০৩. অমৃতাশ্ব (স্থান : মধ্য এশিয়া, পামীর (উত্তর কুরু) ।। কাল-৩০০০খৃষ্টপূর্ব)

অমৃতাশ্ব (স্থান : মধ্য এশিয়া, পামীর (উত্তর কুরু) ।। কাল-৩০০০খৃষ্টপূর্ব)

করগনার সবুজ শ্যামল পাহাড়, স্থানে স্থানে প্রবাহিত নদী বা ঝরনাধারা, তা যে কত সুন্দর সে শুধু তারাই জানে যারা দেখেছে কাশ্মীরের সুষমা। শীতের অবসানে বসন্ত এসেছে, আর বসন্তের অপরুপ সৌন্দর্য এই পার্বত্য উপত্যকাকে করে তুলেছে মর্তের স্বর্গ, পশুর পাল গিরিগুহার শীতের আবাস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে বিস্তৃত গোচারণ ভূমিতে। দূরে দেখা যাচ্ছে ঘোড়ার লোমের তৈরী তাঁবু—তার মধ্যে যেগুলি খুব লাল সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে। একটি তাঁবু খেকে জল-ভরার চামড়ার মশক কাঁধে করে একটি তরুণী বেরিয়ে এল, সে পাথরের ওপর দিয়ে নদীর তীরের দিকে এগুতে লাগল। তাঁবু থেকে বেশী দূরে সে যায়নি এমন সময় একটি পুরুষ তার সামনে এসে দাঁড়াল। তরুণীর মতোই তার শরীর একটি পাতলা সাদা পশমের কম্বলে ঢাকা। কম্বলের দুইটি প্রান্ত এমনভাবে ডান কাঁধের ওপরে গেরো দিয়ে বাঁধা যে শুধু ডান হাত, কাঁধ আর বুকের অধর্র্ধাংশ অনাবৃত। পুরুষটির চুলগুলি পিঙ্গল, গোঁফটি সুন্দরভাবে পাকানো। পুরুষটিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল মেয়েটি। মুচকি হেসে পুরুষটি বলল, ‘‘সোমা আজ দেরী করে জল ভরতে যাচ্ছ?’’

‘‘হ্যাঁ। ঋজ্রাশ্ব। কিন্তু পথ ভুলে ‍তুমি এদিকে কোথায়?’’

‘‘ভুলিনি সখি! আমি তোমার কাছেই এসেছি।’’

‘‘আমার কাছে? অনেক দিন পরে।’’

‘‘আজ সোমার কথা মনে পড়ল!’’

‘‘তা বেশ ভালোই, আমাকে জল নিয়ে ফিরতে হবে, অমৃতাশ্ব খেতে বসেছে!‘‘

দু‘জনেই কথা বলতে বলতে নদী তীর পর্যন্ত গিয়ে ঘরে ফিরল!

ঋজ্রাশ্ব বলল, ‘‘অমৃতাশ্ব বেশ বড় হয়ে গেছে।’’

‘‘হ্যাঁ, ‍তুমি তো অনেকদিন দেখনি।’’

‘‘ওর চার বছর বয়স  থেকে।’’

‘‘এখন তার বয়স বারো। সত্যিই বলছি ঋজ্রাশ্ব, রুপে সে তোমারই মতো।’’

‘‘কি জানি, সে সময় আমি ছিলাম তোমার কৃপার পাত্র। তা অমৃতাশ্ব এতদিন কোথায় ছিল?’’

‘‘বাহলকে দাদামহাশয়ের কাছে।’’

তরুণী জলভর্তি মশকটি নামিয়ে রেখে নিজের স্বামী কৃচ্ছ্রাশ্বকে ঋজ্রাশ্বের আসার খবর দিল। তারা স্বামী স্ত্রী দু‘জনে এবং পেছনে অমৃতাশ্ব তাঁবু থেকে বাইরে এল। ঋদাশ্ব সসম্মানে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘‘বল বন্ধু কৃচ্ছ্রাশ্ব, কেমন ছিলে তুমি?’’

‘‘অগ্নি দেবতার কৃপায় ভালোই আছি ঋজ্রাশ্ব। এস খাওয়া যাক। এক্ষুনি সিদ্ধি কেটে মধু আর অশ্বিনী-ক্ষীর যোগে এই সোমরস তৈরী হয়েছে।

‘‘মধু সোম? কিন্তু এত সকালে কি করে?’’

‘‘আমি ঘোড়ার চারণভূমিতে যাচ্ছি। বাইরে দেখছ না ঘোড়া তৈরী?’’

‘‘তা‘হলে আজকে সন্ধ্যায় ফিরবার ইচ্ছা নেই?’’

‘‘নাও ফিরতে পারি। তাই এ সোমের মশক আর অশ্ব-মাংস সঙ্গে নেব।’’

‘‘অশ্ব-মাংস!’’

‘‘হ্যাঁ, কৃচ্ছ্রাশ্ব! তোমার নামটা কিন্তু উল্টো।’’

‘‘মা বাবার সময় আমাদের অশ্বের কৃচ্ছ্রতা ছিল, তাই আামার নাম কৃচ্ছ্রাশ্ব।’’

‘‘কিন্তু এখন তো ঋদ্ধাশ্ব হওয়া উচিত।’’

‘‘আচ্ছা, ভেতরে চল।’’

‘‘এই পাইন গাছের নীচে সবুজ ঘাসের ওপরই বসি না কেন, বন্ধু!’’

‘‘ঠিকই। সোমা, তুমি তা‘হলে নিয়ে এস, সোম আর মাংস। এখানেই বসে বন্ধুকে তৃপ্ত করি।’’

‘‘কিন্তু কৃচ্ছ্র, ‍তুমি তো ঘোড়ার পালের দিকে যাচ্ছিলে যে?’’

‘‘আজ না হয় কাল যা্ব। বস ঋজ্রাশ্ব!’’

সোমা ভাঙের মশক এবং চষক নিয়ে এল। দু‘বন্ধুর মাছে অমৃতাশ্বও বসে পড়ল। সোমা ভাঙ ও চষক মাটিতে রেখে বলল, ‘‘একটু অপেক্ষা কর, বিছানা এনে দিচ্ছি।’’

‘‘না সোমা, এই নরম ঘাস বিছানার চেয়েও ভালো।’’—ঋজ্রাশ্ব বলল।

‘‘আচ্ছা, বল তো ঋদ্র! লবণ দিয়ে সেদ্ধ-করা মাংস খাবে, না পোড়া-মাংস খাবে? আট মাসের বাছুরের মাংস খুবই নরম।’’

‘‘আমি তো বাছুরের পোড়ানো মাংসই পছন্দ করি। আমি কখনও কখনও গোটা বাছুর আগুনে পোড়াই। পোড়াতে দেরি হলেও কিন্তু মাংস খুব সুস্বাদু হয়। তোমাকে কিন্তু সোমা! ঠোঁটের স্পর্শে আমার চষক মিষ্টি করে দিতে হবে।’’

‘‘হ্যাঁ—হ্যাঁ সোমা! ঋজ্র দীর্ঘ দিন পরে এসেছে।’’—কৃচ্ছ্রাশ্ব বলল।

‘‘আমি এখুনি আসছি, জোর আগুন আছে, মাংস পোড়াতে দেরি হবে না।’’

কৃচ্ছ্রাশ্বকে চষকের পর চষক নিঃশেষ করতে দেখে ঋজ্রাশ্ব বলল, ‘‘এত তাড়া কিসের?’’

‘‘সিদ্ধি হচ্ছে অপূর্ব! সোমার হাতে তৈরী সিদ্ধি খাওয়া অপূর্ব!যেন অমৃত। এ সিদ্ধি লোককে অমর করে। সিদ্ধি পার কর এবং অমর হও।’’

‘‘তুমি কি অমর হতে চাও? যে রকম চষকের পর চষক নিঃশেষ করে চলেছ, তাতে অচিরেই মৃত্যুর পর অমরত্ব লাভ করবে।’’

‘‘কিন্তু তুমি তো জান ঋজ্র, সিদ্ধি আমি কত ভালোবাসি!’’

এই সময় সোমা চামড়ায় করে পোড়ানো তিন টুকরা মাংস নিয়ে এসে বলল, ‘‘কৃচ্ছ্র! সোমাকে কি ‍তুমি ভালোবাসো না!’’

কৃচ্ছ্র স্বর পরিবর্তন করে বলল, ‘‘সোমা ও সোম দুটিকেই আমি ভালোবাসি।’’ তার চোখ লাল হয়ে উঠছিল। সে বলল, ‘‘সোমা, আজ তোমার কিসের চিন্তা?’’

‘‘হ্যাঁ, আজকে তো আমি ঋদ্রের।’’

‘‘অতিথি না পুরানো বন্ধু?’’—কৃচ্ছ্র হাসতে চেষ্টা করে বলল।

ঋজ্রাশ্ব সোমার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে সোমপূর্ণ চষক তার মুখের কাছে ধরল। সোমা দু‘ঢোক পান করে বলল, ‘‘এখন তুমি খাও ঋদ্র! অনেক দিন পরে আজ আবার সুদিন ফিরেছে।’’

ঋজ্রাশ্ব পুরো চষকটি এক নিঃশ্বাসে পার করে পা্ত্রটি মাটিতে রেখে বলল, ‘‘তোমার ঠোটের স্পর্শে সোম না জানি কতই মিষ্টি হয়।’’

কৃচ্ছ্রাশ্বের ভেতর সোমের প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। সে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি নিজের চষকটি ভর্তি করে নিয়ে সেই পেয়ালা সোমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘‘তা‘হলে সোমা, এটাও মধুর বানিয়ে দাও!’’

সোমা ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ করে চষক ফিরিয়ে দিল। অমৃতাশ্ব বৃদ্ধদের প্রেমালাপে রস পেল না, তাই বয়স্ক বালক বালিকাদের সঙ্গে খেলতে চলে গেল। কৃচ্ছ্রাশ্বের মাথা ঝুঁকে পড়ছিল, সে ঢুলু ঢুলু চোখে বলল, ‘‘সোমা আমি গান গাই…’’

‘‘হ্যাঁ, তোমার মতো গায়ক কুরুদের মধ্যে আর কেউ কি আছে?’’

‘‘ঠি-ই-ক ব-লে-এ-ছ, আ-মা-র জু-উ-ড়ি-ই-নে-ই। বেশ তা—তা হোলে…’’

‘‘থাক, কৃচ্ছ্র! দেখছ না তোমার গান শুনে সমস্ত পশু-পক্ষী জঙ্গল ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।’’

‘‘হু-হু-ম-ম’’

এটা সোম খাওয়ার সময় নয়। সাধারণত তার সময় সুর্যাস্তের পরে; কিন্তু কৃচ্ছ্রাশ্বের তো কোনো একটি বাহানার দরকার নেই। সে বেহুঁশ হয়ে পড়ায় সোমা ও ঋজ্রাশ্ব চষক রেখে দিল এবং দু‘জনে নদীর ধারে একটি টিলার ওপর গিয়ে বসল। পাহাড়ের মধ্যে যেখানটা কিছুটা সমতল সেখান থেকে নদী প্রবাহিত হচ্ছিল। নদী ছিল ছোট-বড় উপখণ্ডে ভরা। তার ওপর জলের আঘাত লাগায় শব্দ হচ্ছিল। পাথরের আড়ালে মাছগুলিকে চলতে ফিরতে দেখা যাচ্ছিল। পাখীর সুমিষ্ট সঙ্গীত আর ফুলের সুগন্ধি মৃদৃমন্দ বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছিল। অনেকদিন পরে তারা দু‘জনে এই স্বর্গীয় ভূমিতে অতীত দিনের প্রেমালাপের পুনরাবৃত্তি করছিল। তাদের মনে পড়ছিল সে-দিনগুলির কথা, যখন কিনা সোমা ছিল ষোড়শী পিঙ্গলা-কেশী। বসন্ত উৎসবের সময় ঋজ্রাশ্বও ছিল তার প্রেমিকদের একজন। তখন সোমার প্রণয়াভিলাষীদের ভেতর বেশ প্রতিযোগীতা ছিল। কিন্তু জয়মাল্য জুটল কৃচ্ছ্রাশ্বের অদৃষ্টে। অন্যান্য সকলের মতো ঋশ্বকেও পরাজয় স্বীকার করে নিতে হল। আজ সোমা কৃচ্ছ্রাশ্রের স্ত্রী কিন্তু সেই প্রাণপূর্ণ যুগে স্ত্রীলোক পুরুষের একচেটে জঙ্গম সম্পত্তি হতে স্বীকার করেনি, এর জন্য অস্থায়ী প্রেমিক গ্রহণ করার অধিকার ছিল। অতিথি এবং বন্ধুর নিকট নিজের স্ত্রীকে সেবা করতে পাঠানো তখন সর্বমান্য সদাচার বলে গণ্য হত। তাই আজ সোমা ঋজ্রের।

সন্ধ্যায় গ্রামের নরনারী মহাপিতরের বিস্তৃত আঙ্গিনায় জড়ো হল। সোমা মধু সুরা এবং সুস্বাদু গো-অশ্ব মাংস নিয়ে ‍যাচ্ছিল। মহাপিতরের পুত্রের আজ জন্ম উৎসব। কৃচ্ছ্র নিজে বেসামাল অবস্থায় ছিল তাই তার বদলে সোমা এবং ঋশ্ব উপস্থিত ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত গান, গীত, নৃত্য করে মহোৎসব হল। সোমার গান এবং ঋশ্বের নৃত্য কুরু-জন সর্বদাই ভালোবাসত।

 

 ‘‘মধুরা! ‍তুমি ক্লান্ত হওনি তো?ৎৎ

‘‘না, আমি ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসি।’’

‘‘কিন্তু সেই দস্যুরা তোমাকে কি খারাপভাবে আটক করেছিল?’’

‘‘হ্যাঁ, বাহলীকরা পক্থদের শুধু গরু এবং ঘোড়াই নয় পরন্তু তারা মেয়েদেরও লুট করতে এসেছিল।’’

‘‘হ্যাঁ, পশু-লুণ্ঠন দুটি‘জন’- এর মধ্যে চিরস্থায়ী শত্রুতার সৃষ্টি করে। কিন্তু কন্যা লুট করলে শত্রুতা ক্ষণস্থায়ী হয়, কারণ শেষ পর্যন্ত শ্বশুড়কে জামাতার সমাদর করতেই হয়।’’

‘‘কিন্তু তোমার নাম আমার মনে নেই।’’

‘‘অমৃতাশ্ব; কৃ্চ্ছ্রাশ্ব-পুত্র, কৌরব।’’

‘‘কৌরব! কুরু আমার মামার কুল।’’

‘‘মধুরা এখন তুমি নিরাপদ। বল—কোথায় যাবে?’’

মধুরার মুখে আনন্দের রেখা ফুটে উঠে অচিরেই বিলীন হয়ে গেল দেখে অমৃতাশ্ব কথার মোড় ঘুরিয়ে বলল, ‘‘অতীতে পক্থদের কন্যারা আমাদের গাঁয়েও এসেছে।’’

‘‘সমস্তই লুট করে তো?’’

‘‘না, তাদের ভেতর অধিকসংখ্যক মাতুল কন্যা ছিল।’’

‘‘তা‘হলেও মেয়েদের লুট-পাট করা আমার খুব খারাপ লাগে।’’

‘‘আর আমিও এটা খারাপ মনে করি, মধুরা! বিশেষ করে যেখানে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে প্রেমের সম্ভাবনা আছে কি-না—আমার জানা নেই।’’

‘‘মাতুল কন্যা বিয়ে করা এর চেয়ে ভালো। কেন না তা‘হলে প্রথম হতেই পরিচিত হওয়ার সুযোগ মেলে।

‘‘তোমার এ রকম কোন প্রেমিক ছিল না-কি, মধুরা?’’

‘‘না, আমার কোন পিসীমা নেই।’’

‘‘অন্য কোন লোক?’’

‘‘স্থায়ীভাবে নয়।’’

‘‘তুমি কি আমাকে ভাগ্যবান করতে পার?’’

মধুরার সলজ্জ দৃষ্টি নত হয়ে গেল। অমৃতাশ্ব বলল, ‘‘মধুরা! এ রকম জনপদও আছে যেখানে স্ত্রী অন্যের নয়, নিজের।’’

‘‘তোমার কথা বুঝলাম না, অমৃতাশ্ব!’’

‘‘স্ত্রীলোককে কেউ লুট করে না কিম্বা স্থায়ী পত্মী করে রাখতে পারে না, সেখানে স্ত্রী পুরুষ সবাই সমান।’’

‘‘পুরুষের মতো মেয়েরাও সমানে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে?’’

‘‘হ্যাঁ, স্ত্রীর সে স্বাধীনতা আছে।’’

‘‘কোথায় সে ‘জনপদ’ অমৃতাশ্ব—অঃঅমৃতাশ্ব!’’

‘‘তুমি আমায় অমৃত বল মধুরা! সে ‘জনপদ’ পশ্চিমে, এখান থেকে অনেক দূরে!’’

‘‘অমৃত, ‍তুমি কি সেখানে গিয়েছ?’’

‘‘হ্যাঁ, সেখানে নারী আজীবন স্বাধীনভাবে থাকে, যে রকম জঙ্গলে মৃগ স্বতন্ত্র বিচরণ করে, পাখি গাছে গাছে স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়।’’

‘‘নিশ্চয়ই খুব সুন্দর‘জনপদ’? সেখানে কেউ মেয়েদের লুট করে না তো?’’

‘‘স্বাধীন! বাঘিনীকে জীবন্ত কে লুট করতে পারে?’’

‘‘আর পুরুষ, অমৃত?’’

‘‘পুরুষ ও স্বাধীন।’’

‘‘ছেলে মেয়েরা?’’

‘‘মধুরা সেখানকার সংসার অন্য রকমের—সমস্ত গ্রাম নিয়ে একটি পরিবার।’’

‘‘সেখানে পিতার কর্তব্য কি?’’

‘‘পিতা কে তা বলা যায় না। সেখানে নারী পত্মী নয়, স্বচ্ছন্দ তার প্রেম।’’

‘‘তা‘হলে সেখানে কেউ পিতাকে জানে না?’’

‘‘ঘরের সমস্ত পুরুষই পিতা।’’

‘‘এ কেমন প্রথা?’’

‘‘এ জন্যই সেখানে নারী স্বতন্ত্র, তারা যোদ্ধা, শিকারী!’’

‘‘আর গরু-ঘোড়া পালনের কি ব্যবস্থা?’’

‘‘গরু-ঘোড়া জঙ্গলে থাকে, যেভাবে এখানে থাকে হরিণ।’’

‘‘আর ছাগল, ভেড়া?’’

‘‘সেখানকার মানুষ পশুপালন জানে না। শিকার,মাছ এবং জঙ্গলের ফলমূল খেয়ে দিন কাটায়।’’

‘‘শুধু শিকার! তাহলে কি তাদের দুধ জোটে না?’’

‘‘জোটে শুধু মানুষের দুধ, তাও আবার শৈশবেই।’’

‘‘ঘোড়ায় চড়ে না?’’

‘‘না। আর চামড়া ছাড়া তারা অন্য কিছু পরিধেয়ও জানে না।’’

‘‘তারা নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পায়?’’

‘‘তা‘হলেও সেখানকার স্ত্রীলোকেরা স্বাধীন। পুরুষের মতোই তারা ফল সংগ্রহ করে, শিকার কলে, যুদ্ধের সময় শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করে।’’

‘‘আমিও এ জিনিষ পছন্দ করি। আমি অস্ত্র চালাতে শিখেছি কিন্তু পুরুষের মতো যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ কোথায়?’’

‘‘পুরুষরা এ কাজ নিজ হস্তে গ্রহণ করেছে। গরু,ঘোড়া, ছাগল, ভেড়া তারা পালন করে; তারা স্ত্রীকে পশু-পত্মী নয়, গৃহপত্মী করেছে।’’

‘‘আর মেয়েদের লুট্ করার উপযুক্ত করে তৈরী করেছে। সেখানে মেয়েদের লুট করা হয় নাত তো, অমৃত!’’

‘‘একটি ‘জন’-এর ছেলেমেয়েরা সর্বদাই সেই জনের ভেতর থাকে। ‘জন’-এর বাইরে যেতে দেওয়া হয় না, গ্রহণ করাও হয় না।’’

‘‘এ কি রকম প্রথা?’’

‘‘সে সব এখানে চলতে পারে না।’’

‘‘তাই বলে মেয়ে লুট চলতে থাকবে?’’

‘‘হ্যাঁ, মধুরা! আচ্ছা, তখন তুমি কি বলছিলে যেন?’’

‘‘কোন বিষয়?’’

‘‘আমার প্রেম সম্বন্ধে।’’

‘‘আমি তোমার বশীভূত, অমৃত!’’

‘‘কিন্তু আমি তোমাকে লুট করে নিয়ে যেতে চাই না।’’

‘‘তুমি কি আমাকে যুদ্ধ করতে দেবে?’’

‘‘যতদূর পর্যন্ত আমার পক্ষে সম্ভব।’’

‘‘আর শিকার করতে?’’

‘‘যতদূর আমার ক্ষমতা আছে।’’

‘‘ব্যাস এটু্কুই…?’’

‘‘কেন না আমাকে মহাপিতরের আদেশ পালন করতে হবে। নিজের দিক থেকে যদি বল মধুরা—আমি তোমাকে স্বাধীন মনে করব।’’

‘‘প্রেম করা না করার জন্যও?’’

‘‘প্রেম আমাদের সম্বন্ধ স্থাপন করছে। আচ্ছা তার জন্যেও।’’

‘‘তবে অমৃত, আমি তোমার প্রেম গ্রহণ করছি।’’

‘‘তা‘হলে আমরা কুরু‘জনে’ চলে যাব না-কি পক্থ ‘জনে’?’’

‘যেখানে তোমার খুশি।’’

অমৃত ঘোড়া ফিরিয়ে মধুরার নির্দেশিত পথে পক্থ গ্রামে পৌছাল। গ্রামে কোনো তাঁবুতে কেউবা মারা গিয়েছে;কেউ জখম হয়েছে, কারুর কন্যা লুণ্ঠিত হয়েছে। চারিদিকে হল্লা হচ্ছিল।

মধুরার মা কাঁদছিল এবং বাবা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। এ সময় অমৃতাশ্বর ঘোড়া গিয়ে গিয়ে তাদের তাঁবুর বাইরে দাঁড়াল।

অমৃতাশ্ব নীচে নামার পর মধুরা লাফিয়ে পড়ল এবং অমৃতাশ্বকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে গেল। হঠাৎ একাকী কন্যাকে দেখে বাপ মা প্রথমটায় বিশ্বাস করতে পারল না। মা তাকে জড়িয়ে ধরল তার চোখের জলে মেয়ের মুখ ভেসে যেতে লাগল। মা শান্ত হলে, বাবার প্রশ্নের উত্তরে মধুরা বলল, ‘‘বাহলীকরা পক্থ কন্যাদের লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমাকে লুট করে যে নিয়ে যাচ্ছিল সে একটু পিছিয়ে পড়েছিল। সেই সুযোগে আমি ঘোড়া থেকে লাফিয়ে পড়ি। ঠিক সে সময় একটি তরুণ অশ্বারোহী এসে উপস্থিত হল, সে বাহলীককে যুদ্ধে আহবান করে জখম করে মাটিতে ফেলে দিল। সেই কুরু তরুণ আমাকে এখানে পৌছিয়ে দিতে এনেছে।’’

পিতা বলল, ‘‘সেই কুরু তরুণ তোমাকে নিয়ে যেতে চাইল না?’’

‘‘বলপূর্বক নয়।’’

‘‘কিন্তু আমাদের জনপদের নিয়ম অনুসারে ‍তুমি তার।’’

‘‘বাবা, আমি তাকে ভালোবাসি!’’

মধুরার পিতা বাইরে এসে অমৃতাশ্বকে অর্ভ্যথনা করে তাকে তাঁবুর ভেতর নিয়ে গেল।গ্রামবাসীরা সব কথা শুনে আশ্চর্য বোধ করল। সকলের সম্মান ও সহানুভুতির মধ্যে অমৃতাশ্ব মধুরাকে সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিল।

 

অমৃতাশ্ব তখন নিজ কুরু-গ্রামের মহাপিতর। তার পঞ্চাশশাধিক অশ্ব, গরু ও অনেকগুলি ছাগল আর ভেড়া ছিল। তার চার ছেলে  ও মধুরা পশুপালন এবং গৃহকাজ করত। গ্রামের দরিদ্রশ্রেণীর কিছু লোকও তার ওখানে কাজ করত। তবে ভৃত্যের মতো নয়, আপন লোকের মতোই। একজন কুরুকে আর একজন কুরুর সমতা স্বীকার করতে হত। অমৃতাশ্ব যে সব গ্রামে চলাফেরা করত সে সব গ্রামে পঞ্চাশটির অধিক পরিবার বাস করত। তাকে তাদের ঝগড়ার আপোষ এবং মামলার বিচার করতে হত। যুদ্ধ—যা প্রায়ই ঘটত তাতে মহাপিতরকে সৈন্যদলের প্রধানের কাজ করতে হত। বস্তুত, যুদ্ধে সফলতা লাভ করলেই সে সময় মানুষ মহাপিতরের পদ লাভ করত। অমৃতাশ্ব বড় যোদ্ধা ছিল। পক্থ, বাহলীক ও অন্যান্য জনের সঙ্গে যুদ্ধে সে নিজের বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। মধুরাকে সে যে কথা দিয়েছিল তা পালন করেছিল। মধুরা অমৃতাশ্বের সঙ্গে শুয়োর, বাঘ শিকারই শুধু করত না, যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করত। যদিও কেউ কেউ এ সব পছন্দ করত না—তারা বলত স্ত্রীলোকের কাজ হল ঘরে।

অমৃতাশ্বকে প্রথম যেদিন মহাপিতর নির্বাচন করা হয় সেদিন কুরু-পুরে মহোৎসব পালন করা হল। সেদিন তরুণ-তরুণীরা অস্থায়ী প্রণয় বন্ধনে আবদ্ধ হল। গ্রীষ্মের দিনে নদীর উপত্যাকার এবং পাহাড়ের ওপরে গরু, ঘোড়ার পাল মনের সুখে বিচরণ করছিল।গ্রামবাসীরা ভুলেই গেল যে তাদেরও শত্রু আছে। পশু-ধন হতেই তাদের শত্রু সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। কুরুজন ভোল্‌গার তীরে যে যুগে বাস করত, তখন তাদের নিকট পশু ধন ছিল না। তাদের জঙ্গল থেকে আহার্য সংগ্রহ করতে হত। শিকার, মধু কিংবা ফল না পেলে তারা অনাহারে থাকত। আর এখন! কুরুগণ আহারের জন্য কিছু পশু, গরু, ঘোড়া, ছাগল, গাধা ইত্যাদি স্থায়ীভাবে রাখে। তাদের শুধু মাংস, দুধ, চামড়াই নয় এই পশুগুলো পশমের বস্ত্র পর্যন্ত সরবরাহ করে। কুরু স্ত্রীগণ সুতো কাটতে আর কম্বল বুনতে কুশলী! তাদের কুশলতা সমাজে বেশীদিন পূর্বসম্মান অধিকার করে থাকতে পারল না। এখন স্ত্রীর নয় পুরুষের রাজ্য। পুরুষ শাসিত সমাজে সম্পদের অধিকার, সামাজিক ব্যবস্থা অনেক বদলে গেল। স্ত্রীর রাজ্যে যেখানে একাধিক পরিবার একত্রে বাস করত, একসঙ্গে কাজ করত, সেখানে আজকের ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের, ভিন্ন ভিন্ন পশু-সম্পদ এবং ভিন্ন ভিন্ন লাভ লোকসান। হ্যাঁ, সকলের বিপদের সময় ‘জন’ আবার পুরনো ‘জন’-এ রুপ নিত।

অমৃতাশ্ব মহাপিতর নির্বাচিত হল। মহাপিতরের মহোৎসবে মত্ত ‘জন’-এর লোকেরা নিজেদের পশু-ধনের প্রতি কোনো নজর রাখল না। বাদ্যের শব্দে নৃত্যপর তরুণরা কেবল সোম-সুরা এবং সুন্দরী তরুণীদের কথাই মনে করতে পারত। এক প্রহর রাত আর বাকি কিন্তু নৃত্যগীত তখনও বন্ধ হওয়ার কোনো উপক্রম নেই। ঠিক সেই সময় চারদিক থেকে কুকুরগুলিকে জোরে চীৎকার করতে করতে উপত্যকার ওপরের দিকে ছুটতে দেখা গেল। অমৃতাশ্ব পরিমিত সোম পান করত, আর তাতেই আনন্দ পেত। চোখে লাল রঙ ফুটে ওঠে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে বেহুঁস হয়ে পড়ে না। কুকুরগুলির ডাক শুনে সে উঠে দাঁড়াল। কাঠের হাতলযুক্ত নিজের পাষাণ মুদগর বাগিয়ে নিল এবং নদীর যেদিক হতে শব্দ আসছিল সেদিক চলতে শুরু করল। সামান্য অগ্রসর হওয়ার পর অস্তগামী চাঁদের আলোতে একটি স্ত্রীলোককে আসতে দেখা গেল। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। মূর্তি, নিকটবর্তী হলে দেখা গেল—সে মধুরা। মধুরা তখনও ঘন-ঘন শ্বাস নিচ্ছিল, সে উত্তেজিত স্বরে বলল,‘‘পুরুরা আমাদের পশুগুলিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে!’’

‘‘তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে? আর আমাদের ছেলেরা নেশায় চুর! তুমি কতদূর ওদের পেছনে পেছনে গিয়েছিলে, মধুরা?’’

‘‘একেবারে কাছে নয়—যতদূর থেকে দেখা যায় সেই পর্যন্ত।

‘‘আমাদের সমস্ত পশু নিয়ে যাচ্ছে?’’

‘‘ওদের দেখে মনে হল—চারিদিকে ছড়ানো পশুদের একত্র করে নিয়ে যাচ্ছে।’’

‘‘তুমি কি মনে করছ, মধুরা?’’

‘‘দেরী করবার আর সময় নেই।’’

‘‘কিন্তু আমাদের সব ছেলরা নেশায় মত্ত!’’

‘‘যারা চলতে সক্ষম তাদের নিয়ে এখনই আক্রমণ করা চাই।’’

‘‘হ্যাঁ, ঠিক কথা; কিন্তু, মধুরা, আমার সঙ্গে তোমার যাওয়া উচিৎ নয়। এই খবরেই অর্ধেক লোকের নেশা কেটে যাবে এবং বাকি লোকদের দই খাওয়াতে হবে। যখনই যার নেশা কেটে যাবে তখনই তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো চাই।’’

‘‘আর কুরু মেয়েরা?’’

‘‘আমি কুরুদের মহাপিতর হিসাবে এই আদেশ দিচ্ছি, তারাও যুদ্ধক্ষেত্রে যাক! সেই প্র্রাচীন প্রথাকে আবার আমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে।’’

‘‘আমি আগে যাবার চেষ্টা করব না; তবে তাড়াতাড়িই কাজ সারতে হবে।’’

মহাপিতরের আদেশে বাজনা একদম বন্ধ হল। নর-নারী মহাপিতরের চারিদিকে জড়ো হল। সত্যি-সত্যিই গো-অশ্ব চুরির কথা শুনে তাদের মধ্যে অনেকের নেশা কেটে গেল। তাদের চেহারায় প্রণযের কোমলভাব কেটে গিয়ে বীরভাব প্রকাশ পেল, মহাপিতর মেঘগম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘‘কুরু নর-নারীগণ! পুরু শত্রুর কাছ থেকে আমাদের সম্পদ ছিনিয়ে নিতে হবে। তোমাদের মধ্যে যাদের চেতনা আছে, নিজ নিজ হাতিয়ার নিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার হও এবং আমাকে অনুসরণ কর, যারা নেশায় এখনও নিঝুম হয়ে আছ তারা মধুরার কাছ থেকে দই নিয়ে খাও আর নেশা কাটার সঙ্গে সঙ্গে চলে এস। কুরুনারীগণ! আজ তোমাদেরও যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে নির্দেশ দিচ্ছি। প্রাচীন কালের কুরু রমনীগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত—এ কথা আমরা বৃদ্ধদের কাছে শুনেছি। আজ তোমাদের মহাপিতর অমৃতাশ্ব তোমাদের এই আদেশ দিচ্ছে।’’

মূহুর্তে মধ্যে চল্লিশটি ঘোড়া সংগ্রহ হল। পুরুরা যতগুলি পশু জড়ো করতে পেরেছিল তা‘ তারা উপত্যকার অপর পারে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। পুরো দু‘ঘণ্টা্ পশ্চাৎধাবনের পর ঊষার আলো ফোটার সময় কুরুগণ তাদের দেখতে পেল। ঘোড়া আর গরুর দল-গুলিকে একত্রিত একটি পাহাড়ের ওপর তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াটা সহজ কাজ ছিল না। পুরু অশ্বারোহীগণ তাদের চামড়ার চাবুক বাতাস এবং পাথরের ওপর আঘাত করে ভয়াতুর করছিল। অমৃতাশ্ব দেখল যে, পুরুরা সংখ্যায় প্রায় শ‘খানেক হবে। মাত্র চল্লিশটি ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধ শুরু করা উচিত কি অনুচিত তা নিয়ে বেশীক্ষণ অযথা মাথা ঘামাতে চাইল না। শিংয়ের লম্বা ভল্ল বাগিয়ে অমৃতাশ্ব শত্রুর ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিল। কুরু বীর এবং বীরাঙ্গণাগণ সম্মুখে ঘোড়া ছোটাল। তাদের দেখা মাত্রই পুরুরা কিছু লোককে পশুগুলিকে আটকিয়ে রাখবার জন্যে ছেড়ে দিল। পুরুগণ নীচের দিকে ছূটতে লাগল্ এবং ঘোড়ার পুরো সুযোগ গ্রহণের জন্য নদী তীরের একটি উন্মুক্ত মাঠে দাঁড়িয়ে কুরুদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অমৃতাশ্বের সে মূর্তি তখন সত্যিই দেখবার মতো । অমৃতাশ্বের ঘোড়া অমৃত, এখন দু‘জনকেই অভিন্ন মনে হচ্ছিল। তার হরিণের সুতীক্ষ্ণ ভল্ল একবার যার শরীরে লাগত, দ্বিতীয় আঘাতের জন্য তাকে ঘোড়ার ওপর বসে থাকতে হত না। পুরুগণ ধর্নুবাণ ও পাষাণ-পরশুর ওপর বেশী নির্ভর করে ভুল করেছিল। যদি তাদের কাছে অত শিংয়ের ভল্ল থাকত তা‘হলে নিশ্চয়ই কুরুরা তাদের মোকাবিলা করতে পারত না। যুদ্ধ এক ঘণ্টা চলছে, পুরুগণ তখনও সংগ্রাম করছিল। কিন্তু তাদের এক তৃতীয়াংশ যোদ্ধা হতাহত হয়েছে, এটাই হল ভয়ের কারণ। ঠিক এই সময় ত্রিশজন কুরু অশ্বারোহী যুদ্ধক্ষেত্রে এসে হাজির হল। কুরুদের সাহস অনেক বেড়ে গেল। পুরুগণ ভয়ানকভাবে প্রাণ হারাতে লাগল। নিজেদের অবস্থা খারাপ দেখে যে অশ্বারোহীদের লুণ্ঠিত পশুগুলিকে আগ্‌লাবার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তারাও এসে হাজির হল কিন্তু ঠিক এই সময়ে চল্লিশ জনের একটি কুরু নারীর দল নিয়ে মধুরা এসে যুদ্ধে যোগ দিল; দেড় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হল। অধিকাংশ পুরু হতাহত হল আর কিছু পালিয়ে গেল। আহতদের শেষ করে কুরুবাহিনী পুরুদের গ্রামের দিকে এগিয়ে গেল। গ্রাম চার ক্রোশের ওপর! সমস্ত গ্রাম জনশূণ্য। লোকজন তাঁবু ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। তাদের পশুগুলো এখানে-ওখানে বিচরণ করছে। সর্বপ্রথম কুরুদের বোঝাপড়া করতে হবে পুরুদের সঙ্গে। পুরুগণ বিপন্ন হল চারিদিক থেকে ঘেরাও হয়ে। উত্তরের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সুবিধেও ছিল না। উপত্যকা ক্রমশ:ই সঙ্কীর্ণ হয়েছে আর চড়াইও ছিল খুব কষ্টকর। তবু প্রাণের দায়ে নর-নারী ঘোড়ায় করে পালাচ্ছিল। অবশেষে এমন জায়গায় গিয়ে পৌছাল যে ঘোড়া আর সামনের দিকে চলতে পারে না। লোকজন পায়ে হেঁটে চলতে লাগল। কুরুগণ তাদের খুব কাছে এসে পড়ল। বৃদ্ধ, স্ত্রী ও শিশুরা তাড়াতাড়ি এগুতে পারছিল না, তাই তাদের পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবার জন্য কিছু পুরু যোদ্ধা একটি সঙ্কীর্ণ জায়গায় দাঁড়াল। কুরুরা তাদের সমস্ত শক্তি কাজে লাগাতে পারছিল না। এ জন্যই পুরুদের হাত থেকে রাস্তা উন্মুক্ত করতে কয়েক দিন সময় লাগল। পুরু এবং কুরু উভয় দলই পায়ে হেঁটে আসছিল। কিন্তু পুরুদের ভেতর পুরুষের সংখ্যা দশ-বার জনের বেশী ছিল না। একদিন কিছু সাহসী স্ত্রীলোকদের সঙ্গে নিয়ে একটি দুরূহ পথ ধরে ওই উপত্যকা ত্যাগ করল এবং পাহাড় পেরিয়ে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেল। পুরুদের শিশু, বৃদ্ধ ও স্ত্রীলোকেরা প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিল—কুরুরা শেষ পর্যন্ত তাদের পাকড়াও করল। বন্দী করে রাখা তখনকার পিতৃতান্ত্রিক যুগের আইন-বিরুদ্ধ কাজ ছিল। তাই শিশু থেকে আরম্ভ করে সমস্ত পুরুকুলকে তারা মেরে ফেলল এবং স্ত্রীগণকে সঙ্গে নিয়ে গেল। পুরুদের সমস্ত পশু-ধনও তারা করায়ত্ত করল। এখন সেই হরিৎ নদীর উপত্যকায় নীচ থেকে ওপর পর্যন্ত কুরুদে চারণভূমি। এক পুরুষ পর্যন্ত মহাপিতর একাধিক পত্নী গ্রহণ করবার বিধান দিলেন এবং এই সময় কুরুদের ভেতর সর্বপ্রথম সপত্নী দেখা গেল।

 

 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *