১. আলো ক্রমে আসিতেছে

অন্তর্জলী যাত্রা – আলো ক্রমে আসিতেছে

আলো ক্রমে আসিতেছে। এ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনৰ্ব্বার আমরা, প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।

অনতিদূরে উদার বিশাল বাহিণী গঙ্গা, তরল মাতৃমূৰ্ত্তি যথা, মধ্যে মধ্যে বায়ু অনর্গল উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে; এইস্থানে, বেলাতটে, বিবশকারী উদ্বিগ্নতা ক্ষুদ্র একটি জনমণ্ডলীকে আশ্রয় করিয়া আছে। কোথাও কারণের বিকার মাত্র নাই, প্রতিবিম্ব নাই, কোথাও স্বপ্ন পর্য্যন্ত নাই; এ কারণে যে, একটি মুহূর্তের সকল কিছুকে বাস্তব করত স্মরণীয় করিয়া একের যে নাম ভিন্ন ক্রমাগতই অপ্রাকৃতিক পার্থিব, তাহারই প্রাণবায়ু নিষ্ক্রান্ত হইবে এবং তাই মানুষমাত্রই নিশ্চল, ম্রিয়মাণ, বিমূঢ়। ইহাদের প্রত্যেকেরই। মুখে মুখে নির্বোধ গাম্ভীৰ্য্য আরূঢ় হইয়া রহিয়াছে মনে হয়, কখন তাহারা কপালে করাঘাত করিবার অমোঘ সুযোগ পাইবে তাহারই যেন বা কাল গণনা করিতেছে। কেননা চির অসূৰ্য্যম্পশ্যা জীবন এই প্রথম আলোকের শরণাপন্ন, কেননা শূন্যতা লবণাক্ত এবং মহাআকাশ অগ্নিময় হইবে।

আমাদের স্নেহের এ জগৎ নশ্বর, তথা চৈত্ররুক্ষ অগণন অন্ধকার সকলই, মৃন্ময় এবং অনিত্য; তথাপি ইহার, এই জগতের, স্থাবর ও জঙ্গমে পূর্ণিমা; ইহার চতুর্বিংশতিতত্ত্বে, মানুষের দুঃখে, কোমল নিখাদে–সর্বত্রে, এরূপ কোন তন্মাত্রা নাই যেখানে যাহাতে–হাসি নাই, কারণ সৰ্ব্বভূতে, বহুতে, তিনি বিরাজমান।

হায়! ইদানীং সেই বহুর মধ্যে একটিকে পরিত্যাগ করত মহাব্যোমে, বিরাট শূন্যতায়, চক্ষুহীন জিহ্বহীন স্তব্ধতায় তিনি অব্যক্ত হইবেন; চির রহস্যের, অনন্তের রূপ একই রহিবে। গঙ্গাতীরে অন্তর্জলী উদ্দেশ্যে আনীত সীতারাম চট্টোপাধ্যায় এই অগণিত বহুর মধ্যে–সেই নিঃসঙ্গ একটি।

সীতারাম অতীব প্রাচীন হইয়াছেন; অধুনা খড়ের বিছানায় শায়িত, তিনি, যেমত বা স্থিতপ্রজ্ঞ, সমাধিস্থ যোগীসদৃশ, কেবল মাত্র নিষ্পলক চক্ষুর্ঘয় মহাকাশে নিবদ্ধ, স্থির; তিলেক চাঞ্চল্য নাই, প্রকৃতি নাইক্রমাগতই বাঙ্ময়ী গঙ্গার জলছলাৎ তাঁহার বিশীর্ণ পদদ্বয়ে লাগিতেছিল।

অন্তবন্ত, অন্তরঙ্গ এ দেহ যে বৈরাগ্য আনিবার পক্ষে যথেষ্ট অঢেল তাহা অতিবৃদ্ধ সীতারামের। দেহের প্রতি তাকাইলেই সম্যক উপলব্ধি হয়; তদ্দর্শনে, আপনার হস্ত হইতে শিশুর কপোলস্পর্শজনিত যে রেশমী অনুভব তাহা অচিরেই উধাও হইবে; আপনার সকল স্মৃতি–একদা হয়ত যে মানসবেগ চম্পকে জড়াইয়াছিল, কখন হয়ত দূর পথশ্রমের পর–স্রোতস্বিনী দর্শনে যে শান্তি অনুভব, অথবা পরিপ্রেক্ষিত হইতে সৃষ্ট হইয়া ক্রমে দিনের আলোয় ভাঙিয়া পড়া যেমন বুদ্বুদের চরিত্র এবং তাহা। অনুধাবনে মানুষ যেমন বিনয়ী হইতে গিয়া অহঙ্কারী হইয়া উঠিয়াছে–এই সকল স্মৃতি মাত্রই ভ্রংশ হইবে এবং দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করত আপনাকে নিশ্চিত বারম্বার বলিতেই হইবে, হায় এ-দেহ কি গোলাপের অন্যতম দীর্ঘতম পুরস্কার! এবং অজানিতের প্রতি বালকের মতই, আপনার অনাৰ্য্য অভিমান জন্মিবে।

বৃদ্ধের দেহে দেহে কালের নিষ্ঠুর ক্ষতচিহ্ন, অসংখ্য ঘুণাক্ষর, হিজিবিজি। মনে হয়, এ-দেহে পাপ অথবা পুণ্য, কিছুই করিবার যোগ্যতা নাই। বিশুষ্ক চৰ্ম্মের আবরণে কঙ্কালসমান মুখমণ্ডল–এখানে, কপালে চন্দন প্রলেপ অধিকন্তু বীভৎসতা হানিয়াছে। ভাববর্ণহীন চক্ষুদ্বয় কালান্তরে আপনি নিমীলিত হয়, পুনৰ্ব্বার কিসের আশায় খুলিয়া যায়। অব্যক্তের লীলা-সহচরী মাতা, কোন মাতা এ-দেহ হইতে বারেক সৃষ্টির বীজ সঞ্চয় করিয়া আপনার সঙ্গোপনে রাখিবেন কে জানে!

বৃদ্ধের ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছিন্ন এবং এই অপরিসর ফাটলে বিন্দু বিন্দু গঙ্গোদক পড়িতেছে, এক একটি বিন্দু। কুঞ্চিত ওষ্ঠে পড়িয়া চমকাইয়া টলিয়া স্থির হয়, পরক্ষণেই অতর্কিতে কোনরূপে মুখগহ্বরে প্রবেশ করে; কোনটি বা, কীট-পতঙ্গ যেমত, জীবন লাভ করিয়া চিবুকের অঙ্কুরিত দাড়িমধ্য দিয়া পথ পায়, নামিয়া যায়। এই সঙ্গে বিলম্বিত লয়ে ‘গঙ্গা-নারায়ণ-ব্ৰহ্ম বলো’র দুঃসহ নিপীড়িত মর্মান্তিক ভৌতিক ধ্বনিবিস্তার উত্থিত হইতেছে। তবুও সীতারাম প্রৌঢ়শিলার মতই অনড়, গঙ্গা-নারায়ণ-ব্ৰহ্ম বলিবার। কোন ধৈৰ্য্য তাঁহার আয়ত্তের মধ্যে ছিল না।

শিয়রের নিকটে কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ, কণ্ঠলগ্ন চেলীতে নারায়ণ শিলা, অত্যন্ত সন্তর্পণে কুশী হইতে গঙ্গাজল (চরণামৃত) বৃদ্ধের ওষ্ঠে ঢালিতেছেন। সীতারামের মস্তক তাঁহারই জ্যেষ্ঠপুত্র বলরামের উরু-উপরে ন্যস্ত। দক্ষিণে কনিষ্ঠ পুত্র হরেরাম। ইহারা সকলেই বৃদ্ধের আত্মার সদগতি নিমিত্ত ‘গঙ্গা-নারায়ণ-ব্রহ্ম’ পদটি আবৃত্তি করিতে যত্নবান। হরেরাম ঠোঁট কম্পিত করিতেছিল, ঝিমাইতেছিল, এবং মাঝে-মাঝে চক্ষুদুইটি বড় করত আপনাকে সজাগ করিয়া আবৃত্তির সুরের সহিত কণ্ঠস্বর মিলাইতেছিল।

মধ্যে, একপার্শ্বে, কবিরাজ বিহারীনাথ হাতের নাড়ী টিপিয়া অনন্য মনে বৃদ্ধের মুখপানে চাহিয়া আছেন। তাঁহার স্পর্শের মধ্যে নীলাবিসনা এই পৃথিবীর বাঁচার তির্য্যগ সূক্ষ্মগতি এবং তৎসহ সংখ্যাবাচক একের প্রথম উপলব্ধি ছিল। কবিরাজের পিছনেই একজন সৰ্বাঙ্গ চাঁদরে আবৃত করিয়া, অথচ মুখটুকু খোলা, দুলিয়া দুলিয়া গীতাপাঠ করিতেছে। লোকটির সম্মুখে পুঁথি, কিন্তু পুঁথি দেখিবার আলো নাই, প্রয়োজনও নাই একারণে যে লোকটির গীতা কণ্ঠস্থ। কখনও বা তাহার ঘুম বিজড়িত স্বরে শ্লোক পরম্পরা ব্যাখ্যাও শুনা যায় যথা “কৌমার যৌবন কিছুই স্থির নয়, আত্মার হেতু নাই, মৃত্যু নাই–আশ্চৰ্য, কেহই আমরা থাকিব না, আমরা অমৃতে যাইব…” সমস্ত কিছুই একসঙ্গে লোকটি বলিতে চাহে।

এবম্বিধ পাঠ, মরণোন্মুখ সীতারাম ব্যতীত আর আর যাঁহারা উপস্থিত তাঁহাদের মনে স্বতঃই নৈরাশ্যের সঞ্চার করিতেছিল। এই পরিবেশকে, গীতা ব্যাখ্যার গোঙানি ছাড়াও, এইক্ষণে অধিকতর ভয়ঙ্কর রহস্যময় করিয়াছিল নিকটবর্ত্তী চিতা নিৰ্বাপিত করার উদ্দেশ্যে জল নিক্ষেপের ফলে হস্ হস্ শব্দ, তৎসহ অনর্গল ধূমরাশি, যাহা বিচিত্র আকারে কুণ্ডলী সৃষ্টি করত এক এক সময়ে ইহাদের অতিক্রম। করিয়া অন্তর্হিত হইতেছিল। এবং অস্বস্তিকর নরবসার গন্ধ এখানে উদ্দাম। উপস্থিত সকলে, প্রতীয়মান সমস্ত কিছুর মধ্যে ভয়ঙ্কর চিরসত্যটি দেখিতে পাইতেছিল। কীৰ্ত্তনীয়ারা, তাহারা হতাশার চোখ দিয়া একটি গীত গাহিতেছিল। উপস্থিত সকলে মন দিয়া অনেক গীত শুনিতেছিল।

সীতারাম ও নিকটবর্ত্তী সকলকে পরিক্রমণ করিয়া একটি আধো-ঘুমন্ত কীৰ্ত্তনের দল মণ্ডলাকারে ঘুরিতেছে। দলটি ইহাদের পরিক্রমণ করিতে গঙ্গার উপর দিয়া যাইতে বাধ্য হইয়াছিল, যেহেতু সীতারামের পদদ্বয় গঙ্গা স্পর্শ করিয়া আছে। কীৰ্ত্তনের দল শ্রান্ত, তাহারা উৎসাহহীন, তাহারা ক্ষুধার্ত, তাহারা শিথিল গতিতে মনে হয় যেমন বা পলাইতেছে, তাহাদের নৌকার-গাত্রে-লাগা তরঙ্গরাজির। শব্দের মত ভয়প্রদ ভাঙা ভাঙা স্বরে নাম গান স্থানটিতে যথার্থই অন্ধকারের সৃষ্টি করিয়াছিল।

এই গোষ্ঠীর কিছু দূরে; জ্যোতিষী অনন্তহরি উবু হইয়া বসিয়া তামাক খাইতেছিলেন, তাঁহার মন। তখন সৌরজগতে বিচরণ করিতেছে, বিরাট অনৈসর্গিক জ্যোতির্মণ্ডলে তিনি যেন হারাইয়া গিয়াছেন। যেমন বা অশরীর হইয়া গিয়াছেন। তাঁহার হুঁকার গম্ভীর শব্দ এবং কভু বা হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া বিড় বিড় করিয়া কথা বলা, তাঁহারই পার্শ্বস্থিত অন্য এক ব্যক্তিকে ক্রমাগতই রোমাঞ্চিত করিতেছিল, এই ব্যক্তি লক্ষ্মীনারায়ণ। জ্যোতিষী অনন্তহরির ব্যবহারের কিঞ্চিত্র ইতর-বিশেষে লক্ষ্মীনারায়ণের ধৈর্যচ্যুতি এবং অতি উগ্র-আগ্রহের কারণ হইতেছিল, লক্ষ্মীনারায়ণ যেন বা শীতকাতর; তিনি বারম্বার উদগ্রীব হইয়া অনন্তহরির নিকটে মুখ সরাইয়া আনিতেছিলেন, এ কারণে যে, তাঁহার মনে হইতেছিল জ্যোতিষী তাঁহাকেই লক্ষ্য করিয়া কিছু বা বলিতেছেন; ইহাই সত্য যে তিনি কিছু শুনিবার আশায় বসিয়াছিলেন। এই স্থানে কাহার কণ্ঠস্বর আসিতেছিল, “হিঃ ইরে ডরে গেলে হে, হারে মন নিছুনি জান না গো, উ ঠাঁই মরণ নাই গো, লাও গো আঁট করি কলসটা ধর বটে লীচু করি হে, একঠাঁই শান্তি দাও হে”–এ স্বরগভীরে এতাবৎ মিলন অভিলাষী হরিণীর কণ্ঠ ছিল। এ স্বর প্রাণময়, কেননা শান্তি দাও’ কথাটি উচ্চারিত হয়।

একটি চিতা সাজান হইয়াছে, উপরে বর্তমান সত্য যেন বা স্মৃতি হইয়া দেখা দেয়, যেখানে নক্ষত্র নাই। চিতার নিকটে বসিয়া একটি ক্রন্দনরত বালক, সে লাউডগা-রুগ্ন সুন্দর, পিণ্ড হাতে করিয়া বসিয়া আছে, তথাপি তাহার ক্রন্দনে আকাশ আঁকা ছিল, তখনও লহরীতত্ত্ব ছিল। বালকের সম্মুখেই ব্রাহ্মণ। তাঁহার মুখে ভয়জনিত ক্লীব অবিশ্বাস; কিন্তু অনর্গল শ্লোক ধারা উৎসারিত হয়, এবং মাঝে মাঝে অঙ্গুলীস্থিত কুশ-অঙ্গুরীয় যথাযথ করার ইচ্ছাও দেখা যায়, মনে হয় যেন বা এই বন্ধনে সমস্ত কিছু বাঁধা আছে। এই নূতন আয়োজনের পাশেই আর একটি চিতা প্রায় নির্বাপিত। যেখান হইতে উক্ত কণ্ঠস্বর আসিতেছিল।

ক্রমাগত জল দেওয়ার ফলে এই চিতা প্রায় নির্বাপিত হইয়া আসিতেছে; এই স্থান হইতে গঙ্গাজল পর্য্যন্ত অনেক জন লোক দণ্ডায়মান : যে ব্যক্তি গঙ্গায় দাঁড়াইয়া, সে কলস পূর্ণ করিতেছে–তাহার হাত হইতে পূর্ণ কলস হস্তান্তরিত হইয়া আসিয়া এই চিতায় নিঃশেষিত হয়। ভস্মরাশি বিরক্ত হইয়া উঠে। কিন্তু প্রতিবারই দেখা যায় দণ্ডায়মান লোকগুলি এ কার্য সম্পাদন করিতে, কলসটি হাতে লইয়া, কেমন যেন বা ভীত। পয়ারবিলাসী মন উধাও, পা কাঁপিয়া উঠে। সকলেই নিৰ্বাক, সকলেই এই ত গাছ নড়ে, এই ত অন্য সকলে রহিয়াছে–এই কথা ভাবিয়া সমস্ত কিছুকে কলস প্রমুখাৎ যুত করিতে চাহে, তত্রাচ কলস প্রায় হস্তচ্যুত হয়। সকলেরই কলস বাঁচাইতে দেহ বাঁকিয়াছিল।

কেবলমাত্র বৈজু চাঁড়াল, রূপরসগন্ধের সততা মানিয়া নির্ভীক, দাঁড়াইয়া আছে, সে তাহার দুঃসাহসিক মোচে দৃপ্ত চাড়া দিয়া অদ্ভুত করুণাবাচক হাসি হাসিয়া অনেক কথাই বলিতেছিল, তাহার চোখে ঘুম নাই। কহিল, “আই গো, হুঁশিয়ার গো খুব হে, মনকে আঁচ ঠেল, হিঃ গতর খুব খাড়া রাখ মন” পুনৰ্ব্বার দু’এক কদম নিকটে আসিয়া বলিল, “ওগো মশাই গো, উটি কলসটি, তোমার হৃদয় গো, আবার উটি তোমার স্মৃতি বটে, দেখ যেন ভাঙেনি, উটি ভেঙে দিয়ে যাবে চিতায় হে” বলিয়া মাথাটি দিয়া এখানকার আলোকে ঈষৎ নাড়া দিল।

বৈজু কারণসলিলে একটি ক্ষুদ্রপল্লবিত শাখাবৎ, দূরে কোথাও দ্বীপ প্রচ্ছন্ন হইয়া আছে, সুতরাং তার প্রতি সকলের আকর্ষণ অহেতুক নহে। তথাপি বৈজুর কথায় জনগণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিতেছিল, শুধু। কথা কেন, তাহার তুচ্ছ হেরফের গম্ভীর হইয়া দেখা দেয়, যেহেতু তাহার দেহকে অবলম্বন করিয়া একটি চাকচিক্য যেন স্বস্তিলাভ করিয়াছে। জনগণের একজন বৈজুর কথার উত্তরে, কেবলমাত্র নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধির কারণেই বলিল, ‘এতেক কথা শিখালে কে বটে হে!

বৈজু-আশ্রিত চাকচিক্য দুলিয়া উঠিল! বৈজু চাঁড়াল হাস্য সম্বরণ করিতে পারিল না। ভোরের হাসিতে যে ভাই-ভাই ভাবটুকু থাকে, সেইটুকু এ-হাসিতেও ছিল। কিন্তু বৈজু একটু বেশী রকমে অভিমানী, সে ‘নীচ কুলোব, পাছে তাহার হাস্যধ্বনি কাহারও দেহে লাগে সে কারণে সে উৰ্দ্ধ আকাশে হাস্যধ্বনি ছড়াইয়া দিয়া কহিল, “কেনে গো বাবুমশায়, এখনও (!) অবাক কি হেতুক, তোমার কি মনে লয়!” বলিয়া আয়ত নয়নে ঈষৎ বিস্ময় হানিয়া তাহার দিকে চাহিল।

বৈজুর হাস্যধ্বনি শ্রবণে লোকটি ভয়ার্ত হয়, অত্যধিক অস্বস্তি সহকারে তাহার প্রতি সকলেই তাকাইয়াছিল, কারণ এরূপ হাস্য স্থানকালপাত্র ভেদে যারপরনাই অসংযত বলিয়া মনে হয়। অন্যপক্ষে বৈজু চাঁড়াল বুঝিল, লোকটি এক্ষেত্রে ছায়াবৎ, কোন স্বাভাবিকতা নাই, এবং তাহার যাহা কিছু বোধ ছিল, তাহার কিছুটা শবদাহের সহিত পুড়িয়া ছাই হইয়া গিয়াছে। সুতরাং সে এই শ্মশানভূমি নির্দ্দেশ করিয়া কহিল, “তুমি কি ভাব মনে রাত্তদিন শুধু জোড় খায় ই ঠাঁই।” এই উত্তরে ভীত লোকেরা ধরা পড়িয়া গেল। “ই যে মহাটোল বটেক, কত ডাগর ডাগর পণ্ডিত আচাজ্জি ই ঠেন পাঠ দেয় গো, কত যুক্তি আঁটে, আমি শুনি …হ্যাঁ…আমি শুনলাম বটে, তত্ত্বকথা বেজায় জানি হে, আত্মার সাকিম কুত্থাকে তার থানা কোথা; আমি যে তার সরিক!” বলিয়া আনন্দে ডানহাতখানি বাঁ হাতের এবং বাঁ হাতখানি ডানহাতের পেশীকে চাপড়াইল। ইহার কিঞ্চিৎ পরে অত্যন্ত গোপন খবর দিবার মত করিয়া বলিল, “কলস? সে যে হ্রিদয়! ইটা যে স্মৃতি, সিকথা গোবিন্দ আচাজ্জি বললে, মড়া পুড়াতে এসে বললে, বৈজু এ-ইটা ঘটাকাশ, ভাঙলেই পটাকাশে মিলবে বটে, হিসাব মিলে যাবে, আমরা ভাবি কলসটা স্মৃতি… হে হে অমনভাবে না…না…গো বাবু মশায়।”

বৈজুর কথার মধ্যেই নিৰ্বাপিত চিতার নিকটে এক কলস জল রাখা হইয়াছিল, শ্মশান যাত্রীদের একজন এই কলসটিকে ভাঙিয়া, এই স্থান পরিত্যাগ করত চলিয়া যাইবে; যে জন ভাঙিবে সে বাঁশটিকে ঠিক যুত করিয়া ধরে নাই দেখিয়াই, বৈজু তাহার কথা থামাইয়া হাঁ-হাঁ করিয়া ছুটিয়া আসিল। পাছে চণ্ডালের ছোঁয়া লাগে তাই সকলেই যথাসম্ভব সরিয়া গেল। বৈজু আপনাকে সামলাইয়া বলিল, “খুব ডাগর জোর ধর হে বটে, এ হে বাবু…উ তো কলসী–তোমার মাগ লয়।” এবার মুচকি হাসিয়া কহিল, “আর কেনই বা তা লয়, হ্যাঁ জোর করি ধর, অন্যদিকে চাও, লাও মার শালা জোর গুঁতো, যাক শালা ঘটাকাশ পটাকাশে।”

রুদ্ধশ্বাস-স্তব্ধতা দেখা দিল, বৈজু পুনরায় বলিল, “ভাঙার শব্দ হলে ইদিক পানে আর চাহিবে না গো, শুধু হরি বোল দিবে…হরি বোল।”

এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বিকট ভাঙার শব্দ হইল, শূন্যতা বাড়িল। এই সঙ্গে অযুত হরিধ্বনি শোনা। গেল, বৈজু তাহার কথা কয়েকটি বলিয়া মুখোনি অর্ধ-উন্মুক্ত করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। সেও শব্দ শোনা মাত্র বলিয়া উঠিল, “সাবাস সাবাস” এবং ইহার ক্ষণেক পরেই, সে চকিত হইয়া বলিয়া ছিল, “হে রে রে রে…ই দিকে চেওনা…সোজা ঘরকে যাও…।”

তাহারা সকলেই ত্বরিত পদে, শ্মশান পরিত্যাগ করিয়া সুউচ্চ ভেড়ীপথে উঠিল, অদৃশ্য হইয়া গেল। ইহারা সকলেই–যে ইতিপূৰ্ব্বে ছিল–তাহার প্রমাণস্বরূপ বৃক্ষাদির পাতা কম্পিত হইতে লাগিল; কেননা তাহারা ভেড়ীপথ হইতে নামিবার কালে বৃক্ষের ডাল আকর্ষণ করত নামিয়াছিল।

কম্পমান পত্রাদির দিকে বৈজু কিয়ৎকাল চাহিয়া রহিল, কাহাকেও সে দেখিতে পায় নাই, সহসা নিৰ্বাপিত চিতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, এখন সে তাহার পৌরুষে দুর্ধর্ষ ঘাড়খানি ঘুরাইয়া দেখিল ছোট ছোট প্রজ্বলিত পাটকাঠির টুকরা মাটিতে পতিত হইয়া ক্রমে নিভিতেছে, এবং তৎসহ গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ উৎসারিত হয়, “যে তোমার শোক মোহ এ সকল গেল” (শুধু মাত্র প্রেম রহিল সম্ভবত)। বৈজুনাথ, চিতাপ্রদক্ষিণকারী বালকের হস্তধৃত মুখাগ্নিনিমিত্ত প্রজ্বলিত পাটকাঠির আলোকে ভাঙা কলসের অনেক টুকরার মধ্যে পুনরায় কি যেন অনুসন্ধান করিতে ব্যস্ত হইল।

দুই একটি সেই ভাঙা কলসের টুকরা পা দিয়া সরাইতেই, একটি রৌপ্যখণ্ড তাহার চোখে পড়িল, ইহাই সে খুঁজিতেছিল। সত্বর রৌপ্যখণ্ডটি কুড়াইয়া লইয়া মহাউল্লাসে এক কদম, বগল বাজাইয়া, নৃত্য করিতে গিয়া সে একীভূত স্থির!

ক্কচিৎ কখনও সেও স্থির হয়!

সমীপস্থ চিস্থিত মৃতের কণ্ঠলগ্ন ফুলমালা জ্বলিতেছে, আর অন্য পাশে, বালকের বিহ্বল বিমূঢ় সদ্য শুনছিন্ন অসহায় মুখমণ্ডল আর ইতিমধ্যেই অগ্নিশিখা, এবং বালকের সম্মুখে ঘূর্ণিহাওয়া যেমত আবর্তিত হয় তদ্রূপ সমস্ত সৃষ্টি ঘুরিয়া উঠিল। পরক্ষণেই, বাবা গো’ বলিয়াই বহ্নিমান চিতার দিকে সে ছুটিতে উদ্যত হইল।

বৈজুনাথ অন্যমনস্ক, তথাপি আপনার দায়িত্বজ্ঞানে হাঁ-হাঁ করিয়া বাধা প্রদান করিতে গিয়াছিল। বালকটির বয়সী সঙ্গীরা বালককে ধরিয়া ফেলিল; তবুও এখনও, বালক স্বীয় আবেগ সম্বরণ করিতে সমর্থ হয় নাই। একথা সত্য যে, মৃত্যুর গভীরতায়, এক মুহূর্তের জন্য চন্দ্র সূৰ্য্যকে হারাইবার মত স্থিরতা তাহার নাই। যদিচ, সবুজতা তাহার কাছে নিশুতি রাত্রের ঝিঁঝি স্বর এমত, যদিও আপনার নিঃশ্বাস পরিদৃশ্যমান আলোকে আড়াল করিয়াছিল, যদিও স্পর্শবোধ ভোরের পাখীর কণ্ঠস্বরে উধাও।

বয়সী সঙ্গীরা তাহাকে, এমত মনে হয়, যেন বা দাঁত দিয়া টানিয়া ধরিয়া আছে। সুতরাং সান্ত্বনা দিবার ভাষা থাকিলেও উপায় ছিল না। সকলেরই জিহ্বা কটু কোন স্বাদে লিপ্ত, মুখ বিকৃত। তথাপি শুধুমাত্র একজনা কহিল, “ছিঃ পাগল” একথা সংস্কারবশতঃই সে বলে।

এই ছোট মন্তব্যটি বালকের সম্বিৎ ফিরাইয়া দিল; চিন্তাপ্রসূত, উখিত ধূম্রজালের দিকে তাকাইয়া, অন্যেরা ভীতভাবে মাথা নাড়িল। বৈজু বালকের দিকে ব্যাকুলভাবে চাহিয়া ধীরে ধীরে বলিল, “হা রে ননু, খোঁকা গো, মন তোমার পুঁড়ে” এবং পরক্ষণেই অতিশয় কোমল কণ্ঠে উচ্চারণ করিল, “দেহ চিতায় মন পুঁড়ে গো” এ কথার আবৃত্তির রীতিতে মনে হইল, সে কোন এক গীতের প্রথম কলি উদ্ধৃত করিল।

সমবেত জনমণ্ডলী, অল্পক্ষণের জন্য ক্ষিতিতত্ত্বের অনিত্যতা হইতে মন ফিরাইয়া তাহার দিকে আগ্রহভরে দেখিতে লাগিল। ইহাদের সকলেরই আশা, সে কিছু বলুক, কেননা তাহাদের তালু শুকাইয়াছে, কেননা মনে নানাবিধ হাড় স্তূপীকৃত হইয়াছে, কেননা তাহারা অলৌকিক পথশ্রমে ক্লান্ত।

বৈজু পুনৰ্ব্বার বলিল, “কেঁদোনি খোঁকা, একটি গল্প শুন–যে দিলে সেই নিলে, তুমাকে ভাল’র মধ্যে লোভী করে দিলে, কি করবে হে”–তাহার গলার স্বরে সহজ ঠিকানা ছিল, ফলে বালক ডুকরাইয়া কাঁদিয়া ক্ষণিক জিহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ বুলাইয়া, একহাতে চোখ কচলাইতে কচলাইতে আপনার পিতার দেহের দিকে চাহিয়াছিল। এবং ক্ষণেক পরেই বৈজুনাথের বিষাদক্লিষ্ট স্মিতহাস্যময় মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।

অন্যপক্ষে বৈজু আপনার কণ্ঠকে ঈষৎ সরস করিবার মানসে একটি ঢোক গিলিয়া নিতান্ত মেটে হইবার চেষ্টা করে। কিন্তু বালকের লাল চক্ষুদ্বয়–যেখানে কোন ভোর নাই, তাহাকে বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। সে বিমূঢ়, কোনরূপে আপনার লাঠিখানি তুলিয়া লইয়া মুখোনি নীচু করিল, হস্তধৃত লাঠিখানি সে মৃদু মৃদু মাটিতে ঠুকিতেছিল। একবার কি এক কথা বলিতে গিয়া মুখ তুলিয়াই তৎক্ষণাৎ নামাইয়া অতি ধীরে বলিল, “কেঁদনি গো, খোঁকা গো” এই কথার পর একটি বিদেশী নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল, এবং তদনন্তর আপনার রোমশ বক্ষে হাত বুলাইতে বুলাইতে সে কহিল, “ওগো বাবু ইঠাঁই একো জীব আছে হে, ধুক ধুক ধুক ধুক করে, আমার যেটা সেটা লোহার” ইহার পর আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল, “লোহারই বা কেনে, দধীচির অস্তি দিই গড়া, পালোয়ান পালোয়ান বাজ দিই গড়া, গড়া হঁই গেল? আকন্দ ফুল এমন কি, আমি দেখলে চিনতে লারবো, টুকুন ভাত গরাসে মনে লেয় আকাশ খাইছি। তবু তোমার চোখের জলের ভূতে আমাকে পেল।…হারে বাবু মানুষ, দেখনা কেনে গ্রামে গাঁয়কে হলুদ নিশান দিইছে, ভারী গরম (কলেরা) হ’লতার উপর বলে কার্তিক মাস যমের দক্ষিণ দুয়ার খোলা, কত থানা মুলুক ঠেন মড়া এল, এই দেখনা কেনে দড়িতে গিটদি…” বলিয়া কোমরের দড়ি দেখাইয়া পুনরায় কহিল, “সব শালা গরমের দেনাদার প্রজাখাতক, কত যে অনাথ হইল তা পাইমাপে আসে না খোঁকা, তাদের দেখলে আর কানতিসনা গো…উই যে শালা উপরে, যে শালা সবার ভিতরে, তার কলম মানতে হবেক…সে বড় কঠিন প্রাণ গো, কোন বোধ নাই, কান নাই, হাত নাই…বিকার নাই–এতবড় সংসারটা…চালায় হে.আইগো কথা শুনছো তোমরা…মড়ার হাত যে…মাটি ছুঁতে চায়, মাটি হা হা মাংটি…”

এইদৃশ্যে তাহারা সকলে যারপরনাই তটস্থ হয়; কিন্তু দক্ষতা এবং দূরত্ব বিচার তখনও পরিচ্ছন্নভাবে আসে নাই, তখনও তাহারা ললাটে করাঘাত-সুখে অলস। ফলে বৈজুর সাবধান বাণী কাজে দেয় নাই।

“হে হে গো, বাবু গো, হাতকে ঠেকা দাও ঠেকা দাও, না হলে জীবন বড় লষ্ট করবেক হে” এ কথার পর খানিক দ্রুত অগ্রসর হইয়া অঙ্গুলী নির্দ্দেশ করিয়া বৈজুনাথ বলিয়াছিল।

হাতটিকে তুলিবার জন্য, একজন একটি বাঁশ দিয়া তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিল, মৃত সাপের মত শ্লথ এ হস্ত-সৌহার্দ্য অভিমানী, এ হাতখানি ব্যগ্রতার স্থির নশ্বর রূপ! ইদানীং পুনৰ্ব্বার অগ্নিতে সে মনোরমত্ব ঠেলিয়া দেওয়া হয়, লাখ প্রবাদবচন এবং দিগদর্শন পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই হইবে।

বালক এ হেন দৃশ্য যে সহিতে পারে নাই, তাহা বৈজুনাথের চোখ এড়াইল না। বালক দৃঢ় করিয়া আপনকার নয়নযুগল মুদ্রিত করিল, আপনকার মুষ্টির মধ্যে কাহার মুষ্টি প্রবলভাবে ধরিতে চেষ্টা করিতেছিল। তাহার দেহ প্রদীপের শিখাবৎ।

বালকের স্বভাব বৈজুনাথকে আমোদের সন্ধান দিল। সে হাসিয়া উঠিল–আর অন্ধকার নাই, ব্যাঘ্র দীন হয়। সে কহিল, “লাও গো মানুষ বাবু, ভয়ে না ভালবাসায় চোখ বুজলে, এমন যেন শত্রুর না হয় বলে সবাই শুরু করে, অথচক এমনি হয়।”

আর আর সকলেই তাহার ইত্যাকার বাক্যবাণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সকলেই তাহাকে শক্ত করিয়া দেখিল, ইহাদের দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা ছিল। বৈজুনাথ বুঝিল, মুখ দিয়া অনেকটা হাঁফ ছাড়িয়া কহিল, “হে গো, আমার কথা ধর না হে, কথায় আমার আঁকসাট নাই, আমি জাতচাঁড়াল গো, আমি তারাগুলা জলে দেখি আমার মাস শেয়াল শকুনে খায় না গো!”

এইটুকু মাত্র পদবিন্যাসে সকলেই মোহগ্রস্ত, এ কারণে যে তাহার বাক্যসমূহে জীবনের ক্লান্তি ছিল।

“মড়া দেখি দেখি আমি মাটি হইছি গো, আমি তো শব গো, বহুদিন মরে আছি হে…লাও বাবু মশায়, তোমাদেরই ই চিতা ত এখন গোড়া গাঁথছে, খোঁকাকে লিয়ে উ ঠাঁই বস গা, মনের কথা বল গা উ ঠাঁই…” বলিয়া বৈজু গঙ্গার দিকে অগ্রসর হইল।

.

সকলেই চলমান বৈজুনাথকে লক্ষ্য করিল, তাহার কোথায় যেন রঙের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস আছে–সে নিঃশ্বাস নেয়, না নিঃশ্বাস তাহাকেই নেয়–এ প্রশ্ন তাহাদের মনে উদয় হয়।

ইদানীং গঙ্গা, হাস্যময়ী, বহু বহুদূরে বজ্রমুষ্টি রক্তিম, বায়ুচিহ্ন–কোদাল কোপান যেমত ঢেউয়ে ঢেউয়ে ফুলমৃদু জাম রঙ। ক্রমাগতই জলজ পানা ভাসিয়া যাইতেছে, নিম্ন আকাশে ডানার হিলমিল, শূন্যতাকে অপহরণ করিতে আপনার সত্তা হারাইতেছে।

বৈজুনাথ গঙ্গার কিনারে দাঁড়াইয়া পৃথিবীর প্রত্যহের সূক্ষ্মতা দেখিল, বিস্মিত হইল, বার বার ডাকিল, “মা মা, মা গো।” তাহার কণ্ঠস্বরে শিশুহস্তের ছবি মুদ্রিত ছিল। ইহার পর শ্রদ্ধাভরে পুনৰ্ব্বার আপনার মস্তকে গঙ্গোদক লইয়া ছিটাইবার কালে মাতৃনাম উচ্চারণ করিল। মুখ ধুইল এবং এই সময়ে ঘাড় ফিরাইয়া কহিল, “ঠাকুর, বুড়ো কৰ্ত্তার কি দশা গো, গোণ ত পার করলেক, হে হে।”

যেহেতু এখন ফরসা হইয়াছে, ফলে এখন অক্ষর চিনা যায়, সংখ্যা স্বাভাবিক হয়। লক্ষ্মীনারায়ণ জ্যোতিষী অনন্তহরির সম্মুখে লম্বমান কোষ্ঠীপত্ৰ খুলিয়া ধরিয়া আছেন, কোষ্ঠী যেমত আয়না। জ্যোতিষী অন্যমনে বিচার করিয়া, কিছু পরে একটি কাঠি দিয়া নরম বেলাতটে কি লিখিতে লিখিতে অনেকখানি দূরে সরিয়া গিয়াছিলেন। এখন বৈজুনাথের প্রশ্নে একবার ফিরিয়া তাকাইলেন মাত্র, পরক্ষণেই লক্ষ্মীনারায়ণের দিকে চাহিয়া অন্যমনস্ক হইয়া হতবাক হইয়া রহিলেন।

লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহার বিচারের ফলাফল শুনিবার আশায় উদগ্রীব হইয়াছিলেন; এক্ষণে জ্যোতিষীকে এইভাবে তাকাইয়া থাকিতে দেখিয়া, যারপরনাই অস্বস্তি বোধ করত সহজ হইবার ভঙ্গী করিলেন। ইহাতে তাঁহার, লক্ষ্মীনারায়ণের, দেহ যেন বিকলাঙ্গ হইল। একদা তিনি গঙ্গার দিকে, যেখানে অন্যমনা হইবার অব্যর্থ সুযোগ স্রোতরূপে বৰ্ত্তমান, অন্যবার পরিক্রমণকারী, বৃত্তাকারে ক্রমাগতই, ভ্রাম্যমাণ কৃষ্ণকায় কীৰ্ত্তনের দলকে দেখিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণকে দেখিলে সত্যই মায়া হয়, কালের প্রতি চোখমুখে কোথাও সম্মানের লেশমাত্র উল্লেখ নাই। কাহাদের জিহ্বার আস্বাদনের, তৃপ্তির শব্দ—চক্‌চক্‌ শব্দ তিনি বাতাসে বাতাসে শুনিতে পান। এই শব্দ তাঁহাকে একীভূত করে। অতিকায় হিম জলজ দুর্ভাবনায় তিনি মূর্খ। এখন, কোনক্রমে আপনার একটি পা, মাটি হইতে উঠাইয়া, বাঁকাইয়া, ছড়াইয়া, পক্ষীরা যেমত করে, কিছুটা অবশতা দুর করত পুনরায় জ্যোতিষীর প্রতি কহিলেন, “বৈজু চাঁড়াল বেটা কি বলছে গো” বলিয়া আপনার মুখ দিয়া বৈজুকে নির্দ্দেশ করিলেন, নিজের মনোভাব যাহাতে প্রচ্ছন্ন থাকে সে কারণে তিনি একথা ঈষৎ হেনস্থা সহকারেই বলিয়াছিলেন। তথাপি তাঁহার বাক্যসকল কিছু পরিমাণ আর্দ্র।

জ্যোতিষী অনন্তহরির স্থির মুখোনি কঠিন হইয়া উঠিল, কহিলেন, “আঃ, চুপ কর ত।” ইহার মুখমণ্ডলের কঠিনতা যেন অগ্রবর্ত্তী অন্ধকারকে চাপিয়া ধরিল।

লক্ষ্মীনারায়ণ ইহার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না, তাঁহার দেহে এই বিরক্ত-উক্তি পাথরের মত আঘাত করে। ফলে মাথাটি নড়িয়া উঠিল। তিনি একটি শতছিদ্র সম্রম দিয়া নিজেকে ঢাকিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন এবং এখন সত্যই, মাত্র এখনই তাঁহার গাত্র সকালের শুদ্ধ শীতল হাওয়া স্পর্শ করিল।

বৈজুনাথ একদা স্রোত, অন্যপক্ষে শ্মশানভূমি দেখিয়াছিল। সে গঙ্গা হইতে উঠিয়া, নিৰ্বাপিত চিতা অভিমুখে গিয়া তত্রস্থ গহুর হইতে একটি কাঠকয়লা তুলিয়া লইতে তাহার দেহ অসম্ভব বাঁকিয়াচুরিয়া গিয়াছে, এখন ছাই কালোর উপরে দেখা যায় ভূমিস্পর্শরোদে তাহার পিঠ লাল, সে একটি অনিবাৰ্য্যরূপে প্রতীয়মান হইল; মুহূর্তের মধ্যেই একটি কাঠকয়লা বাছিয়া দাঁত মাজিতে মাজিতে বালকটির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল; বালকের চোখে জল আছে তাহা সত্ত্বেও, তাহার, বৈজুনাথের, রীতিনীতি দেখিয়া বিস্ময়ও বর্তমান এবং বালকের সঙ্গীদল এরূপ কাৰ্যে বিশেষ আশ্চর্যান্বিত হইয়া মুখ বিকৃত করিয়াছিল, নিশ্চয়ই তাহাদের মনে হয়, যে সে মানুষের ভীতিজনিত শ্রদ্ধাকে অবমানিত এবং ভালমন্দের সাধারণ রৌদ্রবহুল বিচারকে নষ্ট করিতেছে। ইহারা যেন বলিতে চাহে, এ কি কর গো?

বৈজুনাথ হৃদ্বয় কুঁচকাইয়া তাহাদের বিস্ময়কে সকালের প্রথম সূর্যে শুকাইয়া লইল, কহিল, “কি, আমার গতিক দেখে বেজার নাকি!”

সম্মুখের লোকটি এখনও গভীরভাবে তাহার প্রতি চাহিয়া আছে, অন্যান্য সকলে বিদ্রুপের স্মিতহাস্য রেখা আপন আপন শুষ্ক ওষ্ঠে মিলাইয়া, গম্ভীর। কেননা বৈজু এখনও ছায়া, কেননা বৈজু এখনও ব্যতিক্রম, কেননা বৈজু এখনও স্বেচ্ছাচারিতার বেদনাদায়ক নাম।

বৈজু অল্প আয়াসেই অনাদৃত দেহভঙ্গিমায় ইতোমধ্যের কবিপ্রসিদ্ধ সেই মোহকে চূর্ণ করিয়া না দিয়া সহজ কণ্ঠে কহিল, কেননা সে রঞ্জিত স্তব্ধতার সহিত অমোঘ শুন্যতার, শূন্যতা বোধের পার্থক্য, পার্থক্যের মধ্যে যে যুক্তিপূর্ণ স্বাভাবিকতা তাহা সে অবলীলাক্রমেই বুঝিত। বলিল, “কেইবা বেজার গো, এ আগা দেখে তুমিও সন্ন্যাসী হও না, আমি ত বেজার নই, মনে পড়ে বকাধাম্মিকের পালা? তুমিও আবার নাচতে নাচতে লাঙল ধরবে, ছেলে দুখালে, বউকে বলবে, মাই দে না কেনে? হা হা তুমি বলবে, ‘হারে এত ডালপালা, দাঁত মাজতে একোটা ভাঙলে পাত্তিস রে’ কিন্তু ঘাটকে মড়া থাকলে ছেড়ে যাবার হুকুম নাই গো।”–এ কথার মধ্যে স্পষ্টত দেখা গেল, সে রক্তে না হৃদয়ে অথবা স্মৃতিতে, কোথাও না কোথাও স্থির হইয়াছে।

“তাই বলে…?” লোকটি বলিয়াছিল।

ইহাতে সত্যই তাহাকে পীড়া দিয়াছিল। সে নিশ্চয়ই দুঃখী, ক্ষণেকেই ইতস্ততোর মধ্যে আপনাকে দেখিতে পায়; বুঝিল পৃথিবীটা তাহার আপন নয়, আপনার নহে; এ কথায় সে যেমত বা ঈষৎ স্ফীত, সে কারণে তাহার অধিকারের চারিদিকে পলকে, ঝটিতি, আপনাকে সামলাইয়া ভ্রুকুটি সহকারে তাকাইয়া একটি নিঃশ্বাস গ্রহণ করিল, এখানে সকালের গাঙ্গেয় শৈত্যে দ্রবীভূত বাতাস আপনকার চরিত্র, নিঃশ্বাসের কারণে হারাইল না–অন্তরীক্ষে হানা দিয়া ফিরিল। হায়, তাহার কোন দেবতা নাই, যে তাহার সহিত শুইয়া শুইয়া প্রীতিপদ, সুন্দর, সবুজতার, সন্ধ্যার, নক্ষত্রনিচয়ের, তীরদর্শনের, পক্ষিকুলের অবিমৃষ্যকারিতার, মিনতির, রাখালের গল্প সুর সংযোগে সূক্ষ্মতম নিঃশ্বাসের আওয়াজ করিয়া যাইবে। হায় সে বড় একা! বৈজুনাথ কয়লায় কালো তর্জ্জনীটা তুলিয়া উত্তর করিল, “বাবু বলি এক কথা, আচাজ্জিরা (আচাৰ্যরা) সতীদাহে যখন হাঁক তুলে, এয়োরা তোমরা সোনা দাও, স্বগ্যে সোনা ছাড়া কিছুই যায় না, স্বগ্যে যায় না–তা পরে চিতা লিভিয়ে সোনা তুলে তখন…” বলিয়াই বাঁচাল বৈজুনাথ দ্রুতপদে সে-স্থান পরিত্যাগ করিল।

সে এত দ্রুত গতিতে আসিয়াছিল যে আর একটু হইলেই অনন্তহরির অঙ্কের উপর পা পড়িত। লক্ষ্মীনারায়ণের হুমকিতে সে কোনরূপে আপনাকে সামলাইয়া কহিল, “ই গো ঠাকুর, পুণ্যাত্মা বুড়ার দশা কি গো?”

লক্ষ্মীনারায়ণ বলিয়া উঠিল, “হে বেটা চাঁড়াল, তুই বড় জ্বালাস দেখছি…যা বেটা…”

কাঠকয়লালিপ্ত হইলেও মুখোনিতে বোকা অপ্রস্তুতের ভাব লক্ষিত হইল। কাহারও গোণা কয়েকটি নিঃশ্বাসের পথ সে যেমত বা ভুলক্রমে রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল।

এমত সময় অনন্তহরি কহিল, “আর একটু বাঁকি ওকে বল…”

লক্ষ্মীনারায়ণ ভয়মিশ্রিত চোখে ভিখারীর মত কিয়ৎক্ষণ জ্যোতিষীর দিকে চাহিয়া থাকিয়া, আর খানিক বৈজুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আর একটু বাঁকি।”

লক্ষ্মীনারায়ণ আকাশের দিব্যভাবের দিকে চাহিলেন। তাঁহার দেহ যেন গীতার উক্তি, অথবা পুরাণে লিখিত। গ্রহনক্ষত্রের সাক্ষাৎ নাই, তবু সৌরজগতের ভার তাঁহাকে দিকভ্রান্ত করিয়া দিল, রহস্যময় পরিক্রমণ বহুদূর হইতে নামিয়া আসিয়া তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া ইদানীং আবেগ সঞ্চারী; আপনার বদ্ধতাকে লইয়া কে মহা উল্লাসে খেলা আরম্ভ করে; ফলে আপনার ভার অনুমান ও উপলব্ধি করার মধ্যে যে ত্রাসের সঞ্চার অতীব সাধারণ, তাহা তাঁহার হইয়াছিল। এই উপলব্ধি হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত কোন এক সূত্রে হঠাৎ তিনি বলিয়া ফেলিলেন, “আ মর, তু বেটা জাত জন্ম খোয়াবি? সরে দাঁড়া না মরণ!”–ইহা বলিতে লক্ষ্মীনারায়ণ রাগতভাবে স্ত্রীলোকের মত ঢং করিলেন, তাঁহার ব্যবহার অনেকাংশে ভাঁড়ের মতই।

বৈজুনাথ তাঁহার বাক্যে থতমত তূপীকৃত, কেন না বিচারের আঁচড় ইকড়ি ছাড়িয়া বেশ কিছুটা দুরে সে দাঁড়াইয়াছিল, এবং পরে, অতর্কিত কিছুটা দূরে পুনরায় সরিয়া গিয়া বলিল, “বিধান বল?…কাঁহাতক বুড়া মানুষটা হিম খাবে গো, আর মড়াবসার, মড়া পুড়ার গন্ধ শুকবে…বড় পুণ্যাত্মা গো.শুকনা ডালে পাখী দুটো বড় হিমসিম খায়।” বুড়া অর্থে গঙ্গাতীরে আনীত সীতারামকে উদ্দেশ্য করিয়াই, বৈজু এ সকল কথা বলিয়াছিল। তাহার এহেন সরল শেষ উক্তিতে পুরাতন মধুর পত্রের মায়া ছিল; সময় যেখানে শেফালি, সময় যেখানে অল্পবয়সী, সময় যেখানে হস্তীশাবকের ন্যায়…দর্শনের উপমা নহে– সত্যই পদ্মবনে জলকেলী করিতেছে। বৈজু একথা বলে নাই, সে আবৃত্তি করিয়াছিল, রমণীর বস্ত্রাঞ্চল যে বিশেষ মনোভাব প্রকাশের বাক্যরূপ, সেই গভীরতার, বাস্তবতার অনুভবের আস্থার হৃদয়াবেগের আদ্য অক্ষর এখানেও অস্থির, কেননা এই সূত্রে সূক্ষ্ম রেখার তথা সনাতন সৌন্দর্য্যের শুভ্র মাধুর্যের আখ্যানের ইঙ্গিত, প্রাকৃতজনের মঙ্গলজনক ইঙ্গিত সে করিয়াছিল। আঃ সে এক অপূর্ব আখ্যান! তাহা আদি-অন্তহীন উষ্ণতাকে কাব্যময় এবং উপত্যকা হইতে উপত্যকা অন্তরে তাহাকে বহন না করিয়া, যেখানে সুউচ্চ গৈরিক স্বর্ণাভ শীর্ষযুক্ত পৰ্ব্বতের ছায়া চলমান স্রোতধারার উপর বিস্তৃত, তাহারই তীরে স্থিত করত উপলব্ধি করে। লক্ষ্মীনারায়ণের ইহা ভাল লাগে নাই, তখনও তিনি আপনার দেহস্থিত অন্ধকারে ছুটাছুটি করিতেছিলেন। তিনি বিরক্তি সহকারে কিছু বলিবার পূর্বেই জ্যোতিষীর কথা শোনা গেল।

“ভবিতব্য…ভাগ্য” বলিয়া জ্যোতিষী অনন্তহরি হাতের কাঠি তুলিয়া, প্রাচীন একটি হাসি হাসিলেন–কিছুদূর পর্যন্ত পথ অনুধাবন করার এ হাস্য, এ হাস্যের বাস কোথায় কে জানে, তবে একথা আমরা জানি, এ হাস্য রাত্রের অন্ধকার দিয়া তন্তু প্রস্তুত করে, এবং যাহা নিষ্ঠুর হইলেও অমোঘ। এ হাসিকে কোন হাতই বুঝিয়া লইতে তথা প্রকাশ করিতে অদ্যও পারে নাই। কহিলেন, “ওরে চাঁড়াল, শিবের কলম মানবে না? কি! চন্দ্র সূৰ্য্য সব কিছুকে আক্কেল দিয়েছে রে,…তা ছাড়া তুই জানি না এ বড় পুণ্যের ঘাট, পঞ্চমুণ্ডীর ঘাট। এখানে বুডোর বাপ-ঠাকুরদা সব গঙ্গা পেয়েছে, তাই সে…”

পঞ্চমুণ্ডীর নাম শ্রবণ মাত্র বৈজুনাথের ঈষৎ রোমহর্ষ হয়। এ দেহের পৃষ্ঠদেশ সত্যই কি কিছু পূৰ্ব্বে লাল হইয়াছিল, যে চন্দ্র সূৰ্য্যকে সাক্ষ্য করিয়া অনেকবার আপনার বজ্রমুষ্টি দেখাইয়াছে, পৃথিবীতে সে সহজেই অযাচিতাবলম্বী হইয়া, কৌতুক পরতন্ত্র হইয়া অন্ধকারকে আপনার খেলার সঙ্গী হিসাবে আমন্ত্রণ করিয়াছে–সে এখন একীভূত; তাহারও সংস্কার ছিল, যুক্তি যেখানে কুসুমাদপি কোমল, অবশ। পঞ্চমুণ্ডী নামে সে চোখ দুইটি বড় করিয়া যেন বিপদ গণিল, ইহার পর জ্যোতিষীর পাশ দিয়া গঙ্গায় মুখ প্রক্ষালন করিতে করিতে আপন মনে কহিল, “পুণ্য না শালা হাতী”–তাহার পর হঠাৎ সে জ্যোতিষীকে উদ্দেশ্য করিয়া কহিল, “অত পুণ্যের ঘাট ত গঙ্গা খেলে কেনে গো” বলিয়া নিজের বিদ্রুপে নিজেই হাসিয়া উঠিল, এবং কেহ উত্তর করিল না দেখিয়া নিজেই উত্তর করিল, “গঙ্গা খেলে। কেনে, বলব? সে ঘাটকে গঙ্গা থাকতে দিবে কেনে, কত কটা মানুষ জলজ্যান্ত ধাঁই ধাঁই পুড়ল বল”–এই উত্তর, তাহার আচারের প্রতি যাহাদের কোন বিশ্বাস নাই, তাহাদেরই যেন বা ঘোর। অভিমানে বলিয়াছিল।

ইহারা দুইজনেই কিঞ্চিৎ ভয় ভয়, বৈজুনাথ যাহার পিছনে গঙ্গা, তাহার দিকে তাকাইলেন।

বৈজুনাথ ইঁহাদের অবস্থা দেখিয়া খানিক বিশ্বাস লাভ করিয়া পুনরায় আরম্ভ করিল, “কত কটা ডাগর সতীদাহ হল বল, লোকে শাঁখ বাজালে, উলু দিলে, আমার শ্বশুর বলত শশয়ে গেছে, আমি যেখন এ ঘাটকে জামাই হই এলাম–তারপর কত কটা গেল” বলিয়া গঙ্গা ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া থমকাইয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখ লজ্জায় অথবা দুঃখে নীচু হইয়াছিল; একটি গভীর নিঃশ্বাস লইয়া, ঝটিতি মুখটি ঘুরাইয়া আঙুল দিয়া পশ্চাতের প্রবাহিণী গঙ্গাকে নির্দ্দেশ করত পুনরায় কহিল, “তাই বুঝি গঙ্গা, চোখের জলকে লোনা হল–কে জানে? বল ঠাকুর তোমরা পাঁচজন।” এরূপ কথা গল্প যখনই সে সুযোগ পাইয়াছে তখনই, হয় শবযাত্রীদের জাগাইয়া রাখিবার জন্য, নয় কেবলমাত্র অবসর বিনোদনের জন্য বলিয়াছে। হায়, শ্মশানেরও সুদীর্ঘ গল্প আছে। তথাপি এখন–তাহার কণ্ঠস্বরে এ কথা স্পষ্টতর হইল যে পৃথিবী বড় অন্ধকার আচ্ছন্ন, এ কারণে যে, তাহার বেদনায় নিয়মের প্রতি ক্ষোভ ছিল।

এ ক্ষোভ, নিমজ্জমান ব্যক্তির শূন্যতা আকর্ষণ উদ্যত হাতের মতই জ্যোতিষীর চোখে প্রতিভাত হয়, ফলে ভীত জ্যোতিষী আপনার শরীরকে মৃদু আন্দোলিত করিয়া কহিলেন, “থাম্ থাম্ বেটা চাঁড়াল, সে ঘাট কেন গেল, সে কথায় তোর কি দরকার।” একথা জ্যোতিষী শুধুমাত্র নিজেকে সহজ করিবার জন্যই আপনাকে আড়াল করিবার হেতু বলিয়াছিলেন, যেহেতু বৈজুনাথের বাক্যে ক্ষণিকের জন্য আপনার মোহ অহঙ্কার বিগত হয়, সেই হেতু সহসা এই সৃষ্টির রেখা সমূহ যাহা কখন ফুলে কভু ফলে, প্রায়ই শিশু আলিঙ্গনের বিচিত্র ভঙ্গিমায় প্রতিভাত–তাহা সকল বুদ্ধি হারাইয়া স্মৃতিকে ভ্রংশ করত অসংলগ্ন এলোমেলো হইয়া, অবশেষে–তাঁহার দৃষ্টির সম্মুখে অনাদি অনন্ত হইয়া দেখা দিয়াছিল। কিন্তু তিনি অতীব চতুর, পলকেই বেলাতটের অঙ্কে মনসংযোগ করিলেন।

“আঃ…রে” বলিয়া বৈজু জ্যোতিষীর কথা কয়টিকে যুত করত কহিল, “হায় কপাল, ছি ছি ছি গো আচাজ্জি” বলিয়া কেমন যেমন খুব সহজ নৃত্যের পদবিক্ষেপ একটু এদিক সেদিকে করিয়া পুনৰ্ব্বার কহিল, “সুতাহাট-থানার বাপ-মা তুমি মোড়ল, আমরা আবার কথা কইব কোন মুখে গো, ছোট জাত মোরাবল? আমরা গল্প বললাম হে। আমরা গল্প বলি। বুড়া ঠায় শুই আছে আর মড়াবসার গন্ধ, তাই বললাম হে…” বলিয়াই আপনার ভঙ্গিমায় বেলাতটের অঙ্ককে ভয়ার্ত করিল।

“থাক থাক, চুপ কর বেটা” লক্ষ্মীনারায়ণ বলিলেন, কেন না তিনি আশায় উত্তেজনায় অসহিষ্ণু হইয়াছিলেন, অবাধ্য অনন্তহরির অঙ্কের ফলাফলের প্রতি তাঁহার মন ছিল না।

তাঁহার ভর্ৎসনার সঙ্গে সঙ্গেই বৈজুনাথ উত্তর করিল, “আহা, নিজেকে রাগাইছ কেনে? বলি রাগ চাঁড়াল’?” বলিয়া কিশোরীসদৃশ হাসি হাসিল–তাহার বক্রোক্তি শুনিয়া অন্য দুইজন কিছুই করিতে পারিলেন না। বৈজুনাথ আবার সূত্র ধরিল, “আমার কথা মান কিন্তুক, শালা। এই ঘাট ভারী খানকী খচ্চর ঘাট! পঞ্চমুণ্ডী ছিলেন সে-ঠেন, মা গঙ্গার কাছে চালাকি, মাই বটে কোম্পানী, ডুবে গেল শালা পঞ্চমুণ্ডী”–এইটুকু বাক্যের মধ্যে সে উচ্ছ্বাসে স্ফীত বলীয়ান হইয়া উঠিয়াছিল, তবু এখন একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া অসহায়ভাবে–যে অসহায়তার মধ্যে গোধূলিলগ্নের অস্পষ্টতা, দূরাগত শঙ্খধ্বনির মায়া, বৎসহারা গাভীর আর্নরবের রেশ ছিল অথচ আর এক স্বরে বলিল, “জল যখন নেমে যায়, তখন কখনও কখনও সেই পাঁজা-মুণ্ডী গাঁথা পাঁজা দেখা দেয়, বলে কি জানো? বলে, ‘হেরে বেটা, ভাল করে চিতা সাজাস, আমার হাঁড়ি চড়বেক…’আমি শালা ডর করি না…দু শালা! মা আমার কোম্পানী, আমার আবার ডর কিসের…ভাবি দি শালা এক কুড়ল মেরে…শালা বলে কি না আমি তোকে শান্তি দেব, হা! শান্তি! ভাবি…থাক শালা চোখের জলের লোনা জলে ডুবে…এ ঘাটে বুড়োক না। শোয়ালেই পারতে গো।” এ কথা বলিতে বলিতে বৃদ্ধ সীতারামের মুখোনি তাহার মানসপটে ভাসিয়া উঠে। বৈজুনাথ নিশ্চয় শব সহ্য করিতে পারে কিন্তু মৃত্যু! আঃ পুনরায় ইহা একটি সুবৃহৎ গ্রন্থ–যাহাতে ফুলসকল লবণাক্ত, যাহাতে বিদ্যুৎ-দীপ্ত সবুজতার বিফলতার কথা, যাহা বৃত্তাকার ভ্রমণের অবশ্যম্ভাবী পরিপ্রেক্ষিত, যাহা দৃশ্যত নাই–তাহারই সূচনা করে। একারণে চাঁড়াল বৈজুনাথ কোনক্রমেই মৃত্যুকে সহ্য করিতে অক্ষম, কারণ তাহার আপনকার পূর্ণতা আর যে সেই হেতু সে বৃদ্ধকে এখনও পর্যন্ত ভাল। করিয়া দেখিতেও যায় নাই।

“জয় জয় মা…তারা ব্রহ্মময়ী গো” বলিয়া জ্যোতিষী উল্লাসে যেন বিদীর্ণ হইয়া গেলেন, হস্তস্থিত হুঁকা বেসামাল হয় এবং সত্বর উঠিয়া এক দৌড়ে, না লম্ফে, লক্ষ্মীনারায়ণের নিকটে প্রায় আসিয়া স্থির হইয়া বেলাতটের আঁকাজোকার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন, এসময় তাঁহার গভীর নিঃশ্বাস পড়িতেছিল, তাঁহার আপনার ছায়া অঙ্কের উপর বিস্তৃত, সে ছায়াকে অনভিজ্ঞ বালকের মত সরাইবার বৃথা চেষ্টা করিয়া এবার অন্য দিকে গিয়া তাঁহার মনঃ সংযুক্ত হইল। সীতারামের জীবন যে এইভাবে সংখ্যায় থাকিবে কে জানিত! সংখ্যার পিছনে আমি আছে, অহঙ্কার আছে, নিঃশ্বাসও বৰ্ত্তমান। বৈজুনাথ তাঁহার নিকটে আসিয়াছিল, অন্যত্রে লক্ষ্মীনারায়ণ খানিকটা উঠিয়া পুনরায় ধীরে ধীরে বসিয়া পড়িলেন। জ্যোতিষী আপনার হাতের কাঠি দিয়া কি যেন ঠিক দিবার পরে ক্রমে পিছু হটিতে হটিতে যেখানে আঁকজোক সমাপ্ত হইয়াছে, সেখানে কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত করিয়া কোন সত্য দুর্ধর্ষ অনিবাৰ্য্যতা ঘোষণা করিবার মানসে এখন তাহার দুইহাত খানিক উত্তোলিত হইল, এ সময় আপনকার ওষ্ঠদ্বয় খানিক খুলিয়া নিবিষ্ট মনে নিম্নে লক্ষ্য করিলেন।

বৈজুনাথের আয়ত চক্ষুদ্বয় কোথায় যে স্থায়ী হইবে, তাহা ঠিক পায় নাই। এমত সময় শুনিল, জ্যোতিষী আস্ফালন করিতেছেন, “শালা যাবে কোথায়”, এ কথা শুনা মাত্রই সে যেমন নির্বোধ, তাঁহার দিকে তাকাইল। জ্যোতিষী তখনই’জিহ্বার দ্বারা আপনকার ওষ্ঠ তৃপ্তির সহিত লেহন করত করিলেন, “শ্যালা! ভৃগু যাবে কোথায়…।” এক হস্ত হইতে অন্য হস্তে হুঁকা লইয়া মহা দম্ভে টানিতে লাগিলেন। এইবার হুঁকা হইতে মুখ সরাইয়া কিঞ্চিৎ ধোঁয়া ছাড়িয়া সদর্পে হাসিয়া উঠিলেন। সৌরজগৎ তিন সত্য করিল।

“অনন্ত…” কম্পিতকণ্ঠে লক্ষ্মীনারায়ণ অনন্তহরির উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ার বেগ সামলাইতে না পারিয়া ডাকিয়া ছিলেন। তাঁহার স্বরে যাত্রার শেষ দৃশ্যের শেষ রাত্রের অসংযম ফুটিয়া উঠিল।

“সাত তাড়াতাড়ি ঘর থে কেন বার করলে বুড়োকে হে? বড় কঠিন জান!” বলিয়া মাথা দুলাইয়া “হ্যাঁ হ্যাঁ” বলিয়া আপনার বিশ্বাসকে দৃঢ় করিয়া পুনরায় কহিলেন, “বড় কঠিন জান গো৷” বলিয়া, হুঁকা নিকটের মালসার কাছে রাখিলেন।

বৈজুনাথ জ্যোতিষীর অসংলগ্ন বাক্যে বড়ই ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিল, সে একদা অনন্তহরির মুখপানে অন্যবার মানসিক যন্ত্রণা পীড়িত লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি দৃষ্টিপাত করত আপনার পরনের ঠেটিতে ক্রমাগতই হাতের তালু ঘষিতে ঘষিতে কহিল, “সে কি?” এ সময় তাহার কথায় এলোমলো অবিশ্বাসের ব্যঞ্জনা ছিল।

লক্ষ্মীনারায়ণ প্রায় বৈজুনাথের সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া বলিয়াছিলেন, “বল কি?”

জ্যোতিষী কিঞ্চিৎ সমতা লাভ করিয়াছিলেন, কেননা গ্রহ সকল তিন সত্য করিয়াছে, তাহা স্বকর্ণে তিনি শুনিয়াছেন, ফলে আর চাপল্য নাই। তাঁহার দৃষ্টি এখান হইতে সোজা গিয়া পড়িল অদূরবর্ত্তী কীৰ্ত্তনদল বেষ্টিত স্থানে, যেখানে একটি স্থলিত পদবিক্ষেপে ভ্রমণরত বৃত্তের মধ্যে সীতারাম শায়িত। এই দৃশ্য দেখিতে দেখিতে তিনি যেন নিজেকে হারাইয়া ফেলিলেন! একটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করত কহিলেন, “সীতারাম! ভাগ্য! পূর্ণিমায় যাবে” বলিতে বলিতে তিনি অতি ধীরে আপনার মুখমণ্ডল ঘুরাইতে লাগিলেন।

“পূর্ণিমা? বল কি ঠাকুর!” বৈজুনাথ ভীত হইল।

“পূর্ণিমা! পূর্ণিমা! চাঁদ যখন লাল হবে” বলিয়া উঠিতেই তাঁহার সর্ব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমত বা একটি বিন্দুতে পরিণত, রক্তিম চন্দ্রিমা আখ্যাটিতে তাঁহার অন্তরীক্ষ রহস্যময় দিব্য বিদ্যুতের আলোয় সমাকীর্ণ; এমন একদা চন্দ্র লাল হয়, যোদ্ধৃ সকল সমবেত হন, পাঞ্চজন্য বাজিয়া উঠে, ঘোর যুদ্ধের রক্তে ধরণী প্লাবিত হইয়াছিল–আকাশে পক্ষী ছিল না। এই ক্ষণ-চিত্র দেখিয়া তিনি, অনন্তহরি, নিষ্ঠার সহিত নমস্কার করিয়া কহিলেন, “চাঁদ যখন লাল তখন তার প্রাণ যাবে…যাবে কিন্তু একা যাবে না হে। দোসর নেবে…” একথা তিনি সকালের উদ্বেলিত গঙ্গার দিকে চাহিয়া বলিয়াছিলেন। হয়ত একথা বলিতে তাঁহার ইতস্তততা ছিল।

এই ভয়ঙ্কর আজ্ঞা, লক্ষ্মীনারায়ণ ও বৈজুনাথ দুইজনেই শুনিয়াছিল, দুইজনেই বিশেষ বিভ্রান্ত, দেহের নিকটে ভীমরুল আসিলে মানুষ যেমত ব্যতিব্যস্ত হইয়া কাঁপিয়া উঠে, তেমনি বৈজুনাথ কম্পমান, রোমাঞ্চিত। সে খানিক অস্ফুট শব্দ করত কহিল, “বল কি দোসর!”

জ্যোতিষীর এখনও ধ্যানস্থ অবস্থা, দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর করিলেন, “দোসর!”

“দোসর!” বলিয়া বৈজুনাথ এক-পা পিছু হাটিয়া গিয়া মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটাইয়া, একদা গঙ্গার দিকে পরক্ষণেই শ্মশানের চারিদিকে চাহিয়া, কুকুরের মত ঘ্রাণ লইবার চেষ্টা করত ভৌতিক প্রমাদ গণনার মধ্যে দণ্ডায়মান থাকিয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল। ইহার পর যখন প্রশ্ন করিল, “সে কি ঠাকুর, দোসর পাবে কোথা থেকে?” তখন তাহার কণ্ঠস্বরে জীরেন রসের হিম ছিল। কৌতুক ছিল না। এ প্রশ্নে, নিমেষেই সে যেন উৰ্দ্ধ জ্যোতির্মণ্ডল হইতে ছুটিয়া আসিয়াছে এমত মনে হইল; যে বিরাট সৃষ্টির আর এক অঙ্গের তথ্য সম্যকরূপে জানে, পৃথিবীর স্বভাবময়ী প্রকৃতি যাহার আদিঘর, বন্ধন যাহার বীজমন্ত্র। যদিও ‘দোসর’ বাক্যের আপনকার সৌন্দৰ্য্য বিদ্যমান, যদিও হাটে মাঠে সে বাক্যের নিয়ত প্রতিধ্বনি শ্রুত, যদিও সে বাক্য অনন্ত জ্যোতির্মণ্ডলের এক নির্ঞ্ঝাট ত্রিগুণামিতিক বিচিত্র আকর্ষণ; কিন্তু সে বাক্য দেহ ধারণ করিয়াছে। ব্রাহ্মণ দুইজন আর এক ভাবের মানুষ, আপনকার গাত্র লেহন করিয়া পশুসকল যেমত আরাম পায়, তেমনি হঁহারা আপন আপন চক্ষুদ্বয়কে, মনকে, শ্বেতপদ্মকুসুমাদপি বিবেককে জিহ্বা দ্বারা লেহন করিতেছিলেন।

প্রথম অধীর বৈজুনাথ, আপনার পতিত জমির ন্যায় অনাদৃত বক্ষে হস্ত বুলাইয়া উর্বরতা, আদিম উৰ্ব্বরতাকে উত্থিত করত বেলাতটের ধূসর তান্ত্রিক যন্ত্রসমূহের মত অসংখ্যের হেতু, প্রক্ষিপ্ত অঙ্কের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়াছিল। যাহা কালকে ইদানীং আপনার বাস্তবতাবলে এ হেন রূপ দিয়াছে যাহাতে তাহার ছায়া পর্যন্ত দৃশ্যমান। দুঃসাহসী বৈজুনাথ অধিকন্তু অনুধাবন করে যে রৌদ্রকর্মা অমোঘ বীভৎসতা এ সকল প্রতাঁকের পশ্চাতে ঘূর্ণায়মান, এবং ক্রমান্বয়ে আঘাত হানিতেছে। ইহাকে পরাস্ত করিবার মানসে অনন্তর এমন এক অঙ্গভঙ্গী করে যাহার অর্থ এই যে, এ বিশ্ব সংসারের ঊর্ধ্বে, নভে, জ্যোতির্মণ্ডলে কোথাও যদি সে পাঁচন হস্তে স্থিতবান হইতে পারিত, তবে ভালবাসার এই পৃথিবীকে অন্যত্র, আর এক ঘরে, লইয়া যাইত; ইহাতে তাহার ঔদ্ধত্য প্রকাশ হইত না এবং নিঃসন্দেহে দেবতাগণ। পুষ্পবৃষ্টি করিতেন। সেই অঙ্গভঙ্গীর কারণ এই যে, সে নিজস্ব প্রশ্নের গুরুভারে অত্যধিক হতবুদ্ধি হইয়া বিশেষরূপে নিষ্পেষিত হইতেছিল, কেননা সে ক্ষণিকের জন্য অনুভব করিল, স্বকর্ণে শুনিল, আধো স্বরে সমগ্র বসুন্ধরা–যাহা অন্তরে অনির্বাণ, মধ্যে সুপ্তি আচ্ছন্ন, এখানে শ্লেষাত্মক ভাষার উদর বিশিষ্ট–সেই বসুন্ধরা তাহাকে পিতারূপে সম্বোধন করিতেছে। ইহা শ্রবণে এই প্রথম সে, বৈজুনাথ, আপনার নিঃশ্বাস বায়ুকে আপনার সহজ চোখে দেখিয়াছিল। সে বুঝিল যে তাহার শ্বাসকষ্ট হইতেছে, রোমসকল হরষিত, গাত্র রিমরিম; কেননা আমরা জানি স্তনহীন মৎস্যসংসার যেমত স্বীয় দৃষ্টি দ্বারাই আপন আত্মজগণকে লালন পালন করে, তেমনি সে, বৈজুনাথ, পদতলে যাহার মৃত্তিকা বিস্তার, আর এক হতভাগ্য! তাহার উপায় অন্তর নাই, তবু সে আপন বক্ষ হইতে আদিমতা উজ্জীবিত হস্তখানি উঠাইয়া প্রকাশ্যে সমর-আহ্বান ভঙ্গীতে, আপনার তন্ময়তার মধ্যেই, আন্দোলিত করিয়া পরক্ষণেই মহা কৌতুকে কহিল, “দোসর! দোসর বলতে তবে বুঝি আমি! বুড়া বুঝি আমায় লিবে গো” তাহার শেষ পদটিতে ঝুমুরের ছন্দ ছিল এবং বলিতে বলিতে সে মহা উৎসাহে লাফাইয়া উঠিয়াছিল। এখন সে আপনার ঊরুদেশে অতীব আহ্লাদে চাপড় দেয়।

“ফের বেটা হারামজাদা চাঁড়াল! বড় বাড় বেড়েছে তোর…খড়ম পেটা করে আমি তোর নাম ভুলিয়ে দেবো…ছোট জাত।”–জ্যোতিষী তাহার উল্লাস দর্শনে রাগতভাবে এবম্বিধ কহিয়াছিলেন; ইহা অকৃত্রিম কিম্বা ইহার মধ্যে ইতস্তততা ছিল তাহা সঠিক বলিবার উপায় নাই; অন্যপক্ষে স্মৃতি-উদ্ভূত সম্ভবতার সম্মুখে যে অস্পষ্টতা, তাহা তাঁহাকে এক অলিখিত স্বরভঙ্গতার মধ্যে আনে; পুনৰ্ব্বার, হয়ত এই সত্য যে, সম্ভবতা যাহা বৰ্ত্তমানবৎ তাহা যে ভোজবিদ্যা দেখাইয়াছে, উহা যদিচ ভয়ঙ্কর তবু নির্ঘাত নিশ্চিত অব্যর্থ, সে কারণে মনুষ্যপদবাচ্য যে কোন জীব–এখন চাঁড়াল বৈজুনাথ, যে তাহার বিরোধিতা করিবে, উহাকে উপহাস করিবে–তাহা অপ্রমত্ত অনাৰ্য্য বালখিল্যতা এবং ইহা বাঞ্ছনীয় নহে। কারণ কোথাও না কোথাও উহা শ্ৰীসম্পন্ন, সুন্দর, স্বাভাবিক!

নিরভিমান বৈজুনাথ দমিল না, প্রসন্ন মনে তাঁহার কথার উত্তর দিল, “আর কোত্থাকে দোসর পাবে গো…তাই না বুলোম বটে, আমায় লিবে” বলিয়া এই দুইজন ব্রাহ্মণ ছাড়া তাহার আপনার কথার সায়-সাক্ষী লাভ করিবার আশায় অন্যান্য দিকে পর্য্যবেক্ষণ করিল।

জ্যোতিষী তৎক্ষণাৎ মুখভঙ্গী সহকারে কহিলেন, “হেঃ হেঃ আমায় লিবে”–ইহার পর আপনার কণ্ঠস্বরে সাবধানতার ছল আনিয়া বলিলেন, “হারামজাদ, তোর সাহস ত বড় কম নয়। সাধে কি চাঁড়াল জন্ম হয় তোর, কুট হবে, বেটা কুট হবে, বেটা বামুনের দোসর!” এইখানেই থামিতে হইল, এই জন্য যে সহসা এক ঝলক উগ্রতীব্র নরবসার গন্ধসহ ধূম ব্রাহ্মণের মুখোনিকে বিকৃত করে, তাঁহাদের দুইজনের অবয়বকে ধূসরে সমাচ্ছন্ন করিয়াছে; এবং জ্যোতিষীর শোযোক্ত কথা এ ধূমরাশি বহুদূরে লইয়া গিয়াছিল, এবম্প্রকার বাক্যে বৃক্ষের পত্রনিচয় চুপ, পক্ষিসকল উধাও। এখন আর পাণ্ডুর অস্পষ্টতা নাই। জ্যোতিষী চিক্ করিয়া থুতু ফেলিয়া কহিলেন, “পাষণ্ড, বেটা তুই কুকুর হয়ে জন্মাবি।”

ব্রাহ্মণের বাক্যে মুহূর্তের জন্য সকল কিছুই যেমত বা বিশেষ রূপ পরিগ্রহ করে; বৈজুনাথ, আশ্চৰ্য্য যে, কোন দৈববশে সহসা যেন ক্ষুদ্রকায়া হইয়াছিল, তাহাকে দেখিলে মনে হয়, পৃথিবী নহে–আপনার আকাশ লইয়াই বহু দেশে দেশে সে ভ্রমণ করিয়াছে, এখন বেচারী ক্লান্ত; এখন সে আপনকার নাসাপুট কম্পিত করত নিঃশ্বাস লয় এবং কহিল, “সে বড় ভাল হবে গো ঠাকুরকুকুর হওয়া ঢের ভাল”– বলিয়া অসহায়ভাবে হাসিল। ইহার অর্থ, হয়ত এই হয়, আহার-নিদ্রা-মৈথুন-ভয়ই আমার ভাল। এখানে প্রকাশ থাকে, কিছুদিন পূর্বে এক সাধকের নিকট ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’ গীতটি শুনিয়া সে ভাবিয়াছিল শিখিবে; বিশেষত, কল্পতরুমূলে চারি ফল কুড়ায়ে পাবি’ পদটি ভাবিয়াছিল গঙ্গায় পা ডুবাইয়া অন্ধকার রজনীতে প্রাণ-ভরিয়া গাহিবে। সে আশা নিশ্চয়ই আর নাই। অনন্তর কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করিল, “তবে, তবে কাকে লিবে গো ঠাকুর?”

এ হেন সরল প্রশ্নের বাক্যনিচয়ে সকালের আলোক পরিচ্ছন্নরূপে দেখা গেল।

“ফের হারামজাদা! যা বলছি এখান থেকে” বলিয়া জ্যোতিষী আর আয়ুক্ষয় না করিয়া লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন।

লক্ষ্মীনারায়ণ ভূমিতে বসিয়া পড়িয়াছেন, আপনার জানুর উপর হস্ত স্থাপন করিয়া অধুনা বিনিদ্রা-জনিত ভারে অবসাদতিক্ত মস্তক রাখিয়া চক্ষু বুজাইয়াছিলেন। তাঁহার শরীর এই গণনার ফল ঘোষণায় অধিকন্তু নির্জীব, শীত-উষ্ণ বোধের সাধারণত্বের বাহিরে তিনি আপনা হইতেই সরিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন; আবার মনে হয়, তিনি নিশ্চিতভাবেই স্থির। যতক্ষণ গণনা চলিতেছিল, মন্ত্ৰপড়ার মত ভৌতিক শব্দ হইতেছিল, ততক্ষণ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম জ্ঞান তাঁহাকে স্বাভাবিক বৈষয়িক রাখিয়াছিল; এখন নিছক বিকারগ্রস্ত, স্নায়ুসকল পিঙ্গলকৃষ্ণ-বৃক্ষে পত্রাদি তিরোহিত কখনই হয় নাই, ভেককুলকে হরষিত করিবার নিমিত্তই প্রাবৃট পটলে মেঘমালা দেখা দেয়–লক্ষ্মীনারায়ণ, এরূপ প্রত্যয় হয় যে অঘঘারে ঘুমাইতেছেন।

“আই লক্ষ্মীনারায়ণ খুড়ো” জ্যোতিষী ডাকিলেন। কোন সম্পর্কে লক্ষ্মীনারায়ণ অনন্তহরির খুল্লতাত হইতেন।

লক্ষ্মীনারায়ণ এই ডাকে জাগিলেন সত্য, কিন্তু মাথা তুলিতে সমর্থ হইলেন না। কে যেমন বা জোর । করিয়া তাঁহার চক্ষু দুইটি মেলাইয়া ধরিয়াছে, যাহার একটি উস্কো চুলের তলে বিশ্রীভাবে চাহিয়া আছে। নিকটস্থ শব সৎকারের ধূমে তাহা যারপরনাই লাল, তৎসহ নরবসার গন্ধে দেহ ইন্দ্রিয়হীন অশরীরী বিকল, স্মৃতি তাঁহার এমন কি ধমনীর আশ্রয় ত্যাগ করত বহুদূরে কোন গ্রামে বিশৃঙ্খল আলুথালু প্রতীক্ষারত, এবং কৃতসঙ্কল্প বিমূঢ় তাঁহার চেতনা। বস্তুত ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্রণবিরহিত সৌন্দর্য্যে রাত্র কিম্বা। দিনের কোন প্রভাব নাই, আশ্চর্য্য অথচ ভ্রমরের বিচিত্র ভাব সিদ্ধির অন্যতম কল্পনা বিদ্যমান; উহা । অজর–শুভ্রতায় যাহার জন্ম, পদ্মে যাহার জৈব ধৰ্ম্মের সৰ্বার্থসাধক বিহারভূমি, মৃত্যু যাহার নাই, সমাধিতে যাহার অস্তিত্ব। শ্মশান উহার ইহজনমের উপলব্ধি নহে, জীবনকে ভালবাসার সম্যক কারণও নহে। ব্রাহ্মণ্য ধৰ্ম্ম এক এবং ব্রাহ্মণ আর এক, ইহা ভাবিবার মত ধৃষ্টতা আমাদের নাই। তথাপি কেন যে অতর্কিতে এ হেন শূন্যতা,–মীন হইতে মানুষ যাহার আধার মাত্র–সেই শূন্যতা বাক্য-দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করিয়া উপছাইয়া পড়িয়াছিল; তাহা আংশিকভাবে কল্পনা করিতে পারিলেও লক্ষ্মীনারায়ণ স্বীয় জিহ্বায় অন্য এক স্বাদ পাইবার চেষ্টা করিলেন; এবং অপ্রয়োজনে এদিক-সেদিক চাহিয়া মনে হইল, কোথাও কেহ নাই, ভয়াবহ নির্জনতায় এ স্থান পূর্ণ আর এ শ্মশানভূমি আপনার শায়িত ভৈরব রূপ, শবাসন পরিত্যাগ করিয়া দৃষ্টির সমক্ষে অতিকায় প্রাচীরবৎ দণ্ডায়মান। কারণ বারম্বারই একটি বালিকার, যে তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা সর্বাংশে লক্ষ্মীপ্রতিমার ন্যায়, তাহার সরল নিৰ্ম্মল মুখমণ্ডল তাঁহার মানসপটে ভাসিয়া উঠিয়া তাঁহাকে সৰ্বরূপে বিমূঢ় করিয়াছে এতদৃষ্টে লক্ষ্মীনারায়ণ ঈষৎ শঙ্কিত হইয়া অপ্রস্তুত হইয়া জ্যোতিষীকে ঝটিতি বলিলেন, “বলো।”

“বলো কি গো, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?…” অনন্তহরি প্রশ্ন করিলেন। অনন্তহরিকে তাঁহার দক্ষতার গর্ব এখনও অনেকটা স্ফীত করিয়া রাখিয়াছে। এ জয়ের নিকটে যে কোন মনোভাব তুচ্ছ, দুৰ্বল।

লক্ষ্মীনারায়ণ এমত মনে হয় বৃক্ষরোপণ দেখেন নাই, হরিৎক্ষেত্র বলিতে কোন পাখী অথবা নদীর নাম বুঝায় তাহা যেন তাঁহার জানা নাই, মেলা খেলায় বাজিকরকে ডম্বরু বাজাইতে দেখিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না। তিনি জড়বৎ সম্বিৎহীন, কোনক্রমে মাথা দুলাইয়া, যেহেতু অনন্তহরির গৰ্ব্ব তাঁহাকে আহত করিয়াছিল, উত্তর করিলেন, “বোধ হয়…

কিন্তু আমার কি হবে?” তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইল, এ কথায় দীক্ষালোভীর তীব্র ব্যাকুলতা ছিল, এবং তাঁহার দেহ দিয়া আশ্বিনের প্রমত্ত ঝড়ের ক্রমাগতই শব্দ নির্গত হয়; পূৰ্ব্বে ঐ নির্বাক জবুস্থবু অবস্থার মধ্যেও হয়ত বা লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার নাম মনে করিতে পটু ছিলেন, ফলে সহজেই এ প্রশ্নও তাঁহার মনে আসিয়াছিল, ইহা কি সত্য! এবং এখন বেলাতটের আবছায়া ইয়েরোগ্লিফিক বিশ্লেষণের প্রতি ক্ষণেক দৃষ্টিপাত অন্তে জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসাও করিয়াছিলেন, “সত্যি অনন্ত.দোসর…” বলিবার কালে তাঁহার অঙ্কুরিত কাঁচাপাকা দাড়িসমেত মুখোনি অত্যন্ত কিস্তৃত হইয়াছিল। যদিচ তাঁহার বদনমণ্ডল আৰ্য্যশোভা বিমণ্ডিত।

এ প্রশ্ন একাধারে তাঁহাকে কোথায় যেমন বা তলাইয়া দিয়াছিল; আপনার দৃষ্টি দিয়া গুরুভারসম্পন্ন দেহকে রক্ষা নিমিত্ত চেষ্টা করিবার সুযোগ পৰ্য্যন্ত পান নাই, তেমনি অন্যত্রে হাজার কণ্ঠে জয়ধ্বনি তাঁহাকে নির্ভীক করিয়া তুলিয়াছিল।

জ্যোতিষী অনন্তহরি তাঁহার এ প্রশ্ন শুনিবামাত্র বিশাল হইয়া উঠিয়া সদম্ভে উত্তর করিলেন, “আরে বাবা এ কি চন্দ্র সূর্যের বিচার! তাদের বাপের ইচ্ছে; ভুল যদি হয়…আমার মাথায় ঘোল ঢেলে দিও। কার কলম তা জান?”

লক্ষ্মীনারায়ণ, বালিকাবধূ যেমত বা, জন্মগত সংস্কারবশে শিহরিয়া উঠিলেন; তাঁহার শত সহস্র রোমকূপে স্বেদবিন্দু সকল আসিয়া থমকাইল, যেহেতু তিনি অনুধাবন করিতে পারিয়াছিলেন ইহাই সত্য, ইহাই পথ। কেননা তাঁহার সমক্ষে অক্ষয় পরিক্রমণ সশরীরে আবির্ভূত, যেখানে সূৰ্য্যচন্দ্রগ্রহনক্ষত্ররাজি স্তন্যপায়ী উলঙ্গ শিশুমাত্র! তদনন্তর হাতে হাত ঘর্ষণে আপনাকে অনুভব করিয়া সাহসে সহজ হইয়া দেখিলেন অশীতিপর কালাহত সীতারামের গলে দিব্য বনমালা দুলিতেছে, আর যে বৃদ্ধ সীতারাম কোন এক ঐশ্বৰ্য্যভাবে বাঁকা–সৰ্ব্বলোক আরাধ্যা প্রাণাধিকা রাসেশ্বরীর ভাবে যেমন কৃষ্ণচন্দ্র বঙ্কিম–তেমনি; তিনি, স্থিতপ্রজ্ঞ সীতারাম অনাগত কাহার মধুরভাবে বঙ্কিম হইয়া আছেন। লক্ষ্মীনারায়ণের ঘুণাক্ষরেও মনে হয় নাই জ্যোতিষীর দম্ভ সর্বৈব মিথ্যা হইতে পারে, মনে করিবার আর কোন তর্কও উপস্থিত নাই, কারণ তাহা সত্য, অবশ্যম্ভাবী, কেননা অশরীরী কাহারা ঊর্ধলোক হইতে তিন সত্য করিয়াছিল।

লক্ষ্মীনারায়ণ আপনার আবেগ রোধ করিতে অপারগ, এবং তদ্দণ্ডেই উঠিয়া দৌড়াইয়া গিয়া জ্যোতিষী অনন্তহরির হস্তধারণপূৰ্ব্বক রোরুদ্যমান কণ্ঠে ক্রমে ক্রমে কহিলেন, “ভাই অনন্ত, মান বাঁচাও, মান বাঁচাও আমার। ব্রাহ্মণের ইহকাল পরকাল রক্ষা কর…কোন উপায়ে ওদের রাজী করাও…যদি না হয় আমি গঙ্গায় ঝাঁপ দেবো তুমি তুমি…”

লক্ষ্মীনারায়ণের কম্পমান হস্তের মধ্যে, মনুষ্যোচিত ব্যাকুলতার মধ্যে যেখানে ত্রিসন্ধ্যা এক হইয়া শান্তি লাভ করে, যাহার দ্বারা সমগ্র পরিদৃশ্যমান বিশ্বকে আপনার বাতায়নে দাঁড়াইয়া অক্লেশে আপনার মত দেখিতে গিয়া মানুষ আপনাকেই প্রমাণরূপে জানিয়াছে, এবং সর্বপ্রথম সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করিয়াছে, তখনও রাত ছিল, আকাশে তারা ছিল–এবম্প্রকার হস্তের মধ্যে অনন্তহরির হাতও কাঁপিতেছিল, ফলে আপন হস্তধৃত কাঠির কলম, যাহাতে অনন্ত জ্যোতির্মণ্ডলের ধূলিকণা লাগিয়াছিল–তাহা যেন বা শীতকাতর।

অনন্তহরি লক্ষ্মীনারায়ণের এহেন ব্যবহার দর্শনে, যাহার মধ্যে বজ্র ছিল, রমণীর ন্যায় তিনি ঈষৎ লজ্জাশীল বটে এবং কথঞ্চিৎ নড়বড়েও হইয়াছিলেন। পরক্ষণেই আশপাশ দেখিয়া দ্রুত বলিলেন, “আঃ খুড়ো ছাড় দিকি” বলিবার কালেই অতর্কিতে চিতাধূম আসে, আর যে তিনি নিজের মুখোনি আড়াল করিতে ব্যস্ত হন, তাই “লোকে কি বলিবে” একথা তাঁহার অব্যক্ত রহিল, অথবা চিরআয়ুষ্মন ধূম্ররাজি তাঁহাকে সচেতন করিল।

লক্ষ্মীনারায়ণের এইরূপ বন্ধনে পুরাতন সনাতন প্রকাশের মধ্যে নিটোল সম্পূর্ণ মুক্তি ছিল, জ্যোতিষীর অনুরোধ সত্ত্বেও হাত দুইখানি ছাড়িয়া দিবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না, কেননা আপনার বিশ্বাস, আপনার ধর্মের নয়নাভিরাম রূপ এখানে দেখা দিয়াছিল; আরও দেখিয়াছিলেন, তাঁহার কৰ্ম্ম, বায়ুচালিত চৈত্রের বিশুদ্ধ পাতার মত উধাও হইবার পূর্ধ্বমুহূর্তে কামজ্বর পীড়িত জীবের মত চঞ্চল!

এই শ্মশানের ভয়ঙ্কর ধূমরাশি, ইদানীং যাহা কিয়দংশে সবুজ, তাঁহাকে মোহগ্রস্ত করিতে সক্ষম হয় নাই, চক্ষুকে রক্তিম করিয়াছিল সত্য, কিন্তু তাঁহার অন্তস্থ সঙ্কল্প হইতে তাঁহাকে মনে বিচলিত করিতে পারে নাই! লক্ষ্মীনারায়ণ সংস্কারহীন নির্লিপ্ত বাস্তব জগতকে পর্য্যবেক্ষণ করিলেন, একটি দুর্ধর্ষ দেহ তথা বৈজুনাথ ধীর পদবিক্ষেপে ঘোরা ফেরা করে, নিকটে প্রজ্জ্বলিত চিতা যাহার মধ্যে অস্থিমেদ মাংস কৃষ্ণবর্ণ, ক্রমে পৃথিবীর আয়তনকে নিশ্চয়ই স্ফীত করিতেছে–এপাশে জলধারা অন্যদিকে পত্ৰবাহার। ইহারা কেহই সত্য নহে; কিছুই, না শ্মশান না জলধারা কিছুই তাঁহাকে নিৰ্ব্বোধ করিবার মত পূর্ণতা লাভ করে নাই। এই সসাগরা বসুন্ধরা তাঁহার জন্য বাঁচিয়া থাকুক, ইহাদের দিয়া তাঁহার ব্যক্তিগত কাজ আছে–কেননা তিনি সংস্কার আচ্ছন্ন–এমত মনে হয় নাই। ঈষৎ পূর্বের অবসাদগ্রস্ত মনোভাব এখন অপাংক্তেয়, বুদ্বুদধৰ্ম্মী। লক্ষ্মীনারায়ণের লক্ষ মনোবাসনা আর এক, তাহা এই হয় যে, কাল ক্রন্দনের অন্তর্গত, কিন্তু স্পন্দন নিশ্চিন্ত সত্য, কেননা উহা বিনিষ্কম্প স্তব্ধতায় ফুটে-উঠার একমাত্র দুর্ধর্ষ যুক্তি। পুনরায় তিনি, অল্প সুস্থতা পাইয়া জ্যোতিষীর হাত ঝাঁকানি দিয়া কহিয়াছিলেন, “তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। অনন্ত আমাকে বাঁচাও-”তুমি যদি বলে দাও–তাহলেই হবে…এখনো ত আয়ু আছে…”।

অনন্তহরি এক প্রকার জোর করিয়া আপনাকে মুক্ত করিয়া বিরক্তি সহকারে উত্তর করিলেন, “আঃ খুড়ো, তুমি বৃথা বাক্যব্যয় করছ; ওরা, মানে…ছেলেরা, কুলপুরোহিত কৃষ্ণপ্রাণ এরা সবাই ত রাজী। শুধু বিহারীনাথ–অবশ্য তখন বুড়ো অবস্থা…বেগোড় হয়েছিল…”

“এখন তোমার কথা…” লক্ষ্মীনারায়ণ ইহাতে তাঁহাকে পুনরায় অনুরোধমাত্র করিয়াছিলেন।

“আমার? আমি ত নিমিত্ত…শিবের কলম…” বলিয়া জ্যোতিষী লক্ষ্মীনারায়ণের পদদলিত আঁকের দিকে চাহিলেন, যেখানে জীবনের কিছুটা ছিল, ব্রাহ্মমুহূর্তের প্রাকৃতিক শোভা যাহার আয়ু।

বৈজুনাথ তাঁহাদের যেন বা আপনার দ্বারদেশ হইতে দেখিয়াছিল, প্রিয়জন যেন বিদেশ যাত্রা করে। অল্পকাল পরেই, তাহার দৃষ্টি খসিয়া তাঁহাদের ছায়ার উপর পড়িবামাত্রই সঙ্গে সঙ্গেই, সারা গাত্রে তাহার আপনকার–নিম্ন শ্রেণীর আধা-নিরীহ পশুর ক্ষুব্ধ, অসংযত, মর্মভেদী যন্ত্রণার, বিলাপের, ক্রন্দনের হৃদয়বিদারক শব্দসমূহ ধ্বনিত হয়, এবং ইহা সে নিরীক্ষণমানসে চঞ্চল চিত্তে, একদা দেহের দিকে ক্রমে বাঁধপ্রতিম বাহুর প্রতি মহা উদ্বেগ লক্ষ্য করত অস্থির। একথা সত্য, অদ্যাবধি কোন রাত্রই তাহার দোয়াঁশা হইয়া দেখা দেয় নাই, কোনদিন তাহার হস্তরেখার খাত ছাড়িয়া, অন্যত্রে যায় নাই। এখন, অনন্তর সে ভয়ে তৃষ্ণার্ত হইয়াছিল।

অনন্যমনে সে এক রাত্রের মধ্যে, অর্থাৎ গতরাত্রে ভেড়ীপথ হইতে দেখিয়াছিল, স্রোতবিকার চন্দ্রালোক এবং বেলাতটে পরিক্রমণরত বৃত্ত, যাহাদের নামগান হিম বাতাসে কিয়ৎপরিমাণে দুষ্ট, উপরন্তু যখন তখন কাশির আওয়াজ সমস্ত কিছু অন্ধকারের বক্রোক্তির মত শুনাইতেছিল। বৈজুনাথ তদ্দর্শনে যারপরনাই ত্রস্ত, ফলে সীমাহীন হইয়া গিয়াছিল–এমত অবস্থায় তাহার সুন্দর চক্ষুদ্বয়ের সম্মুখে আধিদৈবিক ভোজবিদ্যার কৌশল চকিতে খেলিয়া যায়, অবলীলাক্রমে প্রতীয়মান হইল, ক্রমাগত পরিবর্তনশীল বৃত্তের তথা যেমত বা রাশমণ্ডলের কেন্দ্রে যে জন একটি অভিব্যক্তিমাত্র, সে যেন নিকটের আকাশে বারেক উঠানামা করিতেছে। বৈজুনাথ বিস্ময়ে অস্ফুট বচনে প্রশ্ন করিয়াছিল, ইহা কি সত্য! এই সীতারাম, কীৰ্ত্তনের দল, কাশির আওয়াজ, বেলাতট এ সকল কিছুই কি স্বপ্ন। দেহ-মায়াবন্ত বৈজুনাথ ভয়ে শঙ্কায় কেমন যেন হইয়া শিবার মত ধ্বনি করিয়া উঠিতে চাহিল; তদনন্তর এক মুহূর্ত ভেড়ীপথে না অতিবাহিত করিয়া সবেগে দৌড়াইয়া তখনও প্রজ্বলিত একটি চিতার নিকট আসিয়া, গ্রীষ্মকালীন দ্বিপ্রহরের কুকুরের মতই জিহ্বা প্রলম্বিত করত হাঁপাইতে লাগিল। বারবারই তাহার মনে হইতেছিল, বাঁচিয়া গিয়াছি। যদিচ একথার কোন যুক্তিপূর্ণ, আপাত দৃষ্টিতে, হেতু ছিল না। পুনরায় সে সুস্পষ্টরূপে ভাবিল, চিতার কাছে আসিয়া সে নিশ্চিত বাঁচিয়াছে। এবং কোনসূত্রে কিঞ্চিৎমনোবল সঞ্চয় করত স্পন্দনশীল রহস্যটিকে আর একবার দেখিয়াছিল। কিন্তু পলকের জন্য তাহার এ হেন অনাৰ্য্য বিমূঢ়তা ছাড়াইয়া, ইহা সহজ হইল না যে সত্যই উহা সুন্দর।

পুনৰ্বার বৈজুনাথ ফিরিয়া আসিয়াছিল। তখনও দুই ব্রাহ্মণ অগ্রসর হইতেছিলেন; উহাদের দেখিয়া সহসা তাহার মনে হইল, ইহাদের পদযুগল একজনেরও মাটিতে নাই, তাঁহাদের পিঠে রাত্র, তাঁহারা শীর্ণ, সূক্ষ্ম, স্বপ্নহীন। এবং এখন সে বেলাতটে ধর্ষিত আঁকের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিল, সেখানে একটি ক্ষুদ্রকায়া ব্যাঙ, এই শায়িত ব্রহ্মাণ্ডের উপর দিয়া লাফাইয়া লাফাইয়া চলিতেছে। এসময় তাহার কানে কাকুতি-মিনতির স্বর আসিতেছিল; সেই হেতু চক্ষুদ্বয় তুলিতেই সম্মুখে অদূরে স্পষ্ট হইল, দুই ব্রাহ্মণ তখনও দাঁড়াইয়া, একজন যেন বা কর্দমাক্ত প্রতি অঙ্গই অসম্ভব এলোমেলো, অন্যজন ক্রমান্বয়ে আশ্বাস দিতেছেন, এবং ইহাতে বৈজুনাথের অতীব ঔৎসুক্য দেখা দেয়। এখন, তাঁহারা চলিতে আরম্ভ করিলেন। পরিক্রমণরত বৃত্তাকার কীৰ্ত্তনের দলের নিকট আসিয়া লক্ষ্মীনারায়ণ থমকাইয়া গিয়াছিলেন; এখন এই দল থামিয়াছিল, কেননা ভঁহারা পথ করিয়া যাইবেন, ফলে দলটি পাশাপাশি দুলিতেছিল।

অনন্তহরি তাঁহাকে, লক্ষ্মীনারায়ণকে, একপ্রকার টানিয়া ভয়ঙ্কর বহর মধ্যে প্রবেশের পরক্ষণেই পুনরায় উচিতমত কীৰ্ত্তনের দল চলিতে লাগিল।

এই শ্যামা আরামহীন বহ-মধ্য প্রতিনিয়ত অক্ষ ঘর্ষণের বিকট কর্কশ বীভৎস রোমহর্ষক শব্দে মথিত; পূর্বেকার মত আর সকল কিছুই স্থির। ইহা অনেকাংশে মনে হয় সুগভীর কৃপ-নিম্নে আলোকপাত হইয়াছে, সেখানে জলস্তর আয়না, উপরিস্থিত আমাদের প্রতিবিম্ব দূরত্ব নিবন্ধে সবিশেষ আবছায়া; অন্যপক্ষে আকাশ প্রতিভাত, দেখা যায়, নির্ভুল সম্যক আর্থিক। আর সকল কিছুই স্থির, পত্রচ্যুত শিশিরবিন্দুর ন্যায় গঙ্গোদকের বিন্দুর শব্দ, স্তব্ধতা অনেকানেক সন্দিগ্ধতাকে জলদান করিয়া পুনরায় আত্মসাৎ করিতেছে, এবং একের ঐশ্বর্যশালী নক্ষত্রখচিত উপাধিসমূহ ধীরে অন্তর্হিত হয়।

তথাপি কীৰ্ত্তনের ধ্বনিমধ্যে কোন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নাই, তৎসহ গম্ভীর কণ্ঠে ‘গঙ্গা নারায়ণ ব্রহ্ম আবৃত্তি-উচ্চারণের ভীতিপ্রদ রেশ অদ্য সকালের স্বর্ণাভ তীক্ষ্ণ রৌদ্রে খেলনার মত নিরীহ। আর যে সমবেত জনমণ্ডলীর চোখেমুখে–যাঁহারা আসীন তাঁহাদের মুখমণ্ডলে–কেশে, ভস্মকণা যায়, অনিবাৰ্যতাকে লইয়া ইহারা প্রহর জাগিয়াছে, ভূতপূজকদের মত ঘঁহারা একনিষ্ঠ বিশ্বাসী; গ্রন্থি নির্মাণের মধুর, সুচতুর, মনোরমা, দিব্য, ছবিলা, চারুকলা-সুকুমার কৌশলখানি মহা ঘোরে বিমোহিত আচ্ছন্ন, ইহা সত্ত্বেও এই মরজগত হইতে অতীব প্রাচীন যে বীজময় শরীর তাহা নির্লজ্জ উন্মুখ, মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যুকে তাহা নিতান্ত অবহেলায় চপলমতি বালকের মত তুড়ি মারিতেছিল; প্রত্যেকের মনে ইদানীং বাস্তবতাকে শ্মশানের ক্ষিপ্রতাকে অগ্রাহ্য করত আপন আপন গৃহকোণের প্রতিচ্ছবি চিত্রিত হইয়াছিল।

অনন্তহরি এবং লক্ষ্মীনারায়ণের বৃত্ত ভেদ করিয়া আগমনে শুধুমাত্র যে আলোআঁধারের তারতম্য, কেবল যে স্থান পূর্ণাঙ্গ নিপট, আর সময় পরোক্ষ অনুভূতির বিষয় হইল, তাহা নহে, জাগ্রত সকলেই আপনকার দৃষ্টি তুলিয়া উহাদের মহাআবেগে আহ্বান করিল; একারণ যে, তাঁহারা মনে হয় সেই দেশ হইতে আসিয়াছেন, যেখানকার সকল সংবাদ কুশল, যেখানে বারিপাত আশাতীত, সংক্রামক ব্যাধি যেখানে নাই, যেখানে প্রতিটি চতুর্দশী বালিকাবধূ অন্তঃসত্ত্বা; ফলে তাঁহাদের দর্শনমাত্রই অনেকেরই রক্তে, স্ফীতনাসা-শঙ্খিনী-রমণীর কাম লালসা উন্মত্ত আঁচড় কাটিতে শুরু করে, সে রমণী–নিদাঘের দগ্ধ দ্বিপ্রহরে আপন স্বেদবিন্দু স্বীয় দেহহাপরি গতিচাঞ্চল্যে মদন দহনে নিপীড়িত, ক্ষিপ্ত, অধীরা, তাই সে আপন শরীরকে কভু বিরাট কখন অতল গভীর করিতে সমুৎসুক। ইহারা প্রত্যেকেই জাগিয়াছিল।

সীতারামের দেহের এক পাশে জ্যোতিষী অনন্তহরি বসিয়া পড়িলেন, ঠিক তাঁহার সম্মুখেই অন্যপার্শ্বে বিহারীনাথ। লক্ষ্মীনারায়ণ এখনও দণ্ডায়মান, কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ, ঈষৎ অপ্রস্তুত। এই হেতু যে তাঁহার মনে সংশয় ছিল, নিরাশাও ছিল, উপরন্তু উদ্বেগে বিনিদ্র শরীর বেপথুমান, কোন উপায়ে যে আপনাকে সুসংযত করিবেন তাহার ঠিক-ঠিকানা পাইতেছিলেন না, একদা সীতারামের যুদ্ধ-তিরোহিত নৈষ্কৰ্ম্মসিদ্ধ মুখোনি দেখিলেন, অন্যবার ভৌতিক গীতা-পাঠকের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতেই অহেতুক ত্রাসের সঞ্চার হইল।

এতদূর অগ্রসর হইয়া নিশ্চয়ই লক্ষ্মীনারায়ণ গীতা পাঠ শ্রবণে ত্রস্ত হন নাই, ইহার হেতু এই যে এইস্থানের একজনকে তিনি অবশ্যই এড়াইতে চাহিয়াছিলেন। তিনি বিহারীনাথ। বিহারীনাথ আয়ুৰ্বেদিক, বিহারীনাথ নাড়ীজ্ঞানী। প্রবৃদ্ধ সীতারামের নাড়ী ধরিয়া বসিয়া আছেন। প্রতিমুহূর্তের নিয়ত কর্মশীল জগত, একটি সূক্ষ্ম প্রতিউত্তরকে কায়মনোবাক্যে প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন–এ-কৰ্মশীল জগতের যদিচ রূপ রস গন্ধ বর্ণ ইত্যাদি কোন অবস্থা নাই। ইহাদের আগমনে তাঁহার মনোযোগের কোন ব্যাঘাত ঘটে নাই।

এখন তিনি বিহারীনাথ মুখোনি তুলিতেই, বুঝা গেল তাঁহার চক্ষুৰ্ধয় আশ্চর্য স্ফীত, এবং সেই কালে লক্ষ্মীনারায়ণের প্রতি কঠোর তথা ঘৃণাভরে, আর জ্যোতিষী অনন্তহরির প্রতি শান্তভাবে দৃষ্টিপাত করিয়া মস্তক আন্দোলিত করেন; ইহা তিনি যেন একটি লোক-গল্প আরম্ভ করিবেন, তাহারই প্রস্তুতি; ইহার মধ্যে মীমাংসা ছিল, সিদ্ধান্তও বলবান।

বিহারীনাথ ইঙ্গিতে যে কথা স্বীকার করিলেন, তাহাতে জ্যোতিষীর দৈববুদ্ধি ও দূরদৃষ্টির চেতনা-মিলিত যে অস্তিত্ব, তাহা নিমেষেই অতিকায় হইয়া উঠিল, অন্তরে তাঁহার ঘনঘটা, বাহিরে গৰ্ব্বে, তাঁহার ব্রাহ্মণসুলভ চক্ষুর্ধয়, যাহা নক্ষত্রলোকের বিহার দর্শন করিয়াছে, উহা চকিতে ঝটিতি তড়িৎময় হইল। অনন্তর তাঁহার দক্ষিণ হস্তখানি উত্তোলিত হইয়া সদম্ভে সজোরে আঘাত করিতে গিয়াসহসা সীতারামের নাভির নিকট থামিয়া, ত্বরিতে সরিয়া খড়ের উপর পড়িল, ধর্ষিত খড় মসমস করিয়া উঠে। পরক্ষণেই, জয় উল্লাসে অথচ দৃঢ় ভারী সংযত স্বরে জ্যোতিষী কহিলেন, “জয় জগদম্বে বলুন কবিরাজ মশাই! বলুন, আমার গণনা ঠিক কি না? যথার্থ কি না!”

এ হেন প্রশ্নে নাড়ীজ্ঞানী বিহারীনাথ পুনৰ্ব্বার মাথা দোলাইয়া সম্মতি জানাইয়া, অতি সন্তর্পণে সীতারামের হাতখানি খড়ের উপরে রাখিলেন, এবং এই কাৰ্য্য করিতে তাঁহাকে কিঞ্চিৎ পিছনে সরিতে হয়। তদ্দর্শনে, এই সুযোগে লক্ষ্মীনারায়ণ সাহস সঞ্চয় করিয়া কোন মতে হাঁটু ভাঙ্গিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া পড়িলেন। বিহারীনাথ তাঁহাকে কঠিন ভাবে পলকের নিমিত্ত দেখিয়া, আপনকার ট্যাঁক হইতে নস্যের ডিবা বাহির করত কিঞ্চিৎ নস্য তালুতে ঢালিয়া, যুত করিয়া টিপ লইবার ছলে আপনাকে সংযতভাবে সামলাইয়া সশব্দে একটি টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চক্ষু দিয়া খানিক জল নিঃসৃত হয় এবং এক নিমেষের আরাম উপভোগের পর কহিলেন, “আপনি যা বলেছিলেন তাই ঠিক।”

অনন্তহরি যারপরনাই আত্মহারা হইয়া বাঁকিয়া চুরিয়া একটি পায়ের উপর ভর দিয়া বসিলেন এবং খানিক, কি যেমন বা সীতারামের দেহের বিস্তৃতির মধ্যে খুঁজিবার কালে, হঠাৎ তাঁহার হস্তে সীতারামের এক সরল তেজোময় নিঃশ্বাস লাগিল, সন্ধ্যায় গৃহাভিমুখী রাখালেরা যে নিঃশ্বাস ফেলিয়া থাকে। তৎক্ষণাৎ মাতৃসুলভ চাহনিতে সীতারামকে দেখিয়া সহাস্য বদনে অবশেষে বিহারীনাথের কোলের নিকট যে হাতখানি সেইটি পলকে তুলিতে গিয়া ধীরতা অবলম্বনে আস্তে আস্তে মেলিয়া ধরিলেন।

বানরতুল্য টানা টানা দীর্ঘ সীতারামের বিশীর্ণ হাতখানির প্রতি সকলেই, দৃষ্টিক্ষম বলিয়াই, অন্যমনস্কতার সহিত লক্ষ্য করিয়াছিলেন। সেখানে সকালের রোদ একদা খরতর শ্বেত অন্যবার আঁধার, কেননা কীৰ্ত্তনের দল এখনও পরিক্রমণ করিতে ব্যর্থ, তাহারা নামগানে এখনও মুখর হাতখানি, চিরদিন নিদ্রালোককেই আহ্বান করিয়াছে, তাই ইহা বনবাসী তাপসচারীর হস্তের ন্যায় শুষ্ক, রসহীন। জ্যোতিষী। অনন্তহরি বৃদ্ধের হাতখানি লইয়া ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিলেন। অনেকবার ইহার উপর দিয়া ধূমরাশি খেলিয়া দুমড়াইয়া বক্র হইয়া ভয়াবহ কুহক সৃষ্টি করিয়া চলিয়া গেল, ইতিমধ্যে তিনি বার বার আপনার হাত দিয়া বিশীর্ণ করতল মুছিলেন, পরে গভীর রেখা সমন্বয়ের দিকে, মনে হয় যেমন, অর্থাৎ আপনারই পরিশ্রম কৃতকর্মের প্রতি স্ফীত চক্ষে অবলোকন করত দেহকে স্বেচ্ছায় কাঁপাইতে লাগিলেন, যাহাতে যেমন দেহের সৰ্ব্বত্রে ছড়াইয়া পড়িয়াছে তাহাকে পুনরায় একত্রিত করিতে পারেন। এ সময় বিশীর্ণ রোগা অতি বৃদ্ধ হাতখানি চমকাইতেছিল।

সম্ভবত একমাত্র লক্ষ্মীনারায়ণই এহেন-হাতখানির আদলে, চিতাধূমের মধ্যেও যাহা পরিচ্ছন্ন, যাহা এখন শ্বেত তখন ছায়া আবৃত, পরিব্যাপ্ত প্রকৃতির হর্ষ দেখিয়াছিলেন। তাঁহার মানসচক্ষে ক্রমে উদ্ভাসিত হইয়াছিল নামহীন পক্ষীর বক্ষদেশের উপর দিয়া, আপন ঐশ্বৰ্য্যরাশি ও বিলাসসামগ্রী লইয়া, দ্বিপ্রহরের নীল লবণসমুদ্র পার হইয়া যাইতেছে; দেখিয়াছিলেন, প্রকৃতি আপনার বিন্দুবৎ শরীর লইয়া স্বহস্তের ডম্বরু বাজাইতে বাজাইতে স্থবির পুরুষকে কেন্দ্র করিয়া নৃত্যময় পদবিক্ষেপে ভ্রমণশীলা। মানুষ বালকমাত্র, একথা মনে হয় নাই। একমাত্র তিনি, লক্ষ্মীনারায়ণ গঙ্গাতীরে আনীত সীতারামের প্রাণবায়ু নির্গমনের কালবিলম্ব-সমাচারে চোরা আনন্দের গুরুভার বহন করিতেছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *