অনুমান – আরজ আলী মাতুব্বর

অনুমান – আরজ আলী মাতুব্বর

অনুমান
রচনাকাল ১৩.৪.১৩৮৮ থেকে ৮.৩.১৩৮৯
প্রকাশকাল কার্তিক ১৩৯০


ভূমিকা

অনুমান করে কথা বললে লোকে তা বিশ্বাস করতে চায় না, চায় যুক্তি ও প্রমাণ। কিন্তু বলবার সাথে সাথে সকল কথা প্রমাণ করা সম্ভব নয়। কেননা হাট-বাজার ও পথে-ঘাটে লোকে তো কতো কথাই বলে থাকে, সংগে তো কারো কোন প্রমাণপত্র থাকে না। তবে বক্তব্যের যুক্তিটা থাকা দরকার সর্বত্রই। কোনো তত্ত্বমূলক বিষয়ে তো নয়ই, যুক্তিহীন (আন্দাজী) কথা বাজারেও চলে না। তাই আমি যুক্তির সাহায্যে কতিপয় বিষয়ের সত্যের সন্ধান করতে চেয়েছিলাম এবং সে জন্য লিখেছিলাম সত্যের সন্ধান নামীয় একখানা পুস্তিকা ১৩৫৮ (১৯৫১) সালে। আর তার অপর একটি নামও দিয়েছিলাম ‘যুক্তিবাদ’। পরিতাপের বিষয় এই যে, সেই যুক্তিবাদ-এর কঠিন দেয়াল ডিঙিয়ে আমাকে নেয়া হয়েছিলো পবিত্র হাজতখানায়। তাই এবারে সত্যের সন্ধান না করে মিথ্যার সন্ধান করতে চেষ্টা করছি এবং ‘যুক্তিবাদ’-এর আশ্রয় না নিয়ে আমি আশ্রয় নিচ্ছি ‘অনুমান’-এর। তাই এ পুস্তিকাখানার নামকরণ করা হলো – মিথ্যার সন্ধানে অনুমান। এতে যুক্তিবাদের কঠিন দেয়াল নেই, আছে স্বচ্ছ কাচের আবরণ।
মূলত অনুমান তুচ্ছ বিষয় নয়। এর আশ্রয় না নিয়ে মানুষের এক মুহূর্তও চলে না। অনুমান করবার শক্তি ক্ষীণ বলেই ইতর প্রাণী মানুষের চেয়ে এত পিছনে এবং মানুষ এত অগ্রগামী তার অনুমান করবার শক্তি প্রবল বলেই। ভবিষ্যতের চিন্তা মাত্রেই অনুমান, কতক অতীতেরও। আর ভবিষ্যৎ ও অতীত বিষয়ের চিন্তা ও অনুমান করতে পারে বলেই মানুষ মানুষ হতে পেরেছে।
অনুমান-এর বাস্তব ও অবাস্তব দুটি রূপ আছে। তবে ভবিষ্যৎ যাবত বর্তমান-এ পরিণত না হয়, তাবৎ সে ‘রূপ ধরা পড়ে না। আবার এমন অনুমানও আছে, যার বাস্তব রূপ কোনো কালেই ধরা পড়তে চায় না।
পরমেশ্বর বলে কেউ আছেন কি-না, এ প্রশ্নটির মীমাংসা অনুমানসাপেক্ষ। প্রশ্নটি অতীতেও ছিলো, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও হয়তো থাকবে ; সুমীমাংসা হয়নি আজও, হয়তো হবেও না কোনোদিন। মীমাংসা হলে – আস্তিক ও নাস্তিক, এ দুটাে সম্প্রদায় থাকতো না বা থাকবে না। কিন্তু সে আশা দুরাশা মাত্র।
প্রাগৈতিহাসিক যুগের বহু খবর আজ আমরা পাচ্ছি — ভূতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, রসায়নতত্ত্ব ইত্যাদির মাধ্যমে। আবার কতক খবর জানা যায় কেচ্ছা-কাহিনী ও পৌরাণিক পুথি-পত্তরের মাধ্যমে। কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই কাহিনীকাররা ঘটনার বাস্তব রূপটি পরিবেশন করেননি। পৌরাণিক কতোগুলো কাহিনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বহু গোষ্ঠীগত স্বার্থের কারণেই। সে সমস্ত কাহিনীর বাস্তবরূপ অনুধাবন করার একমাত্র উপায় অনুমান। আর তারই সামান্য চেষ্টা করা হয়েছে এ পুস্তিকাখানার মাধ্যমে।
এ পুস্তিকাখানায় উল্লিখিত প্রসঙ্গসমূহে আরোপিত আমার অনুমানগুলো যে অন্য কারো অনুমানের সাথে মিলবে, এমন আশা আমি করি না। তবে প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে আমার অনুরোধ যে, তারা যেনো আমার আলোচ্য বিষয়সমূহ নিয়ে স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা করেন এবং ওগুলোর যাথাথ্য নির্ণয়ের চেষ্টা করেন।
এ পুস্তিকাখানা প্রণয়নে আমাকে উৎসাহিত ও সহযোগিতা দান করেছে শিক্ষামোদী তরুণ যুবক প্রিয় মো. ফিরোজ সিকদার। আমি তার উন্নত জীবন ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
রচনাকালীন আমার এ লেখাগুলোর প্রতিটি শব্দ ধন্য হয়েছে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেবের শুভদৃষ্টির পরশে। কিন্তু সেজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি না। কেননা আমার লেখার কলমটাই তার।
এ ক্ষুদ্র পুস্তিকাখানার মুদ্রণকালে যথারীতি প্রুফ সংশোধনের অভাবে এতে ভুলের পরিমাণ এতই বেশী রয়ে গেলো যে, শুদ্ধিপত্রেও তা শুদ্ধ হবার নয় এবং তা একান্তই লজ্জাকর। প্রিয় পাঠকবৃন্দের বিরক্তিজনক সে সব ভুলের জন্য তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই।

বিনীত
গ্রন্থাকার
লামচরি
৭ কার্তিক
১৩৯০ গ্রন্থকার


সূচী

  1. রাবণেরপ্রতিভা
  2. ফেরাউনের কীর্তি
  3. ভগবানের মৃত্যু
  4. আধুনিক দেবতত্ত্ব
  5. মেরাজ
  6. শয়তানের জবানবন্দি
  7. সমাপ্তি
Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *