রৌদ্রলোকে, নক্ষত্রের বিপুল জোয়ারে

আমাদের দু’জনের মধ্যে যেন কবরের মতো কিছু আছে,
বুঝি তাই অন্তহীন বিচ্ছিন্নতা নিয়ে
দু’জন দু’দিকে থাকি। শুকনো ওষ্ঠে পানি ঝরবার
অনেক আগেই বেলা যায়, বেলা যায়।
তবুও তোমার প্রতি যাই বেলাশেষে,
যেমন নিঃসঙ্গ বেদুইন
ব্যাকুল প্রবেশ করে মরুদ্যানে। আমি বালির ভেতর থেকে
ঝরণার বদলে
বেনামি কংকাল তুলে আমি আর প্রিয় কোনো গান
হঠাৎ গাইতে গিয়ে বোবার মতোন কিছু শব্দ করে ফেলি।

কবরখানার পাশে দ্বিপ্রহর, সোনালি নর্তকী,
প্রতিটি মুদ্রায় তার
কেমন ঔদাস্য ছিল, কবরের ফুলের মতোন
দৃষ্টি নিয়ে কী তন্ময় তাকিয়েছিলাম একজন
প্রতিমার প্রতি,
তুমি তাকালে না;
অথচ আমার ভেতরের দৃশ্যাবলী দুলে উঠেছিল খুব।
কবরখানার পাশে দাঁড়ালেই কেবলি আমার
সাবানের ঘ্রাণ, যেশাশের অন্তিম ভোজন, শূন্য পানপাত্র,
জংধরা হেলমেট চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া জল মনে পড়ে,
মনে পড়ে কুয়াশায় ভীষণ একলা কারো যাওয়া।

তোমার নিকট থেকে চলে যেতে ভারি ভয় পাই,
যেমন ধার্মিক ধর্ম থেকে,
সর্বক্ষণ বুক জুড়ে থাকে তোমাকেই
পাওয়ার প্লাবন, কাতরতা।
ধ্বংসস্তূপে বসে আমি তোমার অধরে ওষ্ঠ রেখে
অমরতা চেয়ে নিতে পারি,
তোমাকে বাঁধতে পারি আলিঙ্গনে কবরের পাশে,
কবিতাও লেখা যায় লাশময় প্রান্তরে একাকী
ট্রেঞ্চে জ্যোৎস্না ব্যেপে এলে মুশকিল নয়
দিনপঞ্জী কিংবা চিঠি লেখা।

যখন একলা থাকি ঘরে, পোশাক বদলে ফেলি যথারীতি,
সিগারেট খাই, ভয় পাই, এ ভয়ের কোনো ব্যাখ্যা
চলে না কখনো।
কখন যে কবেকার শীতল মোমের গন্ধে ভরে যায় ঘর,
অনেকেই ফিস ফিস কথা বলে, মনে হয়, আমি
কারো কথা শুনি না স্পষ্টত।
বুঝি বা দেয়াল বলে, ‘আত্মসমর্পণ করো’, কিন্তু তার প্রতি?
পাই না উত্তর।
অনিদ্রার ঘোরে শুধু নিদ্রাকেই ডাকি, পাছে আমি
আত্মহত্যা করে ফেলি জাগরণে ক্রুর নিঃসঙ্গতাবোধে।

প্রতিদিন দেখি আমি মনশ্চক্ষে একটি বিজন পথরেখা-
সে পথে আমরা, তুমি আর আমি, হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে
জেনে নিতে চাই প্রকৃতই কতদূর যাওয়া,
সে পথে তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে নিরিবিলি
কখনো ফিরিয়ে আনতে চাই মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া
দগ্ধ চিৎকারের মতো আমার আহত, অভিমানী
কবিতাগুলিকে।
এভাবে অনন্তকাল তোমার সঙ্গেই হেঁটে যাওয়া যেতো যদি
দয়ার্দ্রে রোদ্দুরে
প্রজাপতিদের মধ্যে, তবে আমি বিশ্রামের কথা
ভুলে থাকতাম।
প্রতিদিন ধু ধু পথে স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলি, যেন মরুদ্যান।

বারবার আমাদের দু’জনের মধ্যে কবরের মতো কিছু,
বস্তুত কবরই এসে যায়।
‘এ কবর কার? বলে আমরা দু’জন পরস্পর চেয়ে থাকি
কিছুক্ষণ দেখি প্রজাপতি ঘাস ছুঁয়ে
ঝরণার নিকটের উড়ে যায়।
কবরের দীর্ঘ ঘাস আমাকে জড়াতে চায় যত,
তত বেশি ভালো লাগে জীবনের সঙ্গে উন্মুখর গলাগলি
রৌদ্রালোকে নক্ষত্রের বিপুল জোয়ারে।