১৩. দুর্মুখ (কাল : ৩৬০ খৃষ্টাব্দ)

দুর্মুখ  -কাল : ৩৬০ খৃষ্টাব্দ

আমার নাম হর্ষবর্ধন, শীলাদিত্য বা সদাচারের সুর্ষ আমার উপাধি। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিজে বিক্রমাদিত্য (পরাক্রমের সৃর্য ) উপাধি গ্রহণ করেছিলেন; আমি এই নম্র উপাধি গ্রহণ করেছি। বিক্রমে অপরকে দমন করে রাখার, অপরকে জয় করার চিন্তা  পেয়ে বসে; শীল-সদাচারে কাউকেও দাবিয়ে রাখার বা কারও ওপর অত্যাচার করার চিন্তা মনে আসে না। গুপ্তরা নিজেদের পরম ষ্ণৈব বলত। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা রাজ্যবর্ধন –যাঁকে গৌড়-শশাস্ক বিশ্বসঘাতকতা করে তারুণ্যেই হত্যা করে এবং যাঁকে স্মরণ করে আজও আমার হৃদয় অধীর হয়ে ওঠে-পরম সৌগত ( পরম বৌদ্ধ ) ছিলেন তিনি। সুগত ( বুদ্ধ ) যেমন ক্ষমা-মুর্তি ছিলেন, তিনিও তেমনি! নিজেকে সর্বদা তাঁর চরণসেবী মনে করেও আমি পরম মাহেশ্বর অর্থাৎ শৈব হওয়া পছন্দ করেছি। কিন্তু শৈব হলেম আমার হৃদয়ে বুদ্ধভক্তি প্রবল, শুধু এই ভারতেই নয়, ভারতের বহির্জগৎ ও এ কথা জানে।

আমি, আমার রাজ্যের সকল ধর্মকেই সম্মান করেছি-প্রজারজ্ঞনের জন্যই শুধু তনয়, আপন শীল ( সদাচার ) সংরক্ষণের জন্যেও। প্রতি পষ্ণম বৎকরে আমি রাজকার্যের উদ্বৃত্ত ধন প্রয়োগে ত্রিবেণী তীরে ব্রাক্ষণ এবং শ্রমণদের মধ্যে বন্টন করতাম। এ থেকে ও প্রমাণিত হবে, আমি সকল ধর্মের সমান সমৃদ্ধি কামনা করেছি। এ কথা সত্য যে, আমি সমৃদ্রগুপ্তের মতো দিগ্নিজয়ের জন্য যাত্রা করেছিলাম কিন্তু সে এই শীলাদিত্য নাম ধারণ করার পূর্বে। তাই বলে এই কথা ভাববেন না যে, ‍যদি দক্ষিণাপথের রাজা পূলকেশীর বিরুদ্বে আমি অসফল না হতাম  তবে বিক্রমাদিত্যের মতোই কোনো পদবী আমিও ধারণ করতাম। আমি সারা ভারতের সম্রাট হয়েও , চন্দ্রগুপ্ত নয়-অশোকের কলিঙ্গিবিজয়ের মতো পশ্চাতা্প করে শীলতা দ্বারা মানুষকে জয় করতাম- আমার প্রকৃতি এমনই বিনয়নম্র ও কোমল।

রাজ্য গ্রহণ করতে ও আমি অস্বীকার করেছিলাম, কারণ স্থাম্বীশ্বরপতি  মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের পুত্র, কান্যকুজাধিপতি পরমভট্রারক মহারাজাধিরাক রাজ্যবর্ধনের অমুজ হয়ে, আমি শুধু রাজ্যভোগ দেখে নয়, নিজে ভোগ করে তার অসারতা উপলব্ধি করেছি। যদি ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধের ক্ষত্রিয়োচিত শুভবুদ্ধি মনে জাগ্রত না হত তবে সম্ববত কান্যকুজ্ঞের সিংাসনে আমি বসতাম না। এর ফলে আমার বোন রাজ্যশ্রীর প্রতিপক্ষ মৌখরি বংশ এই রাজ্যের শাসক হত। আর বস্তুত আমার ভ্রাতার পুর্বে, গুপ্তরা চলে যাবার পর তারাই রাজ্যশাসন করত। এ সব আমি এই জস্যই বলছি যে, আমার পরবতীরা যাতে বুঝতে পারে যে হষূ স্বার্থাদ্ব হয়ে নিজ মস্তকে রাজমুকুট ধারণ করেনি। আমার দুঃখ হয় আমার দরবারী মোসাহেবরা (রাজা মোসাহেবদের সঙ্গ ছাড়তে পারে না, এই বড় মুস্কিল) আমাকে ও সমুদ্যগুপ্ত এবং চন্দ্রগুপ্তবিক্রমাদিত্যের রঙে রাঙিয়ে তুলতে চায়; কিন্তু এতে তারা আমার প্রতি খুবই অন্যায় অবিচার করেছে।

আমি রাজ্য গ্রহণ করেছি শুধু শীলতা এবং ধর্মপালনের জন্যে। বিদ্যা দানকে আমি শ্রেষ্ঠদান বলে মনে করেছি, এ জন্যে গুপ্তদের সময় থেকে চলে আসা ক্রমবর্দ্ধমান নালন্দার সমৃদ্ধিকে আমি আরও বাড়িয়ে তুলেছি, যাতে দশ জমস্র দেশী-বিদেশী পন্ডিত এবং বিদ্যার্থী সর্ববিধ সুযোগ সহ সেখানে বিদ্যাধায়ন করার সুবিধা লাভ করে। বিদ্বানের সম্মান লাভ করা আমার কাছে সব চেয়ে সন্তোষদায়ক, এ জন্য আমি চীনের বিদ্বান ভিক্ষু হয়েন সাঙকে সমস্ত অন্তর দিয়ে সম্মানিত করেছি। বার্ণের অপূর্ব কাব্যপ্রতিভা দেখে আমি তাকে লাম্পট্যের পথ থেকে সরিয়ে েএনে সুপথে চালনা করতে চেয়েছি, যদিম সে বেশী ওপরে উঠতে পারেনি শুধু চাটুকার কবি হিসাবেই রয়ে গেছে। কিন্তু মগধের এক ছোট অখ্যাত গ্রাম থেকে নিয়ে এসে তাকে বিশ্বের দরবারে উপস্থিত করার প্রয়াস আমার বিদ্যানুরাগেরই পরিচায়ক”।

আমি চেয়েছিলাম সকলেই আপন-আপন ধর্ম পালন করুক। স্ব-ধর্মের পথেই চলা উচিত কারণ এতে সংসারে শান্তি এবং সমৃদ্ধি বিরাজ করে এবং স্বর্গের সৃষ্টি হয়। সকল বর্ণের লোক নিজ নিজ বর্ণধর্ম পালন করুক, সকল আশ্রমের লোক আপন আশ্রম পালন করুক, সকল ধর্মমত আপন শ্রদ্ধা-বিশ্বাস অনুযায়ী পূজা-পাঠ করুক-এজ ন্য আমি সদা পযত্নশীল ছিলাম।

কামরূপ থেকে সৌরাষ্ট্র এবং বিন্ধা থেকে হিমালয় পযর্ন্ত বিস্তৃত নিজ রাজ্যে আমি ন্যায়রাজা স্থাপন করেছি। আমার অধিকারীরা (অফিসার) যাতে প্রজাবৃন্দের ওপর জুলুম করতে না পারে, এ জন্য আমি স্বয়ং চক্রভ্রমণে বের হতাম।

এমনই এক পর্যটনে ব্রাহ্মণ বাণ আমার আহবানে আমার কাছে এসেছিল। আমি জানি, সে আমার কীর্তির মহিমা কীর্তন করতেই চেয়েছিল। কিন্তু আমার পর্যটনের সময়েও আমার রাজৈশ্বর্ষ আড়ম্বের যে বর্ণনা সে লিপিবদ্ধ করেছে তা আমার নয়, কোনো বিক্রমাদিত্যের দরবারের হতে পারে। গোপনে গোপনে সে আমার জীবনী ( হর্শ্বচরিত) লিখছিল। ব্যাপারটা আমি আকদিন জানতে পেরে তাকে প্রশ্ন করলাম । লিখিত অংশ সে আমাকে দেখিয়েছিল, দেখে আমি খুব অসু্ন্তুষ্ট হলাম এবং তিরস্কার ও করলাম। যার পরিণামে সে আর তত উৎসাহের সঙ্গে লিখে যেতে পারল না। তার লেখা ‘কাদম্বরী’ আমার অপেক্ষাকৃত পছন্দ হয়েছিল। যদিও তাতে রাজদরবার, অন্তঃপুর, পরিচারক পরিচারিকা, প্রাসাদ, ভোগবিলাস ইত্যাদির এমন বর্ণনা দেওয়া হয়েছির যাতে লোকের অযথা ভ্রম হয় যে, এই সমগ্র বর্ণনা আমারই রাজদরবারের। আমার রাণীদের মধ্যে পারস্য কন্যার সঙ্গেই আমার গভীর প্রণয় ছিল। সে নৌশেরওয়াঁর নাতনিই শুধু নয়, উপরস্তু আপন রুপও গুণের দ্বরা যে কোনো পুরুষকে সে মোহাচ্ছন্ন করতে পারত! বাণ তাকেই মহাশ্বেতা বলে বর্ণনা করেছিল। আমার সৌরাষ্টী রাণীর যৌবন পেরিয়ে এসেছিল, তাকে খুশী রাখবার জন্য আামি তার আবাসস্থল সজ্জিত করতে কিছুটা বিশেষ আয়োজন করেছিরাম। একই বাণ ‘কাদম্বরী’ এবং তার নিবাস রুপে অস্কিত করল। বাণের রচনার এই দুট বিষয় ছাড়া বাকি সমস্ত বিষয় মোটেই আমার সম্বন্ধে প্রযোজ্য নয়, অথবা অম্যন্ত অতিশয়োত্তিপূর্ণ।

আমার অন্তিম সময়ে অনুভব করছি, বাণ আমার হিতৈষী বলে প্রমাণিত হবে না। বাণের ‘হর্ষচরিত’ শুধু নয়, ‘কাদম্বরী’তেও রাজ্য আর তার ঐশ্বর্ষ সম্বন্ধে যা কিছু বর্ণনা করা হয়েছে, লোকে সে সব আমার বিষয়ে বর্ণনা বলেই ধরবে। ‘নাগানন্দ’ ‘রত্বাবলী’ এবং প্রিয়দর্শিকা’ রাটককে আমার নামে লিখে সে তো আরও অনর্থ করেছে। লোকে বলবে, কীর্তির জন্য লালায়িত হয়ে আমি অপরের রচনা টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছি। বিশ্বাস করুন, বহুকাল পরে এই বিষয়টা আমি জানতে পেরেছি যখন হাজার হাজার বিদ্যার্থী আমার নামে এই প্রন্থাবলী পড়ে ফেলেছে এবং অনেকবার এগুলো অভিনতিও হয়ে গেছে। আমি আপন প্রজাদের সুখী দেখতে চেয়েছিলাম , তা আমি দেখেছি। নিজের রাজ্য শান্ত এবং নিরাপদ দেখতে চেয়েছিলাম, সে সাধও পূর্ণ হয়েছে। আমার প্রজারা সোনা বোঝাই করে নিশ্চিন্তে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় যেতে পারছে।

আমার কুল সম্বন্ধে এখনই লোকে বলতে সুরু করেছে যে, এটা না-কি বেণেদের কুল। সম্পুর্ণ ভূল কথা। আমি শ্যৈ-ক্ষত্রিয় বা বৈশ্য-বেণে নই। এক সময় আমাদের শাতবাহন কুলের হাতে সমগ্র ভারতের শাসনবার ছিল। শাতবাহন রাজ্যের ধ্বংসের পর আমাদের প্রজাগণ গোদাবরী তীরস্থিত প্রতিষ্ঠানপুর ( পেঠন )ছেড়ে স্থানবীশ্বর ( থানেশ্বর )চলে আসে। শাতবাহন ( শালিবাহন )বংশ ককনও বেণে ছিল না, সমস্ত জগৎ এ কথা জানে, শক ক্ষত্রিয়ের সঙ্গে তাদের বিবাহাদি হত। রাজাদের যা কুল-লক্ষণ তার বিরোধী কিছু ছিল না। আমার প্রিয়া মহাশ্বেতাও পারসীক রাজবংশোদ্ভুতা।

আমার নাম বাণ। বহু কাব্য নাটক আমি  লিখেছ্ সাহিত্যের কষ্টি পাথরেই লোকে আমাকে কষে দেখতে চাইরে, এই জস্য আমাকে কয়েকটি কথা লিখে রেখে যেতে হচ্ছে, কারণ আমি জানি, বর্তমান রাজবংশের সময় পর্যন্ত এই ষেখা প্রকাশিত হবে না। আমি এগুলো নিরাপদে রাখবার ব্যবস্থা করেছি। আমার সম্বন্ধে ভবিষ্যুৎ মানুষের ভুল ধারণার হাত থেকে রেতাই পাব যদি তারা আমার প্রসিদ্ধ পুস্তকাবলী পড়বার আগে এই লেখাটা পড়ার সুযোগ পায়।

রাজা হষূ একদিন সারা সভার মাঝে আমাকে বুজঙ্গ লম্পট বলে বসলেন-আর এর ফলে লোকে আমায় ভুল বুঝতে পারে। আমি ছিলাম ধনী পিতার আদুরে ছেলে। ভাল ও কালিদাসের রচনাবলী পড়ে আমার মন রঙীন হয়ে উঠেছিল ।আমার রুপ, যৌবন ছিল; আর ছিল দেশভ্রমণের সখও। আমি চেয়েছিলাম যৌবনের ‘আনন্দ’ উপভোগ করতে; অবশ্য ইচ্ছা করলে পিতার ন্যায় ঘরে বসেই সেটা করতে পারতাম। কিন্তু আমার কাছে তা ভন্ডামী বলে মনে হল! ভেতরে ‍যখন লালসা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে তকন নিজেকে জিতেন্দ্রিয়, সংযমী মহাত্না রুপে প্রকট করতে আমার খুবই খারাপ লাগত। সারা জীবন আমি এ সব পছন্দ করিনি। জীবনে যা কিছু করেছি সব সামনা-সামনি। আমার বাবা অবশ্য একবারই সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন –নিজের অসবর্ণ পুত্রকে স্বীকার করে, কিন্তু তাকেম তারুন্যের পাপ কলে গণ্য করা যায়।

আমি বুঝেছিলাম, যৌবনের আনন্দ যা আমি উপভোগ করতে চাই, নিজের জম্মভুমিতে থেকে সেটা সম্ভব নয়। কসল জাতি ও কুলের লোক ক্ষেপে উঠবে, আর পৈতৃক ধন সম্পত্তি ও খোয়াতে হবে। আমার মাথায় এক বিচিত্র পরিকল্পনা এল। আমি এক নাট্য-মন্ডলী গঠন করলাম, মগধের বাইরে গিয়ে। আমার এক গুণী ও কলাকুশলী তরুণ বন্ধু সেখানে ছিল। মূর্খ, ধুর্ত ও চাটুকার বন্ধু আমি কোনোদিন পছন্দ করি না। আমার নাট্য-মন্ডলীতে অনেক সুন্দরী তরুীকে নিয়ে এসেছিলাম, এদের সকলেই বারবনিতা ছিল না। ‘রত্নাবলী’ ‘প্রিয়দর্শিকা’ পুবৃতি নাটক এই নাট্য-মন্ডলীতে অভিনয় বারবার জন্যে লিখলাম। তারুণ্যের আনন্দের সঙ্গে আমি শিল্পকলার মিলন ঘটালাম, আর তা দেখে সহুদয় দর্মকেরা আমার প্রশংসাই করত। জীবনের আনন্দ আমি উভোগ করলাম , সঙ্গে সঙ্গে ‘রত্নাবলী’ ‘প্রিয়দর্শিকা’ ইত্যাদি আপনাদের সামনে উপস্থিত করলাম। যারা শুধু নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক আনন্দ পূরণ করবার জন্যই সব কিছু করে, তারা ভোগী। লোকে বলবে, রাজা হর্ষকে তোষামোদ করার জন্যেই আপন নাটকসমূহ তার নামে প্রকাশ করেছি। কিন্দু তারা জানে  না। যে-সময় প্রবাসে বসে এইসব্ নাটক লিখি তখন হর্ষকে আমি শুধু নামেই জানতাম । সে সময় আমি এও জানতাম না যে, আগামী দিনে হর্ষ আমাকে আমন্ত্রণ করে তার দরবার িকবি করে রাখবে। আত্নগোপনের তাগিদে-শুধু নিজেকে গোপন করার জন্যেই এইসব নাটকের রচয়িতা হিসাবে আমি হর্ষে র নাম দিয়েছি। এইসব নাটক যারা পড়ে, তারা এর মূল্য জানে। এগুলো সম্পৃর্ণ মৌলিক রচনা। আমার দর্শকগণের মধ্যে গুনীজন থাকত বহুল সংখ্যায়। দলে দলে আসত পন্ডিত, রাজা, কলাবিদ। যদি তারা প্রকৃত নাজ্যকারের নাম জানতে পারত, তা’হলে আমি আর নাট্র-মন্ডলীর সূত্রধার হয়ে থাকতে পারতাম না, সকলেই মহাকবি বাণের পশ্চাদ্বাবন করতে সুরু করত। কামরুপ থেকে সিন্ধু এবং হিমালয় থেকে সিংহলের অনুরাধাপুর পর্যন্ত- হর্ষ চাড়া অন্যান্য প্রায় সকল রাজ-দরবারেই নাটক অভিয় করেছি। ভেবে দেখুন, যদি কামরুপেশ্বর, সিংহলেশ্বর বা কুন্ডুলেশ্বরের গোচরীভুত হত যে, আমিই নাটক রচনাকারী মহাকবি বাণভট্র তবে আমার পর্যটন, আমার আনন্দোপভোগে কি দশা হত?আমি কোনো রাজার দরবারী কবি হয়ে থাকতে চাইনি। হর্ষের রাজ্যে যদি আমার জম্মভুমি না হত, তবে তার দরবারী কবিও হতাম না, পিতার সম্পত্তিই আমার কাছে যথেষ্ট ছিল।

হর্ষের বর্ণনা অনুসারে আপনাদের মনে হতে পারে যে, আমি একজন গণিকাসক্ত লম্পট। বস্তুত আমার নাট্য-মন্ডুলীর মধ্যে গুণিকাদের স্থান খুবই নগণ্য। তবু যারা এসেছিল, তারা তাদের নৃত্য-গীত অভিনয়কলার সৌষ্ঠব গুণেই এসেছিল, এখানে তার উৎকর্ষের চর্চা হত আমার সময় নাট্যগগনের তারকার।ভ আসত ভিন্ন পথ ধরে। ভাবীকালে কি হবে জানি না, কিন্তু আমার সময় দেশের সব তরুণীরা- তা সে ব্রাক্ষণ কন্যা বা বেণিয়ার মেয়ে হোক না কেন, রাজা ও সামন্তবর্গের সম্পত্তি বলে গন্য হত।

আমার পিসীমাকে মগধের এক সামন্ত বলপূর্বক নিয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পিসীর আয়ুও শেষ হল বলা চলে। পিসীমা ফিরে এলেন আমাদের ঘরে। আমার প্রতি তাঁর অশেষ স্নেহ ছিল। আমি কোনোদিনই তাঁর সামন্ত-সম্বন্ধের ওপর কটাক্ষ করিনি। আর এই অবলার দোষ কি? সুন্দরী তরুণীদের প্রথম অধীকারী হত মুষ্টিমেয় সামন্ত। আর সুন্দরী তরুণীর সংখ্যা খুব বেশী ছিল তা নয়। সামন্ত রাজারা ছলে বলে কৌশলে যুবতীলে পাওয়ার চেষ্টা কত। াতির কাছে যাওয়ার পূর্ব রাত্রে কোথাও কোথাও সামন্তদের সঙ্গে রাত্রিবাস করতে হত; কারণ এরা যে তাদেরই সম্পত্তি! সাধারণ লোকে একে ধর্ম-মর্যাদা মনে করত।

ব্রাক্ষণ ও বেণিয়ারা আপন কন্যা , পত্নী ও বোনেদের ডুলিতে করে এক রাত্রের জন্যে রাজান্তঃপুরে পৌছে দিত। ডুলি না পাঠাবার অর্থই ছিল, সর্বনাশ ডেকে আনা। আর মেয়ে পছন্দ হলে তো কথাই ছিল না, রাজান্তঃপুরের প্রমোদগৃহে রাখা হত স্থায়ীবাবে। তারা যে রানী হত, তা মনে করার কারণ নেই, পরিচারিকার সম্মান কপালে জুটত। রাণী হওয়ার সৌভাগ্য শুধু রাজকুমারী এবং সামন্তকুমারীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। অন্তঃপুরের এই হাজার হাজার তরুণীর অধিকাংশই এমন ছিল, যারা মাত্র এক রাতের সন্যে রাজা অথবা সামন্তের সঙ্গলাভ করেছে। এই হতভাগিনী নারীদের যৌবন কিভাবে ব্যর্থ হয়েছে সেটা িএকবার ভেবে দেখুন? আমার নাট্যমন্ডলীর অভিনেত্রীরা আসত এইসব অন্তঃপুরের পমোদাগার থেকেই কিন্তু পালিয়ে বা চুপিচুপি নয়। ভালোই বলুন আর মন্দই বলুন, রাজা ও সামন্তবর্গকে কথার জালে নিজের পক্ষে টেনে আনতে আমি ছিলাম সিদ্ধবাক। অবশ্য রাজনীতি আমার বিষয়বুত ছিল না, আমায় তারিফ করে যে শত-শত পত্র পাঠাত রাজা ও সামন্তরা ,গেুলো আজও সাক্ষী হয়ে আছে। যখন কলা সম্বন্ধে প্রশংসায় এরা পষ্ণমূখ হত , আমি তখন বিলাপ করতে সুরু করতাম। বলতাম, æকি করব বলুন! কলাকুশলী তরুণী থাকা সত্বেও পাওয়া যায় না।”

æথাকা সত্তেও পাওয়া যায় না?”

একবার চুম্বন, পরে আলিঙ্গন বা এক রাতের শয্যাসঙ্গনী করার পর খোনে হাজার হাজার তরুণীকে অন্তঃপুরের বন্দিনী করে রাখা হয়, সেখানে কলাকুশলী তরুণী পাওয়া যাবে কেমন করে।?”

æঠিকই বলেছ, আচার্য! আমিও অনুভব করছি, কিন্তু একবার অন্তঃপুরের গ্রহণ করার পর এদের আমি বের করে ‍ুদই কি করে?”

তারপর  আমি তাদের পথ বাতলে দিতাম । রাজকন্যা , সামন্তকন্যা ও রাজান্তঃপুরিকাগণের জন্য নাচগান অপরিহার্য। আহার ও পানীয়ের তমো এ সব তাদের প্রয়োজন। আমার দলেন চতুর নারীদের আমি পাঠিয়ে দিতাম রাজা নিজেই কলাশিক্ষার জন্য আপন অন্তঃপুরকাদের উৎসাহিত করতেন। যাকে গ্রহণ করা আমার পয়োজন মনে হত তার কাছে অন্তঃপুরের দুঃখকষ্ট এবং কলাবিদের জীবনের আনন্দের বিশদভাবে বর্ণনা করা হত। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও শোনানো হত যে, নাটাদের সম্মান রাজান্তঃপুরে কত বেশী, তারা কুশলী নটা হতে পারলে ভবিষ্যতে সুযোগও আছে! এ সব বলার পর অনেক তরণীর পক্ষেই সম্মত হওয়া স্বাভাবিক ছিল যদিও আমি তাদের ভেতর থেকে  যোগ্যতমাকেই বাছাই করে নিতাম। জীবনে মাত্র একটি রাত সম্ভোগের জন্য যেখানে রাজারা হাজার হাজার তরূণীকে অবরোধ করে রাখে, সেখানে অন্তঃপুরে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ করেও কিছু বন্ধ করা যায় নাÍবুড়ো কষ্ণুকী ব্রাহ্মণ তাদের তারণ্যের আনন্দ রোধ করতেও পারে না।

আমি যখন বিধবাদের ‘সতী’ হওয়ার বিরোধিতা করলাম তখন ভণ্ড শিরোমণি ব্রাহ্মণ এবং রাজারা মহা সোরগোল তুলল। তারা প্রচার করতে লাগল, আমি ভ্রূণ-হত্যা আমি একবারেই সমর্থন করি না কিন্তু এখানে এ কথা স্বীকার করতে আমার এইটুকু দ্বিধা নেই যে, আমি বিধবা-বিবাহ সম্পূর্ণ সমর্থন করি। প্রাক গুপ্তশাসনে আমাদের শ্রোত্রিয়গণ যেখানে গোমাংস বিনা কোনো আতিথ্যকে স্বীকার করতে চাইতেন না, সেখানে এখন গোমাংস ভক্ষণকে ধর্মবিরুদ্ধ বলে গণ্য করা হয়। যেখানে আমাদের ঋষিগণ বিধবাদের জন্য দেবরÍদ্বিতীয় বর, সম্পূর্ণ ধর্মসঙ্গত বলে মনে করতেন এবং কোনো ব্রাহ্মণী বা ক্ষত্রিয়া বিধবা-তরুণী ছয় মাস বা এক বছরের অধিক পতিবিধুরা থাকতে পারত না, সেখানে বিধবা-বিবাহকে এখন ধর্মবিরুদ্ধ বলে গণ্য হচ্ছে! গুপ্তরাজবংশের যুগেই এই জঞ্জালেরÍএই নতুন (হিন্দু) ধর্মের গোড়াপত্তন হয়, আর এর প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য আপন পাটরাণী করে রেখেছিলেন নিজেরই বড় ভাই রামগুপ্তর সধবা স্ত্রীকে।

তরুণী বিধবাদের স্ত্রী হিসাবে রাখতে চাইলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও আটকাতে পারেন না আর কোন মুখেই বা আটকাবেন যখন স্ব-স্ব পত্নী বর্তমান থাকতেও তাঁরা নিজেরাই পরস্ত্রীর পিছনে ছুটতে দ্বিধা করনেনি! তরুণীদের  বিধবা করে রাখার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম ভ্রুণ-হত্যা, কারণ সন্তান সৃষ্টি করে তাকে পালন করার অর্থেই হল বিধবা-বিবাহ স্বীকার করে নেওয়াÍযা থেকে লোকে রেহাই পেতে চায়। এই ভয়ে এখন ব্রাহ্মণ এবং সামন্তরা কৌলীন্য সিগ্ধ করার এক নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছে। সে হল বিধবাদের জীবন্ত দগ্ধ করা। স্ত্রীলোকদের এইভাবে জীবন্ত পুড়িয়ে মারাকে এই সব লোক মহাপুণ্য বলে প্রচার কর। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ তরুণীকে বলপূর্বক অগ্নিসাৎ করতে দেখেও যে দেবতাদের হৃদয় বিগলিত হয় না, তারা পাথরের গড়া, নয়ত তাদের অস্তিত্বই নেই। এরা বলে বেড়ায় স্ত্রীলোকেরা সেচ্ছায় সতী হয়। র্ধূত, ভণ্ড, নরাধম! এত মিথ্যা কেন? এই সব রাজান্তঃপুরের শত শত স্ত্রীলোক, যারা পুরুষের সঙ্গ হয়ত সারা জীবনে একবার পেয়েছেÍযাদের তোমরা আগুনে পুড়িয়ে সতী বানাচ্ছ, তাদের মধ্যে- ক’জন আছে যাদের ঐ নরপশুদের সঙ্গে এতটুকু পণয় ছিল? আজীবনের জন্য যারা বন্দী করে রেখেছিলÍতাদের সঙ্গে প্রেম! আর ওদের বিয়োগে পাগল হয়ে আগুনে ঝাঁপ দেবার যে এক-আধটি দৃষ্টান্ত রয়েছে, সে পাগলামীরও দু’চার দিনে প্রশমিত করা যেতে পারে। আত্মহত্যা ধর্ম! রসাতলে যাক ভণ্ড পুরোহিত আর রাজাদের ধর্ম। প্রয়াগের-অক্ষয়বট থেকে যমুনার ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করাকে এরা ধর্ম আখ্যা দিয়েছে, যার ফলে প্রতি বছর এমনি হাজার হাজার পাগল মৃত্যুবরণ করে ‘স্বর্গ’Íএ উপস্থিত হচ্ছে। দোরখণ্ডের সৎপথে গিয়ে তুষারে জমে যাওয়াকে এরা ধর্ম আখ্যা দিয়েছে, যার ফলে প্রতি বছর শত সহস্র মানুষ সৎপথের শৈত্য ‘স্বর্গ’-যাত্রা করছে! এ সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে আমি ঠিকমতো প্রতিবাদ করতে পারিনি কারণ আমাকে ব্রাহ্মণদের মধ্যে, রাজার আশ্রয়ে থাকতে হত। রাজার আশ্রিত হয়েছি, কিন্তু নিজে থেকে এই আশ্রয় গ্রহণ করিনি। আমার নিজের যে সম্পত্তি ছিল তাতে সংযত ভোগপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারতাম। আমার সময়ের রাজা এবং ব্রাহ্মণদের চেয়ে আমি অনেক বেশী সংযমী হতে পারতাম। হর্ষ এবং অপর রাজগণের মতো আমি লক্ষ সুন্দরী উপভোগকারী হওয়ার আকাঙ্কা পোষণ করিনি। খুব বেশী হলে একশ’ সুন্দরী আছে যাদের সঙ্গে কোনো না কোনো সময়ে আমার প্রণয় হয়েছিল। কিন্তু আমার বাড়িঘর, সম্পত্তি সব কিছুই হর্ষের রাজ্যে অস্থিত। যখন তার কাছ থেকে দূতের পর দূত আসতে লাগল, তখন কি করে আমি তার দরবারে যেতে অস্বীকার করি? হ্যাঁ, আমিও যদি অশ্বঘোষ হতাম, সংসার সম্বন্ধে উদাসীন থাকতাম তা’হলে হর্ষের কোনো পরোয়া করতাম না।

হষেৃর সম্বন্ধে যদি আমার গোপন মতামত জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমি বলব যে, তার সমেয় সে মন্দ লোক বা মন্দ রাজা ছিল না। আপন ভ্রাতা রাজ্যবর্ধনের সঙ্গে তার অত্যন্ত সম্প্রীতি ছিল। ভাইয়ের জন্য যদি ‘সতী’ হওয়ার বিধান ধর্মনায়কগণ দিত অথবা তার সামান্য ইঙ্গিত করত, তবে সেও তাই করে বসত। কিন্তু তার মধ্যে অনেক দোষও ছিল, এবং সব চেয়ে বড় দোষ ছিল মিথ্যা ঠাট দেখানোÍপ্রশংসার আকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সে-সম্বন্ধে নিস্পৃহ দেখাত; সুন্দরীদের সম্বন্ধে কামনা থাকা সত্ত্বেও নিজেকে কামনা রহিত বলে জাহির করত। যশোস্পৃহা সত্ত্বেও যশ থেকে দুরে থাকার প্রয়াস পেত। হর্ষকে না জানিয়ে আপন নাটকসমূহকে ‘নিপুণ কবি হর্ষ’ এই নামে আমি নিজের লেখা নাটককে রাতদিনের সঙ্গ লাভের পরও সে কখনও আমাকে বলেনি, ‘বাণ, এখন এই নাটকগুলিকে তোমার নামেই প্রচারিত হতে দাও।’ এ কাজ তার পক্ষে একেবারেই সহজ ছিল। তার অধীন সামন্ত-দরবারে শুধু একবার ‘শ্রীহর্ষো নিপুণঃ কবি’ এই জায়গায় ‘শ্রীবাণো নিপুণঃ কবিঃ’ এই নামে নাটকের অভিনয় করালেই হত।

জগৎ যেমন রয়েছে তাকে ঠিক তেমনিভাবে চিত্রিত করায় আমার আগ্রহ। আমি বারোটি বছর যদি পর্যটনে না কাটাতাম, তবে সম্ভবত এই আগ্রহ জন্মাত না, জন্মালেও আমি সেটা চরিতার্থ করতে পারতাম না। আমি যেখানে অচ্ছোদ সরোবরের বর্ণনা দিয়েছি, সেখানে হিমালয়ের পর্বতের এক সুন্দর দৃশ্য আমার মানসপটে ছিল। কাদমরী-ভবনের বর্ণনায় হিমালয়ের দৃশ্য ছিল। বিদ্ব্যাটবতী নিজেরই দেখা এক বৃদ্ধ দ্রাবিড় ধার্মিককে আমি বসিয়েছি। কিন্তু শুধু এইটুকু চিত্রণে আমি আামার লেখনীকে বিশ্রাম দিতে চাইনি। রাজন্যবর্গের প্রাসাদ, অন্তুঃপুর এবং তাদের ধন-দৌলতের চিত্রণ আমি আামার গ্রন্থে করেছি; কিন্তু আমি পর্নকুটির এবং তার দুঃখদুর্দশাপূর্ণ জীবনকে চিত্রিত করতে পারিনি, যদি করতাম তবে ঐ সব রাজপ্রাসাদ এবং রাজসম্পদভোগীদের ওপর এমন গভীর কালিমা লেপন করতে হত যে, প্রতি পঞ্চম বছরে প্রয়াগে রাজকোষÍভুল বলা হল, উদ্ধৃত্তকোষ উজাড়-করা হর্ষ আমাকে শুধু লম্পট উপাধি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকত না।

আমাকে লোকে দুর্মখ বলে, কেন না কটুসত্য বলা আমার অভ্যাস। আমাদের সময়ে আরও কটুসত্য বলার লোক যখন-তখন দেখা যেত; কিন্তু তারা সে সব কথা বলত পাগলামীর ছলে, যার ফলে অনেকেই তাদের সত্যিকারের পাগল মনে করত এবং অনেকে মনে করত শ্রীপর্বত থেকে আগত কোনো অদ্ভুত সিগ্ধপুরুষ বলে। আমিও এই শ্রীপর্বতের যুগে এক খাসা সিগ্ধপুরুষ সাজতে পারতাম; আর তা’হলে আমার নাম দুর্মুখ হত না।  কিন্তু এই লোকবঞ্চনা আমার কাম্য নয়। লোকবঞ্চনার কথা মনে করেই আমি নালন্দা ছেড়েছি, না হলে আমিও সেখানকার পণ্ডিত, মহাপণ্ডিত হয়ে যেতাম। সেখানে এক ব্যক্তিকে আমি অন্ধকার রাত্রিতে জলন্ত অঙ্গার নিক্ষেপ করতে দেখেছিলাম; কিনউত এত্ত দেখিছিলাম; কি রকমভাবে তাঁর শত্রুমিত্র সকলেই তাঁর পিছনে লেগেছে। সেই ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনাদের হয়ত কৌতুহল জেগে থাকবে। তিনি তার্কিক শ্রেষ্ঠ, নালন্দায় বসে ভঙ্কানিনাদে তিনি বলেছিলেন, বুদ্ধির ওপর পুথিকে স্থান দেওয়া, ঈশ্বরকে সংসারের কর্তা মনে করা, ধর্মপালনের ইচ্ছা, জন্ম-জাতির অভিমান, পাপক্ষয় করার জন্য শীররকে সস্তপ্ত করাÍবিবেচনাহীন জড়ত্বের পঞ্চলক্ষণ এগুলি।

ধর্মকীর্তিকে আমি বলেছিলাম, æআচার্য’ আপনার অস্ত্র তীক্ষ্ণ, কিন্তু এত বেশী সুক্ষ্ণ হয়ে গেছে যে, লোকের নজরেই পড়বে না।”

বেদপ্রমাণ্যং কণ্যচিৎকর্তৃবাদঃ স্নানে ধর্মেচ্ছা জাতিবাদাবলেপ:।

সন্তাপারম্ভঃ পাপহানায় চেতি ধ্বস্তপ্রজ্ঞানাং পঞ্চালিদানি জাভ্‌য়েঃÍপ্রমাণবার্তিক ধর্মকীর্তি বললেন, æআমার অস্ত্রের দুর্বলতার কথা আমি নিজেও বুঝি। আমি যাকে ধ্বংস করতে চাই তার জন্য আমাকে সব কিছু ত্যাগ করে চোখ-ঝলসানো প্রচণ্ড অস্ত্র ধারণ করতে হবে। নালন্দার মহাস্থবির (সন্ত-মহন্ত) ইতিমধ্যেই আমার ওপর অসন্তুষ্ট। তুমি কি মনে কর একটি বিদ্যার্থী লাভেও আমি সমর্থ হতে পারব, যদি আমি বলতে আরম্ভ করি নালন্দা এক প্রহসন বিশেষ! এখানে এমন সব বিদ্যার্থী আসে, যারা বিশাল জগৎকে আলোকিত করতে পারে না, যারা আপন জ্ঞানলোকে অজ্ঞ-স্বল্পজ্ঞদের চোখেই শুধু ধাঁধার সৃষ্টি করতে পারে! শীলাদিত্য প্রদত্ত গ্রাম থেকে যারা সুগন্ধি চাল, মশলা, ঘি, খেজুর ইত্যাদি পায় তারা তার ভোগ-শিকাররূপী প্রজা-সাধারণকে বিদ্রোহী হওয়ার শিক্ষা কেমন করে দেবে?”

আচার্য, এই অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোন পথ কি পেয়েছেন?”

পথ? সকল রোগেরই মহৌষধ আছে, সকল রকম বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা অথবা কোনো না কোনো পথ আছে কিন্তু এই অন্ধকার রাত্রি থেকে উদ্ধার পাওয়ার রাস্তা অথবা বৈতরণীর সেতু একদিনে তৈরী হতে পারে না বন্ধু! কারণ এর নির্মাণকারীর সংখ্যাঅ কম এবং অপরদিকে অন্ধকারের দুর্ভেদ্যতা অত্যন্ত প্রবল।”

তা’হলে কি হতাশ হয়ে বসে পড়তে হবে?”

বসে পড়াটা লোকবঞ্চনা থেকে ভালো। দেখছ না, যাদের পথ-পদর্শক হওয়া উচিত তারাই কি রকম প্রবঞ্চক? আর এই অবস্থা শুধু মাত্র এই দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই। সিংহল, সুবর্ণদ্বীপ, যবদ্বীপ, কম্বোদ্বীপ, চীন, তুষার, (মধ্য এশিয়া) পারস্য কোন জায়গায় বিদ্বান ও বিদ্যার্থী নালন্দায় নেই? এদের সঙ্গে আলোচনা করেলেই বোঝা যায় যে দুনিয়া অন্ধকারে পূর্ণ হয়ে গেছেÍধিগ্ ব্যাপকং তমঃ!”

জলন্ত শব্দাঙ্গার নিক্ষেপ করে ধর্মকীর্তি এই ঘোর তমসাকে দুর করবার প্রচণ্ড চেষ্টা করেন; কিন্তু তৎকালে এর থেকে কোনো সুফল ফলতে আমি দেখিনি। আমি একাই উজ্জল দীপযষ্টি বহন করে চলতে কৃতসঙ্কল্প হলাম। এর একটা ফল এই হলে যে, আমি দুর্মুখ বনে গেলাম। এখানে এ কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই যে, আপন রসনার ব্যবহারে আমাকেও রাজসত্তার ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমন না-তরা সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হত, না হলে দুর্মুখের মুখ দশ দিনেই বন্ধ করে দেওয়া হত! তা সত্বেও নিজিকে বাঁচিয়ে কখনও কখনও আমি বহু দূর পর্যন্ত অগ্রসর হতাম

মরণের পর মুক্তি এবং নির্বাণ-প্রাপ্তির যে-কথা তোমরা বল,কি অর্থ আছে তার?

যে লক্ষ লক্ষ দাসকে পশুরন্যায় আবদ্ধ রেখে ক্রয়-বিক্রয় করা হচ্ছে, তাদের কেন মুক্ত করার চেষ্টা কর না? প্রয়োগের মেলায় একবার রাজা শীলদিত্যকে আমি প্রশ্ন করেছিলাম, মহারাজ, আপনি যে বড় বড় বিত্তশালী মঠ এবং ব্রাহ্মণদের মাঝে প্রতি পঞ্চম বৎসরে এত ধন-দৌলত বিতরণ করছেন, সেগুলি যদি দাসদাসীদের মুক্ত করার কাজে লাগাতেন, হা’হলে কি তাতে কম পুণ্যের কাজ হত?”

একান্ত সময় আলোচনা করার কথা বলে শীলাদিত্য এ প্রশ্ন এড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই ‘অন্য সময়’ও আমি খুঁজে বর করলাম। রাজার ভগ্নী ভিক্ষুণী জোর করেই সে সুযোগ সৃষ্টি করে দিল। রাজ্যশ্রীর সামনে আমি দাসদাসীদের নরক-যন্ত্রণার চিত্র তুলে ধরলাম। তার হুদয় বিগলিত হয়ে গেল। তারপর যখন আমি বললাম যে, অর্থ দিয়ে এই সানতন বংশপরস্পরায় বন্দী মানুষের মুক্তি দান করা সবচেয়ে পুণ্যের কাজ, তখনই সে কথা তার মনে ধরে গেল। বেচারী সরল-হুদয়া স্ত্রীলোক, দাসস্থের আবরণে লুকায়িত বড় বড় স্বার্থের কথা সে কি জানে? সে কি করে জানবে যে, যেদিন মাটিকে স্বর্গে পরিণত করা যাবে, আকাশের স্বর্গ সেদিন হেলে পড়বে! আকাশ-পাতাল, স্বর্গ-নরগ কায়েম রাখার  জন্য, তাদের নামে লাভের কারবার চালানোর জন্য –পৃথিবীতে স্বর্গ-নরক, রাজা-ভিখারী, দাস-স্বামীর প্রয়োজন হয়।

রাজা নির্জনে বসে আলোচনা করল। প্রথমে সে বলল, “একবার অর্থব্যয় করে তাদের আমি মুক্ত করতে পারি, ক্নিতু দারিদ্র্যের চাপে সে মুক্তি বিকিয়ে যাবে।”

“ভবিষ্যতের জন্য মানুষের ক্রয়-বিক্রয় দন্ডনীয় করে দিন।”

এরপর সে চুপ করে ভাবতে লাগল। আমি তার সামনে ‘রাগানন্দের’ নাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরলাম, যে অপরের প্রাণরক্ষার  জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতে চেয়েছিল। ‘নাগানন্দ’হর্ষরাজের সৃষ্ট নাটক বলে কথিত, সুতরাং কি জবাব দেবে সে? শেষকালে সে জানল যে, দাসদাসীদের মুক্ত করায় সে ততটা কীর্তিলাভের আশা রাখে না, যতটা  রাখে শ্রমণ-ব্রাক্ষণদের ঝুলি ভরায় বা বড় বড় মঠ মন্দির  নির্মাণে । এই দিন আমার কাছে পরিষ্কার  হয়ে গেল, সে শীলাদিত্য নয়- শীলান্ধকার।

বেচারা শীলাদিত্যকেই বা আমি কেন দোষ দিই? আজকাল কুলীন নাগরিক হওয়ার লক্ষণই হল যে, সকলেই পরস্পরকে বঞ্চনা করে চলেছে। পুরাতন বৌদ্ধগ্রন্থে বুদ্ধকালনি রীতিনীতির কথা পাঠ করে আমি জেনেছি, পূর্বে মদ্যপান জলপানেরই সামিল ছিল। মদ্যপান না করাকে সে সময় উপবাস-ব্রত বলে মনে করা হত। আজকাল ব্রাহ্মণেরা মদ্যপান নিষিদ্ধ করেছে এবং প্রকাশ্য মদ্য পান করায় শাস্তি পেতে হয়। এ সবের পরিণাম কি? দেবতার নামে সিদ্ধি-সাধনার নামে লুকিয়ে ভৈরবীচক্র চলছে। ব্রহ্মচর্য নিয়ে মহা সোরগোল সুরু হয়েছে, কিন্তু পরিণাম? ভৈরবীচক্রে আপন-পর সকল স্ত্রী ভোগাধিকারভুক্ত। এর চেয়েও জঘণ্য ব্যাপার, দেবতার বরদানে নামে সেখানে মাতা-ভগ্নী-কন্যা পর্যন্ত ভোগাধিকারভুক্ত হয়ে উঠেছে। আর পরিব্রাজক,ভিক্ষু এদের আখড়াগুলি অপ্রাকৃতির ব্যভিচারে আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।

যদি সত্যই এই জগৎকে দেখাশোনার কেউ থাকত, তবে এই বঞ্চনা, এই অন্ধকার এক মুহূর্তের জন্যও সে বরদাস্ত করত না।

একবার আমি কামরূপ গিয়েছিলাম। সেখানকার রাজা নালন্দার ভক্ত এবং মহাযানের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবান। ইম বলেছিলাম, “মহাযাত্রী বোধিসত্বের ব্রতকে আপনি মান্য করেন, যে ব্রতে বলা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত একটিও প্রাণী বন্দী হয়ে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্বাণ আমার কাম্য নয। মহারাজ আপনার রাজ্যে অনেক চণ্ডাল আছে, যারা দণ্ড হাতে নিয়ে নগরে আসে আর রাস্তায় আওয়াজ করতে করতে যায়। তার লোককে সচেতন করে দেয়, যাতের তাদের ছোঁয়া লেগে কেউ যেন অস্পৃশ্য না হয়। তারা হাতে করে পাত্র বয়ে নিয়ে চলে, যাতে তাদের অপবিত্র থুতু নগরেরপবিত্র মাটিতে না পড়ে। কুকুরকে স্পর্শ করলে মানুষ অপবিত্র হয় না, তার বিষ্ঠাও নগরকে চিরদুষিত কর রাখে না। তবে কি চণ্ডালেরা কুকুরের চেয়েও অধম?”

“কুকুরের চেয়ে অধম নয়। এদের মধ্যেও জীবন-প্রবাহ নিহিত আছে, যা বিকাশিত হয়ে বৌদ্ধিক উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারে।”

“তা’হলে রাজ্যে ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা করে দিন না যে, আজ থেকে কোনো চণ্ডালকে নগরে আসতে দণ্ড অথবা কিদানী বয়ে আনতে হবে না?”

“এ আমার শক্তির অতীত; সমাজ-ব্যবস্থা এমনভাবেই রচিত হয়েছে।”

“বোধিসত্বের ধর্মে—মহামানবের কি এই ব্যবস্থা?”

“কিন্তু এখানকার সকল প্রজা তো মহামন্ত্র অনুসরণ করে চলে না।”

“গ্রামে, শহরে সর্বত্র আমি ত্রিরত্বের জয়দুন্দুভি বেজে উঠতে দেখেছি।”

“হ্যাঁ, কথা তো ভালোই । যেদিন আমি এ কথা ঘোষণা করব, সেই দিনই আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আমার বিরুদ্ধে এই বলে তুফান সৃষ্টি করবে যে, সনাতন কার থেকে চলে আসা এক সেতুকে আমি উড়িয়ে দিচ্ছি।”

“বোধিসত্বা-জীবনের মহিমা সম্বন্ধে অহনিশি যে উপদেশ প্রচারিত হচ্ছে, করাও ওপর কোনো প্রভাবই কি তার পড়েনি? আমি বিশ্বাস করি মহারাজ, নিশ্চয় এর প্রভাব পড়েছে, এবং যদি বোধিসত্বের ন্যায় আপনি আপনার সমস্ত কিছু ত্যাগ করার জন্য প্রস্তত হন, তবে আপনাকে অনুসরণ করে চলার পথিকও পাওয়া যাবে।”

“রাজ্যের ভিতরকার প্রশ্নই শুধু নয়, পরমভট্টারকদেবও অসন্তুষ্ট হয়ে উঠবেন।”

“শীলাদিত্য! যে ‘নাগানন্দ’ নাটকে বোধিসত্বের উজ্জ্বল চিত্র অঙ্কিত করেছে?”

“হ্যাঁ, প্রচলিত লোকাচার উঠিয়ে দেওয়া তাঁরও ক্ষমাতাধীণ নয়।”

“এমন কথা যদি তথাগত, যদি আর্য অশ্বঘোষ অথবা নাগার্জুন মনে করতেন?”

“তাঁদের সাহস ছিল, তবু রীতি বর্জন করে তাঁরাও বেশী দুর যেতে পারেননি।”

“বেশীদুর নয়, অল্প দুরই আপনি চলুন মহারাজ, কিছুদুর আপনি অগ্রসর হন।”

“আপনি কি আমাকে নিজ মুখ দিয়ে কাপুরুষ বলিয়ে ছাড়বেন?”

“কাপুরুষ বলছি না। কিন্তু শুনুন, ধর্ম আমাদের কাছে এক নাগপাশ বিশেষ!”

“আমার অন্যরকে জিজ্ঞাসা করলে আমি ‘হ্যাঁ’ বলব, রসনাকে জিজ্ঞাসা করলে সে পরিষ্কার ‘না’ বলবে অথবা একেবারেই মৌনব্রত ধারণ করবে।”

*                             *                             *

ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আমার ঘৃণা ধরে গেছে! বস্তুত কামরূপ নৃপতির মতো বহু সদন্তঃকরণ লোককে কাপুরুষ রূপে সৃষ্টি করার অপরাধ এই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের। যে দিন এই ধর্ম এ দেশ থেকে উঠে যাবে, সেদিন পৃথিবীর এক গুরুতর কলঙ্ক ঘুচে যাবে। নালন্দায় এসে বিদেশী ভিক্ষুদের কাছেআমি ‍শুনেছি, তাদের দেশে ব্রাহ্মণের ন্যায় কোনো সর্বশক্তিমান ধর্মনায়কের জাতি নেই। তাদের কথায় বুঝেছি যে, কেন সেই সব দেশে দণ্ড এবঙ মুখপাত্র বহনকারী চণ্ডালের দেখা পাওয়া যায় না। ব্রাহ্মণেরা আমাদের দেশে মানুষকে ছোট বড় জাতে এমনভাবে ভাগ করে দিয়েছে যে, কেউই নিজের চেয়ে নীচু জাতের লোকের সঙ্গে মিশতে প্রস্তুত নয়। এদের ধর্ম আর জ্ঞান নিছক রাহুকেতুর ছায়া বিশেষ।

নালন্দায় দেশেদেশান্তরের বিচিত্র সংবাদ পাওয়া যেত এ জন্য আমি দু-এক বছরনানা দেশ পর্যটন করে পুনরায় ছয় মাসের জন্য নালন্দায় চলে যেতাম। একবার এক পারসিক ভিক্ষু বলেছিলেন যে, তাঁর দশে কিছুকাল পুর্বে মজদ্‌ক নামে এক বিদ্বান ছিলেন, যিনি এক প্রকারের সঙ্ঘবাদের (যতদূর পযন্ত সম্পত্তির প্রশ্ন রয়েছে) প্রচার করেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্ঘবাদ এখন শুধু বিনয়পিটকে পঠনীয় বস্তু মাত্র। আজ বড় বড় বৈয়ক্তিক (পৌদগলিক) সম্পত্তি ভোগকারী ভিক্ষু রয়েছে। আচার্য মজদক ব্রহ্মচর্য এবং ভিক্ষুবাদ মানতেন না। তিনি মানুষের স্বাভাবিক জীবন—প্রেমিক-প্রেমিকা, পুত্র-পৌত্রের জীবনকেই শুধু স্বীকার করতেন; কিন্তু বলতেন সকল পাপের মুল হল ‘আমি’ এবং ‘আমার’। তিনি বলেছিলেন, ‘সম্পত্তি স্বতন্ত্র হওয়া উচিত নয়, প্রেম স্বেচ্ছানুযায়ী চলবে এবং সন্তান সকলের সম্মিলিত সম্পত্তি বলে গণ্য হবে। জীবে দয়া এবং সংযমের শিক্ষাও তিনি দিতেন। তাঁর মতবাদ আমার কাছে সুন্দর মনে হল। আমি যখন শুনলাম যে, মজদ্‌ক এবং তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুচরকে মেরে এক পারসিক রাজা—নোলেরিয়াঁ, ন্যায়মূর্তি উপাধি ধারণ করেছে, তখন বুঝতে পারলাম, যতদিন পর্যন্ত রাজা থাকবে যতদিন তাদের দান-পুণ্যের সাহায্যে বেঁচে থাকা শ্রমণ-ব্রাহ্মণ থাকবে, ততদিন পৃথিবী স্বর্গে পরিণত হতে পারে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *