের হুপিং কাশি হয়েছিল, কিছুতেই সারছিল না, রাশিয়াতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার, তাই বাবা তাঁকে একটা লটারির সেকেন্ড প্রাইজ পাইয়ে দিয়েছিলেন।

সন্তু ফস করে জিজ্ঞেস করল, ওর বেলা সেকেন্ড প্রাইজ কেন?

জোজো বলল, ছোট ছেলে তো, তার বেশি দরকার নেই!

কাকাবাবু হেসে উঠে জোজোর কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন, শোনো জোজো। আমাদের দেশে কত ছোট ছেলে-মেয়ে হুপিং কাশি কিংবা আরও কতরকম অসুখে ভোগে। টাকার অভাবে তাদের চিকিৎসা হয় না। তোমার বাবাকে বলো, তাদের সাহায্য করতে। একসঙ্গে অনেককে ফার্স্ট প্রাইজ, সেকেন্ড প্রাইজ, সব প্রাইজ পাইয়ে দাও। আমি এই ভাঙা পা নিয়ে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছি। আমার সাহায্যের দরকার নেই!

জোজো বলল, আর একটা ব্যবস্থাও করা যায়। তাতে বিশেষ টাকা খরচ হবে না। অবশ্য আপনি যদি রাজি থাকেন!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বিনা পয়সায় চিকিৎসা? সেটা কী বলল তো?

জোজো বলল, আমার একজন ছোটকাকার একবার ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে মালাইচাকি গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা বলেছিলেন, কোনওদিন আর হাঁটতে পারবেন না

সন্তু বাধা দিয়ে বলল, জোজো, তোর কজন ছোটকাকা রে?

জোজো বলল, ছোটকাকা আবার কজন হয়?

সন্তু বলল, তুই যে বললি, একজন ছোটকাকা?

জোজো বলল, একজন বলেই তো একজন বললুম!

কাকাবাবু বললেন, জোজো আজ বেশ মুডে আছে। তারপর কী হল? তোমার ছোটকাকার পা সেরে গেছে?

জোজো বলল, আমার বাবা তাকে বললেন, তুই মধ্যপ্রদেশের মৃদঙ্গপুর পাহাড়ে চলে যা। সেখানে বিছাবজ্র নামে এক সাধু থাকেন। দুশো সাতান্নটা সিঁড়ি ভেঙে উঠলে সেই পাহাড়ের মাথায় সাধুজির মন্দির। উনি কাঁকড়াবিছে, তেঁতুলেবিছে এরকম অনেক রকম বিছে পোষেন। চোদ্দো-পনেরোটা সাপও আছে। ওই সাধু সবরকম ভাঙা হাড় জোড়া দিয়ে দিতে পারেন। ইঞ্জেকশনের বদলে কাঁকড়াবিছে। ভাঙা জায়গাটায় গোটা দশেক কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দেবেন, তারা হুল ফুটিয়ে-ফুটিয়ে … সেটা সহ্য করতে হবে, সেইসঙ্গে সাধুজি মন্ত্র পড়া জল ছেটাবেন, ঠিক সতেরো দিন! কাকাবাবু যদি ধৈর্য ধরে ওখানে সতেরোটা দিন থাকতে পারেন … আমি আর সন্তুও যাব আপনার সঙ্গে। বিছাবজ্ৰ সাধু একটাও পয়সা নেন না, বরং হালুয়া আর ক্ষীর খেতে দেন!

কাকাবাবু বললেন, সতেরো দিনটা সমস্যা নয়। কিন্তু দুশো সাতান্নটা সিঁড়ি ভেঙে তো আমি পাহাড়চূড়ায় উঠতে পারব না! সিঁড়িতেই আমাকে কাবু করে দেয়।

সন্তু মুচকি-মুচকি হাসতে-হাসতে বলল, জোজো, আর একটা বল!

জোজো জিজ্ঞেস করল, আর একটা কী বলব?

সন্তু বলল, এইরকম আর একটা কিছু চিকিৎসার উপায় জানিস না?

কাকাবাবু এমন মুখের ভাব করে বসে আছেন, যেন তিনি জোজোর সব কথা বিশ্বাস করেছেন।

গাড়িটা চলেছে ডায়মণ্ড হারবার রোড দিয়ে। দুপাশে ফাঁকা মাঠ, মাঝে-মাঝে এক-একটা গ্রাম আসছে। আবার কয়েকটা বড় বড় কারখানাও চোখে পড়ে। শীতকালের নরম রোদ ঝকমক করছে চারদিকে।

সন্তু বলল, কাকাবাবু, তুমি এতদিন পর গাড়ি চালাচ্ছ, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না?

কাকাবাবু বললেন, না রে। কিছুই ভুলিনি দেখছি। গাড়ি চালাতে পেরে বেশ একটা মুক্তির স্বাদ পাচ্ছি। ব্রেক চাপার সময় পায়ে একটু-একটু ব্যথা লাগছে, সেটাও এমন কিছু না।

সন্তু বলল, ভাগ্যিস বিমানদা গাড়িটা রেখে গিয়েছিলেন।

কাকাবাবু জোজোকে জিজ্ঞেস করলেন, জোজো, তুমিই তো ডায়মন্ড হারবার বেড়াতে যাওয়ার কথা বলেছিলে। সেখানে কী-কী দেখার আছে বলে তো?

জোজো সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিল, ইলিশ মাছ!

কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, অ্যাঁ ইলিশ মাছ?

জোজো বলল, ওখানে খুব টাটকা ইলিশ পাওয়া যায়। যারা বেড়াতে যায়, তারা দু-তিনটে করে কিনে নিয়ে আসে। একবার আমার এক মেসোমশাই বত্রিশটা ইলিশ কিনেছিলেন।

সন্তু বলল, বত্রিশটা? তোর মেলোমশাইয়ের বুঝি মাছের দোকান আছে?

জোজো বলল, মোটেই না। উনি মাছ খাওয়ার থেকেও মাছ কিনতে বেশি ভালবাসেন। মাছ কিনে এনে চেনা লোকদের বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। আমাদেরও দুটো দিয়েছিলেন সেবার। অপূর্ব স্বাদ!

কাকাবাবু বললেন, কিন্তু এই শীতকালে তো ইলিশের স্বাদ থাকে না। ভাল ওঠেও না।

জোজো বলল, সরস্বতী পুজো তো পার হয়ে গেছে। ঠিক সরস্বতী পুজোর পর থেকেই আবার ওঠে।

কাকাবাবু বললেন, ইলিশ মাছেরা বুঝি জানে কবে আমাদের সরস্বতী পুজো হয়?

সন্তু বলল, প্রত্যেক বছর তো একই দিনে সরস্বতী পুজো হয়ও না। বদলে বদলে যায়।

জোজো বলল, সরস্বতী পুজোর পর নদীর জলটাও বদলে যায়। তার থেকেই ইলিশ মাছরা টের পেয়ে যায়! সরস্বতীর একটা মানে নদী, তা জানিস?

কাকাবাবু বললেন, অনেকদিন আগে একবার ডায়মন্ড হারবার ছাড়িয়ে কাকদ্বীপ গিয়েছিলাম। একটা ছোট হোটেলে খেয়েছিলাম, এমন চমৎকার রান্না যে, এখনও যেন মুখে স্বাদ লেগে আছে। টাটকা মাছ ভাজা আর পাঁঠার মাংসের ঝোল দিয়ে গরম-গরম ভাত। এইসব ছোটখাটো হোটেলে খেতে আমার খুব ভাল লাগে। আজও ওইরকম একটা হোটেলে খাব।

সন্তু বলল, আমরা বিকেলের আগে ফিরব না।

জোজো বলল, আমাদের ফেরার তাড়া কী আছে? কাকাবাবুর সঙ্গে বেরিয়েছি, হারিয়ে তো যাব না?

ডায়মন্ড হারবারের গঙ্গার ধারে এসে দেখা গেল, প্রচুর গাড়ি আর মানুষজনের ভিড়। শীতকালে এখানে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসে। অনেক পিকনিক পার্টি এসেছে, তারা মাইকে গান বাজাচ্ছে, সেই শব্দে কানে তালা লেগে যায়!

সন্তুর মনটা খারাপ হয়ে গেল। এত ভিড় তার ভাল লাগে না। বাস ভর্তি-ভর্তি আরও লোক আসছে।

কাকাবাবু বললেন, একসঙ্গে তিন-চারটে মাইক বাজছে কাছাকাছি, এতে কোনও গানই তো ভাল করে শোনা যায় না! মাইক না বাজিয়ে এরা নিজেরা গান গায় না কেন?

জোজো বলল, চলুন, আমরা কাকদ্বীপে চলে যাই! আপনার সেই হোটেলে গিয়ে খাব!

গাড়ি, ট্রাক, বাস আর রিকশায় রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে। কাকাবাবু কোনওরকমে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে এগিয়ে চললেন। তারপর রাস্তা ফাঁকা পেতেই স্পিড দিলেন খুব।

কাকদ্বীপ পৌঁছতে দেরি হল না। কাকাবাবু অনেকদিন আগে যখন এসেছিলেন, তখন একটাই মোটে ভাত খাওয়ার হোটেল ছিল। এখন আরও কয়েকটা হোটেল হয়ে গেছে। তবু কাকাবাবু মনে করে করে আগের হোটেলটাই খুঁজে বার করলেন। সেটার নাম নীলকণ্ঠ কেবিন। প্রায় একই রকম রয়েছে। এর তুলনায় অন্য নতুন হোটেলগুলো আরও বড়।

জোজো বলল, বেশ নাম দিয়েছে তো! নীলকণ্ঠ! তার মানে, এখানে বিষ খেলেও হজম হয়ে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, খেলে বুঝবে, এরা বিষ দেয় না, অমৃত দেয়।

বেলা বেশি হয়নি, মাত্র পৌনে এগারোটা। এর মধ্যে ভাত খাওয়া যায় না, কিছু লোক অবশ্য হোটেলের মধ্যে ভাত খাচ্ছে।

জোজো বলল, আমার কিন্তু খিদে পেয়ে গেছে। আমি ব্রেকফাস্টে বিশেষ কিছু খাইনি।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী খেয়েছিস? ক্যাভিয়ার দিয়ে টোস্ট খেয়েছিস? জোজো বলল, আহা, সেটা তো ফুরিয়ে গেছে, তোকে খাওয়াতে পারলুম। আজ খেয়েছি এক বাটি ঘুগনি, দুটো পরোটা, আর দুটো পরোটা খেলুম ঝোলাগুড় দিয়ে, আর নারকোলের নাড় কয়েকটা।

সন্তু বলল, এত খেলে আর দুপুরে আমি কিছু খেতামই না।

জোজো বলল, গাড়িতে চাপলেই আগেকার খাবার সব আমার হজম হয়ে যায়। সেইজন্যই খিদে পায়!

কাকাবাবু বললেন, বেলা একটার আগে লাঞ্চ খাওয়া যায় না, চলো খানিকক্ষণ ঘুরে আসি। এর মধ্যে আমরা একবার চা-বিস্কুট খাব। কিন্তু কোথায় খাওয়া যায়? কাকদ্বীপে তো দেখার কিছু নেই।

সন্তু বলল, এইদিকে নামখানা বলে একটা জায়গা আছে না? সেখানে নদী পার হতে হয়। নদীটার নাম বেশ চমৎকার। হাতানিয়া-দোয়ানিয়া!

কাকাবাবু বললেন, চলো তা হলে নামখানা থেকেই ঘুরে আসি। ইচ্ছে হলে নদী পেরিয়ে ফ্রেজারগঞ্জ-বকখালিতেও যাওয়া যেতে পারে।

উলটো দিক থেকে একটা ভ্যান আসছে, তাতে লাউড স্পিকারে কী যেন ঘোষণা করা হচ্ছে। গ্রামের দিকে বড় ধরনের কোনও সভা-সমিতি হলে এইভাবে ঘোষণা করে। এই লাউড স্পিকারের আওয়াজ এত খারাপ যে, কথাগুলো বোঝাই যাচ্ছে না, শুধু মাঝে-মাঝে শোনা যাচ্ছে কাটা মুণ্ডু…পাঁচটা বাঘ… শূন্য থেকে ঝাঁপ… মুখের মধ্যে আগুন…

একটা লোক সেই ভ্যান থেকে হ্যাণ্ডবিল ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছে, সেগুলো কাটা-ঘুড়ির মতন উড়ছে বাতাসে, জোজো জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একটা খপ করে ধরে নিল।

সার্কাসের বিজ্ঞাপন! এখানে জুয়েল সার্কাস চলছে। দিনে দুবার, দুপুর তিনটে আর সন্ধে সাড়ে ছটায়।

জোজো পড়তে-পড়তে বলে উঠল, কাকাবাবু, আমরা সার্কাস দেখব! অনেকদিন দেখিনি!

কাকাবাবু বললেন, তা দেখা যেতে পারে। মফস্বলের সার্কাস দেখতে বেশ মজা লাগে।

একটুখানি যাওয়ার পর মাঠের মধ্যে সেই সার্কাসের তাঁবুও দেখা গেল। বেশ সুন্দরভাবে সাজানো। সামনে একটা হাতি বাঁধা আছে। এখানেও একজন লোক চ্যাঁচাচ্ছে।

সন্তু বলল, পাঁচটা বাঘ, তার ওপর হাতিও আছে, দারুণ জমবে মনে হচ্ছে।

নামখানায় নদীর ধারে কয়েকটা চায়ের দোকান রয়েছে। কাকাবাবু একটা দোকানের সামনে গাড়ি থামালেন। গাড়ি থেকে না নেমেই তিনি তিনটে চা ও বিস্কুট দিতে বললেন দোকানদারকে।

নদীটা বেশি চওড়া নয়, কিন্তু অনেক বড় বড় নৌকো যায়। একটা ফেরি। চলছে, ইচ্ছে করলে গাড়িসুদ্বুও ওপারে যাওয়া যেতে পারে। একটা খড় বোঝাই নৌকোর ওপরে বসে একটি লোক চেঁচিয়ে গান গাইছে। একটা মাছধরা নৌকো থেকে জেলেরা দু ঝুড়ি মাছ নীচে নামিয়ে আনল।

রাস্তার উলটোদিকে একটা জিপ দাঁড়িয়ে আছে, তার ভেতরে বসা একজন লোক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কাকাবাবুর দিকে। একটু পরে লোকটি নেমে এদিকে এল।

কাছে এসে সে বলল, তা হলে চোখে ভুল দেখিনি। রাজা রায়চৌধুরী? ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না!

কাকাবাবু হেসে বললেন, অসীম দত্ত! অনেকদিন পর দেখা। তোমার কী বিশ্বাস হচ্ছিল না?

অসীম দত্ত বললেন, পা ঠিক হয়ে গেছে? কী করে হল? কবে হল?

কাকাবাবু বললেন, এই ভাঙা পা কি আর জোড়া লাগে? এই দ্যাখো না, ক্রাচ দুটো পাশে রাখা আছে।

অসীম দত্ত জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই তো গাড়ি চালাচ্ছিলে? কাকাবাবু বললেন, এইটুকু প্রোমোশন পেয়েছি। নতুন ধরনের জুতা পেয়েছি দিল্লিতে, গাড়ি চালাতে পারি, কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারি না। ক্রাচ ছাড়া হাঁটতেও পারি না। তুমি এ দিকে কোথায় এসেছিলে?

অসীম দত্ত বললেন, এখানে একটা সুন্দর বাংলো আছে। ছুটি নিয়ে দিন তিনেক কাটাতে এসেছিলাম। আজ ফিরে যাচ্ছি। তুমি কোনও রহস্যের সন্ধানে এসেছ নাকি?

কাকাবাবু বললেন, না, রহস্য-টহস্য কিছু নেই। অনেকদিন পর গাড়ি চালানো প্র্যাকটিস করছি।

সন্তু আর জোজোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে কাকাবাবু বললেন, অসীম আমার ছেলেবেলার বন্ধু, এখন পুলিশের একজন বড়কর্তা।

অসীম দত্ত পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে বললেন, রাজা, এটা রাখো। কখনও দরকার হলে ফোন কোরো। তোমার বাড়িতে আমি একদিন যাব। আমার মেয়ে তোমার খুব ভক্ত। সে অবশ্য আমাদের সঙ্গে আসেনি এবার।

আর একটুক্ষণ কথা বলে অসীম দত্ত চলে গেলেন। সন্তু আর জোজো গাড়ি থেকে নেমে নদীর ধারে এসে দাঁড়াল।

সন্তু বলল, জোজো, চল ফেরিতে চেপে ওপারটা ঘুরে আসি।

জোজো উৎসাহ না দেখিয়ে বলল, ওপারে দেখবার কী আছে? আমার ভাই খিদে পেয়ে গেছে। তা ছাড়া সার্কাস যদি আরম্ভ হয়ে যায়?

আবার ফিরে আসা হল কাকদ্বীপের সেই হোটেলে। এখন ভেতরে বেশ ভিড়। ফাঁকা টেবিল পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হল খানিকক্ষণ। জোজোর মুখ দেখে মনে হয়, সে আর খিদে সহ্য করতে পারছে না। টেবিলে বসার পর বেয়ারা প্রথমেই একটা প্লেটে লেবু, লঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে গেল, জোজো শুধু-শুধু সেই পেঁয়াজই খাওয়া শুরু করে দিল।

এ-হোটেলের খাবার এখনও বেশ ভাল আছে। সবকিছুই গরম-গরম। ভাত, ডাল, বেগুনভাজা, পার্শে মাছ ভাজা, এর পর কাকাবাবু নিলেন বড়বড় ট্যাংরা মাছের ঝোল। সন্তু সেই মাছের বদলে নিল মুর্গির মাংস, জোজো মুর্গির মাংসও নিল, সেইসঙ্গে দুপিস ইলিশ মাছ। সেই ইলিশের ঝোল এমনই ঝাল

যে, ঠোঁট দিয়ে হুস-হুস শব্দ করতে লাগল জোজো।

কাকাবাবু বললেন, এর পর দই খাও, ঝাল কমে যাবে।

এ-হোটেলে দই পাওয়া যায় না। তারা আনিয়ে দিল অন্য দোকান থেকে।

দই শেষ করার পর কাকাবাবু বললেন, আঃ, বড় তৃপ্তি হল।

সন্তু বলল, বেশি খেয়ে ফেলেছি। সার্কাস দেখতে গিয়ে ঘুম না পেয়ে যায়।

জোজো বলল, আমি চিমটি কেটে তোকে জাগিয়ে দেব!

সার্কাস শুরু হতে এখনও কিছুটা দেরি আছে, কিছু কিছু লোক আসছে এর মধ্যে। এখন মাইকে একটা গান বাজছে, আর হঠাৎ হঠাৎ সেই গান থামিয়ে একজন লোক ঘোষণা করছে, আসুন, আসুন, খেলা শুরু হবে, ক্ষণে-ক্ষণে শিহরন, আগুনে ঝাঁপ দেবে মেয়ে, মাথার একটি চুলও পুড়বে না। কাটা মুণ্ডু কথা বলবে, চোখের পলকে জীবন্ত মানুষ অদৃশ্য, বাঘের মুখে বাঙালি, তবলার তালে-তালে হাতির নাচ…

কাকাবাবু বেশি দামের তিনখানা টিকিট কিনে ফেললেন। ভেতরে অনেকটা বড় জায়গা, থাক থাক গ্যালারি করা, সামনের দিকে কিছু গদি-মোড়া চেয়ার। দুটি ক্লাউন ডিগবাজি খাচ্ছে মাঝে মাঝে। তাদের কালো রঙের পোশাক, মুখ এমনই সাদা যে, মনে হয় চুন মেখেছে। পরদার আড়াল থেকে ভ্যাঁপ্লোর পো, ভ্যাঁপ্লোর পোঁ করে একটা বাজনা বাজছে।

ঠিক তিনটের সময় পরদা খুলে গেল। নানারকম সাজপোশাক পরা খেলোয়াড়রা বেরিয়ে এসে দৌড়তে লাগল গোল হয়ে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি মেয়েও রয়েছে।

প্রথমে আরম্ভ হল ট্রাপিজের খেলা। অনেক ওপরে রয়েছে দুটো দোলনা। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে এক দোলনা থেকে লাফিয়ে যাচ্ছে অন্য দোলনায়। সেই খেলাই চলল বেশ কিছুক্ষণ। লোকে উসখুস করছে, অনেকেরই এ-খেলা ভাল লাগছে না। একজন চেঁচিয়ে উঠল, কই দাদা, বাঘ কখন আসবে?

কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, এই ট্রাপিজের খেলা খুব শক্ত। দ্যাখ, নীচে জাল পেতে রাখেনি। পড়ে গেলে হাড়গোড় চুরমার হয়ে যাবে।

তাঁবুর পেছন দিক থেকে দুবার বাঘের ডাক শোনা গেল।

জোজো বলল, আসল বাঘের ডাক নয়। হাঁড়ির মধ্যে মুখ দিয়ে কোনও মানুষ এরকম আওয়াজ করছে।

সন্তু বলল, বাঘের খেলার সময় মানুষই কি বাঘ সেজে আসবে?

সোনালি রঙের কোট পরা একজন লোক এসে মাঝখানে দাঁড়াল, বুকের কাছে অনেক মেডেল ঝোলানো। সে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে বলল, ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়গণ, আমরা পরপর কী খেলা দেখাব, তা আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন। জন্তু-জানোয়ারের খেলা একেবারে শেষকালে দেখানো হয়। তার আগে আপনারা দেখবেন অবিশ্বাস্য চমকপ্রদ সব খেলা, জীবন্ত মানুষ অদৃশ্য, মোটর সাইকেলের মরণঝাঁপ, কাটা মুণ্ডুর কথা বলা…

সেই লোকটির কথা শেষ হতে-না-হতেই একটা মোটর সাইকেলের দারুণ আওয়াজ শোনা গেল। তারপর আর সব আলো নিভিয়ে একদিকে ফোকাস ফেলতে দেখা গেল, খানিকটা উঁচুতে পা থেকে মাথা পর্যন্ত কালো কাপড়ে মোড়া একজন লোক বসে আছে মোটর সাইকেলে। পেছন থেকে খুব জোরে জোরে দুবার ড্রাম বাজতেই সে মোটর সাইকেলে স্টার্ট দিল। প্রথমে মনে হল, সে শূন্যের ওপর দিয়ে মোটর সাইকেলটা চালাচ্ছে। আসলে তা নয়। সেখানে একটা মোটা তার টাঙানো আছে। মোটর সাইকেল যাচ্ছে সেই তারের ওপর দিয়ে।

দুবার সেই তারের ওপর দিয়ে যাতায়াত করার পর সেই লোকটি আরও সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড করল। মোটর সাইকেল সমেত সে সেই তার থেকে ঝাঁপ দিল নীচের দিকে। ততক্ষণে নীচের জায়গাটায় দুজন লোক একটা গোরুর গাড়ির চাকার সমান রিং নিয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই রিংটার মাঝখানে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। মোটর সাইকেল-আরোহী ওপর থেকে পড়ে সেই আগুনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে গেল।

দারুণ খেলা। সবাই চটাপট হাততালি দিল।

কাকাবাবু বললেন, কী করে পারে? কতদিন প্র্যাকটিস করতে হয় বলে তো?

এর পর কয়েকটা খেলা এমন কিছু নয়। অতি সাধারণ। কাটা মুণ্ডুর কথা বলা দেখলে হাসি পায়। প্রথমে সত্যি মনে হয়, একটি মেয়ের শুধু মুণ্ডুটা শূন্যে ঝুলছে। সেটা আবার একপাশ থেকে আরেক পাশে যাচ্ছে। আসলে আর সব আলো নিভিয়ে ফোকাস ফেলা হয়েছে শুধু মেয়েটির মুখে, তার শরীরটা কালো কাপড়ে ঢাকা। সেইজন্য দেখা যাচ্ছে শুধু মুখটা। সেই মুখ আবার নাকিসুরে কথা বলছে।

সেই খেলার পর আবার সব আলো জ্বলে উঠল। এবারে স্টেজের ওপরে এসে দাঁড়াল আর-একজন লোক। এরও কালো পোশাক, মুখে একটা মুখোশ, হাতে একটা মস্ত বড় চাদর। প্রথমে লোকটি সেই চাদরটা নিয়ে খানিকটা নাচ দেখাল। তারপর সে থামতেই আগের সোনালি কোট পরা লোকটি এসে বলল, এবার জাদুকর এক্স আপনাদের মানুষ অদৃশ্য করার খেলা দেখাবেন। ইনি সবকিছু অদৃশ্য করে দিতে পারেন। আলো জ্বলবে, আপনাদের চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যাবে! প্রথমে দেখুন একটা কুমড়ো!

একটা বিরাট কুমড়ো এনে রাখা হল একটা টুলের ওপর। জাদুকর এক্স সেই কুমড়োটার গায়ে হাত বুলিয়ে টুলটার চারপাশে ঘুরলেন একবার। তারপর সেই কালো চাদরটা দিয়ে কুমড়োটাকে একবার ঢেকেই তুলে নিলেন। কুমড়োটা আর নেই!

এর পর জাদুকর এক্স সেই টুলটাকে ওইভাবে অদৃশ্য করে দিলেন। দড়ি বেঁধে একটা ছাগলকে টানতে-টানতে আনা হল মঞ্চে, সেটা ব্যাব্যা করে ডাকছে। কালো কাপড়ে ঢাকার পর ছাগলটাও অদৃশ্য হয়ে গেল।

কালো কাপড়টা রাখা হচ্ছে কয়েক মুহূর্ত মাত্র। জাদুকর এক্স নিজে কোনও কথা বলছেন না, শুধু একবার নাচের ভঙ্গিতে ঘুরছেন।

সোনালি কোট পরা লোকটি বলল, এবার মানুষ! যে-কোনও মানুষ, ছোটবড়, নারী-শিশু, মোটা-রোগা, যে-কোনও মানুষকে দেখবেন, এই আছে, এই নেই!

একজন মাঝবয়েসী লোক এসে দাঁড়াল মঞ্চে। জাদুকর এক্স সঙ্গে-সঙ্গে তাকে অদৃশ্য না করে কালো কাপড়টা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে নাচতে লাগলেন।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কাকাবাবু, মানুষ কি সত্যি-সত্যি অদৃশ্য হতে পারে?

কাকাবাবু দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, না!

জোজো বলল, আমি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা অদৃশ্য মানুষ নামে একটা বই পড়েছি। স্টার ট্রেক সিরিয়ালে দেখায় একটা যন্ত্রের নীচে দাঁড়ালে মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আবার আগের চেহারায় ফিরে আসছে।

কাকাবাবু বললেন, সে তো কল্পনা। সত্যি-সত্যি ওরকম হতে পারে না। এ-পর্যন্ত বিজ্ঞান যতখানি এগিয়েছে, তাতে সম্ভব নয়!

জোজো তবু অবিশ্বাসের সুরে বলল, তা হলে এই লোকটা কী করে করছে?

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই কোনও একটা কায়দায় আমাদের চোখে ধুলো দিচ্ছে। কায়দাটা জানলে তো আমি নিজেই এরকম দেখাতে পারতাম। ম্যাজিশিয়ান কতরকম খেলা দেখায়, আমরা ধরতেই পারি না।

মঞ্চের লোকটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর সোনালি কোট পরা লোকটি দর্শকদের দিকে চেয়ে বলল, দেখলেন? দেখলেন? বিশ্বাস হল তো? যদি কেউ অবিশ্বাস করে থাকেন, তিনি উঠে আসুন। তাঁকেও অদৃশ্য করে দেওয়া হবে। আসুন, আসুন, কে আসবেন, আসুন।

জোজো তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বলল, আমি যাব। আমি কায়দাটা দেখতে চাই।

জোজোর সঙ্গে-সঙ্গে আরও চারজন গিয়ে দাঁড়াল মঞ্চে।

সোনালি কোট বলল, সবাইকে তো অদৃশ্য করা যাবে না। আমাদের এর পরে অন্য খেলা আছে। মাত্র একজন। একজনকে বেছে নেওয়া হবে।

পাঁচজন নানা বয়েসের। ম্যাজিশিয়ান এক্স সকলের মুখের ওপর চোখ বুলিয়ে জোজোর দিকে একটুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। কেন যে তিনি জোজোকে বেশি পছন্দ করলেন, তা বোঝা গেল না। এগিয়ে এসে জোজোর কাঁধে হাত রাখলেন।

অন্য চারজন ফিরে এল। জোজোকে দাঁড় করানো হল স্টেজের মাঝখানে। জোজো মুখোনা হাসি-হাসি করে রেখেছে, তবু মনে হচ্ছে যেন সে একটু নার্ভাস হয়ে গেছে। সোনালি কোট আরও খানিকক্ষণ বকবক করল। তারপর ম্যাজিশিয়ান কালো চাদরটা উড়িয়ে জোজোর পাশ দিয়ে নাচলেন একবার। দর্শকদের দিকে পেছন ফিরে কালো চাদরটা দিয়ে ঢেকে দিলেন, আবার সরিয়ে নিলেন প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে।

জোজো অদৃশ্য হয়ে গেছে।

সবাই খুব জোরে-জোরে হাততালি দিল একবার।